motaherabanu

My Writings


এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান >

বাংলা বিভাগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ঢাকা

ফেব্রয়ারী ২০০৫ ইং।

 

পিএইচ. ডি. ডিগ্রীর জন্যে লেখা গবেষণা অভিসন্দর্ভ।

বিশ শতকের

বিশ শতকের প্রথম চার দশকের

বাংলা শিশুসাহিত্যের পরিপ্রেক্ষিতে                                                                                 বাংলা শিশু সাহিত্যের পরিপ্রেক্ষিবোংলা শিশু সাহিত্যের পরিপ্রেক্ষিতে

কাজী নজরুল ইসলামের শিশুসাহিত্য

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নথিভুক্ত নম্বর :

জই

৮৯১. ৪৪

ইঅই

১৯৯৬

 

িশশুসাহিত্যের পরিপ্রেক্ষিতে কাজী

জই           নজরুল ইসলামের শিশুসাহিত্য (পিএইচ. ডি. গবেষণা অভিসন্দর্ভ সৈয়দা মোতাহেরা বানুঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নথিভুক্ত নম্বর :জই

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

অভিসন্দর্ভটি  নজরুল ইন্সটিটিউট। বাড়ী-৩৩০বি, রোড-২৮ (পুরাতন) ধানমন্ডি, ঢাকা-১২০৯ হতে নি¤œলিখিত শিরোনামে প্রকাশিত

 

সমকালীন শিশুসাহিত্য ও কাজী নজরুল ইসলাম

 

সৈয়দা মোতাহেরা  বানু

 

 

সূচীপত্র

।। বিশ শতকের প্রথম চার দশকের বাংলা শিশুসাহিত্যের পরিপ্রেক্ষিতে কাজী নজরুল ইসলামের শিশুসাহিত্য ।।

বিষয় :                                                                                                                                                                                       পৃষ্ঠা

 

১.  ভূমিকা :

ক)  বিশ শতকের প্রথম চার দশকের উপমহাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট।

খ)  বিশ শতকের প্রথম চার দশকের বাংলা শিশুসাহিত্যের অবস্থান।

গ) বিশ শতকের প্রথম চার দশকের বাংলা শিশুসাহিত্যিকদের রাজনৈতিক, সামাজিক প্রভাব

ও শিশুসাহিত্যে তার প্রতিফলন।

 

২.  প্রথম পরিচ্ছেদ : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিশুসাহিত্য (১৮৬১-১৯৪১)।                                                                                ১৪

 

৩.  দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ : উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীর শিশুসাহিত্য (১৮৬৩-১৯১৫)।                                                                ২৪

 

৪.  তৃতীয় পরিচ্ছেদ : অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিশুসাহিত্য (১৮৭১-১৯৫১)।                                                                            ৩৩

 

৫.  চতুর্থ পরিচ্ছেদ : দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের শিশুসাহিত্য (১৮৭৭-১৯৫৭)।                                                  ৪১

 

৬.  পঞ্চম পরিচ্ছেদ : সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের শিশুসাহিত্য (১৮৮২-১৯২২)।                                                                              ৪৮

 

৭.  ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ : সুকুমার রায়ের শিশুসাহিত্য (১৮৮৭-১৯২৩)।                                                                                       ৫৯

 

৮.  সপ্তম পরিচ্ছেদ : সুনির্মল বসুর শিশুসাহিত্য (১৯০২ – ১৯৫৭)।                                                                                     ৬৯

 

৯.  অষ্টম পরিচ্ছেদ : কাজী নজরুল ইসলামের শিশুসাহিত্য (১৮৯৯-১৯৭৬)।                                                                      ৭৭

 

১০. উপসংহার :                                                                                                                                                                         ৯৪

 

১১. পরিশিষ্ট :                                                                                                                                                                             ৯৯

 

১২. সহায়ক গ্রন্থপঞ্জী :                                                                                                                                                  ১০৭

 

 

 

 

 

ভূমিকা

 

ক) বিশ শতকের প্রথম চার দশকের উপমহাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট :

 

ইংরেজ শাসনের নিগড়ে বাঁধা ভারতবর্ষের প্রায় দু’শত বছরের (১৭৫৭-১৯৪৭) রাজনৈতিক ইতিহাসে বিশ শতকের প্রথমার্ধের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট ছিল সবচাইতে উর্মিমুখর। এই সময় নানা সমস্যা ও সংকট বাঙলা তথা ভারতবর্ষকে জর্জরিত করেছিল। উদ্ভূত সমস্যাগুলি বহুল পরিমানে পৃথিবীর অন্যান্য দেশÑবিশেষতঃ ইউরোপ দ্বারা প্রত্যক্ষ এবং অন্যান্য দেশের ঘটনাবলী দ্বারা পরোক্ষভাবে প্রভাবিত হয়েছিল। বিজ্ঞানের অভাবিত উন্নতির ফলে এদেশ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সঙ্গে নানা ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের সূত্রে তখন আবদ্ধ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পূর্ব এবং দুই বিশ্বযুদ্ধ অন্তর্বর্তীকালীন সভ্যতার সমস্যা ও সংকট মানুষের জীবনেও পরিস্ফুট হয়েছিল।

বিশ শতকে বৃটিশ শাসনে ভারতে নতুন আর্থ-সামাজিক কাঠামো গঠিত হওয়ার ফলে ভারতের সমাজে কৃষক ও জমিদারের মধ্যে সংঘাত ব্যাপক আকার ধারণ করে। পূর্র্বেই শিল্পায়নের ফলে পুঁজিপতি শ্রেণী ও শ্রমিক শ্রেণীর উন্মেষ ঘটে ও শ্রেণী বৈষম্য ক্রমশঃ পরিস্ফুট হতে থাকে, বিশ শতকে তা আরও তীব্র আকার ধারণ করে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ও খাদ্যদ্রব্যের মূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পায়। দৈনিক কাজের সময় হ্রাস, বেতন বৃদ্ধি ও ইউরোপীয় কর্তৃপক্ষের বর্ণবৈষম্যমূলক অত্যাচার থেকে অব্যাহতি প্রভৃতির দাবীতে এইসময় স্বতস্ফূর্ত শ্রমিক ধর্মঘট পালিত হয়। ১৯০৫ সাল পর্যন্ত অনেক শিল্প কারখানা  প্রতিষ্ঠিত হলেও মুসলমানরা মিল মালিক ছিলেন না, তাঁরা ছিলেন চাকুরিজীবী, কেরানী বা কৃষক। বৃটিশ পণ্য বর্জনের অর্থ ছিল হিন্দু মিল-মালিকের মুনাফা বৃদ্ধি।

বিশ শতকের প্রথম থেকে এদেশের মধ্যবিত্ত, শ্রমিক ও কৃষক সমাজ নিজেদের দাবি-দাওয়া সম্পর্কে সচেতন হতে থাকে। প্রথম মহাযুদ্ধের আগে উগ্র জাতীয়তাবাদের প্রচার এবং যুদ্ধোত্তর কালে সাম্যবাদী ভাবধারার প্রসারে জনসমাজের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি পায়। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী রাজশক্তির শাসন-কাঠামোর ভিতরে জন-সমাজের অভাব অভিযোগ দূর করার ব্যবস্থা সীমাবদ্ধ। তার উপর যুদ্ধোত্তর পৃথিবীর দারুণ ডিপ্রেশনের প্রভাবে এদেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সঙ্কটাপন্ন হয়ে উঠে। ফলে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ, ধর্মঘট প্রভৃতির মধ্য দিয়ে জনমতের বিক্ষোভ আত্মপ্রকাশ করতে থাকে। পাশ্চাত্ত্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের সঙ্গে পরিচিত হওয়ায় নৈতিক ও মানসিক জগতেও নানা পরিবর্তনের সূচনা হয়। বহুকালের নিষিদ্ধ ও অবদমিত যৌনভাব ও ধারনা শিল্প, সাহিত্য ও সঙ্গীত প্রভৃতির ক্ষেত্রে নির্বাকভাবে রূপায়িত হতে থাকে। ফলে অনেক ক্ষেত্রে জাতীয় চরিত্রে একটা নৈতিক দোটানার ভাব দেখা দেয়। ভাববাদের সঙ্গে বাস্তববাদের এই দ্বন্দ্বে সাংস্কৃতিক জীবনে নতুন সমস্যার সৃষ্টি হয়। জীবন সম্পর্কে এক গভীর অতৃপ্তি ও হতাশার ছায়া সর্বত্র তখন পরিস্ফুট। পরিবার, শ্রেণী ও সমাজের অভ্যন্তরে অবক্ষয়ের চিহ্ন স্পষ্ট হতে থাকে। এদেশীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে বিদেশী ভাব ও চিন্তাধারার সংঘর্ষে জাতীয় জীবনে ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়।

বিশ্বের ইতিহাসে এসময় একটি বিপর্যয় ঘটে। পাশ্চাত্যের প্রচন্ড শক্তিধর জার শাসিত রাশিয়া এশিয়ার ক্ষুদ্র শক্তি জাপানের কাছে পরাজিত হয়। শ্বেত সাম্রাজ্যের এই অভাবনীয় পরাজয় চরমপন্থীদের মধ্যে প্রবল উদ্দীপনার সঞ্চার করে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের উপর চরম আঘাত হানার প্রস্তুতি শুরু হয় উনিশ শতকের শেষভাগে সন্ত্রাসবাদীদের ভিতর। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তা সুস্পষ্ট আকার ধারণ করে। কংগ্রেসের চরমপন্থীরা বালগঙ্গাধর তিলকের ব্যবহৃত স্বরাজ’ কথাটির প্রতিধ্বনি তুললে, স্বরাজ ভারতের জন্মগত অধিকার এই দাবী জানান হয়। স্বরাজ, স্বদেশী, বয়কট হল তাদের কর্মসূচী। ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর বাংলা বিভক্তির পূর্ব পর্যন্ত বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যা ছিল একই গভর্নরের শাসনাধীন ব্রিটিশ ভারতের একটি প্রদেশ। ইংরেজ সরকার অনেকদিন থেকেই শাসনকার্যে সুবিধার যুক্তিতে প্রদেশটিকে বিভক্ত করার পরিকল্পনা গ্রহন করে। অবশেষে গভর্নর জেনারেল লর্ড কার্জন ১৯০৫ সালে পূর্ববঙ্গ ও আসামকে যুক্ত করে একটি প্রদেশ গঠনের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। ঢাকা হয় এই প্রদেশের রাজধানী এবং কলকাতা থেকে যায় পশ্চিম বঙ্গের রাজধানী। ভারতবর্ষের রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লীতে স্থানান্তরিত হয়। সারা বাংলার হিন্দুগন এর বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। হিন্দুদের বক্তব্য ছিল যে, তাদের বিভক্ত করে দুর্বল করার উদ্দেশ্যেই বাংলাকে দ্বিখন্ডিত করা হয়। অপরদিকে মুসলমান প্রধান পূর্ববঙ্গের অনেকের মনে এই ধারণা স্থান পায় যে, নতুন প্রদেশে মুসলমানদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হবে, উন্নতি ত্বরান্বিত হবে এবং পূর্ববঙ্গ কলকাতার অধীন একটি সেবাদানকারী পশ্চাৎভুমি হয়ে থাকবে না। কিন্তু হিন্দু প্রাধান্যে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন যখন দ্রুত প্রসার লাভ করতে থাকে, তখন তাতে এসে যোগ হয় ’বিপ্লববাদী’ সন্ত্রাসী কর্মকান্ড। এ দলগুলির উদ্দেশ্য ছিল সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন। বিভিন্ন স্থানে ইংরেজ প্রশাসক ও তাদের এদেশীয় অনুগতদের ওপর সন্ত্রাসী আক্রমন ও হত্যাকান্ড চলতে থাকে। সরকার আন্দোলন দমনে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এ প্রেক্ষিতে ক্ষুদিরামের ফাঁসি সর্বত্র উত্তাপ ছড়িয়ে দেয়। অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটতে থাকে। মুসলিম স্বার্থ সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে ভারতীয় মুসলমানদের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ’মুসলিম লীগে’র জন্ম (১৯০৬) হয় ঢাকায়। কিন্তু তার প্রথম অধিবেশনেও হাসান ইমাম ও মজহারুল হক-এর ন্যায় জাতীয়তাবাদী নেতারা যোগ দেন না। পরে লীগ রাজনৈতিক ক্ষেত্রে হাজির হয়। শিক্ষাপ্রসার ও বেকারত্ব বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে  মুসলমান সমাজে রাজনৈতিক সচেতনতা দ্রুত সঞ্চারিত হতে থাকে।

কংগ্রেসের (১৮৮৫) জন্মের একুশ বছর পর ’মুসলিম লীগে’র জন্মের প্রাক্কালেও নব জাতীয়তাবোধের বদলে ধর্মের বন্ধন দৃঢ় করার নীতিই বলবৎ থাকে। চাকুরীক্ষেত্রে মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব ও বিশেষ সুবিধার দাবী ওঠে এবং লীগের ঐকান্তিক চেষ্টায় ১৯০৯ সালের ’মর্লে-মিন্টো রিফর্মে’ মুসলমানদের স্বতন্ত্র নির্বাচনের ব্যবস্থা হয়। দমননীতি, সাম্প্রদায়িক বিক্ষোভ ও অভ্যন্তরীণ  দুর্বলতার জন্য স্বদেশী  আন্দোলন পরিপূর্ণ সাফল্য লাভ করে না।

হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতি অচিরকালের মধ্যেই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। কিছুসংখ্যক প্রভাবশালী মুসলিম নেতৃবৃন্দ ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠীর প্ররোচনায় সক্রিয়ভাবে স্বদেশী ও বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের বিরুদ্ধে এগিয়ে আসেন। তাঁরা শহর ও গ্রামাঞ্চলের মুসলমানদের সংগঠিত করতে শুরু করেন। মৌলবী, মোলা, মুন্সী, মোক্তার, সম্পন্ন কৃষক ইত্যাদি শ্রেণীর সঙ্গে গ্রাম বাংলার সাধারণ মুসলমান জনগণের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ থাকায় এইসকল সম্প্রদায় দরিদ্র মুসলমানদের অর্থনৈতিক ক্ষোভকে সাম্প্রদায়িক খাতে প্রবাহিত করেন, ফলে সাধারণ মুসলমান জনগণ স্বদেশী আন্দোলন থেকে দূরে সরে আসে। অন্যদিকে উচ্চবর্ণের হিন্দুরা স্বদেশী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ায়, পুর্ববঙ্গের অধিকাংশ তফসিলী হিন্দুরা বিশেষতঃ নমঃশুদ্র জাতি বঙ্গভঙ্গবিরোধী স্বদেশী আন্দোলনের প্রতি বিরূপ ছিলেন, কারণ তাঁরা উচ্চবর্ণের হিন্দুদের শোষণে জর্জরিত ছিলেন।

স্বদেশী আন্দোলনের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা হিন্দু-মুসলমান ঐক্যকে সুদৃঢ় না করে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ সুস্পষ্ট করে তোলে।

ফলে বঙ্গভঙ্গের পর কংগ্রেস আহূত স্বদেশী আন্দোলনে মুসলমানরা স্বতঃস্ফুর্তভাবে যোগ দেয় না। উপরন্তু ব্রিটিশ পণ্য-বর্জনেও মুসলমান সমাজ তেমন উৎসাহী হয়না। বঙ্গভঙ্গকে লর্ড কার্জন শাসনতান্ত্রিক প্রয়োজন বলে উপস্থাপন করেন। স্বদেশী আন্দোলনের সমকালে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন বাংলাদেশে ব্যাপক আকার ধারণ করে। সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন বিশেষভাবে হিন্দু যুব-সমাজেই সীমাবদ্ধ ছিল। স্বাধীনতা সংগামে এ আন্দোলনের ভূমিকা অনস্বীকার্য। কিন্তু এ আন্দোলনের সবচেয়ে বড ত্রুটি ছিল আন্দোলনকারীদের হিন্দুত্বের অন্ধ গোড়ামী ও মুসলিম-বিদ্বেষ। ’শিবাজী উৎসব’ প্রবর্তনকালে তিলক যেমন হিন্দু ধর্ম ও দেশাত্মবোধকে এক করে ভেবেছিলেন তেমনি সন্ত্রাসবাদের উদ্যোক্তারাও ভেবেছিলেন যে, স্বদে^শী  আন্দোলনের  জন্য ধর্মীয় আহ্বানই সবচেয়ে কার্যকব।

১৯০৭ সালে পূর্ববঙ্গের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা চরম আকার ধারণ করে। ইংরেজগণ এদেশে তাদের শাসন-শোষণ পাকাপোক্ত করার জন্যে ’ডিভাইড এ্যান্ড রুল’(     )পলিসির অনুসৃতিতে এদেশবাসীকে হিন্দু ও মুসলিম ধর্মীয় সম্প্রদায় ভিত্তিতে সামাজিক-রাজনৈতিকভাবে পৃথক করে ফেলে। বাংলার স্বদেশী আন্দোলন দমনে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের চন্ডনীতি ভয়ংকর মূর্তিতে আত্মপ্রকাশ করে এবং তারই ফলে বহু চরমপন্থী যুবক সশস্ত্র সংগ্রামের পথে ধাবিত হয়। অবশেষে ক্রমবর্ধমান গণ-আন্দোলনের চাপে বঙ্গভঙ্গ রদ (১৯১১) হয়।

এমতাবস্থায়, ১৯১১ সালে ইংল্যান্ডের রাজা পঞ্চম জর্জ ও রাণী মেরীর ভারত সফর ঘোষিত হলে হিন্দু নেতৃবৃন্দের একাংশ সে সফর বয়কটের হুমকি দেন। মুসলিম নেতৃবৃন্দের কোন মতামত যাচাই না করে বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়ার ফলে মুসলমানগন ইংরেজ ও হিন্দু উভয়ের প্রতি ক্ষুন্ন হয়। বাংলা বিভাগের বিরুদ্ধে ছয় বছরব্যাপী আন্দোলনের ফলে বঙ্গভঙ্গ রদ হয়, কিন্তু সেই সাথে রুদ্ধ হয়ে যায় পূর্ববঙ্গবাসীদের, বিশেষ করে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের সম্ভাব্য অর্থনৈতিক ও সাামাজিক অগ্রগতির পথ। বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন বাংলায় স্বদেশী আন্দোলন নামে পরিচিতি পায়। স্বদেশী আন্দোলন বাংলায় হিন্দু চরিত্রের রূপ পরিগ্রহ করে। সুতরাং মুসলমান সম্প্রদায়ের সমর্থন শিথিল হওয়ার ফলে গণভিত্তিক আন্দোলনের পরিধি সীমিত হয়ে পড়ে এবং স্বদেশী আন্দোলন উচ্চবিত্ত হিন্দু আন্দোলনের চরিত্র গ্রহণ করে। দমননীতি, সাম্প্রদায়িক বিক্ষোভ ও অভ্যন্তরীণ  দুর্বলতার জন্য স্বদেশী আন্দোলন পরিপূর্ণ সাফল্য লাভ করে না।

এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯১৩ সালে মুসলিম লীগের মঞ্চ থেকে স্বায়ত্বশাসনের দাবী শোনা যায়। বৃটেন ও তুরস্কের যুদ্ধে ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাব মুসলিমদের মধ্যে তীব্র হয়ে উঠে এবং কংগ্রেসে লীগে লক্ষেèৗ প্যাক্টের মাধ্যমে সহযোগিতার সম্পর্ক স্থাপিত হয়।ক

কংগ্রেসের আবেদন নিবেদন পালার ভিতরেও বিরোধের রূপ প্রথম থেকেই ছিল। এই বিরোধ কংগ্রেসে একদল চরমপন্থীকে কেন্দ্র করে বেড়ে উঠতে থাকে। তাদের নেতা ছিলেন পাঞ্জাবের লালা লাজপৎ রায়, মহারাষ্ট্রের বাল গঙ্গাধর তিলক, বাংলার বিপিন পাল। এই লাল-বাল-পালের মিলনে চরমপন্থীদের সংঘবদ্ধ হল। আবার আবেদন নিবেদনের নীতি আঁকড়ে রইল প্রাচীন দল, নরমপন্থী বলেই তারা আখ্যা পেল।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (১৯১৪) শেষে ভারতের  স্বাধীনতা লাভের আশার পরিসমাপ্তি ঘটে। বিশ্বযুদ্ধে সৃষ্ট অস্থিরতা ও উদ্দীপনা ভারতে নতুন ধরণের আন্দোলনমুখী রাজনীতির অনুকূল পরিবেশ রচনা করে। তারই সাহায্যে, তার মানুষ আর সম্পদের বিনিময়ে যুদ্ধে জয়লাভ হল বটে, কিন্তু ঔপনিবেশিক ভারতের ভাগ্যে মিলল স্বায়ত্তশাসনের পরিবর্তে সংস্কার আইন১।   এই  সংস্কার আইন সমর্থন লাভ করল না। কংগ্রেসের একে বাতিল করে দেয়। রাউলাট আইন(       ) জারী হয়।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্ব পর্র্যন্ত বিজ্ঞানের কল্যাণকর মূর্তিটাই মানুষের কাছে বেশী করে প্রতিভাত হত কিন্তু মহাযুদ্ধে বিজ্ঞানের মারণ কৌশল দেখে মানুষ তার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে শঙ্কিত হয়ে ওঠে। শৌর্যবীর্যের লীলাক্ষেত্র ও শূভকর পরিবর্তনের কারক বলে যে যুদ্ধকে প্রথমে কীর্তিত করা হয়েছিল তার ভয়ঙ্কর রূপ দেখে মানব সমাজ আতঙ্কগ্রপ্ত হল। আকাংখিত নব জীবনের কোন ইঙ্গিতই দেখা গেল না। যুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে আত্মপ্রকাশ করল মুদ্রাস্ফীতি, মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব, মহামারি, নৈতিক বিপর্যয়, বিশৃংখলা প্রভৃতি নানা অভিশাপ। মহাযুদ্ধে পরাজিতের ভাগ্যে ঘটল অবর্ণনীয় দুর্দশা এবং বিজিতের ভাগ্যেও বিশেষ কিছু মিললো না। দেশে দেশে শ্রমিক-বিক্ষোভের অগ্নি ধূমায়িত হতে লাগল। রুশ বিপ্লবের ( ১৯১৭) সাফল্যে শ্রমিক আন্দোলনে নতুন শক্তি সঞ্চারিত হয়। বিভিন্ন দেশে শ্রমিক ধর্মঘটের মধ্য দিয়ে শ্রমশক্তির আত্মচেতনা -মুখরিত জয়ধ্বনি শোনা গেল। ইংল্যান্ডের মত দেশেও সাধারণ ধর্মঘটের  ঘন্টা বাজলো।

গণ-আন্দোলনের উত্তাল তরঙ্গ রোধ করার জন্য এবং ধনিক সভ্যতার স্বার্থ সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে উগ্র জাতীয়তাবাদের নিশান হাতে জার্মানী ইতালী প্রভৃতি দেশ ডিক্টেটরদের আবির্ভাব ঘটতে লাগল। তাদের ঘৃণ্য, কঠোর, নির্মম শাসনদন্ডের তাড়নায় গনতন্ত্রের লাঞ্জনা ও অত্যাচারের সীমা রইল না। যুদ্ধের ফলে এমন কিছূ পাওয়া গেল না যা কিনা মানবসমাজে দৃঢ়প্রত্যয়ে আঁকড়ে ধরতে পারে। শ্রেণীর গন্ডী ভেঙ্গে পড়তে লাগলো, পরিবারের ভিত্তি টলে উঠলো, সমাজের কাঠামো চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে গেল। জীবনের চেয়ে জীবিকার প্রশ্নই বড় হয়ে দেখা দিল।

জীবনের বাইরেই শুধু ফাটল ধরলো না, তার ভিতরেও ভাঙনের স্রোত প্রবেশ করলো। দুঃখ দুর্দশায় মানুষের নীতিবোধ ক্রমেই অসাড় হয়ে পড়তে লাগলো। এসব মানসিক ব্যাধির উৎস খুঁজতে যেয়ে ফ্রয়েড২ চেতনালোকের নীচে এক অচেতন লোকের অস্তিত্ব আবিষ্কার করেন। অবদমিত যৌনপ্রবৃত্তি সমাজ ও জীবনে যেসব বিসর্পিল পথে আত্মপ্রকাশ করে তাদের বিচিত্র তথ্য উদঘাটিত হল। ফ্রয়েড, ইয়ুংগ৩ প্রভৃতি মনস্তত্ত্ববিদ্দের আবি®কৃত বিভিন্ন তথ্য ব্যবহৃত হতে লাগল। সামাজিক ও শাস্ত্রীয় অনুশাসন এবং নৈতিক পীড়নে যেসব নিষিদ্ধ বলে অস্পৃশ্য ছিল, সাহিত্য ও শিল্পের দুঃসাহসী কর্মীরা তাদের জাতে তুলতে আরম্ভ করলেন।

প্রথম মহাযুদ্ধের পর বোঝা গেল পৃথিবীতে প্রাণের মূল্য কমে গিয়েছে। এবং সেই সঙ্গে জীবনের চেয়ে মৃত্যুর আয়োজনই বড় হয়ে উঠেছে। সভ্যতার দোহাই পেরে মানবিকতা হয়েছে ভুলুন্ঠিত। সাহিত্য সংগীত শিল্প প্রভৃতি তাদের ঐতিহ্য-বিচ্যুত চোরাবালির মধ্যে অসহায় ঘুরপাক খেতে লাগল। সংশয় অবিশ্বাস ও স্বার্থপরতা গ্রাস করল যুগমানসকে চিরন্তনতার চেয়ে বড় হয়ে উঠল সাময়িকতা। একদিকে উন্নাসিকতা ও নৈরাশ্যের মহাশূণ্যতা Ñ ফাঁপা মানুষে ভরে উঠল পৃথিবী, অন্যদিকে এক নতুন মূল্যমান মিলে গেল জীবনের। সে মূল্যমান বিশ্বভাতৃত্বের মহাসম্ভাবনায় সমুজ্জল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সঙ্কটে আকীর্ণ পৃথিবী সৃষ্টি করলেও সঙ্কট হরণের বীজ উপ্ত করে দিয়ে গেল।

ইংরেজ শাসিত ভারতবর্ষ পাশ্চাত্যের নববন্যায় ভেসে গিয়েছিল, এবার তার সমস্যা ও সংকটের সে ভাগীদার হল। ভারতবর্ষে কুখ্যাত রাউলাট আইনের(    )ফলে নববর্ষ উপলক্ষে সমবেত নর-নারীর উপর গুলি চালিয়ে (১৬০০ রাউন্ড) পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ড (এপ্রিল, ১৯১৯) সংগঠিত করে। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ভারতীয় মুসলমানরা শুরু করে খিলাফত আন্দোলন (১৯১৯)। পরবর্তীকালে মহাত্মা গান্ধী৪র নেতৃত্বে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন (১৯২০) এভাবে ১৯১০ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ১৯২২/২৩ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত ভারতীয় উপমহাদেশে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সমঝোতার প্রয়াস দেখা যায়। কিন্তু এই প্রয়াস নিছক স্বার্থসিদ্ধিমূলক Ñ কোন মূলীভূত ঐকানূগত্যে তা গঠিত নয় তাই এর মর্মন্তুদ পরিণতি দেখা দেয় উৎকট সা¤প্রদায়িক দাঙ্গার মাধ্যমে। প্রমাণিত হয় Ñ রাজনৈতিক ক্ষেত্রে হিন্দু ও মুসলমানের স^ার্থ এক নয়, ভিন্ন।

স্বদেশী যুগে বঙ্গদেশে এই আন্দোলন যেমন তীব্র ও ব্যাপক হয়েছিল সমগ্র ভারতবর্ষের পরিপ্রেক্ষিতে এবার তেমন কিছু হয়না এবং গঠনমূলক অন্য কয়েকটি আন্দোলনও Ñ অস্পৃশ্যতা বর্জন, হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে প্রীতির বন্ধন Ñ বিশেষ সফলতা লাভ করেনা।

হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতির মধ্য দিয়ে যে ধর্মনিরপেক্ষতা স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্ভবপর ছিল তা অতি অল্প কালের মধ্যেই বিনষ্ট হয়ে যায়। এর একটা প্রধান কারণ আন্দোলনের হিন্দু চরিত্র প্রতিষ্ঠার জন্য গান্ধীর অবিরাম প্রয়াস। তিলক বা  সন্ত্রাসবাদিদের মতো, গান্ধীও তাঁর স্বরাজ ও সত্যাগ্রহের কল্পনার মধ্যেই হিন্দু আতিশয্য অনুপ্রবিষ্ট করান। কংগ্রেসের মধ্যকার অধিকাংশ হিন্দু নেতৃত্বের সাম্প্রদায়িক অবস্থান ও দৃষ্টিভঙ্গীর কারণে হিন্দু মুসলিম ঐক্যের স্বর্ণযুগ অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলনকাল থেকেই কংগ্রেসের প্রতি মুসলিম নেতৃবৃন্দের আস্থাহীনতা গড়ে ওঠে। বস্তুতঃ সন্ত্রাসবাদীদের মুসলিম-বিদ্বেষ ও হিন্দু-গোঁড়ামি বাংলাদেশে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক অধিকতর অবনতি করে। উল্লেখ্য যে, ১৯২১ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে বৃটিশ সরকার খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনের বিরুদ্ধে পীড়ননীতি প্রয়োগ করতে শুরু করে। রাজদ্রোহীদের দোষী বিবেচনা করে বিভিন্ন রকমের শাস্তি প্রদান হয়। অসহযোগ আন্দোলনের সমাপ্তি ঘটায় ভারতের রাজনীতিক্ষেত্রে অবসাদ দেখা দেয়। অনেকে মনে করেন পরবর্তী কয় বৎসর যে হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গা ঘটেছিল তা এই অবসাদেরই অবাঞ্জিত ফল।

অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলনের অবসানের পর বিভিন্ন স্থানে দাঙ্গাহাঙ্গামার মাধ্যমে সাম্প্রদায়িকতার প্রসার ভারতের রাজনীতিকে কলুষিত করতে থাকে। ১৯২১-২২ সালের অসহযোগ আন্দোলনের সময় ও ১৯৩০-৩২ সালের লবন আইন অমান্য আন্দোলনের সময় অন্যান্য প্রদেশসহ বাংলায় কৃষক আন্দোলন জঙ্গী চরিত্র ধারণ করে।

ভারতে ব্যাপক গণ-অসন্তোষের প্রেক্ষাপটে ব্রিটিশ সরকার, শাসন সংস্কারের রিপোর্ট ’সাইমন কমিশন রিপোর্ট’ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। ব্রিটিশ সরকার শাসন সংস্কারের উদ্দেশ্যে পর পর তিনটি গোলটেবিল বৈঠকের আহ্বান করে ১৯৩০ সালে কংগ্রেস বৈঠক বর্জন করে। ৩১, ৩২ সালের বৈঠকে স্বায়ত্বশাসন দূরে থাক বৃটিশ সরকার ভারতবর্ষকে ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাস দিতেও অস্বীকৃতি জানায়। একই বছর উল্লেখযোগ্যভাবে দ্বিতীয়বার বৃদ্ধি পায় পুর্ণ স্বাধীনতা অর্জনে বিপ্লবীদের সন্ত্রাসী কর্মকান্ড। উল্লেখ্য যে সন্ত্রাসী বিপ্লববাদের জন্ম মহারাষ্ট্রে হলেও তা বিকাশ লাভ করেছিল অবিভক্ত বাংলায়। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের কাল (১৯০৫-১১) থেকে ১৯৩৪ সালে বিপ্লবী আন্দোলন স্তিমিত হয়ে আসার পূর্বক্ষণ পর্যন্ত সমগ্র ভারতবর্ষের সমুদয় বিপ্লবাত্মক কার্যাবলীর মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ সংঘটিত হয় বাংলাদেশে বাঙালী হিন্দু যুবকগন কর্তৃক। ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের অধীনে সীমিত ক্ষমতা লাভ করার পরই কংগ্রেসপন্থী নেতৃবৃন্দের আচরণ থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, কংগ্রেস একটি মুসলিম স্বার্থবিরোধী সংগঠন। বিভিন্ন অঞ্চলসহ বাংলার পাটশিল্পে শ্রমিক ধর্মঘট (১৯৩৭) পালিত হয়। বৃটিশ সরকার ’শিল্প বিরোধ আইন’ (১৯৩৮) চালু করে শ্রমিক আন্দোলন দমনে অগ্রসর হয়। ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা পর্যন্ত এ ধারা অব্যাহত থাকে। ইংরেজ শাসনের শুরু থেকে প্রায় সোয়াশত বছর ভারতের পূর্বেকার শাসক সম্প্রদায় মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিন্দুদের ব্যবহার করে ও হিন্দুদের মাঝে কৃপা বিতরণ করে ইংরেজ শাসকগণ উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িকতার যে বিষবৃক্ষ রোপন ও লালন করে, সেই সাম্প্রদায়িকতারই শেষ অধ্যায় রচনা করে ১৯৩৮ সালে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে গঠিত কংগ্রেস সরকার এবং ১৯৪০ সালে মুসলিম লীগের দ্বিজাতি তত্ত্বভিত্তিক লাহোর প্রস্তাব। ১৯৪০ সালে লীগের লাহোর অধিবেশনের সভাপতির ভাষণে জিন্নাহ্ হিন্দু ও মুসলমান যে দুটো ভিন্ন জাতি এ কথা স্পষ্ট ভাষায় বলেন এবং এ, কে, ফজলুল হক কর্তৃক উত্থাপিত স্বতন্ত্র মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব বিপুল ভোটাধিক্যে গৃহীত হয়। বস্তুতঃ মুসলমানদের সামনে তখন স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের পরিকল্পনা ব্যতীত গত্যন্তর থাকে না।

 

পাদটীকা

১। সংস্কার আইন (মন্টেগু চেমস্ফোর্ড সংস্কার)

২। ফ্রয়েড –  সিগমুন্ড ফ্রয়েড (১৮৫৬Ñ১৯৩৯)(ফ্রেবার্র্গ, মোরাভিয়া)।

৩। ইয়ুংগ – কার্ল গুস্তাভ ইয়ুংগ (১৮৭৫-১৯৬১)(ক্যাসুইল, সুইজারল্যান্ড)

৪। মহাত্মা গান্ধী

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

খ) বিশ শতকের প্রথম চার দশকের বাংলা শিশুসাহিত্যের অবস্থান।

 

বাংলা শিশুসাহিত্য বাংলা সাহিত্যেরই অঙ্গীভূত একটি বিশিষ্ট ধারা। উৎস ও উন্মেষে লোকজ ও স্স্কংৃত ধারার ঐতিহ্যবহুল শিশুসাহিত্যের প্রকৃত চর্চা ইংরেজ সভ্যতা ও শিক্ষার সংস্পর্শে, প্রথম পাঠ্যপুস্তক রচনার মধ্যে প্রস্তুতি পর্ব সম্পন্ন করে। মৌলিক শিশুসাহিত্যের সূত্রপাত হয় কেশবচন্দ্র সেন সম্পাদিত ‘বালক-বন্ধু’ (১৮৭৮) প্রকাশিত হওয়ার পর।

আধুনিক শিক্ষা প্রসারের সঙ্গে সঙ্গেই শিশুশিক্ষা প্রসারের কাজও চলতে থাকে। এই সাহিত্যের উৎস সন্ধান করতে গেলে প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যের ধারা, রূপকথা, ছেলে ভুলানো ছড়া পর্যায়ক্রমে এসে পড়ে। আধুনিক অর্থে বাংলা শিশুসাহিত্যের সূত্রপাত উনিশ শতকের ইউরোপীয় প্রভাবেরই ফল। এই অর্থে বাংলা শিশুসাহিত্যের উদ্যোগ পর্বে বিদ্যাসাগর-অক্ষয় দত্ত প্রমুখ পাঠ্য রচনায় বা এই সময় প্রকাশিত ’পদ্মাবলী’ ইত্যাদি পত্রিকায় শিশু বা বালকদের জন্য রচনাকে চিত্তহারী করার প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা গেলেও পাঠ্যপুস্তকের শিক্ষা বা নীতি-উপদেশের অতিরিক্ত কিছু করার উদ্দেশ্য তাদের ছিলনা। এইসব পত্রিকায় যাঁরা লিখতেন তাঁরা অনেকেই শিশুশিক্ষার প্রসারেই অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন। ’শিশুর বিষয় নিয়ে শিশুর জন্য রচনা’র সূত্রপাত হয় এর পরবর্তী পর্বে। শিশুদের বয়সের সঙ্গে অর্থাৎ মানসিক প্রস্তুতির দিকে নজর রেখে সমালোচকরা শিশুসাহিত্যকে বিশেষ কয়েকটি শ্রেণীতে বিভক্ত করতে চান। এই হিসেবে সমস্ত শিশুসাহিত্যিকের রচনা সর্বশ্রেণীর শিশুর জন্যেই উপযুক্ত বলে বিবেচিত হয়না। বিশ শতকের পূর্বে বাংলা শিশুসাহিত্য প্রথমতঃ বিদ্যালয়ের পাঠ্য, দ্বিতীয়তঃ অনুবাদ, তৃতীয়তঃ নীতি শিক্ষামূলক ছিল।

সাহিত্যে জাতীয় চেতনার প্রকাশ পরোক্ষভাবে ঘটে। উনিশ শতকের মধ্যভাগে জাতীয় ইতিহাস বা ঐতিহ্যের আলোচনা, মহাপুরুষদের জীবনী রচনা ইত্যাদির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। এর পরবর্র্তীকালে জাতীয় চেতনা ধর্মাশ্রয়ী থেকেছে। সন্ত্রাসবাদ, গণপতি উৎসব তার মধ্যে অন্যতম।

বাংলা শিশুসাহিত্যের জন্মলগ্ন থেকেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতো প্রতিভাধর পাঠ্যপুস্তক রচনার সঙ্গে সঙ্গে কিছু প্রেরণামূলক বই লিখেন। গুরুত্ব দেয়া হত এমন সব বিষয় যেখানে দেশ বিদেশের জ্ঞানভান্ডার থেকে সম্পদ আহরণ করা হত। গুরুত্ব ছিল অনুবাদ বা অবলম্বিত রচনার উপর। সংস্কৃত বা পালি থেকে যেমন অন্যদিকে প্রধানত ইংরেজীর মাধ্যমে পাশ্চাত্য সাহিত্য থেকে নানাবিধ উৎকৃষ্ট রচনা ছোটদের উপযোগী করে পরিবেশন করা।

পরাধীন ও অধঃপতিত জাতিকে ঊদ্দীপ্ত ও আশ্বান্বিত করার জন্য কবি সাহিত্যিকরা জাতির অতীত কীর্তিকে মহিমান্বিত করে প্রকাশ করেন। বাঙালি সাহিত্যিকরাও সেটা করেছেন Ñ সৃষ্টি করেছেন স্বাধীনচেতা বীরনায়ক। রঙ্গলাল মধুসূদন প্রমুখ বীর নায়কের প্রতিপক্ষ প্রায় ক্ষেত্রেই অত্যাচারী আক্রমনকারী পাঠান, মোগল সেনানায়ক বা রাজা বাদশা। বাঙালি মুসলিম সাহিত্যিকরাও প্রাক-মুসলিম ভারতীয় ঐতিহ্যকে নিজের বলে গ্রহন করতে অস্বীকার করেছেন। ভারতীয় ভাষায় তারা যবন ম্লেচ্ছ। এই সব বিষয় সংক্রান্ত জাতীয়তাবাদী সাহিত্য বাঙালি জাতীয়তাবাদে ফাটল ধরিয়েছে। এদেশের হিন্দুদের কাফের বলে তারা জেনেছেন। মুনীর চৌধুরী বলেন,

ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধের সূচনা থেকেই বাঙালির জাতীয়তাবদের ধারণার সঙ্গে হিন্দু পুনর্জাগরণের আদর্শ মিশ্রিত হতে থাকে। শতাব্দীর শেষে এসে এই জাতীয়তাবাদ প্রায় অবিমিশ্ররূপে হিন্দু জাতীয়তাবাদে রূপান্তরিত হয়। হেম নবীনের কবিতা ও ভূদেবÑবঙ্কিমের উপন্যাস এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ। উপন্যাসে মুসলমান সেনাপতি শাসনকর্তাদের অত্যাচার অনাচারের চিত্র অতিরঞ্জিত করে অঙ্কিত করে তারা জনান্তিকে ইংরেজদের বিরুদ্ধে আঘাত হানতে চেয়েছেন, একথা কেবলমাত্র অংশত সত্য। ইসলাম ধর্ম ও মুসলিম নর-নারীর সর্বপ্রকার লাঞ্জনার গ্রন্থকারগনের ব্যক্তিগত উল্লাস চাপা থাকেনি। এসব উপন্যাসে প্রায়শ দেখতে পাওয়া যায় মুসলমান চরিত্রগুলো হীনস্বভাব এবং হিন্দুগন গুণনিধি।১

উনিশ শতকের শেষভাগে শিশুসাহিত্যে জাতীয়তাবাদের সূচনা লক্ষ্য করা যায়, তবে সেই জাতীয়তাবাদ মণীষীর চরিত্র চিত্রণ ও দেশপ্রেমের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। এর সঙ্গে সংগ্রহ হচ্ছিল বাংলার ঘুমপাড়ানী গান, ছেলেভুলানো ছড়া, রূপকথা, উপকথা, ভূতের গল্প, কিংবদন্তী ইত্যাদি। এই ধরনের রচনা সংগ্রহের পিছনে রবীন্দ্রনাথের সক্রিয় উৎসাহ ও উদ্দীপনা অন্য লেখকদের কাছে প্রেরণার কাজ করেছিল। রবীন্দ্রনাথ অনেককে দিয়ে লোাকসাহিত্যের বিভিন্ন নিদর্শন সংগ্রহ করিয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে উপেন্দ্রকিশোর রায়, দক্ষিণারঞ্জন মিত্র, অবনীন্দ্রনাথ প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। রবীন্দ্রনাথের অনুরোধে শকুন্তলার গল্প ছোটদের মতো করে পরিবেশন করবার পর অবনীন্দ্রনাথ লিখেছেন ’ক্ষীরের পুতুল’(১৮৯৬)।

এর পরবর্তী পর্ব শিশুপত্রিকার প্রকাশনা। সমকালীন সমাজ জীবনের ছবি শিশু পত্রিকাগুলিতে নিষ্ঠার সাথে তুলে ধরা হয়। বাংলা শিশুসাহিত্যের জয়যাত্রা উনিশ শতকের শেষে ’সখা’ (১৮৮৩)২, ‘সাথী’৩, ’বালক’ (১৮৮৫)৪, ’সখা ও সাথী৫’ (১৮৯৪), ’মুকুল’ (১৮৯৫)৬ ইত্যাদি পত্রিকার মাধ্যমে।  শিশুসাহিত্যের ক্ষেত্রে নবজাগ্রত জাতীয় চেতনার প্রতিফলন ঘটে তার জন্মের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। ’সখা’য় রাজনীতিবিষয়ক প্রবন্ধ উগ্র রচনা প্রথম ছাপা হয় এবং তখন থেকেই শুরু হয় জাতীয় চেতনার গঠনমূলক ক্রিয়া। তবে ’মুকুল’ পত্রিকায় শিবনাথ শাস্ত্রী দেশী বিদেশী রূপকথাকেই সহজ সরল ভাষায় স্বচ্ছন্দ রূপ দিয়ে প্রকাশ করেন আবার বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনের সঙ্গেও এই পত্রিকা জড়িত ছিল। এই পত্রিকাতেই বিশিষ্ট সম্পাদক শিশুসাহিত্যের বয়সের সীমা (৮/৯-১৬/১৭) নির্ধারণ করেছিলেন। পৃথিবীতে জেেন্মর শুভক্ষণ থেকে আঠারো বছর বয়স পর্যন্ত শিশু এবং শৈশবকাল হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে। সকল ক্ষেত্রেই শিশুধারণা গঠনের একটি জাতীয় মাত্রা পরিণত বা পুষ্ট হলেই কেবল বৈশ্বিক প্রবাহে মিলিত হতে পেরেছে। বাংলাদেশে জাতীয় পর্যায়ে এ আঠার বছর বয়স নিরূপনের বিষয়টি পরে আলোচিত হয়েছে।৭

 

শিশুসাহিত্যের ইতিহাসে যে যুগ পরিবেশ, সামাজিক পটভূমি সক্রিয় ছিল এসব বিষয় দ্বারা প্রমাণিত হয়। এই সময়ে বাঙ্গালী মণীষির অনেকেই শিশুসাহিত্য রচনায় আত্মনিয়োগ করেন। এইসব পত্রিকার মাধ্যমে যে সব লেখকের উদ্ভব হয় তাদেরকে বিশ শতকের বাংলা শিশুসাহিত্যের পথিকৃত হিসাবে বিবেচনা করা যায়। এদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী, দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার প্রমুখ সাহিত্যিক শিশুসাহিত্যের ক্ষেত্রে মৌলিক অবদান রাখেন। এই পর্বে পাঠ্যপুস্তÍকের প্রত্যক্ষ শাসন হতে শিশুসাহিত্য মুক্তি লাভ করে। নবীন লেখকেরা বুঝেছিলেন, যে ছোটদের সর্বাঙ্গীন মানসিক উৎকর্ষ সাধন করতে হলে আনন্দকে প্রথম সারিতে রেখে নীতিকে নেপথ্যে রাখতে হবে। যোগীন্দ্রনাথ সরকারের ‘হাসি ও খেলা’ (১৮৯১) ও খুকুমনির ছড়া (১৮৯১), অবনীন্দ্রনাথের ‘শকুন্তলা’(১৮৯৫) ও ‘ক্ষীরের পুতুল’ (১৮৯৬) এ দিক থেকে অনন্য কৃতিত্বের নিদর্শন।

মহাপুরুষ চরিত জাতির নিজস্ব গৌরবগাথার তথা জাতীয় চরিত্র গঠনের উপযোগী মালমসলা সন্ধানের যে প্রবণতা লক্ষ্যণীয়, তার প্রতিফলন আরো দুটি ক্ষেত্রে দেখা যায়। প্রথমটি নীতিপ্রীতি বা অদর্শবাদিতা। এ-প্রবনতা বাংলা শিশুসাহিত্যে আগেও ছিল কিন্তু জাতীয়বাদের যুগে এর ব্যাপকতর প্রকাশ ঘটে। জাতীয়তাবাদী চেতনার অন্যতরো প্রকাশ ঘটে স্বদেশের রূপকথা সংগ্রহে। এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখ্য অবনীন্দ্রনাথের (১৮৭১-১৯৫১)’ক্ষীরের পুতুল’ (১৮৯৬), দক্ষিণারঞ্জনের (১৮৭৭-১৯৫৭) ’ঠাকুরমার ঝুলি’ (১৯০৬) আর ’ঠাকুরদার ঝুলি’ (১৯০৮), উপেন্দ্রকিশোরের ’টুনটুনির বই’ (১৯১০) ইত্যাদি গ্রন্থে জাতীয় চেতনা দেশজ ঐতিহ্যে গৌরবের বস্তুর সন্ধান করে ফিরেছে।

উনিশ শতকের শেষ থেকে বাংলায় যে জাতীয় জাগরনের সূচনা হয় সে সময় শিক্ষিত বাঙালী সমাজ জাতীয় চেতনার উৎস সন্ধানে প্রাচীন ইতিহাস এবং ঐতিহ্যের দিকেও ঝুঁকে পড়েন। সেই সঙ্গে তাঁদের দৃষ্টি যায় বিভিন্ন যুগের মহাপুরুষদের বিশেষত স্বদেশের আর স্বধর্মের মণীষীদেরÑজীবনী আলোচনার দিকে। বাংলা শিশুসাহিত্যের ক্রমবিকাশ ধারায় জাতীয় চেতনার একটি বড় দান ছিল মহাপুরুষদের (প্রধানতঃ দেশী, অন্যত্র বিদেশী) চরিতকথা। জীবনীসাহিত্যের ব্যাপক বিকাশে কালীপ্রসন্ন দাশগুপ্তের ’আর্যনারী’ (১৯০৮-০৯), রামপ্রাণ গুপ্তের ’হজরত মোহাম্মদ’ (১৯০৪) ইত্যাদি এমনি ক্রান্তিকালের ফসল। শিশুভোগ্য এবং বয়স্কজন পাঠ্য উভয় শ্রেণীর সাহিত্যেই বহু ঐতিহ্যসন্ধানী রচনা আর জীবনীগ্রন্থ রচিত এবং প্রকাশিত হয়। পরবর্তী কালে, বিশ শতকের প্রথম দিকে, এটা প্রায় জোয়ারের রূপ নেয়, এ জের চলে তৃতীয় দশক অবধি।

গোটা বিশ শতক জুড়ে বিস্তর শিশু সাময়িক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। নানা অর্থেই সাময়িক পত্রিকা সমকালীন জীবনের দর্পন। বৃটিশ যুগের অন্যান্য বাংলা পত্রিকার মতোই শিশু পত্রিকাগুলোতেও উক্ত জাতীয় জাগরণের প্রভাব ছিল অপরিহার্য। এর সবচেয়ে বেশী প্রভাব দেখা যায় ’তোষিণী’ (১৯১০)৮তে।

উন্নয়নশীল জাতীয় চেতনার স্বাভাবিক প্রকাশ ছিল দেশকেন্দ্রিকতায়, প্রবণতাটি কোথাও অতিরেখ রূপে ছড়ানো নয়, রচনাবলীতে ছড়ানো। বিদেশী রচনার ভাবানুসরণ বা অনুবাদ প্রকাশনের অধিকাংশ রচনাই ভাবধারার দিক থেকে ছিল মাটিকেন্দ্রিক। মাঝে মাঝে পত্রিকাগুলিতে দেশপরিচয়মূলক এবং ভাষাপ্রীতিমূলক রচনাও দেখা যায়।

উদ্দিপনামূলক জাতীয় ভাবধারার কবিতায় বাঙালি কবিরা গৌরব সন্ধান করেছেন দূর অতীতের ইতিহাসে। তা কখনো ভারতের গৌরব কখনো আর্যের গৌরব, কখনো হিন্দুর গৌরব। মধ্যযুগের মুসলিম ইতিহাসকে তাঁরা বিদেশীরূপে অনাত্মীয়রূপে দেখেছেন। বাঙালি মুসলিম সহিত্যিকরাও প্রাক-মুসলিম ভারতীয় ঐতিহ্যকে নিজের বলে গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছেন। এদেশের হিন্দুদের তারা কাফের বলে অভিহিত করেছেন।

বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের (১৯০৫) পর এই ধারার কিছু পরিবর্তন সূচিত হয়। এই সময় থেকে বাঙালি কবি-সাহিত্যিকগণ সাহিত্যে হিন্দু মুসলিম মিলনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতে থাকে। তখন থেকে কাব্যে, নাটকে, কথাসাহিত্যে মুসলিম ঐতিহ্য তাঁদের প্রীতি ও প্রশংসা পেতে থাকে।

’শিশু’ (১৯১২)৯ পত্রিকায় মুসলিম বিষয়বস্তু গুরুত্ব পেয়েছে তবে, অব্যবহিত পশ্চাৎভূমি ছিল হিন্দু পাঠক সমাজ। ’সন্দেশ’ (১৯১৩)১০ পত্রিকা ধর্মবোধের উর্ধ্বে শৈশবের মুক্ত সুখ ও অবিমিশ্র আনন্দ সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু সমকালীন সমাজ জীবনের বাস্তবতার সঙ্গে ’সন্দেশ’ পাঠক-পাঠিকাদের তেমন প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ছিলনা। ‘সন্দেশ’ সম্পাদক লক্ষ খুশীর রঙীন আতস বাজীতে শিশুসাহিত্যের আকাশ মাতিয়ে রেখেছিলেন। যোগীন্দ্রনাথ সরকারের সেই আশ্চর্য ছড়া ও ছবিতে নবদিগন্তের আহ্বান অনিবার্য ছিল। অথচ প্রথম মহাযুদ্ধের কাল সেটা।

সমাজ চেতনায় উদ্বুদ্ধ হল ’সন্দেশের পরের পত্রিকাগুলি। বিশ্বযুদ্ধের বিষক্রিয়ায় ভারত জুড়ে মানুষের কষ্ট আরো তীব্রতর হল পঁচিশ বছরের মধ্যে। বিজ্ঞানের নব নব আবিষ্কার, সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির অবিমৃষ্যকারিতা, ভারতীয় কম্যুনিষ্ট পার্টির জন্ম (১৯২৫)১১পৃথিবীর সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জাগরণ, যুদ্ধ-বিধ্বস্ত ভেঙে পড়া অর্থনীতি শিশুসাহিত্যের লেখকদের আর কেবল উদ্ভট কল্পনার জগতে সম্পূর্ণ নির্বাসিত করে রাখতে পারল না। সে অবস্থার চূড়ান্ত রূপ এল মন্বন্তরের ভয়াবহতায়। সঙ্গে আবার বিশ্বযুদ্ধ।

যদিও শিশুপত্রিকায় জাতীয়তাবাদী চেতনা উনিশ শতকের শেষ থেকে দেখা যায়, কিন্তু বাংলা ভাষার কোন শিশুতোষ পত্রিকাই সে- আমলে রাজনীতির সাথে বিশেষ সম্পর্ক রাখেনি। ’আঙুর’ (১৯২০)১২ পত্রিকা ছিল ধর্মনিরপেক্ষ।

‘শিশু সওগাত’১৩ পত্রিকা ১৯২২, এপ্রিল প্রথম প্রকাশিত হয়, কিছুকাল বন্ধ থাকার পরে ১৯৩৮ সালে পুনরায় প্রকাশিত হয়। শিশু বিকাশের সঙ্গে ইতিহাস জ্ঞান ও বিজ্ঞানবুদ্ধিকে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। অমুসলিমদের জন্য দ্বার উন্মুক্ত রেখেই মুসলিম ঐতিহ্যের কথা এসেছে। সেকারণে শিশু বিকাশের ক্ষেত্রটি এখানে বেশ প্রসারিত করে তোলা হয়েছে। মুক্ত বিকাশের দিকটি বিশেষ গুরুত্ব অর্জন করেছে। বাঙালি মুলমানদের সাহিত্যিক জাগরণ হিন্দুদের বিস্ময়ের কারণ হয়েছিল। তারা নানাস্থানে সাহিত্য সম্মেলন এবং কলকাতার নানা কাগজে বিস্ময় প্রকাশ করতে থাকেন। মুসলমানরা রাজনীতির ক্ষেত্র হতে সাহিত্যেও সাম্প্রদায়িকতা টেনে আনলো বলে নানাদিক থেকে হুঙ্কারও আসতে থাকে।

’শিশুসাথী’১৪ (১৩২৯) পত্রিকায় হিন্দু ধর্মবিষয়ক ও বিজ্ঞানবিষয়ক রচনা পাশাপাশি গুরুত্ব পেয়েছে। অনুমিত হয়, হিন্দু সমাজ ও সংস্কৃতি গঠনের জন্য এ পত্রিকা আগ্রহী ছিল। সমকালীন রাজনীতির সারকথা জানানোর জন্যও এই পত্রিকা দায়বদ্ধ ছিল। যুদ্ধের ফলশ্রুতিতে গ্রাম বাংলার অর্থনৈতিক কাঠামোর মর্মন্তুদ পরিবর্তনের প্রতিফলন পত্রিকায় প্রতীয়মান হয়। বার্ষিক ’শিশু সাথী’১৫ (১৩৩২) মাসিক ‘শিশু সাথী’রই ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছে। সব পত্রিকাই পাঠ্যপুস্তকের বাইরে শিশুভুবন গঠন করেছে।

স্বভাবিকভাবে এই সামাজিক পরিবেশে শিশুপত্র-পত্রিকাগুলি কেবল নৈতিক চরিত্র গঠনপোযোগী আদর্শমূলক রচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে পারল না। একদিকে স্বদেশী আন্দোলন, স্বদেশ শ্রদ্ধা, মাতৃজ্ঞানে দেশকে ভালবাসার প্রেরণা দেওয়া, স্বাধীনতা আনার পুণ্যব্রতে উদ্বুদ্ধ করা, অন্যদিকে দুর্বল অর্থনৈতিক, কাঠামোয় বিধ্বস্ত সমাজবোধ জন্মানো, রুদ্র কঠিন বাস্তবতার মধ্যে জীবন গড়ে তোলার দায়িত্ব জাগানোই ছিল এই পত্র-পত্রিকাগুলির প্রধান উদ্দেশ্য। এই সমস্ত মিলেই আধুনিক শিশুসাহিত্যের অস্তিত্ব।

পুরাতন পরীর গল্প, দৈত্যদানোর গল্পের বদলে ক্রমশ শিশুদের বাস্তব পারিপার্শ্বিকের চেনাভুবন সম্পর্কে আরো জানার কথায় উদ্দীপ্ত কৌতুহল চরিতার্থের দায়িত্ব নিলেন শিশুসাহিত্যিকরা। এই প্রচেষ্টায় সমাজের ক্রমোন্নতি ও অর্থনৈতিক কাঠামোর পরিবর্তন জনিত যে দ্রুত শিল্পোন্নয়ন সাড়া পৃথিবী জুড়ে মানব সভ্যতার একটা বিরাট পরিবর্তন এনে দিচ্ছিল তার প্রতিচ্ছাপও অনিবার্যভাবে সাহিত্যে পড়লো। এ বদল ইংরেজী সাহিত্যের শিশুবিভাগেও পড়েছিল। উনিশ শতকের শেষেই সে বদল ঘটে গিয়েছিল। ‘ঞবপযহরপধষ ঢ়ৎড়মৎবংং রহ ঃযব ১৯ঃয পবহঃঁৎু ধিং ৎবষধঃবফ ঃড় ঃযব মৎড়রিড়হম ষরঃবৎধঃঁৎব ঃৎবহফ রহ ঊহমষধহফ.’১৬  সুতরাং জনরুচি তথা পাঠক রুচিরও বদল ঘটেছিল। উনিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে পাশ্চাত্যে যে বিপুল বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ও উন্নতি সাধিত হয়েছে তার প্রভাব সাহিত্যে অনিবার্যভাবে এসে পড়েছিল। জ্ঞান ও আনন্দ সৃষ্টির আদর্শ অক্ষুন্ন রেখে অম্লান শৈশবের অক্ষয় সৌন্দর্যের লীলা উপস্থিত করেছেন – বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির কথা – সভ্যতার অগ্রগতির কথা মাথায় রেখে।

উনিশ শতকের কিছু মান্দ্রেক্ষণ ছিল শিশুসাহিত্য সৃষ্টি হয়ে ওঠার সঙ্গে যুক্ত। সামাজিক শিশুধারণা যত পরিণত রূপ প্রাপ্ত হয়েছে শিশুসাহিত্যের মধ্যে সেসবের সৃষ্টিশীলতা একত্রে গঠিত হয়ে গেছে। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন মূলনক্ষত্র এবং তিনি ছিলেন উনিশ এবং বিশ শতক জুড়ে। তার প্রায় আশি বছর পার্থিব জীবনের অর্ধেক ছিল উনিশ শতকে বাকি অর্ধেক ছিল বিশ শতকে। উনিশ শতকে চরণ রেখেই তিনি বিশ শতকটিকে জয় করে নিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের কালসীমার মধ্যে আরো কিছু উল্লেখযোগ্য শিশুসাহিত্যিক পাওয়া যায় যাদের সক্রিয় সাহিত্যিক জীবনের পুরো অংশ উনিশ ও বিশ শতকের মধ্যে পরিব্যাপ্ত, বিশ শতকের মধ্যে এসে তাদের বিশেষ উল্লেখযোগ্য সাহিত্য কর্মগুলো প্রকাশিত হয়েছিল। উনিশ শতকে পুনর্জাগরণ সৃষ্টির লক্ষ্যে যখন বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষেত্রে অতীত সন্ধান শুরু হয়েছিল তখন একদিকে লোকজীবন ও লোকসাহিত্য অনুসন্ধানের জন্য আগ্রহ জন্মে তেমনি অতীত ইতিহাসের মধ্যে আবেগমন্ডিত সফর শুরু হয়। লোকজীবনে ও সমাজে প্রচলিত রূপকথাগুলো পুনর্জীবনপ্রাপ্ত হয়ে শিশুসাহিত্যে এসে আশ্রয় করে নেয়। বিশ শতকে এর জের চলতে থাকে। অতীত ইতিহাস উপাখ্যান ইত্যাদি সূত্রে রামায়ণ, মহাভারত ও পৌরাণিক কাহিণীগুলো শিশুসাহিত্যের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ অধিকার করে। রামায়ণ, মহাভারত ও পৌরাণিক কাহিণীগুলোর সঙ্গে সমকালীন সমাজ জীবনের সম্পর্ক স্থাপনের সমস্যা ছিল অনেক, ফলে শিশুসাহিত্যে এসবের পুনর্র্বাসনের বিষয়টি সহজ ছিল। কেবল রূপকথার কাহিনীতে নয় ছড়ায়. কবিতায় সর্বত্রই পৌরাণিক কাহিনীর আবেগকে গ্রহণ করে নেবার আগ্রহ লক্ষ্য করা যায়। এভাবে বাংলা শিশুসাহিত্যের প্রথম দিকে গভীর সমাজসম্পর্কযুক্ত হয়ে উঠলেও পৌরাণিক আচ্ছাদনকে সহজে ত্যাগ করতে পারেনি। এই নতুন পথ নির্মাণ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। রূপকথার মধ্যে তারা ভালোমন্দের পার্র্থক্য সামাজিক নৈতিকতার দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করে রেখেছেন। শিশুসাহিত্যে যে ভুবন রচিত হয়েছিল তার মধ্যে মুক্ত শিশুকে পাওয়া গিয়েছিল।

বাংলা সাহিত্য বিকাশের ধারাবাহিকতায় অপেক্ষাকৃত আধুনিক যুগে বাস্তব জীবনের সাথে ঘনিষ্ট পরিচয় ও নিবিড়তম বন্ধন হচ্ছে সাম্প্রতিক সাহিত্যের স্বরূপ লক্ষণ। শুধু তাই নয় সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দেবত্বের মোহ, অলৌকিকতার মায়াজাল কেটে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই আমরা সংস্কারমুক্ত হওয়ার পরিক্রমায় চোখ পড়তে লাগল মানুষের দিকে, তার মহিমাই ক্রমে ক্রমে হৃদয় ও মন অধিকার করতে লাগল। এই মানবতার সুরই আধুনিক যুগের মূল সুর।

ইতিহাসের আবর্তনের ভিতর দিয়ে সাহিত্যের দেহে ও মনে একটু একটু করে প্রকাশ পেয়েছে এই পরিবর্তনের বিশেষ লক্ষণ- সেই লক্ষণ সমষ্টিই আধুনিক যুগের পরিচয়। আমাদের চিন্তাশক্তির ক্রমবিবর্তনের ভিতর মনীষী কোম্ত্ তিনটি প্রধান স্তরবিভাগ করেছেন। চিন্তার আদিম যুগ, এরপর দার্শনিক চিন্তার যুগ। মানুষের চিন্তার প্রসারের ফলে এখন আমরা এসে পেীছেছি বৈজ্ঞানিক যুগে। এ যুগে সত্য লাভের যথার্থ উপায় হচ্ছে গাণিতিক উপায়, এবং সে সত্য লাভের একমাত্র উদ্দেশ্য হবে এই জীবনকে পূর্ন পরিণতি দান। আধুনিক যুগের লক্ষণ মুক্তির সন্ধান।

 

 

পাদটীকাঃ

১। মুনীর চৌধুরীঃ কয়েকটি জীবন।

২। সখা(১৮৮৩-১৮৯৪)সম্পাদক প্রমদাচরণ সেন।

৩। সাথী Ñভুবনমোহন রায়

৪। বালক (১৮৮৫), সম্পাদক Ñজ্ঞানদানন্দিনী দেবী।

৫। সখা ও সাথী (১৮৯৪)

৬।মুকুল (১৮৯৫),সম্পাদক-শিবনাথ শাস্ত্রী।

৭। অৎঃপষব-১, ঈড়াবহঃরড়হ ড়হ ঃযব জরমযঃং ড়ভ

খ. পৃথিবী পৃষ্ঠে জন্মের পর থেকে নাকি জন্মপূর্ব থেকে ১৮ বছর ধরা হবে তা নিয়ে মতপার্থক্য আছে। এখানে বিভিন্ন রাষ্ট্রের নিজস্ব আইনের মধ্যে থাকার স্বাধীনতা রেখেও মোটামুটিভাবে ১৮ বছর বয়স সীমাকে গ্রহণ করে নেয়া হয়েছে।

দ্র. এবৎবষফরহব ঠড়হ ইঁবৎবহ, ঞযব ওঃবৎহধঃরড়হধষ খধি ড়হ ঃযব জরমযঃং ড়ভ ঃযব ঈযরষফ, উড়ৎফবপযঃ, ১৯৯৫, গধৎঃরহঁং ঘবলযড়ভভ চঁনষরংযবৎং, চচ. ৩৪-৩৫ ঃযব ঈযরষফ, ঊহঃৎু রহঃড় ভড়ৎপব. ২ ঝবঢ়ঃবসনবৎ ১৯৯০. ওনরফ. চ.৮.

৮। তোষিণী (১৯১০) সম্পাদক অনুকুলচন্দ্র শাস্ত্রী। এপ্রিল মাস, শান্তি প্রেস, ঢাকা। বৃটিশ আমলের সবচেয়ে দীর্ঘায়ু শিশু মাসিক পত্রিকা।

৯। শিশু (১৯১২) সম্পাদক বরদাকান্ত মজুমদার।

১০। সন্দেশ (১৯১৩) সম্পাদক উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী।

১১। ভারতীয় কম্যুনিষ্ট পার্টির জন্ম (১৯২২)

১২। আঙুর (১৯২০)

১৩। শিশু সওগাত (বাংলা ১৩৪৪ মাঘ, ১৯১৮ ডিসেম্বর) সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরুদ্দিন।

১৪। শিশু সাথী (মাসিক)(১৩২৯)

১৫। শিশু সাথী (বার্ষিক)(১৩৩২)

১৬. অষবপ, ঊষষরং, অ ঐরংঃড়ৎু ড়ভ ঈযরষফৎবহ,ং জবধফরহম ধহফ খরঃবৎধঃঁৎব’ খড়হফড়হ( ১৯৬৮), ৩৩.

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

গ) বিশ শতকের প্রথম চার দশকের বাংলা শিশুসাহিত্যিকদের রাজনৈতিক, সামাজিক প্রভাব ও শিশুসাহিত্যে তার প্রতিফলন।

 

বিশ শতকের প্রথম দশক থেকে চতুর্থ দশক পর্যন্ত বিস্তৃত ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক পটভুমিতে রচিত বাংলা শিশুসাহিত্যে মৌলিক অবদান রেখেছেনÑরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুকুমার রায়, সুনির্মল বসু ও কাজী নজরুল ইসলাম। এঁরা প্রত্যেকেই সমাজ-জীবন সম্পর্কে সচেতন ছিলেন; তাঁদের কাব্যেও এর প্রতিফলন ঘটেছে। তবে এঁদের প্রত্যেকেরই উপলব্ধি এবং প্রকাশভঙ্গীর মধ্যে পার্থক্য বিদ্যমান।

বিশ শতকের প্রথম দশকে রবীন্দ্রনাথ পরিণতবয়স্ক সাহিত্যিক। ভারতবর্ষের প্রতিটি বিক্ষোভ এবং আন্দোলন রবীন্দ্রনাথের স্পর্শচেতন দেহমনকে জীবনের শেষ পর্যন্ত নাড়া দিয়েছিল। বিশ্বের বিভিন্ন ঘটনাবলী সম্পর্কে তিনি ছিলেন অত্যন্ত সচেতন। স্বদেশের আলোড়ন ও আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথ প্রভাবিত হয়েছিলেন।

উনিশ শতকের শেষে রবীন্দ্রনাথ ’স্বদেশী ভান্ডার’(   )খোলার মাধ্যমে স্বদেশীয়ানার পরিচয় দেন। বাঙালী জাতির মধ্যে সত্যিকার স্বদেশচেতনা জাগল বঙ্গভঙ্গনিবারণ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে। ১৯০৫ থেকে ১৯১১ পর্যন্ত যে বিদেশী পণ্য বর্জন সংক্রান্ত ’স্বদেশী আন্দোলন’ চলে তাতে রবীন্দ্রনাথ স্বদেশী পন্য গ্রহনের কথা বলেন। স্বদেশী আন্দোলন শুধুমাত্র রাজনৈতিক দিক দিয়েই নয় এর অপর একটি তাৎপর্য হল যে এই সময় থেকে ভারতে বৈপ্লবিক আন্দোলন বাঙালী জীবন ও মননের ক্ষেত্রে এক অপরিসীম প্রভাব সৃষ্টি করে Ñ বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এক নতুন উদ্দীপনা ও প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। দেশব্যাপী তীব্র আলোড়ন ও উত্তেজনার মুখে তিনি স্বদেশপ্রেমমূলক বহু কবিতা ও গানের মাধ্যমে তাঁর এই চিত্তবৃত্তির পরিচয় দেন। বস্তুত ভারতবর্ষের পরাজয়ের গ্লানি, ব্যক্তিত্বহীন মানুষের বক্র মেরুদন্ড কবিকে বেদনা দিয়েছে সমস্ত লজ্জা ভয় অপমানরাশি কঠিন আঘাতে বিদীর্ন হোক, শুভবোধ জাগ্রত হোক সমগ্র জাতির, এ প্রার্থনা তিনি বার বার করেছেন। তিনি হিংসার পথকে সমর্থন করেননি।

স্বদেশী আন্দোলনের সূচনায় মুসলমান সম্প্রদায় হিন্দুদের সঙ্গে যৌথভাবে আন্দোলনে সামিল হয়েছিল। বাংলা সাহিত্যে বিশেষত গান, নাটক ও লোকগীতির ক্ষেত্রে স্বদেশী ভাবধারার প্রসার ঘটে। হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতির জন্য, যেমন কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে আবেগ সঞ্চারিত হয়, মুসলমান গাড়োয়ানের হাতে রাখী বাঁধতে ররীন্দ্রনাথ ঠাকুর এগিয়ে আসেন। কিন্তু সমস্ত প্রয়াসের কৃত্রিমতা অল্পকালের মধ্যেই তিনি অনুধাবন করেন যে, হিন্দু ও মুসলমান কেবল স্বতন্ত্র নয় বিরুদ্ধও এবং হিন্দু মুসলমানের ’ঐক্য অপেক্ষা সমকক্ষতা অধিক জরুরী। ইংরেজ শাসনের রূঢ় ও নির্মম স্বরূপ জাতির সামনে উদঘাটিত হতে লাগল। এরই জের স্বরূপ ব্রিটিশ কর্তৃক জালিয়ানওয়ালাবাগের নির্মম হত্যাকান্ডের (১৯১৯) প্রতিবাদে তিনি তাঁর ’নাইট’ উপাধি পরিত্যাগ করেন।

স্বদেশী আন্দোলনের সময় বাংলায় ধর্মচেতনা বা ভারত চেতনার চেয়ে বাঙালী চেতনাই বেশী কাজ করেছিল। বঙ্গভঙ্গবিরোধী  আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বাঙালি চেতনা একটি সুস্পষ্ট সৃজনশীল  আকার ধারণ করেছিল।

অন্যদিকে, ধর্মের নামে বাড়াবাড়িতে তাঁর ছিল ঘোর আপত্তি। ১৯২৬ সালের ২রা এপ্রিল মসজিদের সামনে আর্যসমাজবাদীদের ধর্মীয় উৎসবে মিছিলের বাজনা বাজানো উপলক্ষে কলকাতায় দাঙ্গার প্রতিবাদে তিনি ভাষণ দেন।

দেশের বিভিন্ন আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথ নিষ্ক্রিয় ছিলেন না একথা ঠিক তবে তাঁর কর্মকান্ড মূলতঃ সীমাবদ্ধ ছিল তাঁর সমাজকল্যাণমূলক বিভিন্ন ভাষণ, রচনা, প্রতিবাদ এবং জনকল্যাণমূলক কাজের মধ্যে, কবিতার মধ্যে ততটা নয়। প্রত্যক্ষভাবে তিনি কখনো কোন রাজনৈতিক আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিলেন না। উদ্দাম আবেগ নিয়ে কবিতার মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারেন নি। এর কারণ নিহিত তাঁর আপন কবিসত্তায়।

’একদিকে তাঁহার বিদ্রোহ ও বলিষ্ঠ সংগ্রাম প্রবণতা এবং গঠনমূলক বাস্তব কর্ম ও সংগ্রাম বিমুখতা এবং শান্ত               রসনিমগ্নতাÑসারা জীবনই কবি মানসের এই দুই পরস্পরবিরোধী প্রবণতার অন্তর্দ্বন্দ্ব ও সংঘাত চলিয়াছে।১৭

বিশ্বব্যাপি শোষণস্পৃহার আন্তর্জাতিক রূপ এবং জাতীয় জীবনে এই শোষণের রূপ তিনি প্রত্যক্ষ করেছিলেন গভীর বেদনার সঙ্গে। তবে এই শোষণের নির্মমতার রূপটি তিনি যতটুুকু উপলব্ধি করেছিলেন সে তুলনায় তাঁর কবিতায় এর প্রতিফলন কম।

একথা ঠিক দেশের শিল্প, সাহিত্য সংস্কৃতির ধারক ও বাহক ছিলেন রবীন্দ্রনাথ কিন্তু উপমহাদেশের প্রধান যে সামাজিক সমস্যা যে প্রধান দুই ধর্মভিত্তিক গোষ্ঠী হিন্দু মুসলিম মিলনের কোন সুস্পষ্ট সমাধান দিতে পারেননি।(সময়) তাঁর কাব্যের বিষয়রূপে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক ক্রমশঃ তার গুরুত্ব হারাতে থাকে।

রবীন্দ্রনাথের বহুমুখী প্রতিভার পাশাপাশি উপেন্দ্রকিশোর রায় তখন বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে একটি বিশেষ শক্তিরূপে বিরাজমান। শিশুসাহিত্যের অভাব অনুভব করে তিনি উনিশ শতকের শেষ থেকে শিশুসাহিত্য সাধনায় আত্মনিয়োগ করেন। বিশ শতকের প্রারম্ভে তিনি একমাত্র মৌলিক শিশুসাহিত্যিক যাঁর সমস্ত সত্তা শিশুসাহিত্যে ব্যাপৃত।

উপেন্দ্রকিশোর রায় প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে যোগ দেন নি। শ্রীহট্টের জনৈক চা-কর সাহেবের বুটের লাথিতে উমেশ নামে এক কুলীর মৃত্যুর ঘটনায় রচিত কবিতা ’প্লীহা রক্ষক’ তাঁর রাজনৈতিক চেতনা ও ঘটনার সাক্ষ্য বহন করে। ১৩১০ সালের কার্তিক সংখ্যা ’প্রবাসী’তে তাঁর একটি পলিটিক্যাল স্যাটায়ার ছাপা হয়েছিল। এর পাঁচ বছর পরে’ গড়ফবৎহ জবারবি ’ পত্রিকায় ( আগষ্ট সংখ্যা, ১৯০৮) তাঁর অঙ্কিত ছবিসহ লেখাটি পুনঃ প্রকাশিত হয়েছিল। ভারতী ১৩১০ আষাঢ় সংখ্যায় ( বিলাতী ঘুষি বনাম দেশী কিল ) ও কার্তিক সংখ্যায় ( কিঞ্চিৎ উত্তম মধ্যম ) লেখায় ইংরেজের অত্যাচারের বিরুদ্ধে নিস্ক্রিয়তাকে ব্যঙ্গ কৌতুকের ছলে তিরস্কার করা হয়েছিল।

বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের সময় জাতীয় নেতাদের ছবির ব্লক তৈরি হত ইউ, রায়ের কারখানায়। ’প্রবাসী’ পত্রিকার ১৩১৬, জৈষ্ঠ্য সংখ্যায়, আলিপুর বোমা হামলায় সদ্যমুক্ত অরবিন্দের ছবি উপেন্দ্রকিশোর রায়ের তৈরী ব্লকে ছাপা হয়েছিল।

প্রথম মহাযুদ্ধের পর যে কবিবৃন্দ স্বাতন্ত্র্য ও বৈশিষ্ট্যে লক্ষ্যণীয়ভাবে রবীন্দ্রপ্রভাবকে অতিক্রম করেছিলেন এবং বাংলা সাহিত্যে বিশেষ স্থান অধিকার করেছিলেন তাঁদের মধ্যে বিশেষভাবে স্মরণীয় সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত (১৮৮২-১৯২৭)। (সত্যেন্দ্রনাথ দেেত্তর প্রধান মৌলিক কাব্যগ্রন্থগুলি প্রথম মহাযুদ্ধ শেষ হবার আগেই প্রকাশিত (বেণু ও বীণা), (কুহু ও কেকা) বের হয়েছে। রবীন্দ্র-রশ্মির প্রখর উজ্জ্বলতা সত্ত্বেও বাংলা সংস্কৃতির গগনে সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত দীপ্যমান ছিলেন।

সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত প্রথম মহাসাম্যের গান গেয়েছেন, শ্রমিক শক্তির বন্দনা করেছেন, ভারতবর্ষ ও বাংলার প্রাচীন প্রদীপ্ত ঐতিহ্যের কীর্তিগাথা শুনিয়েছেন। তিনিই প্রথম শ্রমিক ধর্মঘটের উপর কবিতা লিখেছেন। বিশ শতকের প্রথম দুই দশকের যাবতীয় স্বদেশী আন্দোলনের সঙ্গে তাঁর অন্তরের যোগ ছিল, বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন থেকে অসহযোগ আন্দোলন পর্যন্ত সমসাময়িক কোন ঘটনাই তাঁর চোখ এড়িয়ে যায়নি, কিন্তু তিনি প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতিতে যোগ দেননি। তিনি যুগের ভাবনাচিন্তা, আশা-আকাংখাকেও অন্তরে স্থাপন করেছিলেন। স্বদেশ এবং সমকালীন সমাজ সম্বন্ধেও সচেতন ছিলেন এবং কবিতায় স্বদেশানুরাগের পরিচয় দিয়েছেন কিন্তু রাজনৈতিক কর্মকান্ডের শরিক তিনি নন। সমালোচকের মতে,

. . . সত্যেন্দ্রনাথ রাজনৈতিক কর্মপ্রবাহের পাশে দাঁড়িয়ে দেখেছেন, ভেসে যাননি স্রোতে।’ ১

কিন্তু এঁদের সঙ্গে নজরুল প্রতিভার কোন বিশেষ সাজুয্য ছিল না। ডঃ সুশীলকুমার গুপ্ত সত্যেন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুল মানসের প্রকাশরীতির সাযুজ্য খুঁজতে চেষ্টা করেছেন। কিন্তু প্রগতিমূলক চিন্তাধারা সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলা সাহিত্যে অনেক কবিতায় প্রথম নিয়ে এলেও সেই চিন্তাধারার উৎস যতটা ভাবকল্পনায় ততটা প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় ছিল না। নজরুলের প্রত্যক্ষ ও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা তাঁর কাব্যচিন্তা ও বক্তব্যকে সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের চাইতে অনেকক্ষেত্রে বহুগুণে তীব্র ও গভীর করে তুলেছে। সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের চারণ কবির ভূমিকাটি একমাত্র নজরুল ইসলাম ছাড়া আর কেউ গ্রহণ করতে পারেননি একথা সত্য, তবে সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের বাস্তবতা নজরুল-সাহিত্যে আরও প্রখর ও দুত্যিমান হয়ে উঠেছে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার পরশমনির স্পর্শে।

রাজনৈতিক সচেতনতা সুকুমার রায়ের মধ্যে বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয় হলেও সুকুমার রায় প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন না। বোয়ার যুদ্ধে বৃটিশের জয়ে তিনি উল্লসিত হন নি। সুকুমারের বোন পুণ্যলতার স্মৃতিকথা থেকে জানা যায় তার পরিবারে বৃটিশের জয়ে আনন্দ প্রকাশে সুকুমার ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন,

’নিজেরা কাদায় পড়ে আছি আবার অন্যের সর্বনাশে আনন্দ করতে লজ্জা করে না?’পৃ-২০

বিশ শতকের প্রথম দিক থেকে বঙ্গভঙ্গের পর যখন দেশাত্মবোধ একটু একটু করে দানা বাঁধছিল সেই সময়ে সুকুমার রায় রচিত গানে ’টুটিল কি আজি ঘুমের ঘোর’ এই সচেতনতারই ইঙ্গিত বহন করে।২ -পৃ২৩ ( সুকুমার, লীলা মজুমদার )

সুনির্মল বসুর রচনায় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সাথে যোগ হয়েছে মানবতাবাদ কিন্তু কোন রাজনৈতিক কর্মপ্রবাহের শরীক তিনি ছিলেন না। স্বদেশী আন্দোলনের প্রাক্কালে তার দাদামশায় বৃটিশ পুলিশ কর্তৃক গ্রেফতার হন। ছাড়া পাবার দিন সুনির্মল বসু বাড়ীতে অন্য সবার সঙ্গে গান ধরেন,

বন্দে মাতরম্, মাতরম্Ñ

উঠিছে ধ্বনি কি মধুরম,Ñ

মরতের জয়ধ্বনি স্বর্গের আসন কাঁপাইল।৩

ইত্যাদি।২১…সু,৩য় পৃ১৬৮

 

বরঞ্চ বৃটিশের জয়ে তিনি উল্লসিতই হয়েছেন।

প্রথম মহাযুদ্ধ যেদিন শেষ হলÑখবরের কাগজে সেদিন সকালবেলা যুদ্ধবিরতির সংবাদ ছাপা হল, সেদিন গিরিডির ছেলেরা ও যুবকেরা মিলে একটা মিছিল বের করল। তাতে সমবেত স্বরে এই গানটি গাওয়া হোলো,

রণে জার্মানের পরাজয়

ওরে বৃটিশের হোল জয়। ইত্যাদি-

—————————–

আমরা নেচে নেচে গান করছিলাম।৪ ২২… সু ৩য় খন্ড পৃ২৯০

বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকের দ্বন্দ্বমুখর রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবেশে কাজী নজরুল ইসলামের কবিত্ব শক্তির স্ফূরণ ও বিকাশ ঘটে। নজরুল প্রতিভা যে যুগের ভিতর উদিত ও অস্তমিত হয় সেই যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি, গীতিকার ও সুরকার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১)। যুগের আশা-আকাংখা দ্বন্দ্ব নজরুল ইসলামের জীবন ও কাব্যে যেভাবে মূর্ত হয়ে উঠেছে সমসাময়িক শিশুসাহিত্যে তেমন দেখা যায় না।

অগ্রহায়ণ ১৩৫২ সংখ্যায় কাজী আবদুল ওদুদ ’আধুনিক বাংলা সাহিত্য’৫ শীর্ষক প্রবন্ধে নজরুল প্রতিভা সম্পর্কে আলোচনা করেছেন,

স্বদেশী আন্দোলনের সমস্ত বীর্য নিয়ে তিনি বাংলা সাহিত্যে আবির্ভূত হলেন। —–নজরুল ইসলাম এ        কালের      বাঙালী মুসলমানদের মধ্যে প্রথম সাহিত্যিক যিনি বাংলার মুসলমান ও হিন্দু উভয়ের চিত্ত আন্দোলিত করতে সমর্থ হলেন।——-একালে দেশের যে গণশক্তির উত্থান তার মূলে নজরুল প্রতিভা বিশেষভাবে কার্যকরী                 হয়েছে। এই দিক দিয়ে তার ঐতিহাসিক মর্যাদা অসাধারণ।

১৩৩৪ সালের জৈষ্ঠ সংখ্যায় আবুল কালাম শামসুদ্দিন তাঁকে মৌলিক প্রতিভা বলে অভিহিত করেন,

‘নজরুল ইসলামকে বাংলার সর্বশ্রেষ্ঠ মৌলিক এবং বস্তুতান্ত্রিক কবি বলিয়া অভিনন্দিত করি।’

নজরুল ইসলাম প্রথম যুদ্ধের সময় করাচীর সেনানিবাসে ৪৯ নং বাঙালি পল্টনের সৈনিক ছিলেন। পরে হাবিলদার পদে উন্নীত হন। ১৯২০ সালে পল্টন ভেঙ্গে গেলে কলকাতায় এসে ৩২ নং কলেজ স্ট্রীটে মুজফফর আহমেদের বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির অফিসে এসে ওঠেন।*

অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলনকে (১৯২০-২২) কেন্দ্র করে সাময়িক হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতি গড়ে ওঠার প্রাক্কালে রাজনীতিক্ষেত্রে কাজী নজরুল ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। মুজফ্ফর আহমদ ও নজরুলের যৌথ পরিচালনায় প্রকাশিত) ’নবযুগ’৫ (১৯২০ জুলাই – ১৯২১ জানুয়ারী) পত্রিকায় একদিকে তাঁর রাজনৈতিক চেতনার পরিচয় পাওয়া যায়, অন্যদিকে শোনা যায় কৃষক-শ্রমিকের ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য বলিষ্ঠ কন্ঠস্বর। এই উর্মিময় রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে রচিত হয় তাঁর বিখ্যাত’ বিদ্রোহী’ কবিতা (ডিসেম্বর, ১৯২১)। তাঁর এ বিদ্রোহ ছিল আন্তর্জাতিকতাবোধে সংসিক্ত। শুধু এদেশেই নয় আন্তর্জাতিক বিশ্বেও তিনি শান্তির এবং পীড়নমুক্ত ও শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার দৃঢ় সংকল্প করেছিলেন। নজরুল ইসলামের কবিসত্তায় পরস্পরবিরোধী অস্তিত্ব দীপ্যমান, একই সময়ে ’অগ্নি’ ও ’বীণা’র সার্থক সমন্বয় ঘটিয়েছেন তিনি এবং একই সময়ে রচিত হয় তার বিখ্যাত শিশুকবিতাসমূহ।

নজরুলের নিজস্ব মালিকানায় ১৯২২ সালের ১২ই আগষ্ট অর্ধ-সাপ্তাহিক ’ধূমকেতু’ প্রকাশিত হলে এর মাধ্যমে প্রকাশিত হতে থাকে নজরুলের বহু উদ্দীপনামূলক কবিতা, রাজনৈতিক আদর্শ এবং ভারতের স্বাধীনতার দাবী স^রাজ। সেই সংগে প্রাণ পায় স্তিমিত সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন। ’অসহযোগ আন্দোলনে’র ফলে বাংলাদেশে সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী অন্দোলন চাপা পড়ে গিয়েছিল। ‘ধূমকেতু’তে নজরুলের লেখার ফলে সে আন্দোলন আবার চাঙ্গা হয়ে উঠেছিল। সন্ত্রাসবাদী দলের আনুষ্ঠানিক বা প্রাতিষ্ঠানিক সদস্য না হলেও সন্ত্রাসবাদের প্রতি ছিল তাঁর আন্তরিক সমর্থন। এ পত্রিকার মাধ্যমে তিনি সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন পুনর্গঠন করার চেষ্টা চালান। ’ধূমকেতু’তে প্রকাশিত শীর্র্ষক ’আনন্দময়ীর আগমনে’ (২৬শে সেপ্টেম্বর, ১৯২২)৬ কবিতার জন্য এক বছর সশ্রম কারাদন্ডাদেশ প্রাপ্ত (১৬ জানুয়ারী) হন। এই সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের সঙ্গে সঙ্গে নজরুল ভারতবর্ষের কমিউনিষ্ট আন্দোলন দ্বারাও প্রভাবিত হন – যার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মুজফ্ফর আহমদ।

’স্বরাজ’ সম্পর্কে নানা ব্যাখ্যা নানা মত ও সামন্ত বুর্জোয়া সুবিধাবাদের এ পটভূমিকায় নজরুল তাঁর ’ধূমকেতু’ পত্রিকায় স্বরাজের ধারণা  প্রত্যাখান করেন। তিনি ভারতবর্ষের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি উত্থাপন করেন।

অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলন বন্ধের ফলে সারাদেশে হতাশা ও সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি হয়। জাতীয় ঐক্য ভেঙ্গে যায়। এরই মধ্যে একদল তরুণ স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে আবারও সশস্ত্র বিপ্লবের পথে পা বাডায়। নজরুল এই ধারার সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন। তাঁর মতে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমেই স্বাধীনতা সম্ভব। দেশবাসীকে সঠিক তথা বিপ্লবের পথে ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করেছেন। তিনি ভারতবাসীকে বোঝাতে চেয়েছেন একমাত্র সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমেই অত্যাচারী ইংরেজদের হাত থেকে দেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনা সম্ভব।

ভারতবর্ষে রাজনৈতিক আন্দোলনের যে ধারাটি বিপ্লববাদের দিকে ঝুঁকে পড়েছিল, নজরুল ছিলেন তাদের সমর্থক। স্বদেশ ও বিদেশে মুক্তি অন্দোলনের দিকে তাঁর তীব্র আকর্ষণ প্রকাশ পেয়েছে। জাতীয়তাবাদের প্রধান বৈশিষ্ট্যপূর্ণ স্বাধীনতার কামনা যা নজরুল কাব্যে প্রথম থেকেই ব্যক্ত হয়েছে। তিনি ছিলেন আপোষবিরোধী বিপ্লবী, স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সতীর্থ।

এই উপমহাদেশে রাজনৈতিক আন্দোলনের সবচেয়ে জটিলগ্রন্থি সাম্প্রদায়িকতা। মওলানা মোহাম্মদ আলী বলেছেন,

যে সমস্যা আমাদের সমুদয় প্রচেষ্টা বারে বারে ব্যর্থ করে দিচ্ছে তা হিন্দু মুসলিম সমস্যা। মওলানা মোহাম্মদ আলীর বক্তৃতা ও রচনাবলীÑচৌধুরী শামসুর রহমান অনুদিত।৭

এর বিষাক্ত স্পর্শ এদেশে কম বুদ্ধিজীবিই এড়াতে পেরেছেন। নজরুল ইসলাম এই সাম্প্রদায়িকতা কখনোই মেনে নিতে পারেননি। সাহিত্যিক জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তিনি সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে আপোষহীন সংগ্রাম করে গেছেন।

তাকে একাধিকবার রাজরোষের কবলে পড়তে হয়েছিল। ভারতবর্ষের মুক্তি সংগ্রামের অগ্রগণ্য নেতৃবৃন্দ যেমন চিত্তরঞ্জন প্রমুখ সম্পর্কে তিনি কবিতা, গান, প্রবন্ধ ইত্যাদি রচনা করেন। তবে তিনি কবি ও গীতিকার বলে তাঁর রোমান্টিক ভাবকল্পনা মুক্তিসংগ্রামের ভাবপ্রবণ আদর্শই তাঁকে আকর্ষণ করতো বেশী। নজরুল জন্মেছিলেন নিুমধ্যবিত্ত পরিবারে। কংগ্রেস ধনিক শ্রেনীর স্বার্থ সংরক্ষণে সচেষ্ট ছিল, সে আপামর জনসাধারণের আশা-আকাংখার সার্থক প্রতিনিধিত্ব করতে পারেনি। তাই জনসমাজের একাংশ সন্ত্রাসবাদকে আশ্রয় করে মুক্তিযুদ্ধের ক্ষেত্রে এক নতুন অধ্যায় সৃষ্টি করতে অগ্রসর হয়। নজরুলের ভাবপ্রবণ কবিচিত্ত সহজেই এই সন্ত্রাসবাদকে বরণ করে নেয়। বিদেশী বিপ্লববাদী আন্দোলনের ইতিহাসও তাঁর কবিসত্তার মর্মমূলে ঢেউ সঞ্চার করে। সন্ত্রাসবাদীদের উপর ইংরেজ সরকারের নির্যাতনে ক্ষুব্ধ কবি রবীন্দ্রনাথ অনেক সময়ই তাঁর কবিতার মাধ্যমে কিংবা অন্যবিধ উপায়ে সন্ত্রাসবাদীদের পক্ষ অবলম্বন করেছেন, কিন্তু পরবর্তীতে তাঁর বাণী বিপ্লবীদের পথে আলোকসম্পাত করতে ব্যর্থ হয়। এক সময়ে স্বদেশী আন্দোলনে জড়িত হলেও তিনি যখন আকাশমার্গে নিরুদ্দেশ হয়ে যাচ্ছেন তখন  নজরুলের ভাষায়,

রবির শিখা ছড়িয়ে পড়ে দিক হতে আজ দিগন্তরে,

সে কর শুধু পশলো না মা অন্ধ কারার বন্ধ ঘরে।

সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন যে নজরুলের মধ্যে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল তার প্রমাণ তাঁর অজস্র রচনায় (ক্ষুদিরাম বসু, সূর্য সেন প্রমুখ) ছড়িয়ে আছে।

সাম্যের আকাঙ্খা নজরুল ইসলামের সমাজচেতনার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এই সাম্যবোধের প্রকাশ তাঁর পূর্বসূরী সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের (১৯৮২-১৯২২) কবিতায়ও প্রকাশ পেয়েছিল। তাঁর কবিতায় সামাজিক ভেদাভেদের বিষয়টি বেশী প্রাধান্য লাভ করে, শোষিত মজুর কৃষকের দুঃখ-দুর্দশার ব্যাপারটিও তাঁর দৃষ্টিতে এড়িয়ে যায়নি সত্য কিন্তু তবু তাঁর চেতনায় সাম্যের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক রূপ স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয়নি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, নজরুল তাঁর সমকালীন বামপন্থী রাজনীতির কাছাকাছি ছিলেন। তাঁর নিকটতম সঙ্গী ও বন্ধু মুজফফর আহমেদ (১৯৮৯-১৯৭৩) সহকর্মী সাংবাদিক হিসেবে কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র লাঙল’ (১৯২৫-২৬) পত্রিকায় কাজ করেন। নজরুল ’সাম্যের গান’, চাষীদের গান’, সব্যসাচী’ প্রভৃতি লিখে এই পত্রিকাকে জনপ্রিয় করেন। কৃষক শ্রমিকের পত্রিকা ’লাঙল’(১৯২৫) ম্যানিফেস্টোতে ছিল,

নারী পুরুষ নির্বিশেষে রাজনৈতিক সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সাম্যের উপর প্রতিষ্ঠিত ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতাসূচক স্বরাজ লাভই এই দলের উদ্দেশ্য। লাঙল, ১ম সংখ্যা ১৬ই ডিসেম্বর ১৯২্৫।৮

এ প্রসঙ্গে বুদ্ধদেব বসু বলেন,

আজকাল যে সাম্যের বাণী লোকের মুখে মুখে বুলিতে পরিণত হয়েছে বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে নজরুল তার প্রথম উদ্যোক্তা।৯

শাসন সংস্কারের নিমিত্ত ’সাইমন কমিশন’ (১৯২৭) রিপোর্টকে নজরুল ’সাইমন কমিশনের রিপোর্ট’ শীর্ষক কবিতার হাস্যব্যঙ্গ রসের মাধ্যমে কমিশনের ভারত বিদ্বেষী দৃষ্টিভঙ্গী তুলে ধরেন। তাঁর শেষ উপন্যাস ’কুহেলিকা’ (১৯৩১)য় তিনি সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী আন্দোলনে যুক্ত হবার প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করেছেন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর অনেক কবিতা সংগীত ও প্রবন্ধে দেশের মুক্তি আকাঙ্খাকে ভাষা দিলেন, সত্যেন্দ্রনাথের কাব্যে দেশীয় চেতনার আলোকপাত হল। দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার রূপকথার আশ্রয় নিলেন। গান্ধীজীর নেতৃত্বে শুরু হল অসহযোগ আন্দোলন। কিন্তু জাতির স্বপ্ন, আশা ও আকাংখা রবীন্দ্রনাথ প্রমুখ কোন সাহিত্য নায়কের মধ্যেই বাঞ্জিতভাবে ভাষা পেল না। তখন অগ্নি-বীণা হাতে নজরুল জাতীয় চারণ কবির মূর্তিতে আবির্ভূত হলেন। তাঁর দারিদ্র্যলাঞ্জিত জীবন, তাঁর সৈনিক জীবনের মোহভঙ্গজনিত অভিজ্ঞতা ও কয়েকজন জননায়কের সঙ্গে সৌহার্দ্য তাঁকে জনজীবনের সঙ্গে একসূত্রে গ্রথিত করল। ইংরেজ শাসনের প্রতি তার কোন মোহ কিছুতই তাঁর পক্ষে সম্ভব হল না। পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি করলেন তিনি। জনসাধারণের সংঘবদ্ধ শক্তির তীব্রতাকে তিনি অনুভব করলেন। ব্রিটিশ শাসনের ক্ষমতাকে উপেক্ষা করা তাঁর পক্ষে সহজ হ’য়ে উঠল।

প্রথম মহাযুদ্ধোত্তর নজরুলের ভূমিকা এ দেশের যে কোন কবির চেয়ে সক্রিয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পৃথিবীর ভাব জগতে যে সুদূরপ্রসারী পরিবর্তনের সৃষ্টি করেছিল নজরুলে তা তত্ত্বগতভাবে আসেনি। মহাযুদ্ধের ফলে রবীন্দ্রনাথের প্রতিক্রিয়া (দ্রষ্টব্য, বলাকা কাব্যের ’ঝড়ের খেয়া’ কবিতা) এবং ইংরেজী সাহিত্যে যে বিপ্লব দেখা যায় তা নজরুলে এসেছে ভিন্নভাবে। নজরুলের কবি জীবনের শুরু সৈনিক জীবন থেকে, আর যে যুগের চারণকবির ভূমিকা তিনি পালন করেছেন সে যুগের বিক্ষোভ, দ্বন্দ্ব, কোলাহল প্রথম মহাযুদ্ধেরই সৃষ্টি। নজরুলও এই যুগেরই সৃষ্টি, এ যুগের দাবী তিনি মিটিয়েছেন এবং তিনি নতুন যুগ ও মূল্যবোধের সৃষ্টি করেছেন, সে মূূূূূল্যবোধ সমকালীন সামাজিক বাস্তবতা থেকে সৃষ্ট।

বিশ শতকের জাতীয় আন্দোলনের যুগে বাংলা সাহিত্য ও গানে জাতীয়তার স্ফুর্তি হয়েছিল বিশেষ ভাবেই Ñ যেমন সাহিত্যে তেমনি শিশুসাহিত্যে। কবিতা গান, নাটক সর্বত্রই জাতীয়তাবাদকে উজ্জ্বলভাবে ও গভীর আন্তরিকতার সঙ্গে প্রচারের প্রয়াস লক্ষ্যণীয়। এই জাতীয়তাবাদের ঐতিহ্য নজরুল -প্রতিভার উপর সুগভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল।

প্রথম মহাযুদ্ধোত্তর যুগের বিভিন্ন আন্দোলন তাঁকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। তিনি বেশ কিছু রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হয়ে পড়েছিলেন। এইসব আন্দোলনের মধ্যে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন, খিলাফত আন্দোলন, কৃষক-শ্রমিক আন্দোলন প্রভৃতি।

বিশ শতকের প্রথম চার দশকের শিশু সাহিত্যিকগণ এসেছিলেন মধ্যবিত্ত বা জমিদার পরিবার থেকে। তাই তাঁদের রচনায় জনসাধারণের মর্মজ্বালা ও আশা-আকাংখা তেমন তীব্রতা নিয়ে ব্যক্ত হয়নি। এঁদের মধ্যে সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কবিতায় খাঁটি স্বদেশপ্রেম প্রকাশিত হযেছে। অন্যরা চেয়েছিলেন ব্রিটিশ শাসনের সুব্যবস্থার মধ্যে থেকেই সম্ভবমতো রাজনীতিক, অর্র্থনীতিক ও সামাজিক সুযোগ সুবিধা ভোগ করতে। ইংরেজ শাসনের পূর্ন অবসান তো তারা চানইনি বরং তাঁদের কেউ কেউ ব্রিটিশ রাজশক্তির রক্ষায় ও জয়কর্তীনে তৎপর ছিলেন। কোনও সংঘবদ্ধ গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ রাজত্বেও পুর্ণোচ্ছেদের স্বপ্ন তাারা দেখেন নি। স্বদেশপ্রেমের যেটুকু স্ফূরণ তাঁদের রচনায় দেখা যায় তাও বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে সহানুভূতিশীল ভাবলোকেই সীমাবদ্ধ। এর একটি বিশেষ কারণ Ñইংরেজী শিক্ষাদীক্ষার সংর্স্পশেই স্বদেশপ্রেমের সত্যিকার স্বরূপ অনেকের মনে অঙ্কুরিত হয়েছিল। তাই সহসা ইংরেজদের প্রতি তাঁদের দুর্র্র্বলতা ও মমত্ব^ তাঁরা জয় করতে পারেন নি।

(১৯১৯-২০)সাল থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনে ভারত যে আশা সাহস, যে উৎসাহ উদ্দীপনা, যে বিদ্রোহ অস্থিরতা সৃষ্টি করেছিল নজরুল সাহিত্যে তার গাঢ় প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। কংগ্রেস-মুসলিম লীগ প্রভৃতি জাতীয়তাবাদী দল যখন শান্তি শৃঙ্খলার মাধ্যমে স্বাধীনতার) জাতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনে তাঁর কবিতা গান (অগ্নিবীণা, (১৯২২), বিষের বাঁশি (১৯২৪), ভাঙার গান (১৯২৪) যথেষ্ট উত্তাপ সঞ্চার করেছে ও জাতিকে বিদ্রোহের পথে সংগ্রামের পথে বার বার আহ্বান জানিয়েছে।

প্রথম মহাযুদ্ধের পর বাংলাদেশের সমস্যা ও সংকট অনেকখানি নজরুল সৃষ্টির মধ্যে বিধৃত হয়েছে। জনসমাজের আশা আকাংখা ও বেদনা নৈরাশ্যের যথাযোগ্য প্রতিনিধিত্ব করতে পেরেছিলেন। নজরুল সাহিত্য ও সংগীতে জনজাগরণ অনণ্যসাধারণ উদ্দীপনা ও উজ্জ্বলতায় কীর্তিত। এর কারণ দেশের কৃষক মজুর ও নিুবিত্ত শ্রেণী স¤পর্কে তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। তিনি নিজে যুদ্ধে গিয়ে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিলেন এবং যুদ্ধোত্তর বাংলার নানা সমস্যা ও সংকটের সম্মুখীন হয়ে দেশের জনসমাজের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে এসেছিলেন। সশস্ত্র বিপ্লবীদের কার্যকলাপও খুব কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল তাঁর। বিপ্লবীদের প্রধান প্রধান কর্মক্ষেত্র কলকাতা, হুগলী, ঢাকা, চট্টগ্রাম প্রভৃতিতে তিনি নাতিদীর্ঘকাল অবস্থান করেন। তাই যুদ্ধোত্তর বাঙলার ভিতরের ও বাইরের রূপ নজরুল সৃষ্টির মধ্যে স্মরণাতীতভাবে প্রতিভাত হয়েছে। আর তা হয়েছে বলেই তাঁর সৃষ্টি আজ জাতীয় সম্পদ বলে গণ্য। নজরুল সে যুগের সবচেয়ে সক্রীয়, প্রাণবন্ত ও যুগধর্মী কবি ও সঙ্গীতকর্মী। নজরুল নিপীড়িত পরাধীন ও আর্ত জনগনের আশা-আকাংখা ও দুঃখ-বেদনা প্রকাশের জন্যে জাতীয় চারণ-কবির মর্যাদা পেয়েছিলেন।

যুদ্ধোত্তর কালের নৈরাশ্য, বেদনা ও অস্থিরতা নজরুল সাহিত্য ও সংগীতে সার্থকভাবে রূপায়িত হয়েছে। কৃষক, শ্রমিক ও নিুমধ্যবিত্ত জীবনের অবক্ষয় ও ভাঙনের ছবি তাঁর সৃষ্টির মধ্যে সার্থকভাবে ধরা পড়েছে। কৃষক ও শ্রমিক সমাজের অভ্যুদয়ে নব-যুগের যে পদধ্বনি শোনা গিয়েছিল তার প্রতিধ্বনিও বেজে উঠেছে তার সাহিত্য ও সংগীতের মর্মস্থলে। নজরুল তাঁর কবিতা-গানে কৃষক ও শ্রমিক জাগরণের আভাস দিয়েই ক্ষান্ত হননি, অগ্নিময়ী ভাষায় তাদের ঐতিহাসিক ভূমিকা বিবৃত করে নতুন যুগের ভাষ্য রচনা করেছেন, শিশুসাহিত্যেও যার প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।

খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলন নজরুল কবি মানসকে গভীরভাবে আলোড়িত ও উদ্বুব্ধ করেছিল। ভারতের রাজনীতিক ক্ষেত্রে হিন্দু মুসলমানের ঐক্য স্থাপন প্রচেষ্টাকে ফলবতী করার অভিপ্রায়ে নজরুল হিন্দুু-সংস্কৃতি ও মুসলিম তমুদ্দনের সম্বন্ধে ভারতীয় সংস্কৃতির গৌরবময় রূপটি ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন (কামাল পাশা ও শাত্-ইল-আরব’ কবিতা দুটিতে।)

স্বদেশী আন্দোলনের যুগে রবীন্দ্রনাথ প্রমুখ বাঙ্গালী কবিগণ যে ভাবে বহুবিধ সঙ্গীত ও কবিতার সাহায্যে      বাঙ্গালীর দেশপ্রেম উদ্বুদ্ধ করেছিলেন, অসহযোগ আন্দোলনের বৃহত্তর বিপ্লবে যে কারণেই হউক, তারা ঠিক    সেভাবে সাড়া দেননি। একমাত্র কাজী নজরুলই ছন্দে গানে এই আন্দোলনকে জয়যুক্ত করেছিলেন। পরবর্তি                 আন্দোলনের চারণকবি তাঁহাকেই বলা যেতে পারে। বাংলাদেশের মত অনড় ও জড়দেশকে জাগাবার জন্য যে          আবেগময় উচ্ছ্বসিত প্রাণ বন্যার প্রয়োজন ছিল, কবি নজরুলের মধ্যে তাহার প্রকাশ ঘটেছিল। কুুল ভাঙ্গা          আবেগের ধাক্কায় এই অনড় জাতিকে প্রাণস্পন্দনে চকিত হইয়া উঠতে আমরাই দেখিয়াছি-শ্রীজনীকান্ত দাস,         বিষের বাঁশী’১

১।সত্যেন্দ্রনাথ রাজনৈতিক কর্মপ্রবাহের পাশে দাঁড়িয়ে দেখেছেন, ভেসে যাননি স্রোতে।’ ১

২ -পৃ২৩ ( সুকুমার, লীলা মজুমদার )

৩।২১…সু,৩য় পৃ১৬৮

৪।২২… সু ৩য় খন্ড পৃ২৯০

৫।১৩৫২ সংখ্যায় কাজী আবদুল ওদুদ ’আধুনিক বাংলা সাহিত্য’

৬।’আনন্দময়ীর আগমনে’ (২৬শে সেপ্টেম্বর, ১৯২২)৬

৭। মওলানা মোহাম্মদ আলী

৮। লাঙল, ১ম সংখ্যা ১৬ই ডিসেম্বর ১৯২্৫।

৯। বুদ্ধদেব বসু বলেন,

১০। শ্রীজনীকান্ত দাস, বিষের বাঁশী’১০

প্রথম পরিচ্ছেদ

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিশুসাহিত্য

(১৮৬১-১৯৪১)

 

রবীন্দ্রনাথ বাংলা শিশুসাহিত্যের অনাবিষ্কৃত দিকটি উন্মোচন করেছেন এবং এই সাহিত্যকে সাহিত্যের খাস দরবারে স্থান দিয়েছেন। বাংলা ১২৬৮, ২৫শে বৈশাখ, ইংরেজী ১৮৬১ সালে, জোড়াসাঁকোর বিখ্যাত ঠাকুর পরিবারে, জমিদার বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখড়ি স্বগৃহে বিভিন্ন শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে সমাপ্ত হয়। পরে বিভিন্ন স্কুলে ভর্তি হন। কিন্তু স্কুলের প্রতি বিতৃষ্ণা থাকায় শেষ পর্যন্ত বাড়িতেই পড়াশুনার ব্যবস্থা হয়, অত্যন্ত পড়ুয়া ও মেধাবী ছিলেন বলে তিনি স্বশিক্ষিত ব্যক্তি মনীষার চূড়ান্ত উদাহরণ বাঙালি জাতির সামনে রেখে যেতে পেরেছেন। তিনি একাধারে কবি, নাট্যকার, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, দার্শনিক, সঙ্গীত রচয়িতা, সুরস্রস্টা, গায়ক, চিত্রশিল্পী, অভিনেতা, সমাজসেবী, শিক্ষাবিদ ও ছোট গল্পকার। রবীন্দ্রনাথের বিরাট সাহিত্যকর্মের পাশে তাঁর শিশুসাহিত্য একটি খন্ডাংশ মাত্র, যদিও শিশুসাহিত্যিক হিসেবেও তাঁর আলাদা এবং ব্যাপক পরিচিতি রয়েছে।

রবীন্দ্রনাথের স্বগৃহে সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিকাশের একটা আবহাওয়া ও পরিবেশ পূর্ব হতেই ছিল। তাঁর পিতামহ ও পিতা সংস্কৃতিসেবী ছিলেন। জৈষ্ঠ্য ভ্রাতা ও পঞ্চম ভ্রাতা সাহিত্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। শিশুসাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে লোককথা এবং ছেলেভুলানো ছড়া সংগ্রহের দ্বারাই তিনি আমাদের প্রথম দৃ্িষ্ট আকর্র্ষণের চেষ্টা করেন।

কেউ ব্যক্তিগত উদ্যোগে কিছু সংগ্রহ করলে তার আলোচনা করা, ভূমিকা লিখে দেওয়া বা কখনো-কখনো নানা পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করা তাঁর নিত্য কৃত্য ছিল।১

রূপকথা, উপকথা, ছড়া ও গান সংগ্রহের দিকে শিশুসাহিত্যের এই ঝোঁকটি কেবল রূপকথার কাল্পনিক জগতের প্রতি শিশুদের স্বাভাবিক টান থেকেই সৃষ্টি হয়নি -এর পিছনে রবীন্দ্রনাথের একটি মস্ত ভুমিকা ছিল। কখনো নীরবে কখনো সরবে তিনি এই ভূমিকা পালন করেছেন। সাহিত্যের এই শাখাটির প্রতি তাঁর উৎসাহ ও শ্রদ্ধার পরিচয় বার বার নানা কাজের মধ্যে ফুটে উঠেছে। লোকসাহিত্য (১৯০৭) গ্রন্থে ছড়ার প্রথম রসজ্ঞ সমালোচনা ও বিশ্লেষণ করেছিলেন; তিনি নিজে লিখেছেনও যেমন, তেমনি লোকসাহিত্যের যে অংশ শিশুসাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে সেই ছেলেভুলানো ছড়া (১৯০৭) সংগ্রহ ও তা প্রকাশের মহান দায়িত্বও তিনি সুষ্ঠুরূপে পালন করেছেন। অবনীন্দ্রনাথকে শিশুসাহিত্য রচনার প্রেরণাও তিনিই দিয়েছিলেন। দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের ’ঠাকুরমার ঝুলি’র (১৯১৫) ভূমিকা লিখে দেওয়া, উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীর ‘ছেলেদের রামায়ণ’ (১৯০৭) ও ’ছেলেদের মহাভারতের’ (১৯০৯) ’গ্রন্থকারের নিবেদন’ লিখে দিয়েছেন, দক্ষিণারঞ্জণের পান্ডুুুুুুুলিপির প্রুফ সংশোধন করে দিয়েছেন। বাংলা সাহিত্যের বহু বিষয়ের মত শিশুসাহিত্যও রবীন্দ্রনাথের হাতেই একটি বিশিষ্টতা লাভ করেছিল। শিশুসাহিত্যের ইতিহাসেও রবীন্দ্রনাথ বহুমুখীন সফলতার এক একক ব্যক্তিত্বরূপে ম্মরণীয়। সেই অত্যুজ্জল ব্যক্তিত্বের ছায়ায় গড়ে উঠেছিল ঠাকুরবাড়ির কৃষ্টিময়তা। শিশুসাহিত্যের আরেক জগৎ।

বিশ শতকের প্রথম থেকেই শিশুসাহিত্যের অনেক লেখকের চেষ্টায় ও উদ্যোগে দেশবিদেশের উপকথা সংগ্রহ করবার ঝোঁক দেখা যেতে লাগলো আর লক্ষ্যণীয় যেটা, এঁদের প্রায় সকলেরই সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের প্রত্যক্ষ পরিচয় ও অনেকের সঙ্গে আত্মীয়তা সম্বন্ধও ছিল।

শিশুসাহিত্যের স্বাধীন ভাবে স্ফূরণ ঘটে ‘বালক’ (১৮৮৫)২ পত্রিকা প্রকাশের মাধ্যমে। রবীন্দ্রনাথের কর্মাধ্যক্ষে পত্রিকাটি ঠাকুরবাড়ী হতে প্রকাশিত হয়। উদ্দেশ্য ’ঠাকুরবাড়ির উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েদের লিখবার সুযোগ’ করে দেয়া। রবীন্দ্রনাথ এর নিয়মিত লেখক ছিলেন। এই পত্রিকার পাতাতে তাঁর কবিতা, প্রবন্ধ, হাস্যকৌতুক, ভ্রমণকাহিনী এবং ধারাবাহিক উপন্যাস প্রকাশিত হয়। এর পৃষ্ঠায় তাঁর প্রথম শিশুপাঠ্য কবিতা৩এই যুগের একটি বিশেষ সৃষ্টি।

’শিশুগ্রন্থে’র রচনামূহ চার ভাগে বিভক্ত। ১.বাৎসল্যভাবময়, ২.বাৎসল্যরসময়, ৩.শিশু-বোধ, ৪.শিশু-কল্পনা।

১.Ñ’জন্মকথা’, ’থোকার রাজ্য’, এবং ’ভিতরে ও বাহিরে’। প্রথম দুটি কবিতায় শিশুমনের অগাধ রহস্য অবগাহনের চেষ্টা।

২.Ñ’খেলা’, ’খোকা’, ’ঘুমচোরা’, ’অপযশ’, ’বিচার’, ’চাতুরী’, নির্লিপ্ত’, ও ’কেন মধুর’ বাৎসল্যরসময়। কবিতাগুলিতে কবির কথা বিবৃত হয়েছে।

৩.- ’প্রশ্ন’, ’সমব্যথী’, ’ব্যাকুল’, ’সমালোচক’, ’জ্যোতিষশাস্ত্র’ ও বৈজ্ঞানিক’।

৪.-’বিচিত্র সাধ’, ’মাষ্টার’, ’বাবু’, বিজ্ঞ,’ ’ছোট-বড়’, ’বীরপুরুষ’, ’রাজার বাডী’, ’নৌকা যাত্রা’, ’ছুটির দিনে’, ’বনবাস’, ’মাতৃবৎসল’, ’লুকোচুরি’, ’দুঃখহারী’, ’মাঝি’ ও ’বিদায়। কবিতাগুলির পিছনে যেন কবির শৈশব কল্পনার পট আছে।

ছেলেভুলানো ছড়াÑ’বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর’, ’সাত ভাই চম্পা’, ’হাসিরাশি’, ’আশীর্বাদ’ (শিশুকাব্যগ্রন্থ) ইত্যাদি।

দর্শন তত্ত্বমূলকÑ’জন্মকথা’, ’খেলা’, ’খোকা’, ’নির্লিপ্ত’, ’কেন মধুর’, বৈজ্ঞানিক’, ’নবীন অতিথি’, ’চাতুরী’, ’খোকার রাজ্য’, ’ভিতরে ও বাহিরে’(শিশু কাব্যগ্রন্থের কবিতাবলী) ইত্যাদি।

বাৎসল্যÑ’ঘুমচোরা’, ’অপযশ’, ’বিচার’, ’জ্যোতিষশাস্ত্র, ’মাতৃবৎসল’, ’লুকোচুরি’, ’বিষয়’, ’মা-লক্ষ্মী’, ’আকুল’ ’আহ্বান’। (শিশু কাব্যগ্রন্থের কবিতাবলী) ইত্যাদি।

সাধারণÑ’প্রশ্ন’, ’সমব্যথী’, ’বিচিত্র সাধ’, ’মাস্টার বাবু’, ’বিজ্ঞ’, ’ব্যাকুল’, ’ছোটোবড়ো’, ’সমালোচক’, ’পরিচয়’, ’কাগজের নৌকা’ (শিশু কাব্যগ্রন্থের কবিতাবলী) ইত্যাদি।

বর্ণনামূলকÑ’রাজার বাড়ি’, ’মাঝি’, ’নৌকাযাত্রা’, ’ছুটির দিনে’, ’বনবাস’ (শিশু কাব্যগ্রন্থের কবিতাবলী) ইত্যাদি।

স্মৃতিচারণমূলকÑ‘বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর’, ‘সাত ভাই চম্পা’,  ’বিচ্ছেদ’, ’উপহার’, ‘পুরনো বট’, ’পাখির পালক’ ইত্যাদি।

শিক্ষামূলকÑ’পূজার সাজ’, ’মা-লক্ষ্মী’ ইত্যাদি।

প্রকৃতি-বিষয়কÑ’শীত’, ’শীতের বিদায়’, ’ফুলের ইতিহাস’ ইত্যাদি।

ব্যঙ্গ কৌতুকÑ’জুতা আবিষ্কার’ ইত্যাদি।

আশীর্বাদমূলকÑ’আশীর্বাদ’ ‘মঙ্গলগীত’ ইত্যাদি।

আদর্শবাদীÑ’পূজোর সাজ’ (শিশুগ্রন্থ) ইত্যাদি।

বীর-রসাত্মক Ñ’বীরপুরুষ’ ইতাদি।

নীতিমূলক কবিতাÑনমস্কার।

অদ্ভূত রসের গল্পÑ’খাপছাড়া’ ’ছড়ার ছবি’ ’ইচ্ছেপূরণ’ ইত্যাদি।

রবীন্দ্রনাথের প্রথম ’কিশোর পাঠ্য’ কবিতা বাংলার বর্ষার আদি ছড়া ’বিষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদেয় এল বান’ অবলম্বনে লিখিত হয় ’বালকে’ (১৮৯৫)র পৃষ্ঠায়। পরবর্তী ছড়া ’সাত ভাই চম্পা’ দুটিই ছেলেভুলানো ছড়া ও রূপকথা অবলম্বনে লেখা। দুটিতেই তিনি পরিণত লেখকের পরিচয় দেন। মেয়েলি ছড়া ও রূপকথার মূল্যের দিকে রবীন্দ্রনাথ এই দুই কবিতা দ্বারাই আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেষ্টা করেন। পরে ছড়া দু’টি ’কড়ি-ও-কোমলে’৪ সংকলিত হয় এবং আরো পরে ’শিশু কাব্যগ্রন্থে’।

রবীন্দ্রনাথের বাণীশিল্পে ছেলে-ভুলানো ছড়ার চিত্রকল্পগুলি যথেচ্ছভাবে ছড়িয়ে আছে। পরবর্তী কালে ’লোকসাহিত্য’ নামক পুস্তকে ’ছেলেভুলানো ছড়া’ প্রবন্ধে লিখেছেন,

’বিষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদেয় এল বান’ এই ছড়াটি বাল্যকালে আমার নিকট মোহমন্ত্রের মতো ছিল এবং সেই মোহ এখনও ভুলিতে পারি নাই।…তখন এই চারিটি ছত্র আমার বাল্যকালের মেঘদূত ছিল।…আমার মানসপটে একটি ঘনমেঘান্ধকার বাদ্লার দিন এবং উত্তাল তরঙ্গিত নদী মূর্তিমান হইয়া দেখা দিত।Ñএই ছড়াটা যেন শৈশবের মেঘদূত। ইহার শব্দচ্ছটা ও ছন্দের দোলা শিশুচিত্তকে মাতাইয়া তুলে এবং তাহার চোখের সামনে নানা বর্ণের বিচিত্র আশ্চর্য ছবি উন্মুক্ত করিয়া ধরে।’৫

রবীন্দ্রনাথের শিশুবিষয়ক-রচনাকে তিন শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। ১ঃ পাঠ্য পুস্তকাদি, ২ঃ শিশুসাহিত্য বলে চিহ্নিত রচনা, ৩ ঃ মূলত বয়স্করচনা।

পাঠ্য পুস্তকের রচনাসমূূহ শিশুসাহিত্য হিসেবে বিবেচিত হয়না। আমরা যে রবীন্দ্র শিশুসাহিত্য পাই তাকে দুটি পর্য়ায়ে ভাগ করা যেতে পারে।

১ম পর্যায়ে-মুকুট, লক্ষ্মীর পরীক্ষা, একটি আষাঢ়ে গল্প, বিম্ববতী, নিদ্রিতা, সুপ্তোত্থিতা, জুতা আবিষ্কার, হিং টিং ছট, কথা ও কাহিনী, হাস্যকৌতুক, ব্যঙ্গ কবিতা, খ্যাতির বিড়ম্বনা, বৈকুন্ঠের খাতা ইত্যাদি।

দ্বিতীয় পর্যায়ে ঋণশোধ, ফাল্গুনী, শারদোৎসব, ডাকঘর, শিশু, শিশু ভোলানাথ’; তারপর সহজ পাঠ-এর কাছাকাছি সময়ে সে, খাপছাড়া, ছড়া, ছড়ার বই, গল্পসল্প, ছেলেবেলা, এমন-কী মরনোত্তর ’চিত্র-বিচিত্র’।

রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যবোধের সঙ্গে তার প্রকৃতিগত বা শিল্পগত কোনো পার্থক্য আছে বলে মনে করেননি, গভীর প্রেরণার বশবর্তী হয়েই তিনি ছোটদের জন্য লিখেছেন ’বালক’ ও ’মুকুলে’র সময় থেকেই তিনি এই প্রেরণার বশবর্তী ছিলেন। দ্বিতীয় পর্য়ায়ে তিনি যখন লিখতে শুরু করেন, তখন বাইরে থেকে তা ছিল নিতান্ত-ই নৈমিত্তিক, একেবারেই তাৎক্ষণিক উপলক্ষঘটিত কারণ, আমরা জানি ’শিশু’ কাব্যগ্রন্থের প্রায় সব ক-টি কবিতাই তিনি রচনা করেছিলেন মাতৃহীন শিশুদের সান্ত¡না দিবার জন্যে, তবে তার নিজের ছেলেবেলাতেও মায়ের সঙ্গে তার দেখা কমই হত, যার বর্ণনা তিনি দিয়েছেন ‘ছেলেবেলা’ বইতে। ফলে মৃণালিনী দেবীর মৃত্যুর পর নিজের মা-হারা ছেলেমেয়েদের মধ্যে তিনি শিশু রবিরই প্রতিচ্ছবি দেখতে পেয়েছিলেন, যাকে বলা যায় তার শৈশব সাধনা, শৈশব থেকে বিচ্যুত কোনো বয়স্কের হৃত শৈশবের জন্য উৎকাংখা, যেটা রোমান্টিক কবিদেরই একটি লক্ষণ। গ্রন্থের কবিতাগুলো কেন লিখেছেন তার জবাব দিয়েছেন  ‘পশ্চিমযাত্রার ডায়ারি’তে (’যাত্রী’),

দেয়ালের মধ্যে কিছুকাল সম্পূর্ণ আটকা পড়লে তবেই মানুষ স্পষ্ট করে আবিষ্কার করে, তার চিত্তের জন্য এত বড়ো আকাশের ফাঁকাটা দরকার। প্রবীনের কেল্লার মধ্যে আটকা পড়ে সেদিন আমি তেমনি করেই আবিষ্কার করেছিলুম’ অন্তরের মধ্যে যে-শিশু আছে তারই খেলার ক্ষেত্র লোকে-লোকান্তরে বিস্তৃত। এইজন্যে কল্পনায় সেই শিশুলীলার মধ্যে ড়ুব দিলুম, সেই শিশুলীলার তরঙ্গে সাঁতার কাঁটলুম, মনটাকে øিগ্ধ করবার জন্যে, নির্মল করবার জন্যে, মুক্ত করবার জন্যে।…৬

রবীন্দ্রনাথ চিরকাল শিশুকে দূর থেকে দেখেছেন, তার সঙ্গে বিচ্ছেদবোধে ব্যথিত হয়েছেন, বারে বারে তৃষিত হয়েছেন তাকে ফিরে পাবার জন্য’ :সেই জন্যই তার এসব রচনা ছিল তাঁর শৈশব সাধনারই অন্তর্ভুক্তঃ – ‘শিশু হবার ভরসা আবার জাগুক আমার প্রাণে/লাগুক হাওয়া নির্ভাবনার পালে’।৭ আরো-একবার তাঁকে শৈশবসাধনা করতে হয়েছিল মুক্তির জন্য, মার্কিন মুলুকের ‘রাক্ষুসে বস্তুগ্রাস’ থেকে বেরিয়ে এসে তিনি ’শিশু ভোলানাথ’ লিখতে বসেছিলেন, ‘বন্দী যেমন ফাঁক পেলেই ছুটে আসে সমুদ্রের ধারে হাওয়া খেতে, তেমনি করে।’৮

বাংলা শিশুসাহিত্যে পত্রসাহিত্যেরও তিনি প্রবর্তক। ’বালক’ পত্রিকায় (তেইশ-চব্বিশ বছর বয়সে) প্রকাশিত ’চিঠিপত্র’ প্রবন্ধটি লেখেন অল্পবয়সীদের জন্য।

কবিতা ও গানের সমাহারে রচিত ’কল্পনা’ (১৯০০) কাব্যগ্রন্থ। কাব্যের অন্তর্গত ’জুতা আবিষ্কার’স্বদেশী আন্দোলনের সময়ে

রচিত একটি উল্লখযোগ্য ব্যঙ্গ কবিতা। দেশের ’নেতা’ এবং ’অভিভাবক’দের কাজ রবীন্দ্রনাথ মেনে নিতে পারেননি। তাঁর

অসন্তোষ দু’একটি কবিতায় সরস ও ঝাঁঝালোভাবে ব্যক্ত হয়েছে। ছেলেভুলানো গল্পের ছাঁদে অত্যন্ত সরল ও সতেজ

কবিতা। বিষয়স্তু রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব বলে মনে হয়। সহজ সমাধান না দেখে যে নেতারা দুরূহ সমাধানের ফিরিস্ত প্রণযন

করেন তারাই কবিতাটির নিগূঢ় ব্যঙ্গের লক্ষ্য। কোনো সমস্যার সহজ-সুন্দর সমাধানের বদলে তাকে জটিল করে তোলা হয়

সদ্বুদ্ধির অভাবের ফলে। হবুরাজা গবুমন্ত্রী সংবাদেই এরই প্রমান দিয়েছেন। কবিতাতে লৌকিক সংস্কারের চিহ্ন ছড়িয়ে

আছে।

’বালক’ ও ’ভারতী’ পর্যায়ে রবীন্দ্রনাথ সক্রিয় সচেতনতায় যে শিশুসাহিত্য সৃষ্টি করেছেন ’নদী’ (১৮৯৫) কবিতাটি তার মধ্যে অন্যতম। পরে ’শিশু’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তত্ত্বশুন্য এবং পরিচিত শব্দের প্রয়োগ, যুক্তাক্ষর বর্জিত শব্দ, যথাসাধ্য পরিচিত পরিবেশের চিত্রাঙ্কিত পনেরো পৃষ্ঠাব্যাপী এই কবিতায় নদীর উৎস, প্রবাহমানতা, পরিণতি ও পথপরিক্রমণের বর্ণনার সবটা শিশুর বোধগম্য নয়।

কবি যখন বলেন, ’শুধু সারা রাত  তারাগুলি, তারে চেয়ে দেখে আঁখি খুলি’ তখন আর শিশুমনের রাজ্যে তার ছাড়পত্র মেলে না। সমগ্র বিষয়টিই তখন রোমান্টিক কবিতার রসমাধুর্যে পূর্ণ হয়ে ওঠে। কবিদৃষ্টির গভীরতায় তা বয়স্কের সামগ্রী হয়ে উঠে। রবীন্দ্রনাথের অধিকাংশ কবিতার শিশুরচনায় ’ঐ আকাশ ওড়া’ ও ভুঁইখেলার দ্বৈতমুখীনতা স্পষ্ট হয়ে আছে। কোথাও কম, কোথাও বেশী, তবে ব্যতিক্রমও আছে।

রবীন্দ্রনাথের প্রথম শিশুসাহিত্য সেই আশ্চর্য মায়াময় কবিতাটি। বালকের প্রথম সংখ্যার (বৈশাখ ১২৯২, ইংরেজি এপ্রিল-মে, ১৮৮৫) প্রথম পাতায় প্রকাশিত হয়েছিল। যার আরম্ভ ছিলÑ

দিনের আলো নিবে এল,

সূয্যি ডোবে ডোবে।

আকাশ ঘিরে মেঘ জুটেছে

চাঁদের লোভে লোভে।

মেঘের উপর মেঘ করেছে-

রঙের উপর রঙ

মন্দিরেতে কাঁসর ঘন্টা

বাজল ঠঙ ঠঙ। ইত্যাদি।

কবিতার শিশু সক্রিয় নয়। সে বয়স্ক স্মৃতিতে বিগত। বর্ষার প্রাকৃতিক পটভূমিতে সেই শৈশবের উদ্ঘাটন।

মনে পড়ে ঘরের কোণে মিটিমিটি আলো/ একটা দিকের দেয়ালেতে ছায়া কালো কালো/ বাইরে কেবল জলের শব্দ ঝুপ ঝুুপ ঝুপ/ দস্যি ছেলে গল্প শোনে একেবারে চুুপ/। তারি সঙ্গে মনে পড়ে মেঘলা দিনের গান-/বিষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদেয় এল বান।

’বালকে’(১৮৮৫)র পৃষ্ঠায় রবীন্দ্রনাথের মুকুট’(বৈশাখÑজ্যৈষ্ঠ) এবং তৃতীয় সংখ্যা ’আষাঢ় মাসে ’রাজর্ষি’ গল্প প্রকাশিত হতে শুরু করে। ক্রমশঃ হেঁয়ালি তথা কৌতুক নাটিকাগুলি; গল্প, ছড়া, গান এবং শেষে সে, গল্পসল্প, খাপছাড়া।

রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যের সর্বপ্রকার কাঠামোতেই শিশুসাহিত্য রচনা করেছিলেন। গল্প, কবিতা, নাটক, ছড়া, রচনাধর্মী সাধারণ গদ্যে তার মুক্তি। বহুক্ষেত্রে বিষয়বস্তুও আকর্ষণ তীব্র হয়ে উঠেছে অসাধারণ ছবির সংযোজনে। সে সব ছবি কখনো এঁকেছেন নন্দলাল, কখনো উপেন্দ্রকিশোর, কখনো অবনীন্দ্রনাথ, কখনো গগনেন্দ্রনাথ।

রবীন্দ্রনাথের প্রধান যে দুটি গ্রন্থ আকর শিশুগ্রন্থ বলে পরিচিত একটি তাঁর “শিশু’ (১৯০৩) ৯ ও ’শিশু ভোলানাথ’(১৯২২)১০।

কবিতা ও গানের সমাহারে রচিত ’শিশু গ্রন্থ’টি প্রথম দুই ভাগে কবির কথা, শেষ দুই ভাগে শিশুর কথা।

কবি পতœীর দেহান্তরের (১৯০২) পর বেদনার্ত হৃদয়ে সন্তানদের সান্ত¡না দিবার জন্য তিনি ’শিশু’ কাব্যগ্রন্থের কবিতাসমুহ রচনা করেন। গ্রন্থের কবিতাগুলি লিখবার উদ্দেশ্য তাঁর স্ত্রী মৃণালিনী দেবীর মৃতু্যুই একমাত্র উপলক্ষ্য বলে মনে হয় না। কবিতাগুলি পড়তে পড়তে অনিবার্যভাবেই মনে পড়ে যায় ভৃত্য ’রাজকতন্ত্রে’র অধীন বালক রবীন্দ্রনাথকে। এই কবিতাবলীর ভেতর থেকে উঠে আসে যেন কবির স্বপ্নচারী শৈশবÑকল্পনার আকাশে উধাও হয়ে যাওয়ার পথে যখন বাধা ছিল না কোনো। শিশুর কবিতা লেখার সময় তাই কবির মনে পড়ে যায় ’তেতালার ছাদের উপর তাঁর ’নিজের শৈশবের কথা;১০ যতই লেখেন, নিজের ভিতরে যে বালকও আছে তার সঙ্গে পরিচয়’১১ ততই বেড়ে যায় তার। মোহিতচন্দ্র সেনকে লেখা একটি চিঠিতে ’শিশু’ কাব্যগ্রন্থ প্রসঙ্গে কবি লিখেছেন,

আমার এই কবিতাগুলি সবই খোকার নামেÑ তার একটি কারণ এই, যে-ব্যক্তি লিখেছে যে আজ চল্লিশ বছর আগে খোকাই ছিল,… তাছাড়া আর এক কথা আছেÑখোকা এবং খোকার মার মধ্যে যে ঘনিষ্ঠ মধুর সম্বন্ধ সেইটে আমার গৃহস্মৃতির শেষ মাধুরী …মাতৃশয্যায় সিংহাসনে খোকাই (শমীন্দ্র) তখন চক্রবর্তী সম্রাট ছিল সেই জন্যে লিখতে গেলে খোকা এবং মার ভাবটুকুই সূর্যাস্তের পরবর্তী মেঘের মতো নানা রঙে রঙিয়ে ওঠে।১২

তাঁর ’শিশু’ কাব্যগ্রন্থের কবিতাবলির মধ্যে দুইটি সুস্পষ্ট বিভাগ লক্ষ্য করা যায়। এক দিকে তাঁর মন পরিত্যক্ত বাল্য জীবনের মধ্যে ফিরে গিয়ে বালক হয়ে উঠেছে আর একদিকে মাতা-পিতার যৌথ বাৎসল্যের øেহধারা অকৃত্রিমভাবে উৎসারিত হয়ে পড়েছে ।

’শিশু’ কাব্যগ্রন্থের ভূমিকায় কবি বলেন,

জগৎ পারাবার তীরে    ছেলেরা  করে মেলা

অন্তহীন গগনতল

মাথার ’পরে অচঞ্চল,  ফেনিল ওই সুনীল জল                                                                                                                       নাচিছে  সারাবেলা।

উঠিছে তটে কি কোলাহলÑ           ছেলেরা করে মেলা।

১৯০২ সালে তাঁর স্ত্রীর মৃত্যু, ১৯০৩ ’শিশু’ প্রকাশকালে তাঁর কন্যা রেণুকার মৃত্যু এবং তারপরেই তার আরো নিকট আত্মীয়ের মৃত্যুর গভীর তীব্র শোক কবি তাঁর জীবনাচরণে কখনো প্রকাশ করেন নি। অসহনীয় এই সব রচনার মধ্যে শত মুখে দেখা দিয়েছিল। শিশু-কবিতার মধ্যেও তাঁর সেই দুঃখ তপ্ত চিত্তের কিছুটা প্রকাশ অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। খোকা, মাঝি, অস্তসখী, বিদায় প্রভৃতি কবিতায় কবির ব্যক্তিগত বিয়োগ ব্যথা মূর্ত হয়ে উঠেছে। দার্শনিক মৃত্যুচেতনায় বয়স্ক ভাবনায় ভরে উঠেছে।

বিশ শতকের প্রথম দশকে রবীন্দ্র সৃষ্টিপ্রতিভা কিছুটা নিস্তেজ, ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনে দুঃখ বিষাদের কারণে ’শিশু’ আধ্যাত্মিক ও দার্শনিক অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ। রবীন্দ্রনাথের শিশুসাহিত্য অনেক ক্ষেত্রে শিশুমনের নাগাল পায়নি, কিন্তু যেখানে পেয়েছে, সেখানে শিশু ও শৈশবের প্রতি তাঁর নিবিড় সম্ভ্রম, নিপাট ভালবাসা উপচে উঠেছে। বাংলা সাহিত্যে ’বীরপুরুষ’ এই কারণে একটি অসাধারণ সৃষ্টি হয়ে আছে। খোকার বীরত্ব, ডাকাতদলের সঙ্গে তার একক যুদ্ধ আর সেই অবিস্মরণীয় বর্ণনার শেষে, তার পৌরুষের পুরস্কার হিসেবে মাতৃ-মুখের মিষ্টি চুম্বনটির যে বর্ণোজ্জ্বল উপস্থাপনা তার কোন তুলনা বাংলা শিশুসাহিত্যে আর নেই। এ কবিতাটি একদিকে শিশুচিত্তের শ্বাশত অভিযান-প্রীতিতে, বীরত্ববোধে যেমন সুখকর, তেমনি তা মা ও সন্তানের চিরন্তন মধুর সম্পর্কের অনড় সূত্রে আগাগোড়া গ্রথিত। কবিতাটি ঘটনামুখর। তীব্র নাটকীয় পরিবেশে পরবর্তীকালে মঞ্চসাফল্যও পেয়েছে। সি, এল, টি পরিবেশিত পুতুল নাচের মধ্যেও তার সফল পরীক্ষা দেখা গেছে। এই ব্যাপকতাগুণে নন্দলাল অঙ্কিত চিত্রসহ পৃথক বই আকারেও প্রকাশিত হয়েছে।

কবিতাটির শুরুতে খোকা জানাতে ভোলেনি যে, ’মনে করো যেন বিদেশ ঘুরে / মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে’ -এই দূরতই এখানে রূপকথার আবেগ যুক্ত করেছে কিন্তু পালকী ও খোকার চলার পথটির সঙ্গে বাস্তবের একটি সম্পর্ক স্থাপিত করে দিয়েছে। সম্পূর্ণ সমকালীন হিন্দুর পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের পটভূমিতে স্থাপিত হয়েই রামায়ণ কথা শিশুর কল্পনাকে প্রসারিত করেছে, পারিবারিক জীবন চিত্রও সেভাবে পরিকল্পিত। রবীন্দ্রনাথের শিশু কাব্যের ’বীরপুরুষ’ কবিতায় খোকার মা পাল্কী থেকে নেমে খোকাকে চুমু খেয়ে কোলে নিয়েছিল, ’খোকার পরামর্শ’ কবিতায় যুদ্ধ ফেলে বাবা খোকাকে কোলে নিয়েছিল।

’মাতৃবৎসল’, ’লুকোচুরি’, ও ’বিদায়’, এই তিনটি কবিতায় কল্পনার সঙ্গে সংবেদনারÑপ্রতিমানের সঙ্গে অনুভাবের (ইমেজারির সঙ্গে ইমোশনের )-সুন্দর সংযোগ। মাতৃবৎসল কবিতায়

তার চেয়ে মা আমি হব ঢেউ,

তুমি হবে অনেক দূরে দেশ

লুটিয়ে আমি পড়বো তোমার কোলে

কেউ আমাদের পাবে না উদ্দেশ!

’বনবাস’, রবীন্দ্রনাথ তার পিতামহের ব্রাহ্মধর্ম অবলম্বন করেছিলেন কিন্তু এই ধর্ম সম্পর্কে তাঁর আবেগ চিরস্থাযী হয়নি। উত্তরকালে ধর্ম বিষয়ে তাঁর একটি ব্যক্তিগত বোধ গড়ে ওঠে, যা হিন্দু ধর্মের অনেক সংস্কারকে গ্রহণ করেছে। তিনি আদি ব্রাম্ম সমাজের এককালীন সম্পাদক হয়েও পরে বলেছেন,

আমাদের পরিবারে যে ধর্ম-সাধনা ছিল আমার সঙ্গে তাহার কোনো সংশ্রব ছিল না, আমি তাহাকে গ্রহণ করি নাই।১৩

হিন্দু সমাজে যে আবহমান সৌন্দর্য ও শক্তি আছে, তিনি তাকে নিয়েছেন, পৌত্তলিকতা, আচার, সংস্কার নেননি। ’অভিযান‘ Ñ ‘দু:খহারী’ কবিতায় কবি শিশুকে রামায়ণের জগতে নিয়ে গেছেন এবং রামের সঙ্গে তুলনা করেই তাকে একটি গুরুত্বের পটভুমিতে স্থাপন করেছেন,

রাক্ষসের ভয় করিনে, আছে গুহক মিতা

রাবণ আমার কী করবে মা নেই তো আমার সীতা।

তার মনে মহাভারত গভীরভাবে প্রোথিত ছিল।

কবিতায় রবীন্দ্রনাথের শিশু লক্ষণ বড় ভাই রামের আগমন প্রত্যাশী যে তার সাথে বনে যাবে এবং প্রতিকুল অবস্থায় সাহস যোগাবে,

কিন্তু আমি পারি যেতে,

ভয় করিনে তাতেÑ

লক্ষণ ভাই যদি আমার

থাকত সাথে সাথে।

’পূজোর-সাজ’-আদর্শবাদী কবিতা। পরের বাড়ীর পোলাও-কোর্মার চেয়ে নিজের বাড়ীর ডাল-ভাত অনেক স্বাদের এই শিক্ষা তিনি দিতে চেয়েছেন শিশুদের। মধু বিধু দুই ভাই। পূজোয় তাদের গরীব বাবা তাদেরকে দুুটি ছিটের জামা কিনে দেয়। মধু রেগে রায় বাবুদের দালানবাড়ীতে চলে যায়। রায় বাবুর ছেলে গুপী পূজোয় পেয়েছে জরির টুপি আর ফুলকাটা সাটিনের জামা। সেখানে মধুকে রায় বাবু গুপীর জামাটি দিয়ে দেন। বিধু আশীর্বাদস্বরূপ বাবার দেয়া কাপড়খানি গ্রহণ করে। বাবার আশীর্বাদ,

ছেঁড়া ধুতি আপনার                      ঢের বেশী দাম তার

ভিক্ষা করা সাটিনের চেয়ে।

আয় বিধু আয় বুকে,     চুমো খাই চাঁদমুখে,

তোর সাজ সবচেয়ে ভালো।

আমারি ছেলের দেহে   আমারি বাপের øেহে

ছিটের জামাটি করে আলো।’

রবীন্দ্রনাথ সৌন্দর্যের পূজারী। তিনি শীতকে বিদায় জানিয়ে বসন্তকে আহ্বান জানাতে চান। শীত ঋতুর প্রতি বিরূপ মনোভাব ’শীত’ কবিতাটির উপজীব্য। পাখি, ফুল, বাতাস সবাই শীতকে বিদায় জানাতে চায়, এবং বসন্তকে স্বাগত জানাতে চায়। তাই কবির কথায়,

শীত, তুমি হেথা কেন এলে।

উত্তরে তোমার দেশ আছেÑ

পাখি সেথা নাহি গাহে গান,

ফুল সেথা নাহি ফুটে গাছে।

সকলি তুষার মরুময়,

সকলি আঁধার জনহীনÑ

রবীন্দ্রনাথের ‘কথা ও কাহিনী’ (১৯০৮) ১৪  বিশ শতকের প্রথম দশকের স্মরণযোগ্য কিশোর সাহিত্য। ‘কথা ও কাহিনী’র ‘শ্রেষ্ঠ ভিক্ষা’, ‘মানী’, ‘বন্দীবীর’, ‘নগর লক্ষèী’, ‘বিচারক’, ‘নিষ্ফল উপহার’, ‘নকল গড়’, ‘পণ রক্ষা’, ’স্পর্শমণি’, ‘পুরাতন ভৃত্য’, এবং ‘দুই বিঘা জমি’ কিশোরসাহিত্যের পর্যায়ভুক্ত। ডক্টর নীহাররঞ্জন রায়ের মতে ভারতীয় ঐতিহ্যের যে দিকে মানব মহত্ত্ব বিচিত্ররূপে আত্মপ্রকাশ করেছে সেই দিকের বাণীরূপই ’কথা ও কাহিনী’ গ্রন্থ দুটি। এই ঐতিহ্যবোধ ও ঐতিহ্য সন্ধানই বাঙালী হিন্দুর স্বদেশী আন্দোলনের ’ভাব ভূমিকা। রবীন্দ্রনাথ এইকালে ’ইতিহাস গ্রন্থসংগ্রহ এবং অত্যন্ত যতেœ  ভারত ইতিহাস পাঠ’ করেন।

’শিশু ভোলানাথ’ (১৯২২,১৩৪৯ কার্তিক )। গ্রন্থের অধিকাংশ কবিতা ’মৌচাক’, ’সন্দেশ’, ’প্রবাসী’, ’বঙ্গবানী’, ’রংমশাল’, ’শ্রেয়সী’ প্রভৃতি সাময়িক পত্রে প্রকাশিত হয়।

’শিশু ভোলানাথ’ গ্রন্থের কবিতাসমূহের শ্রেণীকরণÑ

শিশুর প্রকৃতি – শিশু ভোলানাথ, শিশুর জীবন,

মাটির টান Ñ তালগাছ, মর্ত্যবাসী

দার্শনিক Ñ বুড়ি, সংশয়ী, বাউল,

ইচ্ছেপূরণ Ñ রবিবার, সময়হারা, পুতুল ভাঙ্গা, মুর্খু,

øেহপূর্ণ Ñ মনে পড়া,

খেয়ালী Ñ  সাতসমুদ্র পারে,

কাল্পনিক Ñ জ্যোতিষী, খেলা-ভোলা, পথহারা,

বর্ণনা – রাজা ও রানী, দূর, বৃষ্টি রৌদ্র।

বাৎসল্য Ñদুষ্টু,

হেঁয়ালী – ইচ্ছামতী, অন্য মা, রাজমিস্ত্রী, দুই আমি।

রূপকথা Ñ দুয়োরানী, ঘুমের তত্ত্ব, দুই, বাণী-বিনিময়,

ষাটোর্ধ রবীন্দ্রনাথের কবিসত্তা যেন নব শিশুজন্ম লাভ করেছিল। যৌবনমধ্যাহ্ন পার হবার পর হতেই কবিসত্তায় আয়ু

চিরশ্যামল শিশুদিগন্তের দিকে ফিরতে আরম্ভ করেছিল। রবীন্দ্রনাথ শিশুর মধ্যে অবলোকন করেছেন ভগবান ও বিশ্বপ্রকৃতির

লীলা রহস্য। অনেক সময় তাঁর শিশু মহাকালেরই এক ক্ষুদ্র সংস্করণ। এর প্রথম পরিচয় ’শিশু ভোলানাথে’।

আমেরিকার বস্তুগ্রাস থেকে বেরিয়ে এসেই শিশু ভোলানাথ লিখতে বসেছিলুম। বন্দী যেমন ফাঁক পেলেই ছুটে আসে সমুদ্রের ধারে হাওয়া খেতে তেমনি করে।— ১৫

শিশু রচনাকালে কবি কল্পনার যে রকম বাস্তবভুমিকা ছিল, শিশু ভোলানাথ রচনাকালে ঠিক সেরকম কিছু ছিল না। তাই শিশু ভোলানাথে শিশুমানসিকতা কতকটা তির্যকভাবের। কাব্যনামে ”ভোলানাথ” কথাটির এইখানেই সার্থকতা। সব কবিতায় শিশুর দেখা হয়তো  মেলে না কিন্তু সর্বত্র শিশুত্বের স্পন্দন অনুভূত হয়।” গ্রন্থের প্রথম কবিতা,

দারিদ্র্য করে না দীন, ধূলি তোরে করেনা অশুচি,

নৃত্যের বিক্ষোভে তোর সব গানি নিত্য যায় ঘুচি।

ওরে শিশু ভোলানাথ, মোরে ভক্ত ব’লে

নে রে তোর তান্ডবের দলে ;

দে রে চিত্তে মোর

সকল ভোলার ঐ ঘোর,

খেলেনা-ভাঙ্গার  খেলা আমারে বলি।

এমন কবিতায় রবীন্দ্রনাথ নিজেকেই বেশী স্মরণ করেছেন

বাল্য দিয়ে যে জীবনের

আরম্ভ হয় দিন,

বাল্যে আবার তাহা হোক না সারা। (’শিশুর জীবন’)

রবীন্দ্রনাথের কবিতায় কখনো বিষয় হয়ে আসে একটি ’তালগাছ’ আন্ডেরসেনে১৬র মতোই, যা কিছু প্রাকৃতিক ও নিশ্চেতন,

তার মধ্যের প্রাণীত্বের সঞ্চার করে দেন রবীন্দ্রনাথ হয়তো বা কখনো কবি আরোপ করেন নিজেকেই, ফলে  তালগাছও রূপান্ত

রিত হয় যেন এক ভাবুক ও বিষন্ন কবিতে,

তালগাছ    এক পায়ে দাঁড়িয়ে

সব গাছ ছাড়িয়ে

উঁকি মারে আকাশে।

মনে সাধ    কালো মেঘ ফুঁড়ে যায়Ñ

একেবারে উড়ে যায়Ñ

কোথা পাবে পাখা সে?…

 

সারাদিন     র্ঝর্ঝ থত্থর

কাঁপে পাতা পত্তর

ওড়ে যেন ভাবে ও,

মনে মনে     আকাশেতে বেড়িয়ে

তারাদের এড়িয়ে

যেন কোথা যাবে ও।

’বাউল’ কবিতায় বাউল-দরবেশদের গৃহবন্ধনহীন জীবন উন্মুক্ত সুদূরের প্রতি হৃদয়কে টেনেছে,

অনেক দূরের দেশ

আমার চোখে লাগায় রেশ

যখন          তোমায় দেখি পথে।

’মর্ত্যবাসী’ কবিতায় শিশুহৃদয়ের কল্পনা প্রগাঢ় মানবিকতার অবতারণা করেছে। এখানে কবি মনের কথা চিরকালের শিশুমনের বাসনায় প্রকাশিত,

তোমরা বলো,

স্বর্গ ভালো সেথায় আলো

রঙে রঙে আকাশ রাঙায়

’শিশু ভোলানাথে’ শিশু উপলক্ষ মাত্র। কবির অন্তরের মধ্যে যে শিশুটি আছে তাকে তিনি উপলব্ধি করতে চেয়েছেন এই কবিতাগুলোতে।

তাঁর øেহ কেবল আশীর্বাণী জাতীয় রচনায় সীমাবদ্ধ থাকলেও এখানে তার ব্যতিক্রম দেখা গেছে। ’সোপান’-এ প্রকাশিত তাঁর ’নমস্কার’ নম্র যে সে উর্ধ্ব পানে উঠে/শান্ত যে অজেয় তার বল। কবিতাটি নাতিদীর্ঘ ও নীতিমূলক।

রূপকথা নিয়ে শিশুসাহিত্য রচনা এ সময়ের একটি উল্লেখযোগ্য অবদান। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিশুসাহিত্য একটি বিরাট অংশ জুড়ে রয়েছে রূপকথা সাহিত্য, রূপকথার প্রেক্ষাপটে অথবা আঙ্গিকে লেখা হয়েছে রবীন্দ্রনাথের অসংখ্য কবিতা ও গান। বিভিন্ন কবিতা ও গানে নিজের কথা বলতে গিয়ে রূপকথার মোটিফগুলো ব্যবহার করেছেন। যৌথ নির্জ্ঞানলোকে রূপকথার যে স্মৃতি জড়িয়ে আছে, অজ্ঞাতসারে তা উপমায় উল্লেখে, রূপকে ইমেজে রূপায়িত হয়েছে কবিতা ও গানে।

রবীন্দ্রনাথ রূপকথা লিখবার অনুপ্রেরণা পান আন্ডেরসেন হতে যার রূপকথা মুখ্যত সৃষ্টি, রাজকীয় বর্ণাঢ্যতা থেকে তাঁর রূপকথা নেমে আসে নিতান্ত সাধারণ, তুচ্ছ নগন্যের ভিড়ে। যার শিশুসাহিত্যে প্রায় রূপকাত্মক সঙ্গে সামাজিক জীবনকে মেলানো, কোথাও কোথাও মাত্রার তারতম্য আছে. কোন কোনটি অধিক রূপকথাপ্রবণ কিংবা অধিক বাস্তব জীবনমুখী।

আনন্দলাভের সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞানার্জনের উদ্দেশ্যে শিশুসাহিত্য রচনায় বিশেষভাবে অগ্রসর হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর যুগের লেখকেরা। এই উদ্দেশ্যে শেষ বয়সে রবীন্দ্রনাথ গদ্যে ও পদ্যে অদ্ভুতরসের কাহিনী রচনায় বিচিত্র প্রেরণা অনুভব করেছিলেন। এমন একটি গল্প ’ইচ্ছেপূরণ’। লুইস ক্যারল ও এডওয়ার্ড লিয়ার-দুজনেই আজগুবি ও খেয়াল রসের রাজা বলে পরিচিত ছিলেন। এঁরা ’দুজনেই যুগপৎ সেই আষাঢ়ে ভাবনারই বন্দনা করেছেন যার আড়ালে লুকিয়ে আছে আমাদেরই বাস্তব পৃথিবী। ’খাপছাড়া’ (১৯৩৬)১৭ ও ’ছড়ার ছবি’ ও (১৯৩৭)১৮ পুস্তক দুটি এই ধারার অনুসারী।

অদ্ভূত রসের ভিয়ানে পাক করা ছেলে-ভুলানো গল্পের সৃষ্টি অপেক্ষাকৃত আধুনিক কালে। বাংলা সাহিত্যে এমন গল্প ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় কঙ্কাবতী’(১৮৯১)  প্রথম লিখেছিলেন। তাঁর গ্রন্থটিতে লুইস ক্যারলের ’অবাক জগতে এলিস’Ñ এর প্রভাব লক্ষ্যণীয়। এর মধ্যে রূপকথার এক জগৎ সৃষ্টি করা হয়েছে এবং সেই জগৎ শিশুদের মধ্যে অদ্ভূত রসের সঞ্চার করে। রবীন্দ্রনাথ গ্রন্থটির জনপ্রিয়তা নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন।

প্রথম থেকেই রবীন্দ্রনাথের কবি-ভাবনায় ছেলেভুলানো ছড়ার ও গল্পের রঙ পাকা হয়ে লেগেছিল। শেষ বয়সে কবি খাঁটি ছড়ার শৈলীতে কবিতা লিখে নতুন রসসৃষ্টি করেছেন। এখানে জেষ্ঠ্যভ্রাতার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের মিল দেখা যায়। বাহ্যত ছেলেদের জন্য লেখা হলেও রবীন্দ্রনাথের ছড়া কবিতার রস পরিণত মনেরই বেশি উপভোগ্য। যেগুলির ভাব ও ভাষা অত্যন্ত সহজ সেগুলির মধ্যেও ছন্দের বৈচিত্র্য ও কল্পনার  উদ্ভটতা বিচিত্র রসসৃষ্টি করেছে।

’খাপছাড়া’ গ্রন্থটি বহু রঙিন চিত্র এবং রেখাচিত্র কবি নিজেই চিত্রিত করেছেন। সংখ্যার ক্রমানুসারে ১০৫টি কবিতা সংযোজিত। এর নাম ভূমিকায় কবি লিখেছেন,

সহজ কথায় লিখতে আমায় কহ যে,

সহজ কথা যায়না লিখা সহজে।

লেখার কথা মাথায় যদি জোটে

তখন আমি লিখতে পারি হয়তো।

কঠিন লেখা নয়কো কঠিন মোটে,

যা-তা লেখা তেমন সহজ নয় তো।

ছোট ছোট ছড়া-কবিতাগুলিতে অদ্ভূত-কৌতুকরস উচ্ছলিত। উদাহরণস্বরূপ প্রথমেই ‘ক্ষান্তবুড়ির দিদিশাশুড়ী’র কালনা-নিবাসিনী পঞ্চভগিনীর অসঙ্গত অথচ প্রবল যুক্তিযুক্ত আচরণের উল্লেখ করা যায়,

কোনো দোষ পাছে ধরে নিন্দুকে

নিজে থাকে তারা লোহা সিন্দুকে’

টাকাকড়িগুলো হাওয়া খাবে বলে

রেখে দেয় খোলা জাল্নায়,

নুন দিয়ে তারা ছাঁচিপান সাজে

চুন দেয় তারা ডালনায় ।

অথবা বিশ্বের টেরিটি বাজারে যার সন্ধান পাওয়া আকস্মিক হলেও অসম্ভাবিত নয় সেই ‘গোরা-বোষ্টমবাবা’র আদর্শ সাত্ত্বিক ব্যবহার, কঠোর সংযম ও অতুলনীয় ব্যবসায় বুদ্ধির পরিচয়,

শুদ্ধ নিয়ম মতে মুরগিরে পালিয়া

গঙ্গাজলের যোগে রাঁধে তার কালিয়া;

মুখে চল আাসে তার চরে যবে ধেনু।

বড়ি করে কৌটায় বেচে পদরেণু।

খাপছাড়ার ২৩ সংখ্যক ছড়ায় কবির মগ্নচৈতন্যে জড়িয়ে থাকা ক্যারলের রূপকথার স্মৃতি আবার ফিরে এসেছে যেন। সকৌতুক ভঙ্গীতে ও হাল্কা হাসির সুরে লেখা এই ছড়ায় আছে, ডাক্তার গ্রেগসনে’র দেওয়া ’ইনজেকশনে’র গুণে সন্তোষ   নামে এক বাড়ীর বউ বেঁটে জগদম্বা’র দেহ’ সাতফুট লম্বা হয়ে যায়; মজা আরও বাড়ে, যথন লোকটি স্ত্রীর তুলনায় খর্বকায় হওয়ার অভিমানে ডাক্তারকে অদ্ভূত অনুরোধ জানিয়ে বলে,

শুন ডাক্তার ভায়া,

উঁচু কর মোর পায়া,

স্ত্রীর কাছে কেন রব কম বা।

——————

ওষুধ লাগাও কষেÑ

শুনে ডাক্তার হতভম্বা।

বস্তুত, এই অদ্ভূত অনুরোধ শোনার পর অতিমাত্রায় বিস্মিত হওয়া ডাক্তার গ্রেগ্সনের পক্ষেও সম্ভব নয়।

রবীন্দ্রনাথের ছেলেবেলায় উনিশ শতকের প্রথমে প্রকাশিত ছেলেভুলানো বইয়ে যখন শিশুকে মানুষ বলে গন্য না করে শুধু শিশু বলেই গণ্য করা হত, শিশুদের এবং বড়দের বইয়ে বিশেষ পার্থক্য হত না। ’ছেলেরা যে-বই পড়িবে তাহার কিছু বুঝিবে এবং কিছু বুঝিবে না, এইরূপ বিধান থাকা চাই।’১৯ ঠিক এমন কবিতায় তিনি ’ছড়ার ছবি’র ’বালক’ কবিতায় বলেছেন,

জানার সঙ্গে আধেক জানা, দূরের থেকে শোনা,

নানারঙের নানা সুতোয় সব দিয়ে জাল বোনা,

নানান চলাফেরা,

সব দিয়ে এক হালকা জগৎ মন দিয়ে মোর ঘেরা,

ভাবনাগুলো তারই মধ্যে ফিরত থাকি-থাকি

বনের মধ্যে শ্যাওলা যেমন, মেঘের তলে পাখি।

রবীন্দ্রনাথের অনেক রচনা নানা পালা বদলের মধ্য দিয়ে সারা জীবন ধরে চলেছিল।

’ছড়ার ছবি’ (১৯৩৭)র অধিকাংশ কবিতা ছবি আকারে আলমোড়া বাসকালে রচনা করেন। পিসুনি, বাড় খাটুলি, ঘরের খেয়া, বুধু, চড়িভাতি, ভ্রমণী, প্রবাসে, আকাশপ্রদীপ, পিছুডাকা, অজয় নদী, ছবি আঁকিয়ে, খেলা, আকাশ, বাসাবাড়ি, রিক্ত, শনির দশা, তালগাছ, পাথরপিন্ড, মাধো, সুধিয়া, অচলা বুড়ি, দেশান্তরী, পদ্মায়। এর কবিতাগুলি সবই ছড়া-কবিতা নয়। ভূমিকায় লিখেছেন,

এই ছড়াগুলি ছেলেদের জন্য লেখা। সবগুলো মাথায় এক নয়; রোলার চালিয়ে প্রত্যেকটি সমান সুগম করা হয়নি। এর মধ্যে অপেক্ষাকৃত জটিল যদি কোনোটা থাকে, তবে তার অর্থ হবে কিছ দূরূহ, তবু তার ধ্বনিতে থাকবে সুর। ছেলেমেয়েরা অর্থ নিয়ে নালিশ করবে না, খেলা করবে ধ্বনি নিয়ে। ওরা অর্থলোভী জাত নয়।২০

’ছড়ার ছবি’(১৯৩৭)র কবিতাচিত্রের অনেকগুলিতে কবির বাল্য ও যৌবন স্মৃতি প্রতিফলিত। কয়েকটি কবিতার ব্যঞ্জনা গভীরতর। ’পিস্নি’তে মানবজীবনসন্ধ্যার আলো-আঁধারির যে উদাস ছবি ফুটেছে তা মনকে ব্যথিত করে। অসম্ভবের আশাকে মনে আলগা ধরে নিঃসঙ্গ পিসনি বুড়ি বার্ধক্যের শেষ প্রান্তে উপনীত হয়ে সুদূরের ডাকে গ্রাম ছেড়ে চলতে চলতে তার মনে ক্ষণে ক্ষণে স্মৃতিবিস্মৃতির ঢেউ খেলে যায় দূরপ্রবাসী আত্মীয় যাঁরা, তারা তার সাথে øেহসম্পর্ক বহুদিন চুকিয়ে দিয়েছে। তাদের নাম-ধাম কখনো বুড়ির মনে পড়ে না। মানবমনের জীবন-মৃত্যুর মধ্যবর্তী এই বৈতরনীগামিনী বৃদ্ধার করুন আলেখ্যে দীর্ঘ আয়ুর পরিণামে গভীর অবোধ বেদনার নির্দেশ আছে,

গ্রাম-সুবাদে কোন্কালে সে ছিল যে কার মাসি,

মণিলালের হয় দিদিমা, চুনিলালের মামি,

বলতে বলতে হঠাৎ সে যায় থামি,

স্মরণে কার নাম যে নাহি মেলে ।

গভীর নিশাস ফেলে

চুপটি ক’রে ভাবে

এমন করে আর কতদিন যাবে।

’জীবনস্মৃতি’ রবীন্দ্রনাথের আত্মজীবনী। বিষয়, ভাব ও ভাষার সুসমন্বয় সাহিত্য শিল্পরূপায়িত রচনা। এখানে রবীন্দ্রনাথ জীবনের প্রথম পঁচিশ বছরের কথা বলেছেন। সেকালের গন্ধ গান দৃশ্য স্পর্শের স্বাদ আমরা তাঁর সাথে সাথে অনুভব করি। অকথিত বাল্যজীবনের ছোটখাট স্মৃতি অবলম্বনে অল্পবয়সীদের জন্য ’ছেলেবেলা’ (১৯৪০) গ্রন্থভুক্ত করেছেন। কথিকাটিকে জীবনস্মৃতির পরিপূরক বলা চলে,

ছেলেবেলায় আমার একটা মস্ত সুযোগ এই ছিল যে, বাড়িতে দিনরাত্রি সাহিত্যের হাওয়া বহিত। মনে পড়ে খুব যখন শিশু ছিলাম, বারান্দার রেলিং ধরিয়া একÑএক দিন সন্ধ্যার সময় চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া থাকিতাম। সম্মুখের বৈঠকখানা বাড়িতে আলো জ্বলিতেছে, লোক চলিতেছে, দ্বারে বড় বড় গাড়ি আসিয়া দাঁড়াইতেছে। কি হইতেছে ভাল বুঝিতামনা, কেবল আলোকমালার দিকে তাকাইয়া থাকিতাম।…অধমার খুড়তুত ভাই গনেন্দ্র দাদা তখন রামনারায়ণ তর্করতœকে দিয়া নবনাটক লিখাইয়া বাড়িতে তাহার অভিনয় করাইতেছেন। সাহিত্য এবং ললিত কলায় তাহাদের উৎসাহের সীমা ছিল না। বাংলার আধুনিক যুগকে তাঁহারা যেন সকল দিক দিয়াই উদ্বোধিত করিবার চেষ্টা করিতেছিলেন। বেশে ভূষায় কাব্যে গানে চিত্রে নাট্যে ধর্মে স্বদেশিকতায় সকল বিষয়েই তাঁহাদের মনে একটি সর্বাঙ্গসম্পূর্ণ জাতীয়তার আদর্শ জাগিয়া উঠিতেছিল।২১

সমা-কবিতার বিশেষ ভঙ্গী, সুরের প্রবর্তন, অসাধারণ শব্দসম্ভার, কাব্যক্ষেত্রে শব্দের বিচিত্র প্রয়োগ কৌশল অর্ধশতকেরও অধিককাল ধরে রবীন্দ্রনাথ বাংলার সাহিত্য জীবনকে প্লাবিত করেছেন। কাব্যে ভাব, ভাষা ও ছন্দের সার্থক সমন্বয় সাধন করেছেন। পৃথিবীর প্রতি তার যে অসীম ভালবাসা, সুন্দর ও শাশ্বতের প্রতি অপরিসীম আসক্তি, ভগবান, প্রকৃতি ও মানুষের মধ্যে সুষম সম্পর্ক নির্ণয়ে যে দক্ষতা তিনি অর্জন করেছেন বিশ শতক শুরুর পূর্বেই তা বাঙালী কাব্য পাঠকের অভিজ্ঞতায় উপস্থাপিত।

উনিশ শতকের শেষে এবং বিশ শতকে বাংলায় সমাজ জীবনে ও সাহিত্যে শিশু যেভাবে ছিল তা রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিকর্মে পাওয়া যায়।

ছেলেভুলানো ছড়া রূপকথারই নামান্তর। শিশুসাহিত্য সৃষ্টির প্রথম থেকেই বালকের অথবা অল্পবুদ্ধি বয়স্কের শিক্ষা-সংবিধানে রূপকথাকে সাধারণ জীবনে প্রয়োজনীয় অথবা ধর্মজীবনে অনুকূল উপদেশের আধার করে সাহিত্যে ব্যবহৃত হয়েছিল। ছেলেভুলানো গল্পে বিষয়বস্তুর সত্যাসত্য নিয়ে কোন চিন্তা নেই, আচরণের যৌক্তিকতা নিয়েও কোন মাথাব্যথা নেই  দেব দানব যক্ষ রক্ষ হতে সিংহ ব্যাঘ্র হাতি শিয়াল সজারু ইঁদুর কাক পিঁপড়া পর্যন্ত সব কাল্পনিক ও বাস্তব জীব নিয়ে ছেলে-ভুলানো গল্পের কারবার।

নিছক ছেলে ভুলানো গল্পের প্রতি শিক্ষিত বয়স্ক লোকের দৃষ্টিপাত উনিশ শতকের বিজ্ঞানবুদ্ধির জাগরণের ফল। আমাদের দেশে এর প্রভাবে এসেছিল বিদেশী শিক্ষার দ্বারা। ভারতীয় শিক্ষিত ও সাহিত্যিক ব্যক্তিদের মধ্যে রেভারেন্ড লাল বিহারী দে সর্বপ্রথম ছেলে-ভুলানো গল্পের সংকলন–ইংরেজীতে-প্রকাশ করেন। কিন্তু বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথই প্রথম ছেলে-ভুলানো গল্পের স্থায়ী মূল্য ও নিজস্ব মর্যাদা সম্পর্কে নিশ্চিত করেন। তবে পুরাণের গল্পে মানুষ তপস্যা করেছে দেবত্বলাভের জন্য। আর রবীন্দ্রনাথের রূপকথায় দেবতা কামনা করেছেন মানুষের ভালবাসার স্পর্শ পাবার জন্য।

উনিশ শতকের শেষ দুই দশকে রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি প্রতিভার যে নব নব উন্মেষ তুলনামূলকভাবে বিশ শতকের প্রথম দশকে সে প্রতিভা নিস্তেজ, ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনে দুঃখ বিষাদের কারণে রবীন্দ্রনাথের কাব্য কর্ম আলোচ্য সময়ে ’শিশু’ ( আধ্যাত্মিক ও দার্শনিক অভিজ্ঞতায় নিবিষ্ট। বিশ শতকের প্রথম দশকে ব্যক্তিগত শোক ও বেদনায় রবীন্দ্রনাথ মুক্তি খুঁজেছে আধ্যাত্মলোকে। তাঁর কাব্য তৎপরতা হয়েছে স্তিমিত।

’শিশু’ এবং ’শিশু ভোলানাথ’ কাব্যগ্রন্থে বস্তুবিশ্বকে আবর্ত করে দেখা যায় মায়াজগতের অপরূপ ইন্দ্রজাল।      বৈজ্ঞানিক জগতের বদলে জেগে ওঠে ঝাপসা রূপকথার পৃথিবী।— এই দুই কাব্যগ্রন্থের রচনার প্রত্যক্ষ ভাবপ্রেরণা স্বতন্ত্র হলেও শিশুর মনোজগতের রহস্য উন্মোচনে করেছেন।২২

’শিশু কাব্যগ্রন্থে’র কবিতাবলীতে খুব নির্লিপ্ত চোখে শিশুর কোলাহল কার্যাবলী অবলোকন করেছেন।

শিশু ও কিশোরদের মধ্যে কোন অনুকম্পার সীমারেখা রাখেননি বলে রবীন্দ্রনাথের বহু রচনা শিশুসাহিত্যরূপে চিহ্নিত হয়েও শিশুদের জন্য নয়। রবীন্দ্রনাথের শিশু গ্রন্থগুলির মধ্যে মায়ের মন, শিশুর ভাবনা এবং শিশুর ভাবনা সম্পর্কে বয়স্কের অনুভবÑ এই ত্রিধারা একসংগে মিলেছে।

রবীন্দ্রনাথের মনের স্বরূপ যে, তিনি শিশুদের সাথে সহজে অন্তরঙ্গ হতে পরেননি Ñ একটা নির্লিপ্ততা, নিস্পৃহতা ও দার্শনিকতা অন্তরঙ্গ হয়ে উঠেছে শিশু কাব্যে তিনি শিশুকে সমগ্র বিশ্বের মধ্যে ব্যাপ্ত করে দেখেছেন এবং সেই শিশু বিশেষ কোন শিশু নয়, চিরন্তন শিশু।

’কথা ও কাহিনী’ গ্রন্থে লোক ঐতিহ্যের রেশ এবং রূপকথাগুলিতে লৌকিক সংস্কারের রেশ খুঁজে পাওয়া যায়।

রবীন্দ্রনাথের কবিতায় ঘটেছে রূপকথার আধুনিক রূপান্তর।

’ছড়ার ছবি’র ’পিসনি’তে বুড়ীর নিঃসঙ্গতার বেদনা অনুভূত হবার নয় তেমনি ’পিছু ডাকা’য় অস্তাচলগামী রবির অনুরাগ ধরনীর তুুচ্ছতাকে যে দুর্লভতায় মন্ডিত করেছে তা শিশুদের জন্য আদৌ বোধগম্য নয়।

আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় ’খাপছাড়া’র ছড়াগুলি ছোটদের জন্য লেখা কিন্তু এগুলির রস ছোটদের অপেক্ষা বড়দেরই বেশী উপভোগ্য।

রবীন্দ্রনাথের ‘নদী’ কবিতাটি শিশুদের জন্য রচিত হলেও চিত্র রচনার কৌশলে, প্রকৃতি জীবজন্তু দেশ-বিদেশের মানুষের সংক্ষিপ্ত অথচ অপরূপ নিপুণ বর্ণনায় এবং ভাষার কোমল কারুকৃতিতে তরুণ পাঠকের মনকেই বেশী আকৃষ্ট করে।

ছন্দের সঙ্গে যুক্তির পারম্পর্যের অভাবে সমকালীন বাংলা কবিতায় যে অগভীর ভাব উচ্ছাস এবং গতানুগতিকতার পুনরাবৃত্তি চলছিল সে সম্পর্কে প্রমথ চৌধুরী ক্ষুব্ধ ছিলেন। সনেট পঞ্চাশৎ গ্রন্থের ’উপদেশ’ সনেটটিতে তার সে মনোভাব ধরা পড়েছে। এ সম্পর্কে তিনি অমিয় চক্রবর্তীকে লিখেছিলেন যে রবীন্দ্রনাথের কবিতার খেলো নকল পড়ে  বিরক্ত হয়েই তিনি সনেট রচনায় হাত দিয়েছিলেন।২৩

বাংলা সাহিত্যে তাঁর অসামান্য অবদানের জন্য বিশ্বসাহিত্যে চিরস্থায়ী আসনটি অধিকার করে আছেন।

 

 

পাদটীকা

১। সুকুমার পরিক্রমা, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার, ১/১ আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু রোড, ২০ মে, পবিত্র সরকার, পৃ-৩২।

২। বালকÑসম্পাদক, জ্ঞানদানন্দিনী দেবী, ঠাকুরবাড়ী,১৮৮৫।

৩। ’বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর, নদেয় এল বাণ’।

৪।  ৭ অক্টোবর ১৯২৪.পশ্চিম-যাত্রীর ডায়ারি: রবীন্দ্র রচনাবলী, দশম খন্ড: জন্মশতবার্ষিক সংস্করণ : পৃ : ৫৬৬।

৫। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি, কলিকাতা, বিশ্বভারতী, আশ্বিন ১৩৬৭, পৃ.২২।

৬। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ’একটা আষাঢ়ে গল্প’, গল্পগুচ্ছ, ১ম খন্ড, কলিকাতা, বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ, ১৯৭৭, পৃ- ৯২।

৭। ঐ, পৃ-৯০

৮। রবীন্দ্র রচনাবলী ষষ্ঠ খন্ড, লোকসাহিত্য-পৃ৫৭৮

৯*১৮৯৫ ফেব্রয়ারিতে প্রথম পুস্তিকাকারে প্রকাশিত হয়। মাঘ, ১৩৩২, স, চি, সং বৈশাখ, ১৩৭১, পু, মূ, জৈষ্ঠ্য ১৩৭৭, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী কর্তৃক অলঙ্কৃত।

১০। দ্র,পত্রাবলী, ১৫ শ্রাবণ ১৩১০, বিশ্বভারতী পত্রিকা, ফাল্গুন ১৩৪৯, পৃ-৫২৯।

১১। দ্র. পত্রাবলী, ৮ শ্রাবণ১৩১০, বিশ্বভারতী পত্রিকা, কার্তিক ১৩৪৯, পৃ-২২৪।

১২।%দ্র পত্রাবলী, ২৫ শ্রাবণ ১৩১০, বিশ্বভারতী পত্রিকা, ফাল্গুন, ১৩৪৯, পৃ. ২২২-২৩.

১৪। কথা ও কাহিনী-সম্পাদক মোহিতচন্দ্র সেন, বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ, ১৯০৮।

১৫। শিশু ভোলানাথ

১৬। অ্যান্ডারসেন(১৮০৫-১৮৭৫)(ডেনমার্কের ওডেন্স শহরে জন্ম, গরিব মুচির ছেলে। ১৮৩৫ সালে রূপকথার প্রথম খন্ড                          প্রকাশ-তাঁর রূপকথার বিশেষত্ব-তাঁর নিজের মনগড়া মৌলিক গল্প; গ্রিম ভাইদের মতো পুরনো গল্পের সংগ্রহ নয়।

১৬। ’খাপছাড়া’ রবীন্দ্র-রচনাবলী, একবিংশ খন্ড কলিকাতা, বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ।

১৭। ’ছড়ার ছবি’

১৮। জীবনস্মৃতি, ছেলেবেলা-১৯৪০, রবীন্দ্র রচনাবলী-২৬, পৃ-৫৮৯

১৯। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শান্তিনিকেতন, ২ আশ্বিন. ১৩৪৪.শান্তিনিকেতন

২০। ’ছেলেবেলা’ (১৯৪০

২২। সুমিতা দাস, রূপকথার          আঙ্গিকঃ রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গান, কলিকাতা লিটল ম্যাগাজিন ও গবেষণা কেন্দ্র,                 ১৮/টামার লেন, কলকাতা, ২৫শে বৈশাখ ১৪০৭। পৃ-৭৬,

২৩। ’উপদেশ’ প্রমথ চৌধুরী, উৎসর্গ পত্র, প্রমথ চৌধুরী গ্রন্থাবলী, বসুমতী সাহিত্য মন্দির, সনেট পঞ্চাশৎ ও অন্যান্য কবিতা, ইন্ডিয়ান এসোসিয়েটেড পাবলিশিং কলিকাতা, ৪৮।/২১

– ’ভারতী’ সম্পাদক দিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর ’ঠাকুর বাড়ী’

 

 

 

 

 

 

 

 

 

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীর শিশুসাহিত্য

(১৮৬৩-১৯১৫)

 

উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ১৮৬৩ খ্রীষ্টাব্দের ১২ মে ময়মনসিংহ জেলার অন্তর্গত মসূয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা শ্যামসুন্দর মুন্শী। হরিকিশোর রায়চৗধুরী নামে এক দূর সম্পর্কের আত্মীয় তাঁকে তাঁর পাঁচ বছর বয়সে দত্তক নেন। তখন থেকে তার নাম হয়েছিল উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। প্রথম থেকেই এই পরিবারে শিল্প, সঙ্গীত ও গণিত চর্চা হত। উপেন্দ্রকিশোর রায় স্বভাবতই শিল্প ও সঙ্গীতের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বি, এ, পাস  করেন। সম্ভবত ঐ বছরই সাধারণ ব্রাম্ম সমাজে যোগ দেন।

শৈশবের পারিবারিক পরিমন্ডল এবং চারিদিকের নিসর্গ তাঁর মনে গভীর রেখাপাত করেছিল। পরবর্তীকালে কলকাতায় অবস্থান করেও তিনি স্মৃতিময় শৈশবের মধ্যে ফেলে আসা দিনগুলোর মধ্যে ফিরে ফিরে আসতে ভালবেসেছেন। ফলে তার অন্তরের গভীরে বসবাসরত একটি পরিণত শিশু তার পথ বেঁধে দিয়েছিল, তিনি অত্যন্ত গভীরভাবে ভালবেসে সেই স্মৃতি ভারাবনত পথ অনুসরণ করেছেন, সেই পরিচিত শৈশবের পথে তিনি ফিরে এসেছেন। উপেন্দ্রকিশোরের আরো কিছু দিক লক্ষণীয় এগুলো তাঁর সাহিত্য সৃষ্টির পথকে আলোকিত করে দিয়েছিল। তিনি জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের সংস্পর্শে এসেছিলেন এবং ঠাকুরবাড়ীর সাহিত্য সংস্কৃতিচর্চার ব্যাপারে আকর্ষণ বোধ করেছিলেন। কেবল তাই নয় তিনি ব্রাম্মসমাজে যোগ দিয়েছিলেন,  ব্রাম্মধর্ম গ্রহণও করেছিলেন।

উপেন্দ্রকিশোর তাঁর পিতার জ্ঞান মণীষা যেমন পেয়েছিলেন, পারিবারিক ঐতিহ্যসূত্রেও পেয়েছিলেন সঙ্গীত ও ছবি আঁকার সূক্ষ্ম মনোবৃত্তি। অসাধারণ বেহালা বাজাতেন, ছবি আঁকা শেখার জন্য কলকাতা এসেছিলেন। সমাজের নানা প্রগতিশীল কর্মধারার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। সাহিত্য সাধনায় নিরলস একাগ্রতা ছিল। সেই সঙ্গে ছিল স্বচ্ছ বৈজ্ঞানিক মানসিকতা। ব্যক্তি হিসাবেও ছিলেন কর্তব্যপরায়ণ ও উদার মনের। নিজের সন্তানদের øেহে ও শিক্ষায় মানুষ করেছিলেন, তেমনি রায় পরিবারের অনেকেই তাঁর উদারতা ও আশ্রয়ে বড় হয়েছিলেন। এক কথায় সমগ্র রায় পরিবারকে বিদ্যায় ও বিত্তে ধরে রেখেছিলেন।

বেহালা, পাখোয়াজ, হারমোনিয়াম-অর্গানের সুরজগতে থেকেও প্রিন্টিং টেকনোলোজিতে ব্যুৎপত্তি লাভ করে উপেন্দ্রকিশোর রায় আজীবন ছোটদের জন্য লিখেছেন, এঁকেছেন। খাস বিলিতি কায়দায় তেল-রঙ, জল-রঙ ও কালি-কলমে ছবি এঁকেছেন। ইলাসট্রেটর হিসাবে উপেন্দ্রকিশোর কাজে যে দক্ষতা ও রীতির বৈচিত্র্য দেখিয়েছেন ভারতবর্ষে তা তুলনাহীন। রাতের অন্ধকারে বাড়ির ছাদে দূরবীন চোখে লাগিয়ে নিঃসীম আকাশের বুকে নক্ষত্র দেখেছেন। পৃথিবীর অপার রহস্যের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা শুনিয়েছেন। প্রেরণা জুগিয়ে শিশুসাহিত্যের জগতে প্রবেশপত্র এনে দিয়েছেন পুত্রকন্যা দৌহিত্রদের। সুকুমার-লীলা-সত্যজিৎদের সঙ্গে গড়ে তুলেছেন এক বিশাল সংস্কারমুক্ত শিশুসাহিত্যের পরিচ্ছন্ন  জগৎ। সে জগতে গুপী আর বাঘার সুর ও তালের সুদূরপ্রসারী বিস্তারে ভীড় জমেছে শিশুসাহিত্যের সহস্র ব্যক্তিত্বের। সে জগতে এসে মিলেছে রায়বাড়ি আর ঠাকুরবাড়ির রুচি, ঐতিহ্য এবং আভিজাত্য।

ছবি আঁকা, গান বাজনা ও শিশুসাহিত্য রচনায় উৎকর্ষের স্বাক্ষর ছাড়াও তাঁর বহুমুখী প্রতিভার পরিচয় তাঁর লেখায়, গানে, ছবিতে আর মুদ্রণের কাজে ছড়িয়ে আছে। বিজ্ঞান ও শিল্পের, প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের আশ্চর্য সমন্বয় ঘটেছিল উপেন্দ্রকিশোর রায়ের মধ্যে। ব্রম্মসংগীত রচনার সঙ্গে সঙ্গে মুদ্রণের কাজেও মৌলিক গবেষণা চালিয়েছেন। অননুকরণীয় সুষমামন্ডিত সহজ ভাষায় পৌরাণিক কাহিনী ও গ্রাম্য উপকথা নতুন করে লিখেছেন ছোটদের জন্য।

’ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে’ Ñ অবহেলিত শিশুদের তিনি সাহিত্যের পাতায় স্থান করে নিলেন। শিশুসাহিত্যে রূপকথা রাজ্যের সুয়োরাণীর দশা চলছিলÑস্থান ছিল অভিধানের পাতায়। সেই অবহেলিত অপাংক্তেয় শিশুদের জন্য কিছু করা যায় কি-না এই বোধ থেকেই সেই সময় এক উজ্জলতম অধ্যায়ের সূচনা করেছিলেন উপেন্দ্রকিশোর। ভিন্ন অর্থে উপেন্দ্র সাহিত্যকে ’শিশুতোষ সাহিত্যের খনি’ বলা যায়।

শিশুসাহিত্যের স্বর্ণযুগ রবীন্দ্রপ্রতিভার আংশিক দ্যুতিতে ভাস্বর হয়ে উঠেছে ঠিকই, কিন্তু সহজপাঠের সাফল্য বাদ দিলে, রবীন্দ্রনাথের শিশুসাহিত্য হিসেবে চিহ্নিত রচনা প্রায় সম্পূর্ণই শিশুবিষয়ক কিন্তু শিশুর জন্য নয়। তাঁর বিচিত্র সাহিত্য জীবনের একটি ভগ্নাংশ তাঁর ’শৈশব সাধনা’। উপরন্তু তাঁর কবি মেজাজটি সম্পূর্ণ শিশুসর্বস্ব হওয়া সম্ভব ছিল কিনা সেটাও ভেবে দেখার বিষয়। তবুও মহাকবির কালির গুণে বহু জায়গায় তা শিশুর পক্ষে উপভোগ্য হয়ে উঠেছে। কিন্তু উপেন্দ্রকিশোর প্রমুখের সাহিত্য সাধনার ধারায় শিশুর জন্য রচনা শুধু সর্বপ্রধানই নয়, প্রায় সর্বস্ব।

যোগীন্দ্রনাথ সরকার, দক্ষিনারঞ্জন মিত্র মজুমদার, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী প্রমুখ শিশুসাহিত্যিকদের উজ্জ্বল সৃষ্টির মধ্য দিয়ে শিশুসাহিত্যের স্বর্ণযুগের শুরু হয়। শিশুতোষ রচনার যাদুকর যোগীন্দ্রনাথ সরকারÑ’মাতৃভাষার আনন্দরূপের পরিচয় নিয়ে’ তিনি বাংলাদেশের শিশুর প্রথম অশ্রুহীন বর্ণপরিচয় ঘটালেন তাঁর ছড়া ও ছবির মধ্য দিয়ে। কিন্তু খেলাচ্ছলে হলেও তাঁর মাথা থেকে স্কুলের চিন্তা নির্বাসিত হয়নি। দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারই প্রথম এলেন শিশুকে রূপকথা রাজ্যের গল্প শোনাতে। রূপকথার রাজ্যের নতুন দরজা খুলে গেল বাংলাদেশের শিশুদের কাছে। কিন্তু তিনিও পূর্বধারার সম্পূর্ন রেশমুক্ত হতে পারলেন না। তাঁর ’চারু ও হারু’ (তোষিণী, ১৯১০) উপন্যাসের সর্বাঙ্গে নীতি-উপদেশের গন্ধ প্রকট। এই যুগে ’শিশুর বিষয় নিয়ে শিশুর জন্য ’যিনি প্রথম গল্প শোনালেন তিনিÑউপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী, যাঁর জগতে কৈশোর সমস্ত কিছুরই মাপকাঠি। এতদিনের চলতি ধারার এ যেন এক বিদ্রোহের আভাস। প্রথার আনুগত্য বা ’অতি মৌল শিক্ষাব্রতীর অভিমান’ এই দুটিই বিসর্জন দিয়ে, শিশুকে তিনিই প্রথম ’ইস্কুলে’র বাইরে গল্প শুনতে ডাকলেন।

পুনর্জাগরণের জন্য আগ্রহ ও প্রতিশ্রুতির কারণে তিনি রামায়ণ, মহাভারত ও পুরাণকে সাহিত্য সৃষ্টির উৎস হিসেবে গ্রহণ করেন, একত্রে লোকসাহিত্যের জন্য অনুরাগ প্রদর্শন করেন।

দেশের শিশু ও কিশোরদের কথা ভেবে এবং তাঁদের মানুষ হয়ে উঠবার উদ্দেশ্যে তিনি অননুকরনীয় সাবলীল ও সরস ভাষায়  গ্রাম্য উপকথা, রূপকথা, বিদেশী গল্প, পুরাণ, ছোটদের জন্য রামায়ণ, মহাভারত, পৌরাণিক কাহিনী, ছড়া, মৌলিক গল্প, কবিতা, গান, ধাঁধাঁ, নাটক, হেঁয়ালি ও নানা ধরনের প্রবন্ধ রচনা করেন। বিখ্যাত ছড়ার গদ্যরূপ টুনটুনির গল্প শোনালেন। ভাবগম্ভীর ব্রম্মসংগীত যেমন রচনা করলেন, তেমনি ছোটদের জন্য মজার গান লিখে সুরও দিলেন।

রবিবাসরীয় নীতি বিদ্যালয়ের ক্লাসে নীতি শিক্ষার সঙ্গে গান শেখানোর একসময়ে দায়িত্বে ছিলেন স্বয়ং উপেন্দ্রকিশোর ১

উপেন্দ্রকিশোর রায়ের গল্প বলার একটা আকর্ষনীয় ক্ষমতা ছিল। সুকুমারের ভাষায়,

সহজ বিজ্ঞানের কথা, পৃথিবীর জন্ম কথা, চাঁদ-সূর্য গ্রহ নক্ষত্রের কথা, এমনি কত কি।”— এমন সহজ আর সুন্দর করে বলতেন যে, কত সময়ে একজিবিশন বা মেলায় গিয়ে দেখেছি, আমরা যেখানে যাচ্ছি, আমাদের ঘিরে একটা ছোট খাট ভীড় জমা হয়ে যাচ্ছে।২

তাঁর শিশুসাহিত্য রচনার অন্যতম বৈশিষ্ট্য তিনি নিজের লেখার অলংকরণ নিজেই করেছেন। ছবি মুদ্রণের ব্যাপারে প্রসেসিং সম্পর্কে তাঁর জ্ঞান ও উদ্ভাবনী শক্তি বিদেশে প্রশংসিত হয়েছিল।

সমকালে শিশুদের জন্য পাঠ্যপুস্তক রচনার সঙ্গে উপেন্দ্রকিশোরের মৌলিক পার্থক্য বিদ্যমান, পাঠ্যপুস্তকে নীতিশিক্ষার প্রাধান্য ছিল, তিনি এই একঘেয়েমি থেকে শিশুদের জন্য মুক্তির গাথা সৃষ্টি করেছিলেন, কেবল তাই নয়, তিনি চমৎকার হাস্যরস সৃষ্টি করে তাদের মনোজগতের চারপাশের সকল বন্ধন ও সীমাবদ্ধতাকে দূর করে দিয়েছিলেন।

বিশ শতকের প্রথম দুই দশকে উপেন্দ্রকিশোর লেখা, ছবি আর সর্বাঙ্গসুন্দর প্রকাশনে বাংলা শিশুসাহিত্যে নতুন যুগ প্রবর্তন করে দিলেন। তাঁর সাহিত্যচর্চার হাতেখড়ি ’সখা’৩ (১৮৮৩) পত্রিকার প্রথম বর্ষের দ্বিতীয় সংখ্যায় প্রকাশিত ’মাছি’ প্রবন্ধের মাধ্যমে। এরপর ক্রমশঃ ছোটদের জন্য শিশু পত্রিকায় লিখতে শুরু করেন। প্রথম দিকে বিজ্ঞান বিষয়ক গদ্য রচনাই বেশী লিখেছেন।

উপেন্দ্রকিশোর এই প্রত্রিকাতেই প্রথম চলিত রীতিতে ছোটদের উপযোগী গল্প লিখেন।

গ্রীষ্মকাল সকালবেলা একদিন বড় সুন্দর দেখতে হয়েছে। একটি কর্ম্মকার মৌমাছি মধু আনবার জন্য বাহির হল। সে উড়ে উড়ে অনেক দূর গেল।… আসবার পথে এক বড়লোকের বাড়ীতে জানালা খোলা ছিল সুতরাং তার মধ্যে দিয়ে ঘরের ভিতর গেল। সেখানে ভারী খাবার ভীড়…ডাকাডাকি, হাকাহাকি, মহা গোলমাল। দেখেশুনে বেচারা মৌমাছির মনে বড় ভয় হল…কিন্তু তাহলে কি হয়, বাবুরা যে লাল টুকটুকে রসগোল্লা পাতে নিয়েছেন, তার একটুখানি একবার চেটে না দেখলে কি চলে?৪

অবশ্য রচনাটি অবিমিশ্র চলিত রীতিতে লেখা নয়।

উপেন্দ্রকিশোর রায়ের শিশুতোষ রচনাবলীকে প্রধানত তিনটি পর্যায়ে শ্রেণীকরণ করা যায়, এক. রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণনির্ভর, দুই. লোককাহিনী নির্ভর। তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনাসমূহের অন্যতম ’বিবিধ প্রবন্ধ’, ’পুরাণের গল্প’, ‘সেকালের কথা’ (জীববিদ্যা, ১৯০৩), ’ছেলেদের রামায়ণ’ (১৯০৭)-(’গল্পমালা’,) ’ছেলেদের মহাভারত’ ((১৯০৯), ’মহাভারতের কথা’ (১৯০৯), ’টুনটুনির বই’ (১৯১০), ’ছোট্ট রামায়ণ’ (১৯১১), পূর্ববঙ্গের রূপকথা অবলম্বনে ’গুপি গাইন ও বাঘা বাইন’ (১৯১৩) ’কবিতা ও গান’ ইত্যাদি। একটি সামাজিক দায়বদ্ধতা উপেন্দ্রকিশোরকে এভাবে সাহিত্য সাধনার পথে অগ্রসর করে দিয়েছিল।

শিশুসাহিত্যের অঙ্গসৌষ্ঠব যেমন, শিশুসাহিত্যের বিষয়বস্তু সৃষ্টিতেও তিনি বৈচিত্র্য এনেছিলেন।

পুরানের কথা-’মহাভারতের কথা’, ’পুরানের গল্প’, ’ছেলেদের রামায়ণ’, ’ছেলেদের মহাভারত’ (১৩১৫)ইত্যাদি।

হাসির নাটক- কেনারাম বেচারাম, ’মুকুল’ পত্রিকায় প্রকাশিত ও স্বগৃহে অভিনীত।। পৃ-২১  সুকুমার রায় লীলা মজুমদার, মিত্র ও ঘোষ, ১০ শ্যামাচরণ দে ষ্ট্রীট, কলিকাতা-১২

আত্মকথামূলক Ñ ’রেলগাড়ীর গান’ ইত্যাদি।

উপদেশমূলক Ñ ’গান’ ইত্যাদি।

বর্ণনামূলক Ñ ’পাখির গান’, ’গ্রীষ্মের গান’ ইত্যাদি।

ভক্তিমূলক Ñ ’ব্রহ্মসংগীত’ ইত্যাদি।

সাধারণ Ñ’খুকুমণি’, ’বেচারা’, ’সুখের চাকুরী’, ’শিশুর জাগরণ’।

বীরত্ব Ñ ’কমলা নাপিত’ ইত্যাদি।

ভক্তিমূলক Ñ ’শিশুর কথা’, ’কবিতা’, ’প্রার্থনা’ ইত্যাদি।

অস্পষ্ট ধারণা Ñ ’চাঁদের বিপদ’ ইত্যাদি।

বিজ্ঞানবিষয়ক Ñবিবিধ প্রবন্ধের কিছু রচনা।

হেঁয়ালী Ñ ’বাবার চিঠি’, ’মধুপুরের চিঠি’ ইত্যাদি।

ব্যাঙ্গাত্মক Ñ ’ময়মনসিংহের চিঠি’ ইত্যাদি।

প্রকৃতি বিষয়ক Ñ ’ঋতু’ ইত্যাদি।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা Ñ ’যখন বড় হব’ ইত্যাদি।

উপদেশমূলক Ñ ’অসন্তোষ’ ইত্যাদি।

হাস্যরস Ñ গুপি গাইন বাঘা বাইন গল্প-চলচ্চিত্র রূপায়ণ।

তিনি বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন না কিন্তু বৈজ্ঞানিক মানসিকতা নিয়ে হাফটোন পদ্ধুতিতে গবেষণা করেছেন (১৮৯৫) এবং তা কাজে লাগিয়ে ছোটদের বই ও পত্রিকার চিত্র মুদ্রণের ব্যবস্থায় প্রভূত উন্নতি সাধন করেছেন। যখন হাফটোন পদ্ধুতি পাশ্চাত্যের পরীক্ষার স্তরে ছিল তখন প্রিন্টিং টেকনোলজিতে তার এই জ্ঞান প্রাচ্যের নবদিগন্ত উন্মোচিত করেছিল। মুদ্রণ শিল্পের উন্নতির জন্য, ভাল ছবি ছাপার জন্য উপেন্দ্রকিশোর নিজে উদ্যোগী হয়ে ডায়াফ্রাম, রে স্ক্রীন আডজাস্টার যন্ত্র, ব্লক তৈরীর ডুয়োটাইপ, রে-টিন্ট প্রভৃতি পদ্ধুতির আবিষ্কার করেছিলেন। এই সফলতা বিদেশের পত্র-পত্রিকায় উচ্চ প্রশংসিত হয়েছিল এবং ঊহপুপষড়ঢ়ধবফরধ ইৎরঃধহরপপধ তে তার নাম উল্লিখিত হয়ে আছে।

‘বিবিধ প্রবন্ধে’ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে অত্যন্ত সহজ সরল ভাষায় শিশুদের অবহিত করেছেন। বিষয়বস্তুর মধ্যে অধিকাংশ জীবজন্তু সম্পর্কিত। প্রবন্ধগুলিতে জানোয়ারের প্রতি সহনশীলতা প্রকাশ পেয়েছে।

’সখা’, এপ্রিল ১৮৮৫ সংখ্যায় প্রকাশিত ’সঙ্কেত’ রচনাটিতে আলোর দীর্ঘস্থায়িত্ব ও স্বল্পস্থায়িত্ব যথাক্রমে দীর্ঘ ও হ্রস্ব সংকেতের চিহ্নস্বরূপ(Ñ) এবং (-)। দীর্ঘ ড্যাশ ও হ্রস্ব ড্যাশের ব্যবহার সম্পর্কে তিনিই প্রথম শিশুদের অবহিত করেছেন। ’মূলবর্ন’, ’বেলুন’, ’মুদ্রাযন্ত্র’, জলকণার গল্প যথাক্রমে ’সখা’ পত্রিকায় আগষ্ট ১৮৮৫, মার্চ-মে, ১৮৮৬, নভেম্বর ১৮৮৬’, ফেব্রয়ারী ১৮৮৮-তে প্রকাশিত হয়। রচনাগুলি তার বিজ্ঞানমনস্কতার পরিচয় বহন করে। এই পত্রিকার পাতাতেই প্রকাশিত হয় পুরাণের গল্প।

প্রথম গ্রন্থ ছেলেদের রামায়ণ’(১৯০৭)-এর জন্য নিজের হাতে আঁকা ছবিগুলো যখন অযোগ্য বিবেচিত হল উড-এনগ্রেভের হাতে, তখন থেকেই হাফটোন পদ্ধুতিতে ব্লক তৈরীর দিকে নিবীড় মনোযোগ দিলেন।

’সেকালের কথা’ (১৯০৩) মাসিক ’মুকুল’ (১৮৯৫) পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়, পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। গ্রন্থটিতে নিজে হাফটোন পদ্ধতিতে ব্লক তৈরী করে ব্লকে ছাপা পাতা-জোড়া ঁেসটে দেন। বিশ শতকের প্রথম দশকে যে অল্প সংখ্যক ’পপুলার সায়েন্সে’র বই’ লেখা হয়েছিল, উপেন্দ্রকিশোর রায়ের এই গ্রন্থটি ছিল তার মধ্যে অন্যতম। এখানে তিনি বৈজ্ঞানিক আবি®কৃত সত্যের ঐতিহাসিক বর্ণনা, বিজ্ঞানের আবিষ্কার, তত্ত্ব, বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা ছোটদের ভাল লাগার মত করে সহজ সরল ভাবে রচনা করেছেন। লেখক নিজে যেন তাঁর শৈশবে ফিরে এসে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ হয়ে গেছেন। বৈজ্ঞানিক মন মানসিকতার সঙ্গে যোগ হয়েছিল তাঁর সাহিত্য, চিত্র ও সঙ্গীত সৃষ্টির আনন্দ।

সতেরখানি বড় বড় ছবি এঁকে মনুষ্য জন্মের পূর্ব থেকে পৃথিবী পৃষ্ঠে আবির্ভূত জানোয়ার জাতির পরিচয় দিয়েছেন এ গ্রন্থে। বর্ণনার গুণে গল্পের বই-ই হয়ে উঠেছে। লেখক নিজেও এই সত্যটি ঘোষণা করেছেন,-

—–’এখানি গল্পের বই— বৈজ্ঞানিক পাঠ্য নহে। শিশুপাঠ্য বৈজ্ঞানিক গ্রন্থের মত কতকগুলি বিজ্ঞানের লেসন্্স সর্বস্ব নয়।’৫

ঘটিত বিষয় ও বস্তুর সময় কালান্তরিত হলেও তার চিহ্ন কালপ্রবাহে সম্পূর্ণ বিলিয়মান হয় না। এই সত্যটিকে বক্তব্যের সূত্র রূপে সামনে রেখে ছোটদের অতীতের চিহ্ন অনুসরণ করে বিবর্তনের গল্প শুনিয়েছেন উপেন্দ্রকিশোর রায়। গ্রন্থের সূচনায় তিনি নিবেদন করেছেন,

অবসরকালে পড়িয়া বালক-বালিকাগণ শিক্ষা এবং আনন্দলাভ করিবে, এই আশায় এই পুস্তকখানি লিখিত হইল। বিষয়টি বৈজ্ঞানিক হইলেও, সে হিসাবে তাহার কোনরূপ চর্চার চেষ্টা হয় নাই; বালক-বালিকাদিগকে প্রাচীন কালের কাহিনী শুনাইবার জন্য এই পুস্তক লেখা; বিজ্ঞানের কথা বলা ইহার উদ্দেশ্য নহে। ছেলেদিগকে যেরূপ করিয়া জানোয়ারের গল্প শুনাইলে তাহারা আমোদ পায়, সেইরূপ সহজ কথায় সরলভাবে এই পুুস্তকখানি লিখিতে চেষ্টা করিয়াছি। সুতরাং সকল কথাই বিজ্ঞানের তুলা দন্ডে মাপিয়া বলা সম্ভব হয় নাই, আর তাহার আশঙ্কাও বোধ করি নাই।৬

উপেন্দ্রকিশোরের আঁকা ব্রনোটাসরস্, প্লীসিয়োসরস, মাইলোডন্, ম্যমথের ছবি, ম্যাস্টেডন্, ডাইনোথিরিয়াম্, ষ্টিগোসরস্ ইত্যাদি ছবিগুলি কেবল অতীতের বিবর্তিত জানোয়ারের প্রত্যক্ষীকরণই নয়। ছবিগুলির কমনীয়তায় জীবগুলি দৈহিক সৌন্দর্যের রেখায়ও যেমন, তেমনি সেগুলির চালচিত্রেও বর্তমান। শিল্প সৌন্দর্যের সন্ধানে ’সেকালের কথা’র মূল্য স্বীকার করে সমালোচক বলেন।

প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক উপেন্দ্রকিশোর রায়ের রচনার মধ্যে সেকালের জীবজন্তু-বিষয়ক লেখাগুলি বিশেষ জনপ্রিয়           হয়েছিল।৭

অন্যদিকে ‘রামায়ণ’ জুড়ে যুদ্ধের দামামা বাজলেও উপেন্দ্রকিশোর রায় শিশুমনে যথোচিত আনন্দ সৃষ্টি করেছেন। লঙ্কাকান্ডে অনায়াসে বালী,

’রাবন মহাশয়কে পাখিটির মত খপ্ করিয়া বগলে পুরিয়া বসিয়াছে।…….।……….. । সে রাবনকে বগলে              করিয়াই আরও তিনবার সন্ধ্যা করিল। এদিকে সেই বগলের চাপে, গরমে, ঘামে, আর গন্ধে বেচারা চ্যাপ্টা     হইয়া, সিদ্ধ হইয়া, দম আটকাইয়া, পেট ঢাক হইয়া নাকালের এক শেষ।

’ছেলেদের রামায়ণে’ (১৯০৭) রামকাহিনী বর্ণিত হয়েছে। প্রচ্ছদ চিত্র এবং ভিতরের ছবিও ছিল তিনি এঁকেছিলেন। যুক্তাক্ষর বর্জিত শব্দ ও সরল, সুললিত ভাষায় নবীন পাঠকদের কথা মনে রেখে রামায়ণ, মহাভারতের গদ্যরূপ শোনালেন। তাঁর অনুপম ভাষা থেকে ’অরণ্যকান্ড’ অংশের উদ্ধৃতি,

দন্ডক বনে অনেক মুনির আশ্রম ছিল। সেই সকল আশ্রমের মধ্যে এক রাত্রি থাকিয়া রাম সেখান হইতে আরও গভীর বনে প্রবেশ করিলেন। বনবাসে আসিয়া অবধি এত দিনে তাঁহারা কোন রাক্ষস দেখিতে পান নাই। একবার বেশ জমকালো রকমের একটা রাক্ষস তাঁহাদের সামনে পড়িল। বনের ভিতর সে দাঁড়াইয়া আছে, যেন একটা পাহাড় ! চেহারার কথা আর কি বলিব! যেমন বিষম ভূঁড়ি, তেমন বিদঘুঁটে হাঁ! তাহার উপর আবার গর্তপানা দুটো চোখ, গন্ডারের চামড়ার মত অধর, পরনে রক্ত-চর্বি মাখা বাঘছাল। রাক্ষস মহাশয়ের তখন জলখাবার খাওয়া হইতেছিল। খাওয়ার আয়োজন বেশী নয়, খালি গোটা তিনেক সিংহ, চারিটা বাঘ, দুইটাÑগন্ডার, দশটা হরিণ, আর একটা হাতির মাথা।

’রামায়ণে’ যুদ্ধের দামামার মধ্যে মজা সৃষ্টির সুযোগ করেছেন। লঙ্কাকান্ডে বালীর উক্তি,

’রাবন মহাশয়কে পাখিটির মত খপ্ করিয়া বগলে পুরিয়া বসিয়াছে। —-।—-সে রাবনকে বগলে করিয়াই আরও তিনবার সন্ধ্যা করিল। এদিকে সেই বগলের চাপে, গরমে, ঘামে আর গন্ধে বেচারা চ্যাপ্টা হইয়া, সিদ্ধ হইয়া, দম আটকাইয়া, পেট ঢাক হইয়া নাকালের এক শেষ।’

রামায়ণের বর্ণনায় রূপকথার আমেজও উপেন্দ্রকিশোর সৃষ্টি করেছেন,

রাম-রাবণের ঘোরতর যুদ্ধ চলছে এমন সময় দেখা গেল যে, মণি-মুক্তার কাজ করা একখানি উজ্জ্বল রথ স্বর্গ হইতে নামিয়া আসিতেছে। সেই রথের ঘোড়া ছয়টি সবুজ রঙের, তাহাদের শরীরে সোনার অলঙ্কার, আর গলায় মুক্তার মালা।

’গল্পমালা’ গ্রন্থে সমকালীন জীবন থেকে শুরু করে দেশী বিদেশী রূপকথা, পুরাণ ও হাসির গল্প স্থান পেয়েছে। গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত, ‘সহজে কি বড়লোক হওয়া যায়’, ‘বড়লোক কিসে হয়’- উপদেশমূলক রচনা। ‘বানর রাজপুত্র’ রূপকথামূলক রচনা। পুরাতন নরওয়ে আর সুইডেন দেশের পুরাণের কাহিনী অবলম্বনে রচিত হয়েছে ‘নরওয়ে দেশের পুরাণ’। এর সূচনায় লিখেছেন,

সেকালের আগে যখন পৃথিবী সমুদ্র বা বায়ু কিছুই ছিল নাÑ তখন কেবল বিশ্ব পিতা (অষষভধঃযবৎ) ছিলেন। তাঁহাকে কেহ সৃষ্টি করে নাই, কেউই তাঁহাকে দেখিতে পায় না; তিনি যাহা চাহেন, তাহাই হয়। সৃষ্টির আগে চারিদিকেই শূন্য আর অন্ধকার ছিল, এই বিশ্ব পিতার নাম ছিল ওডিন (ঙফরহ) বা উওডেন (ডড়ফবহ)- যা হ’তে বুধবারের নাম ওয়েডনেজডে হয়েছে। ওডিনের এক পুত্রের নাম টিউ (ঞরঁ) যা হতে টিউজডে (ঞঁবংফধ) মঙ্গলবার হয়েছে। ইনি ছিলেন বীর বা যুদ্ধের দেবতা।

ওডিনের আরেক পুত্র থরো (ঞযড়ৎ) নামে থার্সডে (ঞযঁৎংফধু) বৃহস্পতিবার হয়েছে। ইনি ছিলেন শক্তির দেবতা আর ছিল একটি হাতুড়ি।

‘গল্পমালা’র অন্তর্ভুক্ত ’গুপী গাইন বাঘা বাইন’ এর সার্থক চলচ্চিত্র রূপায়ন হয়েছে।

কিছুসংখ্যক রচনায় হাফটোন ছবি, সংগীত, ফটোগ্রাফী, হারমোনিয়াম, দুরবীন, মুদ্রাযন্ত্র ইত্যাদি সম্বন্ধে শিশুদের ধারণা দেবার চেষ্টা করেছেন। কিছু অংশ জীবজন্তু সম্পর্কিত তাতে জীবজন্তুর স্বভাব, জীবন পরিক্রমা, তাদের বুদ্ধিবৃত্তি, ধুর্ততা, ব্যথা বেদনা, সহানুভূতি, তাদের উপকারের বর্ণনা এবং সেই সাথে উপদেশপূর্ণ বক্তব্য দিয়েছেন।

’মহাভারতের গল্প’ (১৯০৯) ব্যাসদেব অথবা কাশীরামের বিশাল মহাভারত শিল্পীর চেতনায় শিশুদের কোমলচিত্তে আনন্দদায়ক ভাবে উপস্থাপিত করেছেন। মহাভারতের একটি বর্ণনায় রাক্ষস যেখানে দাঁত কড়মড় করে এসে হাজির,

কী বিকট চেহারা। এক কান হইতে আর এক কান পর্যন্ত তাহার দাঁত।—- সে গর্জন করিয়া বলিল মোর ভাতটি খাইছিস? তোকে যম-ঘর পেঠ্ঠাইবোনি?—–রাক্ষস দুই হাতে ধাঁই ধাঁই করিয়া প্রাণপণে তাঁহার পিঠে কিল মারিতে লাগিল।

সমস্ত মহাভারত জুড়েই দেবতা ও অসুরের যুদ্ধবিগ্রহের কথা, মুনি ঋষিদের তপস্যা ও চমতকারীত্বের কথা ধ্বনিত হয়েছে। এর সূচনায় উপেন্দ্রকিশোর লিখেছেন আকাশের উত্তরভাগের সপ্তর্ষির কথাÑযাকে তিনি সাতমুনি বলেছেন। এই মুনিগণ ব্রম্মার পুত্র। পৃথিবী জন্মক্ষণে এঁদের জন্ম। তারা যথাক্রমেÑমরীচি, অত্রি, অঙ্গি, পুলস্ত্য, পুলহ, ক্রতু ও বশিষ্ঠ।

সর্বকনিষ্ঠ বশিষ্টের প্রপৌত্র মহামুনি ব্যাস যাঁর কোন মৃত্যু নেইÑতিনি সর্বজ্ঞ। ব্যাসদেব মানুষের ভালমন্দ চিন্তা করে শাস্ত্রের সারকথা শিষ্যদের মাঝে প্রচারের উদ্দেশ্যে ভগবানের সহায়তায় গণেশের স্মরণাপন্ন হন এবং বেদ, বেদাঙ্গ, উপনিষদ, পুরাণ, ইতিহাস প্রভৃতির সারকথা এমনকি সংসারের সব কাজের উপদেশও অন্তর্ভূক্ত করেন। পৃথিবী, চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, তারা, নদ-নদী, সমুদ্র, পর্বত, গ্রাম, নগর, বন উপবন সবকিছুরই বর্ণনা এতে  রয়েছে।

এই পুস্তকটি রচনা করে ব্যাসদেব প্রথমে তার পুত্র শুকদেব পরে তার শিষ্যরা শিক্ষা করেন। দেবলোকে নারদ, পিতৃলোকে অসিত দেবল, গন্ধর্ব যক্ষ ও রাক্ষসদিগের নিকট শুকদেব ও মনুষ্যলোকে বৈশায়ন এর প্রচার করেন। দেবতারা ব্যাসের এই পুস্তক ও চারিবেদ ওজন করে দেখেছিলেন ব্যাসের পুস্তকই অধিক ভারী তাই এই পুস্তকের নাম রাখেন ’মহাভারত’।

’ছেলেদের মহাভারতে’ (১৯০৯) অতীত ভারতের গল্প-গাথা। বর্তমানের আলোকে বর্ণনা করেছেন ইতিহাসকে। বর্তমান চলমান জীবনে প্রত্যক্ষ করার শিল্পচিন্তায় ধরে দিতে চেয়েছেন জীবনের। ‘উপেন্দ্রকিশোর বাঙালি হিন্দু সমাজের পুণর্জাগরনের এ মাহেন্দ্রক্ষণেই এ উৎসগুলোকে অবলম্বন করেছিলেন।৮

তাঁর ‘কবিতা ও গান’ সামাজিক পটভূমিতে রচিত, উপেন্দ্রকিশোরের নিজের শৈশব এখানে ভাষা পেয়েছে। গ্রন্থের বিষয়বস্তুকে পৃথক দু’টি ভাগে ভাগ করলে কবিতা অংশে, ’খুকুমণি’, ‘কমলা নাপিত’, ‘বেচারা’, ‘শিশুর কথা’, ‘কবিতা’, ‘সুখের চাকুরী’, ’শিশুর ‘জাগরণ’, ‘চাঁদের বিপদ’, ‘প্রার্থনা’, ‘বাবার চিঠি’, ‘ময়মনসিংহের চিঠি’, ‘ঋতু’, ‘মধুপুরের চিঠি’, ‘যখন বড় হব’, ‘অসন্তোষ’ পাওয়া যায়।

‘খুকুমণি’ কবিতায় খুকুমণির নিজের মত করে অসংলগ্ন অস্পষ্ট আধোবুলি বিবৃত হয়েছে। যেমন,

এই যে আমাল থোনাল বালা, থ্যাকলা দিল গলে,

লাঙ্গা তুলি খিল হাতে, খেলতে গেল পলে।

‘কমলা নাপিত’-এ বুদ্ধির বলে কি করে কমলা নাপিত বাঘের পালকে পরাস্ত করে গলা কেটে ফেলল- তার কাহিনী। ‘বেচারা’তে কুকুরের স্বভাবের বর্ণনা, ‘শিশুর কথা’য় ভক্তিভরে করুণাময়ের দোয়া প্রার্থনা, ‘কবিতা’য় সৃষ্টিকর্তার প্রতি ভক্তিমূলক প্রেমের বাণী, গান অংশে ’রেল গাড়ির গান’, ’গান’, ’পাখির গান’, ’গ্রীষ্মের গান’ ও ’ব্রম্মসংগীত’ অন্তর্ভুক্ত করেছেন। তাঁর ’রেলগাড়ির গান’-একটি অতি সাধারণ কবিতা,

ঠনং ঠনং ঠনং বাজে ঘন্টা,

আমরা সবাই রেলের গাড়ি।

ছুটে আয় ঘরমুখো ভাই,

তলপী নিয়ে টিকিট কিনে,

পৌঁছে দেব তাডাতাড়ি।

মোরা করব নাকো দেরি,

রব মিনিট দুই চারি।

শেষে পোঁ পোঁ ভক্!

ভকত্ ভকত্ ভকত্ ভকত্!

পলক মাঝে মুলুক যাব ছাড়ি।

কলিকাতা রবিবাসরীয় নীতিবিদ্যালয়ের উপহার বিতরণ উপলক্ষ্যে অভিনীত এক অংকের নাটিকা ’অসন্তোষ’।

ছেলেরা (ছাত্ররা) তাদের নিজেদের পারিপার্শ্বিক অবস্থা নিয়ে সুখী নয়। লেখাপড়া-খাওয়া ঘুম ইত্যাদি কাজে তারা নিয়মশৃঙ্খলা মানতে রাজী নয়। তাদের ক্ষোভÑ তারা ছোট বলে কেউই তাদের কথা শোনেনাÑ কেউ তাদের মানেনা। এমন সময় দেবদূত এসে হাজির। দেবদুতের প্রতিশ্রুতি,

‘ভালমতে মিলে মিশে থাকিস্ যদি তাহাই হবে।

কিন্তু ছেলেরা ভালমতে থাকতে পারেনা। কে কোন কাজটা বেশী করবে এই নিয়ে আবার বিবাদ শুরু হয়। আবারও দেবদুত এসে হাজির হয়। বলে,

তোমাদের বদনে ছাই, গালে কালি!

এ মধুর মানব জীবন পেয়ে যারা

দিবারাত অসুখেতে হয় সারা,

তাহাদের পোড়া কপাল,

তাদের জীবন কেঁদেই যাবে চলি।

বৈজ্ঞানিক রচনাদি ছেড়ে ’মুকুলে’র পৃষ্ঠাতে লিখলেন টুনটুনির বইয়ের অদ্ভূত আশ্চর্য সুন্দর গল্পগুলি। উপেন্দ্রকিশোর রায়ের শ্রেষ্ঠ শিশুগ্রন্থ ‘টুনটুনির বই’ (১৯১০)। ‘সন্দেশ’ প্রকাশনার পুর্বে উপেন্দ্রকিশোর রায়ের যে সমস্ত বই গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছিল এই বই তার একটি। এ সমস্ত গ্রন্থ ’(ছোটদের রামায়ণ) লেখার সময় তিনি শিশুদের (বালকদের) ভোকাবুলারির সীমাবদ্ধতা সম্বন্ধে সচেতন ছিলেন। ’টুনটুনির বই’ তাঁর মৌলিক রচনা নয়। সাতাশটি লোককথার পুনর্জন্ম। গল্পের ছবিগুলি নিজস্ব চিত্রিত। রবীন্দ্রনাথের ’ছেলে-ভুলানো ছড়া’ (১৮৯৪) প্রকাশের পর উপেন্দ্রকিশোর রায়ও গ্রাম বাংলার লোককথা নিযে বই লিখবার প্রেরণা অনুভব করেন।

সন্ধ্যার সময় শিশুরা যখন আহার না করিয়াই ঘুমাইয়া পড়িতে চায়, তখন পূর্ববঙ্গের কোনো কোনো অঞ্চলের øেহরূপিণী মহিলাগণ এই গল্পগুলি বলিয়া তাহাদের জাগাইয়া রাখেন। সেই গল্পের স্বাদ শিশুরা বড় হইয়াও ভুলিতে পারে না।৯

উপেন্দ্রকিশোর টুনটুনির গল্পগুলির মধ্যে এই চিরন্তন সাহিত্যিক তথা মানবিক মূল্য উপলব্ধি করেছিলেন। গল্পচ্ছলে বিভিন্ন জন্তু-জানোয়ারের সঙ্গে শিশুদের পরিচয় করিয়ে দেবার এক নতুন পদ্ধুতিতে গড়ে তুললেন শিশুসাহিত্যের আরেক আকর্ষণীয় দিক। পশুপাখির প্রতীকে নীতিগল্প বা হিতোপদেশ নয়, ভালমন্দের উপকরণে শিশু কৌতুহল চরিতার্থের এক আনন্দ উপকরণ নিয়ে এলেন। বিচিত্রগামী হয়ে উঠলো ক্রমশঃ তার রচনা ভান্ডার।

বইটির অধিকাংশ গল্পই ঈশপ্স১০ ফেবলস্ ঈষৎ পরবর্তিত আকারে রচিত। ভারতীয় নীতি কাহিনীতে পশুপাখী চরিত্ররা আসলে ছদ্মবেশী মানুষ যেখানে প্রাণীকুলের বুদ্ধিমত্তার কাছে মানুষ পরাস্ত হয় আবার সাধারণ প্রাণীর কাছে অপেক্ষাকৃত সাধারণ প্রাণী পরাস্ত হয়। এভাবে সবলের কাছে দুর্বলের জয় ঘোষিত হয়। মানুষ বুদ্ধিবৃত্তি জীব, নিকৃষ্ট প্রাণীর সামনে তাকে বোকা বানানো শিশুমনের বিরোধী। অনেকসময় শিশুরা এ ব্যাপারটি মানতে চায়না। আধুনিক প্রযুক্তির যুগে মানুষ বুদ্ধিবৃত্তিবলে যেখানে পশুপাথী থেকে শুরু করে মহাকাশ এবং সাগর তলদেশও জয় করে ফেলেছে।

প্রথম তিনটি গল্প টুনটুনিকে কেন্দ্র করে যেমন- টুনটুনি আর বিড়ালের কথা, টুনটুনি আর নাপিতের কথা এবং টুনটুনি আর রাজার কথা। গল্পগুলিতে  টুনটুনির বুদ্ধিমত্তা প্রকাশ পেয়েছে। সে বুদ্ধির বলে বিড়াল, নাপিত এবং এমনকি রাজাকেও পরাজিত করেছে। এ প্রসঙ্গে টুনটুনির বক্তব্য ছড়ায় কেটেছেন উপেন্দ্রকিশোর,

রাজার ঘরে যে ধন আছে

টুনির  ঘরেও সে ধন আছে!

*            *             *

রাজা বড় ধনে কাতর

টুনির ধন নিলে বাড়ির ভিতর!

*             *              *

রাজা ভারি ভয় পেল

টুনির টাকা ফিরিয়ে দিল।

*             *            *

বড় মজা বড় মজা

রাজা খেলেন ব্যাঙ ভাজা!

*             *            *

এক টুনিতে টুনটুনাল

সাত রানীর নাক কাটাল!

*             *             *

 

নাক- কাটা রাজা রে

দেখ তো কেমন সাজা রে!

টুনিভাই, নাপিতদাদা, বিড়ালভাই, আগুনভাই, লাঠি ভাই, বাঘের মামা নরহরিদাস চরিত্রগুলি আলো করে আছে টুনটুনির বই। পড়ুয়াদের মনপ্রাণ আলোকিত হয়ে ওঠে। সারা বই জুড়েই আনন্দ যজ্ঞ বসিয়েছেন উপেন্দ্রকিশোর রায়। যেমন বোকা জোলার সঙ্গে রাজকন্যের বিয়ের ব্যবস্থা করতে চালাক শেয়াল যেসব পরিকল্পনা করেছিল তা এবং সেগুলির কার্যকারণের অনবদ্য বর্ণনা সমগ্র শিশুসাহিত্যের এক উল্লেখযোগ্য অধ্যায় হয়ে আছে।

সেই বরকর্তা, শেয়ালের পোশাকটি উপেন্দ্রকিশোর রায়ের তুলিতে আর শব্দে এমন আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে যে, সব কালের সব শিশুই দেখতে পায়,

কানে কলম গুঁজে পাগড়ি এঁটে, জামা-জুতো পরে, চাদর জড়িয়ে, ছাতা বগলে করে, শিয়াল যখন রাজার কাছে উপস্থিত হল, তখন রাজামশাই ভাবলেন, এ খুব পন্ডিত লোক হবে।

জোলার বিয়েতে বরযাত্রী চলেছে বারো হাজার ব্যাঙ, পাঁচ হাজার শেয়াল। সকলে একসঙ্গে গান ধরেছে হুয়া, হুয়া, হুয়া, হুয়া! ঘোঁৎ ঘোঁৎ, ঘেঁয়াও ঘেঁয়াও। সঙ্গে সাত হাজার শালিক বলতে শুরু করেছে,

ফড়িং সঙ্গে সঙ্গে চারিজনং

চকিৎ কাট কাট কাট গুরুচরণ।

বর্ণ আর সুরের বৈচিত্র্যে টুনটুনির বইয়ের গল্পগুলিকে সাজিয়েছেন উপেন্দ্রকিশোর রায়। উকুনে বুড়ির গল্পের মালায় বক থেকে শুরু করে নদী, হাতি, গাছ, ঘুঘু থেকে মহারাজ পর্যন্ত এগিয়ে গেছে। আবার পান্তাবুড়ি থেকে শিঙি মাছ, বেল, গোবর, ক্ষুর ইত্যাদি পর্যন্ত গল্প এগিয়ে গেছে।

বুদ্ধুর বাপের বাঘ হত্যা অনবদ্য। মজন্তালী সরকার বুদ্ধির রসিকতায় উজ্জ্ল। শেষ উক্তি, ’আর কি হবে? তোরা সব ছোট-ছোট জানোয়ার পাঠিয়েছিলি। দেখে হাসতে হাসতে আমার পেটই ফেটে গিয়েছে।’ সে নিজের জীবনের সঙ্গে প্রতারণা করে বুদ্ধির জয়ধ্বজা উড়িয়ে গেল।

বলার ভঙ্গীতে ছিল ঋজুমুখীনতা-কথ্যভাষায় যা ছোটদের মন জয় করে। পশু-পাখী, জন্তু-জানোয়ারের বোকামি আর চালাকির গল্পে উপেন্দ্রকিশোর রায়ের এই বইটি ছোটদের মন জয় করবার প্রয়াস সর্বত্রই লক্ষ্যণীয়।

ফেব্লসের অন্যতম বৈশিষ্ট্যই হল সামাজিক অসঙ্গতির প্রতি কটাক্ষ সৃষ্টি করা। জন্তু-জানোয়ারদের রূপকে আসলে এই জাতীয় সমস্যার উদঘাটনেই ফেব্্ল্্স্ রচনার সার্থকতা। জন্তু-জানোয়ারেরা স্বজাতীয়, কিন্তু তাদের চরিত্র ও আচরণে প্রকাশিত হয় মানবসমাজের বৈশিষ্ট্য।Ñনীতিটুকু অপ্রচ্ছন্ন নয়, বড় ছোটর অর্থহীন দম্ভের প্রতি দৃক্পাত করে না। ছোটদের নৈতিকবোধ গড়ে তোলার পক্ষে এ জাতীয়  ফেব্ল্সের প্রয়োজন আছে ঠিকই, কিন্তু এর শিল্পজ্ঞান, জগৎ সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা সেই নৈতিকতার সীমা ছাড়িয়ে মানবজীবনের গভীরতর রহস্যের সন্ধান এনে দেয়। শিশুসাহিত্যের এই ধারাটি তখন অনিবার্যভাবে বড়দের হয়ে ওঠে। ভীন দেশের প্রতিভা ও সাহিত্যের সঙ্গে বাংলার ছেলেমেয়েদের পরিচিত করে এভাবেই বাংলা তথা ভারতের সঙ্গে অন্য দেশের সাহিত্যিক সম্পর্ক স্থাপন করেছেন। এভাবেই দুই দেশের ছেলেমেয়েরা সাজুয্যবোধে পরস্পরের নিকটস্থ হয়। শিশুসাহিত্যের গন্ডি যায় ব্যাপকতর হয়ে।

শান্তিনিকেতনের পাঠভবনে উন্দ্রেকিশোরের টুনটুনির বই, ছেলেদের রামায়ণ গল্প পাঠ্য ছিল। পরবর্তীকালে বাংলাদেশ স্কুল টেক্সট্ বোর্ডের। ’টুনটুনির বই’ প্রাথমিক স্কুল পাঠ্য বইয়ের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল।১১

অনেক ক্ষেত্রে প্রকাশ-ভঙ্গীতে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রভাব আছে বলে অনেকে মনে করেন। কিন্তু উপেন্দ্রকিশোর রায়ের শব্দযোজনায় বোকা জোলা আর শেয়ালের কথা ব্যতীত ছাব্বিশটি গল্পের অন্যত্র এই ভাব পরিলক্ষিত হয় না। তাঁর জীবজগৎ মোটামুটি মানব জগতের বাচনভঙ্গীতেই অভ্যস্ত। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই মায়াময়তা, সেই ভেতরকার দৃষ্টি, সেই আলো ফোটানোর যাদুশক্তি যা লিপির ছবি হয়ে, ছবির রূপ হয়ে, রূপের রস হয়ে ঝড়ে পড়েছে তা উপেন্দ্রকিশোর রায়ের ছিল না। উপেন্দ্রকিশোর রায় সোজা কথায়, স্পষ্ট উপমায় ছোটদের মনকে আকৃষ্ট করেন; যেমন তাঁর ‘ছোট্ট রামায়ণের’ (১৯১১) সেই তাড়কাবধের বর্ণনাটি;

মরিবে রাক্ষসী বুড়ি, রক্ষা নাই তার,

তখনি দিলেন রামধনুকে টঙ্কার।

টং টং রবে তার রুষি ভয়ঙ্কর,

দাঁত কড়মড়ি বুড়ি কাঁপে থর থর।

…          …           …

কান যেন কুলো তার, দাঁত যেন মুলো,

জ্বল-জ্বল দুই চোখে জ্বলে যেন চুলো।

বাল্মীকির রামায়ণের ’বালখন্ডে’র বর্ণনার চাইতে উপেন্দ্রকিশোরের রামায়ণ অনেক বেশী সংক্ষিপ্ত ও সংহত। বাংলার রাক্ষসের শ্বাশতকালীন রূপ এঁকেছেন উপেন্দ্রকিশোর। কবিতার ছন্দ মিলিয়ে রামকাহিনী বর্ণনা করেছেন।

উপেন্দ্রকিশোর প্রতিভার বহুমুখী কর্মধারার মধ্যে শিশুতোষ মাসিক ’সন্দেশ’ (১৯১৩)১২ পত্রিকার সম্পাদনা একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে। তিনি পঞ্চাশ বছর বয়সে মৃত্যুর (১৯১৫) দুই বছর পূর্বে এই পত্রিকা সম্পাদনায় হাত দেন। শিশুসাহিত্য বিকাশের লক্ষ্যে এই পত্রিকার পাতায় তিনি সমসাময়িক ঘটনাবলী এবং যাবতীয় ঐতিহাসিক সাংস্কৃতিক বৈজ্ঞানিক সংবাদকে সহজবোধ্য ও আকর্ষণীয় ভাষায় উপস্থাপিত করেছেন। শিশুপোযোগী সাহিত্য-রচনা, সুমুদ্রিত চিত্তাকর্ষক ছবি, উন্নতমানের ইলাসট্রেশনে পত্রিকাটিকে সমৃদ্ধ করেছিল।

বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্যেও উল্লেখযোগ্য ছিল পত্রিকাটি। পৌরাণিক কাহিনী, দেশ-বিদেশের উপকথা, রূপকথা, মৌলিক গল্প, ছড়া, কবিতা, গান ছাড়াও সন্দর্ভ, ধাধাঁ, হেঁয়ালি, দেশ-বিদেশের খবর, ঐতিহাসিক ও বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ, জীবনী, ভ্রমনকাহিনী, জীবজন্তুর কথা, আবিষ্কার, অভিযানের কাহিনী-সবকিছুই সরসভাবে লিখিত হত এবং ছবি ও ফটোতে সুসজ্জিত থাকতো। তথ্যসমৃদ্ধ প্রবন্ধও গল্পের মত চিত্তাকর্ষক হয়ে উঠতো।

প্রথম দু-এক মাস ’সন্দেশ’-এর সবকটি গল্প ও প্রবন্ধ উপেন্দ্রকিশোর নিজেই লিখেছিলেন। এরপর তার পরিবার এগিয়ে এসে বাংলা শিশুসাহিত্যের ইতিহাসে এক স্বর্ণময় অধ্যায়ের সৃষ্টি করেন। কিছুদিনের মধ্যে অনেক গুণী লেখক এগিয়ে আসেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, সুকুমার রায়, সুনির্মল বসু এবং কাজী নজরুল ইসলামও এই পত্রিকায় শিশুতোষ রচনা দিয়েছেন। বাংলা শিশুসাহিত্যের ইতিহাসে ’সন্দেশে’র সবচেয়ে বড় অবদান হল রায়চৌধুরী পরিবারের প্রতিভা আবিষ্কার। ’সন্দেশ’কে ঐতিহ্য অনুযায়ী মনোজ্ঞ ও শিক্ষাপ্রদ করে তোলা ছিল উপেন্দ্রকিশোরের একটা বড় কাজ।

প্রথম থেকেই সন্দেশ পত্রিকার একটি মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল যাতে ছেলেমেয়েরা আনন্দের সঙ্গে শিক্ষালাভ করে। শিক্ষা অর্থাৎ স্কুলের বাঁধাধরা পাঠ বা তার পরিপূরক নয়, স্বদেশ বিদেশের কালাতিক্রম মানব সভ্যতার ঐতিহ্য: ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক ও বৈজ্ঞানিক সমস্ত সংবাদ: সমসাময়িক উল্লেখযোগ্য ঘটনা Ñ ছোটদের কাছে সহজ ও সরসভাবে উপস্থিত করা হয়েছিল যাতে তাদের মনের গভীরে স্বাভাবিকভাবেই যথার্থ শিক্ষা সংস্কৃতির ভিত্তি স্থাপিত হতে পারে।

১৯১৩-১৫ সংখ্যার ’সন্দেশ’ পত্রিকায় ’পুরাণের গল্প’ প্রাক ছাব্বিশটি গল্পের সমাহার। পৃথিবীর পিতা, গণেশের বিবাহ, শিবের বিয়ে স্যমন্তক মণি প্রভৃতি। বাচনভঙ্গী সরস, বর্ণনা ঋজুমুখী। দেবদেবীর মাহাত্ম বর্ণিত হয়েছে। পৃথিবী জন্মের কাহিনীটি অভিনব।

পৃথিবীর আদি রাজা পৃথু, তিনি সূর্যবংশের লোক। প্রজাদিগকে খুশী রেখেছিলেন বলে লোকে তাকে ’রাজা’ বলে ডাকতেন। তিনি পৃথিবী মনুষ্য বসবাসের উপযোগী করেছেন। তার জন্মের পূর্বে পৃথিবী ছিল শুকনো খট্খটে, জমি কঙ্করময়, আকাশ মেঘশূন্য। শস্য ফলাবার উপায় ছিলনা। মানুষের কষ্ট দেখে রাজা তীরধণুক দিয়ে র্পৃথিবীকে মারতে উদ্যত হন। পৃথিবী তখন গাই সেজে ব্রম্মলোকে পালিয়ে যায়। কিন্তু রাজা সেখান হতে তাকে ধরে নিয়ে আসে। পৃথিবী তখন হাত জোড় করে তার কাছে মাফ চায়, বলে সে না হলে শস্যই-বা কি করে ফলবে, মানুষ থাকবেই-বা কোথায় গাই নামক সেই পৃথিবী অশেষ দুধ দান করে।  কাজেই এত উপকারী জিনিসকে রাজা মারবেনই বা কিরূপে? পৃথু তাকে প্রাণ দিলেন বলে পৃথুর কন্যা হলেন পৃথিবী বা পৃথ্বি।

নিছক মনোরঞ্জন ছাড়াও সেসব লেখার একটা উদ্দেশ্য ছিল জগৎ ও জীবন সম্বন্ধে ছোটদের কৌতুহল ও ঔৎসুক্যকে জাগিয়ে দেওয়া।

উপেন্দ্রকিশোরের লেখা ও বিশেষত আঁকা ছবিগুলোতে হাস্যরসিকতার অজস্র উপাদান ছড়িয়ে রয়েছে। পৌরাণিক গল্পের ছবিতে হাস্যরসের তেমন সুযোগ থাকেনা, কিন্তু সেখানেওÑহয়তো শিশুদের কথা চিন্তা করেইÑদৈত্য দানব রাক্ষস পিশাচের চেহারা আঁকতে গিয়ে উপেন্দ্রকিশোর ভয়ঙ্কর রসের সঙ্গে হাস্যরস মেলাতে দ্বিধা করেন নি। তাই তাঁর আঁকা রাক্ষসগুলিকে অনেক সময় মানুষেরই ঈষৎ সংস্করণ বলে মনে হয়। আর মানুষদের নিয়ে যে হাসির ছবি, তাতে চেনাজানা মানুষদেরই দেখতে পাওয়া যায় হাস্যকর অবস্থায়, হাস্যকর ভাবভঙ্গিতে। এইসব ছবিতে কার্টুনের অতিরঞ্জন নেইÑএ হাসি অট্টহাসি নয়Ñএ হাসিতে আছে মৃদু মোলায়েম øিগ্ধ সহজভাব, যাতে শ্লেষ বা বিদ্রুপের লেশমাত্র নেই। আসলে এ হাসি উপেন্দ্রকিশোরেরই চরিত্রের প্রতিফলন। মানুষ হিসেবে তাঁকে যারা চিনতেন, তাঁরাও এই কথা বলেন।

প্রথম পর্যায়েই পত্রিকাখানি সমসাময়িক কালের অন্যান্য শিশুপত্রিকার সাথে প্রতিযোগিতায় ঈর্ষণীয় স্থান অধিকার করে। শিশুসাহিত্যের দুঃসময়ে ’সন্দেশ’ পত্রিকা নিঃসন্দেহে একটি উল্লেখযোগ্য অবদান। উপেন্দ্রকিশোর শিশুসাহিত্য রচনার সময়টি ছিল শিশুসাহিত্য রচনার অপ্রতুলতার যুগ। ১৯১৩-১৫ মাত্র দুই বছর ’সন্দেশ’ সম্পাদনা করেন তিনি।

উপেন্দ্রকিশোরের মৃত্যুর পরের বছর জানুয়ারী মাসে ’সন্দেশ’ পত্রিকায় লেখা হয়,

তোমরা তাহাকে না চিনিলেও, তিনি তোমাদিগকে বাঙলার সকল বালক-বালিকাকে, শিশুদের মনটিকে বেশ চিনিতেন। তাই যেটি বলিলে আর যেমনভাবে বলিলে বেশ সহজে তোমরা বুঝিবে, তোমাদের মনের মত হইবে, তোমাদের প্রতি গভীর øেহ পরবশ হইয়া বহু পরিশ্রম ও যতœ, তীক্ষèবুদ্ধি ও নিপুণতা প্রয়োগে তোমাদের শিক্ষা ও আমোদ দিতে, তোমাদিগকে ফুর্তি দিয়া ভাল করিতে সর্বদা চেষ্টা করিতেন।১৪

বাংলা ভাষাভাষি শিশু ও কিশোরপোযোগী সাহিত্য রচনা করে মুষ্টিমেয় যে কজন শিশুসাহিত্যিক অক্ষয়কীর্তি লাভ করেছেন, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী তাঁদের অন্যতম। বাংলা শিশুসাহিত্যে ’রায়চৌধুরী’ পরিবারের তিনিই ছিলেন কর্ণধার। তিনি বাংলা শিশুসাহিত্যকে একটা পরিণতি ও সমৃদ্ধি দিয়েছিলেন।

উপেন্দ্রকিশোরের সাহিত্য শিশুদের উদ্দেশ্যে রচিত। স্বাভাবিকভাবেই শিশুদের মত করে তা রচিত। পরিণত মনের পাঠক এর মধ্যে তাঁদের লুপ্ত শৈশবকে খুঁজে পেয়েছেন। তাঁদের পরিণত মনের গভীরে বাস করা শিশু এ সাহিত্যের মধ্য দিয়ে নতুনভাবে দীপ্ত হযে ওঠে। সুতরাং উপেন্দ্রকিশোরের সাহিত্যকর্মের সামনে পিছনে সর্বত্র লক্ষ্য পাঠক হল শিশু, সে  শিশুর পশ্চাৎভুমি যাই হোক না।

উপেন্দ্রকিশোর শিশুসাহিত্য  রচনার উদ্দেশ্য ছিল বাংলা ভাষার সহজ ও সরলীকরণ। তাঁর রচিত পুস্তকসমূহ কালের দাবী পূরণ করেছে। উপেন্দ্রকিশোর শিশুদের জন্য যা কিছু রচনা করেছেন তার কিছু উপদেশমূলক কিছুবা স্কুলপাঠ্য ।

’মহাভারতের কথা’ সম্পূর্ণ শাস্ত্রীয় তথ্য ও তত্ত্বকথায় সাজানো রচনা। ওজন দ্বারা পুস্তকের মান বিচার অযৌক্তিক। তবে পুরাণ ও মহাভারত থেকে সংগৃহীত উপাত্তে উপিন্দ্রকিশোর রায় শিশুমনে ধর্মীয় ও ঐতিহ্যবোধে উদ্বুুদ্ধ করতে চেয়েছেন।

শিশুর মুখের আধোবুলিকে (খুকুমণি কবিতা) আমরা উৎসাহিত করি না, শিশু শিক্ষার ধারাকে তা ব্যহত করে। এখনকার শিশুমনোবিজ্ঞনীরা শিশুর সাথে অস্পষ্ট ভাষায় কথা বলাতে অনুৎসাহিত করেন, অন্যথায় তার কথা স্পষ্ট হতে সময় লেগে যায় বেশী, অনেকসময় পরিণত বয়সেও কথার অস্পষ্টতা থেকে যায়।

’নাটিকা’ ‘অষন্তোষে’ ’তাহাদের’ ’তাদের’ সাধু চলিত ভাষার মিশ্রন দূষণীয়।

লেখার সঙ্গে ছবি অলংকরনের ক্ষেত্রে কিছু অবাস্তবতা দৃশ্যমান। গল্পের ভাব অনুযায়ী ছবির  বিষয়বস্তু হলেও বাস্তবে বাঘের মত একটি ভয়ঙ্কর প্রাণীর পিঠে বানরের উপবিষ্ট একটি অবাস্তব ব্যাপার। সাপের পাঁচটি মাথাও যেমন একটি অবিশ্বাস্য ব্যাপার তেমনি রথ নিয়ে পঙ্খিরাজের উড়ে যাওয়া কল্পনাতেই ভাবা সম্ভব, ছবি (২য় খন্ড, পৃ-৫৪৪)

’সেকালের কথা’ প্রবন্ধের রচনাসমূহ প্রাচীনকালের জীবজন্তু নিয়ে মনগড়া কাহিনী, এর বাস্তব কোন ভিত্তি নেই।

ছবি ছাপা নিয়ে উপেন্দ্রকিশোর অনেক পড়াশুনা করেছেন, বিলেত থেকে বই ও যন্ত্রপাতি এনে অনেক পরীক্ষাও করেছেন। শিশুসাহিত্য প্রকাশনার উদ্দেশ্যে তিনি লেখা, পড়া, ছবি আঁকা, ছবি ছাপা, বই আকারে লেখা প্রকাশিত করা এসবই করেছেন।

তাঁর রচনায় বঙ্গভঙ্গজনিত সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সমাবেশ লক্ষ্য করা যায়। তাঁর জীবনকাল ছিল হিন্দু পুনর্জাগরণের শ্রেষ্ঠ সময়। উপেন্দ্রকিশোর এরূপ যুগযাত্রার আবেগমন্ডিত প্রবাহকে গভীরভাবে গ্রহণ করেন। ’তখন দেশে জাতীয়তার বাণ ডেকেছিল উপেন্দ্রকিশোর নিজের মত করে সে ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন।’১৫ ফলে তিনি বিদেশী উৎসের মোহ পরিত্যাগ করে দেশীয় ঐতিহ্যের নিকট ফিরে আসেন, একেই  নিবিড়ভাবে অবলম্বন করেন। তবে সমসাময়িক কালের শিশু এবং শৈশব গঠন ধারণাকে হিন্দু পুনর্জাগরণের সঙ্গে যুক্ত করে তোলেন। পুনর্জাগরণের জন্য  আগ্রহ ও প্রতিশ্রুতির কারণে তিনি রামায়ণ মহাভারত ও পুরাণকে সাহিত্যসৃষ্টির উৎস হিসেবে গ্রহণ করেন, একত্রে লোকসাহিত্যের জন্য অনুরাগ প্রদর্শন করেন।

 

 

পাদটীকা

১। কেদারনাথ চট্টোপাধ্যায়, ’উপেন্দ্রকিশোর বিশ্বভারতী পত্রিকা, কার্তিক-পৌষ ১৩৭০, পৃ-১১২।

২। ঐ

৩। সখা (১৮৮৩-১৮৯৪), সম্পাদক প্রমদাচরণ সেন। পত্রিকাটির মর্মবাণী ছিল, ‘সে পিতা-মাতার উপদেশ এবং        শিক্ষকের শিক্ষা দুই-ই প্রদান করিবে।’

৪। সখা, ডিসেম্বর, ১৮৮৩, ১২সংখ্যা, ১ম ভাগ, ২ সংস্করণ (১৮৮৪), সাধারণ ব্রাম্মসমাজ, সূচীপত্র।)…(নিয়ম এবং                 অনিয়ম, বাধ্যতা এবং অবাধ্যতা)

৫। উপেন্দ্রকিশোর সমগ্র রচনাবলী ১,২,৩, সম্পাদনা লীলা মজুমদার, কলিকাতা, এশিয়া পাবলিশিং কোম্পানি, ১৯৮০,                ১৯৮৪, ১৯৮৬।

৬। ভূমিকা, উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র, ১, ২, প্রকাশক, শ্যামাপদ সরকার কামিনী প্রকাশালয়, ১৩৯৪।

৭।  উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র-১, কামিনী প্রকাশনালয়, কলিকাতা, ১৩৯৪। পৃ-৩২৮।

৮। লীলা মজুমদার পৃ-৮.১৫।

৯। টুনটুনি। উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র পৃ-।  ঐ। পৃ-২৩০।

১০। ঈশপ-খৃষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে জন্ম। জন্মস্থান সম্বন্ধ নানামত রয়েছে। ঈশপের কাহিনীতে জীবজন্তুদের স্বভাব প্রবৃত্তি অনুসারেই যুক্তিগ্রাহ্যরূপে গদ্যের বিস্তার। যেমন শৃগাল সর্বদাই ধূর্ত হবে, খরগোশ ভীরু আর সিংহ সাহসী। কথা কওয়া পশুপাখী গাছপালা সবাই এখানে নিজেদের চরিত্রানুযায়ী আচরণ করে থাকে কিন্তু তার মধ্যে আত্মগোপন করে থাকে মানুষের ও মানব সমাজের শুভাশুভ সম্বন্ধে রচনাকারের নির্দেশ।

১১। নবেন্দু সেন,বা,শি,সা- পৃৃৃ-১৮,

১২। সন্দেশ, মে, ১লা বৈশাখ ১৩২০ পৌষ-১৩২২

১৩। (লীলা মজুমদার (সম্পাদিত), উপেন্দ্রকিশোর সমগ্র রচনাবলী-১, কলিকাতা-১৯৮১, এশিয়া পাবলিশিং কোম্পানী, পৃ.১৬)

১৪।স্বর্গীয় উপেন্দ্রকিশোর’, ’সন্দেশ, মাঘ, ১৩২২)

১৫। উপেন্দ্রকিশোর সমগ্র রচনাবলী-১, কলিকাতা-১৯৮১, এশিয়া পাবলিশিং কোম্পানী, পৃ.১৬।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিশুসাহিত্য

(১৮৭১-১৯৫১)

১৮৭১ খ্রীষ্টাব্দের ৭ই আগষ্ট কলকাতার জোড়াসাঁকোয় অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন লেখক ও চিত্রশিল্পী। সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মীয়। ঠাকুর বাড়ীর প্রথানুসারে ১৮৭৬-১৮৮০ পর্যন্ত গৃহেই প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত হয়। কিছুকাল সংস্কৃত কলেজে অধ্যয়ন করেন। প্রবেশিকা পরীক্ষা দেয়ার পূর্বে কলেজের পাঠত্যাগ (১৮৯০)। নিজের সাধনায় ইংরেজী, ফরাসী, সংস্কৃত এবং বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে দক্ষতা অর্জন করেন। ইটালিয়ান গিলার্ডি ও ইংরেজ পামারের কাছে জাপানি চিত্রাঙ্কন রীতি শিক্ষা করেন। কলকাতাস্থ আর্ট কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ ই.বি. হ্যাভেলের উৎসাহ ও প্রচেষ্টায় ১৮৯৮-তে আর্ট কলেজের সহ-অধ্যক্ষের পদ গ্রহণ করেন। ১৯২১-এ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাগেশ্বরী অধ্যাপক নিযুক্ত হন। ১৯৪২-এ রবীন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতীর আচার্য্যরে পদগ্রহণ। পাশ্চাত্য রীতিতে সুদক্ষ হয়েও এই রীতিতে পরিতৃপ্ত না হয়ে ভারতীয় চিত্রাঙ্কন রীতি পুনরুদ্ধারের সাধনা শুরু করেন। ভারতীয় রীতিতে তাঁর প্রথম প্রয়াস কৃষ্ণলীলা বিষয়ক চিত্রাবলী জাপানী রীতিতে আঁকা ’ওমর খৈয়াম’ তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিত্রকর্ম। তাঁর অন্যান্য বিখ্যাত চিত্রের মধ্যে শাহজাদপুরের দৃশ্যাবলী ’আরব্যোপন্যাসের গল্প’, ’কবিকঙ্কন চন্ডী’ প্রভৃতি। ১৯১৩ সালে তাঁর চিত্র প্রদর্শনী হয় লন্ডন ও প্যারিসে এবং ১৯১৯-এ জাপানে।

জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের নক্ষত্র গুচ্ছের শ্রেষ্ঠতম অবশ্যই ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। শিশুসাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের পর অবনীন্দ্রনাথের এক্ষেত্রে বিরাট অবদান ছিল। জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের শ্রেষ্ঠ প্রতিভা ও মেধা সমুদয়ের তিনি ছিলেন অন্যতম। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সৃষ্টিশীল প্রতিভার বিকাশ হয়েছিল দুটো ক্ষেত্রে, চিত্রশিল্পে ও শিশুসাহিত্যে। এ দুটো অনেকখানি পরিপূরক ভূমিকায় থেকেই অবনীন্দ্রনাথের শিশুভুবন গড়ে তুলেছিলেন। চিত্রশিল্পের মধ্যে রংতুুলি দিয়ে তিনি যে বর্নময় বিশ্ব গড়ে তুলেছিলেন তা অনেকখানি শিশুসাহিত্যের মধ্যে ভাষায় প্রকাশের রূপ লাভ করেছিল। অক্ষর এবং শব্দের বন্ধনে তিনি যে শিশুভুবন সৃষ্টি করেছিলেন তার অনেকখানি স্থানান্তরিত এবং রূপান্তরিত হয়েছিল চিত্রশিল্পের মধ্যেও। এখানে শিশুর স্থান ছিল সর্বোচ্চ। অবনীন্দ্র -রচনায় শিশুসাহিত্যের রূপ ও ধ্বনিময় চিত্র ও সুরের বর্ণবৈভবে ভরা জগৎ। অবনীন্দ্রনাথ ইহজাগতিক মানব জীবনের সূচনাকালকে অভিনন্দিত করেছিলেন। শিশুর বন্ধনমুক্ত মনোবিকাশের দিকটি তাঁকে গভীরভাবে আকর্ষণ করেছিল। সেসবের প্রকাশ রয়েছে এখানে। সকল বয়সী মানুষের অন্তরে চিরায়ত শিশুকে তিনি জাগিয়ে ও রাঙিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর শিশু রচনায় গঠিত চিত্রগুলোও তাঁর চিত্রশিল্পের কাছাকাছি চলে যায়, চিত্রশিল্পের খুবই কাছাকাছি বলে মনে হয়। নিসর্গের নিকট থেকে তিনি তিল তিল সৌন্দর্য বর্ণ আনন্দ ও পুলক সংগ্রহ করে তা ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিয়েছিলেন শিশুসাহিত্য ও চিত্রশিল্পের মধ্যে, কালপ্রবাহে তা’ অমলিন হয়ে আছে সাহিত্যপ্রেমীদের কাছে।

অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিদ্যালয় গ্রাহ্য বিদ্যায় অনুরাগী ছিলেন না। ’ঠাকুর বাড়ী’র শিশুদের গল্প শোনার একটা রেওয়াজ ছিল। রাতে শয়নকালে দাস-দাসীদের মুখে তারা গল্প শোনায় অভ্যস্ত ছিল। ছেলেবেলায় ঘরে শোনা এইসব গল্পে ও ছড়ায় তাঁর মন অভিষিক্ত ছিল। পরবর্তীকালে সাহিত্যে তার প্রতিফলন ঘটে। তাঁর ছিল মৌলিক শিল্প প্রতিভা; যার সঙ্গে যোগ হয়েছিল সাহিত্য প্রতিভা।

বিশ শতকের সূচনালগ্ন থেকে উপেন্দ্রকিশোর শিশুসাহিত্যে বৈচিত্র্যের আভাস পরিস্ফুটিত হতে থাকে, এই সময়ের শিশুসাহিত্যে আনন্দরূপের অধিষ্ঠান থাকলেও উনিশ শতকীয় শিশুসাহিত্যে প্রভাবিত নীতি ও উপদেশের আভাস থেকেই যায়। উপেন্দ্রকিশোর পরবর্তী পর্ব শিশুসাহিত্য ছিল শিশুর আনন্দরূপের সঙ্গে পরিচয় করানোÑএটিকে বাংলা শিশু সাহিত্যের স্বর্ণযুগ বলা যায়। এই পর্বের শিশুসাহিত্য ’উপকরণে বিচিত্র, আর উদ্ভাবনে নিপুণ’। এই দুই যুগের সেতুবন্ধী সওদাগর’ ছিলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তবে তিনি ’শিশুর বইয়ের ছল করে মানুষের (সবার) জন্যই লিখেছেন। যুগলক্ষণের দিক থেকে পিতা-পুত্রের (উপেন্দ্রকিশোর ও সুকুমার) এই ‘এপার গঙ্গা ওপর গঙ্গা’র মধ্যিখানের চর হচ্ছেন অবন ঠাকুর যিনি ’ছবি লেখেন’। রূপ ও রঙের বর্ণনায় ব্যবহৃত বিশেষণ পদের সর্বাধিক প্রয়োগে অবনীন্দ্রনাথের রচনায় বিপুল রঙের অনন্ত সাফল্য সমসাময়িক কোন শিশুসাহিত্যিকের রচনায় লক্ষ্য করা যায় না। এর সাহােেয্য তিনি সহস্র রঙীন রূপের চিত্রবৎ উপস্থাপনা করেছেন। সবজি, সাদা, লাল, পোড়ামাটির লাল, নীল, ধানি, বাসন্তি, হলুদ, প্রভৃতি রামধনু-রঙের বিচিত্র প্রকাশ ঘটেছে বিশেষণ-বাচক শব্দগুলির মধ্যে। দৃ্িষ্টতে সহস্র রঙের বিচিত্র লীলা-রহস্য সৃষ্টি হয় সম্ভবত তার প্রকাশ ভাষাতেও ঘটে।

অবনীন্দ্রনাথের ছিল গল্প বলার যাদুকরী ক্ষমতা। সেই সম্মোহনী ক্ষমতা দিয়ে শিশুকে মোহাবিষ্ট করে রাখতেন। শিশুকে গল্প শোনাতে ভালওবাসতেন খুব। তিনি গল্প শোনার আসর বসাতেন এবং এই আসরের হতেন মধ্যমণিÑতাঁর চারপাশ ঘিরে শিশুরা মোহমুগ্ধের মত তাঁর গল্প শুনতো। তিনি ছিলেন শিশুদের কাছে ’কথক ঠাকুর’ অন্যথায় ’অবন ঠাকুর’। সে আমলে সরাসরি গল্প শোনাবার কোথাও ব্যবস্থা ছিল না। তিনি গল্প শোনাবার জন্য অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হতেন।  সমালোচকের ভাষায়,

মনে আছে সেই সন্ধ্যায় রামমোহন লাইব্রেরীতে অবনীন্দ্রনাথের গ-প-প দারুণ জমে উঠেছিল। উপস্থিত ছেলেমেয়ে চোখ বড বড় করে সেই গ-প-প গিলেছিল।১

অবনীন্দ্র-রচনাবলীর প্রথম খন্ডের ভুমিকা ’মনের কথা’য় তিনি লিখেছেন,

আমার ভাব ছোটদের সঙ্গেÑতাদেরই দিলাম এই লেখা খাতা। আর যারা কিনে নিতে চায় পয়সা দিয়ে আমার জীবন ভরা সুখ দুঃখের কাহিনী, এবং সেটা ছাপিয়ে নিজেরাও কিছু সংস্থান করে নিতে চায় তাদের আমি দূর থেকে নমস্কার দিচ্ছি। তারা কেবল শুনতে চায় আপন কথা, থেকে থেকে যারা কাছে এসে বলে ’গল্প বলো’, সেই শিশু-জগতের সত্যিকার রাজা- রাণী বাদশা বেগম তাদেরই জন্য আমার এই লেখা পাতা ক’খানা।২

অবনীন্দ্রনাথ ছোটদের যেমন ভালবাসতেন তেমনি øেহও করতেন। ছোটদের জন্য যাঁরা লিখেছেন  তাদেরও তিনি ’সেলাম’ জানিয়েছেনÑ

শিশু-সাহিত্য-সম্রাট যাঁরা এসেছেন এবং আসছেন তাঁদের জন্যে রইল বাঁ হাতে সেলাম; আর ডান হাতের কুর্নিশ রইল তাদেরই জন্যে যারা বসে শোনে গল্প রাজা-বাদশার মতো, কিন্তু ছেঁড়া মাদুর নয়তো মাটিতে বসে, আর গল্পের মাঝে মাঝে থেকে থেকে যারা বকশিশ্ দিয়ে চলে একটু হাঁসি কিংবা একটু কান্না; মান-পত্রও নয়, সোনার পদকও নয়; হয় একটু দীর্ঘশ্বাস, নয় একটুখানি ঘুমে ঢোলা চোখের চাহনি !৩

তবে অবনীন্দ্রনাথ গল্প লিখেছেন তাদেরই জন্যÑ

বলে যাওয়া চলে কেবল তাদেরই কাছে নির্ভয়ে, কেউ হামাগুড়ি দিয়ে, কেউ কাঠের ঘোড়ায় চড়ে, নানা ভাবে নানা দিকে আলিবাবার গুহার সন্ধানে! ছোটো ছোটো হাতে ঠেলা দিয়ে যারা কপাট আগলে বসে আছে, যে-দৈত্য সেটাকে ঝাঁকিয়ে বলে, ’ওপুন চিসম্’Ñ অর্থাৎ চশমা খোলো, গল্প বলো। যারা থেকে থেকে ছুটে এসে বলেÑ’এই নুড়ি ছোঁয়াও, দেখবে দাদামশায়, লোহার গায়ে ধরে যাবে সোনা!৪

শান্তিনিকেতনে (বিশ্বভারতী) রবীন্দ্রনাথ ’শিশু-বিভাগ’ বলে একটি বিভাগ খুলেছিলেন-যার প্রধান ছিলেন একজন ’মেম সাহেব’। তিনি বিভিন্ন রকম নেচার স্টাডি শিক্ষা দিতেন। খাঁচায় খরগোস, টবে গাছ ও বিভিন্ন রকমের শিশু সরঞ্জামে ভর্তি ছিল সে বিভাগ-কিন্ডারগার্টেনের মতো। অবনীন্দ্রনাথ এই পুঁথিগত তাত্ত্বিক শিক্ষাপদ্ধুতির বিরোধী ছিলেন। তিনি রবীন্দ্রনাথকে তাৎক্ষণিকভাবে তার প্রতিবাদ করে বললেন ’তোমার শিশু বিভাগের মূলে কুঠারাঘাত হচ্ছে।’ এ শিক্ষা মুক্তির গতির পথরোধ করে, মনের আনন্দের অবগাহন থাকে না। এক জায়গায় বন্দী করে কাঠে পেরেক ঠোকার মত।

শিশুদের ক্ষেত্রে অবনীন্দ্রনাথের শিক্ষা ছিল প্রকৃতির মধ্য থেকে শিক্ষা। ইউরোপিয়ান পদ্ধুতির নেচার স্টাডিÑযেমন খাঁচায় খরগোস টবে গাছ ইত্যাদি তার মনপুত ছিলনা। এ ক্ষেত্রে তার মতবাদ হচ্ছেÑ

খাঁচায় তো খরগোস রেখেছিসÑখাঁচার দরজোটা একবার খুলে দে, খোলা মাঠে কেমন দৌড়ায় খরগোস দেখবি। ৫

তিনি সেই সোনার কাঠি আর রুপোর কাঠি ছুঁইয়ে ইতিহাসের ঘুমন্ত পাতা থেকে জীবন্ত করে তুলে এনেছেন অসংখ্য চরিত্র।-তাদের আনন্দ আর আর্তি, স্বপ্ন আর শৌর্য, আত্মমর্যাদা আর আত্মবলি, প্রতিজ্ঞা আর প্রতিশোধের জগৎকে বিশেষ কালের গন্ডী ছাপিয়ে করে তুলেছেন চিরকালের। কথা দিয়ে তৈরী করেছেন ছবি, ছবি দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন জীবন। ইতিহাসের পাষাণপ্রতিমায় সঞ্চারিত করেছেন প্রাণের স্পন্দন।

অবনীন্দ্রনাথের অধিকাংশ রচনা ছোটদের জন্য হলেও তাঁর সাহিত্যের আবেদন সর্বজনীন। প্রকাশিত শিশুতোষ গ্রন্থ ঃ ’শকুন্তলা’ (১৮৯৫), ’ক্ষীরের পুতুল’ (১৮৯৬), ’রাজকাহিনী’ (১৯০৯), ’ভুত-পত্রীর দেশ’ (১৯১৫), ’নালক’ (১৯১৬), ’খাতাঞ্চির খাতা’ (১৯২১) ’বুড়ো আংলা’ (১৯৪১), ’আলোর ফুলকি’ (১৯৪৭)। হংসনাম পালা (১৯৫১), লম্বকর্ণ (১৯৫৪), একে তিন তিনে এক (১৯৫৪), মারুতির পুঁথি (১৯৫৬), রংবেরং (১৯৫৮), চাঁইবুড়োর পুঁথি (১৯৫৬) রঙবেরং (১৯৫৯) কিশোর সঞ্চয়ন (১৯৬০)। অবনীন্দ্র-রচনাবলীর(১ খন্ড, ১৯৭৩, ২ খন্ড, ১৯৭৪, ৩ খন্ড ১৯৭৬)। এ ছাড়ও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন  পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত বহুসংখ্যক রচনা।

অবনীন্দ্রনাথ শিশুতোষ রচনাবলীর বিষয় বৈচিত্র্যের শ্রেণীকরণ,

রূপকথামূলকÑশকুন্তলা, ক্ষীরের পুতুুল’ ইত্যাদি।

সংস্কারমূলকÑ বুড়ো আংলা ইত্যাদি।

শিশুদের জন্য কিছু করবার অভিপ্রায  নিয়ে ’শিশুদের নিয়ে কিছু করা যাক’ এর এক পর্যায়ে রবীন্দ্রনাথের মাথায় আসে ’বাল্য-গ্রন্থাবলী’ সিরিজ প্রণয়নের। তখন শিশুদের পড়বার মত বই ছিল না। অবনীন্দ্রনাথের উপর ভার পড়ল গল্প লেখার।  ’শিশুদের জন্য কিছু করা’র চিন্তার প্রয়াস থেকেই ’শকুুন্তলা’র সৃষ্টিÑরূপকথা সাহিত্য লিখবার অনুপ্রেরণা পান তিনি রবীন্দ্রনাথ হতে,

রবিকাকার মাথায় প্রথম এল, একটা সিরিজ বার করা যাক। নাম দেওয়া হল বাল্য-গ্রন্থাবলী সিরিজ। তখন শিশুদের পড়বার মত বই ছিল না। তিনি বললেন, তুুুমি গল্প লেখো।’

——আমার ওপরে ভার পড়ল শকুন্তলা লেখবার। আমি লিখলুম ’শকুন্তলা’, ’ক্ষীরের পুতুুল’।৬

প্রথম সংস্করণ লেখক কর্তৃক চিত্রাঙ্কিত ছিল। গ্রন্থ রচনার ইতিহাস প্রসঙ্গে ’জোড়াসাঁকোর ধারে’ বই থেকে নিুোদ্ধৃত স্মৃতিচারণটুকু উল্লেখযোগ্য,

একদিন আমার উনি (রবীন্দ্রনাথ) বললেন, ’তুমি লেখো-না, যেমন করে তুমি মুখে গল্প কর, তেমনি করেই লেখো।’ আমি ভাবলুম বাপরে, লেখাÑসে আমার দ্বারা কস্মিনকালেও হবে না। উনি বললেন,

’তুমি লেখোই-না:ভাষায় কিছু দোষ হয় আমিইতো আছি।’ সেই কথাতেই মনে জোর পেলুম। একদিন সাহস করে বসে গেলুম লিখতে। লিখলুম একঝোঁকে একদম শকুন্তলা বইখানা। লিখে নিয়ে গেলুম রবিকাকার কাছে, পড়লেন আগাগোড়া বইখানা, ভালো করেই পড়লেন। শুধু একটি কথা ’পল্বলের জল’ ওই একটিমাত্র কথা লিখেছিলাম সংস্কৃতে। কথাটা কাটতে গিয়ে না-থাক বলে রেখে দিলেন। আমি ভাবলুম যাঃ। সেই প্রথম জানলুম আমার বাংলা লেখার ক্ষমতা আছে। এত যে অজ্ঞতার ভিতরে ছিলুম, তা থেকে বাইরে বেরিয়ে এলুম। মনে বড় ফূর্তি হল। নিজের উপর মস্ত বিশ্বাস এল। তারপর পটাপট করে লিখে যেতে লাগলুমÑক্ষীরের পুতুল, রাজকাহিনী ইত্যাদি। সেই যে উনি সেদিন বলেছিলেন, ভয় কি অমিই তো আছি’ সেই জোরেই আমার গল্প লেখার দিকটা খুলে গেল।৭)৯

মহাকবি কালিদাসের অমর নাটক ‘শকুন্তলা’র বেদনামধুর উপাখ্যানের কাহিনীকে আখ্যানবস্তুরূপে নির্বাচন করে ছোটদের জন্য নতুন করে লেখেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুুর। ভাষার যাদু আর বর্ণনার সম্মোহনে এবং ছবির পর ছবি দিয়ে এক চিরকালীন রূপকথা ’শকুন্তলা’ নাটক। অবনীন্দ্রনাথ গ্রন্থের প্রথম পৃষ্ঠাতেই ছোটরা খুশী হয়ে উঠবার উপকরণ,

নদীতীরে যে নিবীড় বন ছিল তাতে অনেক জীবজন্তু ছিল। কত হাঁস, কত বক সারাদিন খালের ধারে বিলের জলে ঘুরে বেড়াত। কত ছোটো ছোটো পাখি, কত টিয়া পাখির ঝাঁক গাছের ডালে ডালে গান গাইত, কোটরে কোটরে বাসা বাঁধত। দলে দলে হরিণ। ছোটো ছোটো হরিণ শিশু, কুশের বনে, ধানের ক্ষেতে, কচি ঘাসের মাঠে খেলা করত। বসন্তে কোকিল গাইত, বর্ষায় ময়ূর নাচত।

দু-পৃষ্ঠা পরে,

এভাবেই তপবনে একদিন পৃথিবীর রাজাসেনা রথে চড়ে এলেন শিকারে। কিন্তু সেখানে হিংসা নেই। শিকার নিষেধ। আর ঠিক তখনি সোনার রথে পৃথিবীর রাজার সঙ্গে দেখা হল মাধবীকুুঞ্জের রূপসী শকুন্তলার। একে শিশুপাঠ্য বলে না ধরে বয়স্কপাঠ্য বলেও ধরে নেয়া যায়।

প্রকৃতপক্ষে শকুন্তলা অবনীন্দ্রনাথের পরবর্তী গ্রন্থগুলির ভিত্তি শৈল। এখানেই মুর্ত হয়েছে তাঁর বাণীচিত্রের রূপ ও রসের লীলাÑকথাগুলি ছবি আর ছবিগুলি সুর হয়ে ঝরে পড়েছেÑমানুষ, পশু, পাখি প্রকৃতির বিস্তৃত ক্যানভাস তৈরী হয়ে গেছে। এখানেই নারী-পুরুষের মিলনের আদিম মন্ত্র ধ্বনিত হয়েছে। পরবর্তী বইগুলিতে এসবেরই প্রসরণ ঘটেছে। শকুন্তলা এদিক থেকে অবনীন্দ্রনাথের এক সার্থক উদ্বোধন। পরবর্তীকালে এর ফরাসী ও গুজরাটি অনুবাদ হয়। অবনীন্দ্রনাথ কর্তৃক অঙ্কিত চিত্রেও উঠে এসেছে ’জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ী’৮।

’ক্ষীরের পুতুল’ গ্রন্থটির মূলেও ছিল এই লোকজ প্রেরণা। অবনীন্দ্রনাথ ’ক্ষীরের পুতুল’ গ্রন্থ রচনাসূত্র প্রসঙ্গে ’শিশুদের রবীন্দ্রনাথ’ কথিকায় লিখেছেন,

তিনি কাকীমাকে (রথীর মা) দিয়েও অনেক রূপকথা সংগ্রহ করিয়েছিলেন। কাকীমা সেগুলি একখানি খাতায় লিখে রাখতেন, তাতে অনেক ভালো ভালো রূপকথা ছিল। তাঁর সেই খাতাখানি থেকেই আমার ’ক্ষীরের পুতুুল’ গল্পটি নেওয়া।৯

বাল্যগ্রন্থাবলীর তৃতীয় খন্ড হিসেবে প্রথম সংস্করণে ছয়টি রঙীন ছবি যুক্ত ছিল। অবনীন্দ্রনাথের দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘ক্ষীরের পুতুল’-এ তার শক্তি আরো উজ্জ্বল। গল্পটিতে ‘চঁংং-রহ-ইড়ড়ঃং’১০ এর ক্ষীণছায়া আছে। রূপকথার পদ্ধতিতে গল্পটি বিন্যস্ত। ‘শকুন্তলা’ যে সুরে সমাপ্ত ‘ক্ষীরের পুতুল’ সেই সুরে আরম্ভ। সে সুর রূপকথার সুর। শকুন্তলা শেষ হচ্ছে,

কাশ্যপ অদিতিকে প্রণাম করে রাজরাণী রাজপুত্র কোলে রাজ্যে ফিরলেন। তারপর কতদিন সুখে রাজত্ব করে, রাজপুত্রকে রাজ্য দিয়ে রাজারানী সেই তপোবনে তাত কন্বের কাছে, সেই দুই সখীর কাছে, সেই হরিণ শিশুর কাছে, সেই সহকার মাধবীলতার কাছে ফিরে গেলেন এবং তাপস তাপসীদের কাছে সুখে জীবন কাটিয়ে দিলেন।

আর ক্ষীরের পুতুলের আরম্ভ হচ্ছে,

-এক রাজার দুই রানী। দুও আর সুও। আর রাজবাড়ীতে সুয়োরাণীর বড় আদর, বড় যতœ। সুওরাণী সাতমহল বাড়ীতে থাকেন। সাতশো দাসী তার সেবা করে, পা ধোয়ায়, আলতা পরায়, চুল বাঁধে। সাত মালঞ্চে সাত সাজি ফুল, সেই ফুলে সুওরাণী মালা গাঁথেন। সাত সিন্দুক ভরা সাত-রাজার-ধন মানিকের গহনা, সেই গহনা অঙ্গে পরেন। সুওরানী রাজার প্রাণ।

রাজামশাই বানিজ্যে গেলেন। সুওরানীর কথামত নিয়ে এলেন দামী দামী গয়না আর শাড়ি। দুওরানী চেয়েছিলেন একটা বানর ছানা। তাঁর জন্য এল তাই বানর। বানর হলে হবে কি, আসলে সে এক জাদুকরের দেশের মা-বানর। তাই সে মানুষের মত কথা বলে, ছেলের মত ভালবাসে বড় রানীমাকে, দুঃখিনী মায়ের চোখের জল মুছিয়ে দিতে চায়।

তা সেই মায়া-বানর দারুণ বুদ্ধি খাটিয়ে কী করে রাজার মন ফেরাল বড় রানীর দিকে, কী করে দুওরানীর কোলে এনে দিল সত্যিকারের রাজপুত্র, কী করেই বা হিংসুটে সুওরানীকে ভোগ করাল যাবতীয় পাপের শাস্তিÑতাই নিয়েই এই অবাক করা রূপকথা, ’ক্ষীরের পুতুল’। এর ঢংটিও মা দিদিমার মুখে ব্রত কথা বলবার মত। এর সাথে ছেলে ভুলানো ছড়ার চিত্রগুলি যথেচ্ছ ব্যবহার করেছেন,

ঝুরঝুরে বালির মাঝে চিক্চিকে জল, তারি ধারে একপাল ছেলে দোলায় চেপে ছপন কড়ি গুনতে গুনতে মাঝ ধরতে এসেছে; কারে পায়ে মাছের কাঁটা ফুটেছে, কারো চাঁদমুখে রোদ পড়েছে। জেলেদের ছেলে জালমুড়ি দিয়ে ঘুম দিয়েছে, এমন সময় টাপুর টুুপুর বৃষ্টি এল, নদীতে বাণ এল; অমনি সেই ছেলের পাল, সেই কাঠের দোলা, সেই ছপন কড়ি ফেলে কোন্ পাড়ার কোন্ ঘরের কোণে ফিরে গেল। পথের মাঝে তাদের মাছগুলো চিলে কেড়ে নিলে কুনোব্যাঙে ছিপ গুলো টেনে নিলে, খোকাবাবুরা ক্ষিপ্ত হয়ে ঘরে এলেন, মা তপ্ত দুধ জুড়িয়ে খেতে দিলেন, আর সেই চিক্ চিকে জলের ধারে ঝুুরঝুরে বালির চরে শিব ঠাকুর এসে নৌকা বাঁধলেন তার সঙ্গে তিন কন্যে এক কন্যে রাঁধলেন বাড়লেন, এক কন্যে খেলেন আর এক কন্যে না খেয়ে বাপের বাড়ী গেলেন। বামন তাঁর সঙ্গে বাপের বাড়ীর দেশে গেল। সেখানে জলের ঘাটে মেয়েগুলি নাইতে এসেছে, কালো কালো চুলগুলি ঝাড়তে লেগেছে, তার একটি গুরু ঠাকুুর নিলেন, আর একটি নায়ে ভরা দিয়ে টিয়ে আসছিল সে নিলে। তাই দেখে ভোঁদর টিয়েকে এক হাতে নিয়ে আর মাছকে এক হাতে নিয়ে নাচতে আরম্ভ করলে, ঘরের দুয়ারে খোকার মা খোকা বাবুকে নাচিয়ে নাচিয়ে বললেনÑ ওরে ভোঁদর ফিরে চা, খোকার নাচন দেখে যা।

অবনীন্দ্রনাথের ‘ক্ষীরের পুুতুল’ দক্ষিণারঞ্জনের ’বুদ্ধু ভুতুম’১১ গল্পের অনুসরণ বলা যেতে পারে। সেখানে বানর-পুত্র বুদ্ধুর আর পেঁচা পুত্র ভুতুমের চেষ্টায় বীরত্বে কলাবতী রাজকন্যে আর হীরাবতী রাজকন্যে নিয়ে দুওরানী আবার সুয়োরানী হয়ে উঠেছিলেন। সেখানে বানরের ছাল আর প্যাঁচার পাখের রহস্যটুকু সবার শেষে উদঘাটিত।

’ক্ষীরের পুতুলে’ গ্রামবাংলার লোকজ উপকরণ ব্যবহার করে বানরের কাঠামোটুকু বজায় রেখে ষষ্ঠীদেবীর অবতারণা করে গল্প সম্পূর্ণ নতুন ঢং-এ বলেছেন। লোককথার টাইপ ও মোটিফ অনুযায়ী ঠিক কোনো এক শ্রেণীতে একে রাখা যায় না।

রূপকথা আর ছড়া সাধারণত স্বতন্ত্র। কিন্তু এই গ্রন্থে অবনীন্দ্রনাথ রূপকথা গড়ে তুলতে বাংলার লৌকিক জীবনের ছড়াগুলিকে অসাধারণ সফলতায় কাজে লাগিয়েছেন। একটি উদাহরণ,

ঘুমপাড়ানি মাসি-পিসি সারারাত দিগ্ নগরে ষষ্ঠীরদাস-ষেঠের বাছা ছেলেদের চোখে ঘুম দিয়ে, সকালবেলা ঘুমের দেশে রাজার মেয়েকে ঘুম পাড়িয়ে অনেক বেলায় একটুখানি চোখ বুজেছেন, এমন সময় ষষ্ঠী ঠাকরুনের ডাক পড়ল।

সংশ্লিষ্ট ছড়া,

ঘুম পাড়ানি মাসি পিসি ঘুম দিয়ে যা—

ইত্যাদি।

এই গল্পে, লোকজ উপকরণ দিয়ে নিজ মনের মাধুরী মিশিয়ে যে রস ও রূপের অখন্ড বাণী-চিত্র তিনি সৃষ্টি করেছেন তা কেবল শিশুসাহিত্যের গৌরব নয় সমগ্র বাংলা সাহিত্যের এক অনাস্বাদিত, দিক্বলয়ের সন্ধানও দিয়েছে।

ইংরেজী, ফরাসী, সুইডিশ, হিন্দী’ মারাঠী ভাষায় গ্রন্থটি অনুদিত হয়। ফরাসী এবং সুইডিশ অনুবাদে ঝবষসধ খধমবৎষড়ভ  লিখিত ভুমিকা ছিল।

অবনীন্দ্রনাথের অন্যতম গুরুত্বপূর্ন রচনা ’রাজকাহিনী’ (১৯০৯)।

মোট ন’টি গল্প নিয়ে রচিত। ভাষা এখানেও সুর। সুর রূপের সৃষ্টি করেছে। টডের রাজস্থান অবনীন্দ্রনাথের হাতে নবীন সাহিত্য শিল্প হয়ে উঠেছে। এতে বহু বিষয় ইতিহাস বহির্ভূত অথচ শিল্পীর নিজস্ব মনের।

প্রথম খন্ডের অন্তর্গত-শিলাদিত্য, গোহ, বাপ্পাদিত্য, পদ্মিনী। দ্বিতীয় খন্ডের অন্তর্গত-হাম্বির, হাম্বির (রাজ্যলাভ), চন্ড, রানা কুম্ভ, সংগ্রামসিংহ। পরে খন্ড দুটি একসঙ্গে প্রকাশ করেন সিগনেট প্রেস। ১৯৪৭ সালে ’রাজকাহিনী’র গুজরাটী অনুবাদ প্রকাশিত হয়।

’ভূতপত্রীর দেশ’ ইন্ডিয়ান পাবলিশিং হাউস ১৯১৫ সালে প্রকাশ করেন । ’জোড়াসাঁকোর ধারে’ বইটির এই বর্ণনাংশ এ-প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। লেখকের কোনারক যাত্রা প্রসঙ্গে পালকি চড়ে চাঁদনি রাতে পুরী থেকে আসার অভিজ্ঞতা অপরূপ গল্পরসে ধৃত হয়ে আছে।

সত্যেন দত্তের ‘পাল্কির গানে’র সচিত্র উদ্ভট রূপ এই গ্রন্থে প্রয়োগ করে অবনীন্দ্রনাথ তাঁর ফ্যান্টাসি রচনার অবিসম্বাদিত প্রতিভা দেখিয়ে দিয়েছেন। হারুন্দে কারুন্দে, বালুন্দে মালুন্দে সেই ফ্যান্টাসির জগতে ’চিতাবাড়ি’ আর ’ধাঁই কিড়ি’ দুটি দল হয়ে কারুন্দের সমরাহ্বান শুনছেÑ

ইকড়ি-মিকড়ি চাম চিকড়ি

চাম-কৌটো মজুমদার

ধেয়ে এসো দামুদার

ওদিেেক কিচকিন্দে বাঁশী বাজাতেই ইকড়ি-মিকড়ি হয়ে গেছে ধাঁই কিড়ির কিড়ির দল আর চাম চিকড়ি হয়ে গেছে ধাঁই কিড়ির দল। এক উদ্ভট কল্পনার রেখাচিত্র ধ্বণি প্রতিধ্বণিতে মুখরিত।Ñরঙ বেরঙও (১৯৫৮) কেবল কল্পনার রঙ এখানে অধিক গাঢ়। অবনীন্দ্রনাথের মাসিও (১৯৫৪) এ প্রসঙ্গে স্মরণীয়। যদিও আস্বাদের দিক থেকে বইটি স্বতন্ত। ব্যক্তিজীবনের ছবিতে ঠাসা। (মাসিক ১৯৪২-৪৩-এর বিশ্বভারতী পত্রিকায় (শ্রাবণ-জৈষ্ঠ্য ১৩৪৯-৫০) প্রথম প্রকাশিত।

(পুরীতে অনেক দিন আছি, ভেবেছি সব আমার নখদর্পণে। একদিন হাঁটতে হাঁটতে চক্রতীর্থ পেরিয়ে গেছি সমুদ্রের ধার দিয়ে, রাস্তা ছাডিয়ে বালির উপর দিয়ে ধপাস ধপাস করে চলেইছি। কত দূর এসে পড়েছি কে জানে। হঠাৎ চটকা ভাঙল, দেখি সূর্যাস্ত হচ্ছে। যেদিকে চাই চতুর্দিকে ধু ধু বালি। না নজরে পডে জগন্ননাথের মন্দির না রাস্তা, না কিছু। শুধু শব্দ পাচ্ছি সমুদ্রের। কোনদিকে যাব ঘোর লেগে গেছে তারা ধরে চলব তারও তো কোন জ্ঞান নেই। একেবারে স্তম্ভিত। শেষে সমুদ্রের শব্দ শুনে সেইদিকে চলতে লাগলুম। খানিক বাদে দেখি এক বুড়ি চলেছে লাঠি হাতে; বললে, ’কোথায় যাচ্ছ?’ বললুম, ’চক্রতীর্থে’। ভাবলুম চক্রতীর্থে পৌছতে পারলেই এখন যথেষ্ট। বুড়ি বললে, ’তা যেদিকে যাচ্ছ সেদিকে সমুদ্র। আমার সঙ্গে এস, আমি যাচ্ছি চক্রতীর্থে। বুড়ির সঙ্গে চক্রতীর্থে ফিরে হাঁপ ছেড়ে বাঁচি। নয় তো সারারাত সেদিন ঘুরে বেড়ালেও কিছু খুঁজে পেতুম না। ’ভূতপত্রী’তে  আছে এই বর্ণনা।১২

এ প্রসঙ্গে উমা দেবীর ’বাবার কথা’ থেকে নিুোদ্ধৃত অংশটুকুও এখানে প্রণিধানযোগ্য,

আর একবার বাবার সঙ্গে পুরী গেছি। সমুদ্রের ধারে ’পাথার পুরী’ বাড়িতে তখন ওঁরা গিয়ে থাকতেন। বাড়িটার নাম বাবাই দিয়েছিলেন। সেবার বাবার সখ হল কোনারক দেখতে যাবার। মা জিজ্ঞেস করলেন বাবাকে যে, তিনি একলা যাবেন না কি ! বাবা বললেন যে, মা, আমার মেজো বোন করুণা আর আমিও যাব।…..

এই কোনারক যাত্রার পথ বাবার ’ভূতপত্রীর দেশ’ বইখানি লেখা হয়। এই বইটির মধ্যে যে রোমাঞ্চকর পথের বর্ণনা আছে পাল্কী চড়ে যাবার, সেটার উৎস হল কোনারক যাবার ভুতুরে পথ। যাবার সময় যেমন গা ছমছম করেছিল, পড়লেও তেমনি ভয় মেশানো বিস্ময় জাগে মনে। ১৩

বাদশাহী গল্পকে ভূতপত্রীর গল্পের ক্রমানুবৃত্তি বলা যায়। গল্পগুলিতে অবনীন্দ্রনাথের শৈশবস্মৃতির সঙ্গে জড়িত একাধিক চরিত্রের উল্লেখ রয়েছে।

১৩২২ বঙ্গাব্দের বৈশাখ থেকে ভাদ্র মাস পর্যন্ত ’ভারতী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ’নালক’ (১৯১৬)। ’নালক’ হ’ল গৌতমবুদ্ধের গল্প। কিন্তু নিছক জীবনী নয়। গ্রন্থে আছে ঘর-ছাড়া মুক্তজীবনের প্রতি শিশুর আদিম টানের কথা। আছে না-জানাকে জানার অদম্য কৌতূহল। আছে লৌকিক জীবনের ছবি, পশু-পাখি নদ-নদীর কথা। আছে সারাদিনের দৌরাত্মির পর দামাল ছেলের ঘরে ফেরার কথা, মায়ের কথা। এখানেও অবন ঠাকুর ছবি লেখেন-

তিনজনে মাঠ ভেঙে চলেছেন। তখনো আকাশে তারা দেখা যাচ্ছে-রাত পোহাতে অনেক দেরী। কিন্তু এর মধ্যে সকালের বাতাস পেয়ে গাঁয়ের উপর থেকে সারা রাতের জমা ঘুঁটের ধোঁয়া শাদা একখানি চাঁদোয়ার মতো ক্রমে ক্রমে আকাশের দিকে উঠে যাচ্ছে। উলুবনের ভিতর দু’ একটি তিতির, বকুলগাছে দু-একটা শালিক এরি মধ্যে একটু একটু ডাকতে লেগেছে। একটা ফটিং পাখি শিস দিতে দিতে মাঠের ওপারে চলে গেল। ছাতারেগুলো কিচমিচ ঝুুপঝুপ করে কাঁঠালগাছের তলায় নেমে পড়ল।

এখোনেও লোকজ মানসিকতার সঙ্গে শিল্পবোধের সূক্ষ্ম সংযোগ গড়ে উঠেছে অনবদ্য বাণীচিত্র। ‘ঘুঁটের ধোঁয়া শাদা একখানি চাঁদোয়ার মত ক্রমে ক্রমে আকাশের দিকে উঠে যাচ্ছে।’—এ কেবল একটি সাধারণ বর্ণনাত্মক বাক্য নয়। ঘুঁটের ধোঁয়ার লৌকিক আমেজের সঙ্গে শিল্পীর দৃষ্টি শাদা একখানি চাঁদোয়ার মত মিশে আকাশের দিকে উঠে যাওয়ার একটি পূর্ণ সুন্দর ছবি সৃষ্টি করেছে। সকালের বাতাস এখানে আলোর ফুুলকির রশ্মির ন্যায় কোন অজান্তে এখানে এসে পড়েছে।Ñএখানেও সেই পশুশক্তি আর প্রেমবলের লড়াই বেঁধেছে। সুন্দর আর অসুন্দরের যুদ্ধ। সিদ্ধার্থের বৌদ্ধ-ধ্যান ভেঙ্গে ফেলার অসুন্দর হিংস্রময় শক্তির আবির্ভাব ঘটেছে।

আর এখানেই ছোটদের সঙ্গে বড়রাও ’নালকে’র পাঠক হয়ে যায়।

দেবলঋষি যোগে বসেছিলেন। ছোট্ট ছেলে নালক ঋষির সেবা করছিল। এমন সময় অন্ধকারে আলো ফুটল। চাঁদের আলো নয়, সমস্ত আলো মিশিয়ে এক আলোর আলো। সন্ন্যাসী নালককে বললেন, কপিলাবস্তুতে বুদ্ধদেব জন্ম নেবেন। আমি চললাম।

একলা  নালক চুপ করে বসে রইলো বটতলায়। তার ধ্যানমগ্ন চোখের সামনে ফুটে উঠতে লাগল বুদ্ধের সারা জীবনের ছবি। একের পর এক।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত নালক মাকে দেখার অভিপ্রায়ে বুদ্ধদেব দর্শনের অপেক্ষা না করে শেষ নৌকাটির অভিযাত্রী হয়। এখানে বুদ্ধদেবের চাইতে তার মা প্রাধান্য পেয়েছে। অথচ পুরো গল্পটিতে নালকের বুদ্ধদেব দর্শনের অভিপ্রায় ব্যক্ত হয়েছে।

এ-বইয়ের একটি ফরাসী অনুবাদ হয় ১৯৩৭ সালে।

বিভিন্ন সাময়িক পত্র (১৩১২ বৈশাখ – ১৩৩৭ কার্তিক) থেকে সংকলিত কয়েকটি রচনা এই অংশে বিন্যস্ত হল। এগুলি যথাক্রমে ’একে তিন তিনে এক’ এবং ’রংবেরং’ গ্রন্থের অন্তর্ভূক্ত হয়। রচনাগুলি যথাক্রমে আলেখ্য, আইনে চীন্-ই জয়শ্রী, সূত্রপাত, উদয়াস্ত, যুগ্মতারা, গোরিয়াঁ, চৈতন চুটকি, মাতৃগুপ্ত, তারমান, গঙ্গাফড়িং, জেন্তসভা বা জন্তুজাতীয় মহাসমিতি, হিন্দবাদের প্রথম সিন্দবাদের শেষযাত্রা, বাতাপি রাক্ষস, আলোয় কালোয়, কারিগর ও বাজিকর, বড়ো রাজা ছোট রাজার গল্প, কনকলতা, কোণের ঘর, সাথী, ভোম্বলদাসের কৈলাসযাত্রা, রতা শেয়ালের কথা, সিংহরাজের রাজ্যাভিষেক, দেয়ালা, মহামাস তৈল, আষাঢ়ে গল্প, খোকাখুকি।

অবনীন্দ্র-রচনায় বিদেশী প্রভাবের কথা অনেকেই বলেছেন। অবনীন্দ্রনাথ নিজেও তা স্বীকার করেছেন। তবে এক্ষত্রেও অবনীন্দ্রনাথের মৌলিকতা স্পষ্টতই ধরা পড়ে। শিল্পচর্চা অথবা সাহিত্যসাধনার অবনীন্দ্রনাথের সবচেয়ে মহৎ সম্পদ ছিল মুক্ত অন্তর্দৃষ্টি। ’ঘরোয়া’ (১৯৪১)১৪ লেখা প্রসঙ্গে রানী চন্দকে বলেছেন,

দেখো, শিল্প জিনিসটা কী, তা বুঝিয়ে বলা বড় শক্ত। শিল্প হচ্ছে শখ। যার সেই শখ ভিতর থেকে এল, সেই পারে শিল্পসৃষ্টি করতে, ছবি আঁকতে বাজনা বাজাতে, নাচতে, গাইতে, নাটক লিখতে…।

এ-কালে যেন শখ নেই, শখ বলে কোন পদার্থই নেই। এ কালে সব কিছুকেই বলে শিক্ষা। সব জিনিসের সঙ্গে শিক্ষা জুড়ে দিয়েছে। ছেলেদের জন্য গল্প লিখবে তাতেও থাকবে শিক্ষার গন্ধ।…। এখনকার লোকেরা লেখে ইতিহাস।

এই ভেতরকার শখ দিয়েই অবনীন্দ্রনাথ গড়ে তুুলতে পেরেছিলেন শিশুসাহিত্যের এক স্বতন্ত্র রাজ্য। ‘খাতাঞ্চির খাতা’, ‘বুড়ো আংলা’, ‘আলোর ফুল্কি’, ‘হানাবাড়ির কারখানা’Ñ এই চারটি বইতে বিদেশী লেখার প্রভাব নিয়ে আলোচনার অবকাশ অছে। রচনাগুলি বিদেশী সূত্র অবলম্বনে দেশীয় কাঠামোর উপর পরিবেশিত এবং এর সমন্বয়ের চমৎকারিত্বে হয়েছে যে এগুলো প্রকৃতই বিদেশী সূত্র নির্ভর কিনা তা অনুভব করা যায় না। অবনীন্দ্রনাথ তাঁর শ্রেষ্ঠ সম্পদগুলো বাংলার সব কালের শিশুর জন্য সাজিয়ে রেখেছিলেন, এগুলো সময়ের প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে উত্তরকালের আলোকমালার সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে ঐক্যময় উপলব্ধি সৃষ্টি করে তুলেছে।

খাতাঞ্চির খাতা-১৯২১(১৩২৭, বৈশাখ-মাঘ) প্রকাশিত।

ঔধসবং গধঃঃযবি ইধৎৎরব (১৮৬০-১৯০৭)-র’ চবঃবৎ চধহ (১৯০৪) গল্পের ভাবানুবাদ।

অবনীন্দ্রনাথের ছবিতে যেমন, লেখাতেও তেমন মানস চোখের গভীর অন্তর্দৃষ্টিতে ’খাতাঞ্চির খাতা’ ব্যেরির ’পিটার প্যান’ থেকে স্বতন্ত্র হয়ে উঠেছে। যেমন পরিবেশ, উপকরণ ও উপস্থাপনায় তেমনি  লোকজ শব্দে, প্রবাদে, ছড়ায়, গানে তা’ নতুন সৃষ্টি হয়ে উঠেছে।

একাধিক কাহিনীর মত অবনীন্দ্রনাথের এই কাহিনীতেও বাংলা ছড়ার গদ্ব্যান্বয় লক্ষ্যণীয়। এই সময়ে অবনীন্দ্রনাথ ছড়া ও বচন বিপুল উদ্যমে সংগ্রহ করেছিলেন। এটি রচনার সমসাময়িক সময়ে অবনীন্দ্রনাথ ’ছেলে ভুলানো ছড়া’ সম্বন্ধে বক্তৃতা১৫  করেছিলেন। ছড়া,

সোনা যাবে শ্বশুরবাড়ি সঙ্গে যাবে কে

বাড়িতে আছে পুসি বেড়াল কোমর বেঁধেছে।

ও পারেতে কালো রঙ

বৃষ্টি পড়ে ঝম-ঝম

এ পারেতে লঙ্কা গাছটি রাঙা টুক-টুক করে,

ওগো দাদাভাই আমার মন কেমন করে।

দাদাভাই তার পিঠে হাত বুলিয়ে কইছেনÑ

এ মাসটা থাক দিদি কাঁদিয়ে কঁকিয়ে

ও মাসেতে লয়ে যাব পালকি সাজিয়ে।

তারপর দুজনে দুজনের গলা ধরে কাঁদছেÑ

ঘাড় হল ভাজা ভাজা, মাস হল দড়ি

আয় রে নদীর জলে ঝাঁপ দিয়ে পড়ি।

ইত্যাদি।

বুড়ো আংলা ১৯১০-১১ (১৩২৭-২৮) ’মৌচাক’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে  প্রথম প্রকাশিত হয়।

ঝবষসধ খবমবৎষড়ভ (১৮৪৮-১৯৪৯)-এর ঞযব ডড়হফবৎভঁষ অফাবহঃঁৎবং ড়ভ ঘরষবং (১৯০৭) থেকে ’বুড়ো আংলা’ (১৯৪১) রচনার প্রেরণা পেয়েছিলেন। সেলমা লেগেরলফ্ (১৮৫৮-১৯৪০) মধ্য সুইডেনের ভার্মল্যান্ড শহরে জন্মেছিলেন। লোকসাহিত্যের প্রতি গভীর অনুরাগী ছিলেন। উপন্যাস লিখে ১৯০৯-এ বায়ান্ন বছর বয়সে নোবেল পুরস্কার পান।

অবনীন্দ্রনাথ আঙ্গুলের মতো অর্থে আংলা বিশেষণটি ’বুড়োর সঙ্গে জুড়ে একই সঙ্গে মূলার্থ আর দেশজ পরিচিতিতে গড়ে তুললেন এক নবীন রূপকথা। তাঁর কার্শিয়ং ও দার্জিলিং ভ্রমনের অভিজ্ঞতা এক অসাধারণ নৈপুণ্যে কাজে লাগিয়েছেন। ১৯১৯-২০ সালে তিনি দার্জিলিঙের বহু দৃশ্যচিত্র এঁকেছেন। সাহিত্য রচনায় সেই পাহাড়-প্রবাসের স্মৃতি ’বুড়ো আংলা’ গ্রন্থের ’টুং-সোন্নাদা-ঘুম’ পরিচ্ছদে এক সফল প্রয়াস। ছত্রে ছত্রে দেশজ বস্তু ও লোকজ অনুষঙ্গ বঙ্গজ রূপে রসে আবির্ভূত। হৃদয়ের মানস সরোবর তথা কৈলাসযাত্রার পথে বাংলার মানচিত্র, ভূগোলের পরিচয় যেমন সাতনল, চন্দনপুর, আগরতলার রাজবাড়ি, মীর-কদম, নারায়ণগঞ্জ, ঢাকার নবাববাড়ী, পাবনা,— রাজশাহী, জলপাইগুড়ি ইত্যাদি বিধৃত।

সুইডেনে বড়দিনের উৎসবের সময় একরকম খড়ের পুতুল দোকানে পাওয়া যেত। ঘরষবং  ও তার হাঁস খড়ের পুতুল হয়ে এক বড়দিনে সুইডেনে যখন বিক্রী হচ্ছিল, অবনীন্দ্রনাথের কাছে তাঁর এক ফরাসী বান্ধবী সেটি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। সেই পুতুল দেখে এই সুন্দর প্রচ্ছদপট অঙ্কিত হয়েছে।

ছেলেটির নাম হৃদয়, কিন্তু ছেলেটি আসলে ছিল হৃদয়হীন এবং খুবই বিচ্ছু ছেলে। নষ্টামী করেই দিন কাটত তার। মানুষ, পশুপাখি, কীটপতঙ্গ সবাই অতিষ্ট তার জ্বালাতনে। একদিন সেই বিচ্ছু হৃদয় লাগল হিন্দু দেবতা গণেশ ঠাকুরের পিছনে। হৃদয়ের উৎপাতে গণেশ হিন্দু দেবী দুর্গাকে স্মরণ করে এবং তখনই সে নিজমূর্তি ধারণ করেন। দেখতে দেখতে চালে গিয়ে গণেশের মাথা ঠেকল। তিনি দাঁত কড়মড় করে বললেন,

এতবড় আস্পর্দা ! Ñ ব্রাম্মন আমি, আমার গায়ে চিংড়ি মাছের জল ছোঁয়ানো! যেমন ছোটলোক তুই, তেমনি ছোট বুড়ো আংলা যক্ হয়ে থাক্!

দেখতে না দেখতেই বুড়ো আঙ্গুলের মত ভয়ানক ছোট হয়ে শেষাবধি বুড়ো আংলা যক হয়ে গেল প্রজার ছেলে হৃদয়।

’আলোর ফুল্কি’(১৯৪১) বৈশাখ ১৩২৬Ñঅগ্রহায়ণের ১৩২৬ (১৯১৯-২০) সংখ্যার ’ভারতী’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। এটি ফরাসী ঊফসড়হফ-ঊঁমবহব জড়ংঃধহফ (১৮৬৮-১৯১৮) রচিত ঈযধহঃবপষববৎ (১৯১০) চার অঙ্কের কাব্যনাট্য অবলম্বনে রচিত। ফরাসী রূপক কাব্যনাট্যের ভাবকাহিনী অবলম্বনে রচিত, ইংরেজী সূত্রে এটা গ্রহণ করেন।

’আলোর ফুল্কি’র শুরুতে ’বসন্ত বাউরি’, ’বউ-কথা-কও’ ইত্যাদি দেশজ শব্দের অবতারনা করে অবনীন্দ্রনাথের শিল্পরুচির সীমা ও স্বাতন্ত্র্য ঈযধহঃবপষববৎ থেকে পৃথক করেছেন। এ গ্রন্থের পাট প্রসঙ্গে অবনীন্দ্রনাথের দৌহিত্র জোড়াসাঁকোর বিচিত্রা অথবা বিশ্বভারতী সম্মিলনীতে তাঁর স্মৃতিচারণ করেছেন,

মনে আছে একবার জোড়াসাঁকো বিচিত্রা সভায় সদ্য লেখা ’আলোর  ফুল্কি’র একটা অংশ পড়ে শুনিয়েছিলেন। এখনও তাঁর পড়বার বিশেষ ধরনটি কানে বাজছেÑচিনিদিদির পার্টিতে নানা জাতের মোরগরা আসছে… দাদামশায়ের পড়ার কায়দায় গলার স্বরে নানা জাতের মোরগদের সাজ পোশাক চাল চলন হাবভাব যেন চোখের সামনে ভেসে উঠত।১৬

এই লেখার সমসাময়িক একটি ভাষণে একই ছাঁদের বর্ণনাভঙ্গী রক্ষা করা যায়: ’পাতার ঘরের এতটুকুু পাখি, সকাল সন্ধ্যা আলোর দিকে চেয়ে সেও বললেÑআলো পেলেম তোমার, সুর নাও আমারÑ নতুন নতুন আলোর ফুলকি দিকে দিকে সকলে যুগ-যুগান্তর আগে থেকে এই কথা বলে চলে,…।

সিন্দুর অরূণ আর, আহা কিবা সে মধুর রূপ।

গ্রন্থটির তত্ত্ব শিশুবোধক নয়, কিন্তু বলার ভঙ্গীতে তা হয়ে উঠেছে শিশুদেরও। রূপকথার ভঙ্গীতে বলা শিশু আগাগোড়া জানবে এটা মোরগের গল্প। এক নিমেষে কুঁকড়োর রূপে, গুণে, বীরত্বে শিশু মনে মনে কুঁকড়োকে ভালবেসে ফেলে, কুঁকড়োর পক্ষ নেয়। রূপকথার রাজা ও রাণী অবশেষে সুখে স্বর্গবাস করে। শিশুমন সেটা সহজে মেনে নেয় যেমন, তেমনি মেনে নেয় সোনালি আর কুঁকড়োকে অমল আলোর পটভূমিতে।

ঞযড়সধং ওহমড়ষফংনু ছদ্মনামে জরপযধৎফ ঐধৎৎরং  ইধৎযধস ( ১৭৮৮-১৮৪৫)-এর লেখা ঞযব ওহমড়ষফংনু খবমবহফং ড়ভ গরৎঃয ধহফ গধৎাবষং কাহিনীর ছায়াবলম্বী ’হানাবাড়ির কারখানা’ রচনা সম্পর্কে তার নাতি শ্রীশোভনলাল স্মৃতিকথায় বলেছেন,

অনেকদিন পরে দাদামশায় ওহমড়ষফংনু খবমবহফ বলে একটি বই থেকে কতকগুলি গল্প নিজের ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন। লেখাটি আগাগোড়া গদ্যের ছাঁচে লেখা হলেও বক্যের শেষে প্রায়ই একটা মিল আছে। দাদামশায় বলতেন, এগুলো পড়তে হলে শুধু গল্পের মত একটানা পড়ে গেলে হবে না। এগুলো আসলে কবিতাÑঠিক ছন্দ রেখে ঠিক সুরে এগুলো পড়লে তবেই এর রস পাওয়া যাবে। দাদামশায় পড়ে শোনাচ্ছেন আমরা শুনছি আর দেখছি বাঁ-হাতে লেখার খাতাটা ধরাÑডান হাতটা সামনে বাড়িয়ে লম্বা লম্বা আঙুলগুলো বাতাসে নেড়ে বুঝিয়ে দিচ্ছেন ঝড়ের ঝাপটায সমস্ত কিছু দুলছে এপাশ ওপাশ।১৭

এখানেও অবনীন্দ্রনাথ তাঁর নিজস্ব ভঙ্গীতে সম্পূর্ণ নতুুন সৃষ্টি করেছেন। অনবদ্য ভঙ্গিতে দৈত্য, ভূত, রাক্ষস, চোর, কাপালিকের গল্প ।

যেহেতু গ্রন্থটি অবিমিশ্র গদ্যে লেখা নয় এবং কবিতাকারে সজ্জিতও নয় সেজন্য পঠনভঙ্গীটি ছোটদের ধরতে সমস্যা হয়।

অবনীন্দ্রনাথের ’চাঁইবুড়োর পুঁথি’(১৯৫৬), ’মহাবীরের পুঁথি’ ও ’মারুতির পুঁথি’ (১৯৫৬)র মধ্যেও লক্ষ্য করা যায় রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ, রাক্ষস-খোক্ষসের গল্প ঘেঁটে নিজের অন্তর্দৃষ্টিতে বিশুদ্ধ করে, স্বতন্ত্র মুল্যের বাক্সময় রূপ ফুটে তুলেছেন। ছোটরা এর ধ্বনিমাহাত্মে আকর্ষিত হয় কিন্তু এর সর্বায়ব অর্থ তাদের বোধগম্য নয়। রঙ বেরঙ (১৯৫৮), ’মাসি’ ও (১৯৫৮) এ প্রসঙ্গে স্মরণীয়।

ছোটদের পরিপূর্ণ বিকাশের কথা অবনীন্দ্রনাথ যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে ভেবেছিলেন। তাদের যেমন খেলার মাঠ চাই তেমনি ঘরও চাই, স্টেজও চাই। শিশুসাহিত্য রচনার জন্য যে অন্তর্বোধের দরকার, যে স্বতস্ফুর্ত মানসিকতার প্রয়োজন তা অবনীন্দ্রনাথের জানা ছিল।

অবোলা শিশু যেটা বলে যেতে পারলে না, সেইটেই বলে যান ভাবুক, কবিতায় ছবিতেÑলেখার ছন্দে, রেখার ছন্দে, সুরের ছন্দে, অবোলা শিশুর বোল, হারানো দিনগুলির ছবি।

অবনীন্দ্রনাথ শৈশব সমুদ্রের দক্ষ ডুবুরির মত সমুদ্র মন্থন করে উজার করে এনেছেন মুক্তা-মানিক। লক্ষ শিশুর মুখে হাসি ও মনে সুখ এনে দিয়েছিলেন। শিশুসাহিত্যে তিনি নতুন গদ্যছন্দ এনেছেন।

ঠাকুর পরিবারের এই ব্যক্তিত্ব সব বিষয়েই ছিলেন বিরল। লেখায়, চিত্রকলায়, অভিনয়ে, শিল্পকলায়, সমলোচনায়, গল্প বলার বাচনিক ক্ষমতায়, সূক্ষ্ম রুচিবোধে অবনীন্দ্রনাথ একক নক্ষত্র। রবীন্দ্রনাথের ভ্রাতুষ্পুত্র হলেও এটিই তার আসল পরিচয় নয়। রবীন্দ্রনাথের øেহছায়ায় তার বিকাশ। ছবির জগতে, লেখার জগতে রবীন্দ্রনাথের প্রেরণা ছিল সদাজাগ্রত। তা সত্ত্বেও এই লেখার ক্ষেত্রে, এই বাণীচিত্রের অমর সৃষ্টিতে অবনীন্দ্রনাথ রবীন্দ্র-প্রভাবমুক্ত ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ নিজেও তাকে সম্মানের উচ্চাসনে বসিয়েছেন।

অবনীন্দ্রনাথের সত্তার শিকড় এই বাংলার গভীরে। তিনি অবশ্যই পেয়েছিলেন নবাবী আমেজ। তার গল্পের বইতে, তার মজাদার নাটকে ছড়ায় অবনীন্দ্রনাথের মধ্যে গ্রামীণ বাংলার সংস্কৃতি নবরূপ খুঁজে পায়। আমাদের ছড়া, গান, কথকতা, রূপকথা, মেয়েলি ব্রতে বাংলার প্রত্যক্ষ নিসর্গ তার প্রতিভা ভূতপত্রী ও ক্ষীরের পুতুল গড়ে, হাঁস ঝাঁকে বাংলাময় ওড়ে, কুঁকড়োর গানে জাগে।

অবনীন্দ্রনাথ তার গভীর শিল্পস্বভাবে আর সেই শুদ্ধ কারণে বাংলার লৌকিক জীবনের সঙ্গে দুর্মর সাযুজ্যে বুঝেছিলেন কোথায় বাংলার নবজাগরণের উৎস। ইংরেজী শিক্ষার প্রসার, সমাজস্স্কংার, ব্রাম্মধর্ম আন্দোলন ইত্যাদি যে এ ব্যাপারে সম্পূর্র্ণ সত্য নয়, সে বিষয়ে অবনীন্দ্রনাথ প্রথমে আমাদের চেতন করেন, পালটা গোঁড়ামির বাঁধি গতে নয়, সৃষ্টিময় শিল্পচৈতন্যেরই সার্থক এষণায়।

তবে শকুন্তলাতে শিশুমনের বোধগম্যতা কম। ‘বুড়ো আংলা’য় একটা বিশেষ ধর্মের ধ্যান-ধারণা, কুসংস্কার শিশুর মনে প্রবিষ্ট করানো হয়েছে। হিন্দু ধর্মে দেবতা মাত্রই ব্রাম্মন তার গায়ে চিংড়ি মাছের জল ছোঁয়ানোতে তার অভিশাপে সে মানুষ থেকে এক আঙ্গুল পরিমাণ জীবে পরিণত হল। জাতিভেদপ্রথা প্রকটভাবেই রচনাটিতে প্রকাশ পেয়েছে। ‘বুড়ো আংলা’, ‘নালক’, ‘খাতাঞ্চির খাতা’, ‘ভূতপত্রীর দেশ’ ও ‘চাঁই দিদি’র কাহিনীগুলি অপূর্ব। কিন্তু তার গল্পের ভাব অতি উচ্চমার্গের হওয়াতে এগুলির রসগ্রহণ অল্পবয়স্ক পাঠকের পক্ষে হৃদয়ঙ্গম দুরূহ। তাঁর ‘ভূতপত্রীর দেশ’-এর কাহিনীর অসাধারণতার জন্য এটির রস গ্রহণ বয়স্ক পাঠকের পক্ষে অসুবিধাজনক। ঈশ্প ও কথামালার গল্প আশ্রয়ে তাঁর পালাগুলিও ঠিক একই কারণে শিশুদের জন্যে দুরূহ হয়ে উঠেছে।

’রাজকাহিনী’তে হিন্দু দেবদেবী এবং হিন্দু রাজাপ্রজারই জয়জয়কার ঘোষিত হয়েছে। অন্য কোন ধর্ম বা রাজাপ্রজার শৌর্যবীর্য তার রচনায় স্থান পায়নি। ’গোহ’* অংশে ’ম্লেচ্ছ’* এবং ’ভয়ঙ্কর মুসলিম’ বলে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের অপেক্ষাকৃত হেয় প্রতিপন্ন করার মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক মনোভাব ব্যক্ত হয়েছে। সুতরাং একথা বলা যায় অবনীন্দ্রনাথ পুুনর্র্র্জাগরণ প্রক্রিয়ার অনুসন্ধান করেছেন হিন্দু ঐতিহ্যের মধ্যে। তাঁর শিশুসাহিত্যে বঙ্গভঙ্গজনিত বেদনার প্রতিফলন নেই।

 

 

পাদটীকা

১। সুনির্মল বসু, সুনির্মল রচনাসম্ভার-৩, ফরোয়ার্ড পাবলিশিং কনসার্ন, কলিকাতা-১২। ১৩৮২। পৃ-৩৪৮।

২। অবনীন্দ্র রচনাবলী-১, প্রকাশ ভবন, ১৫, বঙ্কিম চ্যাটার্জি ষ্ট্রিট কলিকাতাÑ১২। ১৯৭৩। পৃ-১

৩।্ ঐ,পৃ-১

৪। ঐপৃ-২

৫। ঐপৃ-৩৭২

৬। ঐ পৃ-৩৬৯।

৭। অবনীন্দ্র রচনাবলী, দ্বিতীয় খন্ড, প্রকাশ ভবন, ১৫, বঙ্কিম চ্যাটার্জি ষ্ট্রিট, কলিকাতা-১২। ১৯৭৪। (ঐ, স্মৃতিচারণ-) পৃ-              ৪৭৩।

৮।

৯। শিশুদের রবীন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্র রচনাবলী-১, প্রকাশ ভবন, ১৫, বঙ্কিম চ্যাটার্জি ষ্ট্রিট কলিকাতাÑ১২। ১৯৭৩। পৃ-৩৭০

১০। পুশ-ইন-বুট্স।

ক্ষীরের পুতুল, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিঃ কলকাতা, পৃ-৫১-৫২।

১১। দক্ষিণারঞ্জন রচনাসমগ্র-১, ঠাকুরমা’র ঝুলি, পৃ-৫(অবনীন্দ্র রচনাবলী, দ্বিতীয় খন্ড, প্রকাশ ভবন, ১৫, বঙ্কিম চ্যাটার্জি ষ্ট্রিট, কলিকাতা-১২। পৃ-৪৭৫)

১২। অবনীন্দ্র রচনাবলী, দ্বিতীয় খন্ড, প্রকাশ ভবন, ১৫, বঙ্কিম চ্যাটার্জি ষ্ট্রিট, কলিকাতা-১২। পৃ-৪৭৬

১৩।

১৪। ’ঘরোয়া’ (১৯৪১)

১৫। আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৯ চৈত্র, ১৩২৯

১৬। শোভনলাল স্মৃতিকথা (১৬ অবনীন্দ্র রচনাবলী-১, প্রকাশ ভবন, ১৫ বঙ্কিম চ্যাটার্জি ষ্ট্রিট কলিকাতাÑ১২। পৃ-৬৩)

১৭। শোভনলাল স্মৃতিকথা

 

(১৭। অবন-৩, পৃ-৬৪)

 

২।‘শকুন্তলা’ অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রথম মুদ্রণ, পৃষ্ঠা ২-৩

৩। শকুন্তলা, আদি ব্রাম্ম সমাজ, আনন্দ প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশনস প্রাইভেট লিমিটেড, ৪৫ বেনিয়াটোলা লেন, কলকাতা ৭০০ ০০০। ১৮৯৫

৪। ক্ষীরের পুতুল, আদি ব্রাম্ম সমাজ, ১৮৯৬।

৫। রাজকাহিনী, হিতবাদী লাইব্রেরী, ১৯০৯।

৬। ভূতপত্রীর দেশ’ ইন্ডিয়ান পাবলিশিং হাউস, ১৯১৫

৬। নালক, ইন্ডিয়ান পাবলিশিং হাউস ১৯১৬।

৭। আলোর ফুলকি, বিশ্বভারতী গ্রন্থালয়, কলকাতা, ১৩৫৪।

৮। খাতাঞ্চির খাতা, ইন্ডিয়ান পাবলিশিং হাউস, কলকাতা।

বুড়ো আংলা, এম. সি. সরকার এ্যান্ড সন্স লিমিটেড, কলকাতা, ১৩৪৮।

৯। হানাবাড়ির কারখানাঃ এম, সি সরকার এ্যান্ড সন্স লিমিটেড, কলিকাতা, ১৩৭০।

১০। বাদশাহী গল্প, প্রকাশ ভবন, কলিকাতা, বৈশাখ ১৩৭৭।

১১। অবনীন্দ্র রচনাবলী- প্রকাশ ভবন, ১৫, বঙ্কিম চ্যাটার্জি ষ্ট্রিট কলিকাতা-১২,। ১৯৭৪। পৃ-৬৫)

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের শিশুসাহিত্য

(১৮৭৭-১৯৫৭)

 

সাহিত্যের ইতিহাসে এমন এক একেকজন প্রতিভার আবির্ভাব ঘটে যাঁর একখানি গ্রন্থই তাঁর খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠার পক্ষে যথেষ্ট হয়ে থাকে। শিশুসাহিত্যের আলোচনাতেও একই প্রমাণ পাওয়া যায়। ’অ্যালিস ইন্ ওয়ান্ডারল্যান্ড’, লুইস ক্যারলের পৃথিবীজোড়া খ্যাতির কারণ, এডওয়ার্ড লীয়ার ’ননসেন্স রাইম্’ লিখে বিশ্বের স্বতন্ত্র সম্মান পেয়েছিলেন, মার্কটোয়াইন ’অ্যাডভেঞ্চারাস অফ্ হিকলব্যেরি ফিন’, আর. এল. ষ্টিভেন্সন্ ’ট্রেসার আইল্যান্ড’, ডিকেন্স অলিভার ’টু ইস্ট’, জোনাদান স্যুইফট ’গালিভার্স ট্রাভেল্স’, ডানিয়েল ডিফো ’রবিনসন ক্রুসো’ লিখে বিশ্ববিখ্যাত হয়েছিলেন।

দক্ষিণারঞ্জন লোকজীবনের প্রচলিত কথা, রূপকথা, গান তুলে এনে বাণীবদ্ধ করে তাঁর অমর সৃষ্টি ’ঠাকুরমার ঝুলি’ রচনা করেছিলেন। এই একটি গ্রন্থই তাঁকে সাহিত্যিক অমরতা এনে দিয়েছিল।

বাংলাদেশের ঢাকা জেলার সাভার-এর নিকটবর্তী উলাইল গ্রামের প্রাচীন মিত্রমজুমদার বংশে ১৮৭৭ খ্রীষ্টাব্দে (বাংলা ২রা বৈশাখ ১২৮৪) দক্ষিণারঞ্জন মিত্র জন্মগ্রহণ করেন। ’যশোর নগরধাম প্রতাপ আদিত্য নাম’-বারো ভুঁইঞার অন্যতম এই বংশ এবং চন্দ্রদ্বীপরাজ রাজচন্দ্র Ñ জন্মসূত্রে এই দুই প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী বংশে জন্মেছিলেন তিনি।

সাহিত্যে পাটখড়ি তাঁর স্কুল জীবনেই। তাঁর প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থাবলী ’’উত্থান’ (১৯০২)। তাঁর সম্পাদিত মাসিক পত্রিকা ’সুধা’। ’সুধা’র পৃষ্ঠায় কবিতা ও বিঞ্জানবুদ্ধির চর্চার দ্বারা সস্মাদক দক্ষিণারঞ্জন প্রমাণ করলেন ’কবিতার ভাবাবেগ এবং সিরিয়স রচনায় কোনো বিরোধ থাকে না’১।

১৯০৩ খ্রীষ্টাব্দে দক্ষিণারঞ্জন বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজে এফ, এ, পড়তে পড়তে পড়াশুনায় ইস্তফা দিয়ে পিসির জমিদারি দেখার ভার নিয়ে ময়মনংিহে চলে যান। পূর্ববঙ্গের গ্রামে, মাঠে, নদীতে ছড়িয়ে থাকা লোকজীবনের সুখ-দুঃখের সহস্র লুপ্ত  সম্পদের সন্ধানও তিনি এখানে পান। একটি ফনোগ্রামের সাহায্যে মোমের রেকর্ডে গ্রাম-গ্রামান্তরের বৃদ্ধ বৃদ্ধার মুখে উচ্চারিত লোককথা, রূপকথা, গান, ব্রতকথা, অবিকৃতরূপে তিনি সংগ্রহ করেন। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে পাঠবিভিন্নতা, আখ্যানবিচিত্রা বিশ্লেষণ করে মূল কথাটিকে আবিষ্কার করে তিনি তৈরী করেন ’কথা সাহিত্য’। কাব্যচর্চা ও কবিকল্পনা মিলে অবহেলিত কথা সাহিত্যকে তিনি বাংলা শিশুসাহিত্যের দরবারে হাজির করেন। চার ভাগে বিন্যস্ত হয় সেই অমূল্য সম্পদ। রূপকথা, গীতিকথা,  ব্রতকথা ও রসকথা। যার পরিণতি যথাক্রমে ’ঠাকুরমার ঝুলি’ (১৯০৬), ’ঠাকুরদাদার ঝুলি’ (১৯০৮), ’ঠানদিদির থলে’, (১৯০৯) আর ’রসকথা’ অথবা ’দাদামশায়ের থলে’ (১৯১৩)।

১৯০৫-এ দক্ষিণারঞ্জন কলকাতায় এলে দীনেশচন্দ্র সেনের সঙ্গে পরিচয় হয়। দীনেশ সেনের অদম্য উৎসাহে, সক্রিয় সহযোগিতায় সেকালীন নামকরা প্রকাশক ’ভট্টাচার্য এ্যান্ড সন্স’ দক্ষিণারঞ্জনের ’ঠাকুরমার ঝুুলি’র প্রথম সংস্করণ প্রকাশ করেন।

’প্রদীপ’, ’প্রকৃতি’, ’ভারতী’, ’বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ’ প্রভৃতি পত্রিকায় দক্ষিণারঞ্জনের প্রবন্ধ ও অন্যান্য রচনা ততদিন নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছিল। ’ঠাকুরদাদার ঝুলি’র ’পুষ্পমালা’ কাহিনীটি স্বর্ণকুমারী দেবী সম্পাদিত ’ভারতী’ পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। তের বর্ষ, তৃতীয় সংখ্যা ’বঙ্গীয় সাহিত্য পত্রিকা’য় ’গ্রাম্য নীতি’ এবং ’গান ও ধুয়া’ নামক দক্ষিণারঞ্জনের দুটি রচনা প্রকাশিত হয়েছিল।

দক্ষিণারঞ্জনের মূল অবদান রূপকথা সৃষ্টির ক্ষেত্রে, এখানে তিনি প্রায় অদ্বিতীয়, এজন্য তাঁকে অনেকে য়্যান্ডারসন২ বা র্গ্রীম ভাই৩দের সঙ্গে তুলনা দেন। ময়মনসিংহে দীর্ঘ দশ বছর অবস্থানকালে গ্রাম বাংলার লুপ্তপ্রায় লোককাহিনী সামাজিক ও পারিবারিক পরিমন্ডলে প্রচলিত আনন্দঘন গল্প কাহিনী সংগ্রহ করে এগুলো শিশুদের জন্য নব রূপায়নের মাধ্যমে তিনি পরিবেশন করেন। গল্পকাহিনীগুলি প্রায়ই রূপকথা কিংবা রূপকথাপ্রবণ, এভাবে পরিবেশনের মধ্যে বাংলায় সমাজ গঠন পুনর্জাগরণ ও দেশাত্মবোধের জন্য দক্ষিণারঞ্জনের দায়বদ্ধতা লক্ষ্য করা যায়। বাংলায় শিশুর সঙ্গে সামাজিক ও পারিবারিক জীবনের øেহ মমতাময় প্রিয় সম্পর্কগুলোকে তিনি গভীর আগ্রহে সামনে নিয়ে এসেছেন, ঠাকুরমা, ঠাকুরদাদা, দাদামশায়, ঠানদিদি ইত্যাদি চরিত্রের সঙ্গে ঝুলি, থলে শব্দ যুক্ত করে দিয়ে এসবের সঙ্গে চিরন্তন শিশুকে সম্পর্কযুক্ত করে দিয়েছেন। মাতৃøেহ সমগ্র রূপকথার ভুবনকে প্লাবিত করে দিয়েছে। তৃতীয পুরুষ কিংবা তৃতীয় প্রজন্মের সঙ্গে প্রথম প্রজন্মকে যুক্ত করে লেখক উভয়কে একই শৈশবের বন্ধনীতে স্থাপন করেছেন। গ্রাম বাংলার একান্নবর্তী পরিবার কাঠামোতে জন্মপ্রাপ্ত এ গল্পকাহিনীগুলো নবরূপে শিশুর সঙ্গে সমাজ ও পরিবারের সম্পর্ককে পুনর্গঠন করে দিযেছে ট্রাডিশনাল রূপকথার। লোককাহিনীগুলোর পুনর্জন্মপ্রাপ্ত হয়েছে। একটি সুনিশ্চিত শিশুধারণাকে সামনে নিয়েই তা শালীন সাহিত্যের পৃষ্ঠায় উঠে এসেছে।

তাঁর গ্রন্থের সংখ্যা সতেরটি। ’উত্থান’ (কাব্য) (১৯০২), ’ঠাকুরমার ঝুলি’ (১৯০৬), মা বা আহুতি, (১৯০৮) ’ঠাকুরদার ঝুলি’ (১৯০৯), ’খোকাখুকুর খেলা’ (১৯০৯), সরল চন্ডী (১৯১০), আর্যনারী’ (১ ও ২ খন্ড ১৯০৮ ও ১৯১০)

’চারু ও হারু’ (১৯১২), আমার বই (১৯১২), দাদামশায়ের থলে’ (১৯১৩), ’ভাদ্র’ (কাব্য ১৯১৩), পূজার কথা (১৯১৮), ফার্স্ট বয় (১৯২৭), উৎপল ও রবি (১৯২৮), কর্মের মূর্তি (১৯৩৩), কিশোরদের মন (১৯৩৪?), বাংলার সোনার ছেলে (১৯৩৭), লেক রোড (১৯৩৮), সবুজ লেখা (১৯৩৮), পৃথিবীর রূপকথা (১৯৪০), চিরদিনের রূপকথা (১৯৪৭), আমার দেশ (১৯৪৮), আশীর্বাদ ও আশীর্বাণী (১৯৪৮), লাস্ট বয় (?), ’ঠানদিদির থলে’ (১৯৪৫)। দক্ষিণারঞ্জন মিত্রের সব রচনাই ছন্দিত।

শিশুসাহিত্যের সব শাখাতেই তিনি বিচরণ করেছেন। শিশুদের জন্য লিখেছেন ছড়া, কবিতা, গাথা, গান, গল্প, কিশোর উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, গল্পকথা, রূপকথা, উপকথা, রসকথা, লোককথা ইত্যাদি। রূপকথার ছবিগুলোও তিনি নিজেই অঙ্কন করেছেন।

তাঁর রচিত শিশুসাহিত্যকে বিষয়-বৈচিত্র্যের দিক থেকে নিুলিখিতরূপে ভাগ করা যায়,

রূপকথা কাহিনীমূলকÑবিভিন্ন গল্পের অন্তর্ভুক্ত ছড়া কবিতাসমূহ।

রূপকথা ঃ ঠাকুরমার ঝুলি, চিরদিনের রূপকথা, অচীন পথে, কাজল জল, ঠাকুরদার ঝুলি।

রসকথা ঃ দাদামশায়ের থলে (হবুচন্দ্র রাজা গবুচন্দ্র মন্ত্রী, সওদাগরের সাত ছেলে, নূতন জামাই, বাইশ জোয়ান আর তেইশ জোয়ান, ব্রাম্মন আর ব্রাম্মনী, ব্রাম্মণ ও বেনে-ভাই-পো, সরকারের ছেলে, রাজপুত্র,)

গীতিকথা ঃ ঠাকুরদাদার ঝুলির অন্তর্গত মধুমালা, পুষ্পমালা, মালঞ্চমালা, কাঞ্চনমালা।

শাস্ত্রীয় কথা ঃ পূজার কথা।

নীতিকথামূলক ঃ চারু ও হারু (কিশোর উপন্যাস), বাংলার সোনার ছেলে, ফার্স্ট বয়, লাস্ট বয়।

আশীর্ব্বাদমূলক ঃ আশীর্বাদ ও আশীর্বাণী।

স্বদেশপ্রেমমূলক ঃ না বা আহূতি।

সাধারণ ঃ জন্মদিন

নিবেদন বা প্রশংসামূলক ঃ রূপগাথা (বাংলার সোনার ছেলে, রবীন্দ্রনাথ)।

উপদেশপূর্ণ বক্তব্য ঃ ’দাদামশায়ের থলে’  গ্রন্থের প্রতিটি কাহিনীর শেষে দ্রষ্টব্য বাণী।

ধর্মাশ্রয়ীÑউপহার।

শিক্ষামূলক ঃ ম্যাজিক।

অবনীন্দ্রনাথের ‘ক্ষীরের পুতুল’ দক্ষিণারঞ্জন মিত্রের সোনার কাঠি রূপোর কাাঠির স্পর্শ বুলিয়ে তাঁকে উদ্বুদ্ধ করেছিল এবং তিনি এর অনুসরণে ‘ঠাকুরমার ঝুলি’ (১৯০৭) প্রকাশ করেছিলেন। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ১৯০৫ সালে বাঙালীর জীবনে নবজাগরণ দেখা দিয়েছিল। ফলে বাঙালী তাঁর ঐতিহ্য সম্পর্কে অনুসন্ধ্যিৎসু হল। সে আলোকে উদ্ভাসিত হয়ে দক্ষিণারঞ্জন মিত্র লিখেছিলেন ‘ঠাকুরমা’র ঝুলি’। প্রকাশিত প্রথম শিশুতোষ গ্রন্থ Ñরূপকথা সংকলন বইটি সাহিত্যিক মহল এবং সাহিত্য সমালোচকদের কাছে দারুণভাবে অভিনন্দিত হয়। ’ঠাকুরমার ঝুলি’ একটি অবিস্মরণীয় ভূমিকা লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সেখানে তিনি একথা উল্লেখ করেছিলেন যে,

’ইতিপূর্বে কোনো কোনো গল্পকুশলা অথচ শিক্ষিতা মেয়েকে দিয়া আমি রূপকথা লিখাইয়া লইবার চেষ্টা করিয়াছি।’৪

লাল বিহার দে’র ঋড়ষশ ঞধষবং ড়ভ ইবহমধষ (১৮৮৩) এ  গ্রামবাংলার লোকজীবনে প্রচলিত কথা ও কাহিনী সংগ্রহ করেছিলেন। ইংরেজীতে লেখা এ সংগ্রহ গ্রন্থ অনিবার্যভাবেই বাংলার ছেলেমেয়েদের নিকট বহুল প্রচার ঘটেনি। বিভিন্ন জনে এর বাংলা অনুবাদও করেছেন। তবে দক্ষিণারঞ্জন এর রচনাকে জীবন্ত জগতের ছবিতে পরিণত করেছিলেন। উভয়ে একই গল্প বলেছেন অনেকক্ষেত্রে কিন্তু লাল বিহারীর ঋড়ষশ ঞধষবং ড়ভ ইবহমধষ (১৮৮৩) এর সঙ্গে ’ঠাকুরমার ঝুলি’র রসগত পার্থক্য যথেষ্ট।

লাল বিহারীর দে’র গল্পগুলি ছিল তাঁর বাল্যকালে বাংলায় জনৈক ’গল্প-বলা বুড়ি’ ও ব্রাম্মনের কাছ থেকে শোনা। পরবর্তীকালে তাঁর যৌবনে এই গল্পগুলি ইংরেজীতে লিখতে গিয়ে তার সতেজতা ও প্রাণবন্ততা হারিয়ে ফেলেন। অন্যদিকে দক্ষিণারঞ্জন গল্প, রীতি, কথা সবই মোমের রেকর্ডে সরাসরি বক্তার মুখ থেকে তুলে এনেছিলেন। বিকৃত হওয়ার সম্ভাবনা সেখানে ছিল না। ’ঠাকুরমার ঝুলি’র মত স্বদেশী দু’টি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও খুঁজে পাননি। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বলেন,

…দক্ষিণাবাবুকে ধন্য! তিনি ঠাকুরমা’র মুখের কথাকে ছাপার অক্ষরে তুলিয়া পুঁতিয়াছেন তবু তাহার পাতাগুলি প্রায় তেমনি সবুজ, তেমনি তাজাই রহিয়াছে; রূপকথার সেই বিশেষ ভাষা, বিশেষ রীতি, তাহার সেই প্রাচীন সরলতাটুকু তিনি যে এতটা দূর রক্ষা করিতে পারিয়াছেন, ইহাতে তাহার সূক্ষ্ম রসবোধ ও স্বাভাবিক কলানৈপুণ্য প্রকাশ পাইয়াছে। ৫

লালবিহারী দে’র রাক্ষসের গল্প আর দক্ষিণারঞ্জনের ’সোনার কাটী রূপার কাটী’ মূলত একই রূপকথা। কেশবতী কন্যার ঘুম ভাঙ্গিয়ে চম্পক-দল লালবিহারী দে’র গল্পে রাক্ষসকুল নিপাত করে সহস্র দলের সঙ্গে সুখে বসবাস করছে। সেই ঘুম ভাঙ্গানোর উপায়ও ছিল ’সোনার কাঠি আর রূপোর কাঠি’। অন্যদিকে দক্ষিণারঞ্জনের গল্পে দেখা যায় মন্ত্রীপুত্র, কোটালপুত্র আর রাজপুত্র রাগ করে দেশ ছেড়ে বিদেশ ঘুরতে গিয়ে রাক্ষসের হাতে পড়েন। রাক্ষস কোটালপুত্র আর মন্ত্রীপুত্রকে খেয়ে ফেলে, রাজপুত্র ঘুমন্ত রাজকন্যাকে সোনার কাঠি রূপার কাঠির স্থান বদল করে জাগিয়ে তুলে সেই রাক্ষসপুরীর রাক্ষসদের হত্যা করে রাজ্যে সুখ এনে রাজকন্যাসহ কোটালপুত্র ও মন্ত্রীপুত্রকে রাক্ষসের পেট থেকে বের করে দেশে ফিরে সুখে   রাজত্ব করতে থাকলেন।

কিন্তু বর্ণনার ঐশ্বর্যে দক্ষিণারঞ্জনের স্বাতন্ত্র্য স্পষ্টতঃই ধরা পড়ে। লালবিহারী দে’ কেবল গল্পটুকু দক্ষিণারঞ্জনের রচনায় তা জীবন্ত জগতের ছবি।

এঁ পিঁত্থিমির মোঁদের কিঁচ্ছুতে মঁরণ নাঁই।…কেঁবল ঐঁ পুঁকুরে যে ফঁটিকস্তঁম্ভ আঁছে। তাঁর মঁধ্যে এঁক সাঁতফণা সাঁপ আঁছে; এঁক নিঁশ্বাসে উঁঠিয়া ঐ সোঁনার তাঁলগাঁছের তাঁলপত্র খাঁড়া পাঁড়িয়া যঁদি কোঁন রাঁজপুত্র ফঁটিকস্তঁম্ভ ভাঁঙ্গিয়া সাঁপ বাঁহির কঁরিয়া বুঁকের উঁপর রাঁখিয়া কাঁটিতে পাঁরে, তঁবেই মোঁদের মঁরণ।

দক্ষিণারঞ্জনের বর্ণনায় পক্ষীরাজ ঘোড়া সাবধান করে দেয় …’রাজপুত্র পলাও পলাও, আর রক্ষা নাই।’ বনের গাছ পাথর চারিদিক থেকে বলে ওঠে, রাজপুত্র পলাও পলাও। সেখানে রাক্ষসের কান কুলোর মত, দাঁত মুলোর মত। এসব ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বর্ননা, ভয় ও সাহসের ঘটমান বর্ণনা, লালবিহারী দে’র রচনায় নেই।

ঠাকুরমা’র ঝুলি’র চারটি বিভাগ করা হয়েছে,

দুধের সাগর, রূপতরাসী, চ্যাং ব্যাং, এবং আম সন্দেশ। ১ম বিভাগে-কলাবতী রাজকন্যা, ঘুমন্ত পুরী, কাঁকনমালা, কাঞ্চনমালা, সাত ভাই চম্পা, শীত বসন্ত, কিরণমালা, ২য় বিভাগে- নীলকমল আর লাল কমল, ডালিম কুমার, পাতাল কন্যা, মণি মালা, সোনার কাটি রূপার কাটি, শিয়াল পন্ডিত, সুখু আর দুখু, ব্রাম্মণ ব্রাম্মণী, দেড় আঙ্গুলে, ৪র্থ বিভাগ-আম সন্দেশে- সোনা ঘুমা’ল, ফুরাল।

সাত ভাই চম্পা, কাঁকন মালা, কাঞ্চনমালা, ডালিম কুমার ইত্যাদি চলচ্চিত্র হিসেবে প্রকাশ পেয়েছে।

রূপকথা: ’চাঁদের কোণায় চরকা-কাটা বুড়ি’৬ র কথা প্রচলিত বাংলা রূপকথায় আছে। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ’ভূতপত্রীর দেশে’ও পাওয়া যায় চাঁদেও বুড়ি’র কথা;

পূর্ণিমার চাঁদের মতো প্রকান্ড একটা কাঁচের গোলা মাঠের ওপর দিয়ে বোঁ বোঁ করে গড়িয়ে আসছেÑযেন একটা মস্ত আলোর ফুটবল।..পালকিসুদ্ধ গোলাটার ভেতরে ঢুকে গেছি। একেবারে গড়িয়ে চলেছিÑবন্ বন্ করে লাঠিমের মতো ঘুরতে ঘুরতে। …ভয়ে দুই হাতে চোখ হাতে চোখ ডেকে চলেছিÑ।… ক্যাঁ ক্যাঁ চরকা-কাটার শব্দ শুনে চোখ খুলে দেখি এক বুড়ি সুতো কাটছে আর একটা খরগোশ তার চরকা ঘুরোচ্চে। বুড়িকে দেখেই চিনেছি, সেই আদ্যিকালের বদ্যিবুড়ি, যে চাঁদের ভেতর বসে থাকে। আর ওই তার চরকা…..৬৮,৭

দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের ’ঠাকুরমার ঝুলি’র ভিতর ’সুখু আর দুখু’ নামে যে রূপকথা রয়েছে, তার মধ্যেও পাওয়া যায় চাঁদের মা বুড়ীর কথা:

তারপর চলিতে চলিতে দুখু বাতাসের সঙ্গে কোথায় দিয়া কোথায় দিয়া এক ধবধবে বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত।

বাড়ীতে আর কেউ নাই: ফিটফাট্ ঘরদোর, ঝক্ঝক। অঙ্গিনা, কেবল দাওয়ার উপর এক বুড়ী বসিয়া বসিয়া

সূতা কাটিতেছে, সেই সূতায় চক্ষের পলকে যোড়ায় যোড়ায় শাড়ী হইতেছে।

বুড়ী আর কেউ না, চাঁদের মা বুড়ী।

দক্ষিণারঞ্জন সমকালীন যুগ এবং সমাজকে দেখেছিলেন বাঙালী সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের মধ্যে। যদিও কলকাতা শহরেই তাঁর জীবনের বেশীর ভাগ সময় অতিবাহিত হয়েছে, তবু গ্রাম বাংলার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল নিবিড়। তিনি ছিলেন স্বদেশীয়ানায় ভরপুর আদর্শবাদী পুরুষ।

১৯০৮ সালে তাঁর ’না বা আহুতি’ গ্রন্থ প্রকাশিত হলে এক সপ্তাহে ৩০০০ কপি বিক্রী হয়ে যায়।

পরের বছর প্রকাশিত ’ঠাকুরদার ঝুলি’ (১৯০৯)Ñ প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই অভিনন্দন জানালেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং অন্যান্য গুণীজন।

দক্ষিণারঞ্জনের রচনার স্বর্ণযুগ ১৯০৬-১২। জাতীয় জীবনে তখন স্বদেশী হাওয়া প্রবল। বঙ্গভঙ্গ, রাখী উৎসব, রবীন্দ্রনাথের গান, অবনীন্দ্রনাথের ছবি, দেশনেতাদের জ্বালাময়ী বক্তৃতায় উত্তাল বঙ্গদেশে দক্ষিণারঞ্জনের চিত্তেও লেগেছিল স্বদেশী ঢেউ। শুধু গ্রামবাংলার লুপ্ত গৌরবের পূর্ণ উদ্ধার করেই তিনি কর্তব্য সম্পাদন করেননি। ছোটদের মনে দেশপ্রেম জাগিয়ে তুলতে লিখলেন নানান কবিতা, গান ও কথার চিত্র। ‘দেশ’-এ গান লিখলেন,

দেশ দেশ দেশ ভাই, আমাদের দেশ!

সকল দেশের আগে সে কোন দেশ?

-ভাই, আমার দেশ।।

’খোকাখুকুর খেলা’ (১৯০৯)র অন্তর্গত এই রচনাটির সুর দিয়েছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর। ’খোকাখুকুর খেলা’, পর্যায়ে রয়েছে খোকাখুকুর খেলা, ভাইবোন, সর্বদমন, অন্নপূর্না মা, টুল! টুল!! টুল!!!, মামার বাড়ী, দুধবরণ, কালকেতু, বানিজ্য, বেহুলা সতী, বুল্বুল্, বুল্বুল্ মামা, এক তারাÑদুই তারা, ছি! ছি! ছি!, মজার গল্প, কে কি হব খেলা, আমাদের গ্রাম, বাগান, গান।

নানা বয়সের ছেলেমেয়ের উপযোগী বিষয় ও কবিতা লেখক আলোচ্য গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। ’খোকাখুকুর খেলা’ কবিতায় খোকাখুকুর খেলা ’সূর্য’কে নিয়ে। খোকাখুকুু আগে উঠবে না সূর্যি মামা আগে উঠবে তাই নিয়ে তার সাথে লুকোচুরি খেলা,

আচ্ছা মামা,                               কা’ল দেখ্বো

আগে উঠে কে!

রাত থাক্তে                 ভাই বোন

উঠ্বো জেগে’!!

একেবারে                   ছুটে’ গিয়ে

লুটে’ তুলবো ফুল,Ñ

তখন তুমি                  উঠে, মোদের

রাঙিয়ে দিও চুল!

বিশ শতকের গোড়ার দিকে মহারাজ মনীন্দ্রচন্দ্র নন্দীর পৃষ্ঠপোষকতায় ‘শিশু’ (১৯১২)৮ নামে একটি উচ্চাংগের পত্রিকা প্রকাশিত হয়। এই পত্রিকা প্রকাশ প্রসঙ্গে সম্পাদকের মতামত,

’শিশু’ শিশুদের খেলার সাথী শিক্ষারÑসহচর। শিশুদিগকে আমোদের সহিত শিক্ষাদান করাই শিশুর উদ্দেশ্য।

দক্ষিণারঞ্জন মিত্রের ‘শিশু’ কবিতা দিয়েই পত্রিকাটির সূচনা হয়েছিল,

ওগো

আমরা এসেছি আজ

শিশুর প্রাণ আমরা এসেছি আজ

সোনার স্বপন দুটি ভাই বোন্

সোনার দেশের বুকে

হাসিয়া এসেছি সুখে।

পুরাণ, শাস্ত্র, প্রাচীন কবিদের কবিতার কাহিনী থেকে চরিত্র ও ঘটনা অবলম্বন করে সেগুলির সঙ্গে পরিচিত করে তুলেছেন ছোটদের। তারই ফলে রচিত হয়েছে তাঁর কালকেতু’, ’অন্নপূর্ণা মা’, সর্বদমন’ প্রভৃতি কবিতা।

এই প্রসঙ্গে তাঁর ’আমার দেশ’ (১৯৪৮) রচনাটিও স্মরণীয়। ’সপ্তডিঙ্গায়’ সওদাগর পুত্র আর সাত ভাই কাঞ্চনের বানিজ্য যাত্রার রূপময় বর্ণনার মধ্যেও বাঙালি যৌবনের জয়গান ধ্বনিত হয়েছে। মাঝ সমুদ্রে তুফান উঠলে ভাই কাঞ্চন দাদাকে বলেছে, তোমার বাঁশি আঁকা নিশান আমি রাখব। ফিরব বাঙলা দেশে আমরা।” কিন্তু প্রলয় ঝড়ে ডুবে যায় সপ্তডিঙ্গা। কেবল বাংলা সাগরের উত্তাল হাওয়ায় গান ভেসে আসে।

আমরা ফিরব, ফিরব, ফিরব, যে বাঙালী, খুঁজতে আসবে আবার সপ্তডিঙ্গা, ফিরব তারি সঙ্গে!

তাঁর ’আর্যনারী’ (১৯০৮) ও ’সচিত্র সরল চন্ডী’ (১৯১০) গ্রন্থে ভারতবর্ষের প্রাচীন ধর্মবোধ শিশুমনোপযোগী করে রচনা করেছিলেন। ’আর্যনারী’ দুই খন্ডে প্রকাশিত এই গ্রন্থের যুগ্মলেখক দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার ও কালীপ্রসন্ন দাশগুপ্ত। গ্রন্থে বৈদিক যুগের নারী মহিমা যেমন কীর্তিত হয়েছে, তেমনি পরবর্তী কালের ভারতীয় নারী চরিত্রের বীরত্ব ও মহত্ত্ব কীর্তিত হয়েছে। বইটি সহজ সরল ভাষায় ছোটদের উপযোগী করে লেখা।

’কিশোর উপন্যাস’ পর্যায়ে রয়েছে ’চারু ও হারু’ (১৯১২), ’উৎপল ও রবি’, ’ক্যাঙ্গারু’।

দক্ষিণারঞ্জনের ’চারু ও হারু’ ঢাকার ‘তোষিণী’৯ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। সূচনায় ডে’ রচিত ‘ঝধহফভড়ৎফ ধহফ গধৎঃবহ’-এর সামান্য সাদৃশ্য আছে। রূপকথার ধাঁচে বিন্যস্ত উপদেশমূলক রচনা।

রচনাটিকে সমালোচকগন অভিনব ও মৌলিক কিশোর উপন্যাস বলে দাবি করেছেন। দুঃখী চাষীর ছেলে হারু কি করে বাবার সংসারের কাজকর্ম করে, সৎভাবে থেকে নিয়মিত পড়াশুনা করে বৃত্তি পায়, মেডেল পায় ও ক্লাসের ’ফার্স্ট বয়’ হয়ে সকলের প্রশংসিত হয় অন্যদিকে চারু জমিদারের ছেলে হয়েও সোনার খাটে শুয়ে বসে, বাবা-মা আত্মীয় স্বজনের অতিরিক্ত আদরে, দুষ্টু বন্ধুদের সংসর্গে ক্লাসের নিকৃষ্ট ছেলেতে পরিণত হয় তার কাহিনী। বলা বাহুল্য এটা শিক্ষাব্যবস্থারই রূপকথা।

রবীন্দ্রনাথের শৈশব সাধনার পাশাপাশি বাংলা শিশুসাহিত্যে আরেকটি ধারা চলছিল, রবীন্দ্রনাথ প্রথম থেকেই নীতিবাগীশ ও উপদেশমূলক বলে যার ব্যঙ্গ করছিলেন। আমাদের দেশে ইংরেজরা মাছিমারা কেরাণী বা সদাগরী আপিসের বাবু তৈরী করবার মধ্যে মস্ত একটা ধাপ্পা ছিল; লেখাপড়া করে যে গাড়ী ঘোড়া চড়ে সে। যেহেতু ফিউড্যাল ব্যবস্থায় গাড়িঘোড়া চড়বার অধিকার আসতো জন্মসূত্রে, ভগবানের সুপ্রশয় কৃপাদাক্ষিণ্যে, অতএব বুর্জোয়া শিক্ষাব্যবস্থার এই জিগির গোড়ার দিকে প্রায় বৈপ্লবিক বলেই বোধ হয়েছিল। ছেঁড়া কাঁথা আর অতুল ঐশ্বর্যের দিবাস্বপ্ন সত্ত্বেও এঁরা সকলেই জানেন আমাদের দেশে কে বা কারা লেখাপড়া করবার সুযোগ পেত। ‘যদি তোমার মেধা, অধ্যবসায়, ধৈর্য, অক্লান্ত পরিশ্রম করবার ক্ষমতা ইত্যাদি বিবিধ চারিত্রিক গুণাবলী থাকে, তবেই তুমি পরিবেশের প্রতিকূলতাকে জয় করতে পারবে’Ñএই রকম একটা আপ্তবাক্য বারে বারে ভজানো হত,  দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদাদের ’চারু ও হারু’, ’ফার্স্ট বয়’, ’লাস্ট বয়’, ’উৎপল ও রবি’, ’কিশোরদের মন’ ইত্যাদি এই জাতীয় গ্রন্থÑ যার আদর্শ ছিল ’ঁটম ব্রাউন্স স্কুল ডেজ’ বা ’দি হিল’ জাতীয় বই।

’ফার্স্ট বয়’ (১৯২৭) গল্পে ভালো ছাত্রের সামাজিক দৃষ্টান্তকে উপস্থাপন করা হয়েছে। কবিতার মধ্যে ‘সবুজ লেখা’ গ্রন্থভুক্ত ‘সবুজ কিশোর’ কবিতায় তিনি বাংলায় চিরন্তন øেহ মমতার রূপটি প্রকাশ করেছেন। যেমন,

মায়ের চোকের আদরটি আর বোনের হাসি,

যারেই দেখি তা’রই ভালবাসার রাশি

দক্ষিণারঞ্জনের প্রায় সকল কবিতাতে এরূপ অন্তরঙ্গ øেহ মমতার সাক্ষাৎ মেলে।

দক্ষিণারঞ্জনের ’দাদামশা’য়ের থলে’ (১৯১৩), বা ’বাংলার রসকথা’। এই পর্যায়ে রয়েছে, হবুচন্দ্র রাজা গবুচন্দ্র মন্ত্রী, সওদাগরের সাত ছেলে, নূতন জামাই, বাইশ জোয়ান আর তেইশ জোয়ান, ব্রাম্মণ আর ব্রাম্মণী, ব্রাম্মণ ও বেনে ভাই-পো, সরকারের ছেলে, রাজপুত্র। ’দাদামশা’য়ের থলে’র ’ভুমিকা’তে রয়েছে রসের ছড়া ’রসগোল্লা’১০পৃৃ-২,

র্ঝছে হাসি, ছুটছে হাসি, ফুটছে হাসি মুখে,

লাল টুক্টুক্ মুখগুলি সব হাসছে মধুর সুখে!

‘সবুজ লেখা’ (১৯৩৮) গ্রন্থে পেয়েছি ’কাজল জল’ (রূপকথা), কবিতা (৬টি), ঙ (গল্প), দরদী (গল্প), তুলির লেখা (গল্প), পরবি (অভিনয়), রামধনু (অভিনয়), শেষের সুর (অভিনয়), পৃথিবীর কথা (প্রবন্ধ), পৃথিবী, ম্যাজিক (প্রবন্ধ), পূজোর চিঠি (বিবিধ), আশীর্বাদ (বিবিধ) দেশ (গান ও স্বরলিপি), বিদায়।

তাঁর কবিতাবলীর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ্য ’কামনা’ (প্রথম বর্ষ, পঞ্চম সংখ্যা), ’নদীর জল’ (প্রথম বর্ষ, সপ্তম সংখ্যা), ’উপহার’ (দ্বিতীয় বর্ষ, ষষ্ঠ সংখ্যা) আর ’শ্রাবনে’ (চতুর্থ সংখ্যা)। প্রথম কবিতা দুটি ছন্দের দিক থেকে ব্যঞ্জনাময়। দ্বিতীয়টির অতিরিক্ত বৈশিষ্ট্য রচিত হয়েছে দুটি চরিত্রের উক্তিকে পাশাপাশি রেখে। কবিতাটির কিছু অংশ,

ÑভাইÑ                                   ÑবোনÑ

ছল্ছলো                                    বলে ’যাই!

Ñকোথা যায়Ñ                                 Ñদিয়ে তাই

জল?                                                        তাই

নেচে নেচে ছোটে আর                কারে ডাকে ? কোথা যায় ?

কারে ডাকে বল্?…     কি জানি

কি ভাই!…

সাড়ে তিন পৃষ্ঠায় প্রকাশিত ’উপহার’ ধর্মাশ্রয়ী এবং প্রকাশভঙ্গীতে প্রাচীনপন্থী।

দক্ষিণারঞ্জনের প্রবন্ধের সংখ্যা তিনটি। প্রবন্ধগুলি যথাক্রমে ’পৃথিবীর রূপকথা’ (১৯৪০), ’পৃথিবী’, ’ম্যাজিক’। বিজ্ঞান বিষয়ক অথচ পুরাণের গল্পের মত করে সাজানো শিশুমনের গভীরে তা দাগ কেটে যায়, অজানাকে জানার পিপাসা সৃষ্টি করে।

’পৃথিবীর রূপকথা’য় পৃথিবী সৃষ্টি রহস্যের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন যদিও প্রাপ্ত তথ্যসূত্রের উল্লেখ কোথাও করেননি।

’চিরদিনের রূপকথা’(১৯৪৭)র রচনাসমূহও সবই রূপকথামূলক। দক্ষিণারঞ্জনের কৃতিত্ব তিনি মুখের কথার বা শব্দের ধ্বনিকে সাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। ’চিরদিনের রূপকথা’য়  বাতাসের শব্দকে কথায় প্রকাশ করেছেনÑ

বাতাস…হো হো, সোঁ সোঁ; আবার র্ঝি র্ঝি, শির র্শি।

’বাংলার সোনার ছেলে’ রবীন্দ্রনাথের জীবনী প্রায় রূপকথার মত করে রচিত। সমকালীন সমাজ পরিমন্ডলের মধ্যে বাস্তব দৃষ্টান্তগুলোকে দুর্বল না করে কিভাবে রূপকথার আনন্দলোক গঠন করে তোলা সম্ভব এখানে তা লক্ষ্য করা যাবে। বাংলার সোনার ছেলে শেষ হয়েছে এভাবে,

বাংলার সোনার ছেলের এমন সত্য কাজ, সুন্দর এত, এতই মোহন, যেন একটি সদ্য রূপকথার মত। বাঙালীর ছেলেমেয়েদের কাছে তা নিত্য সুন্দর। প্রতি সন্ধ্যার দীপ।

মধুর আরও।

শিশুতোষ জীবনী রচনার এরূপ সৃষ্টিশীল দৃষ্টান্ত সমগ্র বাংলা সাহিত্যেই অনির্বচনীয় মনোহর, প্রায় নিরুপম তুলনাবিহীন।

বাংলায় পুনর্জাগরণের কালে যখন উৎস সন্ধানের দিকে সামাজিক আগ্রহ বৃদ্ধি পেয়েছিল সে সময়েই দক্ষিণারঞ্জন শিশুদের জন্য এ আনন্দভূবন সৃষ্টি করে দিয়েছিলেন, তাঁর সমগ্র রচনার সঙ্গে নিসর্গের নিবিড় সম্পর্ক একে আরো অপরূপ করে তুলেছিল। দক্ষিণারঞ্জন যখন সাহিত্য সৃষ্টিতে এগিয়ে আসেন ততদিনে সামাজিক শিশুধারণা সুনির্দিষ্ট রূপ নিয়েছে, তিনি তাঁর পূর্ণ সৃষ্টিকর্ম নিয়ে এখানে যোগ দিয়ে সমগ্র প্রবাহকেই আরো পুষ্ট লাবণ্যময় করে দিয়েছেন।

’আমার দেশে’(১৯৪৮)র ’দাদুর দেশে’র বাঙলার ছেলেমেয়েরা হাত জোর করে ’বন্দেমাত্রম’ গান গেয়েছে।

’আমার দেশ’, পর্যায়ে রয়েছে ’সপ্তডিঙা’, ’দাদুর দেশ’, ’অপরূপ সোনার কাঠি’, ’কলরব’, ’কঙ্কালের জাগরণ’, ’কথিকা’, ’শেষ ফুলদল’, ’পদ্ম’।

দক্ষিণারঞ্জন মিত্রের স্বদেশীয়ানার পরিচয় ’আমার দেশ’ গ্রন্থের ’সপ্তডিঙা’ কবিতায় মূর্ত হয়ে উঠেছে। সপ্তডিঙা সাত সমুদ্রের মুখে পড়ে, নিশান উড়িয়ে তিন ভাগ হয়ে গেল। তারপর সমুদ্রে  উঠল বাংলার সুরÑ

শুকতারা আর চাঁদ, সূরয,

দিক্পবনÑ সাথী!

এপার ওপার, সাত সাগরে,

বাংলার বেসাতি!

মেঘমালার শঙ্খ বাজে,

ডঙ্কা বাউল জল!

সাত ডিঙার পালে হাসে

লক্ষ্মীর আঁচল!

সাত পাথারের তীরে তীরে

ঘুমের মায়াপুর,

জাগর গানের ডাক দিয়ে যায়

সপ্তডিঙার সুর!

’আশীর্বাদ ও আশীর্বাণী’ পর্যায়ে রয়েছে, প্রভাতী তারা, শঙ্খ, বাঁশীর সুর, উৎসবের শুরু, প’েথ, উৎসব, কিশোরদের মন।

দক্ষিণারঞ্জন খুব অল্প সংখ্যক কবিতা লিখেছেন। এসব কবিতাতে রূপকথার সুরটি স্পষ্ট ধরা পডে। কবিতাগুলি যথাক্রমে Ñ খোকার দেশ, সবুজ কিশোর, জন্মদিন, আমরা, অচীনপথে, চিঠি।

’অচীন পথে’ কবিতায় কবি শিশু, কিশোর ও তরুণকে আহ্বান জানিয়েছেন রূপকথার জগতে যাত্রার।

শিশুকে আহ্বান জানাচ্ছেন,

অচীন দেশে যাচ্ছি মোরা

যাচ্ছি অচিন পথে

বিশ্ব-শিশুর দল,

যথায় হেসে ঢেউ দিয়েছে

সোনালী পর্বতে

রূপ সাগরের জল!

তরুণকে আহ্বান জানাচ্ছেন,

অচিন দেশে যাচ্ছি চলে

অচিন সুদূর পথে

বিশ্ব তরুণ দল!

চিল্কা হ্রদের পার দিয়ে আর

উল্কারি জগতে

উৎসাহে উচ্ছল

দক্ষিণারঞ্জনের গল্পের সংখ্যা তিনটি ’ঙ’, ’দরদী’, ’তুলির লেখা’। ‘ঙ’ গল্পে মলিনার মাথায় বড় একটি খোঁপা ছিল এবং সে কুঁজো হয়ে বসতো বলে অন্যান্য ছাত্রীরা তাকে ’ঙ’ বলে ডাকতো। এর মলিনা চরিত্র অত্যন্ত দরদ ও সহানুভূতির সঙ্গে চিত্রায়িত করেছেন। সে দরিদ্র হলেও আদর্শবাদের দৃৃষ্টান্তের মাধ্যমে শিক্ষামূলক উপদেশের চরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছে। তাঁর গল্গগুলিতেও ‘চারু ও হারু’ সুলভ ভাবালুতা লক্ষ্যণীয়।

দক্ষিণারঞ্জনের নাটিকার সংখ্যা তিনটি।  নামগুলি যথাক্রমে -’পরবি’, ’রামধনু’, ’শেষের সুর’। ’পরবি’ নাটিকায় রূপকথার জগতে যাত্রার পদধ্বনি শুনতে পাওয়া যায়।

’কিশোর-কিশোরী পর্বে,

কোথায়, বল                              কোন্ সুদূরে

কোথায় যেতে হবে?

কোন দেশেরি                             অমর পুরে?

উতল কলরবে।

মোদের মনের                            গানের আলোর

অঝোর কণা লভি’

সেথা কি, ভাই                            জাগ্বে অর্ফু

মহা মহোৎসব-ই !!

দক্ষিণারঞ্জন মিত্র যেমন মাতৃøেহের আচ্ছাদনে খেকে রূপকথার একটি বর্ণাঢ্য নতুন ভুবন সৃষ্টি করেছেন, তেমনি তিনি নিজেও এর সঙ্গে অবিভাজ্য যুক্ত থেকে রূপকথাতুল্য প্রিয় চরিত্রে পরিণত হয়েছেন। আবহমান বাংলার শিশুদের নিকট প্রিয় মানুষদের তিনি অন্যতম। দক্ষিণারঞ্জন লৌকিক ঐতিহ্যকে প্রধানত অবলম্বন করেছিলেন কিন্তু উপেন্দ্রকিশোরের অনুরূপ সরাসরি হিন্দু ধর্মের রামায়ণ মহাভারত পুরাণের দ্বারস্থ হননি। তিনি পুনর্জাগরণ প্রক্রিয়ার বাইরে ছিলেন না লোককাহিনী অবলম্বন করে নিজের মত করে ছিলেন। তার হাতে ট্রাডিশনাল রূপকথা ও লোককাহিনীগুলো পুনর্জন্মপ্রাপ্ত হয়েছে।

রূপকথার গল্প বহুযুগ থেকে এই দেশের লোকের মুখে মুখে কথিত হয়ে এসেছে। যখন লেখার কোন ব্যবস্থা ছিল না তখন মানুষ মুখে মুখেই এসব গল্প বলতে ভালবাসতো, আর এসব রাশ ছাড়া ’কল্পনার ঘোড়া’ বলতে যেমন সহজ, লিখতে গেলে ততটাই কঠিন। লাগাম ছাড়া এই সব কল্পনা লেখার বন্ধনে এলে ভাব আড়ষ্ট হয়ে যায়, বলার ভঙ্গীর রস ততটা থাকে না তখন কেমন লিখেছেন এমন প্রশ্নের চাইতে কে লিখেছেন সেই প্রশ্নটাই বড় হয়ে দেখা দেয়।

আবার, একই ধরণের রূপকথা বিভিন্ন দেশের আবহাওয়ায় বিভিন্ন রূপ নেয়। দক্ষিণারঞ্জন রচনা সমগ্রের ভূমিকা লেখক গজেন্দ্রকুমার মিত্র তাঁর রূপকথার সপক্ষে বলেন,

আমাদের দেশের প্রচলিত রূপকথা আমাদের দেশের মাটিতে জলহাওয়ায় গড়ে উঠেছে। … দক্ষিণারঞ্জন যে রূপকথা উপকথা এবং গল্পকথা বেছে নিয়েছেন তার কল্পনার গঠনে বৈচিত্র্যে বাঙালীর ঘরের ঠাকুমা, দিদিমার গল্প বলা শুধু নয়, গল্প ভাবারও জাদু লুকিয়ে আছে। সেদিক দিয়ে দক্ষিণারঞ্জনের অনেকটা সুবিধা হয়েছিল।

শুধু কাঠখড়ে নয়, মাটির প্রলেপের গ্রীক মূর্তি বা জাপানী মূর্তির ধাঁচ নয়Ñ’হিন্দু পুরাণের নিত্য ধ্যানের দেবীর মূর্তির যে আদল তৈরী হয়েই ছিল দক্ষিণারঞ্জন শ্রেষ্ঠ শিল্পীর সূক্ষ্ম তুলির আঁচরে ও বিচিত্রতম রঙ নিয়ে সুনিপুণ হাতে তাকে সাজিয়েছেন, ডাকের সাজের সঙ্গে শালুক ফুল, কলার পেটো, জবার পাঁপড়ি দিয়ে, গলায় পদ্মের মালা ঝুলিয়ে সে প্রতিমাকে এক সময়ে কেবল রূপ নয়, প্রাণেরও সঞ্চার করেছেন সেইখানে তার অদ্বিতীয়ত্ব, সেইখানেই তার ইন্দ্রজাল।১১

অবনীন্দ্রনাথের ’ক্ষীরের পুতুল’ (১৮৯৬) দক্ষিণারঞ্জনের প্রথম রূপকথা-সংকলন ’ঠাকুুুরমার ঝুলি’(১৯০৬)র দশ বছর আগে প্রকাশিত হয়। ’ক্ষীরের পুতুল’ এ আধুনিকতার গন্ধ থাকলেও ’পুরাতনপন্থী’ দক্ষিণারঞ্জনের রচনার উৎকর্ষকে স্বীকার না করে পারা যায় না। ’ক্ষীরের পুতুল’-এর ব্রতকথাঘেঁষা ভাষার ব্যবহার ক্ষেত্র সীমাবদ্ধ, গ্রন্থখানি তাই সব পাঠকের কাছে উপাদেয় নাও হতে পারে। কিন্তু ঠাকুরমার ঝুলির প্রাণরস ব্যাপকতর ক্ষেত্র থেকে আহরিত এবং এজন্য ব্যাপকতরোভাবেই বোধগম্য, যদিও রূপে তা সাধু ভাষা।খ৭

দক্ষিণারঞ্জন রূপকথা লেখক হিসেবে সমধিক প্রসিদ্ধ। বাঙালি ঐতিহ্যের অনুসন্ধানে তিনি রূপকথাকে শিশুসাহিতের ভান্ডার সমৃদ্ধ করেছেন এবং হিন্দু ঐতিহ্যের সঙ্গে শিশুকে যুক্ত রেখেছেন।

 

পাদটীকাঃ

১। দক্ষিণারঞ্জন রচনাসমগ্র-২, বারিদবরণ ঘোষ, পৃ-চ

২। আন্ডারসেন (১৮০৫-১৮৭৫) ডেনমার্কের ওডেন্স শহরে জন্ম, গরিব মুচির ছেলে। তাঁর রূপকথার বিশেষত্ব-তাঁর নিজের         মনগড়া মৌলিক গল্প।

৩। গ্রীম ভাই(জার্মান)Ñসংকলনমূলক রূপকথা রচয়িতা।

৪। দক্ষিণারঞ্জন রচনাসমগ্র-১, ঠাকুরমা’র ঝুলি প্রসঙ্গে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বোলপুর, ভাদ্র, ২০ ভাদ্র, ১৩১৪।

৫। ঐ

৬। লোককথা

৭। অবনীন্দ্রনাথ

৮। ‘শিশু’ (১৩১৯) সম্পাদক-বরদাকান্ত মজুমদার, ৬০ নং মির্জাপুর স্ট্রীট, কলিকাতা।

৯। ’তোষিণী’-(বৃটিশ আমলের সবচেয়ে দীর্ঘায়ু শিশুমাসিক পত্রিকা), সম্পাদক অনুকুলচন্দ্র শাস্ত্রী, শান্তি প্রেস, ঢাকা।               ১৯১০, এপ্রিল। ’তোষিণী’র জন্মের এক বছর পরই বাংলার খন্ডিত জীবনের অবসান ঘটে, কিন্তু বঙ্গভঙ্গের        অবসানে তার গতি ছিল অদম্য এবং প্রথম মহাযুদ্ধোত্তর সে সন্ত্রাসবাদের পথ বেছে নেয়।

১০। ‘দাদামশায়ের থলে’র ভূমিকা।

১১। দক্ষিণারঞ্জন রচনাসমগ্র-১, ভূমিকা লেখক গজেন্দ্রকুমার মিত্র।

 

 

’কন্যকা কুন্তী’,শিশুদের জন্য লেখা নয় বরং শিশুদের উদ্দেশ্যে লেখা। শুরুতেই ভারত মাতার গুণগান এবং পুরো রচনাতেই হিন্দু রাজাধিশ্বর শূরসেন, তার কন্যা এবং তার বন্ধু কুন্তীভোজের জয়গানে মুখরিত। রচনার শেষে পাঁচটি কবিতা রয়েছে যাতে শূরসেন কন্যার মহিমা এবং গুণকীর্তন বর্ণিত হয়েছে। কবিতাবলীর ভাষা সহজ, সরল না হওয়াতে শিশুর পক্ষে এটির রসগ্রহণ কষ্টদায়ক।

একটি চিঠি’, পর্যায়ে রয়েছেÑ

’তোমাদের বয়সে আমি’,

বিজন কুমার গঙ্গোপাধ্যায়কে লেখা দক্ষিণারঞ্জনের একটি চিঠি। চিঠিতে তার দুরন্তপনার উদাহরণ হিসেবে বন্ধুদের সহযোগে লিচু চুরির বর্ণনা ছডিয়ে আছে। চিঠিতে তার লিচু চুরির বুদ্ধি ও সাহস প্রশংসিত হয়েছে কিন্তু নজরুলের ’লিচু চোর’ কবিতায় লিচু চুরি করেছেন একা এবং এর প্রতিফল সন্তোষজনক ছিলনা বরং বাস্তবের দ্বন্দ্ব-সংঘাতের মধ্য দিয়ে এর পরিসমাপ্তি ঘটেছে।

সবগুলিই রূপকথা কাহিনীমূলক। প্রতিটি কাহিনীর প্রারম্ভে সংক্ষিপ্তাকারে  কবিতা আকারে কাহিনীর সারসংক্ষেপ বর্ণিত হয়েছে। যেমন-

’একহি কুমার ছিল নামেতে মদন।

বারো হি বতসর থাকে পাথর ভবন।

থাকিতে রে তিন দিন বিধি হ’ল বাম।

পাতাল পাথও বেঙ্গে’ বাহির হ’ল চাঁদ।

চাঁদ না বাঁধন মানে, কফালের খেল॥

শিকারে গেল রে কুমার বুকে দিয়া শেল।

 

শিকার না পাইল কুমার, পাইল স্বপন।

’মধুমালা’, ’মধুমালা’ করিল জপন!

চৌদ্দ ডিঙ্গা মধুকর, কুমার সাজাইয়া নিল।

সে হি যে বিধির পাখী, বিধি উড়াইয়া দিল!!

*             *             *             *             *             *             *                 *             *     *      *     *      *

এতেক দুখের পর পূর্ণ ষোল কলা

স্বপ্নেতে স্বরগ এনে’ দিল মধুমালাÑ

আহা,Ñ উজানীনগরে!’

শিশুসাহিত্যে দক্ষিণারঞ্জনের আর এক অনবদ্য সৃষ্টি ’দাদামশায়ের থলে’। এটি হাস্যরসের রূপকথা বা লোককথাধর্মী কাহিনী সঞ্চয়ন। বইটি প্রকাশিত হয় ১৯২৪ খ্রীষ্টাব্দের দোলপূর্ণিমায়।

কালীপ্রসন্নের সহযোগে আর একখানি চমৎকার বই তিনি রচনা করেছিলেন ১৯০৯ সালে, সেটি ‘সচিত্র সরল চ-ী’ ১৯০৯ সালে। শিশুদের জন্য মার্ক-েয় চন্ডীকে গদ্যে পদ্যে পরিবেশন করা হয়েছিল এবং এতে প্রচুর রঙীন ছবিও ছিল। রূপকথার সম্রাট দক্ষিণারঞ্জন বাংলার লোকসাহিত্য পুনরুদ্ধারের জন্য আজীবন যে সাধনা করে গেছেন তার জন্য বাংলা সাহিত্য জগতে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তিনি ছিলেন একাধারে গবেষক, ঘীতিকার, কবি, রস-সাহিত্যিক ও প্রবন্ধকার ও শিশুসাহিত্যিক।

১৩৫৭ বঙ্গাব্দে বঙ্গীয় শিশু সাহিত্য পরিষদ তাঁকে শ্রেষ্ঠ শিশুসাহিত্যিক রূপে ’ভুবনেশ্বরী’ পদক দিয়ে সম্মানিত করেন। ১৩৫৯ বঙ্গাব্দে ’বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ’ কতৃৃর্ৃৃক তিনি ’কথা সাহিত্য সম্রাট’ আখ্যা দ্বারা অভিনন্দিত হন।

মহারাজ মনীন্দ্রচন্দ্র নন্দীর পৃষ্টপোষকতায় এং বরদাকান্ত মজুমদারের সúাদনায় ১৯১৩ সালে ‘শিশু’ নামে আরেকটি উচচাংগের পত্রিকা প্রকাশিত হয়। এই পত্রিকা প্রকাশ প্রসঙ্গে সúাদকের মতামত ঃ ‘শিশু’ শিশুদের খেলার সাথী- শিক্ষার সহচর। শিশুদিগকে আমোদের সহিত শিক্ষাদান করাই শিশুর উদ্দেশ্য।”৪

দক্ষিণারঞ্জন মিত্রের একটি কবিতা দিয়েই পত্রিকাটির সূচনা হয়েছিল ঃ

শিশু

ওগো

আমরা এসেছি আজ

সোনার স্বপন দুটি ভাইভোন

সোনার দেশের বুকে

হাসিয়া এসেছি মুখে।২৩

সমালোচনা Ñ দক্ষিণারঞ্জন রচনাসমগ্রের ভুমিকা লেখক গজেন্দ্রকুমার মিত্র তার রচনা সúর্কে বলেনÑ

দক্ষিণারঞ্জনের এই রচনাগুলির মতোÑ শিশুদের মনের সúদ আর কিছু হতে পারে না, এর থেকে বেশী কোন লোভনীয় ব¯তু তাদের হাতে দেওয়া যায় না।

 

বারিদবরণ ঘোষের মতে-

আধ্যাত্মিক কিশোরচিত্তের উপযোগী বিচিত্রবিদ্যার চর্চার দ্বারা মনের সার্বিক বিকাশ দক্ষিনারঞ্জনের অভিপ্রেত ছিল। সে কারণেই বরদাকাšত মজুমদার সúাদিত কিশোর পত্রিকা   ‘শিশু’র প্রথম বর্ষ (১৩১৯) প্রথম সংখ্যার সূচনায় দক্ষিণারঞ্জন ’শিশু’ নাম্নী কবিতায় লিখেছিলেন Ñ

ওগো

আমরা এসেছি আজ

শিশুর প্রাণ আমরা এসেছি আজ

সোনার স্বপন দুটি ভাই বোন্

সোনার দেশের বুকে

হাসিয়া এসেছি সুখে।

বস্তুতঃই সোনার দেশের বুকে সোনার স্বপন রচনাই তাঁর সাহিত্যচর্চার মর্মমূলে প্রোথিত ছিল। তাঁর সময়ে এদেশে শিশু-সাহিত্যিকের পুরো মর্যাদা ছিল না। –           –       –      –       –     দক্ষিনারঞ্জনও সংকলন-সংস্কার-সৃষ্টি মিলিয়ে প্রথম শ্রেণীর রসসাহিত্যিক রস-সাহিত্যের অমরাবতীতে তাঁর স্থান চিরনির্দিষ্ট।

 

”আমোদের সাথে শিক্ষাদান’ তখনকার শিশুসাহিত্যিকদের উদ্দেশ্য ও অভিপ্রায় হয়ে উঠেছিল। তিনি আনন্দকে প্রথম সারিতে রেখেছিলেন কিন্তু এই সাহিত্য বা¯তবতার সাথে জীবনঘনিষ্ঠ ছিল না।

 

দক্ষিণারঞ্জন ’রূপকথা সাহিত্য সম্রাট’ হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। রূপকথা মানেই ছেলেভুলানো ব্যাপার-যেখানে অসম্ভব ব্যাপার সম্ভব হয়ে যায়। যাদুর কাঠির ছোঁয়ায় রাজপুত্র বা রাজকন্যে প্রাণ পায় অথবা রাজপুত্র রাজকন্যেকে পাবার জন্য নিমিষেই সাত সমুদ্র পাড়ি দিতে পারে।

দক্ষিনারঞ্জনের সময়ে যাতায়াতের অসুবিধার যুগে শিশুরা এমনই কল্পনার ফানুষ উড়াতেই পারতো কিন্তু আধুনিক যান্ত্রিক সভ্যতার যুগে শিশুরা উড়েই ষেসব জায়গায় যেতে পারে আর উড়ে গিয়ে  এর বাস্তব সত্যাসত্য দেখতে না পেরে শিশুর মন ব্যথিত হয়। অতএব দক্ষিণারঞ্জন সময়ের দাবী পূরণ করেছিলেন।

রবীন্দ্রনাথ একাধারে আধুনিক দিদিমাদের জন্য স্কুল খুলবার পরামর্শ দিয়েছেন

এক্ষনে আমার প্রস্তাব এই যে, বাংলাদেশের আধুনিক দিদিমাদের জন্য অবিলম্বে একটি স্কুল খোলা হউক এবং দক্ষিণাবাবুর এই বইখানি অবলম্বন করিয়া শিশু শয়নরাজ্যে পুনর্ব্বার তাঁহারা নিজেদের গৌরবের স্থান অধিকার করিয়া বিরাজ করিতে থাকুন।

 

অতএব পাঠ্যবই হিসেরে দক্ষিণারঞ্জনের রচনার মূল্যের চাইতে শিশুদের বিনোদনের সঙ্গী হিসেবে দেখাটাই অধিকতর যুক্তিযুক্ত।

দক্ষিণারঞ্জনের রচনায় শুধু হিন্দু দেবদেবীর গুণগান এবং মহিমাই কীর্তিত হয়েছে  অন্য কোন ধর্মই সেখানে স্থান পায়নি।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের শিশুসাহিত্য

(১৮৮২-১৯২২)

 

কলকাতার নিকটবর্তী নিমতা গ্রামে ইংরেজী ১৮৮২ (বাংলা ১২৮৮, ৩০’ মাঘ) সালে মাতুলালয়ে সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের জন্ম। তাঁর পৈত্রিক নিবাস বর্ধমান জেলার চুপি গ্রামে। পিতামহ অক্ষয় কুমার দত্ত ছিলেন ’তত্ত্ববোধিণী পত্রিকা’র সম্পাদক এবং পিতা রজনীনাথ দত্ত কলকাতার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী (১৯০১) পাস করেন। বি.এ, পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে পিতার ব্যবসার কাজে মনোনিবেশ করেন। পরে ব্যবসা পরিত্যাগ করে কাব্যসাধনায় আত্মনিয়োগ করেন। ইংরেজী ফরাসি ভাষায় অনেক উৎকৃষ্ট কবিতা বঙ্গানুবাদ করে বাংলা সাহিত্যের সমৃদ্ধি সাধন করেছেন।

রসিক পুরুষ সত্যেন্দ্রনাথ মৌখিক কথাবার্তায় যেমন (চিঠিপত্র পড়ে জানা যায়) পত্রাদিতেও তেমনি ছড়া কাটতে ভালবাসতেন। যেমন পত্রের শেষে,

আমার সম্মান নিত্য

হইতে বিশ্বাসী ভৃৃত্য

তাঁর এই অভ্যাস পোপ-এর জীবনের একটি ঘটনা স্মরণ করিয়ে দেয়। ইংরেজ কবি পোপ কবিতা রচনার অভ্যাসের জন্য পিতার কাছে প্রহার খেয়েও বলেছিলেন,

চধঢ়ধ চধঢ়ধ ঢ়রঃু’ং ংধশব’

ও ংযধষষ হবাবৎ াবৎংবং সধশব

বিশ শতকের প্রথম দশকে বাংলার অধিকাংশ কবি রবি প্রদক্ষিণ করেই জ্যোতিঃ বিকিরণ করছিলেন। রবীন্দ্রযুগের এবং রবীন্দ্রভক্ত কবি হয়েও নানা গুণে তিনি স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের অরূপ আধ্যাত্মিক লোক থেকে সরে এসে তিনি জীবনধর্মী সাহিত্য রচনা করলেন। স্বদেশী আন্দোলনের (১৯০৫-১৯১১) উত্তাপ তাঁর কবিতায় সঞ্চারিত হল। এই স্বাতন্ত্র্য ধরা পড়েছে তাঁর কাব্যের বিষয়বস্তুতে, কবিতার ছন্দ নির্মাণের কৌশলে এবং শব্দ ও ভাষা ব্যবহারের কারুকার্যে। কল্পনা এবং হৃদয়াবেগকে পরিহার করে জ্ঞানচর্চাকে কবিত্ব প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। দেশাত্মবোধ, শক্তির সাধনা ও মানবতার বন্দনা তাঁর কবিতার ভাববস্তু। সমাজের তুচ্ছ মানুষকে নিয়ে তিনি কবিতা রচনা করেছেন।

প্রকাশিত  গ্রন্থাবলী ঃ সবিতা (১৯০০), সন্ধিক্ষণ (১৯০৫), বেণু ও বীণা (১৯০৬), হোম শিখা (১৯০৭), তীর্থ-সলিল (১৯০৮), তীর্থ-রেণু (১৯১০), মণি-মঞ্জুষা (১৯১৫), ফুলের ফসল (১৯১১), কুহু ও কেকা (১৯১২), তুলির লিখন (১৯১৪) অভ্র আবীর (১৯১৭), বেলা শেষের গান (১৯২৩), সত্যেন্দ্রনাথের শিশু-কবিতা (১৩৫২,১৯৫৪)।

এইসব কাব্যগ্রন্থে তাঁর শিশু-রচনাসমুহ ছড়িয়ে আছে। একমাত্র ‘সত্যেন্দ্রনাথের শিশু-কবিতা’ শিশু-কবিতার সঙ্কলন। সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত কবিতা লিখেছেন নানা বিষয় নিয়ে। শিশুদের জন্য লিখেছেন ছড়া, কবিতা, ধাঁধা। সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত শিশুসাহিত্যিক নন, কিন্তু তাঁর বেশ কিছু কবিতায় শিশুপ্রসঙ্গ গুরুত্ব পেয়েছে। বিষয়-বৈচিত্র্যের দিক থেকে সত্যেন্দ্রনাথের শিশু-কবিতার শ্রেণীকরণ,

বাৎসল্য রসের কবিতা ঃ ’শিশুর স্বপ্নাশ্রু’, ‘অন্ধ শিশু’, ’শিশুর স্বপ্নাশ্রয়’, শিশুর আশ্রয় (বেণু ও বীণা) ’শিশুহীন পুরী,’ (বিদায় আরতি), ’সন্তানক’(অভ্র-আবীর), ’নতুন মানুষ’, ‘প্রথম হাসি’ (কুহু ও কেকা) ‘বাজশ্রবা’ ’কয়াধূ’, ’গিরিরাণী’ (অনার্য্যা) ‘সুশ্বেতা’, অরূন্ধুতি, ভীমজননী (বেলা শেষের গান), নেই ঘরের ঘুমপাড়ানী, প্রথমগালি, মৌলিকগালি (সত্যেন্দ্রনাথের শিশু-কবিতা)।

কৌতূহলোদ্দীপক ঃ রং মশাল ইত্যাদি।

ছড়ার সুরের ঝংকার ঃ ’পাল্কীর গান’ (কুহু ও কেকা), ’দূরের পাল্লা’, ’জ্যৈষ্ঠী মধু’ (বিদায় আরতি), ’শিল্’ (সত্যেন্দ্রনাথের শিশু-কবিতা) ইত্যাদি।

ধ্বনিঝংকারমূলক কবিতা ঃ ঝর্ণা ইত্যাদি।

চিত্র সৌন্দর্য ঃ পাল্কীর গান (কুহু ও কেকা), দূরের পাল্লা (বিদায়-আরতি) ইত্যাদি।

মনোরঞ্জনমূলক কবিতা ঃ ইলিশ মাছ, তাতারসির গান, রেলগাড়ির গান (সত্যেন্দ্রনাথের শিশু-কবিতা) ইত্যাদি।

আমোদমূলক ঃ গলার তোয়াজ ইত্যাদি।

প্রকৃতি বিষয়ক তথা শিক্ষামূলক ঃ শীতের ফুল, বসন্তের ফুল, শরতের ফুল (সত্যেন্দ্রনাথের শিশু-কবিতা) এ শিশুরা প্রকৃতির পাঠ পেয়েছে। শিশু শিক্ষার উপাদানও এতে রয়েছে।

লোভের বস্তু নিয়ে লেখা ঃ ইলিশ মাছ, তাতারসির গান (সত্যেন্দ্রনাথের শিশু-কবিতা ) ইত্যাদি।

ছেলে ভুলানো ছড়া ঃ রেলগাড়ির গান (সত্যেন্দ্রনাথের শিশু-কবিতা) ইত্যাদি।

মানবতার কবিতা বা সমদৃষ্টির পরিচয়-সাম্যসাম, জাতির পাঁতি, মেথর, শুদ্র, বিশ্বকর্মা ইত্যাদি।

কিশোর বন্দনা ঃ রংমশাল, ধঁাঁধা, ’পদ্মকোষের বজ্রমণি’, ধ্রুব সুমঙ্গল, ছেলের দল’(সত্যেন্দ্রনাথের শিশু-কবিতা)।

খাদ্যদ্রব্যের বর্ণনা ঃ ’পেটুকের বর্ণ-পরিচয়’ (সত্যেন্দ্রনাথের শিশু-কবিতা) ইত্যাদি।

আদর্শবাদী ঃ লাজের কাহিনী ইত্যাদি।

প্রাচীন যুগের  ঐতিহ্যঃ তাতারসির গান (সত্যেন্দ্রনাথের শিশু-কবিতা)

পল্লীর চিত্রÑ পাল্কীর গান, দুরের পাল্লা।

তাঁর প্রকাশিত প্রথম কাব্য পুস্তিকা ’সবিতা’ (১৯০০)। গ্রন্থের শেষ কবিতা ’সাম্যসাম’ বিশ শতকের আগমন বার্তা ঘোষণা করে। আধুনিক বাংলা কবিতায় প্রথম সাম্যের মন্ত্র সোচ্চারভাবে ঘোষিত হয়,

মানি না গির্জা, মঠ মন্দির, কলকি পেগম্বর,

দেবতা মোদের সাম্য দেবতা অন্তরে তার ঘর;

ইংরেজ কবি বার্ণস-এর প্রভাবে রচিত সত্যেন দত্তের কবিতাটি নিপীড়িতের জীবন-গাথা। সাম্যবাদী ও সর্বহারা সমষ্টির পূর্বসূরী ’সাম্য-সাম’ বাংলায় প্রথম গণতান্ত্রিক ও সাম্যবাদী চেতনা রঞ্জিত কবিতা।

১৯০৫ খ্রীস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে স্বদেশী আন্দোলন পর্বে তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ’সন্ধিক্ষণে’ (১৯০৫) সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের সমকালীন সমাজ ও রাজনৈতিক সচেতনার পরিচয় বহন করে। পরবর্তী কাব্যগ্রন্থ ’বেণু ও বীণাতে’ও (১৯০৬) সমসাময়িক ঘটনাবলী আবেগের সঞ্চার করেছে। এ কাব্যের বিভিন্ন কবিতায় স্বদেশের প্রতি, সমাজের নীচুতলার মানুষের প্রতি এবং বারাঙ্গণার প্রতি কবির সহানুভূতি প্রকাশ পেয়েছে। সংস্কৃত ভাষার বন্ধনজাল থেকে বাংলাভাষাকে মুক্তি দেবার ক্ষেত্রেও তিনি মৌলিকতার স্বাক্ষর রেখেছেন। আলোচ্য কাব্যগ্রন্থ থেকেই সরল ভাষা ব্যবহারের প্রতি তাঁর প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। পরবর্তীকালে ’সবুজ পত্র’ (১৩২১) প্রতিষ্ঠার কালে ব্যাপকভাবে বাংলা ভাষার মুক্তি আন্দোলনে তিনি অগ্রণী ভুমিকা পালন করেছিলেন। মোহিতলাল মজুমদার সত্যেন্দ্রকাব্যের দোষগুণ বিচার করে মন্তব্য করেছেন,

বাংলা সাহিত্যে সত্যেন্দ্রনাথের সর্বশ্রেষ্ঠ দান, ভাষার বাক্পদ্ধুতির নূতন করিয়া প্রতিষ্ঠা ও তাহার সমৃদ্ধি সাধন।১ রবীন্দ্রনাথের ’সংলগ্ন’ ও ’অন্তর্গত’ হয়েও সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের সাধনা বিশেষত তার আঙ্গিক চেতনা বাংলা কবিতাতে রবীন্দ্রনাথের সর্বগ্রাসী প্রভাব থেকে মুক্তি দিতে সহায়তা করেছে। সে কারণে শুধুমাত্র সমকালীন কবিদের ওপরে নয়। পরবর্তী কালের অতি আধুনিক কবিদেরও অগ্রগামী কবিদের কবিতায়ও তার প্রভাব লক্ষ্যণীয়। এমনকি অনেক বিরুদ্ধ সমালোচকের উপরও তিনি প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছিলেন। প্রথম মহাযুদ্ধোত্তর যুগের দ্বন্দ্বচঞ্চল মানসিকতা দ্বারা সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত আচ্ছন্ন হননি। সমকাল ও সমাজ সচেতনতার স্বাক্ষর তাঁর ’সাম্যসাম’,’শুদ্র’, ’মেথর’, ’জাতির পাঁতি’ এবং

সমকালীন রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলন সম্পর্কিত বিবিধ কবিতাবলী। তাঁর বিশিষ্টতা হচ্ছে বাস্তববাদিতা। শিশুসাহিত্যের ক্ষেত্রে তাঁর অবদান নিতান্তই সামান্য। এই সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রেও তিনি তাঁর স্বাতন্ত্র্যের পরিচয় দিয়েছেন। প্রকৃতির অফুরন্ত দানের মধ্যে অভাব কেবল একজন শিশুর উপস্থিতি। কবির উপলব্ধি হল এ পরিবেশে কেবল শিশুর উপস্থিতিই প্রকৃতিকে পূর্ণতর করে তুলতে পারত। ‘শিশুহীন পুরী’(বেণু ও বীণা) তে তিনি বলেন,

বনের কুসুমে আদর করিতে

নাহি কেহ নাহি শিশুর হাসি;

বনে ফুলে ফুলে ছায়া তরুতলে

শুধু বিফলতা বেড়ায় ভাসি।

বিজন এ পুরি শিশুর অভাবে

কে যেন জীবন লয়েছে কাড়ি

হরষ বিষাদ নাহি যেন আর

পুলক দেবতা গিয়াছে ছাড়ি।

কেবল শিশু নেই বলে শিশুর হাসি নেই বলে সর্বত্র ব্যর্থতা বিরাজমান, কোনো জীবন নেই, আনন্দ ছেড়ে চলে গেছে। কবির নিকট শিশু জীবনের ও আনন্দের সমার্থক, সুতরাং শিশুর অনুপস্থিতি বিপরীত পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে।

শিশুর ‘প্রথম হাসির ধ্বনি’ কবির কাছে বোধহয় যেন ‘ফুলঝুরিতে ফুল্কি হাসির রাশি’Ñ যেন ‘রুপোর ঘুঙুর জড়িয়ে হাতে বাজায় কে খঞ্জনী’।

’প্রকৃতিতে শিশু মহাবাণী বয়ে আনে তার মধ্যে কোন কৃত্রিমতা বা ভেদাভেদের জ্ঞান নেই। শিশুর সরল সৌন্দর্য         হিংসা বিক্ষুব্ধ পৃথিবীতে শান্তির বার্তা নিয়ে আসে’২

বাংলা কাব্যে সত্যেন্দ্রনাথ দত্তই একমাত্র অনুবাদ-ক্ষেত্রে যথার্থ সিদ্ধহস্তের স্বাক্ষর রেখেছেন। বাংলাসাহিত্যে বৈচিত্র্যের স্বাদ আনার উদ্দেশ্যে এবং দেশ-বিদেশের কবিতার ভাব-প্রবাহের সঙ্গে বাঙ্গালির পরিচয় করাতে তিনি অনুবাদে হাত দিয়েছিলেন। তিনি মূলের রস গ্রহণ করেছিলেন-এ কারণে এগুলো তার মৌলিক সৃষ্টি। তিনি অনুবাদকে রসের সামগ্রী করেছেন-যা মানুষের কল্পনাকে জাগ্রত করে, মানুষের মনে সুন্দরের সৃষ্টি করে।

’তীর্থ-সলিল’ (১৯০৮), ’তীর্থ-রেণু’, (১৯১০) ও ’মণি-মঞ্জুষা’, (১৯১৫) বিভিন্ন দেশের ও বিভিন্ন যুগের বিশিষ্ট কবিগোষ্ঠির কাব্যসম্ভারের পরিচ্ছন্ন ও সুললিত বঙ্গানুবাদ। ’তীর্থ-সলিলে’ (জাপানী) ’ঘুম-পাড়ানি’ ’দু-দিনের শিশু’, ’মাউরি জাতির ঘুম-পাড়ানি’ (অষ্ট্রেলিয়া), ’শিশু’, ’শিশু-কন্দর্পের শাস্তি’ প্রভৃতি শিশু কবিতা রয়েছে। ’মাউরি জাতির ঘুম পাড়ানি’র দৃষ্টান্ত,

খোকা আমার, খোকা আমার, ’তুল তুলসী’র পাতা!

বেনামূলের গুচ্ছ আমায় রাখ্ রে বুকে মাথা!

মৃগনাভির কৌটা আমার খোকা ঘুম যায়,

গুগ্গুলু ধুপ-ধুনার আবেশ খোকার চোখে আয়!

তাঁর অনুবাদ গ্রন্থ ’র্তীর্থ রেণু’(১৯১০) পড়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেন,

তোমার এই অনুবাদগুলি যেন জন্মান্তরপ্রাপ্তিÑআত্মা এক দেহ হইতে অন্য দেহে সঞ্চারিত হইয়াছেÑ       ইহা শিল্পকার্য নহে, ইহা সৃষ্টিকার্য।৩

আলোচ্য কাব্যগ্রন্থের শিশু কবিতায় ভাষার রীতি বা ইডিয়মকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন।

মানৎ মেনে আপদ বালাই কর্ব্বো আমি ক্ষয়’

(’ঘুম পাড়ানী গান’, তীর্থ রেণু )

কে বেড়াবে হামা দিয়ে

কে বেড়াবে দাওয়ায়,

কে খেল্বে ধুলো নিয়ে

ছাঁচতলাটির ছাওয়ায়!

(ঘুম-ভাঙা’, তীর্থ রেণু)।

’বঙ্গবাসী’ পত্রিকা তার অনুবাদ সম্বন্ধে বলেন,

একাধারে জ্ঞান, বিদ্যা, গবেষণা, ভাব, সুষমা, প্রভৃতির পূর্ন পরিচয়।৪

’বেণু ও বীণা’, ’হোম শিখা’, ’ফুলের ফসল’, ’কুহু ও কেকা’, ’তুুলির লিখন’, ’অভ্র-আবীর’ অনুবাদ ক্যাব্যগ্রন্থ। ’উত্তম অধম’, ’নেই ঘরের ঘুমপাড়ানী’ তাঁর অনুবাদমূলক বাৎসল্য রসের কবিতা। বাৎসল্য রসের কবিতা শিশুেেক উদ্দেশ্য করে লেখা। এখানে শিশুর শেখার কোন বিষয় থাকে না।

সত্যেন্দ্রনাথ যুগসচেতন কবি ছিলেন। মানুষের সূখ-দুঃখ, হাসিকান্নার জগত তাঁকে আকৃষ্ট করেছে প্রবলভাবে। সমসাময়িক কালের ঘটনাবলী তাঁর কবিতায় বাণীরূপ পেয়েছে। কবিতায় অশেষের ইঙ্গিতও ছিল। একদিকে তিনি দেশহিতের বানী প্রচার করেছেন, অতীত ইতিহাসের পাতা উন্মোচন করে আমাদের সামনে তুলে ধরেছেনÑঅন্যদিকে চেনা জগতের মধ্যে ব্যঞ্জনা ফুটিয়েছেন, অকিঞ্চিতকরের মধ্যে অসামান্য মহিমা আবিষ্কার করেছেন। মনন এবং আবেগ উভয়কেই স্বীকৃতি দিয়েছেন।

বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কাব্যশক্তির মুখ্য বিকাশ লক্ষ্য করা যায়। তাঁর কাব্যে মৌলিক প্রতিভার স্ফূরণ ঘটে, ’ফুলের ফসল’ (১৯১১), ’কুহু ও কেকা’ (১৯১২), ’তুলির লিখন’ (১৯১৪) ঐ সময়ে বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে নতুন সম্ভাবনাকে জাগ্রত করে।

’কুহু ও কেকা’ (১৯১২) কাব্যগ্রন্থের ’মেথর’ কবিতাতে সমাজে পতিতাদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ পেয়েছে। পরবর্তীকালে এর সাথে নজরুলের ’বারাঙ্গনা’ কবিতার সাদৃশ্য অনেক সমালোচক লক্ষ্য করেছেন। মাতুলের বালিকা কন্যার মৃত্যুতে তিনি অত্যন্ত আঘাত পেয়েছিলেনÑ‘কুহু ও কেকা’(১৯১২)র শিশু মৃত্যুবিষয়ক কবিতাগুলি এই ঘটনা উপলক্ষে লেখা। এগুলির বেদনা করুণ মর্মান্তিক। ‘তুলির লিখন’ (১৯১৪) কাব্যগ্রন্থের ‘পরেয়া’ কবিতায় হিন্দু সমাজের জাতিভেদ প্রথার বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছেন। ‘অভ্র আবীর’ (১৯১৭) কাব্যগ্রন্থের ’জাতির পাঁতি’ কবিতায় জগৎ জুড়ে এক জাতি মানুষ জাতির স্বপ্ন দেখেছেন, এ কবিতাগুলো মহাযুদ্ধের সময়কার। পরবর্তীকালে নজরুলের সাম্যবাদী কবিতা সমষ্টিতে ঐ একই আদর্শের পরিচর্যা অনেক সমালোচক লক্ষ্য করেছেন। সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত ’জাতির পাঁতি’ কবিতায় লিখেছেন,

জগৎ জুড়িয়া এক জাতি আছে

সে জাতির নাম মানুষ জাতি;

এক পৃথিবীর স্তন্যে লালিত

একই রবি শশী মোদের সাথী।

শীতাতপ ক্ষুধা তৃষ্ণার জ্বালা

সবাই আমরা সমান বুঝি,

কচি কাঁচাগুলি ডাঁটো করে তুলি

বাঁচিবার তরে সমান যুঝি।

এ সাম্যচেতনা সাধারণ মানবিকবোধ থেকে উৎসারিত, অর্থনৈতিক শ্রেণীচেতনা থেকে নয়। আলোচ্য গ্রন্থের ’প্রবাসী’ আষাঢ় (১৩২০) সংখ্যা ’সন্তানক’ কবিতায়, শিশুর মধ্য দিয়ে পৃথিবীতে কল্পলোকের মাধুর্যের অবতারনা হয়। সন্তান মানুষের চির কামনার ধন। সন্তানলাভকে সত্যেন্দ্রনাথ স্বর্গীয় আনন্দের সঙ্গে তুলনা করেছেন,

ছোট  ছোট নন্দন যার ঘরে

নন্দন-বনে সেইতো বসতি করে

সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত ’বেলা শেষের গান’ (১৯২৩) গ্রন্থে ’বাঙালি পল্টনের গান’ গেয়ে সেনাবাহিনীতে যোগদানকারী বাঙালী তারুণদের মনের কথা তুলে ধরেছেন, যে বাঙালি পল্টনের নজরুল একজন ছিলেন। যে বাঙালি পল্টন গঠনের জন্য প্রথম মহাযুদ্ধের সূচনাপর্বে দেশময় দাবী উঠেছিল, সেনাবাহিনীতে যোগদান করে বাঙালী যুবকরা ভীরুতার অপবাদ ঘুচিয়েছিল। গ্রন্থের ’ফরিয়াদ’ কবিতাতেও জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ডের নায়ক ডায়ারের বিরুদ্ধাচারণ সম্পর্কিত। উল্লেখ্য যে ’সর্বহারা’ কাব্যগ্রন্থে সংকলিত নজরুলের ’ফরিয়াদ’ও এই গোত্রের।

আলোচ্য গ্রন্থের ’সুশ্বেতা’ কবিতায় বাৎসল্য রসের অবতারণা রয়েছে। পৃথিবীতে শিশুর আগমন ছদ্মবেশী দেবতার মত। সন্তান সৌভাগ্য লাভের জন্য নারী ব্রত পর্যন্ত পালন করে। শিশুর মুখ চেয়ে নারী তার সকল কষ্ট সহ্য করে আরও মর্মান্তিক, দুর্ভিক্ষ-পীড়িতা শবরী মাতার মাতৃত্ববোধ সম্পুর্ণ লুপ্ত হয়ে গেছে। কিন্তু ক্ষুধার উপশমে সেই মাতাও বোঝেন, মায়ের মমতা কলিজায় জ্বালে বাতি’। পুত্রকে পরের কাছে দিয়ে দেবার সময় বলেনÑ’লোভ করিব না, চলে যাই আমি বাছার বালাই নিয়ে’।

সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত ’ছোটদের আহ্বান’৫ কবিতায়  বলেন,

যারা ছোট আছ এস মানুষের মাঝে

মজবুত নও, তবুও লাগিবে কাজে…

এ কবিতায় শিশুর সার্বজনীনতা স্বীকৃত তেমনি শিশুর স্বাতন্ত্র্যও সেভাবে গৃহীত। শিশুর মধ্যে সম্প্রদায় পরিচয়ের পার্থক্য নেই এবং কবি শিশুকে পরিণত মানুষের মাঝে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি শিশুদের সমাজ সচেতন এবং দায়িত্ববান হিসাবে উপলব্ধি করেছেন।

রবিভক্ত কবি হয়েও সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের মধ্যে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ছিল, জগৎ ও জীবনের প্রতি রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিভঙ্গীর সাথে

সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের মৌলিক পার্থক্য দৃশ্যমান। সত্যেন্দ্রনাথের কল্পনা বস্তু ও তথ্যকে অতিক্রম করে রবীন্দ্রনাথের মতো

বিমূর্ত বা অপ্রত্যক্ষ ভাবধারার প্রতি আকৃষ্ট হয়নি। সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কাব্য সাধনার বৈশিষ্ট্য সত্যেন্দ্র সমালোচক হরপ্রসাদ

মিত্র লিখেছেন,

খাঁটি বাংলা ভাষা ও ছন্দের প্রতি আগ্রহ, তদ্ভব ও দেশী শব্দের সঙ্গে তৎসম ও বিদেশী শব্দের বহুল ব্যবহার, তানপ্রধান ও ধ্বনিপ্রধান এবং বিশেষভাবে স্বরাঘাত প্রধান ছন্দের নৈপুণ্য ঐতিহাসিক, পৌরাণিক, বৈজ্ঞানিক, এবং সমকালীন সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় প্রসঙ্গ চিন্তা, গীতি কবিতার প্রকারগত বৈচিত্রেরও রূপগত কৌশলের প্রয়াস, মিলের বিচিত্রতা, শব্দের অভিনবত্ব, চিত্রকল্পের কৌশল, রবীন্দ্রযুগের একান্ত রবীন্দ্রভক্ত কবি হয়েও প্রাচীন ক্লাসিক্যাল কাব্যাদর্শের প্রতি অনুরাগÑএইগুলি তাঁর কাব্যসাধনার বিশিষ্ট লক্ষণ। এছাড়া অনুবাদকের অক্লান্ত অধ্যবসায় ছিলো তাঁর স্বভাবের বিশেষত্ব এবং সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল সাহিত্য পর্যালোকের দৃষ্টি বৈয়াকরণের শব্দজ্ঞান, ছান্দসিকের সৌষমচিন্তা।৬

বাৎসল্য-বাৎসল্য রসের কবিতাতে করুণ রস ধরা পডেছে। শিশুদের প্রতি বিশেষ øেহবশতঃ বাৎসল্য-রসের কবিতাতে সত্যেন্দ্র্রনাথ দত্ত আন্তরিক হয়ে উঠেছেন। বাৎসল্য রসের কবিতায় মনে øেহ-ভাব উদয় হয়।

সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত অনেক শিশু কবিতা লিখেছেন। ইতস্ততঃ ছড়িয়ে থাকা এই সব কবিতার সংকলন ‘সত্যেন্দ্রনাথের শিশু-কবিতা’।

‘সত্যেন্দ্রনাথের শিশু-কবিতা’ শিশুতোষ কবিতার সঙ্কলন। দুপুর বেলায় ঘরের দাওয়ায় বসে থাকার পরিবর্তে শিশুদের তিনি আহ্বান জানিয়েছেন, গ্রন্থভুক্ত ‘মৌচাক’ কবিতায়,

ঝরছেরে মৌচাকের মধু

গন্ধ পাওয়া যায় হাওয়ায়,

দাওয়ায় ব’সে ভাবিস কি আর

আয়রে তোরা বেরিয়ে আয়।

শিশুরঞ্জক অপর কবিতা ’পেটুকের বর্ণ পরিচয়’। তাঁর ভাষাতাত্ত্বিক উৎকর্ষের পরিচয় ‘টপ্টপাটপ্’, ’ঢ়্যাড়শ-কি-তরকারি’, ’নবডঙ্কা’, ’হাপুৎ হুপুৎ হপ্’ ইত্যাদি শব্দে কিশোরসুলভ ভাব পরিস্ফুট হয়েছে। হাস্যরস সৃষ্টিতে সত্যেন্দ্রনাথ হাস্যরসের কবিতায় রবীন্দ্রনাথ (কল্পনা) ও দ্বিজেন্দ্রলালকে অনুসরণ করেছেন। মহৎভাবের কবিতার অনুকরণে হাস্যরস সৃষ্টির উদাহরণ সত্যেন্দ্রনাথের ভোজনবিলাস বিষয়ক রঙ্গরসের কবিতাগুলিতে পাওয়া যায়।

খাদ্যদ্রব্যের বর্ণনার মধ্য দিয়ে শিক্ষা দানের উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত তিনি দিয়েছেন ‘পেটুকের বর্ণ পরিচয়’, প্রকৃতপক্ষে শিশুদের বাংলা বর্ণমালা শিক্ষাদানের প্রয়াস। বিদ্যাসাগরের ’বর্ণ পরিচয়’ শেখার সঙ্গে এর সাদৃশ্য থাকতে পারে যা সত্যেন্দ্রনাথ লিখেছেন কবিতায়। বাংলা বর্ণমালায় মূর্দ্ধণ্য-ণ ও মূর্দ্ধণ্য-ষ-এর প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে নিুোদ্ধৃতরূপে তাঁর মত ব্যক্ত হয়েছে,

দূর থেকে মূর্র্দ্ধন্য ণ-এ প্রণাম ক’রে সারি।Ñ

কৃপণ ওটা ওর ঘরে ভাই মিলবে নাকো কিছু,

আস্ত নবডঙ্কা ওটা যাস্নে পিছু পিছু।’

এবং,

সর্ষের ফুল দেখায় কেবল মূর্দ্ধণ্য ষÑয়ে।’

‘খেলোয়াড় দলে’র গুণগাথায় কবি কিশোর উপযোগী শব্দ ব্যবহার করেছেন। ’হন্টন’, ’এস্পোট’, ’ক্যাচ্ অ্যাজ-ক্যাচ্-ক্যান্’ এই সব শব্দে কিশোরদের একচেটিয়া অধিকার। সত্যেন্দ্রনাথের কবিতায় স্থান পেয়ে এই শব্দগুলি কবিতাকে যেমন সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি সাহিত্যের ভাষায় ব্যবহৃত হবার যোগ্যতাও প্রমাণ করেছে।

’পাল্কীর গান’ প্রথমে ’সন্দেশ’(১৯১৩) পত্রিকায় প্রকাশিত হয়, পরে ‘সত্যেন্দ্রনােেথর শিশু-কবিতা’য় সঙ্কলিত  হয়। ’পাল্কীর

গান’, ’দূরের পাল্লা’,  জ্যৈষ্ঠীমধু’, ’শিল’ প্রভৃতি প্রকৃতি বিষয়ক কবিতায় চিত্র সৌন্দর্য প্রধান হয়ে উঠেছে। এসব কবিতায় খন্ডচিত্রের বর্ণনার মধ্য দিয়ে পল্লীগ্রামের প্রাকৃতিক পরিবেশ নিখুঁতভাবে চিত্রিত হয়েছে। সত্যেন্দ্রনাথের ছন্দোসাধনায় শুধু সঙ্গীত নয়, চিত্রনির্মাণসুলভ গুণ লক্ষ্য করে অজিতকুমার চক্রবর্তী পল ভার্লেন সম্বন্ধে প্রযুক্ত একটি উক্তি আলোচ্য কবি সম্পর্কে প্রয়োগ করেছেনÑ ’যব ঢ়ধরহঃং রিঃয ংড়ঁহফ’

’পাল্কীর গানে’ পল্লী জীবনের প্রাণময় জীবনের সহজ আনন্দের মুগ্ধতা তাঁর কাব্যের বিষয়বস্তু। প্রকৃতি সম্বন্ধে লিখতে গিয়ে সাধারণতঃ তিনি কোন গভীর তত্ত্বকে রূপ দেননি। বাইরের সৌন্দর্যই তাঁর এসব কবিতার প্রধান বিষয় হয়ে উঠেছে। সৌন্দর্যকে কাব্যে ধরে রাখতে হলে যে-পরিমাণ চিত্রাঙ্কন ক্ষমতা চাই, সত্যেন্দ্রনাথের প্রতিভায় তা প্রচুর ছিল। ’পাল্কীর গানে’,

র্পজাপতি

হলুদ বরণ,Ñ

শশার ফলে

রাখছে চরণ!

কার বহুড়ি

বাসন মাজে?Ñ

পুকুর ঘাটে

ব্যস্ত কাজে;

এঁটো হাতেই,

হাতের পোঁছায়

গায়ের মাথার

কাপড় গোছায়!

সত্যেন্দ্রনাথের কবিতায় একটা চেনা, একটা অন্তরঙ্গ বাংলাদেশ আছে। তার লতাপাতায় পাখী, তার মেঘ ও আকাশ খুশীর রঙে রাঙা। বাংলার মাটি আর বাংলার জলকে তিনি চিনিয়েছেন। বাংলার লুপ্ত শ্যামশ্রী কবিতায় এনেছেন। কবির চোখে বাংলার পল্লী-প্রকৃতি একটা মায়ার অঞ্জন পরিয়ে দিয়েছে। পল্লীকে তিনি ’আন্ গগনের আলো’য় উদ্ভাসিত দেখেছেন। পল্লীর বিচিত্র ছবি কবির চিত্তে আনন্দ তরঙ্গের সৃষ্টি করেছে। সেই আনন্দে বাংলার মাঠ-ঘাট-বাটকে তিনি একটা প্রীতিস্বপ্নময় কবিতার দেশে পরিণত করেছেন। পল্লীর ছোট ছোট জিনিসকে ঘিরে কবির কৌতূহলের দীপ্তি উদ্ভাসিত হয়েছে। এছাড়া পল্লীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয়ের প্রকাশ তাঁর নানা কাব্যে ছড়িয়ে অছে।

ধ্বন্যাত্মক শব্দ দিয়ে ভাব-প্রকাশের নিদর্শন ’শিল্’ কবিতায় রয়েছে, ‘কঁড়োমড়ো রব যেন উড়ের বুলি!’

’তাতারসির গানে’ও পল্লীপ্রকৃতি ছড়িয়ে আছে, তবে শিশুর প্রাণে স্বদেশ ও স্বজাতি সম্বন্ধে গৌরববোধ জাগিয়ে তুলবার উপকরণ এই কবিতায় অধিকভাবে দৃশ্যমান। আনন্দোৎসবের কথার মধ্যেও বঙ্গের গৌরবের কথা কীর্তিত হয়েছে। গৌড়েই প্রথম রসের ভিয়ান হয়েছিলÑতারই থেকে মিশর আর চীনে ’মিশ্রী’ আর চিনির উদ্ভব। শেষ স্তবকে কবি বলেছেন,

রসের ভিয়ান্ বার করেছি আমরা বাঙালী,

রস তাতিয়ে তাতারসি, নলেন্ পাটালি।

রসের ভিয়ান্ হেথায় সুরু

মধুর রসের আমরা গুরু,

————————————

আমরা আদিম সভ্য জাতি আমরা বাঙালী।

আলোচ্য কবিতায় বিগত অতীতকে পুনর্জাগ্রত করবার প্রয়াস লক্ষ্যণীয। প্রাচীন যুগের ঐতিহ্যের মধ্যে তিনি আদর্শ অনুসন্ধানে তৎপর হয়েছেন। তাঁর কবিতায় অতীত ও বর্তমানের মধ্যে একটা সেতু রচনার প্রয়াস দেখা যায়। অর্বাচীন পুরাণ থেকে বেদের কাল পর্যন্ত কবি তাঁর দৃষ্টিকে করেছেন প্রসারিত। প্রাচীন যুগের রহস্যময়তার মধ্যে পরিক্রমা করে তিনি পেয়েছেন আনন্দ। আবার লৌকিক সুখদুখের বাস্তবতায় নেমে এসে কবি খুঁজে পেয়েছেন অপার শান্তি। প্রত্যক্ষ জগৎ এবং সুস্পষ্ট চিন্তাই তাঁকে বেশী করে আকৃষ্ট করেছে।

গ্রন্থের ‘মৌলিক গালি’তে দিদির উপর প্রথম অভিমানে অতি দুঃখে সরল, কলহ অনভিজ্ঞ শিশু গালি দেয় ‘ডিডি! টুমি টুই’।

কিশোরদের জন্য লেখা কবিতাগুলিতে সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের আবেগপ্রবণ মনের পরিচয় পাওয়া যায়। ’রংমশাল’ কবিতায় সত্যেন্দ্রনাথ দত্তকে বালকের মত কৌতুহলী হয়ে উঠতে দেখা যায়। ঠিক-দুপুরের আগুন হাওয়ায় কবি তাঁর বালক বন্ধুদের সঙ্গে ’কঞ্চিহাতে’ ছুটেছেন কিশোরজীবনের ’চাকভাঙ্গা মধুর’ সন্ধানে।

ভাবের দিক থেকে সেগুলোর বিভিন্নতা রয়েছে। গ্রন্থের ’রেলগাড়ির গান’ কবিতায় রেলগাড়ির গতির ছন্দে মিলানো যে টুক্রো দৃশ্যগুলি ধরে রাখা হয়েছে, তার বিস্ময় মেশানো ভাষা ছেলে মানুষেরই মুখের ভাষা। সে ভাষার দৃষ্টান্ত,

একি! একি! একি দেখি! ঢেঁকি ঢেঁকি ভাই

ঘোড়া-চুলো গাছগুলো ছোটে বাঁই বাঁই

উঁকি মেরে ঝাৎ ক’রে

স’রে যায় সাঁৎ ক’রে

দেখি ঘাড় কাৎ ক’রেÑ নাই আর নাই

আলোচ্য কবিতায় তিনি ছন্দ ব্যবহারে পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। সরল কলামাত্রিক  ছন্দের ব্যবহারে,

ফাঁকা ফাঁকা মাঠ শুধু আঁকা বাঁকা পথ,

এঁকে বেঁকে ঝেঁকে ঝেঁকে চলে রেল-রথ!

সাতশো চাকার ভরে

চলে সোরগোল ক’রে

তুলক্লাম ধুমধাম মহা হুজ্জৎ!

বেঁকে চলে ঝেঁকে রেল-রথ!’

’দূরের পাল্লা’ কবিতায় অপরূপ স্বপ্ন্চ্ছবির সমাবেশÑবুনো হাঁসের শ্যাওলায় ঢাকা ডিমের কথা, ঝকঝক কলসীর বকবক শব্দের কথা, তন্দ্রাচ্ছন্ন ঢোল-কলমীর ফুলের কথা, গ্রামগঞ্জের ক্ষীণরেখা। রূপকথা ও লৌকিক ছড়ার রসে কবিতাটি øিগ্ধ রমণীয়।

বাংলার পল্লীর কথা বলতে গিয়ে কবি স্বপ্নবিহ্বল হয়েছেন, কবির সৌন্দর্য্যময়তা ফুটেছে বহির্জগতকে অন্তরের সুন্দর স্বপ্নে মন্ডিত করে একটি ভাবময় কল্পলোক সৃষ্টি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তও করেছেন। ’দূরের পাল্লা’ কবিতায় পরিচিত চিত্রকে কবি স্বপ্নলোকের সামগ্রী করে তুলেছেন। এ কবিতায় মননাতিরেক নেই, আছে টুকরো টুকরো রূপচিত্র, বাংলার বিচিত্র ছবি; বর্ণগন্ধের স্বপ্নমদিরাময় মূর্ছনা কবিতাটির পশ্চাতে একটা আবেগের খেলা রক্ষিত হয়।

সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কিছু কবিতা স্বপ্নলোকের ভান্ডার, মনোরম চিত্রশালা, ইন্দ্রজালের রাজ্যÑযেন রূপকথার মায়াজগৎ। সে সব কবিতায় আছে শুধু রঙের পর রঙ, মোহের উপর মোহ, নানারঙের সন্ধ্যেবেলার খেলা। সেখানে পরীর গান, øেহের মায়া। কবির স্বপ্নমুগ্ধ দৃষ্টি মনে করিয়ে দেয় আয়ারল্যান্ডের কবি ইয়েট্সকে। ইয়েট্স যেমন আয়ারল্যান্ডের প্রাচীন গাথা ও কাহিনীর অনুরাগী, সত্যেন্দ্রনাথ দত্তও তেমনি বাংলাদেশের প্রাচীন রূপকথা, ব্রতকথা, ছড়া ও গাথার স্বপ্নাচ্ছন্ন জগতের ভক্ত ছিলেন। রূপকথা ও ব্রতকথার ইন্দ্রজাল তাঁর অনেক কবিতার বিষয়বস্তু, ’দূরের পাল্লা’ কবিতায়Ñ

পাড়ময় ঝোপঝাড

জঙ্গল,Ñজঞ্জাল,

জলময় শৈবাল

পান্নার টাঁকশাল।

কঞ্চির তীর-ঘর

ঐ চর জাগ্ছে,

বন-হাঁস ডিম তার

শ্য্যওলায় ঢাক্ছে।

বাংলা ভাষার ছন্দে সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত কারিগরী দক্ষতা দেখিয়েছেন।

বাঙলা ছন্দে তিনি যে বৈচিত্র্য, যে ভঙ্গী আনিয়াছেন তাহা দেখিলে অবাক হইতে হয়।—– নানা বিদেশী ছন্দÑইংরাজী, গ্রীক, ইতালিয়ান, স্কচ, ফরাসী, জাপানী, জার্মান ছন্দের সুর, সংস্কৃত জটিল ছন্দের সুর বাঙলায় তিনিই আমদানী করেন। ৭

সবচেয়ে বেশী ব্যবহার করেছেন বাংলা স্বরমাত্রিক ছন্দ। স্বরবৃত্ত ছন্দে চলতি ভাষার প্রয়োগ তাঁর কবিতাকে জনপ্রিয় করেছিল। কারণ বাংলা স্বরমাত্রিক ছন্দে বিচিত্র ধ্বনিতরঙ্গ সৃষ্টি করা যায়। স্বরবৃত্তের অদ্ভূত শক্তি সম্পদের পরিচয় তিনি উদ্ঘাটিত করেছেন। প্রাকৃত বাংলার নিগূঢ় শক্তির আবিষ্কারকও তিনি।

একই কবিতায় বিভিন্ন ছন্দের দ্বিদল, ত্রিদল, চতুর্দল-চতুষ্কলামাত্রিক ছন্দ ব্যবহার করেছেন। ‘দূরের পাল্লা’ দ্বিদল-চতুষ্কলামাত্রিক ছন্দের আংশিক ব্যবহার,

ছিপ্খান্ তিন-দাঁড়Ñ

তিনজন্ মাল্লা

চৌপর দিন-ভোর

দ্যায় দূর পাল্লা।’

ছন্দের বৈচিত্র্য আনতে যেয়ে সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের অনেক কবিতার ভাব ভাষার অধীন হয়ে পড়েছে। অনেক ক্ষেত্রে কষ্টকল্পিত অসংগত উপমার প্রাচুর্য কবিতার ভাব স্রোতকে পঙ্কিল করেছে। ছন্দের প্রাচুর্য দেখাতে যেয়ে কাব্যের চাতুর্যকে অবহেলা করেছেন। সে কারণে শিশুসাহিত্যের সম্পদ কিছু বৃদ্ধি হলেও তা প্রাণস্পর্শে স্পন্দিত হয়নি।

’ছেলের দল’ কবিতায় কিশোরদের বন্দনা গেয়েছেন। কারণ তারা আমাদের ’আশার খনি’। তারুন্যের শক্তিতে এরা সব সাধন করতে পারে-যেন ’আলাদিনের মায়া-প্রদীপ’। এদের মধ্যে যে সোনা আছে, তা নিখাদ’। এরা ’পদ্মকোষের বজ্রমণি’ এবং ’ধ্রুব সুমঙ্গল’।

’পাল্কীর গান’ ’দূরের পাল্লা’, ’ইলশে গুঁড়ি’ প্রভৃতি কবিতায় ছন্দোলিপি রচনার সঙ্গে সঙ্গে তিনি ছবি দেখার চোখ জাগ্রত রেখেছিলেন, ‘ইলশে গুঁিড়’ প্রথমে ‘সন্দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়, পরে ‘সতেন্দ্রনাথের শিশু-কবিতা’র অন্তর্ভুক্ত হয়।

ইলশে গুঁড়ি!                ইলশে গুঁড়ি!

ইলিশ মাছের ডিম।

ইলশে গুঁড়ি!                ইলশে গুঁড়ি,

দিনের বেলায় হিম।

কেয়া ফুলে ঘুণ েেলগেছে

পড়তে পরাগ মিলিয়ে গেছে,

মেঘের সীমায় রোদ জেগেছে,

আল্তা-পাটি শিম্

রোদ্দুরে রিম্ ঝিম্Ñ

Ñছবিকে সুন্দর করে সাজাবার কায়দা তিনি আয়ত্ত করেছিলেন।

(বাৎসল্য)’নেই-ঘরের ঘুম-পাড়ানি’ মা’ গান গাইতে গিয়ে দারিদ্র্যের কথা ভুলতে পারেন না। পুরানের সমৃদ্ধির কথা এবং তা থেকে বর্তমান দুর্দশার কারণ যারা তাদের প্রতি আক্রোশে গুমরে ওঠে। মা তাঁর বাছাকে বাঁচিয়ে তুলতে, মানুষ করতে সব ’অপমান ক্লেশ’ সহ্য করতে রাজী। কিন্তু ওই বাছার উপরেই নির্ভর,

’ .. ..যদি পালতে তোরে কলঙ্ক কিনি,Ñ

পঙ্ক ছেনে মুখে এনে দিই ছানা চিনি,Ñ

তবে বাছা ভুলিসনে শোধ দিতে তা’ সবায়,Ñ

উপবাসের ঠোঁটে যারা রসের চুমো চায়;Ñ

দুঃখের জ্বালায় মায়ের মুখে এই বাণী ফোটে,

জোরের কাছে জুজু হ’য়ে জানাসনে তুষ্টি।

শেষ পর্যন্ত মা ছেলেকে ডেকে বলেছেন ঘুমপাড়ানি গাইবার’ ওক্ত পার হ’য়ে গেছে। এবারে জাগতে হবে। খোকা ধার্মিক হোক, কি ’জবরদস্ত’ দারোগা হোক, কি ’মিনমিনে’ ভালোমানুষ হোকÑ এ মায়ের কামনা নয়। মায়ের আশা,

মানুষ হবি শক্ত পোক্ত সাহাসে উল্লাস,

————————————-

ভালো হবি মানুষ হবি এই তো মনের সাধ,

ভালোমানুষ হস্নে শুধু এ মোর আশীর্ব্বাদ।’

এই শুধু কামনা, সন্তান যেন ভবিষ্যতে নিপীড়িত হবার মত দুর্বল না হয়।

সত্যেন্দ্রনাথের মধ্যে রূপোভোগের এক প্রখর পিপাসা ছিল। কবিতায় রূপজগতের সৌন্দর্যকে অম্লান রাখার জন্যে, সৌন্দর্যকে উজ্জ্বলতর করবার  অনিন্দ্যসুন্দর ভাষা ও সব শ্রেনীর শব্দ ব্যবহার করেছেন। তৎসম শব্দ থেকে আরম্ভ করে, বিদেশী ও প্রচলিত শব্দ, দেশজ শব্দ তিনি তাঁর কাব্যে আশ্চর্য সাফল্যের সঙ্গে ব্যবহার করেছেন। সত্যেন্দ্রনাথের কাব্য পাঠকালে মনে হয় যে তাঁর কবিতায় ব্যবহৃত শব্দের অক্ষরগুলি পর্যন্ত বর্ণ ও রসকে পরিস্ফুট করেছে।

বাংলা ভাষায় ঘরোয়া শব্দের প্রচলন করে ও আরবী-ফারসী শব্দকে প্রবেশাধিকার দিয়ে সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর যে সব উত্তরসূরীদের অজস্র ঋণজালে আবদ্ধ করেছেন তাঁদের মধ্যে নজরুল ইসলাম অন্যতম।

 

খাঁটি বাংলা ভাষাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠার কাজে মুখের ভাষায় প্রচলিত দেশী-বিদেশী নানা শব্দকে সাহিত্যের ভাষায় প্রতিষ্ঠা করে ভাষাকে জোরালো করবার আদর্শ স্থাপন। শব্দ চয়নে কৃতিত্ব প্রদর্শন করেছেন। অগণিত খাঁটি দেশী শব্দ সেই সঙ্গে আরবি-ফারসি শব্দ কবিতায় ব্যবহার করে বাংলা ভাষার শক্তিবৃদ্ধি করেছেন। খাঁটি বাঙ্গলা শব্দ এবং বুলির কয়েকটি দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেছেন শিশু-কবিতায়,

কালিয়ে গেছিস্? পাঁজরাগুলো আমারো হিম্ যেরে,

(নেই-ঘরের ঘুম-পাড়ানী’, সত্যেন্দ্রনাথের শিশু-কবিতা)

’বসন্তের ফুল’ কবিতায় মাসতুত, পিসতুত ইত্যাদি সম্বন্ধসূচক শব্দ থেকে ’ফুলতুতো’, ’শরতের ফুল’ কবিতায়  ’লতাতো’, ’গাছতুতো’ ইত্যাদি শব্দের উদ্ভাবন করেছেন।

বালকদের আমোদ দিয়ে লেখা ’গলার তোয়াজে’ কবি কিশোরদের চিত্তহরণকারী নাট্যভঙ্গি অবলম্বন করেছেন। ছেলের দলের বারবার একই ধরনের প্রশ্নের উত্থাপন এবং গায়ক শ্রেষ্ঠের সেই প্রশ্ন এড়িয়ে নিজ সাধনা ও তাতে সিদ্ধিলাভের নানা অবিশ্বাস্য কাহিনীর বর্ণনায় হাস্যরস জমে উঠেছে। এই কৌতুকরসের কাহিনী সুকুমার রায়ের কৌতুক রচনার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।

’ছেলে ভুলান গান’ ফরাসী দেশের অনুবাদ। কবিতায় চাঁদের আলো ধরবার জন্য দেবতাদের দোহাই দিয়েছেন।

চাঁদের আলোর রাজ্যে রাজা

বন্ধু গো আমার,

একটু খানি চাঁদের আলো

দাওনা আমায় ধরে ;

বাতি আমার নিবে গেছে

ঘরে আগুন নাই,

কবাট খোলো কবাট খোলো

দেব্তাদের দোহাই।।

স্বাধীনতা তেজের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেছেন। দেশ-বিদেশের মহত্ত্বকে সম্মান ও বন্দনা করেছেন। কবির অন্তরে গভীর শ্রদ্ধা ছিল মনীষা ও পূর্ণ মনুষ্যত্বের প্রতি, ন্যায়ের প্রতি, প্রতিভার প্রতি। তাঁর মধ্যে ছিল  বীরপূজার প্রবনতা। মহত্ত্বের জ্ঞান গরিমা, আত্মবলিদান ও পরার্থপরতাকে তিনি তাঁর কবিতার বিষয়বস্তু করেছেন। দেশের সেবায় যাঁরা অগ্রগামী, তাঁদের জয়গান করেছেন। জাতীয় গৌরবে কবির মধ্যে জেগেছে উল্লাস। লাঞ্জিতের প্রতি সহানুভূতিতে তাঁর চিত্ত হয়েছে দ্রবীভূত। শিল্পীর অনুভূতি তীব্র, স্বাতন্ত্রবিশিষ্ট।

সত্যেন্দ্রনাথের কবিতায় ছড়ার ভাবই শুধু নয়, ছড়ার সুরের ঝংকার তাঁর শিশুরঞ্জক কবিতাগুলির সৌন্দর্য্য বৃদ্ধি করেছে। মাত্রা গণনায অন্যান্য বৈচিত্র্য আছে, তবে প্রায় সবকটিতেই ছড়ার সুর ও ঝোঁক সুস্পষ্ট। ছড়ার চালে যেমন ধ্বনির নৃত্যময় গতি, ভাবের শিশুসুলভ চাপল্য এবং খন্ডচিত্রের সমৃদ্ধি দেখা যায়।

তাঁর ছন্দ-শিল্প ছিল সুষমামন্ডিত। বাংলা সাহিত্যে ছন্দ নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছেন। ছন্দনৈপুন্যে তিনি পূর্ববর্তী কবিদের অপেক্ষা অধিক সাফল্যের সাক্ষর রেখেছেন। ছন্দ ঝংকারে সমৃদ্ধির কারণে ’ছন্দের রাজা’ ও ’ছন্দের যাদুকর’, ’ছন্দ সরস্বতীর বরপুত্র’ ইত্যাদি বলে খ্যাত হন।

ধ্বনির সহায়তায় তিনি বিচিত্র রঙের ছবি এঁকেছেন। কবির সুপরিচিত ’ঝর্ণা’ কবিতায় রয়েছে অপরূপ ধ্বনি ঝংকার, সেই ধ্বনিঝংকার ঝর্ণার রূপকে স্পষ্টীকৃত করেছে, ঝর্ণার গতিতরঙ্গ ফুটিয়েছে,’ঝর্ণা, ঝর্ণা, সুন্দরী ঝর্ণা’। চরকার গান, দূরের পল্লা, পাল্কীর গান, ইলশে গুঁড়ি প্রভৃতি এই পর্যায়ের কবিতা।

প্রচলিত পয়ার ত্রিপদী তাঁর হাতে নতুন রূপ পেয়েছে। চৌদ্দ অক্ষরের চিরপুরাতন পয়ারকে তিনি যতিবিভাগের বিপর্যয় ঘটিয়ে ও মিলের ঐশ্বর্য বৃদ্ধি করে এক নতুন রূপ দিয়েছেন।

ধাঁধাঁ রচয়িতাÑকিশোরপ্রীতি কিশোরদের সঙ্গে একাত্ম হবার অভিপ্রায়ে এবং কিশোরদের আনন্দদানের উদ্দেশ্যে সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত কিছু ধাঁধাও লিখেছেন।

’মৌচাক’ পত্রিকার ১৩২৮ সালের মাঘ মাসের সংখ্যায় তাঁর আটখানি ধাঁধা ছাপা হয়েছিল। উদাহরণ,

ক)            নড়ন চড়ন নাইকো মোটে

ছোটে মাঠের পার।

আকাশ থেকে খবর আনে

অস্ত পাওয়া ভার।”

উত্তরÑ চোখ।৮

সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের একশ্রেণীর কবিতা নিপীড়িত মানুষের জীবনবেদ। সাম্যসাম, জাতির পাঁতি, মেথর, শুদ্র, সেবাসাম প্রভৃতি সমাজব্যবস্থার নিষ্ঠুর শাসনে নিত্যলাঞ্জিত উপেক্ষিত মানুষের জীবনকথা, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে স্তুতি এবং তত্ত্বের প্রশয়ে সত্যেন দত্তের কবিতা দুর্বল হয়ে পড়েছে। উচ্ছসিত প্রশস্তিবাদ প্রায়ই সত্যকে পিছনে ফেলে অহেতুক অপ্রাকৃত আবেগ হয়ে দাঁড়ায় মাত্র। সাম্যবাদের আবেগে কবি উল্লাসে অধীর হয়ে মেথরকে বলেছেনÑ’কে বলে তোমারে বন্ধু অস্পৃশ্য অশুচি ?’ আবার প্রশংসার চরম করে শুদ্রকেও তিনি দেবোপম করেছেন।

কবির মৃত্যুর পর রবীন্দ্রনাথের প্রশস্তিতে সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের বাংলা কবিতায় নতুন সুর সংযোজনের স্বীকৃতি ভাস্বর হয়ে

উঠেছে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর উদ্দেশ্যে বলেছিলেন,

তুমি বঙ্গভারতীর তন্ত্রী পরে একটি অপূর্ব তন্ত্র এসেছিলে পরাবার তরে,৯

গদ্য সাহিত্যেও তিনি দক্ষতা দেখিয়েছেন কিন্তু শিশুসাহিত্যে এর পরিচর্যা আমরা পাই না।

সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সমকালের কবি। সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কবিতার ভিতর দিয়েই রবীন্দ্রোত্তর যুগের সূচনা হয়েছিল এবং সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত রবীন্দ্র্রনাথ ঠাকুরের ভাব-কল্পনার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। রবীন্দ্রোত্তর কালের কবিতায় ভাবপ্রাবল্যের স্থানে বুদ্ধির প্রাধান্য পেয়েছে, চিত্তের দ্রুতি অপেক্ষা বুদ্ধির দীপ্তি লক্ষ্য করা যায়, তারই আগমণী ছিল সত্যেন্দ্রনাথে।

রবীন্দ্রোত্তর কালের সাধারণ লক্ষণ বাস্তব সচেতনতা, আধ্যাত্মিকতার পরিবর্তে সর্বাতিশয়ী মানবতার প্রতিষ্ঠা। বাস্তব চেতনা এবং রূপচেতনা সত্যেন্দ্রনাথে অতিশয় প্রখর। তাঁর কবিতায় অধাত্মবোধের স্থান অধিকার করেছে একটা তীব্র সমাজবোধ, সেই সমাজবোধের পরিণতি একদিকে সকল প্রকার কৃত্রিম ভেদবিরোধী মনোভাবে এবং নিখিল মানবের প্রতি অসীম সহানুভূতিতে।

কবির অনুরাগ ছিল স্বদেশের প্রতি, মানুষের প্রতি এবং আপন মাতৃভাষার প্রতি। দেশ, জাতি এবং মাতৃভাষার প্রতি গভীর অনুরাগ নিয়ে তিনি তাঁর অধিকাংশ কবিতা লিখেছেন।

আমাদের মধ্যে যারা হীন, কৃপামিশ্রিত অবজ্ঞার পাত্র তাদের মধ্যে কবি সন্ধান পেয়েছেন মনুষত্বের মহিমা। নবরূপের মধ্যে যে মহারূপের অধিষ্ঠান আছে, তার বন্দনা কবি করেছেন। তিনি জীবনের আহ্বান পৃথিবীর চারিদিকে ধ্বনিত হতে শুনেছিলেন। সেই আহ্বান কবির মনে এই বোধ জাগিয়ে দিয়েছিল যে, যেখানে ফুল ফোটে, পাখী ডাকে, পৃথিবী জোৎøার আলোয় উদ্ভাসিত হয়Ñ সেই জগৎটাকেই মেনে নেওয়ার মধ্যে কবি জীবনের সার্থকতা; ব্যথিতের অশ্রুজল, দুঃখ-অমঙ্গল সন্মন্ধে উদাসীন থাকা কোনোমতেই সমীচীন নয়।

বাস্তবতার দাবীকে অগ্রাধিকার দিয়েও সত্যেন্দ্রনাথ অরূপবাদী। রবীন্দ্রনাথের মতই তিনি ভাব হতে রূপে অবিরাম যাওয়া-আসা করেছেন। রোমান্সের মোহে সত্যেন্দ্রনাথ কল্পনার আনন্দলোক থেকে রূপময় পৃথিবীতে ফিরে এসেছেন। মর্ত্যপ্রীতি সত্যেন্দ্রনাথকে করেছে রূপের কবি। রূপের এত বৈচিত্র্য ও চমৎকারিত্ব, এতটা প্রাধান্য তাঁর সমসাময়িক অন্য কোন কবির মধ্যে ছিল বিরল। পৃথিবী ও প্রকৃতির রূপে গুণে তিনি ছিলেন মুগ্ধ। এই কারণেই তিনি পরিপূর্ণ ভাববিভোর ও রসের কবি হয়ে উঠতে পারেননি। সত্যেন দত্ত দেখার উপর জোর দিয়েছেন, অনুভূতির উপর নয়-কাজেই তাঁর অনেক কবিতা ছন্দোবদ্ধ রিপোর্ট-এর মতো হয়ে দাঁড়ায়। তাঁর ’গঙ্গা, রামধনু’, ’গঙ্গার প্রতি’ এই পর্যায়ের কবিতা। জবধষরংস এর স্পর্শে সত্যেন দত্তের অনেক কবিতা প্রায়ই সাধারণ স্তরে নেমে এসেছে। অনেক স্থানে আরম্ভের উদাত্ত গম্ভীর সুরের সঙ্গে Ñপরবর্তী ছত্রগুলি সামঞ্জস্য রক্ষা করে চলতে পারেনি।

মনে হয় বাক্যের অর্থ ও ছন্দের ধ্বনিকে আশ্রয় করে ভাব যেন কোন রূপে নিজকে বিজ্ঞপ্তি করেই ক্ষ্যান্ত হয়েছে।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর অপূর্ব ধ্যানমগ্ন দৃষ্টিতে বাংলাদেশকে দেখেছেন। সত্যেন্দ্রনাথের কবিতায় যে বাংলাদেশকে আমরা পেয়েছি, তা রবীন্দ্রনাথের কবিতার মত ধ্যানের গভীরে আমাদের আত্মস্থ করেনা বটে কিন্তু বৃষ্টিতে ভিজবার জন্য বেরিয়ে পড়া বাবুই পাখীর মত বাংলাদেশের পথে-ঘাটে আমাদের টেনে বের করে নিয়ে যায়। তাঁর কবিতা পড়ে বাংলার চারিদিকে আমরা নিজেদের ছড়িয়ে দেবার দুর্নিবার একটা প্রেরণা অনুভব করি। মুহূর্তকালের মধ্যে আমরা কাজলা দীঘির পারে গিয়ে দাঁড়াই, দেখি ’শোল্-পোনাদের তরুণ পিঠে কে যেন দেয় আলপনা!’ ভোরের রোদ হঠাৎ কমলা খোলার রোঁয়ার মত হয়ে আমাদের মনটাকে প্রসন্ন করে তোলে।

যদিও বাৎসল্য রসের কবিতায় পুরানের সমৃদ্ধি এবং বর্তমান দুর্দশার কারণ নির্ণয় ও দারিদ্র্য থেকে উত্তরণের উপায় ব্যক্ত হয়েছে কিন্তু শিশুসাহিত্যের ধারায় বাৎসল্য রসের কবিতা শিশুকে উদ্দেশ্য করে রচিতÑ শিশুর জন্য রচিত নয়। এ জাতীয় কবিতায় শিশুর শিক্ষণীয় বিষয় বিশেষ কিছুই থাকে না।

তাঁর অনেক কবিতায়, øিগ্ধ আলোর অতীন্দ্রিয় আনন্দ, আস্বাদন এবং মনের নিভৃতে সৌন্দর্যের তৃষ্ণা শিশু বা বালকের বোধগম্য নয়।

কবিতায় ছন্দের চর্চা করে একদিকে যেমন প্রশংসিত হয়েছেন, অন্যদিকে নিন্দিতও হয়েছেন। তিনি ভাবের চাইতে ছন্দ সৌষ্ঠবের প্রতি অধিক মনোযোগী হয়ে সাহিত্যরসকে উপেক্ষা করেছেন।

সত্যেন্দ্রনাথ শিশুর মত কৌতূহলী দৃষ্টি নিয়ে জগতের দিকে তাকিয়েছেন। যা দেখেছেন তাতেই মুগ্ধ হয়েছেন। অপূর্ব আনন্দে তিনি চরকার র্ঘর্ঘ শব্দে কান পেতেছেন, পিয়ানোর টুংটাং শব্দ শুনে মুগ্ধ হয়েছেন। শীতের ভোরে আনন্দে অধীর হয়ে তাতারসির গান গেয়েছেন। মাঝিদের দূরের পাল্লায় তাদের সঙ্গী হয়ে বাংলার পল্লীর বিচিত্র শ্রী ও সম্পদ দেখেছেন এবং আনন্দে তন্ময় হয়েছেন। সে আনন্দ কোন তত্ত্বোপলব্ধির আনন্দ নয়Ñরূপপ্রিয়ের সহজ সরল আনন্দ,

’দূরের পাল্লা’ (বিদায় আরতি)কবিতায়-‘ময়রা মুদি, চক্ষু মুদি, পাটায় বসে ঢুলছে কসি’Ñএকটি অলস জীবনধারার ছবি কবি তুলে ধরেছেন।

সত্যেন্দ্রনাথের গ্রন্থের কবিতাগুলির মধ্যে ভাবের পারম্পর্য নাই বলে অভিযোগ রয়েছে। ’বিদায়-আরতি’র বেলায় কথাটি অতিমাত্রায় প্রযোজ্য।

১৩২৭ সালের ভাদ্র সংখ্যা ’মোসলেম ভারতে’ প্রকাশিত মোহিতলাল মজুমদারের চিঠিতে,

’বাঙ্গালা কাব্যের যে অধুনাতন ছন্দ ঝংকার ও ধ্বনি বৈচিত্র্যে এককালে মুগ্ধ হইয়াছিলাম, কিন্তু অবশেষে নিরতিশয় পীড়িত হইয়া যে সুন্দরী মিথ্যারূপিণীর উপর বিরক্ত হইয়াছি…। যে ছন্দ কবিতায় শব্দার্থময়ী কন্ঠভারতীর ভূষণ না হইয়া প্রাণের আকুতি ও ছন্দস্পন্দনের সহচর না হইয়া, ইদানীং কেবলমাত্র শ্রবণপ্রীতিকর প্রাণহীন চারু-চাতুরীতে পর্যবসিত হইয়াছে.. .’১০

সত্যেন্দ্রনাথের দানকে রবীন্দ্রনাথের ’তরলিত সংস্করণ’ মাত্র বলেছেন।

সত্যেন্দ্রনাথ ’ছন্দ-সরস্বতী’ প্রবন্ধের শেষে  নিজেও স্বীকার করেছেন যে ছন্দোময়ী দেবীর অলোক রথের প্রতি নিবদ্ধদৃষ্টি থাকতে থাকতে তাঁর র্দৃষ্টি ঝলসিত হয়েছেÑবাহ্যচেতন্ লুপ্ত হবার উপক্রম হয়েছে। বাংলার কাব্যপাঠক ও সমালোচককুল সত্যেন্দ্রনাথের ভাববহন-ক্ষম ছন্দোগীতি অংশকে স্বীকার করে তার বাকী গুণ নাকচ করেছেন।

মোহিতলাল মজুমদার সত্যেন্দ্রনাথের মধ্যে বালসুলভ কৌতূহল এবং ক্রীড়াসক্তি লক্ষ্য করেছেন। তাঁর জ্ঞান পিপাসা ছিল, সঙ্গে ক্ষণে ক্ষণে চমৎকৃত হবার চির-তরুণ ক্ষমতা মিশ্রিত ছিল। তৎকালে প্রচলিত সবুজপত্র প্রবর্তিত শব্দসচেতনতা ও শব্দক্রীড়ার উচ্ছল আনন্দপ্রীতিও সত্যেন্দ্রনাথে ছিল।

ভোজনবিলাসের ক্ষেত্রে হাস্যরসের অবতারণা আমাদের সাহিত্যে বহুদিন ধরেই প্রচলিত। মঙ্গলকাব্যের ’কালকেতু ভোজনে’ এই রসের সৃষ্টি। এরপরে ঈশ্বরগুপ্তের ’পাঁটা’, ’তপসে মাছ’ ইত্যাদির মধ্য দিয়ে অপেক্ষাকৃত আধুনিক যুগে এর সূত্রপাত। এই কবিতাগুলি সাধারণতঃ কিছুটা স্থুলত্ব ঘেঁষা। আগেকার দিনে বাঙালির রঙ্গরসিকতার এটা ছিল সাধারণ একটা বিষয়। অবশ্য আধুনিক কালে এই ধরনের কবিতায় উচ্চশ্রেণীর ভাবরসের অবতারণা করে বিষয়বস্তুর লঘুত্ব আনা হয়েছে। সত্যেন্দ্রনাথ ’সাম্য-সামে’র পংক্তি নজরুলপূর্ব উচ্চারণ করলেও স্বল্পসংখ্যক সন্ধানী ব্যতীত সাধারণের কাছে এ সত্য অগোচর। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উচ্চশিক্ষার পাঠ্যতালিকায় অন্তর্ভূক্তি থাকলেও তাঁর সম্বন্ধে কৌতূহলের অভাব দৃষ্ট হয় নানা কারণে।

কবির স্বদেশানুরাগ এবং সমাজÑসচেতন দৃষ্টিভঙ্গী অনেকাংশেই দ্রষ্টার। একাত্মতা লাভের জন্য যে বিপুল প্রাণচাঞ্চল্য এবং বিষয়ের প্রতি গভীর ভালোবাসা এবং আবেগ থাকা প্রয়োজন, সত্যেন্দ্রনাথের মধ্যে তার অনেকখানিই উপস্থিত ছিল। প্রতিটি বিষয়কে তিনি দেখেছেন, তার মধ্যকার অসংগতিকে লক্ষ্য করেছেন অত্যন্ত তীক্ষ্ম সমালোচকের দৃষ্টিতে কিন্তু তাঁর দৃষ্টিভঙ্গী যে পরিমাণ তীক্ষ্ম ছিল আবেগের প্রবণতা সে পরিমাণে প্রগাঢ় ছিল না। ডঃ সুকুমার সেন বলেন,

’সত্যেন্দ্রনাথের কবিমানসের বহিঃপ্রকাশ স্বদেশপ্রীতিতে ও জ্ঞানবিজ্ঞান প্রিয়তায়। সদ্যÑজাগ্রত দেশÑচেতনায় ও সমাজচেতনায় তাঁহার কবিকর্ম প্রায় সর্বদা উদ্ভাসিত।’১১

সুকুমার সেন আরো বলেন,

সত্যেন্দ্রনাথের কবিপ্রকৃতির মধ্যে বিজ্ঞানী বুদ্ধির অংশ প্রবল ছিল তাই তাঁহার কবিতা যতটা বস্তুগর্ভ, ততটা ভাবগম্ভীর নয়।১২

বস্তুতঃ সমসাময়িক কাল এবং সমাজের অসংগতিকে, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং নৈরাজ্যকে কবি দ্রষ্টার দৃষ্টিতে যতটা দেখেছেন এবং ছন্দোবন্ধে প্রকাশ করেছেন সে পরিমাণে তাঁর গভীরে প্রবেশ করবার প্রবণতা তাঁর মধ্যে অনুপস্থিত ছিল। ফলতঃ তাঁর প্রকাশভঙ্গী অনেকটাই সাংবাদিক সুলভ’ বা পর্যবেক্ষকের। বস্তুর সঙ্গে কবিসুলভ আবেগপ্রবণতা যুক্ত হয় নি।

সত্যেন্দ্রনাথের সমসাময়িক সামাজিক বা রাজনৈতিক উত্তেজনামুখর বিষয়ও কালভেদের কারণে সর্বাংশে পাঠকের আগ্রহ উদ্দীপনার অবলম্বন নয় আজ। চারিত্রমাধুর্য বিস্তার এবং পরবর্তী কবিদের উপর কাব্যগত প্রভাব সঞ্চার সত্ত্বেও সত্যেন্দ্রনাথ এ যুগে বিস্মৃতপ্রায়।

ডঃ ক্ষেত্রগুপ্ত ১৩৬৮ সালে ’সত্যেন্দ্রনাথের কাব্যবিচার’, গ্রন্থে  বিশেষ করে দেশ কাল ও রাজনীতির প্রভাব এবং বিশ শতকের পাশ্চাত্ত্যের প্রভাব তাঁর উপর কোন প্রতিক্রিয়া করেছিল কিনা, এ প্রসঙ্গে তিনি সত্যেন্দ্রনাথের দেশাত্মবোধের অনূভূতি সম্পর্কে কিছূটা শৈথিল্যের ইঙ্গিত করেছেন।

অনেক বিদগ্ধ সমালোচক সমালোচনাটি মানতে রাজী নন। আলোচিত গ্রন্থে প্রকাশিত ’সত্যেন্দ্রস্মৃতি’ নিবন্ধে,

ঐব ধিং ধ হধঃরড়হধষরংঃ, ধষসড়ংঃ ধ ৎবাড়ষঁঃরড়হধৎু’

অমল হোম, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত ’মডার্ণ রিভিউ’ পত্রিকা।১৩

চারুচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়ের একটি মন্তব্য এ প্রসঙ্গে যুক্তিযুক্ত,

কবি সত্যেন্দ্রনাথের স্বদেশের প্রতি দরদ এত প্রবল ও তীক্ষ্ম ছিল যে, তিনি পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক কাহিনীর অন্তরালে, এমন কি প্রাকৃতিক দৃশ্য বর্ণনা উপলক্ষ করিয়াও দেশের অবস্থা দুঃখ দুর্দশা এবং আশা আকাঙ্খা প্রভৃতি প্রকাশ করিবার সুযোগ পাইলে ছাড়িতেন না এবং এই প্রকার রচনায় তাঁহার একটি বিশেষ অনন্যসাধারণ নিপুণতা ছিল।১৪

জাতীয় সাংস্কৃতিক চেতনাÑ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন প্রসূত জাতীয় সাংস্কৃতিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সত্যেন্দ্রনাথ Ñ’গঙ্গাহৃদি বঙ্গভূমি’ কবিতায় বললেন,

সাগরে তার শঙ্খ বাজেÑশুনতে যে পাই রাত্রি দিবা,

হিমালয়ের বক্ষ চিরে চক্র তোমার চলছে কিবা!

দেখছি গো রাজ-রাজেশ্বরী মূর্তি তোমার প্রাণের মাঝে,

বিদ্যুতে তোর খড়গ জ্বলে বজ্রে তোমার ডঙ্কা বাজে।

অন্যত্র,

নাগ-কেশরে চামর করে, কোয়েল তোষে সঙ্গীতে,

অভিষেকের বারি ঝরে নিত্য চেরা-পুঞ্জিতে।

লক্ষ্যণীয় যে আলোচ্য কবিতার শিরোনাম ’গঙ্গাহৃদি বঙ্গভূমি’ কবি কবিতার বক্তব্যে হিমালয় থেকে সাগরের গন্তব্য ’গঙ্গা’কে ক্ষুরধার স্রোতস্বিনী মেনেছেন। বঙ্গভুমি বলতে গঙ্গার হৃদয়কে বুঝেছেন এবং তারই প্রশস্তি গেয়েছেন। সত্যেন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে বাংলাদেশের সীমা গঙ্গা পর্যন্ত এবং চেরাপুঞ্জি পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্ভুক্ত একটি প্রদেশ।

জাতীয় চেতনা ঃ উনিশ শতকের শেষ দিকে বাংলা শিশু

 

পাদটীকা ঃ

পোপ

পল ভার্লেন

১।  কবি সত্যেন্দ্রনাথের গ্রন্থাবলী, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, ১ম খন্ড, শ্রী বিশু মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত, বাক্-সাহিত্য প্রাঃ লিমিটেড,           ৩৩, কলেজ রোড, কলিকাতা-৯। ১৯৭১।

২। কবি সত্যেন্দ্রনাথের গ্রন্থাবলী, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, ২য় খন্ড, শ্রী বিশু মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত, বাক্-সাহিত্য প্রাঃ লিমিটেড,          ৩৩, কলেজ রোড, কলিকাতা-৯। ১৯৭৩

২। ’সাম্যসাম’ হোম শিখা, আশ্বিন ১৩১৪, ১৬ই অক্টোবর ১৯০৭,

৩। রবীন্দ্রনাথ

৪।’বঙ্গবাসী’ পত্রিকা তার অনুবাদ

৫। ’ছোটদের আহ্বান’* (আল এসলাম, আষাঢ়, ১৩২৫)

৬। হরপ্রসাদ মিত্র, সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কবিতা ও কাব্যরূপ, ইষ্ট এন্ড কোং, ১৩৬১,  ২৯-৩০।

৭। সৌরীন্দ্রমোহন )২য়, পৃ-৫।

৮। ’মৌচাক’ পত্রিকার ১৩২৮ সালে ধাঁধা

সত্যেন্দ্রনাথের শিশু-কবিতা, প্রথম সংস্করণ, বৈশাখ ১৩৫২,এম,সি , সরকার এ্যান্ড সন্স লিঃ, ১৪, কলেজ স্কোয়ার

৯। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বর্ষার নবীন মেঘ, ’বিদায় আরতি’ (১৯২৪), এম, সি, সরকার, কলিকাতা। কাজী নজরুল

ইসলাম জীবন ও কবিতা, রফিকুল ইসলাম, মল্লিক ব্রাদার্স, ৩/১ বাংলা বাজার, ঢাকা-১।

১০।’মোসলেম ভারত’, মোহিতলাল  মজুমদার, ১৩২৭।

১১। সুকুমার সেন।

১২। ঐ

১৩। ২য়, পৃ-৬ অমল হোম

১৪। সম্পাদকীয়, ২য়,পৃ-৬ চারুচন্দ্র

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

সুকুমার রায়ের শিশুসাহিত্য

(১৮৮৭-১৯২৩)

 

সুকুমার রায় (ইংরেজী ৩০.১০.৮৭) কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। সাহিত্য ও সংস্কৃতির দিক দিয়ে বাঙলার এক বিশিষ্ট ও খ্যাতনামা পরিবারে তাঁর জন্ম। পিতা শিশু-সাহিত্যিক, চিত্রশিল্পী, সঙ্গীতঙ্গ উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী। মাতামহ সমাজ সংস্কারক, ভ্রাতা ও ভগিনীরাও বহুখ্যাত। জেষ্ঠ্যতাত সারদারঞ্জন বাংলার ক্রিকেটের জনক বলে পরিচিত। গুণী পিতার সøেহ সান্নিধ্যে মানুষ হয়েছিলেন সুকুমার রায়। স্কুল ও কলেজের শিক্ষা হয় কলকাতাতেই। শিশুকাল থেকেই মুখে মুখে মজার ছড়া বানানো, ছবি আঁকা ও ফটোগ্রাফীর চর্চা করতেন। পরিণত জীবনে তিনি ’খেয়াল রসের স্রষ্টা’ বলে পরিচিত হন।

প্রথম হাসির নাটক ’রামধন বধ’১(১৯০৫)। অহঙ্কারী র‌্যামসডেন সাহেব কি করে জব্দ হল তার কাহিনী বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে তাঁর কৈশোরক রচনাটি বাড়ীতে অভিনীত হয়। নাটকে স্বদেশী ভাবধারার প্রভাবে তার পরিবারে মোটা কাপড় পরিধান উপলক্ষে সুকুমার রায় রচিত গানে এই সচেতনতার পরিচয় পাওয়া যায়।

আমরা দিশি পাগলার দল,

দেশের জন্য ভেবে ভেবে হয়েছি পাগল!

(যদিও) দেখতে খারাপ, টিকবে কম, দামটা একটু বেশী,

(তা হক না) তাতে দেশের-ই মঙ্গল!২

শিশুদের জন্য তিনি রচনা করেছেন কবিতা, গল্প, নাটক, জীবনী, প্রবন্ধ ইত্যাদি।

সব গ্রন্থই তাঁর মৃত্যুর পরে পূর্ণাঙ্গরূপে প্রকাশিত হয়। গ্রন্থগুলির নাম ’লক্ষ্মণের শক্তিশেল’ (১৯১০) ’অতীতের ছবি’ (১৯২২) ’আবোল-তাবোল’ (১৯২৩), ’হ-য-ব-র-ল’ (১৯২৪), ’পাগলা দাশু’ (১৯৪০), ’বহুরূপী’ (১৯৪৪), ’জীবজন্তু’ (১৯৪৪) ’ঝালাপালা’ (১৯৪৪)। ’অন্যান্য রচনা’ প্রধানত ’সন্দেশ’-এ প্রথম প্রকাশিত হয়, পরে সুকুমার সমগ্রের অন্তর্ভুক্ত হয়।

রাক্ষস-খোক্কস, দৈত্য-দানো, ভূত-প্রেত, রূপকথার ঝাঁপি খুলে ইতোপূর্বে শিশুদের জন্য রঙ বেরঙের উপহার দেওযা হযেছে। উপেন্দ্রকিশোর রায়, যোগীন্দ্রনাথ সরকার, দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার, শিবনাথ শাস্ত্রী প্রমুখ যশস্বীরা থরে বিথরে সাজিয়ে তুলেছেন যে ডালি- সে ডালির ফুল ছিল ভিন্নতর। লোককথা, উপকথার বীজ, রামায়ণ-মহাভারতের গল্প, পুরাণের গল্প, ভূতের গল্প, রূপকথার মায়াময় জগতের কথায় ভরা সে জগৎ দূরের জগৎ। তাতে শিশুমন কল্পনাপ্রবন হত। অবাস্তব সৌন্দর্য চেতনায় বিমুগ্ধ হয়ে যেত।

সুকুমার রায় যে জগৎ সৃষ্টি করলেন সেখানে সুয়োরানী দুয়োরানী আর ভয়াবহ রাক্ষসরাজ্যের মায়ামোহ থেকে মুক্তি ঘটলো। সুকুমার রায়ই বাংলা শিশুসাহিত্যে প্রথম পরিপূর্ণ অসংলগ্ন রসজগৎ সৃষ্টি করলেন। আবোল তাবোলের জগৎ। এ জগৎ অবনীন্দ্রনাথের কল্পিত রঙীন জগতের রহস্য গভীরতা নিয়ে আসে নি। এ জগতে মায়া নেই, আছে আকর্ষণ। স্বপ্ন নেই কিন্তু সত্যও নেই। রূপকথা নয় অথচ রূপজ।

তাঁর রচনায উজ্জ্বল কৌতুক রসের সঙ্গে সূক্ষ্ম ব্যঙ্গাত্মক সমাজচেতনার এক অপূর্ব সংমিশ্রণ লক্ষ্য করা যায়। প্রচলিত রীতির

বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা তাঁর শিশু রচনায় দৃশ্যমান হয়। সুকুমার রায় সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ভাব, ভাষা এবং ছন্দেও দ্বারা

বিশেষভাবে প্রভাবিত হন। ১৯২১ সালে প্রকাশিত ‘মৌচাক’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যার শিশু কবিতার রচয়িতা সুকুমারের

ছন্দের অনুরূপ ছিল।

বিষয় বৈচিত্র্যের দিক থেকে তাঁর রচনাসমূহকে নিুলিখিত শ্রেণীতে ভাগ করা যায়,

বর্ণনামূলক – নদী কবিতা।

কৌতুকরস-ঝালাপালা (নাটক), অবাক জলপান (নাটক) ইত্যাদি।

হাস্যরসাত্মক-’আবোল-তাবোল’ কাব্যগ্রন্থের রচনাসমুহ, ’খাই-খাই’ কাব্যগন্থের রচনাসমূহ ইত্যাদি।

ভাবানুবাদ – হেঁশোরাম হুঁশিয়ারের ডায়েরী।

ছন্দসমৃদ্ধ – খাই খাই কবিতা।

পৌরানিক – মহাভারত ইত্যাদি।

¯মৃতিচারণ – শ্রীগোবিন্দ কথা. অতীতের ছবি ইত্যাদি।

জীব-জন্তু সম্পর্কীয়-সেকাল ও একালে জীব-জন্তুর তথ্যাদি, বিবিধ প্রবন্ধের রচনাবলী।

জীবনী – গ্যালিলিও, নোবেল, পাস্তুর ইত্যাদি মহৎ ব্যক্তিদের জীবনী।

ব্যাজ্ঞাত্মক – রামধন বধ (নাটক), লক্ষ্মণের শক্তিশেল (নাটক)।

ঐতিহাসিক – অতীতের ছবি।

চিত্রাঙ্কন – সুকুমারের প্রখর কল্পনাশক্তি ও রসিক মনের অপরূপ ভাষায় লেখা রচনার সঙ্গে তাঁর আঁকা ছবিসমূহ। হাঁসজারু,           হাতিমি বা হুঁকোমুখো হ্যাংলার ছবি।

’অন্যান্য কবিতা’র অন্তর্ভুক্ত কবিতা এ-যাবৎ কোন গ্রন্থে মুদ্রিত হয়নি।

আট বছর বয়সে সুকুমার রায়ের প্রথম বাল্য রচনা ’নদী’৩ রবীন্দ্রনাথের ’নদী’৪(১৩০২)র সঙ্গে তিনি পরিচিত ছিলেন বলে মনে হয় কেননা ’বাল্যগ্রন্থাবলী’র অন্তর্গত ’নদী’ কাব্যগ্রন্থটিকে চিত্রিত করার দায়িত্ব নিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ ও উপেন্দ্রকিশোর। উপেন্দ্রকিশোর কাব্যটির জন্য মোট সাতটি ছবি এঁকেছিলেন। নদীর যাত্রাপথের বাঁকে বাঁকে উদঘাটিত মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্যকে তুলি-কলমে আশ্চর্য দক্ষতায় ফুটিয়ে তুলেছিলেন উপেন্দ্রকিশোর। বালক কবির কল্পনায় সেই সচিত্র সরল নদী নিঃসন্দেহে স্বপ্নলোকের ছবি এঁকেছিল,

———————————-

পথে যেতে যেতে নদী দেখে কত শোভা,

কি সুন্দর সেই-সব কি-বা মনোলোভা।

কোথাও কোকিল দেখে বসি সাথী সনে,

কী সুন্দর কুহু গান গায় নিজ মনে,

কোথাও ময়ূরে দেখে পাখা প্রসারিয়া

বন ধারে দলে দলে আছে দাঁড়াইয়া!

——————————

পরের বছর এই পত্রিকার জৈষ্ঠ্য, দ্বিতীয় বর্ষের দ্বিতীয় সংখ্যা ১৩০৪, (১৮৯৬) ৫টিক্-টিক্-টং ঐরপশড়ৎু ফরপশড়ৎু, ফড়পশ নার্র্র্সারি রাইমের বঙ্গানুবাদ করেন। এই পত্রিকাতেই আশ্বিন ১৩১৩ সংখ্যায় তাঁর প্রথম গদ্যরচনা ’সূর্যের রাজ্য’৫ প্রকাশিত হয়।

ইংরেজ সভ্যতা ও শাসনতন্ত্রের ফলে আমাদের সাহিত্য ও সংস্কৃতির জগতে অপরিহার্য বদল এসেছিল। অ্যাডভেঞ্চার, গোয়েন্দা-কাহিনী, থ্রিলার শিশু সাহিত্যের বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছিল। তার সূত্রপাত সুকুমার রায়ের হাতেই হয়েছিল। কনান ডয়ালের খড়ংঃ ডড়ৎষফ (১৯১২), খবরিং ঈধৎৎড়ষষ-অররপব’ং ধফাবহঃঁৎব রহ ড়িহফবৎষধহফ (১৯৬৫), ঝরৎ অৎঃযঁৎ ঊফধিৎফ খবধৎ এর ঘড়হংবহংব ডৎরঃরহম’ং এর ইড়ড়শ ড়ভ ঘড়হংবহংব (১৮৪৬), ঔঁষবং ঠবৎহব (১৮২৮-১৯০৫) এর ঝপরবহপব ঋরপঃরড়হ অনুবা ঘটেছিল দ তখন, উধহহরবষ উবভড়ব (১৯৬০-১৭৩১)-র জড়নরহংড়হ ঈৎঁংড়ব(১৭১৯)-র বাংলা রূপ আমাদের শিশুসাহিত্যের জগতে নতুন আস্বাদ এনে দিয়েছিল। অজানাকে জানার কৌতুহল, ভয় আর আনন্দ মিশ্রিত অভিযান আর রহস্য রোমাঞ্চের চিরন্তন আকর্ষণে বাংলার শিশুরাও সাড়া দিয়েছিল। সুকুমার রায়র ‘অজানা দেশে’ এমনি একটি থ্রিলার।

সুকুমার রায়ই প্রথম বাংলা শিশুসাহিত্যে ’হিউমর’ বা হাস্যরসের যথাযোগ্য মর্যাদা দেবার চেষ্টা করেছেন। তা হচ্ছে ভাঁড়ামি

বা নাটকের দুই দৃশ্যেও মাঝখানে একটুখানি সঙের খেলা অথবা তীব্র শ্লেষে ভরা ব্যঙ্গরচনা। অবনীন্দ্রনাথের অনেক রচনায়

এমন শ্লেষ-শুন্য রসের অবতারণা দেখা যায়, কিন্তু তার রসরচনার মন কেমন করা ভাবের জন্য অনেক সময়ই হাসির সঙ্গে

কান্না পায়। কাজেই তাকে অনাবিল হাস্যরস বলা যায় না। আবার মাঝে মাঝে তাঁর অতিশয় উদ্ভট কল্পনা শক্তি এসে হাসির

রঙ্গমঞ্চে বাগড়াও দেয়। একথা ঠিক যে সুকুমার রায় বাংলার রসসাহিত্যে নতুন সুর বেঁধে দিয়েছিলেন, যদিও এই নতুন

সুরের মর্ম সবাই বোঝে না। সুকুমার নিজেই একটি নাটকে এমন কথা বলেছেন,

‘এসব কথা শুনলে তোদের লাগবে মনে

ধাঁধা কেউ বা বুঝে পুরো-পুরি, কেউ বা বুঝে আধা (কেই বা বুঝে না!)।

কলেজ পাঠ সমাপ্তির পর ১৯০৬ সালের দিকে সৃষ্টি হয় তাঁর ’নন্সেন্স ক্লাব’। সুকুমার সাহিত্যের মূলধারা প্রবাহের ইঙ্গিত ক্লাবের নামকরণেই নিহিত। ছোটদের হাসির নাটক লেখা ও নাটকে অভিনয় করার উৎসাহ তখন থেকেই আসে।  আত্মীয় বন্ধুদের নিয়ে গঠিত এই ক্লাবের জন্য লেখা দুটি নাটক-’ঝালাপালা’ ও ’লক্ষ্মণের শক্তিশেল’-এ সুকুমারের হাস্যরসের প্রথম আভাস পাওয়া যায়। ক্লাবের একটা হাতে লেখা পত্রিকা যার নাম ছিল ’সাড়েÑবত্রিশÑভাজা’। তিনি এখানে লেখার সাথে মজার মজার ছবিও আঁকতেন।

প্রথম নাটক হতেই তার মৌলিক প্রতিভার পরিচয় পরিস্ফুট হতে থাকে। ভাষাকে অবলম্বন করে হাস্যরসের সৃষ্টি সুকুমার সাহিত্যের একটি বৈশিষ্ট্য। ’ঝালাপালা’ নাটকের একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্তÑ পাঠশালার ছাত্র কেষ্টা পন্ডিতমশাইকে ইংরেজি কথার মানে জিজ্ঞাসা করছেÑ

কেষ্টাÑ ’আই গো আপ্ উই গো ডাউন মানে কি?

পন্ডিত। ’আই’Ñ’আই’ কিনা চক্ষুঃ, ‘গো’Ñগয়ে ওকারে গো-গৌ গাবৌ গাবঃ, ইত্যমরঃ। ’আপ‘ কিনা আপঃ     Ñসলিলং বারি, অর্থাৎ জল। গোরুর চক্ষে জল,  অর্থাৎ কিনা গরু কান্দিতেছে। কেন কান্দিতেছে? না, উই গো   ডাউন’, কিনা ’উই’ অর্থাৎ যাকে বলে উইপোকাÑ’গো ডাউন’ অর্থাৎ গুদামখানা। গুদামখানায় উই ধরে আর কিছু     রাখলে না, তাই না দেখে ’আই গো আপ’Ñ গরু কেবলই কান্দিতেছেÑ।

দ্বিতীয় নাটকটি অধিকতর সার্থক ও উপভোগ্য। ’লক্ষ্মণের শক্তিশেল’ নাটকে রামায়ণের কিছু চরিত্রকে মহাকাব্যের জগৎ থেকে টেনে নামিয়ে একেবারে রং তামাসার আসরে এনে ফেলেছেন। এ রামায়ণে পুঁইশাক চচ্চরি, বাথগেট কোম্পানি, হোমিওপ্যাথি, ব্যায়ামবীর স্যান্ডো, রেকারিং ডেসিম্যাল ইত্যাদি অকাব্যিক প্রসঙ্গ অনায়াসে স্থান পেয়ে গেছে। এমনকি হনুমান এখানে বাতাসা খায়, যমদূতের মাইনে বাকি পড়ে, সুগ্রীব জখম পায়ে ব্যান্ডেজ বাঁধে, বিভীষণের দাড়ির গন্ধ জাম্বুবানের বিরক্তি উদ্রেক করে। সঙ্গীত-রচয়িতা হিসেবেও সুকুমারের প্রথম পরিচয় এই নাটকে। সহজ সুরে সহজ ছন্দে রচিত গানগুলি নাটকের হাস্যরস চমৎকারভাবে ঘনীভূত করে। রামায়ণের চেনা গল্প থেকে নিছক হাসির মশলাটুকু বের করে নিয়ে সাজিয়ে গুছিয়ে উপস্থিত করেছেন। কাউকে অশ্রদ্ধা না করে সবাইকে নিয়ে শুধু একটু মজা করা হয়েছে। রসের রাজ্যে ছোট বড় মাত্রাজ্ঞান নেই, সত্যমিথ্যা নেই; সেখানে শুধু রসটুকুই সত্য আর বাকি সব তার আধার মাত্র। ‘লক্ষ্মণের শক্তিশেল’ আসলে মধ্যবিত্ত বাঙালি বাবুদের নিয়ে একটা মস্ত ঠাট্টা। নাটকগুলি ঘরোয়া পরিবেশে অভিনীত হয়। নাটকগুলির মেজাজ বয়স্কদের হলেও, ছোটদেরও উপভোগ করার মত।

রবীন্দ্রনাথের ‘হিং টিং ছট’ কবিতাতে পন্ডিত ধাঁধাঁর জবাব খুঁজতে গিয়ে নাস্তানাবুদ হয়ে যাবার পর এক সিড়িঙে ছোকরা এসে হাজির হয়েছিল ’যবন পন্ডিতের গুরুমারা চেলা‘। অথচ রবীন্দ্রনাথ অন্যত্র সর্বদা যেমনভাবে শৈশব সাধনার কথা বলেছিলেন, সুকুমার রায়ের শিশুরা তেমনিভাবে মোটেই কোন তত্ত্ব বা আইডিয়ার বাহন হয়ে নেই।Ñ কোনো রোমান্টিক কল্পনার আভাস তারা দেয় নাÑবরং সুকুমার রায়ের শিশুদের আমরা আমাদের আশেপাশেই সব সময় দেখতে পাই, কেউ চালাক, কেউ হিংসুটে, কেউবা মামার গল্প শোনায় সাতকাহন করে, আর তারা থাকে রোগা ভিস্তিওয়ালা, খেয়ার মাঝি, আগন্তুক পথিক ইত্যাদির সঙ্গেÑ ছেলেরা স্কুলে পড়ে, ফাঁক পেলে মাঞ্জা দিযে ঘুড়ি ওড়ায়, পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়ে, কালাচাঁদের ছবি দেখে ভারতশিল্পের ধোঁয়াটে ছবির সমালোচনা করে, নাটকে অভিনয় করতে দিলে সব ভন্ডুল করে দেয়, কাকতাড়ুয়া সেজে পাড়ার ছাদে আমসত্ত্ব পাহারা দেয়, মোটেই পেছনে খাবার রেখে অস্ত্রশস্ত্র ঢাল সমেত একদিকে তাকিয়ে পাহারা দেয় না। তারাই চালিয়াতি ধরতে পারে, বাগাধীশদের জব্দ করে, তারা মোটেই কোন নোটবই পড়েনি বলে দুন্দুভি বা অরণির মানে জানে না, তবে গোলপাকানো কথায় ঠিকানা চাইলে জানিয়ে দিতে পারে কোথায় কতবার মোড় ঘুরে যেতে হয় অকুস্থলে, কতরকম ডাইনে বাঁয়ে মোচড় মেরে।

সুকুমার রায় ফটোগ্রাফীর উপর পড়াশুনার জন্য বিলেতে অবস্থানকালে (১৯১১-১৯১৬) এবং দেশে ফেরার প্রথম বছরেই  পিতা উপেন্দ্রকিশোর রায় সম্পাদিত ’সন্দেশ’ (১৯১৩) পত্রিকায় লেখা অদ্ভূত মজার কয়েকটি কবিতা গল্প ছড়া ছবিসহ পাঠকদের অবাক করে দেয়। যোগীন্দ্রনাথ সরকারের(১৮৬৬-১৯৩৭) অপূর্ব কবিতার অনাবিল হাস্যস্রোতের সঙ্গে তাদের যথেষ্ট পরিচয় ছিল। লোকসাহিত্যর বাইরে নন্সেন্স ছড়া রচনার প্রাথমিক কৃতিত্ব যোগীন্দ্রনাথের। তাঁর সাহিত্যে কৌতুকরস ছিল, কিন্তু সুকুমার রায়ের হাস্যরস ধারার মত উচ্চকিত, হৃদয়খোলা মজা ছিল না। খেয়ালি ভাষায় খেয়ালি লেখা বাংলায় প্রথম লেখেন সুকুমার। তার হাস্যরসের বিশেষ অভিব্যক্তি প্রথম পাওয়া যায় তার পিতৃপ্রতিষ্ঠিত ’সন্দেশ’ (১৯১৩) পত্রিকায়। সত্যজিৎ রায় বলেন,

সুকুমারের হাসিতে শ্লেষ ছিল না, তবে ব্যঙ্গ ছিল। প্রয়োজনে প্রাণখোলা অট্টহাসিতে পেছপা হতেন না তিনি, এবং সেটাও তার স্বভাবেরই পরিচায়ক। সুকুমার রায়ের কৌতুকপ্রিয় মজলিসী মেজাজের কথা অনেকের কাছেই শুনেছি।

অবনীন্দ্রনাথের অপূর্ব খেয়ালি লেখার খেই ধরা সব সময় ছোটদের কর্ম নয় সুকুমারের কাছে তারা পেল সহজ ভাষায় লেখা সহজবোধ, স্বচ্ছ আজগুবী, যার মাথা মুন্ডু দিব্যি চেনা যায়। কোথাও এতটুকু অস্পষ্টতা বা কর্কশতা নেই; উদ্ভটত্ব থাকলেও সেটা বিভীষিকাময় নয়। এখানে সব কিছূ অদ্ভূত কিন্তু উৎকট নয়, বেয়াড়া কিন্তু বিকট নয়, সৃষ্টি ছাড়া কিন্তু ছন্দোময়।৬

’সন্দেশের’(১৯১৩) পাতায় প্রকাশিত সুকুমারের কয়েকটি রচনায় তাঁর সাহিত্যিক বৈশিষ্ট্যের আভাস পরিস্ফুট হতে থাকে। এই পত্রিকার পাতায় বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত ছবি ও অধিকাংশ কবিতাবলী নিয়েই তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনের শ্রেষ্ঠ কীর্তি প্রথম শিশুতোষ কাব্যগ্রন্থ ‘আবোল তাবোল’ (১৯ সেপ্টেম্বর, ১৯২৩) প্রকাশিত হয়। গ্রন্থের মজাদার মিল আর আজগুবি কথায় পাঠককুল আমোদিত হয়। এর প্রতিটি আঁচড় যেমন রসে টইটুম্বুর তেমনি অর্থে ভরা। এখানে শব্দের অসাধারণ শক্তি সম্বন্ধে তিনি সচেতন ছিলেন। বিভিন্ন দেশের লোককথা রচনার বিষয়বস্তু,

এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে সুকুমার রায় আবোল তাবোলের নাম দিয়ে বই লিখলেও, আবোল তাবোলের আবিষ্কারক তিনি নন, বরং সব দেশের লোককথা চিরকাল আবোল তাবোল দিয়ে ঠাসা।৭

অবনীন্দ্রনাথের অনেক লেখার মধ্যে শ্লেষশুন্য রসের অবতারণা দেখা যায়। কিন্তু তার রসরচনার মন-কেমন করা ভাবের জন্য অনেক সময়ই হাসির সঙ্গে কান্না পায়। কাজেই তাকে অনাবিল হাস্যরস বলা যায় না। আবার অনেক সময় তাঁর অতিশয় উদ্ভট কল্পনা শক্তি এসে হাসির সঙ্গে বাগড়াও দেয়। সুকুমার রায়ের রস রচনার স্রোত কাঁচের মত স্বচ্ছ।

অসংগতিকে খুলে দেখান সুকুমার রায়, গড়ে তোলেন ছন্দে-মিলে হাস্যরোলের এক জগৎ, রোজকার ব্যাকরণকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে লিখেন ‘আবোল তাবোল’ পর্যায়ের প্রথম কবিতা ‘খিচুড়ি’ (১৯১৪, বাং ১৩২২ মাঘ)। শিশুসাহিত্যে এই প্রথম প্রচলিত রীতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা এবং এই প্রথম সুকুমার সাহিত্যে উদ্ভট প্রাণীর আবির্ভাব, সঙ্গে স্বরচিত উদ্ভট ছবি। এখানে প্রাণীর সৃষ্টি হয়েছে ভাষার কারসাজিতে,

হাঁস ছিল, সজারু, (ব্যাকরণ মানি না),

হয়ে গেল ‘হাঁসজারু’ কেমনে তা জানি না।

…কবিতা রচনার পাশাপাশি তিনি তাঁর দক্ষ হাত দিয়ে উপযুক্ত ছবিও এঁকে দিলেন।

পত্রিকায় এই কবিতার প্রকাশনা বাংলা শিশুসাহিত্যে প্রচন্ড সাহিত্যিক বিস্ফোরনের সৃষ্টি হয়। তাঁর এই আজব দুনিয়ার যে সব উদ্ভট জীবজন্তুকে তিনি ছেড়ে দিলেন, তাদের দেখে সেদিনের কিশোর দুনিয়ায় প্রচুর আলোড়নের সৃষ্টি হল।

এর পরেই ’সন্দেশ’ পাঠকদের পরিচয় কাঠ-বুড়ো (১৩২২, ফাল্গুন) র সঙ্গে। এই কাষ্ঠতত্ত্ববিদ্ হলেন সুকুমারের অতি প্রিয় একটি বিশেষ শ্রেণীর চরিত্র। সংসারে উদ্ভট তত্ত্বে বিশ্বাসী বা উৎকট বাতিকগ্রস্ত লোকের অভাব নেই। এইসব লোকদের হাবভাবে মনে হয় এঁরা যেন আজগুবির রাজ্যে প্রবেশ করার জন্য পা বাড়িয়েই আছেন। সুকুমারের কল্পনা তাদের সে আকাঙ্খা পূরণ করেছে। ’আকাশেতে ঝুল ঝোলে, কাঠে তাই গর্ত’ এমন অদ্ভূত তত্ত্বে যিনি বিশ্বাসী, তাঁর প্রতি সমাজ কটাক্ষ করলেও, কাব্যে তাকে স্থান না দিয়ে উপায় নেই। আর তাঁর পাশেই একই পংক্তিতে স্থান দিতে হয় ছায়াধরার ব্যবসাদারকে, পুটোস্কোপের আবিষ্কর্তাকে, চন্ডীদাসের খুড়োকে, হেড আপিসের বড়বাবুকে।

’আবোল তাবোল’-এ সুকুমারের ছিল প্রখর কল্পনাশক্তি। রস জমাবার জন্য অদ্ভূত পরিস্থিতি পরিকল্পনায় তিনি ছিলেন অদ্বিতীয়। লেখা এবং আঁকা দুটি মিলিয়েই তিনি রস জমাতে পারতেন।

সুকুমার সবসময় এসব চরিত্রকে মানুষ হিসেবে কল্পনা করেননি। মাঝে মাঝে এরা কাল্পনিক চেহারা নিয়ে হাজির হয়েছে। এদের মধ্যে প্রথম আবির্ভাব হুঁকোমুখো হ্যাংলার ভাবখানা মানুষের, কিন্তু অঙ্গপ্রত্যঙ্গে জান্তব জগাখিচুড়ি। ছেলেভুলানো ছড়ার হাট্টিমাটিমটিম বা একানড়ের সমগোত্রীয় নন। ছড়ার এইসব উদ্ভট প্রাণীর কোনো চরিত্র-বৈশিষ্ট্য নেই বললেই চলে। একানড়ে এক কথায় এক ধরণের জুজু, আর হাট্টিমাটিম্টিম্ হলেন শৃঙ্গবিশিষ্ট পক্ষীবিশেষ। এই দু’একটি উদ্ভট জীব ছাড়া প্রাক্-সুকুমার বাংলা সাহিত্যে কাল্পনিক প্রাণীর কথা নেই। বিদেশী সাহিত্যে অবশ্যি সুকুমারের আগেই লুইস ক্যারল ও এড্ওয়ার্ড লিয়ার কিছু আজগুবি জানোয়ার সৃষ্টি করেছেন। ক্যারলের বিখ্যাত কবিতা জ্যাবারওয়ার্কি-র ব্রিলিগ বা বোরোগোভে সুকুমার মেজাজের খানিকটা আভাস পাওয়া যায় কিন্তু তাও একটা মূল পার্থক্য রয়ে গেছে। জ্যাবারওয়ার্কি-র প্রাণীগুলি এমনই এক কল্পনার জগতে বাস করে যে তাদের কার্যকলাপের বর্ণনা দিতে আনকোরা নতুন শব্দ ব্যবহার করতে হয়,

ঞধিং নৎরষষরহম ধহফ ঃযব ংষরঃযু ঃড়াবং

উরফ মুৎব ধহফ মরসনষব রহ যব ধিনব

অষষ সরসংু বিৎব ঃযব নড়ৎড়মড়াবং

অহফ ঃযব সড়সব ৎধঃযবং ড়ঁঃমৎধনব

লিয়ার একাধিক আজগুবি প্রাণী সৃষ্টি করে গেছেন। কিন্তু ডং, জাম্ব্লি, পব্ল, ক্লাঙ্গল, ওয়্যাঙ্গল, বু’বস-ওয়স্Ñএদের কাউকেই লিয়ার আমাদের চেনা-জানা জগতের খুব কাছে আসতে দেননি। এদের জগৎটা রূপকথারই জগৎ।

এদিকে হুুঁকোমুখোর বাস বাংলাদেশে। শুধু তাই নয়,

শ্যামাদাস মামা তার                আফিঙের থানাদার,

আর তার কেহ নাই এ-ছাড়াÑ

( হুঁকোমুখো হ্যাংলা )

ঠিক তেমনি, ’ট্যাঁশগরু’ অনায়াসে দেখা যায় হারুদের আপিসে, কিম্ভূত কেঁদে মরে ’মাঠপারে ঘাটপারে’, ’কুমড়োপটাশ’ও নিশ্চয়ই শহরের আশেপাশেই ঘোরাফেরা করেন, নইলে তাঁর সম্বন্ধে আমাদের এতটা সতর্ক হবার প্রয়োজন হত না। একমাত্র রামগরুড়ই সংগত কারণেই নিরিবিলি পরিবেশ বেছে নিয়েছে; কিন্তু সেও রূপকথার রাজ্যে নয়। অবশ্যি এদের জগৎটাকে ঠিক বাস্তব জগৎও বলা চলে না। এটা আসলে সুকুমারের নিজস্ব একটি জগৎ এবং এই জগতের সৃষ্টিই হল সাহিত্যিক সুকুমারের শ্রেষ্ঠ কীর্তি।

শব্দপ্রয়োগের সঙ্গে শব্দ গঠনেও মজা সৃষ্টির বৈশিষ্ট্য দেখা যায় সুকুমার রায়ের বিখ্যাত জন্তু জানোয়ারগুলির নামকরণের কৌশলে ’হাঁসজারু, বকচ্ছপ, কুমরোপটাশ, গোমরাথেরিয়াম, চিল্লানোসোরাস, হ্যাংলাথেরিয়াম, ল্যাংচাব্যাগনিস্ ইত্যাদি। সুকুমারের লেখায় বিশেষণের প্রয়োগ কাব্য সৌন্দর্যের গভীরতা সৃষ্টি করেনি, তা মজার আতশবাজিতে পূর্ণ। সে জগতে হলদে সবুজ ওরাং ওটাং, সর্দি কাশি হলদ জ্বর। সেখানে আদ্যিকালের সাদার নামই কালো আধাঁর ঘনজমাট তারেই বলে আলো, লাল গানে নীল সুর হাসি হাসি গন্ধ। এ পৃথিবী অফুরন্ত খুশীর পৃথিবী। হেথায় রঙীন আকাশতলে স্বপ্নদোলা হাওয়ায় দোলে সেই মেঘমুলুকের ঝাপসা রাতে। মক্ষীরাণী পক্ষী রাজ, দস্যি ছেলে লক্ষèী আজ। আদিম ——। রূপ এমনি করেই শিশুসাহিত্য জুড়ে আছে। ভাষা সেই রূপময় জগৎকে চিনিয়ে দিয়েছে।

ভাষা সেই দুর্র্র্র্র্র্লভ বস্তুর সন্ধান এনে দিয়েছে যা শিশুসাহিত্য পাঠের বড় আনন্দ। একদিক যেমন লৌকিক জগতের সঙ্গে ফ্যান্টাসির জগতের দূরত্ব সৃৃষ্টির জন্য শিশুসাহিত্যিকরা অপরিচিত ও অর্ধপরিচিত শব্দের প্রয়োগ করতে যেমন ম্যাগাথেরিয়াম, হ্যাংলাথেরিয়াম, অন্যদিক তেমনি পরিচিত শব্দে ফ্যান্টাসির জগৎ ভেঙ্গে প্রাত্যহিক জগতের ছবি দিয়ে বাস্তব গল্পের নৈকট্যও সৃষ্টি করেন। এখানে ভিত্তি বাস্তব কিন্তু বর্ণনার গুণে তা অসম্ভব মজার হয়ে ওঠে।

‘সন্দেশে’র অন্তর্ভুক্ত হত দেশ বিদেশের লোককথা উপকথা থেকে আরম্ভ করে ঘরোয়া ইস্কুলের গল্প। বাস্তব পটভূমিকায় লেখার কারণে সুকুমারের ইস্কুলের গল্পগুলো প্রানবন্ত ও সরস হয়ে উঠেছিল, সেগুলি শিশুদের কাছে উপভোগ্য ছিল। তিনি এসব গল্প লেখার প্রেরণা পেয়েছিলেন বিলেতি কিশোর পত্রিকা থেকে কিন্তু সুকুমারের গল্পগুলি ছিল খাঁটি বাঙালি। তবে সুকুমার রায় কোন নাটক বা স্কুলের গল্পেও মেয়েদের বিষয নিয়ে কোন কিছু লেখেননি। প্রথম মহাযুদ্ধ সূত্রপাতের সঙ্গে সঙ্গে ’সন্দেশ’ এর প্রকাশন শুরু হয়, কিন্তু কোন গল্প বা কবিতায় বিদ্বেষ বা হিংসার ছাপ পড়েনি। তার কারণ যুদ্ধের সঙ্গে ভারতের জনগনের খুব অল্পই সম্পর্ক ছিল।

’হ-য-ব-র-ল’র কাহিনী ও ’আবোল তাবোল’এর বহু কবিতার মত বহু কবিতার বহু পঙ্ক্তিতে আ্যাবসার্ড, ফ্যানটাসি, অস্পষ্ট রূপক, সামাজিক ব্যঙ্গের ছায়াপাত ঘটেছে। মনের অবচেতনে স্বপ্ন অনেক সময়য়েই ’উইয়্যার্ড’ এর (অদ্ভূত, অলৌকিক) জগৎ নির্মাণ করে, তাকেই সাধারণভাবে রূপকথা ও লোকছড়া রসে পরিণত করেছে। সুকুমার সাহিত্যে তারই বিশিষ্ট রূপ দেখা যায়। সুকুমার সাহিত্যে ননসেন্স, ফ্যানটাসি, রূপক, সামাজিক ব্যঙ্গ, বিশেষত অ্যাবসার্ড হাত ধরাধরি করে আছে। একটির থেকে অন্যটিকে অনেক সময়ই আলাদা করা যায না।

ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও ধর্মীয় কারণে এত রবীন্দ্রঘনিষ্ঠ হয়েও সুকুমার ভাষা ও ভাবে রবন্দ্রানুসারী হননি। বরং রবীন্দ্রনাথই শেষ বয়সে সুকুমারের (আসলে লিয়ারের) (১৮১২-৮৮) ’ননসেন্স ভার্স’-এর প্রবাহ এনে ’সে’ ও ’খাপছাড়া’র মতো বই রচনা করেছেন।

বাংলার কিশোর পাঠকদের কাছে ’লিয়রে’র ছড়ার বিচিত্র জগত বা ’ক্যারলে’র ’অ্যালিস-এর স্বপ্নরাজ্য’ তত পরিচিত নয়। তাদের সেই ক্ষতিপূরণ করেছিলেন সুকুমার। ক্যারলের রচনার অন্যতম কারণ তাঁর অভিন্ন হৃদয় বন্ধু ’জন টেনিয়েলে’র আঁকা ছবি। অ্যালিসের আজব দেশের নানা বিচিত্র ছবি টেনিয়েল দরদ দিয়ে জীবন্ত করে তুলে ধরেছিলেন বলেই তিনি বিশ্বব্যাপি একচ্ছত্র আধিপত্য পেয়েছিলেন, এমনকি অনেক সময় টেনিয়েল সাহেবের ছবিকে বাঁচাতে ক্যারল সাহেব নিজেই লেখার সংশোধন করেছেন। কিন্তু ছবি আঁকার ব্যাপারে সুকুমারকে কোন টেনিয়েল সাহেবের খোঁজ করতে হয়নি, তিনি তাঁর আজব দেশের হাঁসের পালক থেকে আরেকটি পালক খুলে নিয়ে এঁকেছিলেন ’হাঁসজারু’, ’হাতিমি’ বা ’হুঁকোমুখো হ্যাংলা’ বা ’ট্যাঁশ গোরু’ বা ’হিজি বিজ্ বিজ্’ বা ’চিলোনোসরাস’ ইত্যাদি। অন্যথায় পাঠকের পক্ষে বুঝতে অসুবিধা হত আসলেই বস্তুগুলি কি। তখন তাঁর অনেক রচনাই শিশু-কিশোরদের কাছে আজ ’প্রাগৈতিহাসিক শিলালিপি’র মত মনে হত।

বাংলা পয়ার পরবর্তী পর্বে সুনির্মল বসু, অন্নদাশঙ্কর রায় বা প্রেমেন্দ্র মিত্র ছন্দে মিলে শব্দ ব্যবহারের অভিনবত্ব দেখালেন বটে, কিন্তু যে বিচিত্র ও ব্যাখ্যাতীত অর্থের রসে উপর্যুক্ত রচনাগুলি উদ্ভাসিত, তা এঁদের ছড়ায় প্রায় নেই বললেই চলে। কারু-নৈপুণ্য ও কল্পনার আন্তরিক উদ্দামতা এক নয়।

নিছক অঙ্কন কৌশলে সুকুমার উপেন্দ্রকিশোরের সমকক্ষ ছিলেন না। কিন্তু কৌশলের অভাব সুকুমার পূরণ করেছিলেন দুটি দুর্লভ গুণের সাহায্যে। এক হল তার অসাধারণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা, আরেক হল অফুরন্ত প্রাণশক্তি।

সুকুমার সম্পাদক হওয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই একটি ছোট গল্প সন্দেশে বেরোয়, যেটি সত্যজিৎ রায়ের মতে তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনা। গল্পের নাম ’দ্রিঘাংচু’। এক রাজসভায় অকস্মাৎ এক দাঁড়কাক প্রবেশ করে গম্ভীর কন্ঠে ’কঃ’ শব্দটি উচ্চারণ করার ফলে সভাসদদের মধ্যে যে প্রতিক্রিয়া হয় তাই নিয়েই গল্পটি। গল্পের শেষে রাজামশাইকে দাঁড়কাকের সামনে দাঁড়িয়ে চার লাইনের একটি মন্ত্র উচ্চারণ করতে হয়,

হল্দে সবুজ ওরাং ওটাং

ইঁট পাট্কেল চিৎ পটাং

মুস্কিল আসান উড়ে মালি

ধর্মতলা কর্মখালি।

কিন্তু তিনি ‘ক’ নামক দ্রিঘাংচুর কোন সন্ধান পাননি এবং মন্ত্রেও কোন কাজ হয়নি।

খাঁটি ননসেন্সের এটি একটি সার্থক উদাহরণ। সুকুমার রায় ননসেন্সের এই বিশেষ রসটিকে ’খেয়াল রস’ নাম দিয়েছিলেন সে রসের কিছুটা আভাস পৃথিবীর সব দেশেই গ্রাম্য ছড়ায় পাওয়া যায়,

আইকম বাইকম তাড়াতাড়ি

যদু মাষ্টার শ্বশুর বাড়ি

রেন কম ঝমাঝম

পা পিছলে আলুর দম।

এজাতীয় ছড়ার প্রধান উদ্দেশ্য হল আলঙ্কারিক। হাসির চেয়ে ছন্দ ও শব্দঝংকারের দিকেই এর লক্ষ্য বেশি। খাঁটি সাহিত্যিক ননসেন্স যেভাবে গাম্ভীর্যের মুখোশ পরে হাসির উদ্রেক করে তার কোন লক্ষণ গ্রাম্য ছড়ায় পাওয়া যাবে না কারণ সে মেজাজটা একেবারে শিক্ষিত শহুরে মেজাজ।

গদ্যে এবং পদ্যে হাস্যরসের দৃষ্টান্ত বাংলা সাহিত্যে আদিকাল থেকেই রয়েছে। উইট এর নমুনা যেমন মঙ্গলকাব্যে বা ময়মনসিংহ গীতিকায় পাওয়া যায়, তেমনি হুতোম আলাল-বঙ্কিম-ঈশ্বর গুপ্তেও পাওয়া যায়। হাস্যরসিকদের লক্ষণ সুকুমারেও রয়েছে তবে তার ভাবটা ননসেন্সের। প্যান্-অনুপ্রাস অনোম্যাটোপিয়ার সাহায্যে হাসি যেমন আগে ছিল, তেমনি সুকুমারেও আছে। আলালে দেখি,

বেণীবাবু খান খাবু নাই গতি গঙ্গা

হুপহাপ্ গুপগাপ বেড়ে ওঠে দাঙ্গা।

বাবুরাম ধরে থাম ’থাম থাম’ করে

ঠক ঠক ঠক ঠক কেঁপে মরে ডরে।১৬/৮

এই জিনিসই সুকুমারের হাতে পড়ে হল,

ঠাস্ ঠাস্ দ্রুম দ্রাম্। শুনে লাগে খট্কাÑ

ফুল ফোটে? তাই বল! আমি ভাবি পট্কা!

শাঁই শাঁই পন্ পন্, ভয়ে কান্ বন্ধÑ

ওই বুঝি ছুটে যায় সে-ফুলের গন্ধ?

(শব্দকল্পদ্রূম)

সুকুমারের ননসেন্সের অনেকখানি সুকুমারেরই সৃষ্টি। প্রভাবের ক্ষেত্রে বাংলার হাসির ট্রাডিশনই শুধু নয়, বিদেশী সাহিত্য, পান্টোমাইম, চার্লি চ্যাপলিন, বিলিতি কমিক্স-সুকুমারের ননসেন্সের পুষ্টিসাধন করেছে। এ জাতীয় ননসেন্সের রসগ্রহণ বাঙালি পাঠক করতে পারবে কিনা সে সম্বন্ধে তাঁর সংশয় ছিল, তাই ’আবোল তাবোলে’র ভূমিকায় তাঁকে কৈফিয়ৎ দিতে হয়েছিল,

যাহা আজগুবি, যাহা উদ্ভট, যাহা অসম্ভব, তাহাদের লইয়াই এই পুস্তকের কারবার। ইহা খেয়াল রসের বই। সুতরাং সে রস যাঁহারা উপভোগ করিতে পারেন না, এ পুস্তক তাঁহাদের জন্য নহে।৯

উল্লেখ্য যে রবীন্দ্রনাথ তাঁর শেষ বয়সের উদ্ভট ছড়ার সংকলন ‘খাপছাড়া’১০তে এই ধরণের একটা কৈফিয়তের প্রয়োজন বোধ করেছিলেন। শুধু তাই নয়, সংকলনের প্রথম কবিতায়, আবোল তাবোলের ‘আয়রে ভোলা খেয়াল খোলা’-র মেজাজে পাগলামোর পরিবেশ সৃষ্টির উদ্দেশ্য পদ্যে একটি ভূমিকাও লিখেছিলেন।

খাঁটি ননসেন্সের মেজাজ রবীন্দ্রনাথের ছিল না বলে ’খাপছাড়া’ ছড়ার পাগলামোর প্রতিশ্রুতি রবীন্দ্রনাথ রক্ষা করতে পারেননি। রবীন্দ্রনাথের ছড়ার প্রথম লাইনেÑ’নাম তার ভেলুরাম ধুনিচাঁদ শিরত্থ’, তখন তার বক্তব্যের চেয়ে এই শব্দের সম্ভাব্য মিলের দিকে আমাদের কৌতুহল বেশী চলে যায়। রবীন্দ্রনাথ অবশ্যি তাঁর স্বাভাবিক সাবলীলতার সঙ্গেই আমাদের কৌতুহল মিটিয়েছেন, কিন্তু তার ফলে রচনার শৈলীগত দিকটা প্রকট হয়ে পাগলামির রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু যখন পড়ি,

রোদে রাঙা ইঁটের পাঁজা              তার উপর বসল রাজাÑ

ঠোঙাভরা বাদাম ভাজা খাচ্ছে কিন্তু গিলছে  না।

(ন্যাড়া বেলতলায় যায় ক’বার)

তখন ছন্দ আর মিলের বাহাদুরির চেয়েও যেটা আমাদের বেশি অবাক করে সেটা এই যে, ইঁটের পাজার সঙ্গে রাজার, বা রাজার সঙ্গে বাদাম ভাজার যে কোন সম্পর্ক থাকতে পারে সেটা আমাদের কল্পনাতেই আসেনা। এই উপলব্ধির সঙ্গে সঙ্গেই শব্দ ছন্দ ছবি সব মিলে এক আশ্চর্য নতুন অনুভূতি আমাদের সাধারণ কাব্য ও সাধারণ কৌতুকের জগৎ থেকে এক নতুন জগতে নিয়ে যায়। এরই সঙ্গে আমাদের কৌতুহল জেগে ওঠে ঠিকই, কিন্তু পুর্ব প্রত্যাশার কোন চেনা পথ ধরে কবির আগে এগিয়ে যাবার আর কোন উপায় বা আগ্রহ থাকে না, কারণ আমরা বুঝতে পারি যে পথটা একমাত্র কবিরই চেনা পথ।

‘আবোল তাবোলে’র সব ছড়াই ননসেন্সের শিরোপায ভূষিত নয়। বিখ্যাত ‘বাবুরাম সাপুড়ে’ ছড়াটির অর্থহীনতায় হাঁসি পেলেও এর আড়ালে লুকানো রয়েছে সমাজ ও ব্যক্তিগত টাইপের সমালোচনার কশাঘাত। কথায বলে শক্তের ভক্ত, নরমের যম। কঠিন প্রতিরোধের সামনে যে-মানুষের শিরদাঁড়া শিথিল হয়ে যায়, দুর্বলের প্রতি সে-মানুষই অত্যাচারে শতহস্ত। তাই দরকার হচ্ছে এক নির্বিরোধ রূপকের সম্পর্কে, যাকে ’তেড়ে মেরে ডান্ডা, করে দিই ঠান্ডা’।

সুকুমার রায় শুধু হাস্যরস বা ব্যঙ্গ গল্প, কবিতা লেখেননি। অতীত এবং বর্তমানের বৈজ্ঞানিক ও ঐতিহাসিক আবিষ্কার, আধুনিক সংস্কৃতির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ঘটনা, মানুষের সভ্যতার উপকরণে সংগৃহীত প্রয়োজনীয় উপাদান ইত্যাদি তথ্যবহুল সংবাদ ’সন্দেশ’ পত্রিকায় নিয়মিতরূপে এবং অত্যন্ত সরসভাবে পরিবেশন করেছেন। বিজ্ঞানের তথ্য নিয়ে লেখার মুশকিল এই যে, এককালের প্রতিপাদ্য পরবর্তীকালে বদলে যায়। বিভিন্ন ইওরোপীয গ্রন্থ বা পত্রপত্রিকা থেকেও এসব তথ্য আহৃত হয়েছে কিন্তু এই রচনার মূল্য অন্যত্র ঃ সেটি হচ্ছে লেখকের বলবার ভঙ্গীÑযে ভঙ্গী সুকুমারের সম্পূর্ণ নিজস্ব। তাছাডা উনিশ শতকের মধ্যভাগে আর বিশ শতকের প্রথমভাগে পাশ্চাত্ত্য জগতে বিজ্ঞান ও সভ্যতার অগ্রগতি নিয়ে যে বিস্ময় ও উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছিলÑএ দেশে শিক্ষিতজনের মধ্যেও তার  আলোড়ন লেগেছিল। এই লেখাগুলিতে অন্তর্নিহিত রয়েছে সেই একই আগ্রহ ও উদ্দীপনা – সুকুমার রায় কিশোর মনে তাকে সঞ্চারিত করতে চেয়েছিলেন। একই জিঞ্জাসা আর দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে সুকুমার রায় উপস্থিত করেছেন প্রতীচ্যের দার্শনিক বৈজ্ঞানিক তথ্যাদি। দেশ কাল জাতি ধর্মের অন্ধ কুসংস্কারকে যাঁরা অতিক্রম করতে চেয়েছিলেন প্রধানত সেইসব মনস্বীর প্রতি সুকুমারের বিশেষ পক্ষপাত ছিল।

এ ছাড়া চেনা অচেনা জীবজন্তু বিষয়েও লিখেছেন। বাংলা ভাষায় এক্ষেত্রে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী কেউ নেই।

সুকুমার রায় অপেক্ষাকৃত কিশোর সম্পর্কিত লেখায় বলিষ্ঠতার পরিচয় দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে সত্যজিৎ রায় বলেছেন,

বাবার সন্দেশের চেহারাটা ঠাকুর্দার সন্দেশের থেকে অনেক আলাদা হয়ে গেল। শিশুদের পত্রিকা থেকে হঠাৎ কিশোরদের পত্রিকা হয়ে উঠল।১১

’খাই খাই’-কাব্যগ্রন্থের অবতরণিকা হিসেবে যে ছোট্ট কবিতাটি লিখেছিলেন, সেটা সূত্রের কাজ করবে আমাদের কাছে,

এ সব কথা শুনলে তোদের লাগবে মনে ধাঁধাঁ,

কেউ বা বুঝে পুরোপুরি কেউ বা বুঝে আধা।

( কেউ বা বুঝে না )

কারে বা কই কিসের কথা, কই যে দফে-দফে

গাছের পরে কাঁঠাল দেখে তেল মেখো না গোঁফে।২১/১২

রোজকার অনুজ্জ্বল জীবনের হাসির বাখানি প্রতিদিনের বিরক্তিকর জিনিসগুলির মজার উপস্থাপন করেছেন যেমন,

চুপচাপ চারিদিকে ঝোপঝাড়গুলো,

আয় ভাই গান গাই, আয় ভাই হুলো।২২/১৩

রস জমাতে হলে শুধু পরিস্থিতি পকিল্পনা, চিত্ররচনা বা ভাবব্যঞ্জনা যথেষ্ট নয়, তার যোগ্য ভাষাও থাকা চাই। ভাব যেখানে রস জমাতে বিফল হয়, শুধু সেইখানেই ভাষা নিজের চাতুরি দিয়ে ঘাটতি পূরণের চেষ্টা করে একজন বিখ্যাত ইংরেজ লেখক বলেছেন-’মন যখন দেউলে হয়, লেখক তখন কথার খেলাতে নামেন।’ শব্দ-কল্প-দ্রুমেও আছে ঠাস ঠাস ফুলের গন্ধ। কথার খেলার চমৎকারিত্ব আছে ’খাই খাই’ কবিতায়। ’খাই-খাই’ কবিতা শুধু কথার খেলার জন্য নয়, এর প্রসাদগুণ অনেক উঁচুতে,

খাই খাই করো কেন, এস , বসো আহারেÑ

——————————-

আমিষ ও নিরামিষ চর্ব্য ও চোষ্য।

সুকুমার রায়ের আজগুবি জগৎ আমাদের এত সহজে নাড়া দেয় কারণ তিনি বাংলা ভাষার ঐশ্বর্য এবং বাগ্ধারার সদ্ব্যবহার করতে জানেন।— ’আবোল-তাবোল’, ’খাই-খাই’ এর জোর হলো খাঁটি বাংলার মূল শক্তি আবিষ্কারে। তাই সুকুমার রায়ের বইগুলির অবিস্মরণীয় সাহিত্যমূল্য ছেড়ে দিলেও ভাষাতাত্ত্বিকদের কাছে সেগুলি স্বর্ণখনি। শিক্ষার্থী এবং বৈয়াকরনের কাছে এদের আলাদা মূল্য আছে।১৪

অনুকার ধ্বনিনির্ভর কিছু কবিতা বাংলার শব্দাবলি বাংলা লৌকিক ছড়ার প্রাণ।

ইকড়ি মিকড়ি জামাই চিচিং

তায় পলো মাকড় বিচিংপৃ-১২৭/২৫/১৫

ধনাত্মক শব্দের সাহায্যে তিনি কখনো কোন প্রাণীর বর্ণনা দেন ‘বাবুরাম সাপুড়ে’ কবিতায়। কখনো বা প্রকৃৃতির

করে নাকো ফোঁস্ফাঁস্, মারে নাকো ঢুঁশ্ঢাঁশ্

’খাই-খাই’-কাব্যগ্রন্থের ’জীবনের হিসাব’ কবিতার ’মূর্খ মাঝি’টি ’বিদ্যেবোঝাাই বাবুমশাই’কে একটি প্রশ্ন করে কাবু করে দেয়; বাবুর জ্ঞানের বহর তাকে আদৌ কাত করতে পারে না। মাঝির সাঁতার জানো’র মত প্রশ্নে বাবুর মুখ দিয়ে একটি প্রশ্নেই কাবু করে দেয়; যৌক্তিকতাবাদী, আত্মকেন্দ্রিক বাবুটি ধারনাও করতে পারেননি যে ’অশিক্ষিত’ মাঝির কাছ থেকে তাঁর কিছু শিক্ষণীয় থাকতে পারে। কেবল যে বাবুটিকেই আক্ষরিক অর্থে স্তম্ভিত করে দেয় তা নয়, মূঢ়, ম্লান, মূক মুখে ভাষা জোগাবার বদলে তিনি নিজেই যে কেবল ভাষা হারিয়ে ফেলেন তা নয়, সেই তীক্ষ্ম মুখে প্রশ্নটি প্রতিষ্ঠিত বাচনের সঙ্গে তৈরি করে ফেলে একটি সংঘাতশীল সম্পর্ক। ঐ বাচনের আশ্রয়ে এতদিন বেশ নিশ্চিত নিরাপদভাবে জীবন কাটিয়ে এসেছেন বাবুমশাই। হঠাৎ অবলম্বনের সেই খুঁটিটি হারিয়ে তার কন্ঠরোধ হয়ে যায়, একেবারেই নির্বাক হয়ে পড়েন তিনি।

১৯১৫ সালে তাঁর পিতার মৃত্যুর পর ’সন্দেশ’ সম্পাদনার ভার পড়ে সুকুমারের উপর (মাঘ, ১৩২৪ সংখ্যা থেকে)। ১৯১৬-২৩ পর্যন্ত সুকুমার ’সন্দেশ’ সম্পাদনা করেন। পিতার আকস্মিক শুণ্যতাকে ভরাতে পত্রিকাটিকে চালাতে সুকুমারকে প্রায় সব্যসাচীর ভূমিকা নিতে হয়েছিল। পিতা উপেন্দ্রকিশোর অপেক্ষা অধিকতর সরসভঙ্গিতে এই পত্রিকাকে তথ্যসমৃদ্ধ ও চিত্তাকর্ষক করেন। পিতার অসুস্থতার সময় থেকে সন্দেশ-এর প্রয়োজনে সুকুমারের আঁকা লেখার পরিমাণও বেশী ছিল। লেখা ও আঁকার দিক দিয়ে তার শ্রেষ্ঠ কীর্তির প্রায় সবই শেষের আড়াই বছরের রুগ্নাবস্থায়। ছোটদের নাটকের নামকরণগুলিও কৌতুকরসে ভরপুর। যেমন ’অবাক জলপান’, ‘হিংসুটে’, ‘মামাগো’ ইত্যাদি।

’অবাক জলপান’ ১৯২০(জৈষ্ঠ্য, ১৩২৭), ‘হিংসুটে’, ভাদ্র ১৩২৭, ‘মামা গো’, চৈত্র ১৩২৭। নাটকগুলি সংক্ষিপ্ত ও সরস। স্কুল ও ক্লাবের নানা অনুষ্ঠানের জন্য নাটকগুলি লিখিত হয়। ’অবাক জলপান’ এর কাহিনীটি বেশ চমকপ্রদ। পথিক বিভিন্ন জনের কাছে জল চাইতে গেলে বিচিত্র সব কথা ও বিষয়ের অবতারনা হয়। বিভিন্ন রকম চাতুরি অবলম্বনে সে জলপানে সমর্থ হয়। ক্ষুদ্র পরিসরে সুকুমারের একান্ত স্বকীয় চমৎকারীত্ব ফুটে উঠেছে।

ছোটদের জন্য বড় গল্প, হ-য-ব-র-ল, ১৩২৯ সালের জৈষ্ঠ-ভাদ্র পর্যন্ত সংখ্যায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। পুস্তকাকারে প্রকাশিত ২২ সেপ্টেম্বর, ১৯২৪। উদ্ভট রসের গল্প।

ননসেন্সের এই শ্রেষ্ঠ নিদর্শনটি লুইস ক্যারলের ‘অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড’ দ্বারা অনুপ্রাণিত। এখানেও সেই ঘাসে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়া, সেই স্বপ্ন, সেইসব চেনা আধচেনা জানোয়ার ও মানুষ চরিত্রের মিছিল, ভাষা নিয়ে সামাজিক আচার নিয়ে আইন-কানুন নিয়ে সেই তির্যক রসিকতা, আর সবশেষে ঘুম ভেঙ্গে স্বপ্নের জগৎ থেকে সেই বাস্তবে ফিরে আসা। তফাৎ এই যে হ-য-ব-র-ল মেজাজে একেবারে বাঙালি; এতই বাঙালি যে অন্য কোন ভাষায় এর অনুবাদ কল্পনাই করা যায় না।

’হেশোরাম হুঁশিয়ারের ডায়ারি’ বৈশাখ-জৈষ্ঠ্য (১৩৩০) ’হ-য-ব-র-ল’র (বড় গল্প) সমসাময়িক। এ ধরণের উদ্ভট রস বড়দের চাইতে ছোটরা উপভোগ করে বেশী। এখানেও ননসেন্স, কিন্তু এর মেজাজটা প্যারডির, এবং এই প্যারডির লক্ষ্য হল কোনান ডয়েল রচিত অ্যাডভেঞ্চার উপন্যাস দ্য লস্ট ‘ওয়ার্ল্ড’। ডয়েলের গল্পে বিশ শতকের প্রফেসর চ্যালেঞ্জার দক্ষিণ আমেরিকার আমাজন অঞ্চলে এক অজ্ঞাত জগৎ আবিষ্কার করেন যেখানে প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীরা এখনো বসবাস করছে। সুকুমারের গল্পে চ্যালেঞ্জার হয়ে গেলেন প্রফেসর হুশিয়ার, আর ঘটনাস্থল হয়ে গেল কারাকোরাম পর্বতের এক অনাবিস্কৃত অংশ। এখানেও প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীর ছড়াছড়ি, কিন্তু এদের কোন উল্লেখ প্রাণিবিদ্যা বা জীবতত্ত্বের কোনো বইতে পাওয়া যাবে না। একমাত্র সুকুমারই এদের চেনেন এবং বাংলা ও ল্যাটিন মিলিয়ে এদের নামকরণ একমাত্র তাঁর পক্ষেই সম্ভব। এদের চেহারাও সুকুমার এমন বিশ্বাসযোগ্যভাবে এঁকেছেন যে যাদুঘরে গিয়ে ল্যাগ্Ÿাগর্নিস, কট্কটোডন, চিলানোসরাস বা গোমরাথেরিয়ামের কঙ্কাল দেখতে না পেয়ে ভারি আশ্চর্য লাগে।

‘আবোল-তাবোল’ গ্রন্থের শেষ কবিতা ‘আবোল-তাবোলে’ নিজের মৃত্যু নিকটবর্তী জেনেও সুকুমার রায় রসিকতা ছেড়ে ছড়া কাটেন,

আদিম কালের চাঁদিম হিম,

তোড়ায় বাঁধা ঘোড়ার ডিম।

ঘনিয়ে এল ঘুমের ঘোর,

গানের পালা সাঙ্গ মোর।

তিনি একদিকে ’আবোল-তাবোল’, ’হযবরল’, ’হেঁশোরাম হুুঁশিয়ারের ডায়েরি’ ও  অন্যান্য বহু কবিতায় বিচিত্র শব্দসৃষ্টি ও উদ্ভট খেয়াল রসের বন্যা বইয়ে দিলেন, অন্যদিকে কিশোর হৃদয়ের ’দুরন্ত রাজা’, ’পাগলা দাশুর’ আবির্ভাব ঘটালেন। তখনকার ’সন্দেশ’ এর পাতায় এ ছিল এক অভিনব ভোজ! বাংলা সাহিত্যে এর আগে ও পরে ’ইস্কুলের গল্প’ অনেক বেরিয়েছে  কিন্তু পাগলা দাশু এন্ড কোম্পানীর ভূমিকা ছিল অম্লান। তখনকার দিনে শিশু-কিশোরদের পত্রিকা ’সন্দেশ’ ছিল একটি আদর্শ পত্রিকা। উপেন্দ্র-কিশোর ধারার পত্রিকা যুগোপোযোগী হয়েছিল।

বিশটি গল্পের সমাহারে ‘পাগলা দাশু’ (২২ নভেম্বর, ১৯৪০) বিষয় সব স্কুলের ছেলে। দু’ একটি স্ত্রী চরিত্র ছাড়া বিশেষ কোন চরিত্র নেই। গল্পটি নিটোল একটি শিল্পকর্ম। সমসাময়িক রচনা ‘বহুরূপী’ সুকুমার রায়ের উল্লেখযোগ্য গল্পসংগ্রহ শিশুপাঠ্য ছোটগল্প।  গল্পগুলি রূপকথার ঢঙে লেখা।

শুধু গল্প কবিতা নয়; নানা বিষয়ে চিত্তাকর্ষক প্রবন্ধ, বিশ্বের খুঁটিনাটি খবর, দেশ বিদেশের উপকথা, স্বরচিত ধাঁ ধাঁ, হেঁয়ালি ইত্যাদিতে সুকুমার রায় ’সন্দেশে’র পাতা ভরে রাখতেন। বিষয়ের বৈচিত্র্যে বিশ্লেষণী সংজ্ঞায় এই সময়কার ‘সন্দেশে’  চিরন্তনতার নির্দেশ পাওয়া যায়। ’স্কুল স্টোরি’ বাংলায় সন্দেশের আগেও লেখা হয়েছে, কিন্তু পাগলা দাশু ইত্যাদি গল্পেই সুকুমার প্রথম দেখিয়ে দিলেন এসব গল্প কেমন হওয়া উচিত। দাশুর গল্পে ‘চারু ও হারু’(১৯১২)২ সুলভ ভাবালুতা ও নৈতিক উপদেশ খুঁজতে যাওয়া বৃথা। দক্ষিণারঞ্জনের ‘ফাস্ট বয়’, ‘লাষ্ট বয়’ এর মত সুকুমার রায়ের চরিত্ররা আদৌ ভদ্র বা শান্তশিষ্ট নয়, তারা রাখালদের জগতের বাসিন্দা: গোপালদের ধরাবাঁধা ছককাটা নিক্তিমাপা রীতিনীতিকে পদে-পদে আক্রমন করে তারা, ‘ভালো ছেলে’র সমাজমান্য সংজ্ঞাটাকেই পরিহাসযোগ্য করে তোলে বরং চীনে পট্কার সাহায্যে পন্ডিতমশাইকে কীভাবে অপদস্থ করতে হয় তার ইঙ্গিত পাওয়া যেতে পারে। ’দাশুর ঢলঢলে পায়জামার মতো পেন্টেলুন’ আর ’তাকিয়ার খোলের মতো কোট’ পরিধানে সহপাঠিদের প্রশ্নে, ’পেন্টেলুন পরেছিস কেন’ প্রশ্নোত্তরে দাশুর উত্তর ’ভালো করে ইংরিজি শিখব বলে’ ’কিম্ভূতকিমাকার পোশাকের শয্যায়’। ‘কালাচাঁদের ছবি’, ’নন্দলালের মন্দ কপাল’ও এই ধারারই পরিচয় বহন করে।

রবীন্দ্রনাথ এর ভূমিকায় প্রশংসাসূচক মন্তব্যে লিখেন,

সুকুমারের লেখনী থেকে যে অবিমিশ্র হাস্যরসের উৎসধারা বাংলা সাহিত্যকে অভিষিক্ত করেছে তা অতুলনীয়। তাঁর সুনিপুণ ছন্দের বিচিত্র ও স্বচ্ছল গতি, তাঁর ভাব সমাবেশের অভাবনীয় অসংলগ্নতা পদে পদে চমৎকৃতি আনে। তাঁর স্বভাবের মধ্যে বৈজ্ঞানিক সংস্কৃতির গাম্ভীর্য ছিল সেইজন্যই তিনি তার বৈপরিত্য এমন খেলা ছলে দেখাতে পেরেছিলেন। বঙ্গ সাহিত্যে ব্যঙ্গ রসিকতার উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত আরো কয়েকটি দেখা গিয়েছে, কিন্তু সুকুমারের আগে হাস্যোচ্ছাসের বিশেষত্ব তাঁর প্রতিভার যে স্বকীয়তার পরিচয় দিয়েছে তার ঠিক সমশ্রেণীর রচনা দেখা যায় না।’৪/২৯/১৬

’সন্দেশ’ পত্রিকা থেকে আরো কিছু গল্প নিয়ে সিগনেট প্রেস ’বহুরূপী’ (১৯৪৪) গ্রন্থ প্রকাশ করে। পুস্তকটি শ্রী সত্যজীৎ রায় চিত্রিত করেন।

জীবজন্তু-১৯৭৪, অক্টোবর

সুকুমার শিশুসাহিত্যের গল্পগ্রন্থে ’বাজে গল্প’, ’হাসির গল্প’ ও ’হেঁশোরাম হুঁশিয়ারের ডায়েরি’ ইত্যাদি গল্পের অধিকাংশই বিদেশী গল্পের ভাবানুবাদ, কিছু পৌরাণিক গল্পের ভাবানুবাদ রয়েছে আবার ভারতবর্ষের অন্যরাষ্ট্রের গল্পের অনুবাদও রয়েছে।

’হেশোরাম হুঁশিয়ারের ডায়েরি’ ডায়রি আকারে লেখা রস রচনা। অদ্ভূত সব জন্তুর কথা এবং তাদের শিকারের কাহিনীর বিচিত্র উপায়ের কথা লিখেÑসত্য মিথ্যা বিচারের ভার পাঠকের উপর ছেড়ে দিয়েছেন,

প্রফেসর হূঁশিয়ার আমাদের উপর ভারি রাগ করেছেন। আমরা সেকালের জীবজন্তু সম্বন্ধে নানাকখা ছাপিয়েছি ; কিন্তু কোথাও তাঁর অদ্ভূত শিকার কাহিনীর  কোনো উল্লেখ করি নি। সত্যি এ আমাদের ভারি অন্যায়। আমরা সে সব কাহিনী কিছুই জানতাম না। কিন্তু প্রফেসর হুঁশিয়ার তাঁর শিকারের ডায়েরি থেকে কিছু কিছু উদ্ধার করে আমাদের পাঠিয়েছেন। আমরা তারই কিছু কিছু ছাপিয়ে দিলাম। এ-সব সত্যি কি মিথ্যা তা তোমরা বিচার করে নিয়ো।

উপেন্দ্রকিশোর যেমন একসময়ে রামায়ণের শিশুপাঠ্য পদ্যানুবাদ করেছিলেন, সুকুমার রায়ও মহাভারতের পদ্যানুবাদ করার কথা ভেবে পৌরানিক কাহিনী অবলম্বনে ’মহাভারত’ কবিতার মালায় গাঁথতে চেয়েছিলেন কিন্তু তাঁর অকাল মৃত্যুতে সেই মালাটি অসমাপ্ত রয়ে গেছে।

’বিবিধ প্রবন্ধে’র অধিকাংশ রচনাবলী বিভিন্ন জীব-জন্তু সম্পর্কিত, এবং বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লেখা।

ব্রাম্ম সমাজের ধর্মীয় চেতনা তাঁর সত্তায় ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিল। মৃত্যুর অল্প কিছু আগে তিনি রচনা করেছিলেন ’অতীতের ছবি’র মত শ্রদ্ধার্ঘ। তার মন শেষ পর্যন্ত সহজাত ধর্ম ও আধ্যাত্মিক চেতনাকেই পুনর্বার আশ্রয় করেছিল। দৃশ্যত হাস্যরসিক যে সুকুমারের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ব্রাম্মধর্ম ও ব্রাম্মসমাজ তাঁর সত্তার অনেকখানি অংশ জুড়ে ছিল। মৃত্যুর কিছু সময় আগে লেখা ’অতীতের ছবি’ নামক দীর্ঘ কবিতাটি তারই দৃষ্টান্ত।

সমাজের আদিপর্বের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস তাকে যেমন উদ্বুদ্ধ করত, তেমনি তাকে হতাশ করত সমকালীন কিছু আদর্শ চ্যুতির দৃষ্টান্ত। ছোটদের পদ্যে ব্রাম্মসমাজের ইতিহাস ’অতীতের ছবি’-প্রসঙ্গে কালীকৃষ্ণ ঘোষের একটি চিঠির শেষ কয়েকটি ছত্রে এই কারণেই বোধহয় একটা হতাশার সুর লক্ষ্য করা যায়। ’অতীতের ছবি’ সুকুমার রায়ের প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ। বইটি বিনামূল্যে বিতরণের জন্য মুদ্রিত ক্ষুদ্রকায় পুস্তিকা। কোন সন তারিখ উল্লিখিত নেই। এই গ্রন্থকে কেন্দ্র করে সুকুমার রায়কে লিখিত কালীকৃষ্ণ ঘোষের একটি চিঠির উল্লিখিত তারিখ ২৫ মাঘ, ১৩২৯। ১৯২২ সালের জানুয়ারী মাসে  সাধারণ ব্রাম্মসমাজের ’মাঘোৎসব’ সপ্তাহের অন্যতম অনুষ্ঠান বালক বালিকা সম্মেলন উপলক্ষে পুস্তিকাটি প্রকাশিত ও বিতরিত। রাজা রামমোহন রায় থেকে শুরু করে কালীনারায়ণ গুপ্তের  দেশ ও সমাজে তাদের অবদানের কথা উল্লেখ করেছেন।

পূর্বসুরীদের প্রতি শ্রদ্ধা ও বিনম্র উল্লেখ সুকুমারের ’অতীতের ছবি’তে দৃষ্টিগোচর হয়। একাবলী ছন্দে লেখা ব্রাম্মসমাজের ভাবাত্মক ইতিহাস। কবিতাটির প্রথম পর্যায়ে মানুষের প্রথম জীবন ও জগৎ জিজ্ঞাসা ও ঈশ্বরানুভূতির কথা বলেছেন। এভাবে বিভিন্ন পর্যায়ে ঔপনিষদিক ব্রম্মানুভূতি, ব্রাম্মন্য ভাবধারার বিস্তার, শাস্ত্র ও তর্কের ব্যাসকুট, কুসংস্কার ও আচারে আবদ্ধ গতিহীন সমাজ, বিদেশী শক্তির ভারত অধিকার, রামমোহনের আবির্ভাব, ‘মূরতিবিহীন’ ঈশ্বরোপাসনা ও ব্রাম্মসমাজের জন্ম, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের পিতামহীর শেষক্রিয়ার সময় একটি ছিন্নপত্রের শোক পাঠে আধাত্ম অনুভূতির জন্ম ও ব্রাম্মসমাজে যোগদান, কেশব সেনের আবির্ভাব, সাধারণ ব্রাম্ম সমাজ ও এই সমাজের অসংখ্য ত্যাগব্রতী বিশিষ্ট কর্মীবৃন্দের আবির্ভাব Ñসশ্রদ্ধচিত্তে উল্লেখ করেছেন,

সাধু রামতনু জ্ঞানে প্রবীণ,

শিশুর মত চির নবীন।

শিবচন্দ্র দেব সুধীর মন,

কর্মনিষ্ঠায় সাধু জীবন।

নগেন্দ্রনাথের যুকতি বাণে

কূট তর্ক যত নিমেষ হানে।

———————

দুর্গামোহনের জীবনগত

সমাজের সেবা দানের ব্রত।

দ্বারকানাথের স্মরণ হয়

ন্যায়ধর্মে বীর অকুতোভয়।

সাত পৃৃৃৃৃৃৃষ্ঠাব্যাপী কবিতা

মনীষীদের জীবনী লেখার যে প্রবণতা গড়ে উঠেছিল উনিশ শতকের শেষভাগে তারই অবলম্বনে লিখেছেনÑডেভিড লিভিংস্টোন, পাস্তুর, সক্রেটিস, ফ্লরেন্স নাইটিঙ্গেল, অজানা দেশে, গ্যালিলিও, আর্কিমিডিস, কলম্বস, সামান্য ঘটনা, ডারুইন, খোঁড়ামুচির পাঠশালা, পন্ডিতের খেলা। নোবেলের দান, জোয়ান, দানবীর কার্নেগী, পিপাসার জল।

সমা- পূর্ববর্তী শিশুসাহিত্যের কিছু লক্ষণ তাঁর রচনায় ইতস্তত পাওয়া যায় কিন্তু পিতার সাহিত্যিক উত্তরাধিকারকে অবলম্বন করে বাল্যবঙ্গে এক নতুন জোয়ার এনেছিলেন সুকুমার রায়। বাংলা শিশুসাহিত্যে এটি ছিল এক নতুন ধরণের বিদ্রোহ। সুকুমারের বিশেষত্ব  হাস্ব্যোচ্ছাসে, এই নতুন পর্বের অগ্রপথিক সুকুমার রায়। আপন স্বাতন্ত্র্যে উজ্জ্বল হয়ে আছেন বাংলা শিশুসাহিত্যে।

বিশ শতকের শিশু কিশোরের সাহিত্যিক ভাষার দিগদর্শন সুকুমার দিয়েছিলেন। শুধু তাই নয় ’কিশোর মনের কৌতুহলের চেহারা’৪র একটা স্পষ্ট ধারণা আজকের পাঠকের কাছেও কম মূল্যবান নয়। সেদিক থেকে এর ঐতিহাসিক মূল্যও অনস্বীকার্য। কিন্তু সম্পাদক হিসেবে সুকুমার কিশোর-মনকে আকর্ষণ করার জন্য, তাদের ’মনের ভোজ জোগাবার জন্য’৫যে-সব লেখা লিখে গেছেন তার তথ্যমূল্য আজ অনেক ক্ষেত্রেই নেই। উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন  সুকুমার রায়।

সুকুমার রায় এই শিক্ষাব্যস্থার মধ্যেই অন্যরকম একটি শিক্ষার অবকাশ ও সুযোগ করে দিলেন-এই জগতের মধ্যেই আরেকখানা জগৎ।

মহাভারত, বাঙালি ঐতিহ্য রূপায়নে আলোচিত কবিতামালায় ভারত-গাথা এবং হিন্দু মনীষীদের জীবনধারা বর্ণনা করেছেন।

শব্দগঠনে, শব্দপ্রয়োগে, ভাষার দুর্লভ বস্তুর সন্ধানে সুকুমার রায় ফ্যান্টাসির জগতের যে সন্ধান দিলেন

 

পাদটীকা

১। সুকুমার রায় লীলা মজুমদার,পৃ-২২। নাটকটির কপি পাওয়া যায়নি তবে তার বোন পুন্যলতা চক্রবর্তী স্মৃতিকথায়                      উল্লেখ করেছেন, পৃ-২১(সুকুমার, লীলা মজুমদার)।

২। ঐ

৩। শিবনাথ শাস্ত্রী প্রতিষ্ঠিত ’মুকুল’ ১৮৯৬ পত্রিকায় জৈষ্ঠ্য’ ১৩০৩।

৪। নদী-রবীন্দ্রনাথ

৫। মুকুল পত্রিকার জৈষ্ঠ্য, দ্বিতীয় বর্ষের দ্বিতীয় সংখ্যা ১৩০৪, (১৮৯৬)(মুকুলের পাঠক-পাঠিকারা সাধারণভাবে ইংরেজী শেখায় অভ্যস্ত ছিলো মনে হয়)

৬। ভূমিকা লেখক, সত্যজিৎ রায়, (সুকুমার সাহিত্যসমগ্র, প্রথম খন্ড)১/৭/৬

৭। সুকুমার রায় লীলা মজুমদার,পৃ-৩/৮/৭

৮। আলাল

৯। ’আবোল তাবোলে’র ভূমিকা, সত্যজিৎ রায়, সুকুমার সাহিত্যসমগ্র, প্রথম খন্ড, সম্পাদক, সত্যজিৎ রায় ও পার্থ বসু, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা ৯।

১০। খাপছাড়া, খাপছাড়াÑ১৬, রবীন্দ্র-রচনাবলী, একবিংশ খন্ড কলিকাতা, বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ।

১১। নন্দন পেক্ষাগৃহ ১৬মে ১৯৮৬, সন্দেশের রজত জয়ন্তী উৎসবের ভাষণ। সূত্র প্রণব কুমার মুখোপাধ্যায়। ’সন্দেশ’ সম্পাদক২০/১২/১১

১২। খাই খাই গ্রন্থেও অবতরণিকা

১৩।

১৪। সুকুমার, লীলা মজুমদার, প্রকাশক, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ, পশ্চিম বঙ্গ সরকার, প্রথম প্রকাশ মে ১৯৮৯।

১৫। লৌকিক ছড়া

১৫। পৃ-১২৭/২৫/১৫

১৬। রবীন্দ্রনাথ

 

 

 

২।  চারু ও হারু (১৯১২)-দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার। দক্ষিণারঞ্জন রচনাসমগ্র, ১, ২, কলিকাতা মিত্র ও ঘোঘ পাবলিশার্স

প্রাঃ লিঃ, ১৩৮৮।

মৌচাক-১৯২১

৪। সুকুমার রায় সমগ্র রচনাবলীঃ সম্পাদনায় সমীর মৈত্র, এশিয়া পাবলিশিং কোম্পানী, ১৩২, ১৩৩ কলেজ স্ট্রীট মার্কেট,            কলিকাতা-৭০০ ০০৭, ১৯৭৫।

৫। সুকুমার রায় জীবনকথা, হেমন্তকুমার আঢ্য, প্রকাশ, মহালয়া ১৩৯৭ প্রকাশক পাইওনীয়ার পাবলিশার্স ঃ ৪৪/১ বি                 বেনিয়াটোলা লেন, কলকাতা ৭০০ ০০৯।

সুকুমার রায় লীলা মজুমদার, মিত্র ও ঘোষ ১০ শ্যামাচরণ দে ষ্ট্রীট, কলিকাতা ১২, প্রথম প্রকাশ, শ্রাবণ-১৩৭৬।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

সপ্তম পরিচ্ছেদ

সুনির্মল বসুর শিশুসাহিত্য

(১৯০২ – ১৯৫৭)

 

সুনির্মল বসু ২০শে জুলাই (১৯০২), খ্রীষ্টাব্দে মামাবাড়ী গিরিডির মকৎপুরে জন্মগ্রহন করেন। পৈত্রিক নিবাস ঢাকা জেলার মালখাননগর। তাঁর দাদামশাই ছিলেন স্বদেশী যুগের খ্যাতনামা বিপ্লবী ও সাহিত্যিক মনোরঞ্জন গুহঠাকুরতা। পাহাড়িয়া পাখী ছদ্দনামে তিনি কবিতা লিখতেন। তাঁর সান্নিধ্যেই শৈশব কাটে সুনির্মল বসুর। সুনির্মলের দাদামশাই এবং পিতা পশুপতি ঠাকুরের ছিল অভ্রের ব্যবসা। উত্তরাধিকার সূত্রে দাদামশায়ের সাহিত্যপ্রতিভা তিনি পেয়েছিলেন। শৈশব ও কৈশোরে লালিত গিরিড়ির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং পরিবেশ সুনির্মল বসুর  রচনায় বিশেষভাবে প্রতিফলিত হয়েছিল।

বিশের দশকে উপেন্দ্রকিশোর রায় (১৯১৫) ও ত্রিশের দশকে সুকুমার রায়ের মৃত্যু(১৯২৩)র পর বাংলা শিশুসাহিত্য কিছূদিনের জন্য তার অদম্যগতি হারিয়ে ফেলে। রবীন্দ্রনাথ শিশুসাহিত্যের লেখা ছেড়ে পূর্ণ সাহিত্যের দিকে মনোনিবেশ করেছেন। অবনীন্দ্রনাথও ভাব  প্রকাশের জন্য তুলিকেই শ্রেষ্ঠ মনে করে শিশু লেখা ছেড়ে দিয়েছেন। তাৎক্ষনিকভাবে শিশুসাহিত্যের অভাব পরিলক্ষিত হতে থাকে। শিশুসাহিত্যের এই দুর্দিনে কিছূসংখ্যক উৎসাহী লেখক বাংলার শিশুসাহিত্যকে সঞ্জীবিত রাখার প্রয়াসে ব্রতী হনÑসুনির্মল বসু তাঁদের অন্যতম। তিনি অতি শৈশবকাল থেকে সাহিত্যিক পরিবেশের মধ্যে বড় হয়ে ওঠেন। ছেলেবেলায় হাসি-খুসি, মোহনভোগ, হিতোপদেশ, পদ্যমেলা জাতীয় বই তাঁকে প্রচুর আনন্দ দিত ঐ ধরণের বই লিখবার জন্য বাল্যকালেই উৎসাহ বোধ করতেন। এ বিষয়ে কবি নিজেই লিখেছেন,

এইসব বইগুলো আমার মনকে প্রবলভাবে আন্দোলিত করত। আমি লুকিয়ে লুকিয়ে রাত্রিবেলা মশারির বাইরে মোমবাতি জ্বালিয়ে ঐ ধরণের বই লিখতে চেষ্টা করতাম।১

১৯২০ সালে পাটনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষা উত্তীর্ণ হয়ে কলকাতার সেন্ট পল্স কলেজে ভর্তি হন। কিছুদিন পর গান্ধীজীর অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। কর্পোরেশন স্ট্রীটে ’সরকারী আর্ট স্কুলে’ এবং অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ’ওরিয়েন্টাল স্কুল অফ্ আর্ট’-এ ছবি আঁকা শিখেন এবং চিত্রশিল্পের চর্চা করেন। তিনি উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী সম্পদিত ’সন্দেশ’২ পত্রিকা দ্বারা প্রত্যক্ষভাবে প্রভাবিত হন। তাঁর উক্তিতে,

এই ’সন্দেশ’ই আমার জীবনে একটা রঙিন আনন্দময় জগৎ নিয়ে এলো। কী সুন্দর ছবি, গল্প, কবিতা, ধাঁধা আমায় যেন নতুন এক রাজ্যে নিয়ে গেল।৩

’সন্দেশে’ প্রথম তাঁর নাম ছাপা হয় ধাঁধার উত্তরদাতা হিসেবে। পরবর্তীতে তিনি এর গোষ্ঠীভুক্ত লেখক হন। এই পত্রিকার ’মুন্সিজী’৪ নামে তাঁর একটি হাস্য রসাত্মক স্বচিত্রিত গল্পই সম্ভবতঃ তাঁর প্রথম প্রকাশিত শিশু রচনা। এরপর ক্রমে ক্রমে পরবর্তী সংখ্যাগুলোতে তাঁর কাব্য প্রকাশিত হতে থাকে। এই পত্রিকাখানিতেই তাঁর সৃজনীশক্তির প্রতিশ্রুতি বা পরবর্তীকালে শিশুসাহিত্যের দিকপাল হবার পূর্বাভাস পাওয়া যায়। পঁচিশ ছাব্বিশ বছর বয়সেই তিনি শিশু সাহিত্যিক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়ে যান।

তিনি শিশুসাহিত্যের আসরে আবির্ভুত হয়ে শিশু ও কিশোর পাঠকের মন জয় করে নেন। তাঁর চমতকারিত্ব ছিল কবিতা ও ছড়ায়। শিশু বিষয়ক ছড়া, কবিতা ছাড়াও লিখেছেন গান, গল্প, উপন্যাস, নাটক, জীবনী এবং সাহিত্য সংকলন। শব্দে, ছন্দে, ভাবে, ভাষায় তিনি ছিলেন ভরপুরÑ প্রকাশে ছিল স্বতস্ফূর্ততা। তিনি ছিলেন প্রভাবমুক্ত কবি-’স্বভাব-কবি’ও বলা যায়। সুনির্মল বসুর কবিতা সম্পর্কে জীবনানন্দ দাশ বলেছেন ’সকলেই কবি নন, কেউ কেউ কবি’।

উপেন্দ্রকিশোর-সুকুমার রায়ের পথ অনুসরণ করে সুনির্মল বসুর রচনার ছবিও তিনি নিজেই আঁকতেন। ভাবের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ছবি আঁকতেন বলে তাঁর অঙ্কিত ছবিগুলি ছিল অর্থময়। তিনি ’শিশু সাহিত্য পরিষদ’ কর্তৃক সংবর্ধিত হয়েছিলেন। বাংলা শিশুসাহিত্যে সুনির্মল বসু একটি নতুন যুগের সূত্রপাত করেছিলেন।

একদিকে স্বদেশী আন্দোলন, স্বদেশ শ্রদ্ধা, মাতৃজ্ঞানে দেশকে ভালবাসার প্রেরণা দেওয়া, স্বাধীনতা আনার পুণ্যব্রতে উদ্বুদ্ধ করা, অন্যদিকে দুর্বল অর্থনৈতিক, কাঠামোয় বিধ্বস্ত সমাজবোধ জন্মানো, রুদ্র কঠিন বাস্তবতার মধ্যে জীবন গড়ে তোলার দায়িত্ব জাগানোর উদ্দেশ্যে কেবল নৈতিক চরিত্র গঠনোপযোগী আদর্শমূলক রচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে পারল না। তার সেই ধারাটিকে যাঁরা প্রাণবন্ত করে তুলেছিলেন তাঁদের মধ্যে সুকুমার- উপেন্দ্র ধারায় পুষ্ট আর এক আশ্চর্য সফলতা সুনির্মল বসু।

তাঁর লেখার জগতে ধ্বনিসুখে তৃপ্ত শিশু থেকে আরম্ভ করে বালক ও কিশোর সমভাবে ভাববস্তুর আনন্দরস উপলব্ধি করতে পারতো। সুনির্মল বসুর গ্রন্থ সংখ্যা প্রায় ষাটখানি। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ,Ñ’পাতার ভেঁপু’ (১৯২৫), ’হাওয়ার দোলা’ (১৯২৫), ’হররা’ (১৯২৮), ’কবিতা-মঞ্জুরী’ (১৯২৯), ’ছন্দের টুংটাং’ (১৯২৯), ’টুনটুনির গান’ (১৯৩০), ’হট্টগোল’ (১৯৩২), ’হাসিমুখ’ (১৯৩৩), ’কিপ্টে ঠাকুরদা’ (১৯৩৩), ’কাণাকড়ির খাতা’ (১৯৩৪), ’দিলীকা লাড্ডু’ (১৯৩৪), ’মরণের মুখে’ (১৯৩৫), ’লালন ফকিরের ভিটে’ (১৯৩৬), ’অসম্ভব দুনিয়ায়’ (১৯৩৭), ’আলপনা’ (১৯৩৯), গুজবের জন্ম’ (১৯৩৯), ’ঝিলমিল’ (১৯৪৩), ’জানোয়ারের ছড়া’ (১৯৪৮), ’তেপান্তরের মাঠে’ (১৯৫৫), ’মনের মত বই’ (১৯৫৫), ’শহুরে মামা’ (১৯৫৭), ’হুল্লোড়’ (১৯৫৭), ’আনন্দ নাড়ু’ (১৯৫৭) ইত্যাদি।— শিশুসাহিত্যিক হিসেবে পুরস্কৃতও হন সুনির্মল।৫

বিষয় বৈচিত্র্যের দিক থেকে তাঁর রচিত শিশুসাহিত্যকে নিুলিখিতরূপে ভাগ করা যায়Ñ

হাস্যরসের অবতারনা – মুন্সিজী ইত্যাদি।

উপদেশমূলক – ইন্টি বিন্টির আসর।

নীতিমূলক – ঈশপস্ ফেবলস অবলম্বনে রচিত গল্পসমূহ।

ভারতীয় প্রাচীন আদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ (স্বাধীনতার চিন্তাধারা) – তোমাদের স্মৃতি স্মরি, শহীদ স্মরণে।

এ্যাডভেঞ্চার, গোয়েন্দা রহস্যময়তা, বীরত্বব্যঞ্জক উপন্যাস – মরণ ফাঁদ (১৯৩৫), মরণের ডাক (১৯৩৬), পাহাড়ে জঙ্গলে, রোমাঞ্চের দেশে, জীবন্ত কঙ্কাল, জ্বলন্ত অদৃষ্ট।

রূপকথামূলক – বুদ্ধুভুতুম, নিঝুম পরীর স্বপ্নকথা (১৯৩৯) রঙিন দেশের রূপকথা (১৯৪০)

আজগুবি রচনা – অসম্ভব দুনিয়ায় (১৯৩৭)

মণীষীদের জীবনী – বিদ্যাসাগর।

ছন্দ ও মিলের কবিতা – খামখেয়ালি ঘুম-কাতুরে

সহজাত সারল্য – অতসী

প্রকৃতিবিষয়ক – শরৎ

ব্যঙ্গানুকৃতি – রবীন্দ্রনাথের ’অমল ধবল পাল’ গানের প্যারোডি

ছন্দের নিরীক্ষা – ছন্দের টুংটাং

ছন্দ মধুর – ভোরের বেলায়

প্রীতি ও ভালবাসার বন্ধন – ইন্টি বিন্টির আসর, ঝিলমিল

বীরত্ব ও দেশাত্মবোধক – তোমাদের নীতি স্মরি, শহীদ স্মরণে

ঐতিহ্যবাহী কবিতা – পৌষ পার্বণ।

সুনির্মল বসুর রচনায় সাঁওতাল জীবনের ও তাদের বসবাসের প্রাকৃতিক বর্ণনা আরেকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য।

সুনির্মল যে সব কাগজে লিখেছেন -’সন্দেশ’, ’মাস পয়লা’ ’প্রবাসী’, ’মৌচাক’, ’শিশুসাথী’, ’খোকাখুকু’, ’ভাইবোন’, ’আলপনা’, ’মুকুল’, ’আনন্দ মেলা’।

প্রথম কবিতাতেই সুনির্মল বসুর হাস্যরসের পরিচয় পাওয়া যায়। হাস্যরসের ধারায় তিনি উপেন্দ্রকিশোর রায় এবং সুকুমার রায়কে অনুসরণ করেছেন।

’পাতার ভেঁপু’ (১৯২৫) সুনির্মল বসুর প্রথম কবিতাগ্রন্থ। কবিতার সঙ্গে ছবি,

এই পাতার ভেঁপু বাজিয়েই সেই যাদুকর কবি আমার অন্তর জয় করে নিল।৫

শিশুসাহিত্যের একটি বড় অংশ মিলের বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। এই জগতে সুনির্মল বসুর একটি বিশিষ্ট স্থান এদিক থেকে আছে। তিনিই প্রথম কবিতার ভাবের সঙ্গে ছন্দের সম্পর্ক নিয়ে চিন্তা করেছিলেন। ’ছোটদের কবিতা শেখা’- গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে চারটি গ্রন্থ Ñ ছন্দের টুং-টাং (১৯২৯), ছন্দের গোপন কথা (১৯৫৬), ছন্দের ঝুমঝুমি (১৯৩২) আবৃত্তি গান অভিনয়,  ছোটদের কবিতা শেখা (১৯৫১)। এই চারটি বইয়ের বিষয়বস্তু মোটামুটি একই। সত্যেন দত্তের ‘পাল্কীর গান’, ‘শীতের ফুল’ প্রভৃতি কবিতায় ভাব ও ছন্দের সমতা লক্ষিত হয় ঠিক; কিন্তু মিল ও ছন্দ যে কবিতার ভাব ও ভাষার উপকরণ মাত্র নয়, এ সত্য ঘোষণা করেছিলেন সুনির্মল। তিনি এ নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষাও করেছেন, সফলতা সব জায়গায় আসেনি। এ প্রসঙ্গে অবনীন্দ্রনাথের রেলগাড়ির বিচিত্র গতির ধ্বনিময় ছন্দ ও মিলের মায়া লক্ষ্যণীয়। তুফান মেল চলেছে, তাই খুশীর আমেজÑ

‘টুইঙ্কল  টুইঙ্কল লিট্ল স্টার।

গাড়ী চলতে চলতে শ্রান্তির ঢল নেমেছেÑ

আফতে বাফ্তে আফ্তে বাফ্তে

আলাচ্য গ্রন্থের কবিতায় নানারকম দেশী বিদেশী ছন্দ ও রস সম্বন্ধে ছোটদের ধারণা দিয়েছেন। সহজভাবে ছন্দ চিনে, মিল বুঝে ছোটরা কিভাবে কবিতা রচনা করতে পারে সে সম্পর্কে সহজ সরল ভাষায় লেখা ’ছোটদের কবিতা শেখা’। ’ভূমিকা’য় নবীন কবির দলকে ছন্দ, মিল ও শব্দ নিয়ে কবিতা লিখবার পথ দেখিয়েছেন ও উৎসাহ জুগিয়েছেন। কাব্যে বিভিন্ন রস সম্বন্ধে আলোকপাত করেছেন। সুনির্মল বসুর রচনায় ছন্দের বৈচিত্র্য অফুরন্ত। ছন্দের সৌন্দর্য্যে ভুলিয়েও তিনি শিশুদের                                                                                                                                                                                                                                                                      হৃদয়হরণ করতে চেয়েছেন। ’ছন্দের টুংটাং’ (১৯২৯) বইয়ের ভূমিকা লেখক কবি হেমচন্দ্র বাগচী বলেছেন,

বইখানি নতুন ধরণে লেখা। ছন্দ ধরবার ক্ষমতা থাকলে ছেলেমেয়েরা যে কত শীঘ্র ছন্দ আয়ত্ত করতে পারে, সুনির্মল বাবু নানা দিক দিয়ে তারই পরিচয় দিয়েছেন। শব্দ ও ছন্দ চিত্রের সঙ্গে সঙ্গেই কবির নিজের আঁকা রেখাচিত্রগুলি আশা করি ছেলেমেয়েদের আনন্দ দিতে পারবে।’৬

ছন্দ তার ব্যাকরণ অনুযায়ী মাত্রাবৃত্ত স্বরবৃত্ত হতে পারে। কিন্তু বিরামহীন ঘুঘু পাখীর ক্লান্ত একটানা ডাকেরও যে ছন্দ আছে সেটি সুনির্মল বসুর চোখে ও কানে ধরা পড়েছে,

ঘুঘু—ঘু

ঘুঘু—ঘু

সারা—ভূ

উহু—হু

ঘুঘু—ঘু

সুনির্মল বসুর ’ছন্দের টুংটাং’ কবিতার বইখানিÑএমনি একটি পরীক্ষা নিরীক্ষার ফল।

শব্দ চয়নের ব্যাপারে তিনি অদ্ভূত পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। বিশেষতঃ ধ্বন্যাত্মক শব্দের ব্যবহারে। শিশুরা সাধারণতঃ ধ্বনাত্মক শব্দ পছন্দ করে বেশী। শব্দের ঝংকার ও অনুরণন শিশু-চিত্তে প্রভাব বিস্তার করে। বিভিন্ন ধ্বন্যাত্মক শব্দের প্রয়োগ তিনি সার্থকভাবে করেছেন, শব্দগুলিকে সুন্দরভাবে প্রয়োগ করেছেন-যা নিজেই মুহূর্তে ধ্বনিত হয়েই স্তব্ধ হয়ে যায়-পর মুহূর্তে তার অনুরনণ থাকেনা। এবং পরবর্তী শব্দের ঝঙ্কারের কোন প্রাধান্য নষ্ট করেনা। ঠিক যেন পুরবীর সুরে বাঁধা নিক্কন। এই স্থলে কবির প্রয়োগ নৈপুণ্য প্রশংসার দাবি রাখে। ছন্দের নতুনত্ব নেই কিন্তু অভিনয়ের পারদর্শিতা রয়েছে।

সুনির্মল বসু মানুষ হিসেবেও ছিলেন খুব সহজ সরল, হাসিখুশী, আত্মভোলা এবং স্বজন-ধর্মী। সেকারণেই কবিতার মিল আর ছন্দ তার মনে এমন সহজভাবে ধরা দিয়েছে। কথায় কথায় তিনি কৌতুক পরিহাস করতে পারতেন।Ñএটি ছিল তার জন্মগত গুণ। ছন্দ তাঁর কন্ঠে বিরাজ করত। মুখে মুখে ছড়া বানানো আর কবিতা রচনা করা তাঁর এক মজাদার খেলা ছিল। কবিতার ছন্দ মিলিয়ে সুনির্মল বসু প্রচুর হাসির কবিতা লিখতেনÑএকটি হাসির কবিতা,

ক্রিং           ক্রিং  ক্রিং  ক্রিং !  সবে সরে যাও না।

চড়িতেছি সাইকেল, দেখিতে কি পাও না!

ঘাড়ে যদি পড়ি বাপু, প্রাণ হবে অন্ত

পথ মাছে রবে পড়ে ছিরকুটি দন্ত।

বলিয়া গেছেন তাই মহাকবি মাইকেলÑ

যেওনা, যেওনা সেথা, যেথা চলে সাইকেল

তিনি অনেক লিখেছেন কিন্তু লেখাকে কখনও বানিজ্যিকভাবে নেন নি। কবি লিখেই খুশী হতেন। তার এমনি একটি কবিতাÑ

খোকা কবি লেখে কবিতা গান  নীল পেন্সিলে, লাল খাতায়

কিন্তু হায় তা শুনবে কে       খাতা ভরে ওঠে গান-গাথায়।

সুনির্মল বসুর রচনায় সাঁওতাল জীবন ও তাদের বসবাসের প্রাকৃতিক বর্ণনা আরেকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। তিনি মাঝে মাঝে পালিয়ে গিরিডি চলে আসতেন। এই সময় তিনি সাঁওতালি ছড়া আর কবিতা প্রচুর লিখতেন,

এলো           ঝড় বাদল   ধর মাদল        গান বাজা

ধর              তান বাঁশীর                  গ্রাম বাসীর     প্রাণ তাজা!

(মাদলÑধিন্ তাতা, ধিন তাতা, ধিন্ তাতা ইত্যাদি।

হাতে লেখা পত্রিকা ’অতসী’ প্রকাশ উপলক্ষে সুনির্মল বসুর কবিতা। কবিতাটিতে প্রথম শ্রেণীর পাঁচ অক্ষরের মিল লক্ষ্যণীয়,

অতসী ফুটেছে বন কোণায়

খোঁজ রাখে তার কোন্ জনায়?

কবিতাটিতে কবির সহজাত সারল্যের পরিচয় পাওয়া যায়।

চারজন পরিচালকের সমন্বয়ে হস্তলিখিত ’আশা’১০/৭ পত্রিকার সম্পাদনা করেন সুনির্মল বসু। এখানে তিনি গল্প, প্রবন্ধ, কবিতা লিখতেন। ’আশা’য় প্রকাশিত প্রকৃতির কবিতা ’শরৎ’,

সোনার আলো পড়ছে ঝরে, বাদল হল দূর।

ফুল-বাগানের কুঞ্জগুলি গন্ধেতে ভরপুর।

কুর্চি-কেয়া-কদমফুলে

ভোরের হাওয়া উঠছে দুলে

হাওয়ায় হাওয়ায় আসছে ভেসে হাজার পাখীর সুর।

সোনার আলো পডছে ঝরে, বাদল হল দূর।

কবিতাটিতে বাংলাদেশী কিছু ফুলের পরিচয় পাওয়া যায়।

এই পত্রিকাতেই তিনি রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত গান লেগেছে অমল ধবল পালের’ ছবিসহ একটি ব্যঙ্গানুকৃতি (ঢ়ধৎড়ফু)রচনা করেন,

Ñহাসে প্রিয়া যবে খল্ খল্ খলÑ

কিবা সে দন্ত রুচি,

মনে হয় কালো পাথর-বাটিতে

শাদা নারিকেল কুচি।

-তখনকার দিনে কবিতাটি জনপ্রিয় হয়েছিল।

‘খোকা খুকু’-১৯২৪ পত্রিকায় নিজের আঁকা ছবির সঙ্গে ‘গাট্টামিঞা পাট্টাদার’ লিখে দেখা দেন সুনির্মল বসুÑসুকুমারের সার্থক উত্তরসাধক। প্রখ্যাত শিশুসাহিত্যিক ও ’সন্দেশ’ সম্পাদক শ্রীমতী লীলা মজুমদারের ভাষায়,

সুনির্মল বসুর লেখার বিশেষত্ব হল যে,Ñভাবে কিম্বা ভাষায়, লেখাগুলিকে এতটুকু পুরনো বলে মনে হয় না। .. আমাদের মনে হয় সব স্কুল কলেজ ও পাঠাগারে এই বই থাকা একান্ত উচিত।১২/১৭/৮

’রাজভোগ’ পত্রিকায় তাঁর উপভোগ্য কবিতা ’চাই রাজভোগ’ (দ্বিতীয় বর্ষের চতুর্থ সংখ্যা) ও ’ভোরের বেলায়’ (তৃতীয় বর্ষ, দ্বিতীয় সংখ্যা)। রচনা হিসেবে সাধারণ কিন্তু ছন্দ-মধুর। ’পাপিয়া’র লেখাটি (দ্বিতীয় বর্ষের দ্বিতীয় সংখ্যায়) ও ছন্দিত। ’সহজ গান’ শীর্ষক এই রচনাটি প্রকাশিত হয়

শরতের এক রঙীন ভোরেÑ

হঠাৎ সেদিন আমার দোরে

গাইলো এসে ছোট্ট সে এক টুনটুনি;

আপন মনে অবুঝ ভাষার

খোশ খেয়ালে গান গেয়ে যায়,Ñ

অবাক হয়ে একমনে সেই গান শুনি।

কাকাতুয়ার তোতার মত

জানে না গান অতশত

শেখা-বুলি তাইতো টুনি গাইল না,Ñ

বুকের মাঝে যে গান ছিল

সরল ভাষায় শুনিয়ে দিল,

পড়া বুলি শোনাতে সে চাইলো না।…

সুনির্মল বসুর তাৎক্ষণিকভাবে কবিতা রচনার ক্ষমতা ছিল। তাঁর গৃহশিক্ষক কুল খেতে পছন্দ করতেন। রসিকতা করে সুনির্মল বসু লিখলেন,

সারা গায়ে চুলকানি, খালি খালি চুলকায়,

তবুওতো কালিনাথ টোপা টোপা কুল খায়।

তাঁর ’অপরাধ’ সুনির্র্মল রচনাসম্ভারে’র (২য় খন্ডভুক্ত) কবিতায় শিশু যে অপরাধ করেছে তা অত্যন্ত মানবিকবোধসম্পন্ন,

মাঁচায় ঝোলানো লোহার খাঁচাটি খুলিয়া দিলাম ধীরে,

উড়ায়ে দিলাম ভোরের আলোয় পোষা সে ময়নাটিরে।

অন্যত্র,

দুঃখীর ছেলেরে  চাদর দিয়েছি, মাগো সেই কথা শোন

আমার চাদর দুইখানি আছেÑ ওর কাছে নাই কোন।

তাঁর পূর্বে সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত ‘মেথর’, ‘জাতির পাঁতি’ ইত্যাদি কবিতা লিখে শিশুসাহিত্যের এই ধারাকে সমৃদ্ধ করেন। গতানুগতিক চাঁদ ও জ্যোৎøার বর্ণনা ছেড়ে শিশুর কল্পনাকে জাগ্রত করে দিয়েছে ‘মৌচাক’ কবিতাটি,

চাঁদটা যেন সত্যিকারের আলোরই মৌচাক

দুষ্টু ছেলের ঢিলটা লেগে হঠাৎ হলো ফাঁক।

আজকে রে তাই সাঁজের বেলায়

আলোর মধু সব ঝরে যায়,

হাজার তারা মৌমাছিরা উড়লো ঝাাঁকে ঝাঁক

কবি কল্পনার স্পর্শ লেগে সবকিছুই নতুন তাৎপর্যে ও সৌন্দর্যে ভরে উঠেছে।

’সব পেয়েছির আসর’ দেশের সভ্যদের ’সোনার কাঠি’ নাম দিয়ে একটি সভার আয়োজন করেছিল। উদ্দেশ্য ছোটরাই তাদের পরশে এই ঘুমন্ত দেশকে জাগিয়ে তুলবে। সারা দেশ জুড়ে এর শাখা বিস্তারের পরিকল্পনা হয়। সুনির্মল বসু এই আসরের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহনকারী ছেলেমেয়েদের সব সময়ই উৎসাহ ও প্রেরণা দিয়ে সঞ্জীবিত করে তুলতেন। ’সব পেয়েছির দেশে’ ‘ছোটদের পাততাড়ি’তে সুনির্মল বসুর একটি কবিতা,

সব পেয়েছির দেশে চলো

সকল ছেলে মেয়ে

উঠবে মেতে সবাই সেথায়

সকল জিনিস পেয়ে।

সেথায় হাসির ঝর্ণা হাসে

আমোদ খুশীর বন্যা আসে

সবার মনে দুঃখ নাশে

মিষ্টি সুরের রেশে

সব পেয়েছির দেশে রে ভাই

সব পেয়েছির দেশে।

’সব পেয়েছির আসরে’র প্রথম দিকে পৌষ মাসের সংক্রান্তির দিন এই আসরের সভ্যরা একটি উৎসবের আয়োজন করেছিল এবং নাম দিয়েছিল ’পৌষ পার্বন’। এই কবিতায় সুনির্মল বসুর বাংলার ঐতিহ্যবাহী পৌষ সংক্রান্তির আনন্দ ও আমেজের কথা তুলে ধরেছেনÑএই সময়ের মিষ্টিমধুর আবহাওয়ার চমৎকার বর্ণনার মধ্যে পল্লী বাংলার কড়া শীতের সকালের রোদ গায়ে মেখে ’মুড়ি ঝুড়ি’ খাওয়া, গায়ে কাঁথা জাপটিয়ে ’পুলি’, ’পাটিসাপটা’, ’আস্কে পিঠে’, ’গোকুলপিঠে’, ’সরু চাকলি’ অথবা ’চষি পিঠে’ খাওয়ার মজা তুলে ধরেছেন।

সুনির্মল বসু খেতে খুব পছন্দ করতেন। রবিবাসরীয় আসরের নিধিরাজ বাবুর খাওয়ানো নিয়ে ’নিধিরাজ ভোজ’ নামে তিনি একটি কবিতা রচনা করেন। রবিবাসরীয় সভায় সুনির্মল ’কৌতুক আসরে’র সভ্য  ছিলেন। এই সভায় তিনি কবিতা, গান, অভিনয়, কীর্তন উপহার দিয়েছেন।।——সুনির্মল বসুর মিল আর ছন্দ যেন আমাদের খুশীর দোলায় দুলিয়ে দিত,

খাম খেয়ালী ঘুম-কাতুরে

মস্ত ছিলেন রাজা

কেউ যদিভাই খুঁৎ ধরে তার

তক্ষুণি দেন সাজা।

বেজায় অলস রাত্রি দিবস

মন বসে না কাজে

ভাঁড়-বিদুষক সদাই ঘিরে

রয় যে মহারাজে।

কেবল -খাওয়া, গল্প-রাজের

শুয়ে পালঙ্কেতে

তাস-পাশা আর দাবা খেলায়

ওঠেন তিনি মেতে।

রবিবাসরের অধিবেশনে ’জনান্তিকে’ আমাদের দলের মধ্যে যে আলাদা একটা আসর বসত,Ñতাতে সুনির্মল বসুর এই জাতীয় মজাদার কবিতা বেশ জমে ওঠত।৮———————————————–

সুনির্মল বসুর এক শ্রেণীর কবিতায় হিন্দু পুনর্জাগরণবাদ ধ্বনিত হয়ে উঠেছে। তাঁর বন্দেমাতরম কবিতার মুক্তি মন্ত্রের দীক্ষাই হচ্ছে বন্দে-মা-ত-র-ম্ ধ্বনি। পতাকা উত্তোলন, চল্ রে দিল্লী চল্ , লাল-কেল্লায় তে-রঙা-পতাকা ইত্যাদি কবিতায় মহাভারত ও গান্ধীজীর গুণগাথা বিধৃত হয়েছে।

‘তিতুমীর’ কবিতায় বৃটিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে তিতুমীরের বীরত্ব ঘোষিত হয়েছে তবে অধিকাংশ কবিতায় হিন্দু বীরদের শৌর্যবীর্য ও গুণগাথাই প্রকাশিত হয়েছে, যেমন ‘মারাঠা বীর’ ‘মহারাজা নন্দকুমার’, ‘প্রফুল্ল চাকী’, ‘সত্যেন বসু’ ইত্যাদি।

‘জানায়ারের ছড়া’ কবিতায় বাঘ, সিংহ, ভালুক, হাতি ইত্যাদি জানোয়ারের স্বভাব ও প্রকৃতি সম্বন্ধে আলোচনা করেছেন।

সুনির্মল বসু এক সময় কবিতা লেখা ছেড়ে গল্পলেখায় মনোনিবেশ করেন। তার একটি চমকপ্রদ কাহিনী রয়েছে। কলকাতায় তখন অভিজাত মহলে উদ্যান এবং বাগানবাড়িতে বিশেষ বৈঠকি আসর বসত। ’রসচক্র’ এমনি একটি প্রতিষ্ঠান Ñএমনি একটি অনুষ্ঠানে এসেছিলেন কথা সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র। নানাজাতীয় মজাদার গল্পের এক ফাঁকে তিনি কিশোরদের দিকে তাকিয়ে কবিতা লেখা একেবারে বন্ধ করে দিতে বললেন। কারণ হিসেবে তিনি বললেন,

রবিঠাকুর কবিতায় সব কিছু লিখে গেছেন। কোনো বিষয় আর বাদ নেই। যাই লিখতে যাবেÑএকেবারে পুরোনো বলে মনে হবে। তখন মনে মনে ঠিক করলাম, নাম করতে হলে কবিতার পথে কিছু হবে না। তখন আমি নতুন উদ্যম নিয়ে গল্প লিখতে শুরু করলাম।৯

সুনির্মল বসুর ’কানাকড়ির খাতা’ (১৯৩৪)য় কাণাকড়ি বিষয়ক একাধিক বিষয় সন্নিবেশিত হয়েছেÑযেমন কাণাকড়ির কবিত্ব, এককড়ির চিঠি ও কাণাকড়ির খাতা, কাণাকড়ির আরো কবিতা, কাণাকড়ি মরে নাই, কাণাকড়ির প্রতিভা’তে সে স্বভাবজাত কবি। সহজ কবি কাণাকড়ি, কাণাকড়ির ছন্দজ্ঞান। এই বিষয়গুলিতে সুনির্মল বসু নিজেকেই উপস্থাপন করেছেন। লুকিয়ে লুকিয়ে পত্রিকায় খবর পাঠানো সুনির্মল বসু যেমন করেছেন, কাণাকড়িও তেমনি করেছেন,

’ঘরের কোণায় রেড়ীর তেলের প্রদীপ জ্বেলে কাণাকড়ি কবিতা লিখবার চেষ্টা করেছে। মৌচাকে সে কবিতা দেবে এই তার ইচ্ছা। অনেক কাগজেই সে গোপনে কবিতা পাঠিয়েছেÑ কেউবা ফেরৎ দিয়েছেÑ কেউবা কোন উত্তরই দেয়নি।১০

ছোটদের প্রিয় অ্যাড্ভেঞ্চার, গোয়েন্দা রহস্যময় লিখেছেন, যেমন মরণ ফাঁদ (১৯৩৫), মরণের ডাক (১৯৩৬)। এক্ষেত্রেও তিনি সুকুমার রায়কে অনুসরণ করেছেন।

বাংলা ছড়ার পরবর্তী পর্বে ছন্দে – মিলে শব্দ ব্য্যবহারে অভিনবত্ব দেখালেন বটে, কিন্তু যে বিচিত্র ও ব্যাখ্যাতীত অর্থের রসে উপর্যুক্ত রচনাগুলি উদ্ভাসিত, তা এঁদের ছড়ায় প্রায় নেই বললেই চলে।

বহুযুগ থেকে আমাদের দেশে রূপকথা এবং ছড়ার প্রচলন দেখতে পাওয়া যায়। এই রূপকথা ও ছড়াগুলি উনিশ শতকে পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হবার পূর্বে সাহিত্য বলে বিবেচিত হতো না। উনিশ শতক, এমনকি বিশ শতকের প্রথম দশকেও অধিকাংশ শিশুসাহিত্যিক এই সমস্ত রূপকথা বা ছড়া, গল্পে বা কবিতায় রূপ দিয়ে শিশুসাহিত্য সৃষ্টি করেছেন কিন্তু গল্পগুলি কালোপযোগী হয়নি এবং বাস্তবের সঙ্গে ছিল সম্পর্কহীন। অনেক গল্পে অলৌকিক ঘটনার উপাদানের আধিক্যে গল্পের বিষয়বস্তু শিশু চিত্তের জন্য ভীতি ও সন্ত্রস্ত উদ্রেককারী হয়েছিল Ñ যা শিশুসাহিত্যের পরিপন্থী বলে এ যুগে বিবেচিত হয়েছে। সুনির্মল বসু এই প্রভাব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ছিলেন। তাঁর রূপকথাসাহিত্য কালোপযোগী এবং বাস্তবধর্মী হয়েছিল। পরিমিতিবোধ ও প্রয়োগ নিপুণতার জন্য তাঁর রূপকথা অসম্ভব বলে মনে হয়না। ‘রূপকথার রাজপুত্তুর’, ‘দুয়োরাণী’, ‘রঙীন হাসির দেশে’, ‘সব পেয়েছির দেশে’ ইত্যাদি রচনায় এর উদাহরণ ছড়িয়ে আছে।

সুনির্মল বসুর পূর্বসুরীদের অনেকেই শিশু মনকে ঈশ্বরে বিশ্বাসী করবার জন্য নানা রকম ভক্তি-বিষয়ক গল্প লিখেছেন। কিন্তু প্রস্তাবনা যথাযথ না হওয়ায় অনেকে পরোক্ষে ঈশ্বরকে ভয়ের কারণ করে তুলেছেন। সুনির্মল বসুর বিরুদ্ধে এরকম কোন অভিযোগ আনা যায়না।

জাতিধর্ম নির্বিশেষে সুনির্মল বসুর সাহিত্য সুখপাঠ্য ছিল। উনিশ শতকের শিশুসাহিত্য পরিবেশনের যে ত্রুটি ছিল সুনির্মল বসুর হাতে তার উত্তরণ ঘটেছিল। ভাষার ব্যবহার বা ভাবের বিন্যাসে সুনির্মল বসুর সাহিত্য ব্যতিক্রমধর্মী স্বাদ এনে দিয়েছিল। তিনি সহজ সরল ভাষায় এবং গভীর ভাবকে সহজ ভাবে পরিবেশন করেছিলেন। তাঁর সাহিত্যে একটা সর্বজনীন অনুভূতি বিরাজমান। বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে তাঁর সাহিত্য সম্ভার।

সুনির্মল বসুর শিশুসাহিত্যের ব্যপ্তি সর্বস্তরের শিশুদের জন্য। যে পড়তে শেখে নাই শুধু কল্পনার জাল বোনে, সে বয়স থেকে আরম্ভ করে যে মন ঝোপের ধারে লুকিয়ে থেকে অতর্কিতে কাউকে আক্রমণ করে লড়াইয়ের উত্তেজনা অনুভব করেÑ অর্থাৎ শিশুমন যখন অ্যাডভেঞ্চারাস হয়ে ওঠেÑ এই সব বয়সীদের কাছে তিনি সমান প্রিয়।

সুনির্মল বসু গল্পে নিতান্ত সাধারণ মানুষকে তাঁর সাহিত্যের চরিত্রের উপাদান হিসেবে গ্রহণ করেছেন, তিনি সংস্কারাবদ্ধ ধারণার পরিবর্তনে সহায়তা করেছেন। তার সমাজে সাধারণ মানুষের গুণাবলী অবজ্ঞায় অবহেলিত ছিল। সুনির্মল বসু উদারতার দ্বার প্রসারিত করেছেন। একে অপরের সঙ্গে প্রীতি ও ভালবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে অনিন্দ্যসুন্দর সমাজ গড়ে তুলুকÑ এই স্বপ্নেই তিনি ছিলেন আবিষ্ট। যার ফলশ্রুতি ’ঝিলমিল’ (১৯৪৩), ‘ইন্টি বিন্টির আসর’ (১৯৫০)।

গান্ধীজী এবং ’রামরাজ্যে’র স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য মঙ্গলাকাংখা ’ইন্টি বিন্টি আসরে’র মূলকথা।

শিশুর চরিত্র গঠন এবং মঙ্গল সাধন উদ্দেশ্যে অধিকাংশ গল্পের মধ্যেই তিনি করেছেন নীতির প্রচার। এ ব্যাপারে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে তিনি ফেব্ল্স্-এর সহায়তা নিয়েছেন। পশু-পাখীর স্বভাব ও ব্যবহারের প্রতি শিশু চিত্তের একটা আকর্ষণ বা ঔৎসুক্য একটু বেশী। তিনি বাঘ, শিয়াল, ঘোড়া, জেলে, দানব, কুমীর, চোর, ডাকাত, ভালুক প্রভৃতি নিয়ে গল্প লিখেছেন। চিরাচরিত প্রথায় ফেবলস্ অনুসরণে বাঘকে বোকা বানানো হয়েছে এবং শিয়াল সব সময়ই ধূর্ততার পরিচয় দিয়েছে। এমন গল্পগুলি সেয়ানে সেয়ানে, বাঘ আর শিয়াল, মামা আর ভাগ্নে, বাঘ জামাই, বাঘের বিয়ে ইত্যাদি। এক্ষেত্রে তিনি উপেন্দ্রকিশোর রায় ধারারই অনুসরণ করেছেন।

বাংলা শিশু নাটকের দুর্দিনে সুনির্মল বসুু নাটক রচনায় হাত দিয়েছিলেন,

এই সময় আমি সুনির্মলকে একদিন কথা প্রসঙ্গে বলেছিলাম, সারা জীবন বহু ত’ কবিতা লিখলে, এইবার ছোটদের জন্যে কয়েকখানা হাসির নাটক লেখো দেখি। ছোটদের নাটকের বড় অভাব।১১

সুনির্মল বসুর ’কিপ্টে ঠাকুর্দা’ (১৯৩৩), কাশীর টোট্কা’, ’পবিত্তির মাসিমা’, ’বন্দীবীর’, ’আনন্দ নাড়ু’ (১৯৫৭) ইত্যাদি  নাটকগুলি নির্মল হাসির জোয়ারে প্লাবিত। শিশু চিত্তের আগ্রহের প্রতি বিশেষ নজর রেখে তিনি তাঁর নাটকের বিষয়বস্তু নির্বাচন করেছেন। শিশুদের জন্য নাটকগুলি উপভোগ্য। সুকুমার রায়ের নাটকের ন্যায় নাটকের আঙ্গিকে কোন অদ্ভূত অবাস্তবতার কল্পনা পরিলক্ষিত হয়না। অনাড়ম্বর বেশভূষা ও পরিমিত চরিত্রে তাঁর নাটকের বক্তব্যের গতি সাবলীল। আলোচিত নাটকগুলি বহু শিশু প্রতিষ্ঠানে অভিনীত হয়ে প্রচুর আনন্দ জুগিয়েছে।

হিন্দু ধর্মের আচারগুলিকে অনুৎসাহিত করেছেন ’পবিত্তির পিসিমা’তে। পবিত্তির পিসিমার গোবরজল ছাড়া কোন কিছুই পরিশুদ্ধ হয়না, এমনকি কলার কাঁদিটাও তিনি গোবরজলে চুবিয়ে রাখেন। কলেজে পড়া মেয়ে নিভা সে কলা না খেয়ে মাসিমার ডাবজলের মধ্যে গোবরজল ঢেলে তাকেই পান করতে দেয় এবং উপদেশ দেয়,

অন্তরটা পবিত্র করবার চেষ্টা করুন ; তা না হলে, হাজার বার গোবরজলে চান করুন, গোবরের তাল সারা গায়ে মাখুনÑকোনোই ফল হবে না Ñ

’আনন্দ নাড়ু’ চরিত্র মোট তিনটি ঝগড়াটি, হিংসুটি ও মিতালি। নামেই তাদের পরিচয়। নাটকের আঞ্চলিক শব্দ (ইডিয়ম)গুলি উপভোগ্য যেমন ’হেঁজিপেঁজি মেয়ে’, ’রাম ভুতুড়ে’, ’ভুতুম পেঁচা’, ’আবলুস গাছে রাঙা জবা’ হুঁকোর খোলে শালুর ঝালর’, ’কালো পাথর বাটিতে চীনে সিন্দুর’, ’গাবগাছের পেতœী’, ’শ্যাওড়াগাছের শাঁকচুন্নী’ ইত্যাদির যথাযথ ব্যবহার করেছেন। ঝগড়াটি এবং হিংসুটি সারাক্ষণই একে অপরের সঙ্গে ঝগড়া করে এবং মিতালি তাদের ’নাড়ু’ খাইয়ে ঝগড়ার অবসান করে। প্রকৃতপক্ষে নাড়ু খেয়ে তাদের মিল হয়না, মিল হয় মনের অন্ধকার দূর করে। ঘৃণা আর অবহেলা মানুষের স্বাভাবিক গুণাবলীকে দূরে সরিয়ে রেখে মানুষকে অমানুষে পরিণত করে সংক্ষেপে এই হল নাটকের বিষয়বস্তু। সবশেষে মিতালি শুনিয়ে দেয় গান্ধীজীর ’বিশ্বপ্রেমের বাণী, অহিংসা আর অনন্ত শান্তির বাণী’। ’আনন্দ নাড়ু’ অভিনীত হয়ে প্রচুর আনন্দও কুড়িয়েছিল।

’বুদ্ধু-ভুতুম’ চিরাচরিত রূপকথার গল্প। বড় দুই রাণী ষড়যন্ত্র করে সন্ন্যাসীর পড়া ফল খেলে তাদের ঘরে জন্ম নেয় মানব সন্তান আর ছোটরানী ফলের বীচি খেয়ে জন্ম দেয় বুদ্ধু (পেঁচা) আর ভুতুম (বানর)। তারা বুদ্ধির বলে বড় দুই রানীর ছেলেকে হারিয়ে দেয় এবং রাজকুমারীর গলায় মালা পরিয়ে যুবরাজে পরিণত হয়। অন্যায়কারীরা সাজাপ্রাপ্ত হয়।

দু’একটি চরিত্র ছাড়া সব চরিত্রই অতি কথন দোষে ভারাক্রান্ত। তাঁর নাটকের মান উচ্চ নয়। তাঁর নাটকগুলিকে নাটক না বলে স্কেচ বা নক্সা বললে বোধ হয় ভাল হয়। যে সমস্ত উপাদান নিয়ে নাটক তার পূর্ণতা লাভ করে, তাঁর নাটকে সে সমস্ত উপাদানের অভাব পরিলক্ষিত হয়।

ভারতীয় আদর্শের প্রতি শ্রদ্ধা জাগিয়ে তুলবার উদ্দেশ্যে ’রামায়ণ’ ও ’মহাভারতে’র সহজ, সরল শিশু সংস্করণ প্রকাশ করেন। ’রামায়ণ’, মহাভারত’ নিয়ে উপেন্দ্রকিশোর রায়ও লিখেছেন তবে, সুনির্মল বসুর ’ছোটদের রামায়ণে’র ভাষা অধিকতর সহজ সরল।

শিশুচিত্তে স্বাধীনতার চিন্তাধারা, বীরত্ব ও দেশাত্মবোধ উদ্দীপিত করার উদ্দেশ্যে রচনা করেন ’তোমাদের নীতি স্মরি’, ’শহীদ স্মরণে’ ইত্যাদি।

কিশোর উপন্যাসের সংখ্যা চারটি। যথা- পাহাড়ে জঙ্গলে, রোমাঞ্চের দেশে, জীবন্ত কঙ্কাল, জ্বলন্ত অদৃষ্ট।

’পাহাড়ে জঙ্গলে’ উপন্যাসে শব্দের প্রয়োগ লক্ষ্যণীয়। অতুল উৎসাহ, অদম্য সাহস, অদ্ভূত উপস্থিত বুদ্ধি, আর অপূর্ব ক্ষিপ্রতা’। অন্যত্র শব্দগঠনে উপসর্গের প্রয়োগ বাক্যকে ভিন্ন মাত্রা দান করেছে। যেমন,

ভারতবর্ষের মতো ’দুরারোহ পাহাড়’ আর ’দুর্ভেদ্য জঙ্গল’ তার ’দুর্জয় সাহসে’র কাছে পরাজয় স্বীকার করেছিল। এমন কি ব্রম্মদেশীয় ’দুর্গম স্থানে’ আর ভারতবর্ষের বিপদসঙ্কুল সীমান্ত প্রদেশেও তিনি অনেকবার ছুটে গিয়ে ছিলেন ’দুরন্ত শিকারে’র নেশায়। জীবনে শিকার করেছিলেন সমস্ত রকমই ’দুর্দান্ত হিংস্র জানোয়ার’, কিন্তু নিরীহ পশুপাখী তাঁর হাতে কখনো মারা গেছে, একথা অতি বড় শত্রুও বলতে পারবে না।

সুনির্মল বসুর কিশোর উপন্যাসগুলি রহস্য ঘেরা। উপন্যাসগুলিতে ভাবের আবেগ এবং ভাষার কারুকার্য থাকলেও ভাষার গাঁথুনি শক্তিশালী নয় এবং অতিকথন দোষে ভারাক্রান্ত।

প্রবন্ধগুলির বক্তব্য সাবলীল।

ছোটদের প্রেরণা দানের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নাটকে অভিনয় ও সভাপতিত্বও করেছেন। ’যুগান্তর’ (১৯৪৫)১২ পত্রিকার ’ছোটদের পাততাড়ি’র পরিচালক শ্রী অখিল নিয়োগী (’স্বপনবুড়ো’) প্রতিষ্ঠা করেন ’সব পেয়েছির আসর’ Ñএকটি কিশোর কল্যান প্রতিষ্ঠান। এই আসর এবং ’প্রবাসী’তে সুকুমার রায়ের কবিতায় লিখিত ছোট্ট সরল নাটিকা ’ভাবুক সভা’র ’ভাবুক দাদা’ চরিত্রে অভিনয় করেছেন এবং ’শিশু সাহিত্য শাখা’ অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন যে অনুষ্ঠানে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং দক্ষিণারঞ্জন মিত্র সম্বর্ধিত হয়েছিলেন।

পাক্ষিক পত্রিকা ’কিশোর এশিয়া’(৩২)১৩র সম্পাদনা সুনির্মল বসুর আরেকটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। তবে কিছুদিন চলার পর এটি বন্ধ হয়ে যায়।

বিভিন্ন রকম গঠনমূলক শিশু সংগঠনের সাথে তিনি জড়িত ছিলেন। যার উদ্দেশ্য ছিল ছোটদের আশা-আকাংখার কথা জানা, সাহিত্য রচনার প্রেরণা, নাটক মঞ্চায়ন, দেশভ্রমন ইত্যাদি। ’মণিমেলার সংগঠন’১৪ এমনি একটা সংগঠন।

’সুনির্মল স্মৃতি’তে আমরা জানতে পারি সুনির্মল বসু সারা জীবন দেব সাহিত্য কুটিরের জন্য বহু বই লিখেছেন এবং এগুলির সর্বস্বত্ব তাঁকে তাদের কাছে বিক্রী করে  দিতে  হয়েছে। লেখক হিসেবে সেজন্য তার একটি বেদনা ছিল। তখনকার সময়ে শুধুমাত্র শিশুসাহিত্য রচনা করে সংসার চালানো ছিল একটা দুরূহ কাজ। বাংলা শিশুসাহিত্যের দুর্দিনে, ব্যক্তিগত অভাব অনটন উপেক্ষা করে তিনি শিশুসাহিত্য রচনাকে ব্রত হিসেবে নিয়েছিলেন।

কবিতার বিয়য়বস্তু অপেক্ষা ছন্দ ও মিলের উপর অধিক জোর দিয়েছেন।

সুনির্মল বসুর গল্প এবং উপন্যাসে ভাবের আধিক্য লক্ষ্যনীয়। তাঁর নাটকগুলি উচ্চমানের নয়। অনেকক্ষেত্রে এগুলি অতিকথন দোষে ভারাক্রান্ত। বাক্যগঠনে সাবলীলতার অভাব রয়েছে। হিন্দু ধর্মের কুসংষ্কার নিয়ে কথা বলেছেন, কিন্তু সংস্কারের উপায় কিছু বলেননি। বাংলা ভাষাভাষী অন্যান্য ধর্মাবলম্বী বিশেষতঃ সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জাতি নিয়ে, তাদের আচার- আচরণ, ধর্ম ও তার সংস্কার, ঐতিহ্য ইত্যাদি নিয়ে কোন কথা বলেননি। বিশেষতঃ ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গজনিত আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়, বাঙ্গালী হিন্দু-মুসলিম যে সংঘর্ষে মেতে ওঠে, সেখানেও সুনির্মল বসু তার লেখনী হাতে এগিয়ে আসেননি এই দুই বিরোধী দলকে একই সূত্রের মালায় গাঁথতে। এমনকি তাঁর রচিত চরিত্রে মুসলিম চরিত্রের নাম বা রূপায়নও খুঁজে পাওয়া যায় না।

সুনির্মল বসুর ’চোরধরা’ গল্পে শম্ভূ এবং মালী চোরের উপস্থিতি টের পেয়েও চোরকে ধরেনিÑবরং তারা চোরকে গাছে উঠতে সহায়তা করেছে এবং চোর তাদের উপস্থিতিতেই পালিয়ে বেঁচেছে এবং তাদের মজা দেখেছে। এই স্থলে শম্ভু এবং মালী এবং তাদের পরামর্শদাতা দাদামশাই সবাইকে চোর বোকা বানিয়েছে। অতি-কথনদোষে রচনাটি ভারাক্রান্ত এবং বক্তব্য বিষয়ে বলিষ্ঠতার অভাব পরিদৃষ্ট হয়।

সুনির্মল বসু রচনা সম্ভারের প্রথম খন্ডের সম্পাদকদ্বয়ের মতে,

কাল হতে কালান্তরে শিশু সাহিত্যের সমালোচকদের দৃষ্টিতে তাঁর সাহিত্য কীর্তির মান বিভিন্নভাবে নিরূপিত হতে পারে, তার স্বীকৃতি কমবেশী হতে পারে, কিন্তু তিনি যে তাঁর যুগের শিশু-সাহিত্যের পুরোধা সেই বিষয়ে দ্বিমত হবার কোন উপায় নাই।১৫

একথা সত্যি তিনি তাঁর যুগের শিশুসাহিত্যের পুরোধা কিন্তু তিনি যুগকে অতিক্রম করত পারেননি।

সুনির্মল বসু ঐতিহ্যের অনুসন্ধান করেছেন রামায়ণ, মহাভারতে, বিভিন্ন হিন্দু মণীষীর জীবনচরিতে। তাঁর জীবনীমূলক রচনাগুলির অন্তর্গত জীবনের জটিলতা ও সমস্যা ছোটদের বিষয়বস্তু নয়। শ্রী রামকৃষ্ণের ’সর্বভূতে ঈশ্বর বিরাজমান’ সত্যের কথা শিশুদের বোধগম্য নয়।

সুকুমার পরবর্তী শিশুসাহিত্যের ইতিহাসের ধারাটি তিনি সজীব রেখেছিলেন ঠিকই কিন্তু নতুনত্ব সৃষ্টি করতে পারেন নি।

অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ’ভূত-পত্রী’র দেশও সুনির্মল বসুকে প্রভাবিত করেছিল।

অবনীন্দ্রনাথের ভূত-পত্রীর দেশ এক রাতে পড়ে শেষ করেছি। তার ভাবের বন্যায় ভেসে চলেছি। হুম্পাহুুমার পালকী চড়ে চলেছি সমুদ্রের দিকে। বেহারাগুলোর কালো কালো ছায়া পডেছে সমুদ্রের সাদা সাদা বালু চড়ায়। বেহারাগুলিকে যেন বলেছিÑএ আমায় কোথায় নিয়ে যাচ্ছো তোমরা! কত আনন্দ কত উন্মাদনা।১৬

 

পাদটীকা ঃ

১। সুনির্মল রচনা সম্ভার প্রথম খন্ড, এম, টি. ৭৩ কলেজ স্ট্রীট মার্কেট, কলিকাতা-৭০০০১২। পৃ Ñ ২

২। সন্দেশ(১৯১৩)-সম্পাদক উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী।

৩। সুনির্মল বসু, সুর্নিমল রচনা সম্ভার প্রথম খন্ড পৃ Ñ ২১৩

৪। প্রথম বর্ষের বর্ষের ষষ্ঠ সংখ্যা।

৫। ১৯৭২ ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ এডুকেশন্যাল রিসার্চ এন্ড ট্রেনিং।

৬। সুনির্মল রচনা সম্ভার ৩য় খন্ড পৃ Ñ ৩৪২।

৬। ছন্দের টুংটাং (১৯৩০বাং ১৩৩৬ ফাল্গুন) প্রকাশক বাগচী এন্ড সন্স, ২০/২ কর্নওয়ালিশ স্ট্রীট, কলকাতা।

৭। আশাঃ চারজন পরিচালকের মধ্যে সুনির্মল বসুু অন্যতম (সুিনর্মল রচনা সম্ভার প্রথম খন্ড, পৃÑ১৩)।

৮। সু, র, স,৩য়,পৃ Ñ ২৪৪।

৯। ঐ-পৃ Ñ ৩৪৪।

১০। জীবনখাতার কয়েক পাতা পৃ Ñ ৩৩৫।

১১। জীবন খাতার কয়েক পাতা, পৃ Ñ ৩৩৬।

১৪।   সু. স্মৃতি।

১৫। ঐ।

২৭। সুনির্মল বসু-মৌচাক।

২৮। সুনির্মল স্মৃতি পৃ ৩৫৩।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

অষ্টম পরিচ্ছেদ

কাজী নজরুল ইসলামের শিশুসাহিত্য

(১৮৯৯-১৯৭৬)

 

 

কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত নজরুল সম্পর্কে বুদ্ধদেব বসু বলেছেন,

সত্যেন্দ্রনাথ দত্তকে মনে হয় রবীন্দ্রনাথেরই সংলগ্ন কিংবা অন্তর্গত আর নজরুল ইসলামকে মনে হয় রবীন্দ্রনাথের পরে অন্য একজন কবিÑক্ষুদ্রতর নিশ্চয়ই, কিন্তু নতুন। বুদ্ধদেব বসু, রবীন্দ্রনাথ ও উত্তর সাধক, বুদ্ধদেব বসুর প্রবন্ধ সংকলন, ভারতী ১৯৬৬, ৭৯।৪ ৪।(সৌরীন্দ্রমোহন মুথোপাধ্যায় ”সত্যেন্দ্র-স্মরণ” (ভারতী, শ্রাবণ ১৩২৯)

 

 

 

বিশের দশকে নজরুল ইসলামের সাহিত্য প্রতিভা কবিতা, ছোট গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটকে আবর্তিত হলেও (এ সব রচনার মূলে ছিল সাময়িকপত্রের সম্পাদকদের নিরন্তর তাগাদা)। (এরপর সম্পাদকদের হাত থেকে গ্রামোফোন কোম্পানীর লোকের খপ্পরে পড়েন ) তিরিশের দশকে নিজেকে সংগীতের জগতে সীমিত রাখেন এবং তা অর্থের প্রয়োজনে। তিরিশের দশকের সূচনাতে তাঁর শিশুসাহিত্যেরও স্ফুর্তি ঘটে। পূর্বতন ধারা থেকে সম্পুর্ণ এক ব্যতিক্রমধর্মী, সম্পূর্ণ নতুন মেজাজ ও দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে শিশুসাহিত্য জগতে আবির্ভূত হন তিনি।

বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার জামুরিয়া থানার অন্তর্গত চুরুলিয়া গ্রামে ১৩০৬ সালের ১১ই জ্যৈষ্ঠ (১৮৯৯, ২৪মে) মঙ্গলবার এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহন করেন কাজী নজরুল ইসলাম। নজরুল ইসলামের কবিত্ব শক্তির উন্মেষ হয়েছিল খুব অল্প বয়সেই। পিতার মৃত্যুর পর মাত্র দশ বছর বয়সে পরিবারের আর্থিক দুরাবস্থার দরুণ স্কুলের পড়া ছেড়ে দিতে বাধ্য হন এবং মক্তবের শিক্ষক এক মৌলবী সাহেবের কাছে আরবী-ফারসী মিশ্রিত বাংলা ভাষা শিক্ষা করেন। এরপর আর্থিক অসচ্ছলতার দরুণ স্কুলের পড়া ছেড়ে ‘লেটো নাচ’ আর গানের দলে যোগ দেন এবং বারো-তেরো বছর বয়সে উক্ত ভাষায় লেটোর দলের জন্যে গান আর ‘পালা’ লিখতে শুরু করেন। অশিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত গ্রাম্য লোক দ্বারা লেটো দল গঠিত হয় বলে লেটো গানের ভাষা মার্জিত ও সুরুচিসম্পন্ন হয় না। শিশু কবি নজরুল সেই অল্প বয়সে লেটো দলের উপযোগী এবং উপভোগ্য গান রচনা করে, গ্রাম্য রসগ্রাহিদের তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন।

নজরুল বাল্যকালেই বেশ কয়েকশত মারফতী, পাঁচালী, ব্যঙ্গ, মারফতী, ঠিস্ ইত্যাদি গান এবং লেটো-নাচের অভিনয়োপযোগী ছোট ছোট নাটক-নাটিকা রচনা করেছেন। তাঁর বাল্য-জীবনের রচিত সাহিত্য কুলীন সমাজে সমাদৃত না হলেও গীতগুলির অনাড়ম্বর সরল ভাষা কচিমনের অনাবিল ভাব পরিস্ফুট করেছে এবং পরবর্তীকালেও ভাষার এই সারল্য তাঁর রচিত সাহিত্য তথা শিশুসাহিত্যে প্রত্যক্ষ প্রভাব ফেলেছে ও সাহিত্য স্বাচ্ছন্দ্য লাভ করেছে। মসজিদ, মাজার ও মক্তবের আওতায় থাকার ফলে তাঁর কবিতায়, গানে প্রচুর আরবী-ফারসী শব্দ ব্যবহার করতে পেরেছেন।

(’১৯১৪ সালের ফেব্রয়ারী মাসে নজরুল দরিরামপুর হাইস্কুলে ছাত্রাবস্থায় পীর মাহমুদ হাজীর (ত্রিশাল দরিরামপুর হাই স্কুল পরিচালনা কমিটির একজন কর্মকর্তা) কাছে মক্কা মদিনার গল্প শুনতে আসতেন। এভাবেই নজরুল প্রথম ইসলামী ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচিত হন।’১

নজরুল এখানে লেখাপড়ায় অত্যন্ত অমনোযোগী ছিলেন কিন্তু ক্লাসে বরাবরই প্রথম হতেন এজন্য তিনি বার্ষিক ভাতা পেতেন। এমনকি সাপ্তাহিক নাটকে, বিতর্কে, গান, অভিনয়, আবৃত্তি, রচনা প্রতিযোগিতায় সবকিছুতেই নজরুল প্রথম হতেন। বিতর্কে ও রচনায় নজরুল মাঝে মাঝে আস্বাভাবিক শব্দাদি ব্যবহার করতেন যা শিক্ষকদেরও অবাক করতো।

দরিরামপুর হাইস্কুলে পাঠকালীন  সে-

’সুন্দর কবিতা লিখে স্কুলের সাপ্তাহিক সভায় পড়ে শোনায়। মাষ্টাররা বিশ্বাস করেন না। তাঁরা বলেন, রবীন্দ্রনাথের না-পড়া কবিতা নিজের নামে চালিয়ে দিচ্ছে’।২

নজরুল আবৃত্তিও করতেন খুব সুন্দর। দরিরামপুর হাই স্কুলে পাঠকালীন (১৯১৪) স্কুলের বাৎসরিক বিচিত্রানুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়।

’কোনো মহড়া ব্যতিরেকেই সে-অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথের কবিতা ’দুই বিঘা জমি’ ও ’পুরাতন ভৃত্য’ এমন             চমৎকাররূপে আবৃত্তি করেন যে, সে কথা বলতে গিয়ে মহিম বাবু আজো আনন্দে গদ্গদ হয়ে উঠেন।’৩

’নজরুলের তৎকালীন  রচনা ’করুণ-গাথা’, ’করুন-বেহাগ’, ও ’চড়ুই পাখির ছানা’ যথাক্রমে অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত         ও স্বরবৃত্ত ছন্দের নিদর্শন। সেই সুকুমার বয়সেই নজরুল বাংলায় এই তিনটি মুল ছন্দ আয়ত্ত করে ফেলেছেন…।              এসব রচনা থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, তাঁর তখনকার কবিতায় লেটো দল ও কবিয়ালদের প্রভাব তিরোহিত        হয়ে শালীন আধুনিক ভংগীর সূচনা হয়েছে।’৪ )

রাণীগঞ্জের সিয়ারসোল স্কুলে (১৯১৫-১৯১৮) পাঠকালীন কবিতা-ছড়া-গান লিখতেন। এ সময়ের লেখা ’চড়ুই পাখীর ছানা’, কবিতার ভাষা পূর্বাপেক্ষা মার্জিত, ভাব প্রকাশে উন্নতি এবং ছন্দ-জ্ঞানও বৃদ্ধি পায়। øেহ, বাৎসল্য ও মমতার আধারে রচিত নজরুলের কবিতাটি হয়ে উঠেছে প্রাণস্পন্দনস্বরূপ। ’অগ্নিগিরি’ গল্পে রস্তম সর্দারের দলের দুরন্তপনায় নজরুলের কাজীর শিমলা আর দরিরামপুরের অভিজ্ঞতা  প্রকাশ পেয়েছে। গল্পে ময়মনসিংহের আঞ্চলিক ভাষার ছড়ার ব্যবহার লক্ষ্যণীয়।’৫ পরবর্র্তীকালে ছড়াটি ’পুতুলের বিয়ে’ গ্রন্থেও ব্যবহৃত।

ঠ্যাং চ্যাগাইয়া প্যাঁচা যায়

যাইতে যাইতে খ্যাচ্খ্যাচায়

প্যাঁচায় গিয়া উঠল গাছ,

কাওয়ারা সব লইল পাছ।

প্যাঁচার ভাইশ্তা কোলা ব্যাং

কইল, চাচা দাও মোর ঠ্যাং

প্যাঁচায় কয়, বাপ, বারিত যাও

পাছ লইছে সব হাপের ছাও

ইঁদুর জবাই কইর‌্যা খায়

বোঁচা নাকে ফ্যাচ্ফ্যাচায় ॥

লক্ষ্যণীয় যে রাঢ় বাংলার বালকের মুখে পূর্ব বাংলার ময়মনসিংহের আঞ্চলিক ভাষা সুন্দরভাবে রূপান্তরিত হয়েছে।

১৯১৮ সালে নজরুল পড়াশুনা ছেড়ে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। নৌসেনায় ট্রেনিং শেষ করে কোয়ার্টার মাষ্টার হাবিলদার পদে বেঙ্গল ব্যাটিলিয়নে যোগ দেন। (নজরুল প্রকাশিত সর্বপ্রথম রচনা ”বাউন্ডেলের আত্মকাহিনী” ১৩২৬ (১৯১৯)৬ জৈষ্ঠ্য সংখ্যা ’সওগাত’-এ ছাপা হয়। (তাতে”রানীগঞ্জ সিয়ারসোল রাজ-স্কুলের” উল্লেখ আছে।-)। ঐ বছরই জুলাই আগষ্ট মাসে ’বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য’ পত্রিকায় ’মুক্তি’ ৭প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়।)

(নজরুলের সাহিত্যচর্চার কাল ১৩২৬-১৩৪৯(১৯১৯-১৯৪২) ২৩ বছর। নজরুল তার সাহিত্য জীবনের প্রথম দশ বছর কবিতা এবং শেষ তের বছর গান রচনা করেন। নজরুলের সাহিত্য জীবনের স্থিতি বিশ শতকের তৃতীয ও চতুর্র্থ দশক। মোটামুটিভাবে প্রথম ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের মধ্যবর্তীকালীন সময়। নজরুল বাংলা সাহিত্যে প্রবেশের পূর্বেই রবীন্দ্রনাথের কৈশোরিক রচনাবলী ছাড়াও যৌবনে রচিত রচনাবলী প্রকাশিত হয়েছে। সাহিত্যক্ষেত্রে নজরুলের বড় কৃতিত্ব রবীন্দ্র-বলয় থেকে বেরিয়ে আসা।)

নজরুলের কাব্যে প্রবল ব্যক্তিত্বের স্ফূরণ হযেছে, তাই বিমূর্ত জীবন চেতনা বা অপ্রত্যক্ষ সত্তার কাছে আত্মসমর্পণের বিরুদ্ধে তাঁর মধ্যে জাগরণ দেখা গিয়েছে। সে কারণেই তার কবিতায় সীমাকে ছেড়ে অসীমের উত্তরণের বা দেহকে ছাড়িয়ে দেহাতীতে যাবার প্রয়াস নেই। তাঁর চিত্রকল্পে বাস্তব ঘটনার চেতনা বা উপস্থিতি প্রখর। সমাজ সচেতনতা ও সাম্যবাদী চেতনা নজরুল ইসলামের অন্যতম প্রধান সুর এবং বাংলা কাব্যে এ ধারাকে তিনি সমৃদ্ধ করেছেন।

নজরুল কাব্যে রবীন্দ্র কাব্য-নির্ঝরের মত নব নব উন্মেষিকা প্রতিভার পরিচয় নেই, কিন্তু নজরুল তাঁর কবিতায় বিশেষ যে মনোভঙ্গিটি বজায় রাখতে সমর্থ হয়েছেন তা হ’ল যৌবন বন্দনা। বিদ্রোহী কবিতায় যে ভাব, ভঙ্গী ও ছন্দের সূত্রপাত সম্ভব হয়েছিল থেকে থেকেই তা নজরুল ইসলামের কবিতায় ধরা পডেছে।)

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতই বিচিত্র সাহিত্যজীবনের পরিধির মধ্যে নজরুল শিশুসাহিত্য একটি খন্ডাংশ মাত্র। কিন্তু এই সংক্ষিপ্ত শিশুসাহিত্য পুর্ববর্তী শিশুসাহিত্যিকদের তুলনায় বিষয়ের বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধতর। নজরুল শিশুকে ছেলে ভুলানো ছড়া শোনাননি বা শুধু পুঁথিগত বিদ্যায় পারদর্শী করতে চাননি বা শুষ্ক নীতিবাক্য শোনাননি বরং শিশুসাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় তাঁর পদচারণা শিশুকে এক ভিন্নতর জগতে নিয়ে যায়।

পরিমাণে স্বল্প হলেও উৎকর্ষের বিচারে তাঁর শিশুসাহিত্য এক দুর্লভ সম্পদ।…শিশুসাহিত্যের কোন কোন জায়গায় তিনি প্রায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী। নজরুল চরিতমানস পৃ-২৪৭।৯

আধুনিক বাংলা কবিতার সাধারণ লক্ষণগুলোর মধ্যে অন্ততঃ কয়েকটি ভিত্তিমূল নজরুল ইসলামের কবিতাতেই প্রতিষ্ঠিত হয়। তাঁর সাধনার বড় সার্থকতা হচ্ছে, রবীন্দ্রনাথের ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে সচেতনভাবে বিদ্রোহী না হয়েও স্বচ্ছন্দে রবীন্দ্র প্রভাব থেকে মুক্তি। ভাবধর্মের সঙ্গে শৈলী বা আঙ্গিকের ক্ষেত্রে আধুনিক কবিতায় যে বিধিবদ্ধ পরিবর্তন দেখা দেয়, তার বিশিষ্ট লক্ষণগুলো অবশ্য নজরুল ইসলামে স্পষ্ট নয়। তবে প্রবাদ চলতি শব্দ, গ্রাম্য শব্দ ও বিদেশী শব্দ ব্যবহারে, ভাষা সম্বন্ধে সূচিবায় পরিহারে, নতুন চিত্রকল্প সৃষ্টিতে, বিষয় বৈচিত্র্যে ও ছন্দ স্বচ্ছন্দে নজরুল ইসলাম তিরিশের আধুনিক কবিদের পূর্বসূরী। ঐতিহ্যের ক্ষেত্রে নজরুল ইসলামের পটভূমি বিস্তৃত, হিন্দু, মুসলিম ও ইরাণীয় ঐতিহ্য তাঁর মানসকে অভিষিক্ত করেছে। মুসলিম সন্তান হলেও তিনি কেবল মুসলিম বা ইসলামী ঐতিহ্যের মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি, তিনি নিজের ধর্মীয় ও সামাজিক ঐতিহ্যকে অতিক্রম করে বাংলাদেশের অপর একটি প্রধান ধারা হিন্দু ঐতিহ্যও সমান ভাবে গ্রহন করেছেন এবং শিশুাহিত্যেও তার সার্থক ব্যবহার করেছেন। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে অপর কোন কবি বাংলার দুটি প্রধান ঐতিহ্যের ধারা থেকে নজরুল ইসলামের মত নিপুণভাবে উপাদান সংগ্রহ করে তা সাহিত্যে ব্যবহার করতে সক্ষম হননি, সেদিক থেকে তিনি অনন্য। নজরুল ইসলামের সমসাময়িক মুসলমান কবিরা মীর মোশাররফ হোসেন ((১৯৪৮-১৯১১), কায়কোবাদ (১৮৫৭-১৯৫২), সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী (১৮৮০-১৯৩১) প্রমুখেরা ছিলেন মুসলিম পুনর্জাগরণবাদী। নবজাগরণের আহ্বান এসেছে নজরুল ইসলাম থেকে ।

নজরুল শিশুসাহিত্য আন্তর-চেতনা ও বিগত বৈশিষ্ট্যের দিক দিয়ে সামগ্রিক নজরুল সাহিত্য থেকে আলাদা কিছু  নয়।

নজরুল ছিলেন বেগের কবি আবেগের কবি, তারুণ্য, উজ্জীবন, শক্তিময়তা, শুভ কল্যাণ আর প্রগতির কবি; প্রেম, মানবতা,

সৌন্দর্য আর সৌাভ্রাতৃত্বের কবি তবে শিশু-কিশোর সাহিত্য যেহেতু বয়স, রুচি, মনন-শৈলী এবং প্রেজেন্টেশনের ক্ষেত্রে

একটা বিশেষ মাত্রা ও বৈশিষ্ট্য দাবি করে, সেহেতু নজরুল অত্যন্ত নিপুণতা ও পারঙ্গমতাার সাথে, যথার্থ পরিমিত সংযম ও

কান্ডজ্ঞান বজায় রেখে শিশুসাহিত্য রচনা করেছেন। তিনি জানতেন ছোটরাও জাতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ; তাদের বাদ

দিয়ে ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধ জাতি গঠনের চিন্তা করা বাতুলতা মাত্র। তাদের মানসিক ও সৃজনশীলতার বিকাশে তাদের মধ্যকার

শুভ ও কল্যাণবোধের উজ্জীবনÑসর্বোপরি তাদের মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে শিশুসাহিত্য অসাধারণ ভূমিকা পালন

করে। নজরুলও সে বিষয়িিট বিশ্বাস করতেন তাই শিশুসাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে আমরা তাঁর সযতœ সুপরিকল্পনা লক্ষ্য করি।

শিশুদের মানস-বৈশিষ্ট্য, তাদের চরিত্রের নানা মাত্রা, তাদের আশা-আকাংখা চাহিদা সবই ছিল তাঁর নখদর্পনে। তাঁর

জীবনে কর্মে এক ধরনের শিশুসুলভ চাপল্য ও ডানপিটেমি বজায় ছিলো প্রায় সবময়ই। তাই বোধহয় এত সহজে তিনি

বলতে পারেন আমি…..। শিশুসাহিত্য যেন তাঁর জীবনভাষ্য। তাঁর দুরন্তপনা, সংবেদনশীলতা, মানবতা, প্রাণখোলা

উদারতা, কল্পনার বল্গাহীনতা, সামনে চলার দুর্দম আকাংখা, ক্ষুদ্রত্ব, দীনহীনতাকে অতিক্রম করে শুভ ও কল্যাণের প্রশস্ত

জমিনে বিচরণÑএসব চিরচেনা  নজরুলীয় বৈশিষ্ট্য নানা কৌশলে নানা প্রকরণে প্রতিভাত হয়েছে তাঁর শিশুসাহিত্যে।

উল্লিখিত নজরুলীয় বৈশিষ্ট্যের আলোকে, মর্মবাণী ও অন্তর্গত চেতনার প্রেক্ষাপটে সমগ্র নজরুল শিশুসাহিত্যকে মোটামুটি

নিম্ববর্ণিত ভাবে শ্রেণীবদ্ধ করা যেতে পারে—-।

নজরুল ইসলামের শিশুসাহিত্যের বিষয়ভিত্তিক শ্রেণীকর-।

সাধারণ জিনিসকে অসাধারণত্ব দান – ‘ঝিঙ্গে ফুল’ কবিতা।

বাস্তবসম্মত শিক্ষা – ‘খুকী ও কাঠবেরালি’,‘খোকার খুশী’, ‘খাঁদু দাদু’, ‘দিদির বে’তে খোকা’।

অভিনন্দন পত্র – করুণ গাঁথা।

কৌতুক রসের কবিতা – ’আগা মুর্গী লেকে ভাগা’, ‘খোকার বুদ্ধি’, ‘খোকার গপ্প বলা’, ‘চিঠি’, ‘হোঁদল কুঁৎকুতের বিজ্ঞাপন’, ‘ঠ্যাং ফুলী’, ‘পিলে-পটকা’, ‘মট্কু মাইতি বাঁটকুল রায়’, ‘নতুন খাবার’, ‘বগ দেখেছ’, ‘ফ্যাসাদ’,

হাস্যরসÑ’গদাইয়ের পদবৃদ্ধি’ ইত্যাদি।

শিক্ষামূলক উপদেশ – ‘লিচু চোর’, ‘সাত ভাই চম্পা’, নজরুল সম্পাদিত ও সংকলিত ‘মক্তব সাহিত্য’।

দেশপ্রেম – ‘হোঁদল কুঁৎকুতের বিজ্ঞাপন’ ইত্যাদি।

আদর্শবাদী তথা শিক্ষামূলক -‘সাত ভাই চম্পা’, ’মক্তব সাহিত্য গ্রন্থে’র রচনাবলী ইত্যাদি।

উপদেশ তথা নীতিশিক্ষা – ‘মা’ ইত্যাদি।

দর্শন তত্ত্বমূলক -’জিজ্ঞাসা’, নজ রচ.Ñ৩য় খন্ডের অন্তর্গত। গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত কবিতা ও গান’ পর্যায়ের একটি কবিতা। লঘু ছন্দে লেখা এই কবিতায় শিশুশিক্ষা ও শিশুমনস্তত্বের বিষয়ে কবির অসাধারণ দখল প্রকাশ পেয়েছে। ’কোথায় ছিলাম আমি’

কাহিনী কবিতা – ‘লিচু চোর’।

জাগরণমূলক – ‘প্রভাতী’, ‘সাত ভাই চম্পা’ ইত্যাদি।

প্রেরণা সমৃদ্ধ রচনা – ‘সংকল্প’, ‘ছোট হিটলার’, ’মায়া-মুকুর’ ইত্যাদি।

মনস্তাত্বিক -’মটকু মাইতি বাঁটকুল রায়’।

উদ্বোধনমূলক – ’মুকুলের উদ্বোধন’।

সৌন্দর্য্য সৃষ্টিমূলক – ‘ঝিঙে ফুল’, ‘সারস পাখি’, ‘আগুনের ফুল্কী ছোটে’ (দৈনিক নবযুগ, ৮ই অগ্রহায়ণ, ১৩৪৮, পৃ-৮)ইত্যাদি।

বাৎসল্য রসের কবিতা – ‘শিশু যাদুকর’, ‘আবাহন’, ‘কোথায় ছিলাম আমি’ ইত্যাদি।

ব্যঙ্গরসাত্মক -’ফ্যাসাদ’, আগা মুর্গী লেকে ভাগা’ (ছোটদের মধুচক্র’ ১৩৪১), ’লক্ষ্মী ছেলে তাই তোলে’,  ‘ওরে হুলোরে তুই রাত বিরেতে’।

শিশুপ্রীতি তথা মানব সেবার কাহিনী -‘ঈদের দিনে’ গল্পে।

কল্যাণ ধর্মী রচনা – ‘পুতুলের বিয়ে’ নাটিকা।

অভিযানমূলক – ‘জাগো সুন্দর চিরকিশোর’ একাংকিকা।

আনন্দ দান – ‘প্রজাপতি’, ‘শুক্নো পাতার নূপুর পায়ে’(গান), ইত্যাদি।

বিশ শতকের তৃতীয় দশকে নজরুল ইসলামের শ্রেষ্ঠ শিশুতোষ কাব্যগ্রন্থ ‘ঝিঙেফুল’ (আশ্বিন-১৩৩৩, ১৯২৬) শিশুর জন্য

রচিত এবং শিশু মনস্তত্ত্বের সার্থক প্রতিফলন ঘটেছে এই কাব্যগ্রন্থে। এতে ভূমিকা স্বরূপ নাম Ñ কবিতাটি ছাড়া আরো

তেরটি কবিতা রয়েছে। নজরুল ইসলামের বুকভরা আগুনের অন্তরালে লুকিয়ে ছিল মমতার হিমশীতল প্রসবণ। নজরুল

ইসলাম বাংলা সাহিত্যে যুগস্রষ্টা তিনি নিজে একটি যুগকে পরিব্যাপ্ত করে আছেন। রবীন্দ্র প্রভাবমুক্ত অসাধারন ক্ষমতার

অধিকারী নজরুল ইসলামের কাব্য প্রথমদিকে ছিল বিপ্লবধর্মী। সাময়িক পারিপার্শ্বিকতা দৃষ্টে এই বিপ্লবধর্মী সৃষ্টিকে

কল্যাণধর্মি বলা যায়। যুগ-জাগরণের অগ্নিবানী তার লেখনী থেকে উৎসারিত হত; সাময়িক রাজনৈতিক কর্মীরা তাই

কবিকে বলত ’বিপ্লবের রক্ত অশ্ব’। কবির কবিতায় বিপ্লবীরা পেত প্রাণ আর বিপ্লবী তরুণ-তরুনীদের আত্মদানে কবির

প্রাণে জাগত পুলক স্পন্দন। তিনি উদ্দাম গতিতে সৃষ্টি করে চলতেন আগুণ ছড়ানো কবিতা। কবির বুকের আগুণ

লেখনীতে ধরা দিত।

আজাদী আন্দোলনের এই ডামাডোলের মধ্যেও কবি শিশুদের জন্য অফুরন্ত মমতা নিজের অন্তরে সঞ্চিত রেখেছিলেন। তিনি স্বপ্ন দেখতেন তার দেশ স্বাধীন হবে দেশের কোটি কোটি শিশুর চোখে মুখে আশা ও জয়ের দীপ্তি ঠিকরে বের হবে। তাজা ফুলের মত শিশুরা ফুটে উঠবে আর তার সৌরভে জগৎ আলোকিত হবে। আশাবাদী বলেই নজরুল ইসলামের লেখার অধিকাংশই কল্যাণধর্মী।

বিশ শতকের শক্তিমান ও শ্রেষ্ঠ শিশুসাহিত্যিক নিঃসন্দেহে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সুকুমার রায়। তবে তাদের চিন্তাধারার সঙ্গে নজরুল ইসলামের চিন্তাধারার পার্থক্য যথেষ্ট। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটদের জন্য লেখা সব কবিতাই ছোটদের উপযোগী নয়। বড়দের চোখে ছোটদের জন্য রসোত্তীর্ণ মনে হলেও, সেগুলি বোঝার মত ক্ষমতা শিশুদের না থাকাই স্বাভাবিক।

সুকুমার রায় এদিক হতে অভাবনীয় কৃতিত্বের অধিকারী। শিশুমনের উপর বৈজ্ঞানিক দৃ্িষ্ট চালিয়ে তিনি নিজের মানসে শিশুমনের প্রতিচ্ছবি তুলে নিতে পেরেছেন। শিশুর মন জানা থাকলে তবেই তাদের মনের মত সৃষ্টি সম্ভব। সুকুমার রায় একালের সার্থক শিশু-স্রষ্টা। তাঁর ট্যাঁশ-গরু’, গোঁফচুরি কুমড়োপটাশ শিশুসাহিত্যে অমর সৃষ্টি। আনন্দের উপাদান সাহিত্যের মাধ্যমে আর কেউ এত বেশী যোগাতে পারেননি। কিন্তু কেবল আনন্দই সব নয়। স্রষ্টা যে তাকে কেবল আনন্দের উপাদান সংগ্রহ করলেই চলে না। নজরুল ইসলাম এই সত্য উপলব্ধি করেছিলেন। আর্টের জন্য আর্ট;-এই চিন্তাধারায় নজরুল ইসলাম বিশ্বাসী নহেন বলেই নজরুল ইসলামের শিশুসাহিত্যের মধ্যে সন্তর্পণে অন্য সুরের অনুপ্রবেশ লক্ষ্য করি। এ সুর জাগ্রত জাতি সৃষ্টির তাগিদে অপরিহার্য। কল্যাণধর্মী সৃষ্টিও রসোত্তীর্ণ হওয়া সম্ভব এবং তা রসোত্তীর্ণ হওয়াই স্রষ্টার কৃতিত্বের পরিচায়ক। কবির ’লিচুচোর’১২ কবিতা আজ শিশুদের মুখে মুখে। অপার আনন্দে তারা এই কবিতা কন্ঠস্থ করেÑ                                                                   …….কাণ মলি ভাই

চুরিতে আর যদি যাই।

নীতিকথার ইষ্টক বর্ষণ না করে আনন্দ-উল্লাসের মধ্য দিয়ে শিশুদের গড়ে তোলার এই কৃতিত্ব বোধহয় একা নজরুল ইসলামেরই ছিল। কবিতাটি বিষয়বস্তু ও স্বরবৃত্ত ছন্দের নিখুঁত প্রয়োগ বৈচিত্র্যে বাংলা শিশুসাহিত্যে একটি শ্রেষ্ঠ সৃষ্টির দাবীদার। কবির ব্যক্তি জীবনের দুরন্তপনা ছড়িয়ে আছে কবিতাটিতে। কল্পনার স্বর্গরাজ্য নয়, বাস্তবজীবনের দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও ঘাত-প্রতিঘাতময় জীবনের কথা শুনিয়েছেন কবি শিশুদের। কবিতাটি ক্লাসিক্সের মর্যাদা পেয়েছে।

এমন একটা পরিস্থিতি এই কবিতায় রচনা করা হয়েছে যা সহজেই শিশুমনকে আকর্ষণ করে। আঠারোটি ক্রিয়ার এমন কৌতুহল জাগিয়ে রাখা নাটকধর্মী কবিতা বাংলা শিশুসাহিত্যে বিরল। নজরুল ইসলামের হাস্যরস নিয়ে আলোচনা করেছেন রাশিদুল হাসান ’হাস্যরসিক নজরুল’ প্রবন্ধে। তিনি নিরীক্ষণ করেছেন নজরুলের হাস্যরসে কোন তিক্ততা বা ব্যঙ্গ নেই। তাঁর হাসি বাঁধভাঙ্গা স্রোতের মত, সব কিছু ভাসিয়ে নিয়ে যায়। তাঁর বিদ্রোহের মতোই কোন বাঁধা মানতে চায় না। শিশুদের নিয়ে কবিতাতেও তার অনাবিল হাস্যরসের পরিচয় মেলেÑ যেমন ’লিচু চোর’।

শিশু বিষয়ক কবিতাতে রবীন্দ্রনাথ অপেক্ষা তার মধ্যে উৎকর্ষতার পরিচয় মেলে,

রবীন্দ্রনাথের শিশু বইতে শিশুমনের যে প্রকাশ দেখতে পাই সেখানে মনে হয় Ñপ্রায়ই মনে হয় যে শিশুটা একটু ইঁচড়ে পেকে গেছে বোধ হয়, কিন্তু নজরুলের কবিতায় সুকুমার রায়ের কবিতার মতই শিশুমনের উচ্ছ্বসিত অভিব্যক্তি দেখতে পাই।

নিছক আনন্দের খোরাক জোগায় এমন বহু কবিতা কবির আছে, যা ঘঁৎংবৎু জযুসব-এর পর্যায়ে পড়ে। কিন্তু কবি নীতিবোধকে সব সময় প্রাধান্য দিয়েছেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল নতুন জাতি গঠন করা।Ñনিষ্কলুষ, প্রাণবন্ত জাতি।

‘মুকুল-আন্দোলনের গোড়াপত্তনের পূর্বে আমি কবির নিকট বহুবার গিয়াছি। তিনি বলিতেন-নজরুল ইসলামের           অন্তরের তাগিদকে তিনি ভাষা দিয়ে বর্ণনা করতে না পারার অক্ষমতা প্রকাশ করেছেন।১৩

মুকুলদের জন্য তিনি মোবারকবাদ জানিয়ে লিখেছেন

মোরা ফোটা ফুল

 

তোমাদের সাথে মিশে

*       *    *

ফুল দল

দুনিয়ার মহফিলে।

*             *        *

গোলামের চেয়ে শহীদী দরজা

————————–

শির করিওনা নীচু

শিশুদের জন্য এটা  কবির মহাদান। ছোটদের জন্য তার এত মমত্ববোধ লুকিয়ে ছিল যে তার পরিমাপ করা যায়না। তার বুক ভরা আগুনের অন্তরালে লুকিয়ে ছিল মমতার প্রসবণ।

‘সন্দেশ’ পরবর্তী পত্রিকাগুলি১৪ লেখা ও লেখকের মানসিকতায় স্পষ্ট নতুনত্ব দেখা যায়। ১৯১৯-২০ এর খিলাফত আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মুসলমান-সমাজ। প্রথম মহাযুদ্ধের ফলে তুর্কির পরাজয় হলে খলিফাদের প্রভাব প্রতিপত্তি উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়। মুসলমানরা তার কারণ হিসেবে দায়ী করেছিলেন ব্রিটিশ সরকারকে। তারা প্রতিবাদ আর প্রতিরোধের আন্দোলন গড়ে তুললেন। মওলানা শওকত আলী আর মওলানা আবুল কালাম আজাদ ও মোহাম্মদ আলী তার নেতৃত্ব দিলেন। এই আন্দোলন বাংলার মুসলমান সমাজের একটা বড় উপকার হেেয়ছিল। সাহিত্যের ইতিহাসে কিছু বড় লেখকের আবির্ভাব হয়েছিল, যাঁরা ইসলাম ধর্মের ধ্বজা উড়িয়ে আসেননি, কিন্তু মুসলমান সমাজ জীবনের স্বাতন্ত্র্যের চিহ্ন বহন করে এনেছিলেন। অন্যকথায় এঁরা মানবতার জয়বাণী উচ্চারণ করেছিলেন। গোলাম মোস্তফা (১৮৯৭), কাজী নজরুল ইসলাম, জসীম উদ্দীন (১৯০৩), বন্দে আলী মিঞা (১৯০৭) প্রভৃতি প্রসিদ্ধ কবি, সাহত্যিকরা এলেন। বাংলা শিশুসাহিত্য এঁদের প্রত্যেকের নিকটই ঋণী। আর ’মৌচাক’১৫ শিশুপত্রেই এঁদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিমান লেখক নজরুল ইসলামের শিশু কবিতার সূত্রপাত হল। ১৯২১-এর অক্টোবর ষষ্ঠ সংখ্যায় কাজীর সেই বিখ্যাত শিশু কবিতা ’খুকী ও কাঠবেরালি১৬ প্রকাশিত হয়। পরবর্তীকালে কবিতাটি ’ঝিঙেফুল’ (১৯২৬) কাব্যগ্রন্থের অন্তভর্ুৃক্ত হয়।

জীবন শুধু কল্পনার বিলাসই নয় বাস্তবের দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও ঘাত-প্রতিঘাতময় ‘খুকী ও কাঠবেরালি’ কবিতাতে তিনি শিশুদের কাছে সে কথাটিই প্রমাণ করতে চেয়েছেন। খুকীর জবানীতে শিশু মনস্তত্ত্বের চড়াই উৎরাই অতিক্রমনের বন্ধুর পথটি অঙ্কন করা হয়েছে। কবিতাটি ছোটদের কন্ঠে আবৃত্তির উপযোগী বাংলা সাহিত্যের এক ব্যতিক্রমধর্মী রচনা।

শিশুমনে জিজ্ঞাসার শেষ নেই, কথার শেষ নেই, গল্প রচনায় ক্লান্তি নেই। তার কথা সবার সঙ্গে। মানুষের সঙ্গে এবং সব প্রাণীর সঙ্গে। দৃশ্যমান সব কিছুর সঙ্গে তার কৌতুহল, সবার সঙ্গেই তার বাক্যালাপ। এখানে শিশু কথা বলছে কাঠবেরালির সঙ্গে। শিশুর একটি ছোট্ট প্রত্যাশা এবং তাকে কেন্দ্র করে অভিমান ও তিরস্কারে ভরা এক অবিস্মরণীয কবিতা ’খুকী ও কাঠবেরালি’।

’আবেদনের ধরন, সখ্যতার অধিকার, বঞ্চিতের অভিমান, গোপন বাসনার অপ্রত্যক্ষ প্রকাশ, প্রলুব্ধ করার কৌশল তোষণের সরল অভিব্যক্তি, অপ্রাপ্তির আক্রোশ সবই ধারাবাহিকভাবে চিত্রিত হয়েছে কবিতাটিতে।৭/১৭

এ কবিতাটি যে শিশুদের খুব প্রিয় তার প্রমাণ ছোটদের যে কোন অনুষ্ঠানে এই কবিতার পুনঃ পুনঃ আবৃত্তি দীর্ঘকাল যাবৎ।

‘খোকার খুশি’ কবিতাতে খোকার মতে ‘বিবাহ’ অর্থই খুব খাওয়া দাওয়ার ধুম,

বিবাহ! বাস, কি মজা!

সারাদিন ম-া গজা

গপাগপ্ খাও না সোজা

দেওয়ালে ঠেসান দিয়ে।

শিশুরা সব সময়ই কৌতূহল প্রিয়। কবিতাটিতে শিশু মনের অজানা কৌতূহল ফুটে উঠেছে। বিয়ের যে কষ্টকর দিকটি উপোস থাকা বা শুধু হরিমটর খাওয়া শিশু সেসব ঝামেলা পোয়াতে চায়না, সে কষ্টকর দিকটি গ্রহণ করতে চায়না। সে শুধুই আনন্দের, øেহ-প্রেম-প্রীতির ভাগটি নিতে চায়। ‘মামী এলে তার আদর  পাওয়ার আশা আছে, এটাই বেশ ভাল। সে সানন্দে ঘোষণা করে, ‘আমি রোজ করব বিয়ে’। খোকার খুশী বিয়ে করাতেই, বর হওয়াতে নয়-এই হল কবিতাটির কৌতুকের ব্যাপার। কবি কবিতাটির বিষয়বস্তু নির্বাচন ও শব্দচয়নে শিশুদের নিকট সাহিত্যের রস পরিবেশন করেছেন ও শিশু মনে আনন্দের খোরাক জুগিয়েছেন।

সুরসিক বিশ্লেষণী পর্যবেক্ষণ আর মন্তব্যে কিছু কবিতা হাস্যকর হয়ে উঠেছে, তা কেবল তাঁর অসাধারণ কল্পনাশক্তির বলেই সম্ভব হয়েছে। বক্তব্য এখানে সিরিয়াস হলেও, আদর্শবাদী কবিতার ক্ষেত্রে রচনাভঙ্গি বলিষ্ঠতর এবং আদর্শ ঋজুরেখ ও স্পষ্টবাক। নায়কের আঙ্গিক ত্রুটি আর উদ্ভট আচরণ এবং নজরুল ইসলামের নিজস্ব গড়া কিছু শব্দ দিয়ে নজরুল ইসলাম যে, হাস্যরসের সৃষ্টি করেছেন তা শিশুকাব্য সাহিত্যে তাঁর আগে কেউ পরিবেশন করেননি। নজরুলের এসব ছন্দিত রচনা লিখেছিলেন শিশু কিশোরদের প্রেরণা দানের জন্য; কিছু আবার আনন্দ দানের উদ্দেশ্যে। ’ঠ্যাং ফুলি’, ’পিলে পটকা’, ’হোঁদল কুঁৎকুঁতের বিজ্ঞাপন’(১৩২৭ জৈষ্ঠ‘, ’অঙ্কুর’)।

’ঠ্যাং-ফুলী’ (হোÑহোÑহোÑর্উরোÑহোÑহো) কবিতাটির ছন্দোচাতুর্য ’লিচুচোর’ কবিতার সমগোত্রীয়। ছোটদের খুশী করবার ছন্দ ও ধ্বনিÑব্যঞ্জনা সৃষ্টির কৌশল কবির করায়ত্ত ছিল। এর কারণ সম্পর্কে ডঃ সুশীলকুমার গুপ্ত বলেনÑ

নজরুলের কবিমানসের  একদিকে একটি শৈশবের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় তাঁর শিশুসুলভ খামখেয়ালিপনা, ভাবালুতা ও বাধাবন্ধনহীনতা হাস্য পরিহাসের লঘুতার জন্যই তিনি যথার্থ শিশুভাবে ভাবিত হয়ে সার্থক শিশুসাহিত্য রচনা করতে পেরেছেন। পরিমানে স্বল্প হলেও উৎকর্ষের বিচারে তাঁর শিশুসাহিত্য বাঙলা সাহিত্যের এক ’দুর্লভ সম্পদ’।১৮

’হোঁদল কুঁৎকুঁতের বিজ্ঞাপন’ (মিচকে মারা কয়না কথা মনটি বড় খুঁৎখুঁতে) কবি নানারকম শিশুর উদ্ভট ও মজাদার বর্ণনার মাধ্যমে নির্মল হাস্যরসের সৃষ্টি করেছেন। নজরুল ইসলাম ’মিচ্কে-মারা ছিচ্কাঁদুনে ’ড্যাবরা’ ছেলে থেকে ’বীরবাদলের পরিচয় দিয়েছেন। এই কবিতায় যেমন বিষয়বস্তুর দিক থেকে, তেমনি ছন্দ, শব্দ, ধ্বনি ব্যবহারের দিক থেকেও এটি শিশুমনকে অতি সহজে আকৃষ্ট করে।

’বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা’য় যথাক্রমে  ‘মা’ ( ১৩২৮ শ্রাবণ, ১৯২২), ‘‘খোকার গপ্প বলা’ (১৩২৮মাঘ), ‘চিঠি’

(১৩২৮মাঘ) প্রকাশিত হয়।

‘খাঁদু-দাদু’ ( ১৩৩৩ )(নজ.রচ.Ñ১ম খন্ড) শিশুর জবানীতে লেখা অবিমিশ্র মজার কবিতা। এর নামকরণের মধ্য দিয়েই কবিতাটির পরিচয় মূর্ত হয়ে উঠেছে। নাতি ও দাদুর সুখকর সম্পর্ক আমাদের সমাজ জীবনের এক সম্পদ। দিদিমাও সে সম্পদ বৃদ্ধি করেছেন। এখানে দাদুর বোঁচা নাক নিয়ে নাতির রসিকতাই কবিতাটির উপজীব্য। কবিতাটিতে স্থান পেয়েছে দাদুর নাসিকার নানাবিধ তত্ত্বকথা। কবিতাটির প্রতিস্তবকে ধুয়া হিসেবে ব্যবহৃত চরণটিতে ”অমা! আমি হেসে মরি, নাক ডেঙা ডেং ডেং’ লৌকিক রচনার কিছুটা অনুসরণ রয়েছে”। ৮দাদুর নাকটি ধ্যাবড়া করার পিছনে দিদিমার কোন কারসাজি আছে বলেও নাতির বিশ্বাস। অবশেষে লম্বা নাকের জন্য দাদুকে লম্বা নাকের দেবতা ‘গরূড় দেব’-এর ধ্যানের পরামর্শ দানেই কবিতাটির পরিসমাপ্তি। শিশুর জবানীতে লেখা কৌতুক রসের কবিতা এটি। মাতামহের সঙ্গে খুদে দৌহিত্রের এক অন্তরঙ্গ সম্পর্ক সহাস্য রসিকতাপূর্ণ ভাষায় প্রকাশ পেয়েছে। কবির ছন্দ নির্মাণে অনায়াস গতি, কুশলতা ও নিরাভরণ অলঙ্করণ রীতি এ কবিতার সারল্যকে অবারিত করেছে। অনাবিল পরিহাস রসোচ্ছলতা কবিতাটিকে শিশুদের কাছে আবৃত্তিযোগ্য করে তুলেছে এবং অদ্যাবধি ছোটদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে প্রায়শঃ কবিতাটির আবৃত্তি শোনা যায়। কবিতাটি ক্লাসিক্সের মর্যাদা পেয়েছে।

দিদির বে’তে খোকা’ কবিতায় শিশুর সুখ-দুঃখ মিশ্রিত শ্বাশত মানবিক অনুভূতির স্পর্শ মনকে নাড়া দেয়। শিশুর হৃদয়ে রূপকথার কাহিনী দিদির বিয়েকে কেন্দ্র করে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। রূপকথার রাজপুত্রই দিদির বর হয়ে শিশুর সামনে ধরা দিয়েছে।

’খোকার বুদ্ধি’ ’ (১৩২৮ কার্তিক, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা) কবিতাতে খোকা খুব সহজ সরল মনে তার মার কাছে আষাঢ়ে গল্পের অবতারণা করেছে। আষাঢ়ে গল্পের অবতারণা রবীন্দ্রনাথও৯, করেছেন অবনীন্দ্রনাথও১০ করেছেন। তবে তাঁদের আষাঢ়ে গল্প রূপকথা আশ্রয়ী। ‘আষাঢ়ে গল্প’ শুনতে শুধু শিশুরাই নয়, বয়স্করাও ভালবাসে। গল্পের যে একটি বস্তুনিষ্ঠ ভিত্তি থাকতেই হবে; একটি কার্যকারণ সম্পর্ক থাকতেই হবে এমন কথা শিশুরা মানতে চায় না। শিশুর কল্পনাতে রাজার ফড়িং শিকার করতে যাওয়া এবং রাণীর কল্মী শাক তুলতে যাওয়া কোন মানহানিজনক কাজ নয়,

একদিন না রাজাÑ

ফড়িং শিকার করতে গেলেন খেয়ে পাঁপড় ভাজা!

রাণী গেলেন তুলতে কলমী শাক

বাজিয়ে বগল টাক্ ডুমাডুম টাক্!

আবার বেড়াল বাচ্চাকে হাতি বলে ধরে নেয়া আর রাণীর রামছাগলের পিঠে চড়া শিশুর পক্ষে কোন অকল্পনীয় ব্যাপার নয়,

রাজা শেষে ফিরে এলেন ঘরে

হাতির মতন একটা বেড়াল বাচ্চা শিকার করে’।

এমন সময় দেখেন রাজা আসছে রাণী দৌড়ে

সারকুঁড় হ’তে ক্যাঁকড়া ধ’রে রাম-ছাগলে চড়ে!

সমানভাবে রাজার পান্তাভাত খাওয়ার মধ্যেও ধনী-দরিদ্রের বিভেদ শিশুমনে কোন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে না।

নজরুল ইসলাম একজন শিশু মনস্তত্ত্ববিদ ছিলেন। আলোচ্য কবিতাটিতে তিনি শিশুমনে ঢুকে তার হৃদয়ের কথাটি জেনে নিয়েছেন ও তা’ হৃদয়গ্রাহী করে তুলে ধরেছেন। শিশুর বৈচিত্র্যমন্ডিত কর্মকান্ড, উদ্দীপনাময জীবন যাপন প্রয়াস রকমারী কল্পনা, ও অবুঝ অনুভূতিগুলো এখানে যেন ডানা মেলেছে। কবিতায় নজরুল ইসলাম শিশুমনের সঙ্গে হৃদতা স্থাপন করে রঙ্গরসের পরিবেশনে শিশুর আনন্দবিধানের আয়োজন করেছেন।

‘চিঠি’ (নজ.রচ.-১ম) একটি পত্র কবিতা শিশুর কাঁচা হাতের লেখার এমন বাস্তবমুখী ও চমকপ্রদ বর্ণনা বাংলা শিশু সাহিত্যে দ্বিতীয়টি নেই। ‘কবিতাটি লৌকিক ছড়ার ছন্দে লিখিত জন্টি নামের কোনো ছোট্ট মেয়ের লেখা চিঠির উত্তর,’১০

ছড়ার ছন্দে কৌতুকপূর্ণ সহজ ভাষায় রচিত ছোটদের কবিতাটি কুমিল্লা থেকে কলিকাতায় ফেরার পরে কুমিল্লার শ্রী ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের ছোট্ট মেয়ে ’জটু’র আঁকাবাঁকা অক্ষরে মাত্র তিন ছত্রে লেখা একখানি চিঠি পেয়ে কবিতাটি তার উদ্দেশ্যে রচনা করেন। ন-অ.পৃ-১৮৬

চিঠির অক্ষর আঁকাবাঁকা, বিভিন্ন ছাঁদের ও কিম্ভূতকিমাকার চেহারার। সেটাকে কবি রসিকতা করে লিখেছেন ’যদি তার অক্ষর ছিল ঠ্যাং লম্বা, চিপসে পেটÑওয়ালা, রম্ভা কিম্বা খাম্বার মতো, কারো আবার থুত্ণা উর্র্চ্ছের মতো, তথাপি সে কবির লক্ষ্মী বোনের মতো’। অতঃপর সবার কুশল জিজ্ঞাসাতেই কবিতাটির পরিসমাপ্তি।

তার ছোট্ট চিঠি কবির কাছে মোটেও তুচ্ছ নয়। বরং মহাদামী। ‘কবিতাটির একটি অংশ বড়দের জন্যে রীতিমতো উপভোগ্যÑ যেখানে নজরুল ইসলাম পত্রলেখিকার হাতের লেখার বর্ণনা দেন।’৯

কবিতাটির ছন্দসৌকর্য, বাস্তবমুখী বর্ণনা ও শব্দচয়নে নজরুল ইসলাম শিশুদের নিকট সাহিত্যের রস পরিবেশন করেছেন।

বাংলা শিশুতোষ কবিতার আকাশে ’প্রভাতী’, কবিতাটি এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। বাংলা শিশুসাহিত্যে অবিস্মরণীয় শিল্পকর্ম।

স্বরবৃৃত্ত ছন্দের নিখুঁত প্রয়োগ কবিতাটিকে শিশু প্রাণের স্পন্দনে রূপান্তরিত করেছে।  কবিতাটি জাগরণী গানে মুখরিত,

ভোর হলো

দোর খোলো

খুকুমণি ওঠরে!

ঐ ডাকে

যুঁই শাখে

ফুল-খুকি ছোটরে

খুকুমনি ওঠরে।

আপাতঃদৃষ্টিতে মনে হয় খুকুকে তথা তাবৎ শিশুকে ভোরবেলা জাগানোই কবিতাটির উদ্দেশ্য, কিন্তু শুধু ভোরবেলার জাগরণই কবিতাটির আসল উদ্দেশ্য নয়; বস্তুত ভগবানের নামে জীবনের জাগরণই মূলকথা। অন্ধকার নয়, জীবনে আলোর প্রয়োজন। অফুরন্ত আলো আনবার আহ্বান জানিয়েছেন কবি। কবিতাটি এক অবিচ্যুত শব্দসঙ্গীত দিয়ে গড়া। লয় কোথাও ব্যাহত হয়নি, ছন্দাঘাত কোথাও খসে পড়েনি। শিশুর মনকে মাতিয়ে তোলার মত শব্দ’ ছন্দ ও সংগীতের সমাহার ঘটেছে এই রচনায়। এত সহজ শব্দ, এমন স্পষ্ট ও নিখুঁত ছন্দে কবিতাটি রচিত হয়েছে যে, এর ভেতর দিয়ে বাংলা শিশুতোষ কবিতার আদর্শ রূপটি প্রত্যক্ষ করা যায়।

নজরুল ইসলাম শিশু কাব্যে রূপকথা, ঘুমপাড়ানী গান এবং শুষ্ক নীতিবাক্য না শুনিয়ে শিশুকে বাস্তবের দ্বন্দ্ব-সংঘাতের সাথে পরিচয় করিয়েছেন। তাঁর ‘খুকী ও কাঠবেরালি’ ও ‘লিচু চোর’ কবিতাদ্বয় ক্লাসিক্সের মর্যাদা পেয়েছে। বস্তুতঃ শিশু এখানে মানব সমাজে অগ্রদূতের ভূমিকা পালন করেছে।

কাব্যগুনে ‘ঝিঙে ফুল’ কবিতা শিশুরঞ্জক নজরুল ইসলামের অন্যতম উৎকৃষ্ট রচনা। বাঙালীর পুষ্পসভায় ঝিঙে ফুলের কোনদিন স্থান হয়নি। ঝিঙে সবজি বলে তার ফুল কাব্যকৌলিন্য বর্জিত। এখনকার শহুরে শিশু ঝিঙে ফুল চিনে না কিন্তু নজরুল ইসলামের সময়ের শিশু এই ফুলটিকে জানত। বাড়ির উঠোনের মাচানে এই ফুলটি ফুুটতো। এই চির চেনা অথচ চির উপেক্ষিত ফুলটিকে নিয়ে নজরুল ইসলাম শিশুদের জন্য একটি অসাধারণ কবিতা উপহার দিলেন। কবিতাটিকে ঘিরে এমন চমৎকার এক শব্দ-সঙ্গীত ধ্বনিত হয়ে উঠলো-যে ধরনের শব্দ-সঙ্গীত এবং ছন্দাঘাত শিশুরা ভালবাসে। তারা তালে তালে পড়তে চায় এবং লয়ে লয়ে নাচতে চায়। নজরুল ইসলাম শিশুদের এই তালপ্রবণ এবং ছন্দপ্রিয় মনটিকে জানতেন বলেই এমন একটি কবিতা উপহার দিতে পেরেছেন। শিশুর কলনাদ ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়েছে। মাত্রাবৃত্ত ছন্দে রচিত কবিতাটি অপূর্ব সুন্দর সুরের ঝংকার ধ্বনিত হয়েছে সর্বত্র,

ঝিঙে ফুল! ঝিঙে ফুল!

সবুজ পাতার দেশে ফিরোজিয়া ফিঙে-কুলÑ

ঝিঙে ফুল।

গুল্মে পর্ণে

লতিকার কর্ণে

ঢল ঢল স্বর্ণে

ঝলমল দোলো দুলÑ

ঝিঙে ফুল॥

‘গৃহস্থের আঙিনায় অতি সাধারণ এক সবজি লতার ফুল এ কবিতায় বর্ণে গন্ধে অভিজাত বাগান ফুলের মর্যাদা লাভ করেছে।’৬

এখানে চিরবঞ্চিতের কথাই বলেছেন নজরুল ইসলাম। এই ফুলকে ভালবাসার আরেকটি কারণ হচ্ছে যে, প্রজাপতি বা  আসমানের তারা তাকে স্বর্গলোকে নিতে চাইলেও সে তাদের প্রলোভনে ভোলে না। সে শ্যামল মাটির স্পর্শ চায়। গৃহস্থ শিশুর মনে সে-ই আনবে ছন্দ-দোলা। সে বলে,

আমি হায়

ভালবাসি মাটি-মায়

চাই না ও অলকায়-

ভাল এই পথ ভুল।

সে তার ফসল দিয়ে মর্ত্যরে মানুষের সেবা করবে। মর্ত্যপ্রীতির অসাধারণ প্রকাশ এই কবিতায়।

নজরুল অসাধারণ সৃষ্টিক্ষমতার গুণে তাঁর শিশুতোষ রচনায় অতি তুচ্ছ ঘটনা ও বিষয়, এমনকি এক ধরনের বিষয়হীনতাও যে অনবদ্য রূপ লাভ করেছে সে-ও তাঁর ভাষা, ছন্দ ও অনন্য মিল প্রয়োগের অসামান্য ক্ষমতার গুণে। এ প্রসঙ্গে ‘ঝিঙে ফুল’ কবিতাটি উল্লেখযোগ্য। তাঁর রচনায় বিবৃত সুখ-দুঃখের অনুভূতি শিশু কিশোর ও বয়স্ক সবার মনকেই সমানভাবে আন্দোলিত করে। বর্ণনা ও ছন্দ ঝংকারে সত্যেন্দ্রনাথ দেেত্তর ‘ঝর্ণা’ কবিতাটি মনে করিয়ে দিলেও এটি একটি নিটোল সুন্দর কবিতা।

’চলব আমি হাল্কা চালে’ কবিতায় অপূর্ব ছন্দ ও ঝংকার তুলে হ্যামিলনের বংশীবাদকের মত বাঙ্গালী শিশু-কিশোরের মন

জয় করে নিলেন।

যৌবনের অমিত শক্তিকে নজরুল প্রত্যক্ষ করেছেন ছাত্রদলের সংগ্রামের মধ্যে বৃহত্তর সংগ্রামী জনসাধারণের মধ্যে। সত্যেন দত্তের ’ছেলের দল’ কবিতাটির সঙ্গে নজরুলের ’ছাত্রদলের গান’ কবিতাটির গান তুলনা করলেই এই দু’জন প্রতিষ্ঠিত কবির দৃষ্টিভঙ্গীর মৌলিক প্রভেদটা ধরা পড়ে। সত্যেন দত্তের কবিতায় আছে ছেলের দলের জন্য অসীম মমতা ও ভালোবাসা। ফুটে উঠেছে নীড়মুখী শান্তিকামী ছেলের দলের জন্যে গর্ব্ব ও অগাধ øেহ।

কিন্তু নজরুল অভিনন্দিত করেছেন ছাত্রদলের সংগ্রামী মনোভাবকে। ‘পদ্মকোষের বজ্রমণি ওরাই ধ্রুব সুমঙ্গল; আলাদিনের মায়ার প্রদীপ ওই আমাদের ছেলের দল।’ এই পর্যন্ত বলেই সত্যেন্দ্রনাথ ছেলেদের উদ্দেশ্যে তার বক্তব্য শেষ করেছেন। কিন্তু নিছক øেহ মমতা বিলিয়ে দিয়েই নজরুল ক্ষান্ত হননি; ছেলের দলকে এনে তিনি দাঁড় করিয়েছেন দুর্যোগঘন পথের মোড়ে; সেখান থেকে যাত্রা শুরু হবে কর্তব্য নিষ্ঠার তাগিদে শক্ত মাটির উপর দিয়ে। আসবে প্রবল বাধা, অতর্কিত মৃত্যু ছাত্রদলকে যে তার জন্যে প্রস্তুত থাকতে হবে। কবি এই বাস্তব সত্যকে ছাত্রদের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে রাজী হননি। এই দিক থেকেই নজরুল ইসলামের কাব্যের অনন্যতা। এবং এই অনন্যতাই সমগ্রভাবে নজরুল ইসলামের কাজের স্বাতন্ত্রকে গোড়া থেকে প্রকাশ করে এসেছিল। তাই ছাত্রদলের যে গান তা ব্যাপকভাবে সংগ্রামী জনসমাজেরও গান Ñ এ কথাটা মেনে নিতে আর আপত্তি থাকেনা।

সবাই যখন বুদ্ধি যোগায়

আমরা করি ভুল।

সাবধানীরা বাঁধ বাঁধে সব

আমরা ভাঙ্গি কুল।

দারুণ রাতে আমরা তরূণ

রক্তে করি পথ পিছল!

আমরা ছাত্রদল।

১১। আব্দুল কাদির সম্পাদিত নজরুল রচনাবলীর তৃতীয় খ-ে প্রকাশিত

‘অপ্রকাশিত কবিতা ও গান’১১-এ প্রকাশিত শিশু কিশোরদের জন্য প্রকাশিত কবিতাসমূহÑ ‘সারস পাখি’, ’মাঙ্গলিক’ ‘ছোট হিটলার’, ‘নতুন পথিক’, ‘নতুন খাবার’, ‘শিশু সওগাত’, ‘মটকু মাইতি বাঁটকুল রায়’, ‘ঝুমকো লতায় জোনাকি’, ‘কোথায় ছিলাম আমি’, ‘সংকল্প’, ‘চলব আমি হাল্কা চালে’, ‘কিশোরের স্বপ্ন’, ‘জিজ্ঞাসা’, ‘মাঙ্গলিক’, ‘লক্ষ্মী ছেলে তাই তোলে’, ‘প্রার্থনা’, ‘মুকুলের উদ্বোধনী’, ‘আগা মুর্গী লে কে ভাগা’, ‘মায়া-মুকুর’, ‘ফ্যাসাদ’, ‘আগুনের ফুল্কি ছুটে’, ‘আবাহন’, ‘আবীর’, ‘লাল সালাম’, ‘বর-প্রার্থনা’, ‘এস মধু মেলাতে’, ‘মা এসেছে’, ‘বগ দেখেছ’, ‘গদাই এর পদবৃদ্ধি’।

‘লক্ষ্মী ছেলে তাই তোলে’ (ঘরের আড়াল ভেঙ্গে এবার বাহির ভুবন লুটতে চাই)। এখানে পদে পদে কুসংস্কার ভীতি, শাসন ও বাধা-বিপত্তির মধ্য দিয়ে আমাদের সন্তানেরা কিভাবে বেড়ে ওঠে তারই মনোজ্ঞ বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। শিশু অবস্থা থেকেই সন্তানকে ’লক্ষ্মী ছেলে’ বানাবার আপ্রাণ চেষ্টা বাবা-মায়ের। তাই মানা শতেক এদিক যেওনা ওদিক যেওনা। ওখানে ভূত রয়েছে ব্রম্মদৈত্যি রয়েছে-ইত্যাদি ব’লে তাকে জেল-কয়েদী বানিয়ে রাখবার প্রচেষ্টা। খোকার গন্ডী পেরিেেয় যখন বালক, তখন ভূতের বদলে পন্ডিত মশায়ের আগমন, সে-ও আরেক ধরণের ভূত।

এই বালক যখন যুবক হ’ল, তখনব স্বাস্থ্যে হাড্ডিসার’, কথা বলে আস্তে’, লজ্জায় একেবারে নববধূ’। যৌবন- সুলভ তেজ, উদ্দীপনা তার মধ্যে একেবারে অনুপস্থিত। আর তাতেই অভিভাবকেরা খুশী, তাদের ভাষায় এই রুগ্ন ছেলে একেবারে ’সোনার ছেলে’। পরিণােেম এই ছেলে ’বিশ বছরেই পটল তোলে। শারীরিক ভাবে না হলেও মানসিকভাবে তার মৃত্যু ঘটে। এই কারণে আমাদের দেশে সত্যিকার অর্থে সাহসী প্রাণবন্ত যুবকের এতো অভাব। নজরুল ইসলাম লক্ষ্মী ছেলে মানুষ করবার প্রক্রিয়াটি বিদ্রুপের সঙ্গে তুলে ধরেছেন।

‘সারস পাখি’ ‘সারস পাখি! সারস পাখি! আকাশ-গাঙের শ্বেতকমল!‘ (শিশু মহল, ১ম সংখ্যা, ১৩৩৪) নজরুল ইসলাম অপরূপ সৌন্দর্য সৃষ্টি করেছেন। এদিক থেকে কবিতাটিকে নজরুল ইসলামের ‘ঝিঙে ফুল’ কবিতার সাথে তুলনা করা যায়। বিশেষ কোন বক্তব্য নেই কবিতাটিতে। নজরুল তাঁর অসাধারণ কল্পনাশক্তি বলে খুব সাধারণ জিনিসকে অসাধারন মর্যাদা এনে দিয়েছেন। অতি সাধারণ একটি পাখি বা বিষয়ও যে প্রতিভার স্পর্শে অপরূপ সৌন্দর্যের আধারে পরিণত হতে পারে ‘সারস পাখি’ তার আরেকটি প্রমাণ। সাধারণকে এমন অসাধারণ সৌন্দর্য দান কেবল নজরুল ইসলামের মত প্রতিভাধরের পক্ষেই সম্ভব। বলিষ্ঠ শব্দচয়ন, ছন্দের ঝংকার আর কাব্যিক সৌন্দর্যে এমন ঝলমল একটি কবিতা তাঁর সময়েতো নয়ই তাঁর পরবর্তী সময়েও বাংলা শিশুতোষ সাহিত্যে সৃষ্টি হয়নি।

’মাঙ্গলিক’ (ভোরের বেলায় পূব-গগনে সূয্যি ঠাকুর দেন উঁকি) নীতিমূলক কবিতা। কবিতায় কবি শিশু কিশোরদের জীবন যেন পরিপূর্ণভাবে গড়ে ওঠে, সেই মঙ্গল কামনা করেছেন। কবি কামনা করছেন, তারা যেন এই পৃথিবীর মানুষের সকল ভয়, সকল দুঃখ দূর করতে পারে, যেন তারা দেশ ও জাতির পরাধীনতা, লজ্জা-গ্লানি ঘুচিয়ে দিতে পারে, যেন অধ্যাবসায়ী আদর্শ মানুষ হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলতে পারে। কবি বলছেন তাহলেই জগতের সমস্ত মানুষ তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবে।

বীররসের কবিতাতেও নজরুল ইসলাম শ্রেষ্ঠত্বের পরিচয় দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের ’শিশু কাব্যগ্রন্থভুক্ত ’বীরপুরুষ’ কবিতায় কল্প-যুদ্ধে প্রতিপক্ষ ও ডাকাতেরা পরাজিত হয়ে শিশুটির কাছেÑকল্পনায় যে নিজেকে জানে ’রাজপুত্র’ বলে। এ-কবিতায় প্রধান চরিত্র ’শিশু’-রূপকথার রাজপুত্রের মতোই সে বিঘœবিপদজয়ী, বীরপুরুষ। নজরুল ইসলামের ’ছোট হিটলার’ কবিতায় শিশু নিজেকে ছোট হিটলার বলে পরিচয় দিয়ে ভীরুতা ও কাপুরুষতার বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। হিটলার ও মুসোলিনী শিশুর কাছে বীরত্ব ও শৌর্যের প্রতীক হয়ে ধরা দিয়েছে। সে ভূতে ভরা এই বাংলাদেশে বীরত্ব ও শৌর্যের প্রতিষ্ঠা করতে চায়। সে যুদ্ধে মুসোলিনী ও হিটলারকে নিজের দেশে ধরে নিয়ে আসবে। তার রণকৌশলে মুসোলিনি হেঁসেলে ঢুকে মশলা পিষবেন আর হিটলার হবেন উড়ে বামুন।

এ কবিতার নায়ক নজরুলপুত্র সানি, সে খুবই ছোট, কিন্তু সে অসম্ভব সাহসী ও তেজী। তার কল্পনায় সে একজন অমিত তেজ বীরপুরুষ। সে পোল্যান্ড, জার্মানিকে ভয় পায় না। রাইফেল, এয়ারগান এরোপ্লেন আধুনিক কোন সমরাস্ত্রই তার কাছে  গ্রাহ্য করবার মত বস্তু নয়। তার রাগে ঘোলা চোখ দেখেই গোলাগুলি বারুদ বোম সব কুলপি বরফের মত ঠা-া হয়ে যায়,

রাইফেলকে ভয় করে কে? বগল দাবা এয়ারগান,

এক গুলিতে উড়িয়ে দিতে পারি কত মিঞার কান।

গুল্তি মেরে ফেলতে পারি ঝুলতি-ন্যাজা এরোপ্লেন,

দেখলে মোরে, বলবে ওরা ‘ছোট-হিটলার বেরুচ্ছেন’!

বীর রসের রচনা ‘ছোট হিটলারের’ ক্ষেত্র অনেক বেশী প্রশস্ত। বিশ্বজনীন আবেদন তাতে ধরা পড়েছে।

’নতুন পথিক’ শিশুদের উদ্দেশ্যে কবি আশীর্বাণী জানিয়েছেন, কারণ তারা এই ধূলার ধরণীতে স্বর্গ রচনা করবে। রাজভোগ’ পত্রিকার আষাঢ়, ১৩৩৫ সংখ্যায় প্রথম প্রকাশ।

‘নতুন খাবার’( রাজভোগ, ১৩৩৫, ইন্দ্রধনু, ১৩৬৯)। শিশু কল্পনার সাহায্যে তিনি আজব ধরনের এক নতুন খাবারের

বিবরণ দিয়েছেন‘, কম্বলের অম্বল কেরোসিনের চাট্নি,  চামচের আমচূর খাইছ নি নাত্নি ?

নজরুল প্রেমের কবি বিদ্রোহের কবি একথা যেমন সত্য, তেমনি তিনি যে কোমল-মতি শিশু-কিশোরদেরও কবি, তার চমৎকার নিদর্শন পাওয়া যায় কবির এই জাতীয় কবিতায়। শিশু-কিশোরেরা তাঁদের কল্পনার জগৎ নজরুল ইসলামের শিশু রচনায় খুঁজে পেয়েছে বলেই কবি নজরুল তাদের এত কাছের কবি এবং সেই সঙ্গে প্রিয় কবি।

সুকুমার রায়ের ‘খাই খাই’ (১৩২৫, কার্তিক, সন্দেশ) কবিতায় আছে আজব আজব খাবারের কথা। পার্থক্য এই যে, এখানে খাবারগুলির উল্লেখ করা হয়েছে বিভিন্ন ধরনের খাওয়ার উদাহরণ হিসেবে। যেমন,

ডাল ভাত তরকারি ফলমূল শস্য

আমিষ ও নিরামিষ, চর্ব্য ও চোষ্য,

রুটি লুচি, ভাজাভুজি, কৈ ঝাল মিষ্টি,

ময়রা ও পাচকের যত কিছু সৃষ্টি,।

বিশ শতকের দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ দশকে সওগাতের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গৌরবজ্জ্বল। কেননা ’সওগাত’* সাহিত্যক্ষেত্রে এক উদার ও অসাম্প্রদায়িক মনোভাব এবং মানবিক মূল্যবোধ সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়েছিল। সওগাতের যুগে নজরুল ইসলাম বাংলার আকাশে বাতাসে মুক্ত চিন্তার হাওয়া বইয়ে দিয়েছিলেন। সওগাত দলের অন্যান্য চিন্তাবিদদের সঙ্গে ধর্মীয় ও সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম আরম্ভ করেছিলেন। তেজোদিপ্ত কবিতা ও গানের মাধ্যমে যেমন যুব সমাজকে উদ্দীপ্ত করেছেন তেমনি সম্পাদকের অনুরোধক্রমে ’শিশু সওগাত’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যার জন্য ছোটদের জন্য যুক্তাক্ষরবর্জিত শব্দ দ্বারা সহজ ও সরল ভাষায় পত্রিকার নামানুযায়ী ‘শিশু সওগাত’ কবিতা রচনা করেছেন। পত্রিকাটি শিশু সাহিত্যের অভাব মোচনের জন্য বাঙ্গালী মুসলমান পরিচালিত ছেলেমেয়েদের একমাত্র মাসিক পত্রিকা হলেও রচনা দেবার জন্য এবং পাঠের জন্য সব ধর্মের জন্যই অবারিত ছিল। নজরুল পত্রিকাটির নামানুসারে ’শিশু সওগাত’ ১৩৪৪, মাঘ (১ম বর্ষ ১ম সংখ্যা) কবিতাটি লিখে দেন। কবিতার কয়েকটি লাইন,

ওরে শিশু, ঘরে তোল এল সওগাত,

আলো পানে তুলে র্ধ ননী-মাখা হাত!

নিয়ে আয় কচি মুখে আধো আধো বোল্,

তুলতুলে গাল-ভরা টুলটুলে টোল।

চক্চকে চোখে আন্ আলো ঝিক্মিক্,

খুলে দেরে তুলে দেরে আঁধারের চিক।

কবিতায় নজরুল ’শিশু সমাজ’কে এর অন্তর্ভুক্ত করেছেন। তিনি তাদের দেখেছেন নতুন প্রভাতের এবং সেই সঙ্গে শক্তিরও প্রতীকরূপে। রাজনৈতিক ঝঞ্ঝা, সামাজিক অবক্ষয়ের হাত থেকে সমাজকে বাঁচাতে হলে শিশুর নরম হাতকে শক্ত হাতে পরিণত করতে হলে সমস্ত আঁধারকে ভেঙে নতুন প্রভাত আনার আহ্বান জানিয়েছেন। কবিতাটি পত্রিকার জন্য এত উপযোগী হয়েছিল যে চারদিক থেকে এর প্রশংসা ও উপহার আসতে লাগলো।

’কোথায় ছিলাম আমি’ কবিতায় নজরুলের শিশুর জবাব দিয়েছে বিশ্বমাতা বা বিশ্বপ্রকৃতি। রবীন্দ্রনাথের ’জন্মকথা’ কবিতায়। অর্থাৎ ‘জন্ম কথা’র, শিশু মানুষের জীবনধারার জীবনচারণের ফল, ‘কোথায় ছিলাম আমি’র শিশু বিশ্বপ্রকৃতির তথা বিশ্বমায়ের সন্তান।

নজরুল অসহায় শিশুর জন্য লিখেননি। দেহ মনে যেসব শিশু স্থবির তার জন্যও লেখেননি; তিনি লিখেছেন অগ্নিযুগের অগ্নিপূজারী বীর সন্তানদের জন্য।

সুনির্র্মল বসুর ‘আমরা কিশোর’ কবিতায় কৈশোরের ভূমিকা ও বৈশিষ্টের কথা রূপায়িত হয়েছে। এখানে মুক্ত স্বাধীন কিশোর মন পাখা মেলতে চায় কল্পনার দিক দিগন্তে। তাদের মনের অজানা কোণে লুকিয়ে আছে ভবিষ্যতের শিল্পী গায়ক সাহিত্যিকদের সম্ভানাময় প্রতিভা। পৃথিবীকে সার্থক ও সুন্দর করতে হলে এই প্রতিভাকে সমাজের কল্যাণে লাগাতে হবে। কিশোরদের সুদৃঢ় মনোবল ও চারিত্রিক দৃঢ়তা দ্বারাই এই সমাজের মঙ্গল আনা সম্ভব। কিশোর মনের বিকাশের জন্য তিনি জ্ঞানচর্চােেকই যথার্থ বলে মনে করেছেন অন্যদিকে নজরুলের কিশোর

বাংলা ভাষায় অভিযানপ্রিয়তার শ্রেষ্ঠ প্রকাশ ’সংকল্প’ কবিতাটি।৭ প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ও পঞ্চম স্তবক ’দেখব এবার

জগৎটাকে’ শিরোনামে বিশ্বভারতী গ্রন্থণ-বিভাগ কর্তৃক প্রকাশিত ’কবিতা সংকলন নামক বাংলা পাঠ্যপুস্তকে সংকলিত

(অগ্রহায়ণ, ১৩৬৯)।  শিশু আবদ্ধ থাকতে চায়না, সে চায় বিশ্বজগতের পরিচয় পেতে, ’থাকব নাকো বদ্ধ ঘরে, দেখব এবার

জগতটাকে’, নজরুল ইসলামের শিশুর দেখা ও জানার কৌতূহল সীমাহীন। এখানে একজন কিশোরের এই বিশ্ব ও জগতের

জ্ঞানÑবিজ্ঞানের নানান রহস্যকে জানবার এক তীব্র আগ্রহ প্রকাশিত হয়েছে। কেমন করে মানুষ এক দেশ হতে অন্য দেশে

ছুটে চলেছে, কিসের নেশায় লাখ লাখ বীর নিজের জীবন উৎসর্গ করছে। কেমন করেইবা বীর ডুবুরী সাগরের তলদেশ

থেকে মুক্তো সংগ্রহ করে, সমুদ্রের তীব্র ঢেউকে অগ্রাহ্য করে কীভাবে যুদ্ধ জাহাজ এগিয়ে চলে এনসব নানাবিধ জিজ্ঞাসার

উত্তর চায় সে। সে মহাবিশ্বের যাবতীয় অভিযানে সামিল হতে চায়। শুধু যে বিজ্ঞানের রহস্যকেই জানতে চায় এমন নয়,

বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক ইতিহাস জানতেও সে আগ্রহী। তুরস্ক কেমন ক’রে সকল প্রকার পশ্চাৎপদতার শিকল

কাটলো, গ্রীসের সভ্যতার বাতি মাঝ গগনে কেন নিভে গেল সেটিও এই দুরন্ত কিশোর জানতে চায়। চীনবিপ্লব, চীন

প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, আয়ারল্যান্ড বিপ্লব, তুর্কী বিপ্লব, তুর্কী প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, গ্রীসের পতন নজরুলের স্বাধীনচিত্ত মনে প্রেরণা

জাগিয়েছে ও সমভাবে শিশুর মনেও আবেগ সঞ্চারিত করেছে। কবিতাটির মাধ্যমে কবি শিশুর স্বাধীনসত্তা ও চিন্তার জগৎ

প্রসারিত করেছেন। এই কিশোর নজরুল পরিণত ’বিদ্রোহী’রই ক্ষুদে সংস্করণ, যে কিনা বিশ্বটাকে হাতের মুঠোয় পুরে সমস্ত

অত্যাচার, নিপীড়নকে সমূলে উৎপাটন করার স্বপ্ন দেখে। বড়দের মত ছোটদেরও যত নীচতা, কুপমন্ডুকতা, গোঁড়ামি-

কুসংস্কার, অজ্ঞানতা ও ক্ষুদ্রত্বের পঙ্কিলতা এবং পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্ত করতে চেয়েছেন নজরুল। এ প্রসঙ্গে ‘সংকল্প’

কবিতাটি অসীম আত্মবিশ্বাস, আত্ম-উজ্জীবন আর অনুসন্ধিৎসা ও প্রেরণায় তিনি উদ্বুদ্ধ করতে চেয়েছেন আমাদের শিশু-

কিশোর-তরুণদের।

এই কবিতায় সাবলীল দৃঢ়তায় প্রকাশিত হয়েছে প্রেম ও বিদ্রোহ। একাধারে মানুষের প্রতি মমতা, আঁধার সমান প্রতিকূলতা ভেঙ্গে, বন্ধনের বেড়িকে ছিন্ন করে বেরিয়ে পড়ার আহ্বান। সাগরের গভীর তলদেশ থেকে মুক্তা এনে কেমন করে ভরিয়ে তুলছে এই পৃথিবীর রতœভান্ডার, কখনওবা হিমালয়ের চূড়ায় উঠে বিশালতার স্বাদকে উপলব্ধি করা যায়, বরফাবৃত শীতার্ত মেরু পার হয়ে অজানা কোন তৃষায় তৃষিত হওয়া। চাঁদের অচিনপুর অথবা মঙ্গল গ্রহের হাতছানি, এসব কিছূই কবির দেখানো স্বপ্ন। যা কিনা আজ অনেকাংশে সফল।

‘সংকল্প’ কবিতার মাধ্যমে পংক্তি দুটি অসাধারণ দৃঢ়তায় শিশুর চেতনাকে নাড়া দিয়ে যায়,

পাতাল ফেঁড়ে নাম্ব নীচে, ওঠব আমি আকাশ ফুঁড়ে;

বিশ্ব-জগৎ দেখবো আমি আপন হাতের মুঠোয় পুরে।।

ইতিহাসের পাতা থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত, পরদেশ জয়ের নেশায় উন্মত্ত শক্তিধরেরা আজও বিদ্যমান। প্রাচীনকালে তাদের বলা হত বীর আজকে তারা বৃহৎশক্তি। আলেকজান্ডার দূরগ্রীস থেকে ভারতবর্ষ পর্যন্ত জয় করেছিলেন অজস্র জনপদ। তাঁর সেই বীরত্বকে গৌরবান্বিত করবার জন্য কতো প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছে তার হিসেব নেই। আজও যেমন বৃহৎ শক্তিগুলোর খেয়াল খুশীর শিকার হচ্ছে এ বিশ্বের লক্ষ কোটি নিরীহ মানুষ। আজকের ফিলিস্তিন-ইসরাইল সংঘাত অথবা কিছুদিন আগে ঘটে যাওয়া আফগান-আমেরিকা যুদ্ধের দিকে দৃষ্টি রাখলে একথা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, ইতিহাস বারবার ফিরে আসে।

’কিশোর স্বপ্ন’ কবিতায় কবি কিশোরমনে স্বাজাত্যবোধ ও স্বাধীনতার আকাংখা জাগাতে চেয়েছেন। কিশোর অনুভব করেছে এই দেশ শ্মশানের মেলা। এখানে সত্যিকার জীবন নেই এবং প্রকৃত আদর্শের একান্ত অভাব। তাই যারা দেশের মধ্যে যথার্থ প্রাণের আগুন জ্বালাতে চায় কিশোর মন স্বভাবতই তাদের সঙ্গে একাত্ববোধ করে। সে বিদেশ থেকে যৌবনের অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে এসে নিজের দেশকে জাগাতে চায়।

‘মুকুলের উদ্বোধন’ কবিতায় নজরুল নারী শিক্ষাকে উৎসাহিত করেছেন,

বীণা-পানির সুর-মহলের কোন্ দুয়ার আজ খুললো রে,

——————————————

লক্ষ্মী যত মেয়েদের আজ জ্ঞান-মুকুলের উদ্বোধন।

নজরুল রচনাবলীর সম্পাদক আবদুল কাদির মনে করেন ’কোনো বালিকা বিদ্যালয়ের পারিতোষিক বিতরণী অনুষ্ঠানে কবিতাটি পঠিত হয়েছিল।’

মেয়েদের লেখাপড়া শেখানো এবং লেখনী ধারণের মাধ্যমে নজরুল ইসলাম নারীদের জাগাতে চেয়েছেন। তিনি জন্মেই ভারতবর্ষকে শুধু পরাধীন ও অবমানিত দেখেননি। নারীকেও ওইরকম হতশ্রী অবস্থানে দেখেছেন। তবে উপমহাদেশটি ছিল বিদেশী বেনিয়াদের অধীনে, আর নারীরা ছিল স্বজাতীয় পুরুষেরই সৃষ্ট নানান কুপমন্ডুকতায় নুব্জ্য, নতজানু, বন্দী। বৃটিশ শাসিত ভারতবর্ষে মুসলমান মেয়েদের মধ্যে শিক্ষার অগ্রগতি ছিলই না বলা চলে, সেই সময় রচিত এই উদ্বোধনী কবিতাটি শুধু মুসলিম মেয়েদের নয়, সব ধর্ম নির্বিশেষে নারী শিক্ষাকে প্রচুর উৎসাহ জুগিয়েছিল। সমসাময়িক কোন শিশুসাহিত্যের রচনাতেই নারী শিশুেেদর নিয়ে এমন উৎসাহব্যঞ্জক কথা শোনা যায়নি। নজরুল ইসলামের এইসব কবিতার উৎস থেকে নারীরা খুঁজে পাচ্ছে আলোকিত পথ উপকৃত ও উদ্বুদ্ধ হচ্ছে, সমাজ মানসে ঘটেছে পরিবর্তন।

কবিতাটি দৌলতপুরে ১৩২৮ সালে রচিত।

’আগা মুর্গী লেকে ভাগা’ ব্যঙ্গ রচনা। (‘ছোটদের মধুচক্র’ পত্রিকায় প্রথম প্রকাশ, ১৩৪১)

’মায়া-মুকুর’ (তোমার মনের মায়া-মুকুরে কি দেখেছ নিজের মুখ) এই উপদেশমূূলক কবিতায় নজরুল আগামী দিনের বালক বালিকাদের অমৃতের পুত্র ব’লে অভিহিত করেছেন। তাদেরকে দীনহীন ভাবতে বারণ করেছেন। ক্ষুদ্র সাধনা তাদের জন্য নয়। তাদের মধ্যেই বড় ও মহৎ কর্মের প্রেরণা লুকিয়ে আছে কেননা সে বিপুল কর্মশক্তি নিয়ে পৃথিবীতে নেমে এসেছে। এই মানুষই দিব্যশক্তি বলে শক্তিশালী হতে পারে। ইচ্ছা করলেই সে ব্রহ্ম বিষ্ণু বা শিব হতে পারে; হতে পারে লেনিন, কামাল, বুদ্ধ কৃষ্ণ প্রমুখ মহাপুরুষের মত উদার নির্ভীক সত্যবাদী ও মানবতাবাদী। অজ্ঞানতা বা ক্ষুদ্রগ-ি পেরিয়ে মানুষের ভিতর যে মহামানব রয়েছে তাকে জাগিয়ে তুলতে হবে। তাই কবি প্রেরণা জাগান শিশুর মাঝে,

তুমি নও শিশু দুর্বল, তুমি মহৎ ও মহীয়ান,

জাগো দুর্বার, বিপুল, বিরাট, অমৃতের সন্তান।

’ফ্যাসাদ’ কবিতায় বাবা-মা ও শিক্ষকের শাসনে অতিষ্ঠ এক ডানপিটে ছেলে পেসাদের প্রতিদিনকার ফ্যাসাদ’ তৈরী করছে, তাদের শায়েস্তা করবার জন্য তার মনের আকাঙ্খা যেন দানো হয়ে যায়। তারপরÑ’রাত্রি হলে বসবে এসে সবার ঘাড়ে  চড়ে।/ কিলিয়ে তাদের ভূত ভাগাবে, বলবে একি ফ্যাসাদ।’

শুধু পেসাদেরই নয়, প্রতিটি ডানপিটে শিশু কিশোরের মনে লুকানো বাসনাকে নজরুল ইসলাম এই কবিতায় রূপ দিতে পেরেছেন, এখানেই তার সার্থকতা।

‘দৈনিক নবযুগ (৮ই অগ্রহায়ণ, ১৩৪৮) শিশু-বিভাগের জন্য ‘আগুনের ফুলকি’ কবিতাটি রচিত। এ বিভাগের নামকরণের কৃতিত্বও নজরুলের। ’আগুনের ফুলকী’র পরিচালক ’আতশ বাজে’র কথাগুচ্ছ এরকম ’তোমাদের এ আসরের নামকরন করেছেন তোমাদের প্রাণপ্রতিম কবি কাজী নজরুল ইসলাম সাহেব। তোমরা বিলাসী না হয়ে, আগুনের ফুলকীর মত বিশ্বের বুকে ফুটে উঠোÑ এই তাঁর ইচ্ছা। তিনি আজ ’আগুনের ফুলকী ছুটে’ নামক কবিতা দিয়ে তোমাদের আশীর্বাদ করেছেন।

’বর প্রার্থনা’ কবিতায় শিশু দশভূজা দেবী দুর্গার নিকট প্রার্থনা করছে, তার মধ্যে শিশুচিত্তের সারল্য ও ভাব-বিলাসময় বিচিত্র কল্পনার পরিচয় লক্ষ্য করা যায়। শিশু গতিময় জীবন ভালবাসে। গাড়ী চড়ায় তার প্রচুর আনন্দ। কিন্তু গাড়ির মালিক তার পিতামাতা যখন জ্বালানী পেট্রোলের মূল্যের উর্ধ্বগতি দেখে, শিশুকে অধিক ভ্রমণ থেকে বিরত রাখার যথাসাধ্য করেন তখন শিশু সর্ব-মানবের ভান্ডারী স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করে বলে দেবী যেন দয়া করে ’পেট্রল যাতে খায়না, দিবি এমনি একটা মোটর’ এই  শিশুটির পিতাকে প্রদান করেন।

কিশোর কবিতা। এখানে পদে পদে কুসংস্কার, ভীতি, শাসন ও বাধা-বিপত্তির মধ্য দিয়ে আমাদের সন্তানেরা কীভাবে বেড়ে ওঠে, তারই মনোজ্ঞ বর্ণনা দেয়া হয়েছে। শিশু অবস্থা থেকেই সন্তানকে ’লক্ষ্মী ছেলে’ বানাবার আপ্রাণ চেষ্টা বাবা-মায়ের। তাই মানা শতেকÑএদিক যেওনা, ওদিক যেওনা। ওখানে ভূত রয়েছে, ব্রম্মদত্যি রয়েছেÑইত্যাদি বলে তাকে ’জেল কয়েদী’ বানিয়ে রাখবার প্রচেষ্টা। খোকার গন্ডী পেরিয়ে যখন বালক, তখন ভূতের বদলে পন্ডিত মশায়ের আগমন, সে-ও আরেক ধরনের ভূত

এই বালক যখন যুবক হলো, তখন সে স্বাস্থ্যে হাড্ডিসার’, কথা বলে ’আস্তে’, লজ্জায় একবারে ’নববধূ’। যৌবন-সুলভ তেজ, উদ্দীপনা তার মধ্যে একেবারে অনুপস্থিত আর তাতেই অভিভাবকেরা খুশী, তাদের ভাষায় এই রুগ্ন ছেলে একবারে ’সোনার ছেলে’। পরিণামে এই ছেলে ’বিশ বছরেই’ পটল তোলে। শারীরিকভাবে না হলেও মানসিকভাবে তার মৃত্যু ঘটে। এই কারণে আমােেদর দেশে সত্যিকার অর্থে সাহসী প্রাণবন্ত যুবকের এতো অভাব। নজরুল লক্ষ্মী ছেলে মানুষ করবার প্রক্রিয়াটি  বিদ্রুপের সঙ্গে তুলে ধরেছেন।

নজরুলের কবিতায় কৃত্রিমতা নেই, কারসাজি নেই, প্রাণের অদম্য আনন্দরসে তা বেগবান ও দীপ্যমান Ñ আছে স্বতস্ফূর্ততা, আছে স্বাস্থ্য স্বচ্ছলতা, সাবলিল গতি আছে আর আছে বাস্তবের ঘাত-প্রতিঘাত যা সমসাময়িক শিশুসাহিত্যে পরিলক্ষিত হয় না।

’বগ দেখেছ?’ বককে যে শিশু জীবনেও দেখেনি তাকেও কবি দেখিয়েছেন নানান অঙ্গভঙ্গীর মাধ্যমেÑমাটিতে মাথা নুইয়ে, শরীর গুটিয়ে, গলায় বাঁশের লাঠি বেঁধে অথবা হুঁকোকে বগের গলারূপে চিন্তা করে।

মাসিক ’মোহাম্মদী’(মৌলানা মোহাম্মদ আঁকরম খাঁ, কার্তিক ১৩৩৪/নভেম্বর ১৯২৭)  মে ১৩৪২  ‘আশ্বিনে গদাই এর পদবৃদ্ধি’-(এই হাস্যরসাত্মক-কবিতাটি ’কিশোর’ কাব্যগ্রন্থে সংকলিত)।১০

কবি ঝড়ের মধ্যেও জীবনের আহ্বান ধ্বনিত হতে শোনেন,

ঝড় এসেছে ঝড় এসেছে

কারা যেন ডাকে।

বেরিয়ে এল নূতন পাতা

জীর্ণ বটের শাখে।।

স্থবির আমার ভয় টুটেছে

গভীর শঙ্খ-রবে

মন মেতেছে আজ নূতনের

প্রলয় – মহোৎসবে

প্রণাম জানাই ভয়-ভাঙানো

অভয় -মহাত্মাকে।।

১৯৩৫ সালের ১৩ই জানুয়ারিতে শ্যামাপদ ভবাই-এর অটোগ্রাফের খাতায় কবিতাটি লিখে দিয়েছিলেন। শ্যামাপদবাবু নদিয়া জেলার শান্তিপুরের মানুষ ছিলেন। তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র কল্যাণকুমার ভবাইয়ের সৌজন্যে কবিতাটি প্রকাশিত হল।

আনন্দমেলা পূজাবার্ষিকী১৪১১       পৃৃ-২১

যথাযথ শব্দের প্রয়োগে, বলিষ্ঠ শব্দচয়নে এবং কাহিনীর প্রাঞ্জলতায় তার কিছু কবিতা মুখরিত হয়ে উঠেছে, এসব কবিতায় শিশুসাহিত্যের মর্মবানী বিধৃত হয়েছে।

বিদ্রোহ, প্রেম প্রভৃতির পাশাপাশি শিশু কিশোরদের জন্য উপযোগী কবিতা রচনায়ও তিনি সার্থকতার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর জাগরণমূলক কবিতাতে শুধু ভোরবেলার জাগরণই নয়। এই জাগরণ আত্মার জাগরণ, শিশুর ন্যায় সংগত অধিকারসমূহ আদায়ের জন্য চিত্তের জাগরণ।

কবিতা রচনার মূল কথা হল কবিতার কাব্যিক সৌন্দর্য ও ছন্দের ঝংকার। এক্ষেত্রে তাঁর সৌন্দর্য সৃষ্টিমূলক কবিতা কাব্যিক লাবণ্যে ঝলমল, তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিশুতোষ কীর্তি। নজরুল কিশোরসুলভ অনুসন্ধিৎসা নিয়ে যে সমস্ত কবিতা লিখেছেন তাতে কল্পলোকের বিস্তার ঘটিয়েছেন। শিশুর কল্পনাশক্তি ও চিন্তার জগৎকে বহুলাংশে বাড়িয়ে দিয়েছেন। অভিযানমূলক কবিতায় শিশুকে দুঃসাহসী করেছেন নিজের দেশকে ও বিশ্বকে জানবার অভিপ্রায়ে। দার্শনিক তত্ত্বের কবিতাগুলিতে শিশুকে দেখেছেন নতুন প্রভাতের ও শক্তির প্রতীকরূপে। হাস্যরসের কবিতার বর্ণনা বাস্তবমুখী ও চমকপ্রদ।

আবৃত্তিযোগ্যতা শিশুতোষ কবিতার একটি উল্লেখযোগ্য গুণ। এই গুণটি নজরুল রচনায় গভীরভাবে বর্তমান। তিনি কবিতাপাঠে শিশুমনকে প্রলুব্ধ করে তোলেন। যে স্বল্পসংখ্যক কবিতা আমাদের চির পাঠ্যবিষয়ে পরিণত হয়েছে তার মধ্যে নজরুলের রচনা নগন্য নয়। তাঁর ’খুকী ও কাঠবেরালি’, ’লিচু চোর’ কবিতাদ্বয় ক্লাসিক্সের মর্যাদা পেয়েছে।

নজরুল ’ঝিঙে ফুলে’র মত লঘু তরল বাসন্ত্রতন্ত্রী হ’তে রুদ্র রূপের পরিচয় পাওয়া যায়।

শিশুতোষ কাব্য রচনার ক্ষেত্রে নজরুলের সৃষ্টি প্রয়াস নিতান্তই স্বল্প। কিন্তু বিষয়ের বৈচিত্র্য ও কাব্যগুণপ্রসাদে এই স্বল্প সৃষ্টি প্রয়াস বাংলা শিশুতোষ কাব্যসাহিত্যে ভিন্নতর ও স্থায়ী স্বাদ এনে দিয়েছে। তিনি কেবল বাংলা কাব্যে নতুন সুর ধ্বনিত করেননি, কেবল নতুন ভাববন্যা আনেননি, কাব্যে নতুন ভাষার সৃষ্টিতেও মৌলিক অবদান রেখেছেন। এ ভাষা বাংলা, হিন্দী, সংস্কৃত  পার্সী ও আরবীর মিশ্রনে পরিকল্পিত। তিনিই প্রথম পার্সী শব্দকে অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে কাব্যের মধ্যে স্থান দিয়ে কাব্যের অঙ্গশ্রী বর্ধন করেছেন, এ কথা শিশুসাহিত্যের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এসব কবিতাবলীতে শিশুপোযোগী শব্দচয়ন করেছেন ও সাহিত্যরস পরিবেশন করেছেন।

শিশুতোষ নাটক রচনায় নজরুল ইসলাম অত্যন্ত সফল নাট্যকারের পরিচয় দিয়েছেন। ‘পুতুলের বিয়ে’ (১৩৪০, ১৯৩৩) র গ্রন্থভুক্ত হয়েছে আটটি চিত্রনাট্যের। মূল নাটিকায় তিনি এর চরিত্রাবলীর সাথে মিশে গেছেন। এখানে তিনি কেবল ‘চির শিশু চির কিশোর’ই নন, তাঁর মনের মধ্যে ক্রিয়াশীল বিদ্রোহী, সংস্কারক আর হাসি গানের মানুষের সার্থক প্রতিফলন ঘটেছে। ‘পুতুলের বিয়ে’তে আমরা তাঁর এই মিশ্রিত রূপ পাই একই আধারে।

আলোচ্য নাটকে নাটকীয় সংলাপ রচনা, চরিত্র সৃষ্টিতে যথেষ্ট কৃতিত্ব ও শৈল্পিক কুশলতার পরিচয় দিয়েছেন। এর প্রতিটি চরিত্রই শিশুমনস্তত্ত্ব নিয়ে লেখা। নাটিকটি বিশ্লেষণ করলে আমরা নিুলিখিত বিষয়গুলো এর অন্তর্ভুক্ত দেখতে পাই। (১) সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি (২) আঞ্চলিক সম্প্রীতিস্থাপন (৩) বিশ্বভ্রাতৃত্ব তথা সর্বমানবের একজাতিত্ববোধের আভাস (৪) বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতি। এছাড়া আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গের অবতারণা করে নজরুল নাটকটিতে প্রগতিশীল মনের পরিচয় দিয়েছেন।

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বৈশিষ্ট ফুটে উঠেছে কম্লি(হিন্দু)র চীনা ছেলের সংগে বেগমের (মুসলমান) জাপানী মেয়ে গেইশার বিয়েকে কেন্দ্র করে গানের মাধ্যমে,

মোরা এক বৃন্তে দু’টি ফুল হিন্দু মুসলমান।

মুসলিম তার নয়ন-মণি, হিন্দু তাহার প্রাণ ॥

নাটিকার দুটি চরিত্র খেঁদি (বাঁকুড়া) আর পঞ্চি (ময়মনসিংহ) আঞ্চলিক ভাষায় কথোপকথনের মাধ্যমে আঞ্চলিক সম্প্রীতির ভাবের অবতারনা করেছে। আমরা অন্যের মুখে আঞ্চলিক ভাষা শুনে কৌতুকবোধ ও অনেক সময় বিদ্রুপও করি। কিন্তু এখানে শুধু একবার খেঁদি ‘বাঁক্ড়ি’ সম্বোধিত হওয়া ছাড়া আর কোথাও ঠাট্টা উপহাসের কথা উচ্চারিত হয়নি। তারা খেলার সঙ্গিনীদের মতই আঞ্চলিক ভাষা বৈচিত্র্যকেও সহজভাবেই মেনে নেয়।

(হিন্দু) কম্লির ছেলে ডালিম কুমার (‘সায়েব’) আর ফুচুং (চীনা) এবং (মুসলিম) বেগমের মেয়ে গেইশার (জাপানী) বিয়ের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক আন্তঃসাম্প্রদায়িক সম্পর্ক স্থাপন করেছেন। এখানে পরিবেশগত কোন সংস্কার প্রভাব ফেলতে পারেনি। এভাবে নজরুল মানুষের মন তথা শিশুর মন থেকে ভেদাভেদের সব ভাবনা উড়িয়ে দিয়েছেন।

খেলার আসরে বেগমের বিলম্বে আাসার হেতুস্বরূপ সে বলেছে, ‘বাপরে। আব্বা যা বকেন ভাই, আমি বাইরে বেরুলে। আম্মাকে বলেন আমাকে পর্দার ভিতর বিবি করে রাখতে।’

পর্দা প্রথারও ঘোর বিরোধিতা করেছেন নজরুল। বেগমের বাবা কম্লির আট বছরের মেয়েকে পর্দার ভেতর বিবি করে রাখার পক্ষপাতি, কিন্তু কম্লির এতে ঘোর আপত্তি,

কম্লি।  মা গো মা! কি হবে! অসৈরণ সইতে নারি। আট বছরের মেয়ে আবার বিবি হবে!

পর্দাসমস্যা ও সতীন সমস্যাসমকালীন সমাজে নারীর জীবনে গভীর ক্ষত তৈরী করেছিল বলে নজরুল ছোটদের নাটকে  এসব প্রসঙ্গ সন্নিবেশিত করেছেন।

নাটকটিতে নজরুল পুরুষের একাধিক বিয়ের বিরুদ্ধেও কথা বলেছেন। ডালিম কুমারের সাথে বেগম ও টুলির মেয়ের প্রস্তাব টুলি মেনে নেয় না। বলে ‘কি? আমার মেয়ে সতীন নিয়ে ঘর করবে? আমি বেঁচে থাকতে নয়।’

কৌতুক রস এর প্রতিটি মেয়ে-চরিত্রের সংলাপে বর্তমান। যেমন বেগম নামের এই মেয়েটির জীবনের উদ্দেশ্য তার মায়ের ভাষায় শুধু ’বেগম সাহেব’ হয়ে ধনীর বাড়ির দাস-দাসী পরিবৃত সংসারের ভাঁড় গুছানো নয়। তার সাধ স্বামীর কর্মসঙ্গিনী হওয়াও। উৎপাদনক্রীয়ায় স্বামী-¯ত্রীর সম্মিলিত প্রচেষ্টায় উৎসাহদানেরও উদাহরণ পাওয়া যায় এতে,

‘                               আমি বিবি হব না।

আম কুড়াবো জাম কুড়াবো, কুড়াবো শুকনা পাতা,

সোয়ামী করবে লাঙল চাষ, আমি ধরব ছাতা।

শিশু ও কিশোরী কন্যার চরিত্র ও মনস্তত্ত্ব প্রকাশে লেখক এখানে দক্ষ। নাট্যকার নজরুলের ব্যঙ্গনিপুণ রসিকতাপূর্ণ সংলাপ এ নাটকে অত্যন্ত উপভোগ্য হয়েছে।

এ থেকে উপলব্ধি করা যায নজরুল চেতনায় নারী সমস্যাগুলো ক্ষণিকের জন্য রেখাপাত করেনি। এগুলো যেন সর্বস্তরের মানুষের বোধনকে স্পর্শ করে, এই উদ্দেশ্যে নাটকের প্রাসঙ্গিকতায় পর্দা ও বহুবিবাহের সমস্যা তুলে ধরা হয়েছে। এ নাটেেক নারী শিশুর বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচিত হয়েছে যা সমসাময়িক শিশুতোষ রচনায় দৃষ্টিগোচর হয় না।

শুধু গুরু গম্ভীর পরিবেশ ও চিন্তাশীল ধ্যানধারণাই নয়, নাটকটিতে তিনি হাস্যরসও পরিবেশন করেছেন। কম্লির দাদা মনি নাটকের একটি বিশিষ্ট চরিত্র। সে বয়সে কিশোর, তার ভূমিকা অল্প সময়ের জন্য, তার কাজ শুধু হাস্যরস পরিবেশন করা। সে কখনো উদ্ভট রান্নার ফর্মূলা বাৎলায়, কখনো খুনসুড়িপ্রতিম কথা বলে, কখনো আজব বিষয়ের গান গেয়ে বিয়ের আসর মাতিয়ে রাখে। উক্ত আসরে তারা একখানি কমিক গান গায়,

হেড মাস্টারের ছড়ি,         সেকে- মাস্টারের দাড়ি

থার্ড মাস্টারের টেড়ি,        কারে দেখি কারে ছাড়ি।

হেড প-িতের টিকির সাথে তাদের যেন আড়ি ॥

‘পুতুলের বিয়ে’র অন্যতম বড়ো বৈশিষ্ট্য, এতে বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতির কিছু পরিচয় আছে। পাঁচটি ছোট ছোট মা তাদের পুতুল ছেলেমেয়েদের বিয়ে দেবার অভিপ্রায়ে কখনো আদর করে ছড়া কাটে, কখনো বিয়ের গান গায় ’শাদী মোবারকবাদ শাদী মোবারক’। এই সব ছড়া আর গানের ধ্বনি প্রতিধ্বনি, তাদের আঞ্চলিক ভাষা, দৃষ্টিভঙ্গি সংস্কৃতি, জীবনযাত্রা ইত্যাদির অনেক টুকরো বিষয়ের সঙ্গে শিশুদের পরিচয় করিয়েছেন। আঞ্চলিক লোকসংস্কৃতির পরিচায়ক হিসেবে এগুলি যথেষ্ট মূল্যবান।

গ্রন্থের ‘কালো জামরে ভাই’, ’জুজুবুড়ির ভয়’ ’কে কি হবি বল’, ছিনিমিনি খেলা, ’কানামাছি খেলা’, নবার নাম্তা পাঠ, সাত

ভাই চম্পা, ’শিশু যাদুকর’ গীতি-নক্সা রচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের আবহমান লোকসংস্কৃতির চরিত্র তুলে ধরেছেন। ‘শিশু

যাদুকর’ চিত্রনাট্যে পৃথিবী এবং মানুষের প্রতি অপরিসীম মমতা ব্যক্ত হয়েছে। চাঁদের দেশ এবং মাটির পৃথিবী কোনটি ভাল

লাগে কল্পনার প্রশ্নোত্তরে বেণুর উত্তর, ‘আমি এই পৃথিবীকে খুব ভালবাসি। একে ছেড়ে কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না। ও

যেন আমার মা।’ ‘সাত ভাই চম্পা’সে ছোট্ট হলেও এ্যাডভেঞ্চার- প্রিয়। নাটকটির মধ্য দিয়ে নজরুল এদেশের কিশোর-কিশোরীদের কর্মোদ্দীপনা ও

প্রাণচাঞ্চল্য জাগিয়ে তুলতে চেয়েছেন। (বুলবুল, ১৩৪০, ভাদ্র-অগ্রহায়ণ, চতুর্মাস্য সংখ্যায়) ’সাত ভাই চম্পা জাগরে’র

চারটি গান প্রকাশিত হয়।

(ক) আমি হব সকাল বেলার পাখী

(খ) ’আমি হ’ব গাঁয়ের রাখাল- ছেলে’

(গ) ’আমি হ’ব দিনের সহচর’

(ঘ) ’আমি সাগর পাড়ি দেবো’

’সাত ভাই চম্পা’র প্রথম ভাই প্রথম ভাই ’সকাল বেলার পাখি’ হয়ে সবাইকে ’ঘুম জাগানো পাখী’র দায়িত্ব নিয়েছে। সে

সূর্য উঠবার আগে ঘুম থেকে জাগবে এবং সবাইকে ’ঘুম-ভাঙা গান’ শোনাবে। বর্ণনা, উপমা ও রূপসাধন প্রক্রিয়ায়

কবিতাটি সার্থক। শিশুর অভিযানপ্রিয়তা ও মনে মনে নানা কল্পনার জালবোনার ব্যাপারগুলো মূর্ত হয়ে উঠেছে।

সংলাপগুলো যথার্থ রসোত্তীর্ণ। গ্রাম বাংলার কোলে লালিত লোক-ঐতিহ্যের মানসপুত্র কবি নজরুল ইসলামের প্রথম

কবিতাটি হয়ে উঠেছে তাঁর প্রাণপ্পন্দন স্বরূপ। এক কোমল, মধুর ও অসামান্য সৌকুমার্য  প্রকাশ পেয়েছে শিশুর আকাঙ্খা

ও কল্পনা। সে পাখির প্রতিদ্বন্দ্বী, সে সূর্যের প্রতিদ্বন্দ্বী এখানকার ভাষা ও ছন্দ অতি সুন্দর ও মনোহর। শিশুর সবল উল্লাস

ফেটে পড়েছে কবিতার সর্বত্র।   দক্ষিণারঞ্জনেরও, ভোরবেলার কবিতা ’খোকাখুকুর খেলা’ সূর্যের সাথে লুকোচুরি খেলা

আছে,

শুধু ঘুম থেকে জাগানোই এই রচনার উদ্দেশ্য নয়। সমস্ত অন্ধ, জরা, ব্যাধিগ্রস্থ ও অলসদের তিনি গতি দিতে চান। তাদেরকে তিনি উদ্যোগী ও কর্মঠ দেখতে চান। জীবনযুদ্ধে জয়ী দেখতে চান। সে নিরলস পরিশ্রমের মধ্যে দিয়ে শান্তি ও মঙ্গল আনবে। কবিতাটিতে নজরুল শিশুসাহিত্যের মর্মবাণী বিধৃত হয়েছে। ’প্রভাতী’ কবিতাটিও এই গোত্রীয়। কবিতাদ্বয়ে বর্তমান ও ভবিষ্যতের শিশু মনের আশা-আকাংখার মূর্ত প্রকাশ ঘটেছে। চতুর্থ কবিতাটিতে আমি সওদাগর-শিশু মনস্তত্ত্বের সফলতায় আরেকটি কবিতা।

 

গ্রন্থভুক্ত ’লাল টুক্টুক্ মুখে হাসি মুখখানি টুল্টুল’, ‘ঠ্যাং চ্যাগাইয়া প্যাঁচা যায়’ ইত্যাদি ছড়াগানের মাধ্যমে লোকসংস্কৃতি

ফুটে উঠেছে।

‘পুতুলের বিয়ে’র অন্তর্ভুক্ত লোক সঙ্গীতের বিভিন্ন গানের মাধ্যমে আমরা পাই লোকায়ত নজরুলকে। এক্ষেত্রে আক্ষরিক অর্থেই আর এক নতুন পরিচয়ে নজরুল আবির্ভূত। অন্যান্য যেসব একাংকিকা ও সংলাপ রচনা করেছেন Ñ লোক ঐতিহ্যের নিরিখে গ্রামীণ জীবনের বর্ণনায় – নৈসর্গিক সৌন্দর্যের বর্ণনায়, গ্রামীণ জীবনের চালচিত্র Ñ উপমার ব্যবহারে লোকজ উপাদানের সার্থক প্রয়োগ দেখিয়েছেন। লোক সঙ্গীতের বিভিন্ন শাখায় তাঁর সফল পদচারণা আমাদের রীতিমত বিস্মিত করে। শিশুবিষয়ক ছড়া গানগুলিতে আঞ্চলিক ভাষা অত্যন্ত মিষ্টিসুরে ঝংকৃত হয়েছে। এসব ছড়াগানে আঞ্চলিক জীবনযাত্রার চিত্র অত্যন্ত সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। নানা রকম গানে আমাদের লোকসংস্কৃত, আঞ্চলিক ভাষা, দৃষ্টিভঙ্গি ইত্যাদি প্রতিফলিত হয়েছে। ঘুমপাড়ানী গান, পল্লীনৃত্যের গান, গ্রাম্যসংগীত, মেয়েলি লোকসংগীতের সুরে গীতরচনা ব্যাপকভাবে বাংলার আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন নজরুল। সুধী সমাজে অবহেলিত লোকসংগীতকে তিনি আপন মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন। যা শিশুর মানসিক বিকাশ সাধনে যথেষ্ট সহায়ক হয়েছে।

নজরুল শুধু যে হিন্দু মুসলিম জাতির মধ্যে বিভেদের দূরত্ব দূর করার চেষ্টা করেছেন তা নয় বরং তিনি সকল কালের সকল মানুষের মধ্যে সাম্য, সহানুভূতি ও সম্প্রীতির হাত বাড়িয়েছেন। পৃথিবীর সকল মানুষকে একজাতিত্ববোধে উদ্বুদ্ধ করেছেন। নজরুল সাম্প্রদায়িকতার উর্দ্ধে উঠে এই নাটকের মাধ্যমে শিশুর মানসিক বিকাশ সাধনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। যা সমসাময়িক কোন শিশুসাহিত্যিকের মধ্যে দৃষ্টিগোচর হয়নি। এখানে তিনি বিভিন্ন দেশ, ধর্ম, বর্ণের পুতুলের বিয়ের মাধ্যমে জাতি-ধর্ম-বর্ণ প্রথা দূর করে শিশু মনকে ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ববোধ আবদ্ধ ও কল্যাণ্যধর্মী করার চেষ্টা করেছেন। বস্তুতঃ শিশুকে উপলক্ষ করে বয়স্কের মনে ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ববোধ আনার চেষ্টা করেছেন।

৫’শিশু যাদুকর’ ১৩৩৭ সালের ফাল্গুন-চৈত্র সংখ্যক জয়তী পত্রিকায়,

কাল্পনিক অভিযানের কাহিনী নিয়ে রচিত ‘জাগো সুন্দর চিরকিশোর’ (১৯৯১) নজরুল ইন্সটিটিউট থেকে স্বতন্ত্র গ্রন্থাকারে প্রকাশিত। বাস্তবের শিশু মহাকাশ পরিভ্রমণ ও সাগর অভিযানে অসমর্থ তাই নজরুল কল্পনার মাধ্যমে শিশুকে মহাকাশ অভিযান ও সাগর তলদেশে নিয়ে যান। নাটকে তিনি কল্পলোকের বিস্তার ঘটিয়েছেন ও শিশুর চিন্তার জগৎকে বহুলাংশে প্রসারিত করেছেন। উপযুক্ত শব্দচয়ন ও বলিষ্ঠ সংলাপে নাটকটি সমৃদ্ধ।

সঙ্গীত রচনাতেও নজরুল বাংলাদেশে নতুন প্রানের সঞ্চার করেছেন। ’নজরুল গীতি’ বাংলা ভাষাভাষি লোকদের কাছে অতি গৌরবের স্থান অধিকার করেছে। শিশুসাহিত্যে গান রচনার ক্ষেত্রে নজরুলের উদ্যোগ প্রায় ছিল না বলা চলে। তবু দুই-চারটি গান তিনি লিখেছেন শিশুদের উদ্দেশ্যেই।

প্রজাপতি, ফড়িং প্রভৃতি পতঙ্গ বিষয়ে শিশুর মন চিরকৌতূহলী। এদের পিছনে ধাওয়া করা, বা এদের উড়ে যাবার সঙ্গে শিশুর মন উধাও হয়ে যাওয়া একটি চিরকালীন ঘটনা। এই প্রেক্ষিতেই প্রজাপতি ছড়া গান(নজ.রচ.৩য়)টি রচিত।

প্রজাপতি! প্রজাপতি! কোথায় পেলে ভাই!

এমন রঙিন পাখা!

টুক্টুকে লাল নীল ঝিলিমিলি আঁকাবাঁকা

কোথায় পেলে এমন রঙিন্ পাখা!

শিশুর জগৎ বর্ণালী। শিশুর পাঠশালা পড়াশুনা একঘেঁয়েমি ও বিরক্তিকর মনে হয়, সে ঘুরে ঘুরে রঙিন পৃথিবীকে জানতে চায়, দেখতে চায়। এর বস্তুজগতের স্বাদ নিতে চায়। গানটি ধ্বনি-প্রতিধ্বনি, দৃষ্টিভঙ্গি, শব্দ, আবহ সমন্বয়ে এক অপূর্ব সৃষ্টি। প্রজাপতিকে নিয়ে বাংলায় এর চেয়ে সুন্দর, চিত্তাকর্ষক কোন গান চোখে পড়েনি। কমল দাশগুপ্তের সুরারোপিত এই গান শিল্পী সুমিতা বসুর কন্ঠে প্রথম রেকর্ডকৃত হয়। চম্কে চম্কে ধীর ভীরু পায়, (‘গীতি শতদল’)(এপ্রিল,১৯৩৪)। আরবী নৃত্যের কার্ফা’ সুরের পল্লী বালিকার নিরাভরন সৌন্দর্যের প্রশস্তিমূলক গীতি বিশেষ (নজ.রচ.২য়)।

‘ঘুম পাড়ানী গান’ (নজ. রচ.Ñ৩য়) শিশুকে ঘুম-পাড়ানী ছড়া জাতীয় গান। গানটি বাংলা দেশের আবহমান লোকঐতিহ্য সংলগ্ন স্বতঃস্ফুর্ত সুরেলা সংগীত। দেশী সুর ও আবহে বাঙালীর দৈনন্দিন জীবনযাত্রার ছবি তুুলে ধরেছেন,

ঘুম পাড়ানী মাসি পিসি ঘুম দিয়ে যেয়ো

বাটা ভরে পান দেবো গাল ভরে খেয়ো

ঘুম আয় রে, ঘুম আয় ঘুম।

গ্রাম্যসুরে ঝংকৃত ‘লাল নটের ক্ষেতে লাল টুকটুকে বউ’। মিশরীয় নৃত্যের অনুসরণে ’মোমের পুতুল মমীর দেশের মেয়ে’

(গানের মালা’, ১৯৩৪,অক্টো,১৩৪১, আশ্বিন)’ইজিপসিয়ান ডান্সের’সুরে রচিত। শিল্পী অনিমা বাদলের কন্ঠে অক্টোবর

১৯৩৪ সালে রেকর্ডকৃত হয়। খুব অবহেলিত রুক্ষ খর্জুর বৃক্ষ, সাহারা মরু, বালুকার উড়ুনী ইত্যাদি জিনিসকে তিনি যে

পেলবতা দিয়েছেন বাংলা গানের ক্ষেত্রে তা দুর্লভ সামগ্রী। এই সমস্ত গানকে তিনি শব্দসংগীত ও ছন্দাঘাতে অনবদ্য

করে তুলেছেন। ’শুকনো পাতার নূপুর পায়ে’ (‘গীতি শতদল’, ১৩৪১ বৈশাখ) সহজে পথিকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এর

প্রধান চরিত্রধারণকারী কোন শিশু নয় তথাপি এর দৃশ্যপট, বর্ণময় চিত্র নৃত্যময় ছন্দ শিশুমনকে সমভাবে বয়স্ককেও

আকর্ষিত করে। খুব সাধারণ পুঁইপাতা, নটেশাক, লাল লংকার মত জিনিসকে চিত্রকল্পের মাধ্যমে অসাধারণ করে

তুলেছেন। নজরুল শিশুদের তালপ্রবণ ও ছন্দপ্রিয় মনটিকে জানতেন বলেই এমন গান লিখতে পেরেছেন। যৌথ ভোগের

কিছু গান ‘ত্রিভুবনের প্রিয় মোহাম্মদ’, ’তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের ঘরে’ ইসলামী ভাবাদর্শে রচিত। গানগুলির সুর,

তাল, লয় অপূর্ব ব্যঞ্জনার সৃষ্টি করে। এই সমস্ত গানের মাধ্যমে ধনী গরীবের বিভেদ দূর করেছেন ও বিশ্বমানবতার মুক্তির

গান শুনিয়েছেন। যেমন হাস্যরস তেমনি ব্যঙ্গরস সৃষ্টিতেও তিনি পারঙ্গম।

নজরুলের যৌথ ভোগের গান ব্যঙাত্মক ‘ওরে হুলোরে তুই,‘(গীতি শতদল’ কাব্যগ্রন্থভুক্ত, বৈশাখ ১৩৪১)(নজ.রচ.-২য় খন্ড)। গানখানিতে সন্ত্রাসবাদী কোনো শ্বেতাঙ্গ পুলিশ কর্মকর্তার প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে বলে মনে হয়। এর  শেষাংশ,

স্বীকার করি শিকারী তুই গোঁফ দেখেই চিনি,

গাছে কাঁঠাল ঝুলতে দেখে দিস গোঁফে তুই তেল।

ওরে ছোঁচা ওরে ওঁচা বাড়ী বাড়ী তুই হাঁড়ি খাস

নাদনার বাড়ী খেয়ে কোনদিন ধনে প্রাণে মারা যাস,

বৌঝি যখন মাছ কোটেরে, তুমি খোঁজ দাও

বিড়াল-তপস্বী, আড়নয়নে থালার পানে চাও॥

তুই উত্তম-মাধ্যম খাস এত তবু হল না আক্কেল।

ভেদ-বুদ্ধি তাঁকে অত্যন্ত বিচলিত করেছে এবং একে তিনি ব্যঙ্গ-বিদ্রুপে জর্জরিত করেছেন।

নজরুলের হাতে বাংলা সংগীত যেভাবে সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে ইতিপূর্বে তেমনটি দেখা যায়নি। সুরের এই মৌলিক অবদানের

জন্যেই নজররুলগীতি ক্রমেই জনপ্রিয়তা লাভ করছে। যৌথভাবের নজরুলের গানগুলি শিশুদের উদ্দেশ্যে রচিত না হলেও

শিশু ও বয়স্ক উভয়েই গানগুলি গেয়ে এবং নেচে আনন্দ পায়। বিভিন্ন প্রকাশ মাধ্যমে এর পুনঃ পুনঃ গীত ও নৃত্য এর বহুল

জনপ্রিয়তাই প্রমাণ করে।

নজরুলের হাসির গানের জুড়ি মেলা ভার। নজরুলের গানে আছে নির্মল হাসির প্রবাহ। রাজনৈতিক, ধর্মীয় এবং সামাজিক সমস্যাবলীকে ব্যঙ্গ করে লেখা গানগুলি সমধিক প্রসিদ্ধ। সুরের দিক দিয়ে না হলেও বিষয়ের বৈচিত্র্যে ভরপুর। দেশী আবহে রচিত বিভিন্ন পরিবেশের গানের মধ্যে পাই লোকায়ত নজরুলকে।

বাংলা গানের সমৃদ্ধিতে নজরুলের আরেকটি উল্লেখযোগ্য অবদান হল বিদেশী সুর সংগ্রহ। যে কোন ভাষায় গানের

আকর্ষণীয় সুর তিনি বাংলা গানে লিখতেন। এতে বাংলা গানের সুরের ভা-ার সমৃদ্ধ হয়েছে। নজরুলগীতির সুরের মাদকতা

বেড়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের অনেকগুলি দেশের বিভিন্ন সুর তিনি সংগ্রহ করেছেন এবং হুবহু সেই সুরের ফ্রেমে বাংলা কথা বসিয়ে

দিয়েছেন। নিছক আনন্দ দানের উদ্দেশ্যে নজরুল শিশুদের জন্য যে গুটিকতক গান লিখেছেন রচনা হিসেবে তা যেমন

ছন্দিত তেমনি সুখপাঠ্য। দেশী যে সমস্ত গান লিখেছেন সেখানে শব্দ, ছন্দ ও সংগীতের অপূর্ব সুন্দর সার্থক সমাহার

ঘটিয়েছেন।

বাংলার হিন্দু-মুসলমানের ঐতিহ্যকে তিনি অজস্র গানে সঞ্জীবিত করেছেন, একনিষ্ঠ আদর্শবাদিতার প্রেরণা অপেক্ষা বিচিত্র সুরের প্ররোচনাতেই তিনি সমধিক প্রবুদ্ধ হয়েছেন। গানে তিনি পূর্ণ নিবেদিতচিত্ত শিল্পসাধক। তাঁর প্রেমের গান, সাধনার গান, হাসির গান- বাঙ্গালীর মনকে বহুদিন সরস করে রাখবে। জাতীয় দুর্দিনে বাঙ্গালি বারবার স্মরণ করবে তাঁর স্বদেশী সঙ্গীত।

নজরুল ইসলাম কতর্র্র্ৃৃক প্রণীত ‘মক্তব্য সাহিত্য’ (১৩৩৫)। খান মুহাম্মদ মঈনুদ্দীন তাঁর ‘যুগস্রষ্টা নজরুল’ গ্রন্থের তথ্য অনুযায়ী গ্রন্থটি তৎকালীন মক্তব ও মাদ্রাসাসমূহের প্রথম শ্রেণীর জন্য অবশ্যপাঠ্য। এতে তিনি মোনাজাত’ নজরুল কর্তৃক অনূদিত ’সূরা ফাতেহা-র বঙ্গানুবাদ, ‘হজরত মোহাম্মদের উম্মত পরীক্ষা’, ‘পানি’, ‘ঈদের দিনে’ ‘মৌলবী সাহেব’, চাষী, ‘কাবা শরীফ’, ‘কোরআন শরীফ’, ‘উদ্ভিদ্’, ‘আল¬াহ্ তায়ালা’, ‘হজরতের মহানুভবতা’, ‘গোরু’, ‘পরিচ্ছদ’, সত্যরক্ষা’, ‘বিড়াল’, ‘ঈদের চাঁদ’, রচনা অন্তর্ভুক্ত করেন। শিশুসাহিত্যের অন্যান্য শাখা অল্প বিস্তর বিচরণ করলেও ছোটদের জন্যে কোনো গল্প প্রায় ছিলনা বলা চলে। শিশুরঞ্জক কথাকার হিসেবে ছাত্রদের জন্য তিনি এই গ্রন্থটি প্রণয়ন করেছেন। সত্যিকার গল্পকারের গুণাবলী তাঁর ছিলো এবং সেই গুণাবলীর কিছু স্বাক্ষর তিনি এ গ্রন্থে রেখে গেছেন। গল্পগুলির ভাষা নিরতিশয় সরল ও স্বচ্ছন্দ, ঢঙে মজলিসী আর সরস। নিতান্তই শিশু গল্পের ভাষা ও রচনাভঙ্গির অনুরূপ। গল্প পরিবেশনে আঙ্গিকগত দিক থেকেও নজরুল যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। শিশুতোষ গল্প রচনায় মনোযোগী হলে তিনি একজন উঁচুদরের কথাকার হতে পারতেন নিঃসন্দেহে। গ্রন্থভুক্ত ‘সত্যরক্ষা’ নাটকটি শিশুর নৈতিক চরিত্রগঠন তথা বিকাশসাধনে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে।

নজরুল ইসলামের প্রতিটি রচনারই এক একটি বৈচিত্র্যময় কাহিনী রয়েছে। শিশুদের মনন বিকাশের উপযোগী এই কাহিনীগুলি। শিশুমনের চিন্তাধারার উৎকর্ষ সাধনে এই সমস্ত কাহিনী তথা চরিত্রের বিন্যাস যথাযথ।

নজরুল শিশুসাহিত্যের সমাজচিত্র আলাদা বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। তিনি যুগের দাবীকে মেনে নিয়েছেন এবং অত্যন্ত বাস্তবসম্মতভাবে শিশু মানস বিকাশের উপযোগী করে তাঁর সাহিত্যে প্রতিভাত করেছেন। নজরুল শিশুসাহিত্যের প্রতিটি ক্ষেত্রেই স্বচ্ছন্দ বিচরণ করেছেন। এইসব রচনা পরিমানে সীমিত হলেও সাহিত্যের মানদন্ডের বিচারে পূর্ববর্তী শিশু সাহিত্যের তুলনায় অধিকতর সার্থক শিশুসাহিত্য।

নজরুল শিশুসাহিত্যের চরিত্রগুলো দ্বন্দ্ব সংঘাতময় এবং বাস্তবতার সাথে সম্পৃক্ত। শিশুমনের আশা-আকাংক্ষা, অজানাকে জানবার ও জয় করবার ইচ্ছা তাঁর সাহিত্যে মূর্ত হয়ে উঠেছে।

ভাষা ও ছন্দের উপর ছিল নজরুলের অপ্রতিহত অধিকার। ছিল অনুপ্রাস ও অন্ত্যমিল সৃষ্টির অপরিসীম ক্ষমতা, উপমা ও চিত্রকল্প রচনার দক্ষতা এক্ষেত্রে নজরুলকে সার্থক শিশু-কিশোরপোযোগী সাহিত্য রচনায় সহায়তা দিয়েছে। অনেকক্ষেত্রে সামান্য ঘটনা আর বিষয়বস্তুকেও নজরুল নাটকীয় করে তুলেছেন, করেছেন আকর্ষণীয় অনুপ্রেরণা-সঞ্চারী, করে তুলেছেন ব্যঙ্গ-কৌতুক হাস্যরসে ভরপুর। এই অসাধারণ সৃষ্টিক্ষমতার কারণেই তাঁর রচনায় বিধৃত সুখ-দুঃখের অনুভূতি শিশু কিশোর ও বয়স্ক সবার মনকেই সমানভাবে আন্দোলিত করে। তাঁর অধিকাংশ শিশুতোষ ছড়া ও লোকসাহিত্যের কবিতাগুলি স্বরবৃত্ত ছন্দে রচিত। বাংলা ছন্দের প্রয়োগে তিনি যে নতুনত্ব দেখিয়েছেন, শিশুসাহিত্য তার ব্যতিক্রম নয়।

শিশু-কিশরোপোযোগী সাহিত্য রচনার জন্য প্রয়োজন শিশু ও কিশোর মনস্তত্ত্ববিদের। প্রয়োজন তাদের মন মানসিকতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়া ও গভীরভাবে পরিচিতি হওয়া। তাদের আচার-আচরণ, ভাবনা-চিন্তা ও স্বপ্ন কল্পনার ব্যাপারে অভিজ্ঞতা অর্জন, তাদের ভাষা, কথনভঙ্গী ও অভিব্যক্তি সম্পর্কে প্রত্যক্ষ জ্ঞান, সেই ভাষায় ও ভঙ্গীতে লেখার ক্ষমতা। নজরুল এর সবকিছুই আত্মস্থ করেছিলেন, সহজ ও স্বচ্ছন্দে লেখার ক্ষমতাও তিনি আত্মস্থ করেছিলেন।

নজরুলের শিশুরা বেশ পরিপক্ক, জীবনচঞ্চল কৌতুহলী ও কৌতুক-পরায়ণ। তারা বাক্সময় ও মুখর। সুবোধ বালকের সুশীল ভাষিক আচরণ তারা তেমন পছন্দ করে না। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের পক্ষপাত ছিল, গোপালের প্রতি নয় রাখালের প্রতি, নজরুল ইসলামের পক্ষপাতও সেদিকে।

তিনি শিশু উপযোগী বিষয়বস্তু উপস্থাপন করেছেন। শব্দচয়নে সাহিত্যের রস পরিবেশন করেছেন।

নজরুল ইসলাম বাংলা শিশুসাহিত্যে নবজাগরণের সঞ্চার করেছেন ও সাহিত্যের মাধ্যমে প্রগতিশীল মতামত ব্যক্ত করেছেন। সাহিত্যের প্রচলিত মেজাজকে ভেঙ্গেচুরে নতুন মেজাজ প্রবর্তন ও বুদ্ধির বিকাশ ও চিন্তার মুক্তির ক্ষেত্রে তার সমপর্যায়ের লেখক বাংলা সাহিত্যে দুর্লভ।

নজরুল বাংলা সাহিত্যের একজন সব্যসাচীপ্রতিম লেখক Ñ সাহিত্যের সকল ক্ষেত্রেই  যাঁর অবাধ বিচরণ। তাঁর শিশুসাহিত্য চর্চা এমনি বিচরণের ফল। তাঁর শিশুসাহিত্য সৃষ্টি যৎসামান্য। কিন্তু এই সামান্য সৃষ্টি নজরুল প্রতিভার প্পর্শে ঋদ্ধ। তাঁর রচনাগুলি ছন্দিত। তিনি এগুলি লিখেছেন Ñ শিশুদের প্রেরণা ও আনন্দদানের উদ্দেশ্যে। কিন্তু শুধু শিশুই নয় তাঁর রচিত সাহিত্য শিশু-বয়স্ক উভয়েরই শ্রতি ও দৃষ্টিকে নন্দিত করে। তিনি যে সর্বতোভাবে সফল হয়েছিলেন তার প্রমাণ আমরা আমাদের জীবনে জাতীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানে বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে পাই। সুতরাং শিশুসাহিত্যের ক্ষেত্রে নজরুলের সৃষ্টি প্রয়াস অল্প হলেও তিনি আধুনিক বাংলা শিশুসাহিত্যের এক বিশিষ্ট স্রষ্টা। নজরুল তাই তাঁর মহাপ্রয়াণের পরেও সমান জনপ্রিয়।

 

 

 

————————————————————————————————————

 

মানবকল্যানের জন্য কোন পথ শ্রেয় কোন পথ পরিত্যজ্য মানবপ্রেমিক কবি রবীন্দ্রনাথ প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি তা নির্দেশ করেছেন, কিন্তু তাঁর কবি ও কর্মী ’সত্তার মধ্যে সমন্বয় সাধন করতে ব্যর্থ হয়েছেন। অপরদিকে নজরুলের মধ্যে এ দুয়ের সমন্বয় লক্ষ্যনীয়। পুঁজিবাদী শাসন ও শোষনের বিরুদ্ধে তিনি যেমন ছিলেন উচ্চকন্ঠ তেমনি সমাজের নিুশ্রেণীর মানুষের দুঃখ-বেদনার সংগে ছিলেন ঘনিষ্ঠরূপে পরিচিত। তাঁর কাব্যে তাই একদিকে যেমন আছে বিদ্রোহ, তেমনি আছে সর্বহারা মানুষের জন্য সমবেদনা এবং অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রাম।

এই সমাজসচেতনতা এবং দারিদ্র-শোষিতÑবঞ্চিত মানুষের জন্য সহানুভূতি নজরুলের সমসাময়িক কোন কবির কাব্যে তেমন বলিষ্ঠতা নিয়ে উপস্থিত নয়। নজরুল কেবল রাজনৈতিক মতাদর্শই প্রচার করেননি, সঙ্কীর্ণ সাম্প্রদায়িকতার প্রতিও তাঁর তীর বিদ্রুপবাণ নিক্ষিপ্ত হয়েছে সমাজের সব অন্যায় এবং অসঙ্গতিকে তিনি যেমন চিহ্নিত করেছেন তেমনি ব্যঙ্গ-বিদ্রপে, কর্মে-কথায় তিনি চেষ্টা করেছেন সব অসঙ্গতির অবসান ঘটাতে।

সত্যেন্দ্রনাথের তুলনায় নজরুল ইসলামের কবিতা অত্যধিক ছন্দময়। মোহিতলাল একসময় অতিশয় প্রীত হয়ে বলেছিলেন, ’কাজী সাহেবের কবিতা পড়িয়া সেই ছন্দ ঝংকারে আমার আস্থা হইয়াছে। ’নজরুল ও সাময়িক পত্র’, মোবাশ্বের আলী পৃ-৬৯।

অগ্রহায়ণ ১৩৫২ সংখ্যায় কাজী আবদুল ওদুদ ’আধুনিক বাংলা সাহিত্য’ শীর্ষক প্রবন্ধে নজরুল প্রতিভা সম্পর্কে আলোচনা করেছেন,

স্বদেশী আন্দোলনের সমস্ত বীর্য নিয়ে তিনি বাংলা সাহিত্যে আবির্ভুত হলেন। তাঁর অপূর্ব তারুণ্য আর অপুর্ব স্বাধীনতা-প্রীতি দেখতে দেখতে তাঁকে প্রিয় করে তুললো বাংলার আবালবৃদ্ধবনিতার কাছে।…নজরুল ইসলাম এ কালের বাঙ্গালী মুসলমানের মধ্যে প্রথম সাহিত্যিক যিনি বাংলার মুসলমান ও হিন্দু উভয়ের চিত্ত আন্দোলিত করতে সক্ষম হলেন।…

কবি (নজরুল ইসলাম) সত্যিকার বাঙালীর কবি। হিন্দু ও মুসলিম উভয় জাতির সাহিত্য, ধর্ম ও সভ্যতার ধারা ও চিন্তাপ্রণালীর সাথে তাঁর সুপরিচয় এ দু’য়ের সংমিশ্রণ ও সমন্বয় ঘটাবার জন্য তিনি সাধনা করেছেন তাঁর কাব্যের ভিতর দিয়ে।…

তিনি বাঙালি হিন্দু-মুসলানের প্রথম জাতীয় কবি।

মোহাম্মদ মতিয়ার রহমান ’নজরুল- সাহিত্য’ পৃ-২১০ নজ ও সা প মোবাশ্বের আলী

দিলরুবাই সৈয়দ আলী আশরাফ, পরবর্তীতে যুগ্ম সম্পাদক (কাজী মোতাহার হোসেন ও বেগম সুফিয়া কামাল। বৈশাখ, ১৩৫৬, ১৯৪৯, ঢাকা)তাঁকে সর্বপ্রথম ’জাতীয় কবি’ বলে অভিহিত করেন। তাঁকে সহায়তায় এবং তাঁর প্রতিষ্ঠায় সাময়িক পক্রের ভূমিকা ও গুরুত্ব অনুধাবনযোগ্য।

একেই সময়ে রচিত শিশুসাহিত্যে অন্যান্য কবিগন যখন ভাষার কারকার্য় এং ছন্দ ও মিল খুজতে ব্যস্ত ছিলেন তখন নজরুলের শিশুসাহিত্যে

রবীন্দ্রনাথের শিশুসাহিত্য কিছু দার্শনিকতায় ভরপুর, অতীত স্মৃতির্চ্চা, রূপকথা, অদ্ভূত রসের কাহিনী ইত্যাদির প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার প্রমুখ লোককথার অন্তরালে রূপকথা, ধর্মকথা, নীতিকথা উপদেশমূলক বয়ান দিয়েছেন। সুকুমার শিশুসাহিত্যের বিশেষত্ব হাস্যোচ্ছ্াসের অন্তরালে  উদ্ভট জগতের কথা বলেছেন। সুনির্মল বসু সুকুমারের অনুসারী।

 

পাদটীকা

১। কাজীর সিমলা ও দরিরামপুরে নজরুল সংকলন ও সúাদনা, মোহাম্মদ মাহরুজুলাহ, নজরুল ইন্সটিটিউট, ১৯৩৭। ফারুক মাহমুদ ’ময়মনসিংহে নজরুল স্মৃতি’তে বলেছেন পৃ-৭৩

২। আবুল মনসুর আহমদ এর ’নজরুল স্মৃতি’তে বলেছেন, ঐ, পৃ-৬৬

৩। এ প্রসঙ্গে আবদুল কাদির ’নজরুল-জীবনের এক অধ্যায়’, বলেছেন

ঐ, পৃ-৩৩।

৪। ঐ, পৃ-৩৪।

৫। রফিকুল ইসলাম, ’কাজীর শিমলা ও দরিরামপুরে নজরুল’, অধ্যায়ে বলেন ঐ পৃ-৩৮।

৬। আতোয়ার রহমান, ‘নজরুল বর্ণালী’, সহকারী পরিচালক, নজরুল ইন্সটিটিউট, ফাল্গুন, ১৪০০। পৃ-৪১  ।

৮। বাংলা সাময়িক পত্রের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় পত্রিকা। অল্প সময়ের মধ্যে এমন জনপ্রিয কবিও দেখা যায় না                    এমন কাগজও। বাঙ্গলা দেশে ধূমকেতুর আবির্ভাব অপ্রত্যাশিত, স্বল্পায়ু কিন্তু অবিস্মরণীয়। (মইনুদ্দিন, নজরুল ও                 সাময়িক পত্র,পৃ-৮৭)।

নজরুলের নিজস্ব মালিকানায় ১৯২২ সালের ১২ই আগষ্ট অর্ধ-সাপ্তাহিক ’ধূমকেতু’ পত্রিকার মাধ্যমে প্রকাশিত হতে থাকে নজরুলের বহু উদ্দীপনামূলক কবিতা, রাজনৈতিক আদর্শ এবং ভারতের স্বাধীনতার দাবী স^রাজ। সেই সংগে প্রাণ পায় স্তিমিত সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন। অসহযোগ আন্দোলনে ঝিমিয়ে পড়া মানুষের øায়ুতে আগুন ধরিয়ে দেয় ধূমকেতু। জ্বালাময়ী সম্পাদকীয় প্রবন্ধগুলো হল ধূমকেতুর প্রধান আকর্ষণ। বিদেশী শাসনের বিরুদ্ধে পরাধীন দেশবাসীর ধূমায়িত অন্তর্জালার নির্ভীক অভিব্যক্তি এই সকল সম্পাদকীয় প্রবন্ধের বৈশিষ্ট্য। ধূমকেতুতে নজরুলের লেখার ফলে অসহযোগ আন্দোলনের ফলে চাপা পড়া (সন্ত্রাসবাদ আন্দোলন আবার চাঙ্গা হয়ে উঠেছিল। সন্ত্রাসবাদী দলের আনুষ্ঠানিক বা প্রাতিষ্ঠানিক সদস্য না হলেও সন্ত্রাসবাদের প্রতি ছিল তাঁর আন্তরিক সমর্থন। এ পত্রিকার মাধ্যমে তিনি সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন পুনর্গঠন করার চেষ্টা চালান।) ’ধূমকেতু’তে প্রকাশিত (’আনন্দময়ীর আগমনে’ শীর্ষক কবিতার জন্য কারাদন্ডাদেশ প্রাপ্ত (১৬ জানুয়ারী) হন।  (’স্বরাজ’ সম্পর্কে নানা ব্যাখ্যা নানা মত ও সামন্ত বুর্জোয়া সুবিধাবাদের এ পটভূমিকায় নজরুল তাঁর ’ধূমকেতু’ পত্রিকায় স্বরাজের ধারণা প্রত্যাখান করেন। তিনি ভারতবর্ষের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি উত্থাপন করেন। এই সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের সঙ্গে সঙ্গে নজরুল ভারতবর্ষের কমিউনিষ্ট আন্দোলন দ্বারাও প্রভাবিত হন-যার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মুজফ্ফর আহমদ।))

৮। আতোয়ার রহমান, ‘নজরুল বর্ণালী’, সহকারী পরিচালক, নজরুল ইন্সটিটিউট, ফাল্গুন, ১৪০০।  পৃ-৪৩।

৯। অবনীন্দ্র রচনাবলী দ্বিতীয় খন্ড, প্রকাশ ভবন, ১৫ বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিট, ১৯৭৪। পৃ-৪৬৬।

১০। ঐ, পৃ-৪৪।

১১। ঐ, পৃ-৪৪।

আশরাফ সিদ্দিকির ’স্মৃতি অম্লান’১২ থেকে জানা যায় Ñ ত্রিশাল জমিদার বাবুদের বাড়ীর লিচু গাছকে কেন্দ্র করে বিখ্যাত ’লিচু-চোর’ কবিতাটি রচিত। মুজফফর আহমদ এর ’কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথা’ থেকে জানতে পারি বিখ্যাত ’লিচু-চোর’ কবিতাটি প্রাথমিক স্কুলের পাঠ্যপুস্তকের জন্য রচনা করেছিলেন। অদ্যাবধি এর স্থান ’বাংলাদেশ স্কুল টেক্সট বুকে’র অধীন পাঠ্যপুস্তকের পাতাতেই রয়েছে। ১৯১৯ সালে আলী আকর খানের সঙ্গে মুজফ্ফরের পরিচয়ের পর ’লিচু চোর’ লিখিত। কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথা ’মুজফফর আহমদ পৃ, ৯৮ Ñ ১০০। আলী আকবর খানের প্রাথমিক স্কুলপাঠ্য বইয়ের জন্য লিখিত কবিতা দেখে হতবাক হয়ে নজরুল ইসলাম কবিতাটি লিখেছিলেন।(যিনি বড়লোক হওয়ার উদ্দেশ্যে প্রাথমিক স্কুলপাঠ্য কবিতা লিখেন।

১২। হাস্যরসিক নজরুল, রাশিদুল হাসান, নজরুল ও সাময়িক পত্র, মোবাশ্বের আলী, প্রকাশক আবুল কালাম আজাদ, নজরুল ইন্সটিটিউট, ঢাকা-১৯৯৪।

কাজীর সিমলা ও দরিরামপুরে নজরুল, সংকলন ও সম্পাদনা, মোহাম্মদ মাহফুজুল্লাহ, নজরুল ইন্সটিটিউট, ১৯৩৭। পৃ-৪৩

১২। ঐ, পৃ-১০০

(১৩। সুকুমার রায়, ‘খাই খাই’ কাব্যগ্রন্থ, সিগনেট প্রেস, ১০/২ এলিগেন রোড, কলকাতা, ২১শে সেপ্টেম্বর, ১৯৫০।)

১৩। শিশুসাহিত্যে নজরুল-মোহাম্মদ মোদোব্বের-পৃ-৩, মাহে নও তৃতীয় চতুর্থ সংখ্যা, জুলাই-১৯৫২, শ্রাবণ-১৩৫৮ সম্পাদক মীজানুর রহমান।

(১৪। সওগাত, সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরুদ্দিন, বাংলা ১৩৪৪ মাঘ (১৯৩৭)

১৪।’মৌচাক’ (১৪ এপ্রিল, ১৯২২) সুধীরচন্দ্র রাহা সম্পাদিত), শিশুসাথী (১৯২২), রামধনু (১৯২৭), মাস পয়লা (১৯২৯) ছিল অন্যতম।

১৫। ’মৌচাক’  ১৯২২) সুধীরচন্দ্র রাহা সম্পাদিত),

(১৫। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ‘শিশু’ কাব্যগ্রন্থ, সম্পাদক মোহিতচন্দ্র সেন, ১৩১০।

রবীন্দ্র রচনাবলী। তৃতীয় খ-। ‘সোনার তরী’ কাব্যগ্রন্থ। ১৩৮০ সালে প্রকাশিত। পৃষ্ঠা ৪৯-৫৫।)

১৬।কথ্য ভাষায় কাঠবিড়ালী। কিন্তু নজরুল ইসলামের মুল কবিতায় কাঠবেরালি

‘ঝিঙেফুল’ (আশ্বিন-১৩৩৩) নজরুল ইসলাম দৌলতপুর থেকে কুমিল্লায় ফিরে এসে কবিতাটি লিখেছিলেন। এ কবিতার রস-উপকরণের উৎস সন্ধানে মুজফফর আহমদ বলেন,

নজরুল একদিন দেখতে পেল যে, শ্রী ইন্দ্রকুমার সেন গুপ্তের শিশুকন্যা ’জটু’ (শ্রীমতি অঞ্জলি সেন) একা একা কাঠবেরালির সঙ্গে কথা বলছে। তা দেখেই সে কবিতাটি লিখে ফেলল। (মুজফফর আহমদ, কাজী নজরুল ইসলাম Ñস্মৃতি কথা, ২য় সংস্করণ, ৩য় মুদ্রণ, ১৯৬৯, পৃঃ ১৮০)।

৭।১৭। আবু হেনা মোস্তফা কামাল, প্রাগুক্ত, পৃ.১২২।

১৮। (নজরুল চরিত মানস,পৃ-২৫৭)

 

১১.‘পুতুলের বিয়ে’ নাট্যগ্রন্থ ১৩৪০  ডি, এম, লাইব্রেরী, ৬১

কর্ণওয়ালিশ স্ট্রীট, কলিকাতা।

১০.সত্যরক্ষা, নজরুল ইসলাম প্রণীত ‘মক্তব সাহিত্য’ গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত, ৩১শে জুলাই ১৩৩৫, ২৫-এ পঞ্চানন টোলা লেন, কলিকাতা।

উনিশ শতক শুরুর পূর্বে সাহিত্য জীবন ঘনিষ্ট ছিল না। প্রাক আধুনিক বাংলা সাহিত্যে মাত্র কয়েকটি ক্ষেত্রে শিশুর সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। এ শিশুও দু’ভাবে ছিল, এক. সমাজ জীবনের মধ্যে স্থাপিত মানব শিশু. দুই. সমাজ জীবেেনর বাইরে দেব শিশু. দেবাদের শিশু, দেবতাদের শৈশব, আরণ্যক শিশু ইত্যাদি। উনিশ শতক শুরুর পর সমাজ ও জীবনের গোটা ধারণা কাঠামো বদলে গেছে, শিশু ধারণার মধ্যেও তা লক্ষ্য করা গেছে। কোনো কোনো দিক দিয়ে এ পরিবর্তন এত বড়ো এবং মৌলিক যে একে প্রায় নতুন সূচনা বলেও মনে হয়। বাংলা সাহিত্য গভীরভাবে সমাজ সম্পর্কযুক্ত, ক্রমবর্ধমান সমাজ সম্পর্ক আধুনিক বাংলা সাহিত্যের নিবিড় চরিত্রায়ন সৃষ্টি করেছে। এ সাহিত্য মোটামুটি পুরোটাই নাগরিক শিক্ষিত মধ্যবিত্তের জীবন এবং চেতনা নির্ভর, নাগরিক সমাজ ও জীবন মূল্যবোধ ইত্যাদির পরিপ্রেক্ষিতে সেভাবে তা প্রতিফলিত ও রূপায়িত হয়েছে। বিশ শতকের বাংলা সাহিত্যে শিশুধারণা গঠন নগরায়নের ফলশ্রুতি, নাগরিক জীবন ঘনিষ্ঠ, শিক্ষিত মধ্যবিত্তের সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক চেতনালোক সামনে নিয়ে সেভাবেই এর রূপরেখা গঠন করা যেতে পারে।

*ঠাকুরবাড়ী ও রায়বাড়ীর রুচি ও আভিজাত্যের পটভূমিকায় গড়ে উঠেছে বাংলা শিশুসাহিত্য। ঐতিহ্যে গড়ে উঠেছে বিশিষ্ট শিশুাহিত্যিক যাঁরা বিশ শতকের প্রথম থেকে চতুর্থ দশক পর্যন্ত শিশুসাহিত্য সৃষ্টিতে স্বাতন্ত্র্য এনেছিলেন আলোকিত মানুষ গঠনের লেেক্ষ্য

একই ধরণের সামাজিক বা রাজনৈতিক সাময়িক বিষয় অবলম্বনে কবিতা রচনা করে একই সময়ে প্রভূত পরিমাণ চাঞ্চল্য সৃষ্টি এবং রবীন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ, প্রমথ চৌধুরীর মত বিশিষ্ট সাহিত্যিকদের উপর সাহিত্যিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক দায়িত্ব পালনের ভূমিকা সতেন্দ্রনাথের চাইতে নজরুলে অধিকতর গ্রহণীয়।

উল্লেখ্য যে সমসাময়িক ঘটনাবলী নিয়ে কবিতা রচনার এই প্রয়াস  নজরুলেও বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়।

সার্থক ও সফল শিশুসাহিত্য সব বয়সের নর নারীর কাছে সমান রসাস্বাদ এনে দেয়।

 

 

 

উপসংহার

 

বিশ শতকের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক প্রেক্ষাপটে আলোচিত শিশুসাহিত্যিকগন শিশুসাহিত্যের অভাবের সময়ে শিশুপোযোগী সাহিত্য রচনার পদক্ষেপ নিয়ে এই সাহিত্য বিকাশের পথকে সুগম করেছেন নিঃসন্দেহে। বিশ শতকের প্রথমেও বাংলার সাহিত্যাকাশ রবির প্রখর দ্যুতিতে আলোকিত ছিল। শিশুসাহিত্যে তার পদচারণাও এই শতকেরই শুরুতে। আলোচিত শিশুসাহিত্যিকগণ রবীন্দ্রপ্রভাবমুক্ত হয়েই সাহিত্যে মৌলিক অবদান রেখেছিলেন। তাঁরা শিশুসাহিত্যের অঙ্গসৌষ্ঠবের প্রতি যেমন মনোযোগী ছিলেন, তেমনি যুক্তাক্ষরবর্র্জিত শব্দ দ্বারা অপেক্ষাকৃত সহজ সরল ভাষায় এই সাহিত্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তাঁরা সবাই পূর্বতন ধারার শিশুসাহিত্যিকদের স্কুলপাঠ্য, নীতিবিদ্যা এবং উপদেশমূলক বাণী ছেড়ে শিশুকে আনন্দরূপের সঙ্গে পরিচয় করালেন। তাতে শিশুসাহিত্যজগতে নতুন প্রাণের সঞ্চার হলেও শিশুর স্থান হল কল্পনা ও উদ্ভটের জগতে। শিশুসাহিত্যে কল্পনার প্রসারতা বাড়লেও, ধর্মীয় সংস্কারের উর্ধ্বে নজরুল শিশুসাহিত্যে যে ধরণের প্রগতিশীল মতামত ব্যক্ত করলেন, শিশুকে যে ধরণের জাগরণের মন্ত্র শোনালেন তাতে শিশুসাহিত্যে যে আবেগের সঞ্চার হল – তা একুশ শতকেও সমানভাবে দীপ্যমান।

নজরুল ইংরেজ আমলের বাংলা কাব্যে শেষ প্রতিভাধর কবি এবং উনিশ শতকের নবজাগরনের যে প্রধান সুর মানবতাবাদ, তা তাঁর মধ্য দিয়ে মূর্ত হয়ে উঠেছে। তিনি মানূষের  মনূষ্যত্ব ও মহিমায় অপার বিশ্বাসী এ দিক দিয়ে তিনি রবীন্দ্রনাথের উত্তরসাধক।

রবীন্দ্রনাথ যে পটভূমিতে কাব্যসাধনায় ব্রতী ছিলেন নজররুলের কাব্যসাধনার সামাজিক, অর্থিেনতিক এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট তা থেকে ভিন্ন ছিল না। যুদ্ধ, কালোবাজারী, মন্বন্তর, অসহযোগ আন্দোলন, খিলাফত আন্দোলন প্রভৃতি ঘটনাগুলো তাঁকে প্রভাবিত করেছিল বিপুলভাবে। বিদ্যালয়ে পাঠরত অবস্থায় ’যুগান্তর’ দলের সংগে সংশিষ্ট শিক্ষক নিবারণচন্দ্র ঘটকের বিপ্লববাদ নজরুলকে প্রভাবিত করেছিল যার প্রভাব তাঁর পরবর্তী জীবনে লক্ষ্য করা যায়। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে নজরুলের ভূমিকা অপরিসীম।

।-পৃ-৫.সুকুমার রায়,লীলা মজুমদার (দক্ষিণারঞ্জন, সুকুমার রায় সবার ভাগ্যে প্রায় বিস্মৃতি লেখা ছিল্)

 

বস্তুত নজরুল ইসলামের কবিতা ও গানের অন্যতম বিশেষ বক্তব্যই হচ্ছে হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতি। তাঁর কবিতার মূল সুর অবশ্য সাম্যবাদ ও মানবতাবাদ এবং হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতি কামনা।

কাজী নজরুল ইসলাম একই সঙ্গে বিদ্রোহী এবং সমাজসচেতন কবি। সামাজিক এবং রাজনৈতিক অসংগতি সম্পর্কে সচেতনতাই তাঁকে বিদ্রোহী করে তুলেছে। তাই তিনি কেবল মানবতার জয়গানই গাইলেন না, সেই সংগে বিদ্রোহ করলেন অবিচার ও শোষণের বিরুদ্ধে। বস্তুত সত্যেন্দ্রনাথের মধ্যে যে মানবধর্মের উন্মেষ নজরুলে তার পরিপূর্ণতা। তবে তাঁর সমাজচেতনা কোন বিশেষ মতবাদ দ্বারা পরিচালিত নয়। তাঁর বিদ্রোহাত্মক বা সমাজ-সংস্কারমূলক কবিতাগুলো মূলত এই মানবতাবোধ থেকেই উদ্ভূত। রাজনৈতিক চিন্তাধারার ক্ষেত্রেও তিনি ছিলেন সংস্কারমুক্ত এবং অসাম্প্রদায়িক। অত্যাচারী এবং শোষণকারীকে পদানত ও পরাস্ত করে মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামই ছিল তাঁর আদর্শ, আর সেই আদর্শেরই প্রতিফলন ঘটেছে তাঁর কাব্যে। এ কারণেই তাঁর জীবন ও কবিতাকে পৃথক করে দেখার উপায় নেই। বস্তুত নজরুল ইসলাম ’সকলকে জাগাতে চেয়েছেন মঙ্গলের জন্যে, সত্য প্রতিষ্ঠার জন্যে, মিথ্যার বিরুদ্ধে প্রাণপণ বিদ্রোহ ঘোষণার জন্যে।’

তিনি ছিলেন সঙ্কীর্ণ সাম্প্রদায়িকতার উর্ধ্বে এবং হিন্দু মুসলমান মিলনের আকাংখী। তাঁর কাব্যে মুসলমান জীবনবোধ বলিষ্ঠভাবে ঘোষিত হলেও রাজনীতির খাতিরে তিনি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী। তিনি হিন্দু ঐতিহ্যকে অবলম্বন করে সাহিত্য রচনা করেছেন, অপরদিকে ইসলামী ঐতিহ্যও তার সহায় হয়েছে। বিগত যুগের কাব্যধারায় তিনিই প্রথম শক্তিশালী মুসলমান কবি, যিনি ইসলামী ঐতিহ্যকে সাহিত্য সাধনায় আশ্রয় করেছেন। কিন্তু তাঁর মধ্যে ইসলামী ঐতিহ্য সর্বতোভাবে সজ্ঞান ও সচেতন সাধনার ফল নয় এজন্যই তিনি হিন্দু ও ইসলামী এই দুই ভিন্ন ও বিরোধী  ঐতিহ্য আশ্রয় করেছেন। শুধু তাই নয়, তিনি মুসলমান পুনর্জাগরণের কবি হয়েও হিন্দু জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী।

তাঁর রচনাবলীতে কখনো প্রকাশিত হয়েছে বিদেশী শাসকগোষ্ঠীর শাসনপাশ থেকে দেশ ও জাতিকে মুক্ত করবার আকাংখা, কখনো সাম্যবাদী চেতনায় উদ্বোধিত হয়ে শোষণমুক্ত সমাজ গঠনের আকাংখা। এছাড়া অন্ধ কুসংস্কার, গোঁড়ামী এবং সাম্প্রদায়িক মনোভাব বিরোধী কবিতা ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে মুসলিম পুনর্জাগরণমূলক কবিতাতেও কবির সমাজচেতনার পরিচয় বিধৃত। এ ধরনের কবিতাগুলোতে মূলত বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনা, মুসলিম ব্যক্তিত্ব বা মুসলিম ঐতিহ্যই প্রাধান্য পেয়েছে। আবার হিন্দু ঐতিহ্য অবলম্বনেও প্রচুর উদ্দীপনামূলক কবিতা তিনি রচনা করেছেন। এর কারণস্বরূপ ডঃ মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান বলেন,

বস্তুত মানবতার মহৎ আদর্শে অনুপ্রাণিত কবি কাজী নজরুল ইসলামের কাব্য-ভাবনায় এক প্রধান অংশ জুড়ে আছে হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতি কামনা। মনে রাখা দরকার সমগ্র আধুনিক বাংলা কাব্যের ইতিহাসে কাজী নজরুল ইসলামই একমাত্র কবি যিনি দক্ষতার সঙ্গে হিন্দু ও মুসলমান উভয় ঐতিহ্যকে আপন কাব্যে ব্যবহার করতে সমর্থ হয়েছেন।’

তবে কবির এ ধরনের কবিতাগুলোর বিষয়বস্তু এতো ব্যাপক এবং উদার মনোভঙ্গীতে তিনি বিভিন্ন বিষয়গুলোকে গ্রহণ করেছিলেন যে, কোন কোন সময় সেগুলোকে পরস্পরবিরোধী চেতনা বলে ভ্রম হয়। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, একদিকে তিনি যেমন রুশ বিপ্লব নিয়ে কবিতা লিখেছেন, অন্যদিকে তেমনি প্যান ইসলামিক আন্দোলন এবং চিন্তাধারাও তাঁর কাব্যে স্থান লাভ করেছে। একই কারণে একদিকে যেমন তিনি তুর্কি আন্দোলনের নেতা কামাল আতাতুর্ককে নিয়ে কবিতা রচনা করেছেন, অন্যদিকে তেমনি এশিয়ার বলশেভিক বিরোধী তুর্কি নেতা আনোয়ার পাশাও তাঁর কাব্যে সম-মর্যাদায় স্থান লাভ করেছে। আবার দেখা যায় কবি নিজে যদিও অহিংস অসহযোগ আন্দোলনে বিশ্বাসী ছিলেন না, তথাপি গান্ধীজি এবং চরকাও তাঁর কাব্যে স্থান লাভ করেছে। প্রকৃতপক্ষে নজরুল মানবধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন বলে জাতিÑধর্ম নির্বিশেষে বিশ্বের  যে কোন প্রান্তের মানুষের মানবধর্মী ব্যক্তিত্ব ও আদর্শ তাঁকে অভিভূত করেছে। এ কারণেই দেখা যায়, তাঁর সমসাময়িক কালে বিশ্বব্যাপী বিশেষত ভারতবর্ষ, মধ্যপ্রাচ্য, রাশিয়া, আয়ারল্যান্ড প্রভৃতি দেশের স্বাধীনতা আন্দোলন এবং জাতীয় জাগরণের প্রায় প্রতিটিই তাঁর কাব্যের বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছে।

একজন কবি যেহেতু সমাজের একজন সদস্য, সেহেতু দেশ, কাল, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তন তাঁর মনের মধ্যে ক্রিয়াশীল থাকে, যার অনিবার্য প্রতিফলন ঘটে তাঁর কাব্যে এবং রচনায়। এ চেতনা কেবল স্বদেশেই সীমাবদ্ধ থাকে না, স্বদেশের গন্ডীর বাইরে যে জগৎ তারও প্রতিফলন ঘটতে পারে। একজন মহৎ কবি  কেবল স্বাদেশিক নন, তিনি আন্তর্জাতিকও। এ কারণেই তাঁর কাব্যে ছায়াপাত ঘটে বিশ্বের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতির। অবশ্য একজন কবির দায়িত্ব কেবল সমাজ চৈতন্য নয়, সৃষ্টিরহস্যের প্রয়াসও সেখানে অনিবার্য়। সৈয়দ আলী আহ্সান বলেন,

কবির দায়িত্ব হচ্ছে যুগের সত্যকে এবং প্রাণধর্মকে আবিষ্কার এবং এ আবিষ্কারের চেষ্টায় তিনি যুগের ঘটনাÑপরম্পরাকে স্পর্শ করেন, কিন্তু তার মধ্যে আবদ্ধ থাকেন না।১৭

প্রত্যেক সফল কবির কাব্যে তাঁর সমকালীন যুগ ও সমাজের সার্বিক পরিস্থিতির প্রতিফলন ঘটে। কোন মহৎ কবিই সমকালীন যুগ, সমাজ তথা আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি থেকে নিজেকে একেবারে বিশ্লিষ্ট করে রাখতে পারেন না এ কারণেই ভিন্ন ভিন্ন কালের বিভিন্ন কবির কবিতায় সমাজচেতনার বিভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। বাংলা আদিকাব্য বা মধ্যযুগীয় মঙ্গল কাব্যেও সমাজসচেতনতা লক্ষণীয়। কিন্তু সে সমাজচেতনার সঙ্গে বর্তমানকালের সমাজচেতনার পার্থক্য বিস্তর। এককালে কবিরা শুধু তাদের সমকালীন সময়ের সামাাজিক কিংবা অর্থনৈতিক অসংগতির চিত্র চিত্রিত করেছেন। কিন্তু আধুনিক কবি যেহেতু অধিকতর সচেতন এবং অধিকতর অস্থিরতার যুগে তার বসবাস সেহেতু তিনি শুধু সামাজিক অসংগতির চিত্রই চিত্রিত করেন না, সেইসঙ্গে সেই অসংগতির পথও নির্দেশ করেন। এ কারণেই একজন কবি-কবি হয়েও সমাজ সংস্কারের ভূমিকা পালন করতে পারেন। ঐ একই কারণে রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি প্রভৃতি ক্ষেত্রে একজন কবির অবাধ বিচরন। বিভিন্ন সামাজিক অসংগতির তিনি একজন নির্মম সমালোচকও বটে। একজন কবির লেখনী তাই তরবারির চেয়েও শানিত। তাঁরা শুধু কবি নন, কর্মীও বটে।

সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত রবিভক্ত ছিলেন কিন্তু তাঁর মধ্যেও মৌলিক গদ্যলেখক অবনীন্দ্রনাথের মত স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ছিল, জগৎ ও জীবনের প্রতি রবীন্দ্রনাথের যে দৃষ্টিভঙ্গী তার সঙ্গে সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের দৃষ্টিভঙ্গীর মৌলিক পার্থক্য ছিল। সত্যেন্দ্রনাথের কল্পনা বস্তু ও তথ্যকে অতিক্রম করে রবীন্দ্রনাথের মতো বিমূর্ত বা অপ্রত্যক্ষ ভাবধারা প্রতি আকৃষ্ট হয়নি।

প্রথম মহাযুদ্ধোত্তরকালে জীবিত থেকেও সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত যুদ্ধোত্তর যুগের দ্বন্দ্বচঞ্চল মানসিকতা দ্বারা পরবর্তীকালের কবিদের মতো আচছন্ন হননি ঠিক কিন্তু সত্যেন্দ্রনাথের মধ্যে যে গভীর কাল ও সমাজ সচেতনতা ছিল তার প্রমাণ তাঁর ’সাম্যসাম’, শুদ্র’, ’মেথর’, ’জাতির পাঁতি’ এবং সমকালীন রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলন সম্পর্কিত বিবিধ কবিতাবলী। সমসাময়িক ঘটনাবলী নিয়ে কাবা রচনার এই প্রবণতা নজরুলেও বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়।

বিশ শতকের আধুনিক বাংলা কবিতাকে রবীন্দ্র কবিতার ব্যর্থ অনুকৃতি থেকে অব্যাহতি দেয়ার জন্য অর্থাৎ রবীন্দ্র সমকালীন বাংলা কবিতাকে স্থবিরতা থেকে মুক্তি দেয়ার জন্য  সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত প্রমুখ বিভিন্নভাবে অবদান রেখেছেন। কিন্তু নজরুলের সঙ্গে তাদের পার্থক্য এই যে, তাদের বিদ্রোহ তত্ত্বগত নজরুলে তা বস্তুগত। ঐ কবিদের প্রতিক্রিয়া সাহিত্যে সীমাবদ্ধ, নজরুলে প্রতিক্রিয়া সাহিত্য থেকে সমাজ ও রাষ্ট্রে পরিব্যাপ্ত। নজরুলের বিদ্রোহ তাঁর জীবন ও সাহিত্যে একই সঙ্গে কার্যকর। তাঁর সাহিত্য তাঁর জীবন থেকে স্বতন্ত্র নয়। সে কারণেও সমকালীন বাংলা কবিতায় ভিন্ন স্বাদ আনয়নে নজরুলের ভূমিকা বিশেষভাবে কার্যকর। বুদ্ধদেব বসুর ভায়ায়,

কবিতায় রবীন্দ্রনাথের উত্থান এমনই কার্যকর হয়েছিলো যে তার বিস্ময়জনিত মুগ্ধতা কাটিয়ে উঠতেই দু-তিন দশক কেটে গেল বাংলাদেশের। এই মাঝখানটার সময়ই সত্যেন্দ্র গোষ্ঠীর সময়, রবীন্দ্রনাথেও প্রথম, এবং প্রচন্ড ধাক্কাটা তারা সামলে নিতে সাহায্য করলেন…যতদিন না ’বিদ্রোহী’ কবিতার নিশান উড়িয়ে হৈ হৈ ক’রে নজরুল ইসলাম এসে পৌঁছলেন। সেই প্রথম রবীন্দ্রনাথের মায়াজাল ভাংলো।…সব সত্ত্বেও এ কথা সত্য যে রবীন্দ্রনাথের পরে বাংলা ভাাষায় তিনিই প্রথম মৌলিক কবি।

উনিশ শতকের অপেক্ষাকৃত শান্ত, রিজু, পরিপূর্ণ ও আদর্শ জীবনের প্রতিভূ ছিলেন রবীন্দ্রনাথ, উনিশ শতকের শেষ ভাগ থেকে বিশ শতকের তিন দশক পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের মূলধারা আবর্তিত হয়েছিল রবীন্দ্রনাথকে অবলম্বন করেই। অথচ রবীন্দ্রনাথ তার জীবদ্দশাতেই নতুন যুগের সুচনা প্রত্যক্ষ করেছিলেন। গদ্যে প্রমথ চৌধুরী, অবনীন্দ্রনাথ প্রমুখ, কবিতায় সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, নজরুল ইসলাম প্রমুখের রচনায় লক্ষ্যণীয় পরিবর্তনের সূচনা হয়। ১৯১৩ সালে প্রকাশিত সবুজ পত্র’ এবং ১৯২৩ খ্রীষ্টাব্দে প্রকাশিত ’কল্লোল’ পত্রিকা যে পরিবর্তনের মুখপত্র।

নজরুলকে সৃষ্টি করেছিল বিক্ষুব্ধ যুগ, যুগের বিক্ষোভ সত্যেন্দ্রনাথ দত্তকে সমসাময়িকতায় আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। এবং রবীন্দ্রনাথের কাব্যকে প্রভাবিত করেছিল। সমসাময়িক রাজনৈতিক ও সামাজিক ঘটনা-প্রবাহ রবীন্দ্রনাথ সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত নজরুল ইসলাম পর্যন্ত প্রত্যেকের রচনায় ছায়াপাত করেছে। বাংলা সাহিত্যে নজরুলের আবির্ভাবের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছিল রবীন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্র দত্ত প্রমুখ কবির সৃষ্টির মাধ্যমে। সমকালীন রাজনৈতিক ও সামাজিক ঘটনামূলক কবিতায় সমাজের অনাচারের প্রতি শেষ ও নিপীড়িতদের প্রতি সমবেদনা প্রকাশের ধার সূত্রপাত ঐ কবিদের কাব্যে হয়েছিল। প্রথম মহাযুদ্ধ প্রচলিত মূল্যবোধ ও ধ্যান ধারণার পরিবর্তন আনয়ন করেছিল, বাংলা কাব্যেও রবীন্দ্রোত্তর যুগের সূত্রপাত হয়েছিল। সুতরাং নজরুলের আবির্ভাব বাংলা কাব্যে অভাবিত নয়, সর্বোপরি নজরুলের ঐতিহ্যগত বৈশিষ্ট্য সহায়ক হয়েছিল বাংলা কবিতায় নতুন ও ভিন্নতর সুর সৃষ্টিতে। বুদ্ধদেব বসুর ভাষায়,

…নজরুল বৈশিষ্ট্য পেয়েছিলেন তাঁর জীবনের পটভূমিকার ভিন্নতায়। মুসলমান তিনি সেই সঙ্গে হিন্দু মানসও            আপন করে নিয়েছিলেনÑচেষ্টার দ্বারা নয়, স্বভাবতই… যেহেতু তাঁর পরিবেশ ছিলো ভিন্ন এবং একটু বন্য              ধরনের, আর যেহেতু সেই পরিবেশ তাঁকে পীড়িত না ক’রে উলটে আরো সবল করেছিল তার সহজাত                 বৃত্তিগুলোকে, সেইজন্য কোন রকম সাহিত্যিক প্রস্তুতি না নিয়েও শুধু আপন স্বভাবের জোরেই রবীন্দ্রনাথের মুঠো      থেকে পালাতে পারলেন তিনি, বাংলা কবিতায় নতুন যুগ আনতে পারলেন।…অন্তত এটুকু তিনি দেখিয়ে দিলেন              যে রবীন্দ্রনাথের পথ ছাড়াও অন্য পথ বাংলা কবিতায় সম্ভব। যে আকাংখা তিনি জাগালেন, তার তৃপ্তির জন্য          চাঞ্চল্য জেগে উঠলো নানা দিকে, এলেন স্বপন পসারীর সত্যেন দত্তীয় মৌতাত কাটিয়ে, এবং কল্লোল গোষ্ঠীর            নতুনতর প্রচেষ্টা, বাংলা সাহিত্যে মোর ফেরার ঘন্টা বাজলো।… নজরুল ইসলাম নিজে জানেননি, তিনি নতুন             যুগ আনছেন। *

১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গজনিত কারণে যে স্বদেশী আন্দোলন চলে তাতে বাঙালি শিক্ষিত ও সাহিত্যিক সম্প্রদায় প্রথমারের মত একত্রিত হন। স্বদেশী ভাবধারার প্রসার ঘটে এং বাঙালিচেতনা একটি সুস্পষ্ট সৃজনশীল আকার ধারণ করে, রবীন্দ্রনাথ রূপকথার পাষাণপ্রতিমায় প্রাণের সঞ্চার করেন এবং অন্যান্য শিশুসাহিত্যিকগণ এই সাহিত্যে আনন্দরূপের অধিষ্ঠান রচনা করেন কিন্তু একই সময়ে রচিত নজরুল শিশুসাহিত্য একদিকে যেমন পেয়েছে প্রাণের সঞ্চার তেমনি পেয়েছে আবৃত্তিযোগ্যতা।

বিশ শতকের প্রথম চার দশকের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপেেট রচিত শিশুসাহিত্যিকগণ তাঁদের রচনায় লোকসাহিত্যের আড়ালে হিন্দু পুর্নজাগরণবাদের কথাই বলেছেন। একমাত্র নজরুল শিশুসাহিত্যেই হিন্দু-মুসলিম ঐতিহ্য সমানভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। উপমহাদেশের মুসলিমদের সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অধঃপতিত পরিস্থিতিতে নজরুল ইসলামের আবির্ভাব ঘটেছিল। লাঞ্জিত, অপমানিত সাম্রাজ্যহারা মুসলিম জাতিকে যেমন আশার আলো দেখিয়েছেন, তেমনি হিন্দুদের শক্তি ও সাহস জোগাবার জন্য হিন্দু দেব-দেবীর শরণাপন্ন হবার আহ্বান জানিয়েেেছন। তাঁর রচনায় শুধু যে ইসলামের সাম্য, মৈত্রী, সত্য-ন্যায় ও মানবতাবোধ যথাযথভাবে বিধৃৃত হয়েছে তা নয়, শোষিত, বঞ্চিত, পরাধীন মানুষের মুক্তি ও স্বাধীনতার জয়ধ্বনিও ঘোষিত হয়েছে। ঔপনিবেশিক বৃটিশ শাসনের শৃঙ্খল মোচনে জনগনকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছেন। নিজ দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বৈপ্লবিক চেতনা জাগাতে সক্ষম হয়েছেন। মুসলিম জাতিকে অতীত ঐতিহ্য ও গৌরব পুণঃপ্রতিষ্ঠার জন্য ব্রতী হবার আহ্বান জানিয়েছেন।

তাঁর আদর্শ ও লক্ষ্য ছিল সৃষ্টির কল্যাণ, অন্যায়ের অবসান, অত্যাচারের প্রতিরোধ। নিজ উদ্দেশ্য লক্ষ্যে সাফল্য লাভ করে জন সমাদৃত হতে সক্ষম হয়েছেন। তাই তিনি ‘জনগনের কবি’, ‘আর্ত মানবতার কবি’রূপে আখ্যায়িত হয়েছেন।

নজরুলের বিদ্রোহ কোন বিশেষ মতবাদের খাতে প্রবাহিত নয়। তাঁর বিদ্রোহের মূলে ছিল অকৃত্রিম মানবপ্রেম এযং প্রেমের বহিঃপ্রকাশ তাঁর অন্তরের নির্দেশানুসারে। শুধু এদশেই নয় বিশ্বের মানবগোষ্ঠির সঙ্গে তিনি একাত্মতা অনুভব করেন বলেই তাঁর রোমান্টিক কবিচিত্ত মানুষের নির্যাতন লাঞ্জনা শোষণ উচ্ছেদ করতে বিদ্রোহের ভূমিকায় অবতীর্ণ। তিনি শিশুসাহিত্যের অঙ্গসৌষ্ঠবের প্রতিও অধিক মনোযোগী ছিলেন। কোন পরম আস্তিক্যবোধে তিনি মানুষের অত্যাচার, অবিচার ও নিপীড়নের জন্যে বিধাতার শক্তির কাছে আবেদন করে নিশ্চিত থাকতে পারেননি। তাঁর কবিসত্তা নিজেই তরবারি হাতে অসংগতি, বৈষম্য প্রভৃৃতির অবসান ঘটাবার জন্য যুদ্ধ ঘোষণা করে লাঞ্জিত ও নিপীড়িত মানবগোষ্ঠিকে আত্মশক্তিতে উদ্বুদ্ধ হ’য়ে স্বাধীনতা-সংগ্রামে অংশ গ্রহণ করতে ডাক দিয়েছে। তিনি আস্তিক্যবাদী হলেও তাঁর আসিস্তক্যবাদ অক্ষত নয়। মুক্তিসংগ্রামে পুরুষকারের উদ্বোধনের সঙ্গে সঙ্গে বিধাতার কাছেও তিনি শক্তি ও সাহায্য ভিক্ষা করেছেন। এই দিক দিয়ে দেখলে নজরুলের বিদ্রোহ একটি উজ্জ্বল বৈশিষ্ট্যের আলোকে আলোকিত এবং একটি বিশেষ মূল্যে গৌরবান্বিত। এখনো পর্যন্ত ব^াংলা সাহিত্যে নজরুলের মতো কোন কবির কাব্য মুক্তি সংগ্রামের হাতিয়ার হ’য়ে ওঠে নি।

সব মহৎ কবির মধ্যেই বিদ্রোহ থাকে। পুরান ধ্যান ধারণার উচ্ছেদ বা পূর্বতন ঐতিহ্যের নতুন মূল্যায়নের ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠ কবিদেরই বিদ্রোহ প্রকাশ পায়। বাংলা কবিতার প্রথম পর্যায়ে অতীন্দ্রিয়, ধ্যাননিমগ্ন ও আস্তিক্যনির্ভর রবীন্দ্র-দার্শনিকতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন সমসাময়িক কবিগন। তারপর বিদ্রোহের ধ্বজা উড়িযে এলেন নজরুল। সমসাময়িক কবিগনের (মোহিতলাল, যতীন্দ্রনাথ) বিদ্রোহ যেখানে ভাবের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে আবদ্ধ ছিল নজরুল তাকে সামাজিক রাজনীতিক ও ধর্মনীতিক জীবনের বৈষম্য কন্টকিত বাস্তব ক্ষেত্রে এনে দাঁড় করালেন।

নজরুলের বিদ্রোহের উৎস তাঁর সুগভীর ও প্রতোয়োজ্জ্বল মানবপ্রেম। তাই মানুষের রাজনীতিক, সমাজনীতিক, ধর্মনীতিক প্রভৃৃতি সকল ক্ষেত্রেই বৈষম্য ও অসংগতি  তাঁকে প্রবলভাবে নাড়া দিয়েছে। তিনি এই বৈষম্য ও অসংগতির স্রষ্টাদের বিরুদ্ধে প্রচন্ড বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন। তাঁর অনমনীয় বিদ্রোহ কখনো স্বদেশের অধীনতার বিরুদ্ধে আবার কখনো তা  সমগ্র মানব জাতির নির্যাতন ও লাঞ্জনার বিরুদ্ধে মাথা  তুলে দাঁড়িয়েছে।

নজরুল শিশুসাহিত্যের বিষয়বস্তু অধিকতর বৈচিত্রময় ও বেগবান। শিশুদের উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা দান নজরুল শিশু সাহিত্যেই বিদ্যমান। নজরুল শিশুসাহিত্য জাগরণী গানে মুখরিত।

বাঙালি কবি হয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে সমানভাবে ধারণ করতে পারেননি কেউ নজরুলের মত করে। ঐতিহ্য সবার শিশুসাহিত্যেই প্রতিফলিত হয়েছে তবে জাতি গঠনে ধর্ম, সংস্কৃতি ও ইতিহাসÑঐতিহ্যের স্বাতন্ত্র্য যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও বড় ভূমিকা পালন করে, সে সম্পর্কে শিশুসাহিত্যকগণ যত সচেতন না ছিলেন নজরুল ছিলেন গভীরভাবে সচেতন। এ কারণেই নজরুল ভারতীয় জাতীয়তা এবং জাগরণের গান গেয়েছেন।

প্রচলিত সজ্ঞা অনুযাযী শিশুসাহিত্য হচ্ছে শিশুদের জন্য বিনোদন বা শিশুদের জন্য রচিত সাহিত্য। নজরুলের লেখাগুলো শিশুদের আনন্দদানের জন্যই রচিত। শোনার আনন্দ শুধু নয়, আবৃত্তি আর অভিনয়ের আনন্দের জন্যও তাঁর শিশুতোষ কবিতা উল্লেখের দাবি রাখে। তিনি বিদ্রোহী কবি’ খ্যাতি ছাড়াও বাংলা সাহিত্যের অন্যান্য শাখার পাশাপাশি শিশুসাহিত্যে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন একথা আজ ধ্রুবতারার মত সত্য। একদিকে সংগ্রাম করেছেন সাম্রাজ্যবাদী শাসকদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে, অন্যদিকে সংগ্রাম করেছেন নিদারুণ ব্যক্তিগত ও সাম্প্রদায়িকতা এবং দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে। এই দুই শক্তিক্ষয়ী অপশক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে তিনি যে সৃজন-কর্ম করেছেন, তা বিস্ময় উৎপাদন না করে পারে না।

কাজী নজরুল ইসলামের কাব্য বিভিন্ন সময়ে জাতীয় আত্মপরিচয়, জাতির আশা-আকাংখা, স্বপ্ন-কামনা, সংগ্রাম সাধনার ধারক বাহক হতে পেরেছে। তিনি বৃটিশ যুগেই জাতীয় কবির অভিধায় চিহ্নিত হয়েছেন। তাঁর কাব্যে রয়েছে ভারতীয় জাতীয়তার বলিষ্ঠ ও বিচিত্র প্রতিফলন, উপমহাদেশ তথা অবিভক্ত ভারতের সমগ্র জনমন্ডলীর আশা আকাংখা স্বপ্ন কল্পনা ও সংগ্রাম সাধনা তাতে বাক্সময়, ভারতের স্বাধীনতার সংগ্রামী প্রেরণায় তা উজ্জীবিত।

প্রথম মহাযুদ্ধের বিভীষিকা নজরুল যেভাবে প্রত্যক্ষ করেছিলেন আর কোন শিশুসাহিত্যিক সেভাবে করেননি। লক্ষ মানুষের খুন, স্বার্থের প্রচন্ড হানাহানি, পররাজ্য গ্রাসের প্রয়াস, অনাহার ক্লিষ্ট জনগনের উপর বড়লোকদের নিষ্পেষণ, মজুর ও প্রজাদের অর্থে জমিদারদের ভোগ-বিলাসের স্রোতÑনজরুলকে পাগল করে তুলেছিল।

নজরুল তাঁর শিশুতোষ রচনায় সর্বহারাদের জাগিয়ে তুলে চলার পথের যে সন্ধান দিলেন তাতে সর্বহারারা আজও অন্ধকারে আলোর সন্ধানে উন্মাদ হয়ে উঠেছে, তাদের প্রতিকারের দিন ঘনিয়ে এসেছে। নজরুল ইসলাম জাগরণের কবি তিনি চমক মেরে অর্ধচেতনদের জাগিয়ে দিয়েছেন। প্রগতিমূলক রচনায় দেশ-কাল নির্বিশেষে সব জাতির মানুষকে যেভাবে একই মালায় গ্রথিত করেছেন, তা-ও সমসাময়িক শিশুসাহিত্যে দৃষ্টিগোচর হয়না। এমনকি নারী শিক্ষার বিষয়টিও নয়।

নজরুল ইসলাম হতদরিদ্র মুসলিম সমাজে জন্মগ্রহন করেও দারিদ্রের কাছে মাথা নত করেননি, বরং দারিদ্র্য তাঁকে মহান করেছে। দারিদ্র্যের অগ্নিজ্বালাতেই কবি হয়েছেন বিদ্রোহী।

শিশুসাহিত্যের ধারায় নজরুল ইসলাম সবচাইতে বাস্তববাদী। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ কল্পনার পাখায় ভর দিয়ে এত দূর চলে গিয়েছেন যে তার নাগাল সাধারণ মানুষ পায় না, কিন্তু নজরুল ইসলাম জাগরণের কবি হিসেবে মাটির ধরার কাছাকাছি থেকেছেন, যখন তিনি মহাকাশে পাখা মেলেছেন তখন তা বিজ্ঞান মনস্কতাভিত্তিক।

রবীন্দ্রোত্তরকালে এসে শিশুর উপলব্ধি ক্রমে সামাজিক বাস্তবতার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হয়েছে, এর সঙ্গেএকটি বৈশ্বিক পরিমন্ডল অনেক বেশী উন্মোচিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের ’বীরপুরুষে’র শিশু ডাকাতদলের সাথে মোকাবিলা করেছে কিন্তু নজরুলের শিশু পৃথিবীকে হাতের মুঠোয় জয় করে বা অধিকার করে নিতে চেয়েছে। নজরুলের শিশুর ক্ষেত্র সমসসাময়িক শিশু সাহিত্যিকদের তুলনায় বিস্তৃত।

বিশ শতকের শিশুসাহিত্যে একটি সীমাবদ্ধতা প্রাসঙ্গিকভাবে স্মর্তব্য, বাংলা সাহিত্যের সীমাবদ্ধতার এটি অনিবার্য অংশ। বিশ শতকের এ শিশুসাহিত্য নাগরিক শিশুর জীবন নির্ভর তাদের জীবনকথা, স্বপ্ন, আকাংখা, কল্পনা, ভালবাসা এবং অন্যান্য বিকাশের প্রতিশ্রুতি নিয়ে এগুলো সৃৃষ্টি ও বিকাশপ্রাপ্ত। নাগরিক জীবনের বাইরে এর ভূবন সীমিত, হয়তো নেইও। গ্রামীন শিশুর দারিদ্র্য অশিক্ষা নিরক্ষরতা ইত্যাদি এ শিশুসাহিত্যের ভুবনে প্রবেশাধিকার সৃৃৃষ্টি করতে পারেনি। রবীন্দ্রনাথ, সুকুমার প্রমুখের শিশুসাহিত্যে অভিজাত ও সংস্কৃতিসম্পন্ন শিশুর কথাই ঘুরেফিরে এসেছে, গ্রাম্যশিশুর দুরন্তপনা ছড়িয়ে আছে  নজরুল শিশুসাহিত্যে।

মানুষের মুক্তি প্রচেষ্টায় শাসক শোষকের অত্যাচার বর্ণনায়, সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখের চিত্রাঙ্কনে, জাতীয়তাবোধের উন্মেষ সাধনে, সামাজিক ও রাজনৈতিক মুক্তি প্রচেষ্টায় নজরুল বাংলা সাহিত্যকে গানে ছন্দে কাব্যে ভরে তুলেছেন।

সমসাময়িক সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প কবিকে কখনও স্পর্শ করেনি, কবি সব সময়ই গেয়েছেন মানবতার গান। সাম্যের যে গান কবি গেয়েছেন সে গান বাঙালী তথা মানুষের প্রাণকে মানবতার এক মহান স্তরে পৌঁছিয়েছে।

স্বদেশপ্রেমিক কবি শুধু দেশের নিসর্গ বন্দনার মধ্যেই তার আবেগ ও স্বপ্ন কল্পনাকে সীমাবদ্ধ রাখেন না, তিনি দেশ মাটি আবহাওয়ার পটভূমিতে, দেশবাসীর আশা-আকাংখা ও কামনা বাসনাকে রূপায়িত করেন। আর এ সূত্রেই তার দেশপ্রেম আপন চেতনার রঙেরঞ্জিত হয়।

অবিভক্ত ব্রিটিশ ভারতের প্রেক্ষিতে নজরুল রচিত জাগরণমূলক ও মানবতাবাদী চিন্তাপ্রসূত রচনার আবেদন চিরন্তন ও অমোঘ। এ কারণেই রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয়, ভাষাভিত্তিক ইত্যাদি যে কোন প্রেক্ষাপটেই নজরুল বাঙালীর জাতীয় কবি। বাংলার মাটি, মানুষ ও প্রকৃতি এবং সমাজের সঙ্গে নজরুলের ব্যাপক ও গভীর সম্পর্ক আর এ দেশের শ্যামল মাটিতে তার শেষ শয্যা গ্রহনেরও অম্লান স্মৃতির দিক থেকে আরও যথার্থ ও তাৎপর্যবাহী হয়ে উঠেছে।

 

পরিশিষ্ট-১

 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাপঞ্জী

৩৭। রবীন্দ্র-রচনাবলী, অচলিত সংগ্রহ, প্রথম খন্ড ১৩৪৭।

৯-১০        রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ‘শিশু’ কাব্যগ্রন্থ। ১৩১০ সালে প্রকাশিত। মোহিতচন্দ্র সেন সম্পাদিত।

 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ‘শিশু ভোলানাথ’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। প্রকাশকাল ঃ কার্তিক ১৩৪৯। প্রকাশক ঃ রঞ্জিৎ রায় বিশ্বভারতী। ১০, প্রিটোরিয়া ষ্ট্রীট। কলিকাতা- ১৬।’খাপছাডা’ রবীন্দ্র-রচনাবলীর একবিংশ খন্ডে প্রকাশিত। প্রকাশ: ২২ শ্রাবণ ১৩৫৩। প্রকাশক রণজিত রায়। বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ। ৬ আচার্য় জগদীশ বসু রোড়। কলিকাতা ১৭।

 

’নবজাতক’১৩৪৭ সালের বৈশাখ মাসে প্রথম প্রকাশিত হয়।

’ছেলেবেলা’ (১৯৪০) লিখেছেন।বইটিকে জীবনস্মৃতির পরিপূরক বলা

 

’ছড়ার ছবি’১৩৪৪

 

’সে’ (১৯৩৭)

 

’কল্পনা’ (১৯০০)

 

‘কথা ও কাহিনী’ (১৯০৮) কথা ও কাহিনী-সম্পাদক মোহিতচন্দ্র সেন, বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ, ১৯০৮।

১৬। ’খাপছাড়া’ রবীন্দ্র-রচনাবলী, একবিংশ খন্ড কলিকাতা, বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ।

১৮। জীবনস্মৃতি, ছেলেবেলা-১৯৪০, রবীন্দ্র রচনাবলী-২৬,

 

৭ অক্টোবর ১৯২৪.পশ্চিম-যাত্রীর ডায়ারি: রবীন্দ্র রচনাবলী, দশম খন্ড: জন্মশতবার্ষিক সংস্করণ :

৫। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি, কলিকাতা, বিশ্বভারতী, আশ্বিন ১৩৬৭,

৬। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ’একটা আষাঢ়ে গল্প’, গল্পগুচ্ছ, ১ম খন্ড, কলিকাতা, বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ, ১৯৭৭,

৮। রবীন্দ্র রচনাবলী ষষ্ঠ খন্ড, লোকসাহিত্য

 

 

উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীর রচনাপঞ্জী

১৪। উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী, উপেন্দ্রকিশোর সমগ্র রচনাবলী-১, ২, ৩, প্রকাশিকা গীতা দত্ত, এশিয়া পাবলিশিং

কোম্পানী, ১৯৭৩।

১৫। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, উপেন্দ্রকিশোর সমগ্র রচনাবলী ১,২,৩, সম্পাদনা লীলা মজুমদার, কলিকাতা, এশিয়া

পাবলিশিং কোম্পানি, ১৯৮০, ১৯৮৪, ১৯৮৬।

১৬। উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র-১, ২। প্রকাশক, শ্যামাপদ সরকার কামিনী প্রকাশনালয়, ১৩৯৪।

 

মহাভারতের কথা উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র, প্রথম খন্ডের অšতর্ভূক্ত। প্রথম প্রকাশঃ রথযাত্রা ১৩৯৪। প্রকাশকঃ শ্যামাপদ সরকার, কামিনী প্রকাশনালয়। ৫, নবীনচন্দ্র পাল লেন, কলিকাতা-৯।

পুরাণের গল্প ঃ                ঐ

ছেলেদের রামায়ণ ঃ          ঐ

ছেলেদের মহাভারত   ঃ       ঐ

কবিতা ও গান ঃ            ঐ

টুনটুনির বই                ঃ উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র দ্বিতীয় খন্ডের অšতর্ভুক্ত। প্রথম প্রকাশঃ রথযাত্রা ১৩৯৪। প্রকাশক ঃ শ্যামাপদ সরকার, কামিনী প্রকাশনালয়, ৫ নবীনচন্দ্র পাল লেন, কলিকাতা-৯।

গল্পমালা                            ঐ

সেকালের কথা ঃ          ঐ

বিবিধ প্রবন্ধ ঃ             ঐ

ছোট্ট রামায়ণ             ঃ            ঐ

 

 

অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুুরের রচনাপঞ্জী

 

 

 

২। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অবনীন্দ্র রচনাবলী, ১-২-৩, কলিকাতা, প্রকাশভবন, ১৯৭৩, ১৯৭৪।

 

শকুšতলা ঃ              অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রথম প্রকাশ, ১৯৮৬, প্রকাশক, দ্বিজেন্দ্রনাথ বসু, আনন্দ প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশনস প্রাইভেট লিমিটেডের পক্ষে ৪৫ বেনিয়াটোলা লেন, কলকাতা ৭০০ ০০৯            ।

ক্ষীরের পুতুল ঃ         ঐ

বুড়ো আংলা ঃ          ঐ

নালক ঃ                   ঐ

খাতাঞ্জির খাতা

’ভূতপত্রীর দেশ’ ইন্ডিয়ান পাবলিশিং হাউস ১৯১৫ সাে

 

অবনীন্দ্র রচনাবলী দ্বিতীয় খন্ড, প্রকাশ ভবন, ১৫ বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিট, ১৯৭৪।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাপঞ্জী

 

 

৪২। সত্যেন্দ্র কাব্যগুচ্ছ, সম্পাদনা অলোক রায়, কলিকাতা, সাহিত্য সংসদ, ১৯৮৪।

৪৪। সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত প্রণীত, সত্যেন্দ্রনাথের শিশু কবিতা, এম, সি, সরকার এ্যান্ড সন্স লিঃ, ১৪ কলেজ স্কোয়ার,                         কলিকাতা।

৪৫। সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, কাব্য-সঞ্চয়ন, দে বুক স্টোর, ১৩ বঙ্কিম চ্যাটার্জী স্ট্রীট, কলিকাতা-৭৩, ২৬শে সেপ্টেম্বর ১৯৩০।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের রচনাপঞ্জী

 

 

২০। দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার, দক্ষিণারঞ্জন রচনাসমগ্র, ১, ২, দক্ষিণারঞ্জন শতবার্ষিকী গ্রন্থাবলী, মিত্র ও ঘোষ

পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ, কলিকাতা ১৩৮৮।

 

১.দক্ষিণারঞ্জন রচনাসমগ্র প্রথম খন্ড, প্রথম প্রকাশ  জন্মাষ্টমী ১৩৮৮। প্রকাশক-মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ ১০, শ্যামাচরণ দে ষ্ট্রীট, কলিকাতা-৭৩।

 

২.দক্ষিণারঞ্জন রচনাসমগ্র দ্বিতীয় খন্ড, প্রথম প্রকাশ, বৈশাখ ১৩৮৮। প্রকাশক- ঐ

 

’দাদামশায়ের থলে’। বইটি প্রকাশিত হয় ১৯২৪

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

সুকুমার রায়ের রচনাপঞ্জী

 

 

৪৭। সুকুমার সাহিত্যসমগ্র-সম্পাদক, সত্যজিৎ রায় ও পার্থ বসু, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিঃ, কলিকাতা-৯।

৪৮। সুকুমার পরিক্রমা, শতবার্ষিক শ্রদ্ধার্ঘ্য, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার,                                                                          কলকাতা, ২০মে ১৯৮৯।

 

সুকুমার রায়, ‘খাই খাই’ কাব্যগ্রন্থ, প্রকাশকাল ঃ ২১শে সেপ্টেম্বর, ১৯৫০। প্রকাশক সিগনেট প্রেস, ১০/২ এলিগেন রোড, কলকাতা।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

সুনির্মল বসুর রচনাপঞ্জী

 

৫২। সুনির্মল বসু, সুনির্মল রচনাসম্ভার, ১, ২, ৩, ৪, ফরোয়ার্ড পাবলিশিং কনসার্ন, কলিকাতা-১২। ১৩৮০, ১৩৮২।

 

। ছন্দের টুংটাং (১৯৩০বাং ১৩৩৬ ফাল্গুন) প্রকাশক বাগচী এন্ড সন্স, ২০/২ কর্নওয়ালিশ স্ট্রীট, কলকাতা।

 

সুনির্মল রচনা সম্ভার প্রথম খন্ড, এম, টি. ৭৩ কলেজ স্ট্রীট মার্কেট, কলিকাতা-৭০০০১২।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

কাজী নজরুল ইসলামের রচনাপঞ্জী

 

৪।

আব্দুল আজিজ আল মামুন           ঃ            সংগ্রহ ও সম্পাদনা; অপ্রকাশিত নজরুল। প্রথম প্রকাশ- শুক্রবার, ১লা অগ্রহায়ণ, ১৯৩৬, ১৭ নভেম্বর, ১৯৮৯। হরফ প্রকাশনী, এ-১২৬ কলেজ স্ট্রীট মার্কেট, কলিকাতা- ৭০০০০৭।

২.             ঐ             ঃ            নজরুল গীতি (অখ-) প্রকাশকাল- ৬ আশ্বিন ১৩৮৫, ২৩শে সেপ্টেম্বর, ১৯৭৮। প্রকাশক- আব্দুল আজিজ আল মামুন এম, এ,। প্রকশনা- হরফ প্রকাশনী, কলিকাতা।

অপ্রকাশিত নজরুল। শুক্রবার, ১লা অগ্রহায়ণ, ১৯৩৬। ১৭ নভেম্বর, ১৯৮৯। হরফ প্রকাশনী, এ-১২৬ কলেজ স্ট্রীট   মার্কেট, কলিকাতা- ৭০০০০৭।

৫। ঐ, নজরুল গীতি, অখ-  আব্দুল আজিজ আল আমান এম, এ, হরফ প্রকাশনী, কলিকাতা, ১৯৭৮। ‘ছায়ানট’ কাব্যগ্রন্থ । প্রথম প্রকাশ ‘বিজলী’ পত্রিকা। ১৩৩২ শ্রাবণে ৫ম বর্ষের ৩৩শ সংখ্যক সংখ্যাতে।

২. আব্দুল কাদির সম্পাদিত নজরুল রচনাবলীর তৃতীয় খ-ে প্রকাশিত ‘গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত কবিতা ও গান’- এর অন্তর্ভুক্ত। প্রথম প্রকাশ ১৩৮১ সালের বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ সংখ্যক ‘সওগাত’ পত্রিকায়।

৬. নজরুল ইসলাম প্রণীত ‘মক্তব সাহিত্য’ গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। প্রকাশকাল ৩১শে জুলাই ১৯৩৫। প্রকাশক খোন্দকার আব্দুল

জব্বার। ২৫-এ পঞ্চানন টোলা লেন, কলিকাতা।

 

‘ঝিঙে ফুল’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। ১৩৩৩ সালে প্রকাশিত। প্রকাশক ডি, এম, লাইব্রেরী। ৬১, কর্ণ ওয়ালিশ স্ট্রীট, কলিকাতা।

‘নতুন চাঁদ’ গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। প্রথম প্রকাশ ১৯৪০ খৃঃ ৭ই আগষ্ট। ‘মুকুলের মহফিল’ শিরোনামে ছাপা হয়েছিল।

‘পুতুলের বিয়ে’ নাট্যগ্রন্থ , প্রকাশকাল- ১৩৪০ সাল, প্রকাশক- ডি, এম, লাইব্রেরী, ৬১ কর্ণওয়ালিশ স্ট্রীট, কলিকাতা।

৫,‘গীতি শতদল’ কাব্যগ্রন্থ অন্তর্ভুক্ত। ১৩৪১ সালের বৈশাখ মাসে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত। প্রকাশক- ডি, এম, লাইব্রেরী, ৬১ কর্ণওয়ালিশ স্ট্রীট, কলিকাতা।

‘জুলফিকার’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। এর প্রথম সংস্করণের প্রকাশকাল ১৩৩৯-এর ভাদ্র মাসে। প্রকাশক- বি, দোজা, এম্পায়ার বুক হাউস, ১৫, কলেজ স্কোয়ার, কলিকাতা।

‘গানের মালা’ গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। এর প্রথম সংস্করণ ১৩৪১ সালের আশ্বিন মাসে প্রকাশিত হয়। প্রকাশকাল- গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় এ্যান্ড সন্স, ২০৩/১/১ কর্ণওয়ালিশ স্ট্রীট, কলিকাতা।

 

 

জাগো সুন্দর চির কিশোর              ঃ            ১৯৯১ সালে নজরুল ইন্সটিটিউট থেকে স্বতন্ত্র গ্রন্থাকারে প্রকাশিত।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

গ্রন্থপঞ্জী ঃ

১। আবদুল কাদির সম্পাদিত নজরুল রচনাবলী, ৩য় খন্ড, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১ম সস্করণ, ২৫মে, ১৯৭৭।

২। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অবনীন্দ্র রচনাবলী, ১-২-৩, কলিকাতা, প্রকাশভবন, ১৯৭৩, ১৯৭৪।

৩। আবু হেনা আবদুল আউয়াল, নজরুলের রাষ্ট্রচিন্তা ও রাজনীতি, নজরুল ইন্সটিটিউট, ১৯৯৯।

৪। অপ্রকাশিত নজরুল। শুক্রবার, ১লা অগ্রহায়ণ, ১৯৩৬। ১৭ নভেম্বর, ১৯৮৯। হরফ প্রকাশনী, এ-১২৬ কলেজ স্ট্রীট              মার্কেট, কলিকাতা- ৭০০০০৭।

৫। ঐ, নজরুল গীতি, অখ-  আব্দুল আজিজ আল আমান এম, এ, হরফ প্রকাশনী, কলিকাতা, ১৯৭৮।

৬।           আতাউর রহমান, নজরুলঃ ঔপনিবেশিক সমাজে সংগ্রামী কবি, প্রকাশকাল ভাদ্র-১৪০০। নজরুল ইন্সটিটিউট, ঢাকা, ১৯৯৩।

৭।            আতাউর রহমান, নজরুল কাব্য সমীক্ষা, প্রথম সংস্করণ ১৯৬৮। শুভ্রা প্রকাশনী, ঢাকা, বাংলাদেশ, ১৯৬৮।

৮।  আতোয়ার রহমান, নজরুল বর্ণালী, নজরুল ইন্সটিটিউট, ঢাকা, ১৯৯৪।

৯।  আতোয়ার রহমান, শিশু সাহিত্যে মুসলিম সাধনা, সংকলন ফোকলোর বিভাগ, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৯৪।

১০। আতোয়ার রহমান, বাংলাদেশের শিশুপত্রিকা, প্রকাশক-ফজলে রাব্বি, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৭৭।

১১। আ, ফ, ম আবু বকর সিদ্দিক, ড.,বাংলার মুসলিম চেতনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, প্রমিনেন্ট পাবলিকেশন, ঢাকা, ২০০৩।

১২। আবদুল মান্নান সৈয়দ, নজরুল ইসলাম/কবি ও কবিতা, তালিম হোসেন, নজরুল একাডেমী, ঢাকা- ২, ১৯৭৭।

১৩। আশা গঙ্গোপাধ্যায়, বাংলা শিশু সাহিত্যের ক্রমবিকাশ। (১৮০০-১৯০০), রূপবানী প্রেস- ৩১, বাদুড়বাগান স্ট্রীট,

কলিকাতা- ৯।

১৪। উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী, উপেন্দ্রকিশোর সমগ্র রচনাবলী-১, ২, ৩, প্রকাশিকা গীতা দত্ত, এশিয়া পাবলিশিং

কোম্পানী, ১৯৭৩।

১৫। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, উপেন্দ্রকিশোর সমগ্র রচনাবলী ১, ২, ৩, সম্পাদনা লীলা মজুমদার, কলিকাতা, এশিয়া

পাবলিশিং কোম্পানি, ১৯৮০, ১৯৮৪, ১৯৮৬।

১৬। উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র-১, ২। প্রকাশক, শ্যামাপদ সরকার কামিনী প্রকাশনালয়, ১৩৯৪।

১৭। করুণাময় গোস্বামী, সম্পাদনা; নজরুলের শিশুতোষ কবিতা, নজরুল ইন্সটিটিউট, ঢাকা, ১৯৯৫।

১৮। কালীপদ দাস, ছোটদের নজরুল, সাহিত্যমালা, ৩৪/২ নর্থব্রক হল রোড, বাংলাবাজার, ঢাকা, ১৯৯১।

১৯। খগেন্দ্রনাথ মিত্র, শতাব্দীর শিশু সাহিত্য, বিদ্যালয় প্রাইভেট লিমিটেড, কলিকাতা, ১৯৫৮।

২০। দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার, দক্ষিণারঞ্জন রচনাসমগ্র, ১, ২, দক্ষিণারঞ্জন শতবার্ষিকী গ্রন্থাবলী, মিত্র ও ঘোষ

পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ, কলিকাতা ১৩৮৮।

২১। নবেন্দু সেন, বাংলা শিশু সাহিত্য, তথ্য তত্ত্ব রূপ ও বিশ্লেষণ, পুঁথিপত্র (ক্যালকাটা) প্রাইভেট লিঃ, ৯ এ্যান্টনি বাগান

লেন কলিকাতা ৭০০ ০৭৩, আগষ্ট ১৯২২।

২২। বদিউজ্জামান, বাংলা সাহিত্যে শিশু, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, ৫ পুরাতন সেক্রেটারিয়েট রোড, নিমতলা,

রমনা, ঢাকা-১০০০০, মার্চ, ২০০২।

২৩। মাহবুবুল আলম, বাংলা ছন্দের রূপরেখা, পঞ্চম সংস্করণ, খান ব্রাদার্স এ- কোম্পানী, ৬৭ প্যারিদাস রোড, ঢাকা,

১৯৮০।

২৪। মানবেন্দ্র বন্দোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঃ শিশু সাহিত্য, ৩৮ বিধান সরণী, কলকাতা-৬। ২৫ বৈশাখ, ১৩৭৭

২৫। মোবাশ্বের আলী, নজরুল প্রতিভা, ১ম সংস্করণ, চিত্তরঞ্জন সাহা, মুক্তধারা, স্বঃ পুঁথিঘর লিঃ, ৭৪, ফরাশগঞ্জ, ঢাকা-

১১০০, ১৩৭৬।

২৬। মোবাশ্বের আলী, নজরুল ও সাময়িক পত্র, প্রকাশক আবুল কালাম আজাদ, নজরুল ইন্সটিটিউট, ঢাকা-১৯৯৪।

মুহম্মদ আবদুল হাই ও সৈয়দ আলী আহ্সান, বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জুন, ১৯৫৬।

২৭। মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, নজরুল সমীক্ষণ, আনন্দ প্রকাশন, ১১ শ্রীশদাস লেন, বাংলা বাজার, ঢাকা, ১৩৭৯।

২৮। মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন, ‘সওগাত’ যুগে নজরুল ইসলাম, মোহাম্মদ মাহ্ফুজউল্লাহ্, নজরুল ইন্সটিটিউট,

ঢাকা, ১৯৮৮।

২৯। মোহাম্মদ মাহ্ফুজউলাহ, নজরুল ইসলাম ও আধুনিক বাংলা কবিতা, সাহিত্য মঞ্জিল, ৪১, আগামসিহ্ লেন, ঢাকা-

২, প্রথম প্রকাশ, ১৯৬৩।

৩০। মোহাম্মদ মাহ্ফুজউল্লাহ্, সংকলন ও সম্পাদনা, নজরুল ইন্সটিটিউট, ঢাকা, প্রকাশকাল ১৩৯৭।

৩১। মুহাম্মদ আবদুলাহ, ড.,বাঙলায় খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলন, পরিচালক গবেষণা সংকলন ও ফোকলোর বিভাগ

বাংলা একাডেমি, ঢাকা -১০০০, ১৯৯৬।

৩২। মুজফ্ফ্র আহমদ, কাজী নজরুল ইসলামঃ স্মৃতিকথা, মুক্তধারা, ৭৪ ফরাশগঞ্জ, ঢাকা-১১০০, ১ম প্রকাশ, ১৯৭৩।

৩৩। রফিকুল ইসলাম, কাজী নজরুল ইসলাম, জীবন ও কবিতা, মল্লিক ব্রাদার্স, ৩/১ বাংলা বাজার, ঢাকা-১, ১লা

বৈশাখ, ১৩৮৯।

৩৪। রবীন্দ্র-রচনাবলী

৩৫। রাজিয়া সুলতানা. ড., নজরুল অণ্বেষা, গতিধারা, ৩৮/২-ক, বাংলাবাজার, ঢাকা-১১০০। ১৯৬৯।

৩৬। হায়াৎ মাহমুদ, নজরুল ইসলাম কিশোর জীবন, প্রতীক প্রকাশনা সংস্থা; ৪৬/২ হেমেন্দ্র দাস রোড, সূত্রাপুর, ঢাকা-

১১০০, ১৯৮৯।

৩৭। রবীন্দ্র-রচনাবলী, অচলিত সংগ্রহ, প্রথম খন্ড ১৩৪৭।

৩৮। রবিরশ্মি-চারুচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়, কলেজ স্ট্রীট পাবলিকেশন প্রাইভেট লিমিটেড, ১৩ বঙ্কিম চ্যাটার্জি ষ্ট্রীট কলকাতা-                                              ৭৩

৩৯। শাহাবুদ্দীন আহমদ, ছোটদের নজরুল, মুক্তধারা (স্ব পুঁথিঘর লিঃ) ৭৪, ফরাশগঞ্জ, ঢাকা- ১১০০, ১৯৭৭।

৪০। শ্রীশশিভূষণ দাশগুপ্ত, বাঙলা সাহিত্যের নবযুগ

৪১। ওয়াকিল আহমদ (সম্পাদক) কাজী নজরুল ইসলাম (জন্মশতবর্ষ), এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ। ঢাকা-১০০০।

৪২। সত্যেন্দ্র কাব্যগুচ্ছ, সম্পাদনা অলোক রায়, কলিকাতা, সাহিত্য সংসদ, ১৯৮৪।

৪৩। সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত প্রণীত, সত্যেন্দ্রনাথের শিশু কবিতা, এম, সি, সরকার এ্যান্ড সন্স লিঃ, ১৪ কলেজ স্কোয়ার, কলিকাতা।

৪৪। সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, কাব্য-সঞ্চয়ন, দে বুক স্টোর, ১৩ বঙ্কিম চ্যাটার্জী স্ট্রীট, কলিকাতা-৭৩, ২৬শে সেপ্টেম্বর ১৯৩০।

৪৫। সিরাজুল হোসেন খান, উপমহাদেশের-রাজনৈতিক ইতিবৃত্ত, ঝিনুক প্রকাশ, ৩৮/৪ বাংলাবাজার, ঢাকা-১১০০, প্রথম                           প্রকাশ- ২০০২

৪৬। সেলিম জাহাঙ্গীর, লোকায়ত নজরুল, গবেষণা ও প্রকাশনা বিভাগ, ১৯৯৭।

৪৭। সুকুমার সাহিত্যসমগ্র-সম্পাদক, সত্যজিৎ রায় ও পার্থ বসু, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিঃ, কলিকাতা-৯।

৪৮। সুকুমার পরিক্রমা, শতবার্ষিক শ্রদ্ধার্ঘ্য, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার,                                                                          কলকাতা, ২০মে ১৯৮৯।

৪৯। সুকুমার সেন, বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস, ৪র্থ খন্ড, রবীন্দ্রনাথ, কলিকাতা, আনন্দ পাবলিশাার্স প্রাইভেট লিমিটেড,              ১৩৫৩।

৫০। সুমিতা দাস, রূপকথার আঙ্গিক, রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গান, কলিকাতা লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণা কেন্দ্র             ১৮/ এম, টামার লেন, কলকাতা ৭০০ ০০৯, ১৪০৭ বঙ্গাব্দ।

৫১। সুশীলকুমার গুপ্ত ডঃ, নজরুলÑচরিতমানস, ৩০শে মে, ১৯৬০ সাল, কলকাতা।

৫২। সুনির্মল বসু, সুনির্মল রচনাসম্ভার, ১, ২, ৩, ৪, ফরোয়ার্ড পাবলিশিং কনসার্ন, কলিকাতা-১২। ১৩৮০, ১৩৮২।

৫৩। সৈয়দা মোতাহেরা বানু, নজরুলের শিশু সাহিত্য, নজরুল ইন্সটিটিউট, ঢাকা, ডিসেম্বর ২০০০।


এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান >

বাংলা বিভাগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ঢাকা

এম. ফিল. ডিগ্রীর জন্যে লেখা গবেষণা অভিসন্দর্ভ

নজরুলের শিশুসাহিত্য :           (এম. ফিল গবেষণা অভিসন্দর্ভ)

সৈয়দা মোতাহেরা বানু

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নথিভুক্ত নম্বর :

:

RB

৮৯১.৪৪

BAN

১৯৯৬

প্রকাশক : নজরুল ইন্সটিটিউট। বাড়ী-৩৩০বি, রোড-২৮ (পুরাতন) ধানমন্ডি, ঢাকা-১২০৯।

প্রথম মুদ্রণ : অগ্রহায়ণ ১৪০৭ / ডিসেম্বর ২০০০।

দ্বিতীয় মুদ্রণ : আষাঢ়  ১৪০৮ / জুলাই ২০০১।

অভিসন্দর্ভটি  নজরুল ইন্সটিটিউট। বাড়ী-৩৩০বি, রোড-২৮ (পুরাতন) ধানমন্ডি, ঢাকা-১২০৯ হতে নি¤œলিখিত  শিরোনামে প্রকাশিত

নজরুলের শিশুসাহিত্য

সৈয়দা মোতাহেরা বানু

ভূমিকা

বিশ শতকের পূর্বে বাংলা শিশুসাহিত্য প্রথমত: বিদ্যালয়ের পাঠ্য, দ্বিতীয়ত:   অনুবাদ, তৃতীয়ত: নীতিশিক্ষামূলক ছিল। শিশুসাহিত্যের স্বাধীনভাবে স্ফূরণ ঘটে ঠাকুর বাড়ীর জ্ঞানদানন্দিনী দেবী সম্পাদিত ‘বালক’ (১৮৮৫) পত্রিকার মাধ্যমে। দিকপাল লেখকেরা শিশুদের জন্য লিখতে শুরু করেন। শিশুসাহিত্যের বিকাশ ঘটতে থাকে।

তারপর ভূবন মোহন রায়ের পত্রিকা ‘সাথী’ ও ‘সখা এবং আচার্য শিবনাথ শাস্ত্রীর পত্রিকা ‘মুকুল’ (১৮৯৫) প্রকাশিত হয়। এইসব পত্রিকার মাধ্যমে যে সব লেখকের উদ্ভব হয় তাদেরকে বিশ শতকের বাংলা শিশুসাহিত্যের পথিকৃত হিসাবে বিবেচনা করা যায়। এদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, যোগীন্দ্রনাথ সরকার, নবকৃষ্ণ ভট্টাচার্য, গিরিন্দ্রমোহন দাসী, দ্বিজেন্দ্রনাথ বসু, জগদানন্দ রায়, হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ, দীনেন্দ্রকুমার রায় ও জলধর সেন প্রমুখ সাহিত্যিক শিশুসাহিত্যের ক্ষেত্রে অবদান রাখেন। এই পর্বে পাঠ্যপুস্তকের প্রত্যক্ষ শাসন হতে শিশুসাহিত্য মুক্তি লাভ করে। নবীন লেখকেরা বুঝেছিলেন, যে ছোটদের সর্বাঙ্গীন মানসিক উৎকর্ষ সাধন করতে হলে আনন্দকে প্রথম সারিতে রেখে নীতিকে নেপথ্যে রাখতে হবে। যোগীন্দ্রনাথের ‘হাসি ও খেলা’ অবনীন্দ্রনাথের ‘শকুন্তলা’ ও ‘ক্ষীরের পুতুল’ এ দিক থেকে অনন্য কৃতিত্বের নিদর্শন।

বিশ শতকের সূচনালগ্নের উল্লেখযোগ্য শিশুসাহিত্যিক অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি বিদ্যালয়গ্রাহ্য বিদ্যায় অনুরাগী ছিলেন না। ছেলেবেলায় ঘরে শোনা গল্পে ও ছড়ায় তাঁর মন অভিষিক্ত ছিল। তাঁর ছিল মৌলিক শিল্পপ্রতিভা। যার সঙ্গে যোগ হয়েছিল সাহিত্যপ্রতিভা। পুরোনো রূপকথা কাহিনীকে নতুন রঙ্গে রঞ্জিত করে অবনীন্দ্রনাথ সাহিত্যের আসরে প্রথম দেখা দেন ‘শকুন্তলা’ (১৮৯৫) নিয়ে। মহাকবি কালিদাসের ‘শকুন্তলা’ নাটককে লেখক আখ্যানবস্তুরূপে নির্বাচন করে এটিকে রূপকথায় পরিণত করেন। তাঁর মহর্ষি কন্বের আশ্রমের বর্ণনা নি¤œরূপ,

বনে বনে হোমের কাঠ কুড়িয়ে বেড়াত, কালো গাই ধ’লো গাই মাঠে চরাতে যেত, সবুজ মাঠ ছিল তাতে গাই বাছুর চড়ে বেড়াতে, বনে ছায়া ছিল, ময়ূর গড়বার মাটি ছিল, বেণু বাঁশের বাঁশি ছিল, বটপাতার ভেলা ছিল, আর ছিল খেলবার পাখি, বনের হরিণ, গাছের ময়ূর আর মা গৌতমীর মুখে দেব দানবের যুদ্ধকথা, তাত কন্বের মুখের মধুর সামবেদ গান।

সকলি ছিল, ছিল না কেবল-আঁধার ঘরের মানিক ছোট মেয়ে শকুন্তলা। একদিন নিশুতি রাতে অপ্সরী মেনকা তার রূপের ডালি দুধের বাছা শকুন্তলা মেয়েকে সেই তপোবনে ফেলে রেখে গেলে বনের পাখিরা তাকে ডানায় ঢেকে বুকে করে রেখে দিলে।১

অবনীন্দ্রনাথের দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘ক্ষীরের পুতুল’-এ তার শক্তি আরো উজ্জ্বল। গল্পটিতে ‘Puss-in-Boots’ এর ক্ষীণছায়া আছে। রূপকথার পদ্ধতিতে গল্পটি বিন্যস্ত। এর ঢংটিও মা দিদিমার মুখে ব্রত কথা বলবার মত। এর সাথে ছেলে ভুলানো ছড়ার চিত্রগুলি যথেচ্ছ ব্যবহার করেছেন,

ঝুরঝুরে বালির মাঝে চিক্চিকে জল, তারি ধারে একপাল ছেলে দোলায় চেপে ছপন কড়ি গুনতে গুনতে মাঝ ধরতে এসেছে; কারে পায়ে মাছের কাঁটা ফুটেছে, কারো চাঁদমুখে রোদ পড়েছে। জেলেদের ছেলে জালমুড়ি দিয়ে ঘুম দিচ্ছে, এমন সময় টাপুর টুপুর বৃষ্টি এল, নদীতে বাণ এল; অমনি সেই ছেলের পাল, সেই কাঠের দোলা, সেই ছপন কড়ি ফেলে কোন্ পাড়ার কোন্ ঘরের কোণে ফিরে গেল। পথের মাঝে তাদের মাছগুলো চিলে কেড়ে নিলে কুনোব্যাঙে ছিপগুলো টেনে নিলে, খোকাবাবুরা ক্ষিপ্ত হয়ে ঘরে এলেন, মা তপ্ত দুধ জুড়িয়ে খেতে দিলেন, আর সেই চিক্ চিকে জলের ধারে ঝুরঝুরে বালির চরে শিব ঠাকুর এসে নৌকা বাঁধলেন তার সংগে তিন কন্যে এক কন্যে রাঁধলেন বাড়লেন, এক কন্যে খেলেন আর এক কন্যে না খেয়ে বাপের বাড়ী গেলেন। বামন তাঁর সংগে বাপের বাড়ীর দেশে গেল। সেখানে জলের ঘাটে মেয়েগুলি নাইতে এসেছে, কালো কালো চুলগুলি ঝাড়তে লেগেছে, তার একটি গুরুঠাকুর নিলেন, আর একটি নায়ে ভরা দিয়ে টিয়ে আসছিল সে নিলে। তাই দেখে ভোঁদর টিয়েকে এক হাতে নিয়ে আর মাছকে এক হাতে নিয়ে নাচতে আরম্ভ করলে, ঘরের দুয়ারে খোকার মা খোকা বাবুকে নাচিয়ে নাচিয়ে বললেন-ওরে ভোঁদর ফিরে চা, খোকার নাচন দেখে যা।২

অবনীন্দ্রনাথের ‘ক্ষীরের পুতুল’ দক্ষিণারঞ্জন মিত্রের কল্পনার সোনার কাঠি রূপোর কাঠির স্পর্শ বুলিয়ে তাঁকে উদ্বুদ্ধ করেছিল এবং তিনি এর অনুসরণে ‘ঠাকুরমার ঝুলি’ প্রকাশ করেছিলেন।

অবনীন্দনাথের অন্যান্য রচনা ‘নালক’, ‘খাতাঞ্চির খাতা’, ‘বুড়ো আংলা’, ‘ভূত-পতরীর দেশ’ (১৯৯৫), ও ‘চাঁই দিদি’র কাহিনীগুলি অপূর্ব। তবে তাঁর ‘ভূত পত্রীর দেশ’-এর কাহিনীর অসাধারণতার জন্য এটির রস গ্রহণ বয়স্ক পাঠকের পক্ষে অসুবিধাজনক। ঈশ্প ও কথামালার গল্প আশ্রয়ে তাঁর পালাগুলিও ঠিক একই কারণে শিশুদের জন্যে দুরূহ হয়ে উঠেছে।

বিশ শতকের আচার্য শিবনাথ শাস্ত্রীর ‘মুকুল’(১৮৯৫) একটি উৎকৃষ্ট পত্রিকা। নব-বিধানের ‘প্রকৃত’বের হয়েছে ১৯০৭ সালে। ঢাকা হতে অনুকুলচন্দ্র শাস্ত্রীর সম্পাদনায় ‘তোষিনী’১৯১০ সালে প্রকাশিত হয়। হেমেন্দ্রপ্রসাদ ‘আষাঢ়ে গল্প’ লিখেছেন ১৯০১ সালে। যোগীন্দ্রনাথ সরকারের ‘ছবির বই’ ১৯০২, ‘হাসিরাশি’ ১৯০২ এবং ‘নতুন ছবি’ ১৯০৩ সালে প্রকাশিত হয়। নবকৃষ্ণের ‘ছেলে খেলা’র দ্বিতীয় মুদ্রণ প্রকাশিত হয় ১৯০৪ সালে, মনোমোহন সেনের ‘খোকাবাবুর দপ্তর’ ১৯০২ সালে দুই খন্ডে বের হয়, অল্প কিছু পরে বের হয় তাঁর ‘মোহনভোগ’। ১৯০৪ সালে তাঁর ‘শিশুতোষ’ বের হয়। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী প্রাচীন কালের জীবজন্তু নিয়ে যে সমস্ত মনোরম প্রবন্ধ লিখেছিলেন সেগুলো একত্রে গ্রথিত করে ১৯০৩ সালে ‘সেকালের কথা’ প্রকাশ করেন।

বিশ শতকে উৎকট ভৌতিক গল্পের আবির্ভাব হয়েছে আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের হাতে। তাঁর ‘ভূত-পেতœী’ ১৩০৯ সালে ও ‘রাক্ষস-খোক্কস’ ১৩১০-এর প্রমাণ। প্রথমটি গ্রাম্যতার প্রতিমূর্তি, এর স্থূলকাহিনী ও কদাকার চিত্র বহু বৎসর ধরে শিশু মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে এবং দ্বিতীয়টি রূপকথা। তাঁর ‘সপ্ত আশ্চর্য্য’ ১৯০৩ সালে রচিত পৃথিবীর সপ্ত আশ্চর্য্যরে বর্ণনামূলক একটি সুন্দর বই।

১৩১০ সালে মোহিতচন্দ্র সেন সম্পাদিত কাব্য গ্রন্থাবলীর সপ্তম খন্ডরূপে দেখা দেয় রবীন্দ্রনাথের ‘শিশু’। কবি পতœীর দেহান্তরের (৭ই অগ্রহায়ণ, ১৩০৯) পর বেদনার্ত হৃদয়ে সন্তানদের সান্ত¡না দিবার জন্য তিনি শিশুদের উপযোগী কিছু কবিতা, নাটক, যেমন ‘নদী’, ‘মুকুট’, ‘শিশু ভোলানাথ’, ‘খাপছাড়া’, ‘সে’, ‘ছড়ার ছবি’, ‘ছেলেবেলা’, ‘গল্প সল্প’, ‘সহজপাঠ’, ‘পাঠ প্রচয়’ এবং ‘ছুটির পড়া’ রচনা করেন।

‘বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদেয় এল বান’ বালকের পৃষ্ঠায় শিশুদের জন্য রচিত তাঁর সর্বপ্রথম কবিতা। এটি কেবল অল্পবয়সী পাঠককে উদ্দেশ্য করেই লেখা নয়। রবীন্দ্রনাথের মন বর্ষণমুখরিত দিনে বিস্মৃতযুগের উজ্জয়িনীচারিনী ‘মালবিকা’র স্বপ্ন দেখে সেই মনটিই আর একভাবে নিজের ফেলে আসা অতীতের দিকে যাত্রা শুরু করেছে,

… মনে পড়ে সুয়োরাণী দুয়োরাণীর কথা,

মনে পড়ে অভিমানী কংকাবতীর ব্যথা।

মনে পড়ে ঘরের কোণে মিটিমিটি আলো,

একটা দিকের দেয়ালেতে ছায়া কালো কালো –

(রচনাবলীর পাঠ)

শৈশবের হারিয়ে যাওয়া দিনগুলোর জন্য বয়স্ক মনের দীর্ঘশ্বাস ‘কড়ি ও কোমলের উপকথা’ কবিতাতেও অনুরূপভাবে ঝরে পড়েছে,

রাজপুত্র অবহেলে                       কোন দেশে যেত চলে

কথা নদী কত সিন্ধু পার।

সরোবর ঘাট আলো                     মনি হাতে নাগবালা

বসিয়া বাঁধিত কেশভার

সিন্ধুতীরে কতদূরে                       কোন রাক্ষসের পুরে

ঘুমাইত রাজার ঝিয়ারী

তাঁর এই কবিতাগুলির মধ্যে দুইটি সুস্পষ্ট বিভাগ লক্ষ করা যায়। এক দিকে তাঁর মন পরিত্যক্ত বাল্য জীবনের মধ্যে ফিরে গিয়ে বালক হয়ে উঠেছে আর একদিকে মাতা-পিতার যৌথ বাৎসল্যের ¯েœহধারা অকৃত্রিমভাবে উৎসারিত হয়ে পড়েছে। এ প্রসঙ্গে ‘হাসি-রাশি’, ‘বাব্লা রাণী’, ‘মায়ের আশা’ ও ‘আশীর্ব্বাদ’ উল্লেখযোগ্য। তাঁর স্মৃতিচর্চার পরিচয় বহন করছে ‘বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর’, ছাড়াও ‘সাত ভাই চম্পা’, ‘পুরোনো বট’ ইত্যাদি কবিতা। ‘কড়ি ও কোমল’-এর বিস্তীর্ণ মংগল গীতির তিনটি কবিতার আদেশ ও উপদেশপূর্ণ বক্তব্য শিশুদের কাছে সম্পূর্ণ স্পষ্ট নয়। রবীন্দ্রনাথের ‘নদী’ কবিতাটি শিশুদের জন্য রচিত হলেও চিত্র রচনার কৌশলে, প্রকৃতি জীবজন্তু দেশ-বিদেশের মানুষের সংক্ষিপ্ত অথচ অপরূপ নিপুণ বর্ণনায় এবং ভাষার কোমল কারুকৃতিতে তরুণ পাঠকের মনকেই বেশী আকৃষ্ট করে।

রবীন্দ্রনাথের ‘কথা ও কাহিনী’ বিশ শতকের প্রথম দশকের স্মরণযোগ্য কিশোর সাহিত্য। ‘কথা ও কাহিনী’র ‘শ্রেষ্ঠ ভিক্ষা’, ‘মানী’, ‘বন্দীবীর’, ‘নগর লক্ষèী’, ‘বিচারক’, ‘নিষ্ফল উপহার’, ‘নকল গড়’, ‘পণ রক্ষণ’, ‘স্পর্শমণি’, ‘পুরাতন ভৃর্ত্য’, এবং ‘দুই বিঘা জমি’ কিশোর সাহিত্যের পর্যায়ভুক্ত।

শিশু ও কিশোরদের মধ্যে কোন অনুকম্পার সীমারেখা রাখেননি বলে রবীন্দ্রনাথের বহু রচনা শিশু সাহিত্যরূপে চিহ্নিত হয়েও শিশুদের জন্য নয়। রবীন্দ্রনাথের শিশু গ্রন্থগুলির মধ্যে মায়ের মন, শিশুর ভাবনা এবং শিশুর ভাবনা সম্পর্কে বয়স্কের অনুভবÑ এই ত্রিধারা একসঙ্গে মিলেছে।

বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ১৯০৫ সালে বাঙালীর জীবনে নবজাগরণ দেখা দিল। ফলে বাঙালী তাঁর ঐতিহ্য সম্পর্কে অনুসন্ধ্যিৎসু হল। সে আলোকে উদ্ভাসিত হয়ে দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার লিখলেন ‘ঠাকুরমার ঝুলি’ ১৯০৭ সালে। কালীপ্রসন্নের সহযোগে আর একখানি চমৎকার বই তিনি রচনা করেছিলেন ১৯০৯ সালে, সেটি ‘সচিত্র রসল চন্ডী’ ১৯০৯ সালে। শিশুদের জন্য মার্কন্ডেয় চন্ডীকে গদ্যে পদ্যে পরিবেশন করা হয়েছিল এবং এতে প্রচুর রঙীন ছবিও ছিল। ঢাকার ‘তোষিণী’ পত্রিকায় তার শিশুপাঠ্য উপন্যাসে ‘চারু ও হারু’ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল ১৯২২ সালে। ডে রচিত ‘Sandford and Marten’ -এর সূচনায় সামান্য সাদৃশ্য আছে কিন্তু এতে সমগ্রভাবে দক্ষিণারঞ্জণের মৌলিকতার পরিচয় আছে।

অন্যান্য লেখকের মধ্যে কয়েকটি জাপানী উপকথার স্বচ্ছন্দ অনুবাদ করে ভারতীয় সম্পাদক মনিলাল গঙ্গোপাধ্যায় ১৯০৮ সালে ‘জাপানী ফানুষ’ প্রকাশ করেন। ‘বালক’ সম্পাদিকা জ্ঞানদানন্দিনী দেবী ‘টাক্ডুমাডুম’ ও ‘সাত ভাই চম্পা’ লেখেন ১৯১০ সালে। দীনেন্দ্রকুমার রায় ১৯১৩ সালে ‘দানোর দান’ প্রকাশ করেন।

রজনীকান্ত সেনের ‘অমৃত’ ১৯১০ সালের বৈশাখ মাসে পুনর্মূদ্রিত হয়। এটি উপদেশপূর্ণ প্রসঙ্গ নিয়ে অনেকগুলি মনোহর কবিতার সমাবেশ। যেমন : ‘নদী কভু পান নাহি করে নিজ জল’ অথবা ‘ প্রভৃ ভৃত্যে দুইজনে নৌকা বাহি যায়’।৩

মহারাজ মনীন্দ্রচন্দ্র নন্দীর পৃষ্টপোষকতায় এং বরদাকান্ত মজুমদারের সম্পাদনায় ১৯১৩ সালে ‘শিশু’ নামে আরেকটি উচ্চাঙ্গের পত্রিকা প্রকাশিত হয়। এই পত্রিকা প্রকাশ প্রসঙ্গে সম্পাদকের মতামত : “‘শিশু’ শিশুদের খেলার সাথী- শিক্ষার সহচর। শিশুদিগকে আমোদের সহিত শিক্ষাদান করাই শিশুর উদ্দেশ্য।”৪

দক্ষিণারঞ্জন মিত্রের একটি কবিতা দিয়েই পত্রিকাটির সূচনা হয়েছিল :

শিশু

ওগো

আমরা এসেছি আজ

সোনার স্বপন দুটি ভাইভোন

সোনার দেশের বুক

হাসিয়া এসেছি মুখে।৫

এই পত্রিকাতেই হাসির কবিতার রচয়িতারূপে বিশিষ্ট লেখক হরপ্রসন্ন দাশগুপ্তের ‘সোনার দাঁত’, ‘পান্তা বুড়ি’, ‘বিদ্যাভূতুম’ ও ‘সাতখানি পিঠে’ প্রভৃতি মজার কবিতা প্রকাশিত হয়। পরে তার কাব্য গ্রন্থ ‘রঙিলায়’ তা প্রকাশিত হয় ১৯১৪ সালে।

১৯১৩ সালে ‘ধ্রুব’ নামে বীরেন্দ্র ঘোষের সম্পাদনায় একটি সচিত্র মাসিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। পত্রিকাটি বেশী দিন চালু ছিল না।

বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে প্রকাশিত ‘সন্দেশ’ (১৯১৪) একটি উল্লেখযোগ্য পত্রিকা। সম্পাদনা করেন উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী। সম্পাদকের গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ এবং তাঁর আাঁকা চিত্রে পত্রিকাটি সমৃদ্ধ ছিল।

১৯১২ সাল হতে তাঁর সুযোগ্য পুত্র সুকুমার রায় পত্রিকাটি সম্পাদনার ভার গ্রহণ করেন। লেখক হিসেবে এই পত্রিকায় তাঁর একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। এই পত্রিকাতেই তাঁর শ্রেষ্ঠ শিশুসাহিত্য ‘আবোল-তাবোল’, তাঁর, ‘এলিস ইন্ ওয়ান্ডারল্যান্ড’-এর ধরনে লিখা ‘হযবরল’, ‘পাগলা দাশু’র মজার গল্পগুলি এবং ‘লক্ষণের শক্তিশেল’ এবং ‘অবাক জলপান’, নাটক প্রকাশিত হয়। ‘আবোল-তাবোল’ এর ভূমিকায় তিনি লিখেছেন : ‘যাহা আজগুবি, যাহা উদ্ভট, যাহা অসম্ভব তাহাদের লইয়াই এই পুস্তকের কারবার। ইহা খেয়াল রসের বই। সুতরাং সে রস যাহারা উপভোগ করিতে পারেন এ পুস্তক তাহাদের জন্য নহে’। ‘পাগলা দাশু’ সুকুমার রায়ের একটি উল্লেখযোগ্য শিশুপাঠ্য বই। প্রকাশিত হয় ২২শে নভেম্বর ১৯৪০ সালে। রবীন্দ্রনাথ-এর প্রশংসাসূচক মন্তব্যে লিখেন : ‘সুকুমারের লেখনী থেকে যে অবিমিশ্র হাস্যরসের উৎসধারা বাংলা সাহিত্যকে অভিষিক্ত করেছে তা অতুলনীয়’। মূলত তাঁর বিশেষত্ব হাস্যোচ্ছ্বাসে।

সুকুমার শিশুসাহিত্যের ‘অন্যান্য গল্পে’ তিনটি গল্প আছে : ‘বাজে গল্প’ ও ‘হেশোরাম হুঁশিয়ারের ডায়েরি’ ’সন্দেশ’ পত্রিকায় প্রথমে প্রকাশিত হয়েছিল। পরে ‘পাগলা দাশু’ পুস্তকের প্রথম সংস্করণে প্রথম মুদ্রিত হয়েছিল। এসব গল্পের অধিকাংশই ভাবানুবাদ। অন্য রাষ্ট্র এবং বিদেশী পৌরাণিক গল্পগুলি এতে রয়েছে। যেমন, ‘ভাঙা তারা’, ‘মাওরি দেশের গল্প’, ‘খৃষ্ট বাহন’, ‘রোমান ক্যাথলিক’, ‘কাহিনী’, ‘দেবতার দুর্বুদ্ধি’, ‘নরওয়ে দেশের পুরান’, ‘বুদ্ধিমান শিষ্য’, ‘জাতকের গল্প’, ‘সুদন ওঝা’, ‘দ্রাবিড়ী গল্প’, ‘লোলির পাহারা’, ‘চীন দেশের গল্প’ ইত্যাদি।

১৯২১ সালে প্রকাশিত ‘মৌচাক’ পত্রিকায় প্রথম সংখ্যায় প্রথম কবিতাটির রচয়িতা সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত। তাঁর মতে, শিশুর মধ্য দিয়ে পৃথিবীতে কল্পলোকের মাধূর্যের অবতারণা হয়। শিশুর ‘প্রথম হাসির ধ্বনি’ কবির কাছে বোধ হয় যেন ‘ফুলঝুরিতে ফুল্কি হাসির রাশি’- যেন ‘রূপোর ঘুঙুর জড়িয়ে হাতে বাজায় কে খঞ্জনী’। দিদির উপর প্রথম অভিমানে অতি দু॥খে সরল, কলহ, অনভিজ্ঞ শিশু গালি দেয়Ñ ‘ডিডি! টুমি টুই’ (সত্যেন্দ্রনাথের শিশু কবিতা, ‘মৌলিক গালি’)। সরল শিশুর পক্ষেই সম্ভব দাঁত থাকা সত্ত্বেও দংশনকারী কুকুরকে পিতা কেন প্রতিফল না দিয়ে ছেড়ে দিলেনÑ এই প্রশ্ন করার (সত্যেন্দ্রনাথের উত্তম-অধম)। ভালবাসার রঙিন চোখে শিশুর সৌন্দর্যে কবি গোপন সঞ্চারী ‘লাল পরী’র অতুল রূপের স্পর্শ দেখতে পেয়েছেন (অভ্র আবীর, লালপরী)। খোকা ধার্মিক হোক, কি ‘জবরদস্ত’ দারোগা হোক, কি মিনমিনে ‘ভালোমানুষ’ হোকÑ এ মায়ের কামনা নয়। মায়ের আশাÑ মানুষ হবি শক্ত পোক্ত সাহসে উল্লাসÑ সত্যেন্দ্রনাথের শিশু কবিতা, (নই ঘরের ঘুমপাড়ানী)। তাঁর ‘উত্তম ও অধম’ এবং ‘নই ঘরের ঘুমপাড়ানী’ কবিতা দুটি অনুবাদ কবিতা।

শিশুর মনোরঞ্জনের জন্য সত্যেন্দ্রনাথ যেসব কবিতা লিখেছেন, তার বেশির ভাগ ছড়াজাতীয়। ভাবের দিক থেকে কতকগুলি প্রকৃতি বিষয়ক- কতকগুলি ‘ইলিশ মাছ’, ‘তাতারসির গান’ ইত্যাদি বালকদের লোভের বস্তু নিয়ে লেখা। রেলগাড়ীর গতির ছন্দে মিলানো ‘রেলগাড়ীর টানে’ যে টুকরো দৃশ্যগুলি ধরে রাখা হয়েছে, তার বিস্ময় মেশানো ভাষা ছেলে মানুষেরই মুখের ভাষা। সে ভাষার দৃষ্টান্ত,

একি! একি! একি দেখি! ঢেঁকি ঢেঁকি ভাই

ঘোড়া-চুলো গাছগুলো ছোটে বাঁই বাঁই

উকি মেরে ঝাৎ ক’রে

দেখি ঘাড় কাৎ করেÑ নাই আর নাই।

(সত্যেন্দ্রনাথের শিশু কবিতা)

সত্যেন্দ্রনাথের কবিতায় ছড়ার ভাব ও সুরের ঝঙ্কার তাঁর শিশুরঞ্জক কবিতাগুলির সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছে। তিনি কতকগুলি শিশুশিক্ষামূলক কবিতাও রচনা করেছেন। ‘শীতের ফুল’, ‘বসন্তের ফুল’, ‘শরতের ফুল’, এ (সত্যেন্দ্রনাথের শিশু কবিতা)। শিশুরা প্রকৃতির পাঠ পেয়েছে। শিশুর প্রাণে স্বদেশ ও স্বজাতি সম্বন্ধে গৌরববোধ জাগিয়ে তুলবার উপকরণ আছে ‘তাতারসির গানে’। খাদ্যদ্রব্যের বর্ণনার মধ্যে দিয়ে শিক্ষাদানের সবচাইতে ভাল দৃষ্টান্ত ‘পেটুকের বর্ণ পরিচয়’। এই কবিতার ভাষা উৎকর্ষের পরিচায়ক।

১৯২৪ সালে প্রকাশিত ‘খোকাখুকু’ একটি উচ্চঙ্গের শিশুপত্রিকা। এর প্রথম বৎসরেই নিজের আঁকা ছবির সংগে ‘গাট্টা মিঞা পাট্টাদার’ লিখে দেখা দেন সুনির্ম্মল বসু, সুকুমার রায়ের সার্থক উত্তর সাধক। তিনি শিশুবিষয়ক কাব্য, গল্প উপন্যাস, নাট্য-রচনা করে শিশুসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেন। তাঁর ‘অপরাধ’ কবিতায় শিশু যে অপরাধ করছে তা অত্যন্ত মানবিকবোধসম্পন্ন,

মাচায় ঝোলানো লোহার খাঁচাটি খুলিয়া দিলাম ধীরে,

উড়ায়ে দিলাম ভোরের আলোয় পোষা সে ময়নাটিরেÑ

অন্যত্র,

দুখীর ছেলের চাদর দিয়েছি, মাগো সেই কথা শোন

আমার চাদর দুইখানি আছে ওর কাছে নাই কোনো।

চাঁদ, জ্যোৎøা আকাশের হাজার তারা নিয়ে অগণিত কবিতা লেখা হয়, শিশুরা পড়ে এবং ভুলেও যায়, কিন্তুÑ

চাঁদটা যেন সত্যিকারের আলোরই মৌচাক

দুষ্টু ছেলের ঢিলটা লাগে হঠাৎ হোলো ফাঁক।

আজকে রে তাই সাঁঝের বেলায়

আলোর মধু সব ঝরে যায়

হাজার তারা মৌমাছিরা উড়লো ঝাঁকে ঝাঁকে

নীল আকাশের নিতল নীলে, উড়ল ঝাঁকে ঝাঁক

(মৌচাক- সুনির্মল বসু)

গতানুগতিক চাঁদ ও জ্যোৎøার বর্ণনা নয়। কবি কল্পনায় স্পর্শ লেগে সব কিছুই নতুন তাৎপর্য ও সৌন্দর্যে ভরে উঠেছে ও শিশুর কল্পনাকে জাগিয়ে দিয়েছে। এর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ‘হাওয়ার দোলা’, ‘হুলুস্থুল’, ‘টুনটুনির গান’।

১০২৪ সালে হেমেন্দ্রকুমার রায় রোমাঞ্চকর উপন্যাস ‘যকের ধন’, ‘মৌচাক’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করেছিলেন। সে সময় রূপকথার ইন্দ্রজাল ছড়িয়েছিলেন তিনি। সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায় তাঁর অনুসরণে লিখেছিলেন ‘লালকুঠি’। হাসির গল্প লিখেছিলেন নলিনীভূষণ দাশগুপ্ত। জুলভার্ণের অনুবাদ অবলম্বনে রমেশ চন্দ্র দাশের ‘সাগরিকা’ শিশুমহলকে আন্দোলিত করেছিল। সত্যচরণ চক্রবর্তীর গল্প, উপন্যাস, নিশিকান্ত সেন ও ফটিক বন্দোপাধ্যায় ‘খোকাখুকু’-তে লিখতে লাগলেন। কার্তিকচন্দ্র দাশগুপ্ত লৌকিকগল্পের আসর জমিয়ে তুলতে লাগলেন। ক্ষেত্রমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত, সুরেন্দ্রনাথ সেন এবং ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় নিয়মিতভাবে ঐতিহাসিক গল্প লিখেছেন। কবি শেখর কালিদাস রায় ও কুমুদরঞ্জন মল্লিক নীতিগর্ভ কবিতা লিখতে লাগলেন। হাসির গল্প ও উপন্যাসে কেদারনাথ চট্টোপাধ্যায়, প্রফুল্লচন্দ্র বসু ও জ্ঞানেন্দ্রনাথ রায় প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিলেন।

কাজী নজরুল ইসলাম বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার জামুরিয়া থানার  অন্তর্গত চুরুলিয়া গ্রামে ১৩০৬ সালের ১১ই জ্যৈষ্ঠ (ইংরেজী ১৮৯৯ সালের ২৪শে মে) মঙ্গলবার জন্মগ্রহণ করেন।

নজরুল ইসলামের কবিত্ব শক্তির উন্মেষ হয়েছিল খুব অল্প বয়সেই। পিতার মৃত্যুর পর মাত্র দশ বছর বয়সে পরিবারের আর্থিক দুরাবস্থার দরুণ স্কুলের পড়া ছেড়ে দিতে বাধ্য হন এবং মক্তবের শিক্ষক এক মৌলবী সাহেবের কাছে আরবী-ফারসী মিশ্রিত বাংলা ভাষা শিক্ষা করেন। এরপর আর্থিক সচ্ছলতার উপায় হিসাবে তিনি ‘লেটো নাচ’ আর গানের দলে যোগ দেন এবং মাত্র বারো-তেরো বছর বয়সে উক্ত ভাষায় লেটোর দলের জন্যে গান আর ‘পালা’ লিখতে শুরু করেন।

লেটোর দল সাধারণত: অশিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত গ্রাম্য লোকের দ্বারাই গঠিত হয়। সে কারণে লেটোর গানের ভাষা মার্জিত ও সুরুচিসম্পন্ন হয় না। শিশু কবি নজরুল সেই অল্প বয়সে লেটোর দলের উপযোগী যে সমস্ত গান রচনা করেছিলেন, গ্রাম্য রসগ্রাহিদের কাছে তা-ই হয়েছিল পরম উপভোগ্য।

নজরুল ইসলাম বলে কর ভাই বন্দেগী,

খোয়াইও না আপন গোনাতে জিন্দেগী

শরমেন্দানী হবে হাসরের মাঝে।৬

লেটোর দলের জন্যে রচিত ‘চাষীর সং’ নাটিকায় ‘চাষীর গীত’ :

চাষ কর দেহ জমিতে,

হবে নানা ফসল এতে।

নামাজে জমি ‘উগালে’,

রোজাতে জমি ‘সামালে’

কালেমায় জমিতে মই দিলে

চিন্তা কি হে এ ভবেতে।৭

তাঁর আত্মীয় কাজী নুরুল ইসলামের মতে, নজরুল বাল্যকালে বেশ কয়েকশত মারফতী, পাঁচালী, ব্যঙ্গ, বংগ-মারফতী, ঠিস্ ইত্যাদি গান এবং লেটো-নাচের অভিনয়োপযোগী ছোট ছোট নাটক-নাটিকা রচনা করেছেন। তাঁর বাল্য-জীবনের রচিত সাহিত্য কুলীনসমাজে সমাদৃত না হলেও গীতগুলির অনাড়ম্বর সরল ভাষা কচিমনের অনাবিল ভাব পরিস্ফুট করেছে এবং পরবর্তীকালেও ভাষার এই সারল্য তাঁর রচিত সাহিত্যে প্রত্যক্ষ প্রভাব ফেলেছে ও সাহিত্য স্বাচ্ছন্দ্য লাভ করেছে। মসজিদ, মাজার ও মক্তবের আওতায় থাকার ফলে তাঁর কবিতায়, গানে প্রচুর আরবী-ফারসী শব্দ ব্যবহার করতে পেরেছিলেন।

আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে বার বারই নজরুলের স্থান ও স্কুল বদল হতে থাকে। এই অবস্থায় সিয়ারসোল উচ্চ ইংরেজী বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণীতে পড়াকালীন শিক্ষক বাবু ভোলানাথ স্বর্ণকার বি.এ. মহাশয়ের বিদায় উপলক্ষে ১৯১৬ সালের ১৩ই জুলাই নজরুল ইসলাম ‘করুণ গাঁথা’ অভিনন্দন পত্রটি রচনা করেন। একজন শিক্ষকের বিদায়ে ছাত্রদের হৃদয়বিদারক মানসিক অবস্থার বর্ণনা কবিতাটির উপজীব্য। শিক্ষক পিতার মত তিনি ¯েœহবন্ধনে ছাত্রকে আবদ্ধ করেন। ¯েœহের একটি রীতি এই যে, ¯েœহ কখনও বন্ধন ছিন্ন করতে চায় না। এখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘যেতে নাহি দিব’ কবিতার অনুরনণ শুনতে পাই। রবীন্দ্রনাথের কবিতা,

‘যেতে নাহি দিব’Ñ হায়

তবু যেতে দিতে হয়ে, তবু চলে যায়।৮

নজরুলের,

উঠরে বালক দল                         মুছিয়া আঁখির জল

করে নে বরণ-ডালা                     দে গলে পরিয়ে মালা

চরণ ঢাকিয়া দে রে প্রসুন রাশিতে;

পাবিনা আর যে কভু এ ভালবাসিতে।৯

কবিতাটি সাময়িকভাবে জনপ্রিয় হয়েছিল।

‘করুণ-বেহাগ’ কবিতাটিও একই স্কুলে পড়াকালীন সমসাময়িক রচনা। উক্ত স্কুলের শিক্ষক শ্রীযুক্ত হরিশংকর মিশ্র বি.এ. মহাশয়ের বিদায় উপলক্ষে রচিত। বিদায় বেদনা বড়ই করুণ। বার বারই সে বেদনা জেগে উঠে ও অশ্রু সম্বরণ কঠিন হয়ে পড়ে। স্মৃতি বিজড়িত দিনের কথা মনে করে কবি মর্মাহত। যিনি চলে যাচ্ছেন তাঁর হৃদয় আকাশের মত উদার ও রূপে গুণে তিনি ঋষিতুল্য। বস্তুত: যিনি চলে যান তাঁকেই আমাদের পরম কাছের মনে হয়। কবি তাঁকে যেতে দিতে চান না। কিন্তু জাগতিক নিয়মানুযায়ী তাঁকে চলে যেতেই হবে।

তাই কবির উপহার,

বনফুলহার দেবতার গলে সাজিবে না ওগো ভালো,

আনিয়াছি তাই মন-ফুলে ছোট সাজিখানি করি আলো।

কি দিব গো আর, কি দেবার আছে, আমরা বড়ই দীন,

বিনা এ হৃদির করুণ গভীর আসার-বিন্দু তিন।১০

কবিতাটির শব্দচয়ন ও ব্যঞ্জনা অত্যন্ত শ্রুতিমধুর। এই কবিতাটিও সাময়িকভাবে জনপ্রিয় হয়েছিল।

নজরুলের উল্লেখযোগ্য কবিতা ‘মুক্তি’ প্রকাশিত হয় ত্রৈমাসিক ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা’য় ১৩২৬ সালের শ্রাবণ মাসে। এটি তাঁর প্রথম প্রকাশিত কবিতা- সত্য ঘটনা অবলম্বনে রচিত এক দরবেশের কাহিনী।

কবিতায় ভক্ত-দরবেশ ও সাধু-দরবেশের মধ্যে ষ্পষ্ট পার্থক্য বোঝা যায়। প্রকৃত দরবেশ তিনি, যিনি মানুষকে মুক্তির পথ দেখাতে পারেন।

মানুষের জীবনে জন্ম থেকে শুরু করে শৈশব-কৈশোর-যৌবন-বার্ধক্য পর্যায়গুলি অতিক্রম করে আসে মৃত্যু নামক দেহের ‘মুক্তি’। সাধারণ মানুষ জীবনের পরিণতি মৃত্যু বলে ধরে নিলেও সাধু-সন্ন্যাসী বা ধ্যানী-পুরুষ মৃত্যুকেই জীবনের ‘মুক্তি’ বলে মনে করেন। গাড়োয়ানের গাড়ীর আঘাতে দরবেশের মৃত্যু তাঁর কাছে মুক্তি সমতুল্য। এক্ষেত্রে গাড়োয়ানই তাঁর মুক্তিদাতা। মুক্তিদাতার শাস্তিকে তাঁর কাছে অন্যায় মনে হয়,

ওগো, আমার মুক্তি দাতায় কে রেখেছ বেঁধে?

এ কোন জনার ফন্দি,

বাঁধন যে মোর খুলে দিলে তায় করেছে বন্দী?১১

মুক্তি মূলত: আত্মার মুক্তি। মানবাত্মার মুক্তির কথা বলেছেন কবি। কবিতায় ভাব ও ভাষার সুরুচিসম্পন্ন ভাব পরিলক্ষিত হয়। ছন্দের ক্ষেত্রে প্রখর জ্ঞান ও বুদ্ধিমত্তার পরিচয় ক্রমশ:ই পরিস্ফুট হতে থাকে।

রাণীগঞ্জ সিয়ারসোল হাই স্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্র থাকাকালীন ১৩২৯ আশ্বিনে মাসিক ‘পল্লিশ্রী’ পত্রিকায় ‘ভগ্নস্তূপ’ কবিতা প্রকাশিত হয়। নিখুঁত মাত্রাবৃত্ত ছন্দে লেখা নজরুলের ‘প্রথম কবিতা’ এটি। কবিতাটি স্মৃতিচারণমূলক। মাটির যে প্রকান্ড স্তূপটি গ্রামের দক্ষিণে যুগ যুগ ধরে দাঁড়িয়ে আছে, তার বুক একসময় জাঁকসমকে পরিপূর্ণ ছিল। মানব হৃদয়ের সুখ-দু:খ, ব্যথা-বেদনার অনুভূতি,

(ঐ)          গাঁয়ের দাখিনে দাঁড়ায়ে কে তুমি যুগ যুগ একা গো?

তোমার বুকে ও কিসের মলিন রেখা গো?

এ কোন্ দেশের ভগ্নাবশেষ?

কোন্ দিদিমার কাহিনীর দেশ?

যায় অতীতের আবছায়া টুকু পাষাণেরি গায় দেখা গো

তোমারি উরসে কোন চিতোরের চিতার ভষ্ম রেখা গো?১২

বালক নজরুল অতীতের এই সব মানব-মানবীর সুখ-দুঃখের সমব্যথী হয়েছেন এবং অত্যন্ত সহজ ও স্বচ্ছন্দ্য ভাষায় অন্ত্যমিল প্রয়োগে কবিতাটি রচনা করেছেন।

ঐ স্কুলের দশম শ্রেণীতে পড়াকালীন ‘চড়–ই পাখির ছানা’ কবিতাটি রচনা করেন। কাবিতাটির বক্তব্য ও বিষয় হৃদয়গ্রাহী। একটি চড়–ই ছানা নিয়ে স্কুলের দুষ্টু ছেলেদের কাড়াকাড়ির উপর ভিত্তি করে কবিতাটি রচিত হয়। চড়–ইছানাটি তার মায়ের বুক হতে পড়ে যাওয়াতে মায়ের যে বেদনা তা’ পাঁচু ছাড়া অন্য কোন ছেলেরই বোধগম্য হয়নি। পাঁচু মাতৃহারা বলে পাখিটির বেদনা তার হৃদয় স্পর্শ করেছে। কেননা,

মা মরেছে বহুদিন তার, ভুলে গেছে মায়ের সোহাগ

তবু গো তার মরম ছিঁড়ে উঠলো বেজে করুণ-বেহাগ

মই এনে সে ছানাটিরে দিল তাহার বাসায় তুলে,

ছানার দু’টি সজল আঁখি করলে আশিস পরাণ খুলে।

অবাক-নয়ান মা’টি তাহার রইলো চেয়ে পাঁচুর পাণে,

হৃদয়-ভরা কৃতজ্ঞতা দিল দেখা আঁখির কোণে।

পাখির মায়েরে নীরব আশিস যে ধারাটি দিল ঢেলে,

দিতে কি তার পারে কণা বিশ্বমাতার বিশ্ব মিলে।১৩

এ সময় হ’তে নজরুলের ভাষা পূর্বাপেক্ষা মার্জিত এবং ভাব প্রকাশেও উন্নতি পরিলক্ষিত হয়। তাঁর ছন্দ-জ্ঞানও বৃদ্ধি পায়।

উল্লেখিত সব রচনাই নজরুল শিশুদের উদ্দেশ্যে রচনা করেননি। কিন্তু শিশুতোষ-নজরুল সাহিত্যের সূচনা এখান হ’তেই।

বিশ শতকের চতুর্থ দশকে বাংলা ১৩৪৪ সালের মাঘ মাসে ছোটদের জন্য মোহাম্মদ নাসিরুদ্দিন অতি সহজ সরল ভাষায় বহু চিত্রশোভিত ‘শিশু সওগাত’ নামে একটি মাসিক পত্রিকা বের করেন। সে সময় বাংলাদেশে মুসলমানদের দ্বারা পরিচালিত ছোটদের জন্য কোনো পত্রিকা ছিল না। শিশুসাহিত্যের অভাব মোচনের জন্য ‘শিশু সওগাত’ই বাঙালী মুসলমান পরিচালিত ছেলেমেয়েদের একমাত্র মাসিক পত্রিকা। এর জন্য যে বিজ্ঞপ্তি প্রচারিত হয়েছিল তার সারমর্ম হচ্ছে,

শিশু সওগাত বাঙালী মুসলমানের পরিচালিত ছেলে-মেয়েদের একমাত্র মাসিক পত্র। শিশু মনের উপযোগী সহজ ও সরল ভাষায় লিখিত বিবিধ রচনা, আদর্শ জীবন-চরিত, জ্ঞান-বিজ্ঞানের কথা, ছোটদের গল্প উপন্যাস ও রসালো কবিতা, জীব-জানোয়ারের কাহিনী, দেশ-বিদেশের ছেলেমেয়েদের সচিত্র পরিচয়, সাধারণ জ্ঞানের কথা, ছড়া ও ধাঁ ধাঁ তার উপর পাতায় পাতায় ছবি, যেন চিত্রশালা। তিন বর্ণে রঞ্জিত মলাটের সৌন্দর্যে চোখ জুড়ায়। ছেলেমেয়েদের হাতে ‘শিশু সওগাত’ দিয়ে শিক্ষার সংগে সংগে তাদের হৃদয়মন আনন্দরসে ভরপুর করিয়া দিন।১৪

‘শিশু সওগাত’ পত্রিকাটি সর্বত্র সমাদৃত হয়েছিল। এর গ্রাহক সংখ্যা কল্পনাতীত ভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং ভাল পত্রিকা বলে বিবেচিত হওয়ায় সরকার দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলিকে এই পত্রিকার গ্রাহক করে দিয়েছিলেন এবং সরকারই ঐগুলির বার্ষিক মূল্য পরিশোধ করতেন।

মোহাম্মদ নাসির উদ্দীন ঐ কাগজের প্রথম সংখ্যার জন্য যুক্তাক্ষরবর্জিত শব্দ দ্বারা সহজ ভাষায় একটি কবিতা লিখে দিবার জন্য নজরুলকে অনুরোধ জানান। কবিতাটি শুরু এভাবে,

ওরে শিশু, ঘরে তোর এল সওগাত

আলো পানে তুলে ধর ননী মাখা হাত!

এটি ‘শিশু সওগাতে’র জন্য এত উপযোগী হয়েছিল যে, চারদিক থেকে এর প্রশংসা আসতে লাগল।

নজরুল শিশুকে ছেলেভুলানো ছড়া শোনাননি বা শুধু পুঁথিগত বিদ্যায় পারদর্শী করতে চাননি বা শুষ্ক নীতিবাক্য শোনাননি বরং শিশুসাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় তাঁর পদচারণা শিশুকে এক ভিন্নতর জগতে নিয়ে যায়।

তাঁর রচিত শিশুসাহিত্যকে আমরা বিষয়বৈচিত্র্যের দিক থেকে কয়েকটি শ্রেণীতে ভাগ করতে পারি।

সাধারণতঃ শিশু বলতে সাত বা আট বছরের শিশু বোঝায়, কিন্তু সাত আট বছরের শিশুর পক্ষে কবিতার মর্মার্থ হৃদয়ঙ্গম দুরূহ ব্যাপার, কাজেই বয়সের সময়সীমা আমরা বাড়াতে চাই। এ প্রসঙ্গে ড. শিবনাথশাস্ত্রীর মতামত গ্রহণযোগ্য। তিনি বলেছেন, ষোল বছরের নীচে সবাই শিশু। এই দৃষ্টিভঙ্গীতে নজরুল রচিত সাহিত্যের মধ্যে নি¤েœাক্ত সৃষ্টিসমূহ ‘শিশুসাহিত্য’ বিবেচনা করা যায়।

১.             সাধারণ জিনিসকে অসাধারণত্ব দান- ‘ঝিঙ্গে ফুল’ কবিতা।

২.             কৌতুক ও হাস্যরসের অবতারণা- ‘খুকী ও কাঠ্বেড়ালী’

৩.            ‘খোকার খুশী’, ‘খাঁদু দাদু’, ‘দিদির বে’তে খোকা’,

‘খোকার বুদ্ধি’, ‘খোকার গপ্প বলা’, ‘চিঠি’, ‘লিচু চোর’, ‘হোঁদল কুঁৎকুতের বিজ্ঞাপন’, ‘ঠ্যাং ফুলী’, ‘পিলে-পটকা’, ‘মট্কু মাইতি বাঁটকুল রায়’, ‘নতুন খাবার’, ‘বগ দেখেছ’, ‘ফ্যাসাদ’ ইত্যাদি।

৪.             শিক্ষামূলক উপদেশ- ‘লিচু চোর’, ‘সাত ভাই চম্পা’ ইত্যাদি।

৫.             দেশপ্রেম- ‘হোঁদল কুঁৎকুতের বিজ্ঞাপন’ ইত্যাদি।

৬.            আদর্শবাদী তথা শিক্ষামূলক বর্ণনা- ‘সাত ভাই চম্পা’ ইত্যাদি।

৭.             নীতিশিক্ষা- ‘মা’ ইত্যাদি।

৮.            জাগরণমূলক- ‘প্রভাতী’, ‘সাত ভাই চম্পা’ ইত্যাদি।

৯.            প্রেরণা সমৃদ্ধ রচনা- ‘সংকল্প’, ‘ছোট হিটলার’ ইত্যাদি।

১০.          সৌন্দয্য সৃষ্টিমূলক- ‘সারস পাখি’, ‘ঝিঙে ফুল’, ‘আগুনের ফুল্কী ছোটে’ ইত্যাদি।

১১.           বাৎসল্য রসের কবিতা- ‘শিশু যাদুকর’, ‘আবাহন’, ‘কোথায় ছিলাম আমি’ ইত্যাদি।

১২.           শিশুপ্রীতি তথা মানবসেবার কাহিনী ব্যক্ত করেছেন- ‘ঈদের দিনে’ গল্পে।

১৩.          কল্যাণধর্মী রচনা- নজরুলের ‘পুতুলের বিয়ে’ নাটিকা।

১৪.           অভিযানমূলক- নজরুলের ‘জাগো সুন্দর চিরকিশোর’ একাংকিকা।

১৫.           শিশুদের নিছক আনন্দ দানের উদ্দেশ্যে তিনি কিছু গানও লিখেছেন। ‘প্রজাপতি’, ‘শুক্নো পাতার নূপুর পায়ে’, ‘ওরে হুলোর তুই রাত বিরেতে’ ইত্যাদি।

১৬.          শিক্ষামূলক- নজরুল সম্পাদিত ও সংকলিত ‘মক্তব সাহিত্য’ গ্রন্থের রচনাবলী।

নজরুল ইসলামের প্রতিটি রচনারই এক একটি বৈচিত্র্যময় কাহিনী রয়েছে। শিশুদের মনন বিকাশের উপযোগী এই কাহিনীগুলি। শিশুমনের চিন্তাধারার উৎকর্ষ সাধনে এই সমস্ত কাহিনী তথা চরিত্রের বিন্যাস যথাযথ।

নজরুল শিশুসাহিত্যের সমাজচিত্র আলাদা বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। তিনি যুগের দাবীকে মেনে নিয়েছেন এবং অত্যন্ত বাস্তবসম্মতভাবে শিশুমানস বিকাশের উপযোগী করে তাঁর সাহিত্যে প্রতিভাত করেছেন।

নজরুল শিশুসাহিত্যের চরিত্রগুলো দ্বন্দ্ব সংঘাতময় এবং বাস্তবতার সাথে সম্পৃক্ত। শিশুমনের আশা-আকাক্সক্ষা, অজানাকে জানবার ও জয় করবার ইচ্ছা তাঁর সাহিত্যে মূর্ত হয়ে উঠেছে।

তাঁর সাহিত্যের বিশেষত্ব কাব্য সাহিত্যের আঙ্গিক ও ছন্দসৌকর্য বাস্তবসম্মত ও সুষমামন্ডিত। সাহিত্যিক মানদন্ডের বিচারে তা’ শিশুর মনন বিকাশের উপযোগী।

পাদটীকা

১.             ‘শকুন্তলা’ অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রথম মুদ্রণ, পৃষ্ঠা ২-৩

২.             ১৩০১ সালে রবীন্দ্রনাথের ‘ছেলে ভুলানোর ছড়া’ প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়।

অবনীন্দ্রনাথ সেটির দ্বারা বিশেষ প্রভাবিত হয়েছিলেন।

৩.            ‘অমৃত’ ১৯১০ সালে প্রকাশিত পত্রিকা। সম্পাদক- রজনীকান্ত সেন।

৪.             ‘শিশু’ ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত পত্রিকা। সম্পাদক- বরদাকান্ত মজুমদার।

৫.             ‘শিশু’ পত্রিকায় প্রকাশিত। রচয়িতা- দিক্ষণারঞ্জন মিত্র।

৬.            আব্দুল কাদির সম্পাদিত ‘নজরুল রচনাবলী’র তৃতীয় খন্ডে প্রকাশিত ‘গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত কবিতা ও গান’-এ ‘বন্দনা গান’-এর অর্ন্তভুক্ত।

৭.                                             ঐ

৮.            রবীন্দ্র রচনাবলী। তৃতীয় খ-। ‘সোনার তরী’ কাব্যগ্রন্থ। ১৩৮০ সালে প্রকাশিত। পৃষ্ঠা ৪৯-৫৫।

৯.            আব্দুল কাদির সম্পাদিত ‘নজরুল রচনাবলী’র তৃতীয় খন্ডে প্রকাশিত ‘গ্রন্থকারে অপ্রকাশিত কবিতা ও গান’-এর অন্তর্ভুক্ত। খান মুহম্মদ মঈনুদ্দীনের ‘যুগ-স্রষ্টা নজরুল’ গ্রন্থে সংকলিত।

১০.          আব্দুল কাদির সম্পাদিত ‘নজরুল রচনাবলী’র তৃতীয় খন্ডে প্রকাশিত ‘গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত কবিতা ও গান’-এর অন্তর্ভুক্ত। ঈদ সংখ্যা সাপ্তাহিক ‘ওয়াতান’ এ প্রকাশিত।

১১.           ‘ত্রৈমাসিক বংগীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা’য় প্রকাশিত। ১৩২৬ সালের শ্রাবণ সংখ্যা।

১২.           আব্দুল কাদির সম্পাদিত ‘নজরুল রচনাবলী’র তৃতীয় খন্ডে প্রকাশিত ‘গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত কবিতা ও গান’-এর অন্তর্ভুক্ত। ১৩২৯ আশ্বিনে ময়মনসিংহের মাসিক ‘পল্লীশ্রী’ পত্রিকায় প্রকাশিত।

১৩.          আব্দুল কাদির সম্পাদিত ‘নজরুল রচনাবলী’র তৃতীয় খন্ডে প্রকাশিত ‘গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত কবিতা ও গান’-এর অন্তর্ভুক্ত। শৈলজানন্দ বলেন কবিতাটি ১৯১৮ সালে রচিত।

১৪.           ‘শিশু সওগাত’ মাঘ, ১৩৪৪ সালে প্রকাশিত ১ম বর্ষ, ১ম সংখ্যায় প্রকাশিত ‘শিশু পত্রিকা’। সম্পাদক- মোহাম্মদ নাসির উদ্দীন।

১৫.           ‘মক্তব সাহিত্য’ সংকলন, কাজী নজরুল ইসলাম।

প্রথম পরিচ্ছেদ

নজরুলের শিশুতোষ কবিতা

নজরুলের শ্রেষ্ঠ শিশুতোষ কাব্যগ্রন্থ ‘ঝিঙেফুল’। প্রকাশিত হয় বাংলা ১৩৩৩ সালের আশ্বিন মাসে। এতে ভূমিকা স্বরূপ নাম- কবিতাটি ছাড়া আরো তেরোটি কবিতা রয়েছে। কবিতাগুলো যথাক্রমে- ‘ঝিঙেফুল’, ‘খুকি ও কাঠ্বেড়ালি’, ‘খোকার খুশি’, ‘খাঁদু-দাদু’, ‘দিদির বে’তে খোকা’, ‘মা’, ‘খোকার বুদ্ধি’, ‘খোকার গপ্প বলা’, ‘চিঠি’, ‘প্রভাতি’, ‘লিচু চোর’, ‘ঠ্যাং-ফুলী’, ‘পিলে পট্কা’, ‘হোঁদল-কুঁৎকুতের বিজ্ঞাপন’।

কাব্যগুলে ‘ঝিঙে ফুল’ শিশুরঞ্জক নজরুলের অন্যতম উৎকৃষ্ট রচনা। কবিতাটির প্রথম কয়েকটি পঙ্তি,

ঝিঙে ফুল! ঝিঙে ফুল!

সবুজ পাতার দেশে ফিরোজিয়া ফিঙে-কুলÑ

ঝিঙে ফুল।

গুল্মে পর্ণে

লতিকার কর্ণে

ঢল ঢল স্বর্ণে

ঝলমল দোলো দুলÑ

ঝিঙে ফুল॥

‘গৃহস্থের আঙিনায় অতি সাধারণ এক সবজি লতার ফুল এ কবিতায় বর্ণে গন্ধে অভিজাত বাগান ফুলের মর্যাদা লাভ করেছে।’১ ফুলটির ঢলঢলে সোনা বর্ণের সৌন্দর্য কবির হৃদয়কে খুব সহজেই আকৃষ্ট করেছে। এর সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয়ে ফিঙে পাখিরা এর চারিদিকে কলরব করতে ভালবাসে।

সন্ধ্যেবেলায় এই ফুল ফোটার সঙ্গে সঙ্গে কবির হৃদয় গানের সুরে ভরে ওঠে। পৌষ মাসের শেষ বেলাতে যখন এই ফুল জাফরানী রং পরে উপস্থিত হয় তখন নীরব আসরও সরব ও জমজমাট হয়ে ওঠে।

এই ফুলকে ভালবাসার আরেকটি কারণ হচ্ছে যে, সে মিথ্যা প্রলোভনে ভোলে না। প্রচন্ড রোদের দাবদাহে আলুথালু বেশে সে শ্যামল মায়ের কোলেই ঘুমাতে ভালবাসে। প্রজাপতি তাকে তার সাথে উড়তে ডাক দেয়। আসমানের তারাও তাকে স্বর্গলোকে নিতে চায়। কিন্তু সে স্বর্গের সুখ চায় না। সে মাটির স্পর্শ চায়। সে বলে,

আমি হায়

ভালবাসি মাটি-মায়

চাই না ও অলকায়-

ভাল এই পথ ভুল।

সে তার ফসল দিয়ে মর্ত্যরে মানুষের সেবা করবে। এদের দু:খ-কষ্টের সে অংশীদার হবে। সে এই পৃথিবীর মাটিকে ভালবাসে- তাই সে এর সাথেই সম্পৃক্ত থাকতে চায়। কবিতাটির অপূর্ব সুন্দর ছন্দ শিশুমনকে আকৃষ্ট করে। এটি মাত্রাবৃত্ত ছন্দে রচিত।

জীবন শুধু কল্পনার বিলাসই নয় বাস্তবের দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও ঘাত-প্রতিঘাতময় ‘খুকী ও কাঠ্বেড়ালি’ কবিতাতে তিনি শিশুদের কাছে সে কথাটিই প্রমাণ করতে চেয়েছেন।

খুকী গাছে উঠতে অসমর্থ, কিন্তু সে একটি পেয়ারা চায়। ডাল হতে ডালে কাঠ্বেড়ালির অবাধ ও ত্বরিৎ বিচরণ খুকিকে আশান্বিত করেছে। সে পেয়ারার জন্য কাঠ্বেড়ালিকে প্রথমে প্রলোভন দেখায়,

গুড় মুড়ি খাও? দুধ ভাত খাও? বাতাবি নেবু? লাউ

বেড়াল বাচ্চা? কুকুর ছানা? তাও?

তার ডাকে সাড়া না দেয়াতে সে তাকে ‘হোঁৎকা পেটুক’ বলে অভিহিত করে। একটিও পেয়ারা পেতে অসমর্থ হয়ে খুকি গালি দেয়,

কাঠ্বেড়ালি! বাঁদরমুখি! মারবো ছুঁড়ে কিল?

দেখবি তবে? রাঙাদাকে ডাকবো? দেবে ঢিল!

কিন্তু কাঠ্বেড়ালিকে তার স্বভাব অনুযায়ী পেয়ারা খেতে দেখে খুকি তাকে অভিশাপ দেয়,

পেটে তোমার পিলে হবে! কুড়ি-কুষ্টি মুখে!

হেই ভগবান! একটা পোকা যাস পেটে ওর ঢুকে!

এতসব প্রলোভন, তিরস্কার ও অভিশাপের পরেও যকন খুকি কাঠ্বেড়ালির কার হতে পেয়ারা আদায়ে ব্যর্থ হয় তখন সে নমণীয় মনোভাব গ্রহণ করে এবং কাঠ্বেড়ালিকে সম্মানজনক পদ দিতে আহ্বান জানায়,

কাঠ্বেড়ালি! তুমি আমার ছোড়দি হবে? বৌদি হবে হুঁ!

তেমনি তাকে জামা দেবার লোভও দেখায়। কিন্তু তবু খুকি একটি পেয়ারাও কাঠ্বেড়ালির কাছ হতে আদায়ে সমর্থ হয় না। একটি ইতর প্রাণীর পক্ষে মানব সন্তানের আশা-আকাক্সক্ষার প্রাপ্তি দুরূহ কল্পনা বিশেষ।

পর্যায়ক্রমে এই অবস্থাগুলির মধ্যে দিয়ে শিশুচরিত্র বিকাশের একটি ধারাবাহিকতা লক্ষ করা যায়। শিশু হলেও তার মধ্যে একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষের চরিত্র লুকিয়ে থাকে। একজন বয়স্ক ধীর, স্থির, বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষও তার কাক্সিক্ষত বস্তু পেতে হলে উল্লিখিত পর্যায়গুলি অতিক্রম করে। উপরন্তু, শিশুরা সরল। যে অভিব্যক্তিগুলি একজন বয়স্ক মানুষ সঙ্কোচের কারণে প্রকাশ করতে পারে না শিশুরা তা অকপটে প্রকাশ করে। এদিক থেকে দেখতে গেলে শিশুচরিত্র বিকাশের একটি উল্লেখযোগ্য কবিতা ‘খুকি ও কাঠ্বেড়ালি’। এ কবিতাটি যে শিশুদের খুব প্রিয় তার প্রমাণ ছোটদের যে কোন অনুষ্ঠানে এই কবিতার পুন: পুন: আবৃত্তি দীর্ঘকাল যাবৎ।

‘খোকার খুশি’ কবিতাতে খোকার মতে ‘বিবাহ’ অর্থই খুব খাওয়া দাওয়া ধুম,

বিবাহ! বাস, কি মজা!

সারাদিন মন্ডা গজা

গপাগপ্ খাও না সোজা

দেওয়ালে ঠেসান দিয়ে।

খোকা বর হতে চায় না এই কারণে যে সারাদিন উপোস থাকতে হবে। বিয়ে হবে এই অর্থে যে, সারাদিন সানাই বাজবে, মন্ডা-গজা ইত্যাদি খাওয়ার সাথে সাথে নতুন জামা, পাগড়ি ইত্যাদি প্রাপ্তি ঘটবে।

শিশুরা সব সময়ই কৌতূহল প্রিয়। এই কবিতাটিতে শিশু মনের অজানা কৌতূহল ফুটে উঠেছে। বিয়ের যে কষ্টকর দিকটি উপোস থাকা বা শুধু হরিমটর খাওয়া শিশু সেসব ঝামেলা পোয়াতে চায়না, সে কষ্টকর দিকটি গ্রহণ করতে চায়না। সে শুধুই আনন্দের, ¯েœহ-প্রেম-প্রীতির ভাগটি নিতে চায়। ‘মামী ঘরে এলে সে আদর পাবে, তখন তার সব বিরক্তি, সব ভয় কেটে যাবে। সে সানন্দে ঘোষণা করে, ‘আমি রোজ করব বিয়ে।’২

কবি কবিতাটির বিষয়বস্তু নির্বাচন ও শব্দচয়নে শিশুদের নিকট সাহিত্যের রস পরিবেশন করেছেন ও শিশু মনে আনন্দের খোরাক জুগিয়েছেন।

‘খাঁদু-দাদু’ কবিতাটির নামকরণের মধ্যে দিয়েই কবিতাটির পরিচয় মূর্ত হয়ে উঠেছে। বাস্তবজীবনে বেশির ভাগ সময়ই দাদুর সংগে নাতির ঠাট্টার সম্পর্ক দেখা যায়। এখানে দাদুর বোঁচা নাক নিয়ে নাতির রসিকতাই কবিতাটির উপজীব্য।

দাদুর নাকটি কিভাবে বোঁচা হল তার রহস্য উদ্ঘাটন করতে গিয়ে নাতি বলছে কেউ হয়তো তার দাদুর নাকে ল্যাং মেরে বোঁচা করে দিয়েছে।

অমা! তোমার বাবার নাকে কে মেরেছে ল্যাং?

খোকা তার দাদুর নাকের উপমা দিয়েছে এভাবে,

চামচিকে ছা বসে যেন ল্যাজুড় ঝুলিয়ে!

অথবা,

বুড়ো গরুর টিকে যেন শুয়ে কোলা ব্যাঙ!

অথবা,

কাছিম যেন উপুর হয়ে ছড়িয়ে আছেন ঠ্যাং!

এমন আরো কিছু কল্পনা প্রসঙ্গত: লক্ষণীয়, কবিতাটির প্রতিস্তবকে ধুয়া হিসেবে ব্যবহৃত চরণটিতে ‘(অমা! আমি হেসে মরি, নাক ডেঙা ডেং ডেং) লৌকিক রচনার কিছুটা অনুরণন রয়েছে’।৩

দাদুর নাকটি চীন ও জাপান দেশের লোকের মতই চ্যাপ্টা। দাদুর নাকের তুলনা করতে যেয়ে কবি নিজ দেশ, ধর্ম, বর্ণের গন্ডী অতিক্রম করে চীন, জাপান দেশের সাথে নিজেদের একাত্মতা ঘোষণা করেছেন। এতে দেশ-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে শিশু মনে প্রসারতা ও উদারতা আনবার চেষ্টা করেছেন।

দাদুর নাটি ধ্যাবড়া করার পিছনে দিদিমার কোন কারসাজি আছে বলেও নাতির বিশ্বাস। অবশেষে লম্বা নাকের জন্য দাদুকে লম্বা নাকের দেবতা ‘গরুড় দেব’-এর ধ্যানের পরামর্শ দানেই কবিতাটির পরিসমাপ্তি।

শিশু মনে শুধু কল্পনার বিলাসই নয়, বাস্তবের দ্বন্দ্ব সংঘাতগুলোও কবি তুলে ধরেছেন। অনাবিল পরিহাস রসোচ্ছলতা কবিতাটিকে শিশুদের কাছে আবৃত্তিযোগ্য করে তুলেছে এবং অদ্যাবধি ছোটদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে প্রায়শ: কবিতাটির আবৃত্তি শোনা যায়।

‘দিদির বে’তে খোকা’-তে সাতটি ভাইয়ের একটি বোন চম্পা। তার কোন কষ্ট দেখতে ও মানতে খোকা রাজী নয়। সাত সাগর পাড়ি দিয়ে কাহিনীর দেশের রাজপুত্র এসেছে তার দিদিকে নিয়ে যেতে,

কাহিনীর দেশেতে ঘর

তোর সেই রাজপুততুর?

‘কাহিনী’ অর্থ যে দেশে দু:খ নেই, শোক নেই, জরা নেই, মৃত্যু নেইÑ কেবল চতুর্দিকে আনন্দ কোলাহলÑ কেবলই জীবনÑ শুধুই প্রাচুর্য।

বিয়ে অর্থই খোকার কাছে মন্ডা মিঠাই খাওয়ার ধুম। ‘কিন্তু এতেও তার শান্তি নেই, কেননা তার দিদি তাকে ছেড়ে একাকীই চলে যাচ্ছে,

ভাল ছাই লাগছে না ভাই

যাবি তুই একেলাটি।

খোকা তার দিদির কাছে সোনার কাঠি চায়, তার দিদি যদি সেখানে গিয়ে সারাদিন কেবলই ঘুমিয়ে থাকে তবে তাকে সেই কাঠির স্পর্শে ঘুম ভাঙ্গাবার জন্য।

নজরুলের শিশু কখনই নির্জীব ও নির্লিপ্ত নয়। দু:খ-শোক-জরা মৃত্যুকে জয় করবার জন্য সে সদাই তৎপর। রূপকথার রাজ্যের অফুরন্ত ও অশেষ শান্তি ও ঘুম খোকার কাম্য হতে পারে না। সে কারণে সে সোনার কাঠি চায় তার দিদির ঘুম ভাঙ্গাবার জন্য,

জাগাব পরশ দিয়ে

রেখে যাস্ সোনার কাঠি।

‘মা’ কবিতাতে কবি মায়ের সদৃশ্য ব্যক্তি পৃথিবীতে খুঁজে পাননি। পৃথিবীর যাবতীয় সুধা এই একটি কথার মাঝে। মা এর মত এত আদর সোহাগ আর কারো কাছেই পাওয়া যায় না,

মায়ের মতন এত

আদর সোহাগ সে তো

আর কোনখানে কেহ পাইবে না ভাই,

মায়ের মুখ দেখলে পৃথিবীর সব দু:খ দূরে সরে যায়। মায়ের কোলে ঘুমালে প্রাণ জুড়িয়ে যায়Ñ সকল যন্ত্রণার অবসান হয়। মা সমস্ত আবদার দিনরাত হাসিমুখে সহ্য করেন। দিনরাত এক করে নিজে না খেয়ে নিজ সন্তানকে বড় করে তোলেন।

এতটুকু থেকে মা কোলে করে বড় করে তোলেন; অসুখ হলে শিয়রে বাতি জ্বালিয়ে সারারাত মা-ই সেবা করেন।

ছোট শিশুর ব্যথা মা বুঝতে পারেন। দুঃখের মাঝে বুকে ধরে রেখে মা তাকে বড় করে তোলেন। পাঠশালা হতে ঘরে ফিরে গেলে মা-ই আদর করে কোলে তুলে খাবার কথা শুধান। পড়া লেখায় ভাল হলে গর্বে মার বুক ভরে ওঠে,

পড়া লেখা ভাল হ’লে

দেখেছ সে কত ছলে

ঘরে ঘরে মা আমার কত নাম ক’রে।

সন্তানের অসুখ হলে মা পীর ফকিরের কাছে মানত করে তার মঙ্গল কামনায়। ঘুম না পেলে ঘুম পাড়ানী গান গেয়ে ঘুম পাড়ান। দিবানিশি মায়ের ভাবনা তার সন্তান কিসে মানুষ হবে, কিসে বড় হবে। মায়ের আশীর্বাদে সব দু:খ ‘সুখ’ হয়ে যায়।

সুতরাং মায়ের চেয়ে বড় কেই নেই। সবাইকে কবি নত শিরে মায়ের পদধূলি নেবার আহ্বান জানিয়েছেন। বাঙালী মায়ের চিরন্তন রূপ এবং সন্তানের জন্যে সে মায়ের বিশেষ আকুতির পরিচয় গভীর দরদের সঙ্গে আলোচ্য কবিতায় আবেগ সঞ্চার করেছে।

‘খোকার বুদ্ধি’ কবিতায় কবি খোকার বীরত্বের পরিচয় দিয়েছেন এভাবে,

সাত লাঠিতে ফড়িং মারেন এমনি পালোয়ান

দাঁত দিয়ে সে ছিঁড়লে সেদিন আস্ত আলোয়ন!

ন্যাংটা-পুঁটো দিগম্বরের দলে তিনিই রাজা

তাঁরে কিনা বোকা বলা? কি এর উচিৎ সাজা?

খোকাকে বোকা বলা হোক এটা তার মোটেই পছন্দ নয়। যে শিশুরা তখনও আবরণের মর্ম বোঝে না তাদের দলে তিনি রাজা আর তাকে কি-না বোকা বলা? খোকা আপন বিচারে বীর এবং বুদ্ধিমান।

আমি নাকি বোক্-চন্দর? ও গো মা, বুদ্ধি দেখে যা!

ঐ না একটা মট্কু বানর দিব্যি মাচায় বসে

লাউ খাচ্ছে? কেউ দেখেনি, দেখি আমিই এসে!

দিদিদেরও চোখ ছিল ত, কেউ কি দেখেছেন?

তবে আমার আমায় বোকা কও যে!

কবির অন্তরের কোণে লুকিয়ে ছিল একটি শিশুমন। তাই শিশুদের আশা-আকাক্সক্ষা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। ছোট শিশু কিভাবে বুদ্ধির প্রকাশ করতে হয় জানে না; কিন্তু সে হার মানতেও রাজী নয়। নিজেকে মার কাছে বুদ্ধিমান প্রমাণ করতে যেয়ে সে যে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছে তাতে তার অকপট সরলতাই প্রকাশ পেয়েছে এবং অন্যদিকে প্রচুর আনন্দের খোরাক জুগিয়েছে।

‘খোকার গপ্প বলা’ কবিতাতে খোকা খুব সহজ সরল মনে তার মার কাছে আষাঢ়ে গল্পের অবতারণা করেছে। ‘আষাঢ়ে গল্প’ শুনতে শুধু শিশুরাই নয়, বয়স্করাও ভালবাসে। গল্পের যে একটি বস্তুনিষ্ঠ ভিত্তি থাকতেই হবে; একটি কার্যকারণ সম্পর্ক থাকতেই হবে এমন কথা শিশুরা মানতে চায় না। শিশুর কল্পনাতে রাজার ফড়িং শিকার করতে যাওয়া এবং রাণীর কল্মী শাক তুলতে যাওয়া কোন মানহানিজনক কাজ নয়,

একদিন না রাজাÑ

ফড়িং শিকার করতে গেলেন খেয়ে পাঁপড় ভাজা!

রাণী গেলেন তুলতে কলমী শাক

বাজিয়ে বগল টাক্ ডুমাডুম টাক্!

আবার বেড়াল বাচ্চাকে হাতি বলে ধরে নেয়া আর রাণীর রামছাগলের পিঠে চড়া শিশুর পক্ষে কোন অকল্পনীয় ব্যাপার নয়।

রাজা শেষে ফিরে এলেন ঘরে

হাতির মতন একটা বেড়াল বাচ্চা শিকার করে’।

এমন সময় দেখেন রাজা আসছে রাণী দৌড়ে

সারকুঁড়ে হ’তে ক্যাঁকড়া ধ’রে রাম-ছাগলে চড়ে!

সমানভাবে রাজার পান্তাভাত খাওয়ার মধ্যেও ধনী-দরিদ্রের বিভেদ শিশুমনে কোন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে না।

নজরুল ইসলাম একজন শিশু মনস্তত্ত্ববিদ ছিলেন। আলোচ্য কবিতাটিতে তিনি শিশুমনে ঢুকে তার হৃদয়ের কথাটি জেনে নিয়েছেন ও তা’ হৃদয়গ্রাহী করে তুলে ধরেছেন।

কিন্তু কবিতাটির শেষ অংশে খোকার দাদার বেধরক মারধর শিশুমনকে ব্যথিত করে তোলে। শিশুসুলভ গল্পবাজিকে মারপিটে ঠান্ডা করে তার দাদা তথা নজরুল বিবেচনার কাজ করেননি।

‘চিঠি’ একটি পত্র কবিতা। বাংলা শিশু সাহিত্যে কাজী নজরুল ইসলামের এটি একটি উল্লেখযোগ্য অবদান। চিঠির উত্তর লিখে ছোট বোনের মান ভাঙ্গানোর তথা উৎসাহিত করবার কবিতা। অপূর্ব সুন্দর ছন্দ মিলিয়ে প্রতিটি ছত্রে ছোট বোনকে কিভাবে তুষ্ট রাখা যায় তার চেষ্টা রয়েছে সর্বত্র। চিঠিটির লিখন, বানান ইত্যাদির মর্মোদ্ধার করা কবির পক্ষে যদিও খুব কষ্টসাধ্য তবু তিনি তিন ছত্রের জবাব দিয়েছেন বাষট্টি ছত্রে এবং তিনি তাঁর ছোট বোনের চিঠির প্রত্যাশী। তার ছোট্ট চিঠি কবির কাছে মোটেও তুচ্ছ নয়। বরং মহাদামী। ‘কবিতাটির একটি অংশ বড়দের জন্যেও রীতিমতো উপভোগ্যÑ যেখানে নজরুল পত্রলেখিকা’র হাতে লেখার বর্ণনা দেন’।৪

শিশুর কাঁচা হাতের লেখার এমন বাস্তবমুখী ও চমকপ্রদ বর্ণনা আর কোথাও আছে বলে মনে হয় না। ‘কবিতাটি লৌকিক ছড়ার ছন্দে লিখিত জন্টি নামের কোনো ছোট্ট মেয়ের লেখা চিঠির উত্তর’৫,

তোর অক্ষর

হাত পা নেয যক্ষর,

পেটটা কারুর চিপ্সে

পিঠ্টে কারুর ঢিপ্সে

ঠ্যাংটা কারুর লম্বা

কেউ বা দেখতে রম্ভা!

কেউ যেন ঠিক থাম্বা,

কেউ বা ডাকেন হাম্বা!

থুত্নো কারুর উচ্চে

কেউ বা ঝুলেন পুচ্ছে!

এক একটা যা বানান

হাঁ করে কি জানান!

কারুর গা ঠিক উচ্ছের,

লিখ্লি এমনি গুর্চ্চের! …

কবিতাটির ছন্দ সৌকর্য, বাস্তবমুখী বর্ণনা ও শব্দচয়নে শিশুদের নিকট সাহিত্যের রস পরিবেশন করেছেন।

‘প্রভাতী’ কবিতাটি জাগরণী গানে মুখরিত। আপাতঃদৃষ্টিতে মনে হয় খুকুকে তথা তাবৎ শিশুকে ভোরবেলা জাগানোই কবিতাটির উদ্দেশ্য,

ভোর হলো

দোর খোলো

খুকুমণি ওঠরে!

যখন যুঁইয়ের শাখে ফুলকুঁড়ি পাপড়ি মেলতে থাকে, সূর্য পূর্বদিক হতে সবে লাল আভা ধারণ করতে শুরু করেÑ দারোয়ানের হাঁক শোনা যায় ও বাসা ছেড়ে পাখিরা আকাশে গান গেয়ে বেড়ায় কবি সেই ভোরে শিশুদের জেগে উঠবার আহ্বান জানিয়েছেন।

বুলবুলিরা যখন ফুলে ফুলে শিষ দিয়ে বেড়ায়, নদীতে মাঝি নৌকায় পাল তুলে দেয়, সেই সকালে ঘুম থেকে উঠলে খুকুর কপালে ভোরবেলার চাঁদও টিপ দিয়ে যায়। তখন কে আগে উঠেছে তাই নিয়ে খুকুদের কলরব শোনা যায়। ভগবানের প্রতি প্রার্থনা জানিয়ে কবি দিনের কাজ শুরু করার আহ্বান জানিয়েছেন। সমস্ত জড়তা ও অলসতা পরিত্যাগ করে দিনের কর্মকান্ডে অংশ নিতে বলেছেন তিনি।

শুধু ভোরবেলার জাগরণই কবিতাটির আসল উদ্দেশ্য নয়; বস্তুত ভগবানের নামে জীবনের জাগরণই মূলকথা। অন্ধকার নয়, জীবনে আলোর প্রয়োজন। অফুরন্ত আলো আনবার আহ্বান জানিয়েছেন কবি।

‘লিচু চোর’ কবিতাটি বিষয়বস্তু ও ছন্দবৈচিত্র্যে বাংলা শিশু সাহিত্যে একটি শ্রেষ্ঠ সৃষ্টির দাবীদার। কবির ব্যক্তি জীবনের দুরন্তপনা ছড়িয়ে আছে কবিতাটিতে। কল্পনার স্বর্গরাজ্য নয়, বাস্তবজীবনের দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও ঘাত-প্রতিঘাতময় জীবনের কথা শুনিয়েছেন কবি শিশুদের।

এটি একটি কাহিনীমূলক কবিতা। ঘটনাটি নাটকীয়। পাড়ার ধনাঢ্য ব্যক্তির গাছ হতে এক দুরন্ত গ্রাম্য কিশোরের লিচু চুরির ব্যর্থ প্রয়াস।

যদিও প্রয়াসের ফল কিশোরের জন্য করুণ, কিন্তু পাঠকের জন্য কৌতুকবহ। চুরির প্রথম পর্যায়েই গাছে উঠবার সময় ডাল ভেঙে যায়। কিশোরটির জন্য মালী ও কুকুরের হাতে লাঞ্ছনা ও দুর্ভোগ জোটে।

তার ব্যর্থতা, লাঞ্ছনা, দুর্ভোগ ইত্যাদি দুঃখজনক পরিণতি পল্লী অঞ্চলের এক শ্রেণীর কিশোর মহলে অতি সাধারণ ব্যাপার। এই সাধারণ ব্যাপারটি নজরুল তাঁর স্বভাবগুণে পরম উপভোগ্য করেছেন। বর্ণনার কৌশল এবং শব্দাদির সুনিপুণ প্রয়োগে কিশোরদের কাছে এর চিরস্থায়ীত্ব এনে দিয়েছে এবং এটি বহুল আবৃত্ত একটি কবিতা।

কবিতাটিতে একটি শিক্ষামূলক বিষয়ও আছে। কিন্তু অভিজ্ঞতার পর কিশোরটির চুরি ছেড়ে দেয়ার শপথ গ্রহণ। যেমন,

যাব ফের? কান মলি ভাই,

চুরিতে আর যদি যাই!

তবে মোর নামই মিছা!

কুকুরের চাম্ড়া খিঁচা

সে কি ভাই যায় রে ভুলোÑ

মালীর ঐ পিট্নীগুলো!

কি বলিস্? ফের হপ্তা?

তৌবা-নাক খপ্তা।

‘ঠ্যাং ফুলি’ কবিতার উপজীব্য কৌতুক পরিবেশন- কিছু আঙ্গিক বিকৃতিকে উপলক্ষ করে, কথা আর শব্দের কাতুকুতু দেওয়া প্রয়োগের মাধ্যমে। কৌতুক এখানে তাই কিছু কৃত্রিম তথা অস্বাভাবিক।৬ যেমন এই অংশে,

বটু তুই র্জো দে ভোঁ দৌড়,

রাখালো! ভাঙবে গোঁ তোর

নাদনা গুঁতোর

ভিটিম্ ভাটিম্।

ধুমাধুম্ তাল ধুমাধুম্

পৃষ্ঠে-মাথায় চাটিম্ চাটিম্!

কবিতাটির শেষাংশে উপদেশমূলক দিকও রয়েছে যা শিশুদের জন্য কল্যাণধর্মী। কারো অংগহানির কারণে তার নিজেকে লজ্জিত হওয়া উচিত নয়। কেননা কান্না শোনার লোক পৃথিবীতে খুব কম। লোকে হাসবে বলে তার কোথাও যেতে বা কারো সাথে মিশতে মানা নেই।

বস্তুতঃ মানুষের অংগহানির জন্য সে নিজে দায়ী নয়। তার জন্য নিজেকে লুকিয়ে রাখা তার কোন মতেই উচিত নয়। কেননা নিজেকে লুকিয়ে রাখলেই অন্যরা তাকে নিয়ে হাসবে। বরং সবার সাথে মিলে মিশে থাকলে লোকে তাকে নিয়ে আর উপহাস ও ঠাট্টা করবে না। অন্যেরও উচিত নয় কারো দুর্বল স্থানে আঘাত করা। তাতে মানুষের কষ্ট দ্বিগুণ বেড়ে যায়।

‘পিলে-পট্কা’ কবিতাটিতে কবি নিছক কৌতুক পরিবেশন করেছেন কথা ও শব্দের কাতুকুতু দেওয়া প্রয়োগের মাধ্যমে আঙ্গিক বিকৃতিও করেছেন। পুরো কবিতাটিতেই পিলে পট্কা হাশিমের দৈহিক বিকৃতি ও তার চাল-চলনের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। এখানে কয়েকটি লাইন উদ্ধৃত হল,

উঁটমুখো সে সুঁটকো হাশিম,

পেট যেন ঠিক ভুঁটকো কাছিম!

চুলগুলো সব বাবুই দড়ি-

ঘুসকো জ্বরের কাবুয় পড়ি!

তিন-কোনা ইয়া মস্ত মাথা,

ফ্যাচকা-চোখো; হস্ত? হাঁ তা

ঠিক গরিলা, লোবনে ঢ্যাঙা!

নিট্ পিটে ঠ্যাং সজনে ঠ্যাঙা!

গাইতি-দেঁতো উঁচকে কপাল

আঁতকে ওঠেন পুঁচকে গোপাল“

নাক খাঁদা ঠিক চামচিকেটি!

পৃথিবীতে তার শুধু খাওয়া ছাড়া দ্বিতীয় কোন কাজ নেই। এই একটি কাজই সে পারে। সব মোটারা মিলেও পিলে পটকাকে বাগাতে পারে না, কেননা তার পেট মোটা ও পা সরু। সারাক্ষণ তার ঠ্যাং দুটো ঠুঁটো ব্যাঙের মত কিলবিলিয়ে নড়তে থাকে।

‘হোঁদল কুঁৎকুতের বিজ্ঞাপন’ নজরুলের অন্যতম বিখ্যাত রচনা। রচনাদৃষ্টে মনে হয় শিরোনাম অনুযায়ী কোন কিছুর বর্ণনা বা বিজ্ঞাপন থাকবে, কিন্তু এতে আছে কিছু ছেলেমেয়ের চেহারা আর চরিত্রের নামানুগ বিশ্লেষণ এবং চরিত্র বা চেহারা অনুযায়ী নামের ব্যাখ্যা।৭ কবিতাটি পড়াবার আগে এ দেশের শিশুরা কখনো ভেবে দেখেনি যে ড্যাবরা ছেলেদের স্বভাব কেমন হতে পারে এবং হাঁদারাই বা কেমন? প্যাঁটরা দেহ কোন ধরনের হয় এবং বোঁচাদেরই বা কি নাম রাখা দরকার। কিছু অংশ উদ্ধৃত হল,

গাব্দা ছেলের মনটি সাদা একটুকুতেই হন খুশী,

আদর করে মাত তারে তাই নাম দিয়েছেন মন্টুসী

*                             *                             *

গাল টেবো যাঁর নাম টেবী তার একটুকুতেই যান রেগে।

কান খডুকে’, মায়ের লেঠা, রয় ঘুমুলেও কান জেগে। …

*                             *                             *

পুঁটুরানী বাপ-সোহাগী, নন্দদুলাল মানিক মার,

দাদু বুড়োর ন্যাওটা যে ভাই মটরু ছাগল নামটি তার!…

কবিতাটি আগাগোড়া হাঁসির দমকে কাঁপানো তবে, শেষ অংশটি একটু ভিন্ন ধরনের। দেশের জন্য প্রাণ দিতে এবং সাত সাগরের ওপার থেকে বন্দিনী দেশ লক্ষèীকে উদ্ধার করতে সক্ষম বাদল নামের বীর ছেলেটিকে কবি উপহার দিতে চান ‘হোঁদল-কুঁৎকুঁতের ছানা’।

মনস্তাত্ত্বিক বক্তব্যের সাথে এই হাস্যকর বিষয়ের সংযোজনে নজরুল অসাবধানতার পরিচয় দিয়েছেন। দেশপ্রেম এখানে রসিকতায় পরিণত হয়েছে।

আব্দুল কাদির সম্পাদিত নজরুল রচনাবলীর তৃতীয় খন্ডে প্রকাশিত ‘অপ্রকাশিত কবিতা ও গান’-এ কিছুসংখ্যক শিশু কিশোরদের জন্য লিখিত কবিতা পাই। কবিতাগুলোÑ ‘সারস পাখি’, ‘ছোট হিটলার’, ‘নতুন পথিক’, ‘নতুন খাবার’, ‘শিশু সওগাত’, ‘মটকু মাইতি বাঁটকুল রায়’, ‘ঝুমকো লতায় জোনাকি’, ‘কোথায় ছিলাম আমি’, ‘সংকল্প’, ‘চলব আমি হাল্কা চালে’, ‘কিশোরের স্বপ্ন’, ‘প্রার্থনা’, ‘মুকুলের উদ্বোধনী’, ‘আগা মুর্গী লে কে ভাগা’, ‘মায়া-মুকুর’, ‘ফ্যাসাদ’, ‘আগুনের ফুল্কি ছুটে’, ‘আবাহন’, ‘আবীর’, ‘লাল সালাম’, ‘বর-প্রার্থনা’, ‘এস মধু মেলাতে’, ‘মা এসেছে’, ‘বগ দেখেছ’, ‘গদাই এর পদবৃদ্ধি’।

‘সারস পাখি’ কবিতাটিতে নজরুল অপরূপ সৌন্দর্য সৃষ্টি করেছেন। এদিক থেকে কবিতাটিকে নজরুলের ‘ঝিঙে ফুল’ কবিতার সাথে তুলনা করা যায়। বিশেষ কোন বক্তব্য নেই কবিতাটিতে। অতি সাধারণ একটি পাখি বা বিষয়ও যে প্রতিভার স্পর্শে অপরূপ সৌন্দর্যের আধারে পরিণত হতে পারে ‘সারস পাখি’ তার আরেকটি প্রমাণ। সাধারণকে এমন অসাধারণ সৌন্দর্য দান কেবল নজরুলের মত প্রতিভাবানের পক্ষেই সম্ভব। কবিতাটির প্রথমাংশে,

সারস পাখি! সারস পাখি!

আকাশ-গাঙের শ্বেতকমল!

পুষ্পপাখি! বায়ুর ঢেউ এ

যাস্ ভেসে তুই কোন্ মহল?

তোরে ময়ূর পঙ্খী করি

পরীস্থানের কোন্ কিশোরী

হাল্কা পাখার দাঁড়ে টেনে যায়?

নি¤েœ কাঁপে সায়র জল!

গগন-কূলে ঘুম ভেঙে চায়

মেঘের ফেনা অচঞ্চল।

‘ছোট হিটলার’ একটি বীর রসের রচনা। এ কবিতায় নায়ক সানি খুবই ছোট, কিন্তু সে অসম্ভব সাহসী ও তেজী। তার কল্পনায় সে একজন অমিত তেজ বীর পুরুষ। সে পোল্যান্ড, জার্মানিকে ভয় পায় না। রাইফেল, এয়ারগান এরোপ্লেন আধুনিক কোন সমরাস্ত্রই তার কাছে গ্রাহ্য করবার মত বস্তু নয়। তার রাগে ঘোলা চোখ দেখেই গোলাগুলি বারুদ বোম সব কুলপি বরফের মত ঠান্ডা হয়ে যায়,

রাইফেলকে ভয় করে কে? বগল দাবা এয়ারগান,

এক গুলিতে উড়িয়ে দিতে পারি কত মিঞার কান।

গুল্তি মেরে ফেলতে পারি ঝুলতি-ন্যাজা এরোপ্লেন,

দেখলে মোরে, বলবে ওরা ‘ছোট-হিটলার বেরুচ্ছেন’!

তার রণকৌশলে মুসোলিনি হেঁসেলে ঢুকে মশলা পিষবেন আর হিটলার হবেন উড়ে বামুন।

‘নতুন পথিক’ এ আগামী দিনের শিশুকে কবি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি তাদের নতুন যুগের মানুষরূপে দেখেছেন।

কবি তাদের সম্বন্ধে আশাবাদী। সে বেপথুকে পথ দেখাবে। মানুষকে ভরসার কথা শোনাবে। পৃথিবীতে আনন্দ বয়ে নিয়ে আসবে। এই পৃথিবীর মাটির করুণা নিয়ে স্বর্গ রচনা করবে। কবিতাটি নীচে উদ্ধৃত হল,

নতুন দিনের মানুষ তোরা

আয় শিশুরা আয়!

নতুন চোখে নতুন লোকের

নতুন ভরসায়।

নতুন তারার বেভুল পথিক

আনলি ধরাতে,

ধরার পারে আনন্দলোকে

দেখাস ইশারায়।

খেলার সুখে মাতলি তোরা

মাটির করুণা,

এই মাটির স্বর্গ রচিস,

তোদের মহিমায়।

‘নতুন খাবার’ হাস্য রসের কবিতা। তিনি খাবার তৈরীর যে উপকরণ ও পদ্ধতির কথা বলেছেন তা অবাস্তব ও উদ্ভট। নীচে কবিতাটির কিছু অংশ উদ্ধৃত হল,

কম্বলের অম্বল

কেরোসিনের চাট্নি,

চামচের আম্চুর

খাইছ নি নাত্নি?

আমড়ার দামড়ার

কান দিয়ে ঘষে নাও,

চামড়ার বাটিতে চট্কিয়ে কষে খাও।…

কবিতাটি সুকুমার রায়ের ‘খাই খাই’ কবিতার সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। তাঁর কবিতাতেও আজব আজব খাবারের কথা বলা হয়েছে। পার্থক্য এই যে, এখানে খাবারগুলির উল্লেখ করা হয়েছে বিভিন্ন ধরনের খাওয়ার উদাহরণ হিসেবে। ‘খাই খাই’ কবিতার কিছু অংশ,

ডাল ভাত তরকারি ফলমূল শস্য

আমিষ ও নিরামিষ, চর্ব্য ও চোষ্য,

রুটি লুচি, ভাজাভুজি, কৈ ঝাল মিষ্টি,

ময়রা ও পাচকের যত কিছু সৃষ্টি,।৮

‘শিশু সওগাত’ এ নজরুল সমগ্র শিশু সমাজকে এর অন্তর্ভুক্ত করেছেন। তিনি তাদের দেখেছেন নতুন প্রভাতের এবং সেই সংগে শক্তিরও প্রতীকরূপে।

প্রকৃতির যত কিছু আয়োজন এবং আহ্বান সব শিশুদেরই জন্য,

তোরে চেয়ে নিতি রবি ওঠে পুরবে,

তোর ঘুম ভাংগিলে যে প্রভাত হবে।

ডালে ডালে ঘুম জাগা পাখিরা নীরব,

তোর গান শুনে তবে ওরা গাবে সব।

অতএব, কবি শিশুকে আহ্বান জানিয়েছেনÑ

তারে দিন অনাগত, শিশু তুই আয়,

জীবন মরণ দোলে তার রাঙা পায়।

তোর চোখে দেখিয়াছি নবীন প্রভাত,

তোর তরে আজিকার নব সওগাত।

সহজ সরল শিশুদের জন্য রচিত অত্যন্ত উপযোগী কবিতা এটি। শিশুদের উপযোগী ছন্দ ও মিষ্টি ভাষায় একটি অপূর্ব নিদর্শন।

‘মট্কু মাইতি বাঁটকুল রায়’ একটি হাস্যরাসাত্মক কবিতা। নিতান্তই হাস্যরস পরিবেশেন এই কবিতা রচনার উদ্দেশ্য। এর কাহিনীর পিছনে বিশেষ কোন বক্তব্য নেই। ‘মট্কু মাইতি বাঁটকুল রায়’ কবিতার নামকরণটি যেমন উদ্ভট তেমনি এর কাহিনীটি। কাহিনীর নায়ক রেগেমেগে যুদ্ধে যাত্রা করলেও তার চলার ঢংটি মোটেও যুদ্ধংদেহী নয়। বরং তার চলার ঢংটি,

পায়ে পরে গাবদা বুট আর পট্টি,

গড়াইয়া চলে যেন গাঁঠ্রি ও মোটটি,

হনুলুলু সুরে গায় গান উদ্ভটটি

হাঁটি হাঁটি পা পা ডাইনে বাঁয়

মটকু মাইতি বাঁটকুল রায় ॥

বরং সে যুদ্ধ যাত্রা করলেও সামান্য দামড়া দেখেই ভয়ে অস্থির হয়। নায়কের আঙ্গিক ত্রুটি ও উদ্ভট আচরণ এখানে হাসির উৎস। নজরুলের নিজস্ব ঢঙে কিছু শব্দ এখানে পাওয়া যায়। এ ধরনের হাস্যরস পরিবেশন বাঙলা শিশুসাহিত্যে এই প্রথম।

‘ঝুমকো লতায় জোনাকি’তে কবির কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে মধুরতম শব্দটি হল শিশুর,

ঝুমকো লতায় জোনাকি

মাঝে মাঝে বৃষ্টি গো

আবল তাবল বকে কে

তারও চেয়ে মিষ্টি গো

মিষ্টি মিষ্টি।

এখানে শিশুর শব্দকে ‘ঝুমকো লতায় জোনাকি’ আলো এবং তার মধ্যে বৃষ্টির শব্দ পড়লে যে একটি মিষ্টিমধুর শব্দ ও আমেজের সৃষ্টি হয় তার চেয়েও মধুরতম শব্দকে শিশুর শব্দ বলা হয়েছে। কবিতাটির উপজীব্য বার বছর খোকনের বিরহে মা কাতর। বাঘিনী মাও তার ছেলের বিরহে কাতর। দুধের বাটি, যে বাটিতে শিশু দুধ খেত সেটি অব্যবহারে পাথর হয়ে গেছে। ঘরের সমস্ত জিনিস তার অভাব বোধ করছে,

কেঁদে বলে ঘরের জিনিসÑ “যেমন ছিলাম তেমনি আছি-

খোকা কেন ভাঙে না,

কিছুই ভালো লাগে না।”

পৃথিবীর সব কিছুই পরিবর্তন চায়। খোকার হাতের ছোঁয়া অর্থাৎ নতুনের ছোঁয়া সবাই আশা করে।

‘কোথায় ছিলাম আমি’র শিশু বিশ্বপ্রকৃতি বা বিশ্বমায়ের সন্তান। মায়ের কোলে আসার আগে সে ছিল সারা বিশ্বে ছড়ানো। সে ছিল চাঁদে শুকতারায়, কাজলা দীঘির পদ্মফুলে, নদীর বন্যায়, ঝড়ের দুরন্তপনায়, সন্ধ্যাদীপের শিখায়। কেননা বিশ্ব প্রকৃতির জন্য তার মন অধীর হয়। পৃথিবীর প্রকৃতি বলে ‘তুই যে আমার এই ত সেদিন আমার বুকে ছিলি’। সে সব খোকাকে নিজের মনে করে, ‘যে খোকারে দেখি-ভাবি আমার খোকা বুঝি’। বস্তুতঃ মায়ের কোলে আসার আগে সে ছিলো সারা বিশ্বে ছড়ানো। তার ভাষায়,

কবিতাটি রবীন্দ্রনাথের ‘শিশু’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত ‘জন্মকথা’৯ কবিতাটির দ্বারা প্রত্যক্ষ এবং গভীরভাবে প্রভাবিত। তবে রবীন্দ্রনাথের কবিতায় শিশুর প্রশ্ন ‘এলেম আমি কোথা থেকে?’ এর উত্তর দেন তার মা। নজরুলের শিশুর জবাব দিয়েছে বিশ্বমাতা বা বিশ্বপ্রকৃতি। এখানেই রবীন্দ্রনাথের কবিতার সংগে নজরুলের কবিতার পার্থক্য। অর্থাৎ ‘জন্ম কথা’র, শিশু মানুষের জীবনধারার জীবনচারণের ফল, ‘কোথায় ছিলাম আমি’র শিশু বিশ্বপ্রকৃতির তথা বিশ্বমায়ের সন্তান।

একটি জায়গায় এই উভয় কবির মিল রয়েছে। তা’হল রবীন্দ্রনাথের ‘জন্ম কথা’ ও নজরুলের ‘কোথায় ছিলাম আমি’ দার্শনিক তত্ত্বের কারণে শিশুদের কাছে সহজবোধগম্য হতে পারেনি।

‘সংকল্প’ কবিতাটি অভিযানমূলক। শিশু আর আবদ্ধ হয়ে থাকতে চায়না, সে চায় বিশ্বজগতের পরিচয় পেতে,

থাকব নাকো বদ্ধ ঘরে, দেখব এবার জগতটাকে,

কেমন করে ঘুরছে মানুষ যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে।

দেশ হতে দেশ দেশান্তরে

ছুটছে তারা কেমন করে,

কিসের নেশায় কেমন করে মরছে যে বীর লাখে লাখে

কিসের আশায় করছে তারা বরণ মরণ যন্ত্রণাকে।

কি করে এবং কিসের নেশায় মানুষ এক দেশ হতে আরেক দেশে ছুটে চলেছে, কেন মানুষ সাগরের তলদেশ হতে লক্ষèী আহরণে ব্যস্ত, কেন মানুষ হিমালয়ের চূড়ায় উঠতে চায়, পৃথিবীর উত্তর মেরু এবং দক্ষিণ মেরুতে কি আছে, চাঁদ ও মঙ্গল গ্রহেই বা কি আছে এসবই দেখা এবং জানার নেশায় মানুষ ছুটে চলেছে। নজরুলের শিশুও এইসব অভিযানে সামিল হতে চায়। চীনবিপ্লব, চীন প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, আয়ারল্যান্ড বিপ্লব, তুর্কী বিপ্লব, তুর্কী প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, গ্রীসের পতন নজরুলের স্বাধীনচিত্ত মনে প্রেরণা জাগিয়েছে ও সমভাবে শিশুর মনেও আবেগ সঞ্চারিত করেছে। কবিতাটির মাধ্যমে কবি শিশুর স্বাধীনসত্তা ও চিন্তার জগৎ প্রসারিত করেছেন।

‘চলব আমি হাল্কা চালে

পল্কা খেয়ার হাওয়ার তালে,

কুসুম যেমন গন্ধ ঢালে

তরল সরল ছন্দে রে।

যেনম চলার ছন্দ লুটে

চন্দ্র ডোবে সূর্য উঠে,

সন্ধ্যা সকাল সমীর ছুটে

যেমন সে আনন্দে রে ॥

সে ধনজন গাড়ী ঘোড়া কিছুই চায় না, সে প্রকৃতির পাঠ নিতে চায়। জাগতিক লোভ বা কোন কিছুতে মোহও নেই। ভয় দেখানো কোন কিছু হওয়ার ইচ্ছাও তার নেই। সবার ভালোবাসা নিয়ে সে বেঁচে থাকতে চায়।

‘কিশোর স্বপ্ন’ দেশপ্রেমমূলক কবিতা। এখানে শিশু দেশমাতার দু:খ মোচনের জন্য বাইরের জগৎ ঘুরে আসতে চায়। দেশের মধ্যে শুধু স্কুলে যাওয়া আর চাকুরী করার মত একঘেঁয়ে কাজ ছাড়া প্রাণের কোন বিকাশ নেই।

শিশু চেকোশ্লোভাকিয়া, চীন, জাপান ও রাশিয়া যাবে। সেখান হতে সে অগ্নিমন্ত্রের দীক্ষা এনে দেশমাতৃকার জড়তা ও অবহেলা দূর করবে। বিদেশ হতে রতœরাজি এনে তার দেশ মাতৃকাকে সে রাজরাণীর অলংকারে সাজিয়ে তুলবে।

দেশ-বিদেশের ছেলেমেয়ে তার প্রসাদে ধন্য হবে এবং হৃত গৌরব পুনরুদ্ধার করবে ও শৌর্যে-বীর্যে দেশকে সমৃদ্ধ করে তুলবে,

আমার দেশের প্রসাদ পেয়ে

দেশ-বিদেশের ছেলে মেয়ে

ধন্য হতে আগে যেমন তেমনি আজও হবে;

তোমার পুত্র না যদি রয় (তাহার) আশার স্বপ্ন রবে ॥

‘জিজ্ঞাসা’ নজরুলের আরেকটি ব্যতিক্রমধর্মী শিশুতোষ কবিতা। কিশোরসুলব অনুসন্ধিৎসার আড়ালে এটি একটি দার্শনিক বা তত্ত্বমূলক রচনা। ‘শিশু-যাদুকর’, ‘আবাহন’, ‘কোথায় ছিলাম আমি’, কবিতাতেও তত্ত্ব বা দর্শন আছে; সে দর্শন মানুষের জন্ম বিষয়ক কিন্তু ‘জিজ্ঞাসা’র অনুসন্ধিৎসা জগৎ ও তার পরিচালককে কেন্দ্র করে,

রব না চক্ষু বুঁজি

আমি ভাই দেখব খুঁজি

লুকানো কোথায় কুঁজি

দুনিয়ার আজব-খানায়।

আকাশের প্যাটরাতে কে

এত সব খেলনা রেখে

খেলে ভাই আড়াল থেকে,

সে তা ভাই ভারী মজার।…

‘মাঙ্গলিক’ প্রেরণামূলক কবিতা। খুব ভোরবেলা সুর্য পূর্বাকাশে ওঠে। সে তার আকাশ মায়ের কোলে ফুল ফোটায়, ক্রমে যত উপরে উঠে ও তার শক্তি ও তেজের দ্যুতি বিশ্বময় ছড়াতে থাকে। আবার তার বিদায়ে পৃথিবী মলিন হয়ে পড়ে।

শিশুর জীবনও হবে সূর্যের মত আনন্দময় ও গৌরবময়। তার আলোকে পৃথিবীর দু:খ শোক শেষ হয়ে যাবে। দেশের কলংক ও অসম্মান নিঃশেষ হয়ে নতুন প্রাণে সব কিছু জেগে উঠেবে। তার আহ্বানে আত্ম-অবিশ্বাসীরাও জেগে উঠবে। তবেই বিশ্ব তার মাঙ্গলিক গাইবে,

যে আদর্শ মানুষ আজও জন্মেনিক এই ধারায়,

তুমিই হবে সেই সে মানুষ অধ্যবসায়, তপস্যায়।

সূর্য-সম শেষ জীবনে রাঙিয়ে যাবে দিগি¦দিক্,

যুক্ত করে বিশ্ব-নিখিল গাইবে তোমার মাঙ্গলিক।

‘লক্ষèী ছেলে তাই তোলে’ কবিতাটি অভিযানমূলক। খোকা এখানে সমস্ত বাঁধা নিষেধ উপেক্ষা করে বিশ্বময় বেরিয়ে পড়তে চায়,

ঘরের আড়াল ভেঙ্গে এবার বাহির ভুবন লুটতে চাই;

জীনব হলো জেল-কয়েদি টেনে সর্বদাই।

নিষেধ বাঁধা মেনে মেনে বুকের ভিতর ধরল ক্ষয়,

প্যাঁচার চেয়েও হলাম অধম, সন্ধ্যে রাতে চলতে ভয়।

একটু বয়স হলে পন্ডিত মশায়ের রক্ত নেত্রে খোকা নিরুৎসাহ হয়ে পড়ে। অভিভাবকের দল খোকার মঙ্গলের ভয়ে ঘর হতে বাইরে বেরুতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।

কবিতাটিতে খোকার মা, অভিভাবক এবং পন্ডিত মশাই খোকার মঙ্গল কামনায় সব কাজেই বাধা দেন ও নিরুৎসাহী করেন। এখানে মাতু¯েœহের আতিশয্যে শিশুর চলার পথ পায়ে পায়ে বিঘিœত হয়। তাই সে বড় হয়ে বীর তথা দেশের গৌরব বয়ে আনতে পারে না,

যৌবনে সে বীর হল না দেশের গরব? মার কোলে

বিশ বছরে তুলছে পটল? লক্ষèী ছেলে তাই তোলে।

‘কিশোর স্বপন’ একটি স্মৃতিচারণমূলক কবিতা। এই কবিতার নায়ক যৌবনের মাঝগগনে পৌঁছে বেনুবাদ্যরত কিশোরদের মাঝে আপন কৈশোরকে অবলোকন করে আনন্দিত হয়েছে। কৈশোর থেকে যৌবনে উত্তরণের বেদনায় সে বেদনার্ত,

ফোট ফুল আজ স্বপ্ন দেখে নয়ন বুজে,

কোরক-বেলায় বিকাশ বেদন বেড়ায় খুঁজে।

কিশলয়ের পাতার ফাঁকে

খুঁজে বেড়ায় আপনাকে,

অতীত দিনের পথের বাঁকে

তোদের সাথে হারিয়ে গেনু ॥

‘প্রার্থনা’ প্রার্থনামূলক কবিতা। খোদার কাছে নিজেদের তথা সকলের ভাল কামনা কবিতাটির উপজীব্য,

আমাদের ভালো করো হে ভগবান!

সকলের ভালো করো হে ভগবান ॥

মন থেকে হিংসা ও ক্লেশ দূর করে পরস্পরের প্রতি ভালবাসাবাসিতে পৃথিবী স্বর্গে পরিণত হবে। ভগবানের কাছে শিশুর প্রার্থনা- জ্ঞানের আলো ও বিপুল শক্তি- যেন তার প্রদত্ত জ্ঞানে শিশু তাঁকে চিনে নিতে পারে ও তাঁর শক্তি কাজে সহায় হয়। এই পর্যায়ে কবি অত্যন্ত ধর্মভীরু। কেননা,

ধর্ম যদি সাথী হয়

রবে না ক দু:খ ভয়।

বিপদে পড়িলে তুমি করো যেন ত্রাণÑ

হে ভগবান ॥

‘মুকুলের উদ্বোধনী’ উদ্বোধনমূলক কবিতা। কোন বালিকা বিদ্যালয়ের পারিতোষিক বিতরণী অনুষ্ঠানে পঠিত বলে সম্পাদক আবদুল কাদির মনে করেন। বিদ্যার মহিমায় আজ ভারত মাতার আসন টলে উঠেছে। জ্ঞানবিদ্যার সংস্পর্শে ছোট ছোট বোনেরা আজ প্রাণচাঞ্চল্যে জেগে উঠেছে, দেখে কবির মন ভরে উঠেছে,

আজ কি বাণীর সোহাগটুকুন লুটলি তোরা লুটলি হায়,

গরবিনী বোনগুলি মোর তাদের দেখে চোক জুড়ায়।

কিসের এত আনন্দ আজ জান কি তা জান বোন

লক্ষèী যত মেয়েদের আজ জ্ঞান-মুকুলের উদ্বোধন।

নজরুল নারী শিক্ষাকে উৎসাহিত করেছেন। মেয়েরা সব দুঃখজয়ের ক্ষমতা রাখে। সব দুঃখজয় করে ভালভাবে পড়াশুনা শিখলে মেয়েরাই দারিদ্র্যের কুটিরে রাজ বিভব আনতে পারবে।

যে সময়ে বৃটিশ শাসিত পরাধীন ভারতবর্ষে মুসলমান রমণীদের মধ্যে শিক্ষার হার অনেক কম ছিল সেই সময় রচিত এই কবিতাটি নারী শিক্ষাকে প্রচুর উৎসাহ জুগিয়েছিল।

‘আগা মুর্গী লে কে ভাগা’ অতি উপভোগ্য হাস্য রসের কবিতা। কবিতাটির মুখ্য চরিত্র আগা একজন অর্থব্যবসায়ী আফগানী। এদেশে এরা কাবুলিওয়ালা বলে পরিচিত। এরা চড়া সুদে টাকা ধার দেয়। নজরুল এদের নিয়ে কিছু নির্মল কৌতুক করেছেন। কবিতার এক অংশে আগা গাছে চড়ে জাম খাওয়ার সময় জাম ভেবে একটি ভোমরা মুখে পুরে খেয়ে ফেলে। ভোমরাটি যখন যন্ত্রণায় চুঁ চুঁ আওয়াজ করে আগা তখনও নিজের ভুল বুঝতে পারে না। সে কালো রঙের সব কিছু খেয়ে ফেলবেÑ কোনো আপত্তিই শুনবে না। কবিতাটির শেষ অংশ উপভোগ্য,

ও পাড়ার   হীরু তোমায়               দেখেই পালায়            পগার পারে,

‘রুপিয়া      লে আও’ বলে        ধরলে তাহার              ছাগলটারে।

দেখিয়াই    মট্রু মিঞার মুর্গী লুকায়  ঝোপের আড়ে

তাই কি      ছেলে মেয়ে               মুর্গী চোরা                  বলে ডাকে ॥

‘মায়া-মুকুর’ একটি প্রেরণামূলক কবিতা। সৃষ্টির আদিকাল হতে জগতের তাবৎ মুনি-ঋষিরা আপন মনের দর্পণে নিজেকে যাচাই করে নিতে চায়।

আজকের বালক-বালিকারা শরীরে সারা বিশ্বের ছায়া পড়েছে। শরীর ছোট হলেও তাদের মধ্যে সৃষ্টি বৈচিত্র্যের বিপুল সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে কেননা,

তুমি হতে পার মহাযোগী, মহামুনি, ঋষি, অবতার,

তুমি হতে পার লেনিন, কামাল, সাজিয়াৎ, হিটলার।

তুমি হতে পার কৃষ্ণ, বুদ্ধ, রামানুজ, শংকর,

প্রতাপাদিত্য, শিবাজী, সিরাজ, রানাপ্রতাপ, আকবর।

তুমি হতে পার রবীন্দ্র, অরবিন্দ, বিবেকানন্দ

দেখিবে, রয়েছে অনন্ত গাঁথি সুভাষ তোমাতে বন্ধ।

ভগবানের যে অসীম শক্তি তোমাতে তাহা বিরাজে,

বুঝিবে তোমার স্বরূপ দেখিলে মায়া-মুকুলের মাঝে।

নিজেকে ছোট ভাবলে কাজের পূর্ণতা আসে না। শিশুর মধ্যেই বড় ও মহৎ কর্মের প্রেরণা লুকিয়ে আছে কেননা সে বিপুল কর্মশক্তি নিয়ে পৃথিবীতে নেমে এসেছে। এই মানুষই দিব্যশক্তি বলে শক্তিশালী হতে পারে। ইচ্ছা করলেই সে ব্রহ্ম বিষ্ণু বা শিব হতে পারে। অজ্ঞানতা বা ক্ষুদ্রগন্ডি পেরিয়ে মানুষের ভিতর যে মহামানব রয়েছে তাকে জাগিয়ে তুলতে হবে। তাই কবি প্রেরণা জাগান শিশুর মাঝে,

তুমি নও শিশু দুর্বল, তুমি মহৎ ও মহীয়ান

জাগো দুর্বার, বিপুল, বিরাট, অমৃতের সন্তান।

‘ফ্যাসাদ’ একটি ব্যঙরসাত্মক কবিতা। পেসাদ নামের ছেলেটি একজন জীবনবিমুখ বালক। সে এই দুনিয়াতে বেঁচে থাকাটাই মস্ত ফ্যাসাদ বলে মনে করে,

শয্যা ছেড়ে নিত্য ভাবে গোমরা-মুখো পেসাদ,

এই দুনিয়ায় বেঁচে থাকা মস্ত একটা ফ্যাসাদ।

ভোরবেলা ঘুম থেকে ওঠা সে ঝামেলা বলে মনে করে। স্কুলের গুরুমশাই তার কাছে ‘জুজু’ বলে মনে হয়। পাঠশালাতে নামতা বলা এবং অংক কষা সবই তার কাছে বিরক্তিকর। বাড়ী এবং স্কুলের নিয়ম-শৃংখলা ও অনুশাসন কিছুই তার ভাল লাগে না; তার ভাল লাগে পাড়া বেড়াতে।

বাবা মায়ের ভয়ে সে প্রাণ খুলে হাসতে পারে না। আমবাগানে সে স্বাধীনভাবে ঘোরাফেরা করতে পারে না, সর্বত্রই তার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ। পরিশেষে,

বেঁচে থাকার ফ্যাসাদ দেখে পেসাদ ভাবে মনে,

আজ বাদে কাল চলে যাবে অনেক সে দূর বনে।

কিংবা হবে তালগাছে যে দানো একানোড়ে,

রাত্রি হলে বসবে এসে সবার ঘাড়ে চড়ে!

কিলিয়ে তাদের ভূত ভাগাবে, বলবে এ কি ফ্যাসাদ

নাকি সুরে বলবে তখন ‘ফ্যাঁসাদ নয়, এ পেঁসাদ’।

নজরুলের শিশু সব-সময়ই স্বাধীনতা ভালবাসে। কবিতাটি যৌথ ভোগের। শিশু ও বয়স্ক উভয়ই আমোদিত হয় কবিতাটি পড়ে।

‘আগুনের ফুলকী ছুটে’ কাব্যিক সৌন্দর্য আর ছন্দের ঝংকারে উপভোগ্য কবিতা। এটি গীতধর্মী। এর সূচনাভাগের কাব্যিক সৌন্দর্য,

আগুনের ফুলকি ছুটে,  ফুলকি ছুটে!

ফাগুনের ফুলকি ফুটে  নব যুগ পত্রপুটে

ফাগুনের ফুল কি ফুটে।

আগুনের ফুলকি ছুটে ফুলকি ছুটে“

উল্কার উলকি লেখায়

নিশীথে পথ কে দেখায়?

আকাশে হজরত আলির

আগ্নেয় ‘দুল দুল’ কি ছুটে?

আগুনের ফুলকি ছুটে   ফুলকি ছুটে!

‘আবাহন’ বাৎসল্য রসের কবিতা। দার্শনিক তত্ত্বের জন্য বিখ্যাত। এতেও শিশুর আবির্ভাব পথের কথা বলা হয়েছে। পূর্বের আলোচিত ‘শিশু যাদুকর’ ও ‘কোথায় ছিলাম আমি’র সগোত্র। তবে এখানে তত্ত্ব আরো গভীর ও প্রত্যক্ষ। ‘জন্ম কথা’১০র মায়ের শিশু ইচ্ছে হয়ে তাঁর মনের ভিথর লুকিয়ে ছিল আর ‘আবাহন’ এর মা স্পষ্টই বলেনÑ তাদের সকল ইচ্ছার মূর্তি নিয়ে শিশুর আবির্ভাব ঘটেছে। তিনি শিশুর মধ্যে তার শৈশব সত্তাকে ফিরে পান। ‘আবাহন’ এর শিশু সার্বজনীন, সর্বকালীন সকল মায়ের ’সকল ইচ্ছার’ প্রতীক,

মোদের বুকের কামনায় কি সুপ্ত ছিলি ওরে,

শিশু হয়ে এলি সকল ইচ্ছা মূর্তি ধরে।

আমার ‘আমি’ হারিয়ে ফেলে পেয়েছি আজ ফিরে,

বহুদিনের হারিয়ে যাওয়া আমার ‘আমি’ টিরে।

‘আবাহন’ ১৯২২ সালে প্রথম প্রকাশিত। বাৎসল্য রসের কবিতা হলেও প্রকাশকাল দেখে বোঝা যায় এটি তাঁর প্রাগ্দাম্পত্য জীবনের রচনা কিন্তু কবিতাটিতে নবজাতককে কেন্দ্র করে মায়ের যে অনুভূতি ব্যক্ত হয়েছে কুমার নজরুল তাকে তাঁর কবি প্রতিভার বলে বিস্ময়করভাবে স্বাভাবিক রূপ দিয়েছেন।১১

কবিতাটি শিশুদের জন্য রচিত হলেও দার্শনিক তত্ত্বের কারণে বোধ্যতার দিক হতে শিশুর নাগালের বাইরে রয়ে যায়।

‘আবীর’ একটি প্রেরণামুলক কবিতা। এই দেশের শীতের জর্জরতা নেমে এসেছে। জরা-জীর্ণে ভরে উঠেছে সব কিছু। গানের আবীর ছড়াতে কবি আহ্বান জানিয়েছেন শিশুদের। এই পৃথিবী আবার ফুল ও ফলে ভরে উঠুক এবং ফাগুন হেসে উঠুক,

ছড়াও ছড়াও গানের আবীর শীত জর্জর দেশে,

রাঙিয়া উঠুক জীর্ণ ও জরা, ফাগুন উঠুক হেসে।

আবার পুষ্প পরøবহীন শীর্ণ তরুর শাখা

হউক পূর্ণ কুঁড়ি কিশলয়ে, পরাগের ফাগে মাখা।

এই পৃথিবী নতুনের রঙে রঞ্জিত হয়ে উঠবে। দেশ যখন ঘুমে অচেতন তরুণের আঁখি তখনও জেগে থাকে তারাই অশোক কৃষ্ণচূড়ার রঙে পৃথিবী রাঙিয়ে তুলবে।

‘লাল সালাম’ কবিতাটিতে সরস্বতী পূজার উদ্বোধনী গেয়েছেন কবি। আজ নতুনের উদ্বোধন। দিকে দিকে আজ জ্ঞানের দেবতা জেগে উঠেছে,

আজ নতুন

উদ্বোধন

বীন্-পাণির

সুর-বাণীর।

প্রকৃতিতেও আজ তার আয়োজন। ভাবে মোহিত হয়ে পাখি গান গাচ্ছে। এই বিশেষ সময় প্রতি বছর নতুন জামা ও বই প্রাপ্তি ঘটে। গুরুজনে ভক্তি করতে হবে। নইলে সুখ প্রাপ্তি কোথাও ঘটবে না। সুতরাং,

এই সভায়

আজ সবায়

কর প্রণাম

লাল সালাম।

বাহ্বা কি

আজ খুশি!

এমনি জোর

সব বছর

চাই হাসি

আর খুশি!

‘বর প্রার্থনা’ একটি ব্যতিক্রমধর্মী রচনা। ব্যঙ্গাত্মক এই কবিতাটি সমকালীন যুগযন্ত্রণার সাক্ষী। এটি রচিত হয় সম্ভবত দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের প্রথম দিকে। যখন একদল সুবিধাবাদী সুবিধা আদায়ে ব্যস্ত। আলোচ্য কবিতাতে দেবী দুর্গার কাছে বরপ্রার্থী কোনো ভক্তের জবানী বিবৃত। ‘তার কাম্য বস্তু মোক্ষ নয়, ঐহিক স্বাচ্ছন্দ্য।’ যার স্বরূপ,

ঐ খাঁড়াটা নিয়ে মা তোর করতে পারিস তাড়া?

বাড়িওয়ালা আসবে যখন চাইতে বাড়ী ভাড়া?…

 

রাত্রে যেন কামড়ায় না মা, ছাড়পোকা আর মশা,

আর দিনের বেলায় সইতে না হয়, গায়ে মাছি বসা।…

‘এস মধু মেলাতে’ কবিতায় কবি শিশুদের আহ্বান জানিয়েছেন শারদ প্রভাতের দুর্গাপূজার উৎসবে বালক-বালিকা, কিশোর-কিশোরীকে আহ্বান জানিয়েছেন পূজার আনন্দোৎসবে যোগ দিতে। নজরুল শিশুকে দেখেছেন শক্তিরও প্রতীক রূপে। যত প্রৌঢ় ও জরাজীর্ণ আছে তাদের অন্তর্নিহীত শক্তিকে জাগিয়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন,

এস মধু-মেলাতে

খেলতে ও খেলাতে

প্রৌঢ় ও জরাজীর্ণ যত বৃদ্ধে

লয়ে তনু ভরা তৃপ্তি, শক্তির দীপ্তি,

ডেকে আনো সাথেÑ ঐশ্বর্য-সমৃদ্ধে।

‘মা এসেছে’ কবিতায় এক বছর পরে আবার পূজা ফিরে এসেছে। হিন্দুধর্মে দুর্গাপূজা অর্থ মঙ্গল ও কল্যাণের দেবীর ফিরে আসা। মায়ের আসার খুশিতে দিকে দিকে আনন্দ ও বাদ্য বেজে উঠেছে।

নজরুল কোন ধর্মকেই ছোট করে দেখেননি। সব ধর্মের উৎসব ও আনন্দকেই আন্তরিকতার সাথে গ্রহণ করেছেন। তিনি কাজ ফেলেও এই দিনে বেহিসাবী খরচ করতে বলেছেন। কেননা আগামী বৎসর এই দিনের উৎসবে আবার যোগদান সম্ভব নাও হতে পারে,

এক বছরের অতৃপ্তি ভাই

এই ক দিনে কিসে মিটাই,

কে জানে ভাই ফিরব কি না আবার মায়ের কোলে,

আনন্দ আজ আনন্দকে পাগল করে তোল ॥

‘বগ দেখেছ’ কবিতাটি কৌতুক রসের কবিতা। বগ একটি সাদা রংয়ের পাখি। বাংলা অক্ষর ‘দ’ এর মত। এটি বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের জলাশয়ের পাখি। এখানে বগের আকৃতি যত রকমভাবে বানানো যেতে পারে তার বাস্তব ও চমকপ্রদ বর্ণনা দেয়া হয়েছে। নীচে তার কিছু অংশ উদ্ধৃত হল,

বগ অর্থাৎ বগলা অর্থাৎ কুঁজো সাদা পাখি।

রামার বুড়ো, দাদা মশাই, মামার খুড়ো

থুথ্থুড়ো নুন্নুড়ো যেমন সুটকো বাঁকা!…

বুঝলে না কো? আচ্ছা রোসো, উবু হয়ে সামনে বসো,

কাছিম যেমন বাড়ায় গলা তেমনি করে ঘাড়টা বাঁকাও

বাঁ হাতটা গুটিয়ে রেখে উপর দিকে কেৎরে তাকাও

ঠোঁট দুটোকে ঘোঁচ করম এই চষ্ণু হল,

এমনিতর বগ দেখেছ? দেখনি ক? কি যে বল!

একটি সাধারণ পাখিকে নিয়ে নজরুল সুকৌশল বর্ণনায় এবং শব্দাদির সুনিপুণ প্রয়োগে একটি পরম উপভোগ্য শিশুতোষ কবিতা রচনা করেছেন।

‘গদাই এর পদবৃদ্ধি’ একটি হাস্যরসের কবিতা। এখানে গদাই এর পদবৃদ্ধি অফিসে নয় বরং ঘরে।

গদাই এর যখন দু’পা ছিল অর্থাৎ বিয়ের পূর্বে তখন যে এখানে সেখানে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতো। বিয়ের পর হ’ল চার পা, এরপর যখন বাচ্চা হল তখন ক্রমেই ছয় পা হতে আট পায়ে পরিণত হল এবং তখন যে একটি কেন্নোয় পরিণত হল তার গতি হল মন্থর। কবিতাটির শেষাংশ উল্লেখযোগ্য,

মানুষ থেকে চার পেয়ে জীব, শেষ ছ’ পেয়ে মাছি,

তারপর আটপেয়ে পিঁপড়ে, গদাই বলে গেছি!

কেন্নোর প্রায় গদাই

ছুঁলেই এখন জড়সড় জবড়জঙ সদাই।

‘মোবারকবাদ’ ১৯৪৫ খৃষ্টাব্দে প্রকাশিত হয়। ‘নতুন চাঁদ’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। এটি একটি আদর্শবাদী কবিতা। তিনি এতে ‘মুকুলের মহফিল’ এর সভ্যদের উদ্দেশ্যে উদ্বোধনী হিসেবে কিছু মূল্যবান নীতিমূলক উপদেশ দেন।

নজরুল গোলামীর বিরুদ্ধে; হীনমন্যতার বিরুদ্ধে ছোটদের মন্ত্র শিখিয়েছেন এ কবিতায়,

গোলামীর চেয়ে শহীদী দর্জা অনেক উর্দ্ধে জেনো;

চাপরাশির ঐ তক্মার চেয়ে তলোয়ার বড় মেনো।

আার কাছে কখনো চেয়োনা ক্ষুদ্র জিনিস কিছু

আল্লাহ ছাড়া কারও কাছে কভু শির করিও না নিচু!

বয়স্কের অপূর্ণ কাজ পূর্ণ করার আহ্বান জানিয়েছেন কবি শিশুদের। তিনি এর জন্য শুধু আল্লাহর কাছে সাহায্যের হাত পাততে বলেছেনÑ কোন মানুষের কাছে নয়। কেননা,

গোলামের ফুলদানীতে যদি এ মুকুরে ঠাঁই হয়

আল্লাহর কৃপা বঞ্চিত হব, পাব মোরা পরাজয়।

‘অমর কানন’ ১৩৩২ সালে প্রকাশিত ‘ছায়ানট’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। এই কবিতাটি নজরুল ১৯২৫ সালে, বাঁকুড়া জেলার একটি বিদ্যালয়ের ছাত্রীদের জন্য লিখেছিলেন। বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয় অমর নামক এক তরুণের প্রচেষ্টায়। কবিতাটিতে আছে বিদ্যালয়ের পরিবেশ আর ছাত্রদের কাজকর্মের বর্ণনা। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য বাঁকুড়া জেলার গঙ্গাজলে ফঁটি নদী, পাহাড়, বন ও মাঠঘেরা নৈসর্গিক সৌন্দর্যের গ্রামীণ পরিবেশে স্থাপিত অমর কানন বিদ্যালয়ের ছেলেদের উদ্দেশ্যে গানটি রচিত।

অমর কাননের একাংশ,

… দূর প্রান্তর ঘেরা আমাদের বাস,

দুধ-হাসি হেসে হেথা কচি দুব্-ঘাস,

উপরে মায়ের মত চাহিয়া আকাশ

বেনু-বাজা মাঠে হেথা চরে ধেনুগণ ॥

মোরা        নিজ হাতে মাটি কাটি, নিজে ধরি হাল,

সদা           খুশি-ভরা বুক হেথা হাসি ভরা গাল,

মোরা        বাতাস করিগো ভেঙ্গে হরিতকি ডাল,

হেথা         শাখায় শাখায় শাখী, গনের মাতন ॥

নজরুল ইসলাম ১৯৩৫ সালের ৩১শে জুলাই স্কুল পাঠোযোগী ‘মক্তব সাহিত্য’, গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। ‘মোনাজাত’, ‘মৌলবি সাহেব’, ‘চাষী’, ‘হজরতের মহানুভবতা’, ‘ঈদের চাঁদ’ কবিতা আলোচ্য গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত করেন।

মোনাজাত

(সুরা-ফাতেহা)

শুরু করিলাম লয়ে নাম আল্লার

করুণা ও দয়া যাঁর অশেষ অপার।

*                    *                  *

সকলি বিশ্বের স্বামী আল্লার মহিমা

করুণা কৃপার যাঁর নাই নাই সীমা।

বিচার-দিনের খোদা! কেবল তোমারি

আরাধনা করি আর শক্তি ভিক্ষা করি।

সরল সহজ পথে মোদের চালাও

যাদের বিলাও দয়া সে পথ দেখাও।

যারা অভিশপ্ত পথভ্রষ্ট এ জগতে

চালায়োনা খোদা যেন তাহাদের পথে।

‘সুরা ফাতেহা’ পবিত্র কোরান শরীফের ৩০ নং অধ্যায়ের পদ্যানুবাদ। অত্যন্ত সহজ, সরল ভাষায় অনূদিত বলে নজরুল ইসলাম কবিতাটি আলোচ্য গ্রন্থের   অন্তর্ভুক্ত করেছেন। আল্লাহ্র গুণকীর্তন এবং তাঁর কৃপালাভ এ কবিতাটির উপজীব্য। ‘মৌলবী সাহেব’ একটি নীতিবাদী কবিতা। কবিতাটি স্কুলপাঠ্য। মৌলবি সাহেবের গুণকীর্তন ছাড়া বিশেষ কিছু পাওয়া যায় না কবিতাটিতে। কবিতাটির প্রথম ও শেষাংশ,

ওয়ালেদেরই মতন বুজুর্গ

মক্তবের ঐ মৌলবি সাহেব

তাই – উহারে কেতাবে কয়

“হজরত রসুলের নায়েব।”

*                             *                             *

শিক্ষা দিয়ে দীক্ষা দিয়ে

ঢাকেন মোদের সকল আয়েব

পাক কদমে সালাম জানাই

নবীর নায়েব মৌলবি সাহেব।

কবিতাটি প্রসাদগুণে অসচ্ছল।

‘চাষী’ কবিতাতে কবি চাষীকে সম্মান করতে বলেছেন। কেননা চাষীরা মেহ্নতের ফসল না পেলে আমরা ক্ষুধায় অন্ন পেতাম না,

চাষীকে কেও চাষা বলে

করিও না ঘৃণা,

বাঁচতাম না আমরা কেহ

ঐ সে কৃষাণ বিনা।

রৌদ্রে পুড়ে ও বৃষ্টিতে ভিজে সে আমাদের ক্ষুধার অন্ন জোগায়, বিনিময়ে সে যশখ্যাতি কিছুই চায় না। এটিও প্রসাদগুণে অসচ্ছল এবং বিদ্যালয়ের পাঠ ছাড়া তেমন মুল্য নেই।

‘হজরতের মহানুভবতা’ হজরতের গুণকীর্তনমূলক রচনা। আলোচ্য কবিতায় কবি অত্যন্ত সহজ সরল ভাষায় তাঁর মহানুভবতা প্রকাশ করেছেন। একদা হজরতের ঘরে ভিক্ষার ঝুলি হাতে ভিক্ষুক এসেছে ভিক্ষা করতে। হজরতের নিজের ঘরেই কিছু নেই জেনে লজ্জিত ভিক্ষুক যখন ফিরে যাচ্ছিলেন তখন হঠাৎ তিনি আবার তাঁকে ডেকে বললেন,

ভুলিয়া গেছিনু, ফিরে এস তুমি, আছে আছে কিছু ঘরে,

উসমান কিছু দুধ পাঠায়েছে হাসান হোসেন তরে।

তাই এনে দিই, তুমি কর পান।

হজরত নিজে অভুক্ত এবং তাঁর নাতীদ্বয় হাসান হোসেনের মুখ হতে দুধের বাটি তুলে যখন ভিখারীর হাতে দেন ; তখন তাঁর এই ত্যাগ ও মহানুভবতায় বিশ্বমানবতা হতবাক হ’য়ে পড়ে।

হজরতের চরিত্র রূপায়নের মাধ্যমে নজরুল শিশু মনে ত্যাগ ও মহানুভবতার মহান চিত্র অংকন করেছেন। স্কুলেপাঠ্য হওয়ায় কবিতাটির ভাব ও ভাষা সরল ও স্বচ্ছন্দ।

‘ঈদের চাঁদ’ নজরুলের স্কুল পাঠ্য শিশুতোষ কবিতা। শিশুদের উদ্দেশ্যেই রচনা করেছেন বলে এর ভাব, ভাষা, ছন্দ অত্যন্ত সহজ ও সরল।

একমাস সিয়াম সাধনার পর ঈদের চাঁদ সব মুসলমানের জীবনেই আনন্দের বার্তা বয়ে নিয়ে আসে,

রমজানেরই রোজার শেষে

উঠেছে আজ ঈদের চাঁদ

চারদিকে আজ খুশির তুফান

নাই ভাবনা নাই বিষাদ।

শিশুমনে আল্লাহ্ এবং রাসুলের প্রতি একগ্রতা জাগ্রত করেছেন কবিতাটিতে।

নজরুল-শিশু-কাব্য সাহিত্য ঘুমপাড়ানী গান এবং শুধু শুষ্ক নীতিবিদ্যা না শুনিয়ে শিশুকে বাস্তবের দ্বন্দ্ব-সংঘাতের সাথে পরিচয় করিয়েছেন। ফলে তাঁর রচিত কিছু সংখ্যক শিশু কবিতা ক্লাসিক্সের মর্যাদা পেয়েছে।

তিনি শিশুপোযোগী বিষয়বস্তু উপস্থাপন করেছেন। শব্দচয়নে সাহিত্যের রস পরিবেশন করেছেন।

তাঁর জাগরণমূলক কবিতাতে শুধু ভোরবেলার জাগরণই নয়। এই জাগরণ আত্মার জাগরণ শিশুর ন্যায় সংগত অধিকারসমূহ আদায়ের জন্য চিত্তের জাগরণ।

নজরুল তাঁর অসাধারণ কল্পনাশক্তির বলে খুব সাধারণ জিনিসকে অসাধারণ মর্যাদা এনে দিয়েছেন। সুরসিক বিশ্লেষণী পর্যবেক্ষণে আর মন্তব্যে কিছু কবিতা হাস্যকর হয়ে উঠেছে, তা কেবল তাঁর অসাধারণ কল্পনাশক্তির বলেই সম্ভব হয়েছে। বক্তব্য এখানে সিরিয়াস হলেও, আদর্শবাদী কবিতার ক্ষেত্রে রচনাভঙ্গি বলিষ্ঠতর এবং আদর্শ ঋজুরেখ ও স্পষ্টবাক্।

কবিতা রচনার মূল কথা হল কবিতার কাব্যিক সৌন্দর্য ও ছন্দের ঝংকার। এক্ষেত্রে তাঁর সৌন্দর্যসৃষ্টিমূলক কবিতা কাব্যিক লাবণ্যে ঝলমল, তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিশুতোষ কীর্তি। নায়কের আংগিক ত্রুটি আর উদ্ভট আচরণ এবং নজরুলের নিজস্ব গড়া কিছু শব্দ দিয়ে নজরুল যে, হাস্যরসের সৃষ্টি করেছেন তা শিশু কাব্য সাহিত্যে তাঁর আগে কেউ পরিবেশন করেননি। নজরুলের এসব ছন্দিত রচনা লিখেছিলেন শিশু কিশোরদের প্রেরণা দানের জন্য; কিছু আবার আনন্দ দানের উদ্দেশ্যে।

নজরুল কিশোরসুলভ অনুসন্ধিৎসা নিয়ে যে সমস্ত কবিতা লিখেছেন তাতে কল্পলোকের বিস্তার ঘটিয়েছেন। শিশুর কল্পনাশক্তি ও চিন্তার জগৎকে বহুলাংশে বাড়িয়ে দিয়েছেন। অভিযানমূলক কবিতায় শিশুকে দুঃসাহসী করেছেন নিজের দেশকে ও বিশ্বকে জানবার অভিপ্রায়ে। দার্শনিক তত্ত্বের কবিতাগুলিতে শিশুকে দেখেছেন নতুন প্রভাতের ও শক্তির প্রতীকরূপে। হাস্যরসের কবিতার বর্ণনা    বাস্তবমুখী ও চমকপ্রদ।

‘মক্তব সাহিত্য’ স্কুলপাঠ্য হওয়াতে এর ভাষা সহজ ও সরল। ছাত্রদের চারিত্রিক গঠনের উদ্দেশ্য এখানে তিনি নীতিশিক্ষার অবতারণা করেছেন এবং নীতিকে যথাসম্ভব আনন্দের সাথে পরিবেশন করেছেন। কিছু কবিতা বিষয়ের দিক হতে সাময়িক হলেও সুখপাঠ্য হয়েছে।

শিশুকাব্য রচনার ক্ষেত্রে নজরুলের সৃষ্টি প্রয়াস নিতান্তই স্বল্প। কিন্তু বিষয়ের বৈচিত্র্যে ও কাব্যগুণে প্রসাদে এই স্বল্প সৃষ্টি প্রয়াস বাংলা শিশুকাব্য সাহিত্যে ভিন্নতর ও স্থায়ী স্বাদ এনে দিয়েছে।

 

পাদটীকা

১-৭          আতোয়ার রহমান, ‘নজরুল বর্ণালী’, প্রকাশকাল ফাল্গুন, ১৪০০।  প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ, সহকারী পরিচালক, নজরুল ইন্সটিটিউট।

৮              সুকুমার রায়, ‘খাই খাই’ কাব্যগ্রন্থ, প্রকাশকাল : ২১শে সেপ্টেম্বর, ১৯৫০। প্রকাশক সিগনেট প্রেস, ১০/২ এলিগেন রোড, কলকাতা।

৯-১০        রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ‘শিশু’ কাব্যগ্রন্থ। ১৩১০ সালে প্রকাশিত। মোহিতচন্দ্র সেন সম্পাদিত।

১১            আতোয়ার রহমান, ‘নজরুল বর্ণালী’, প্রকাশকাল ফাল্গুন, ১৪০০।  প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ, সহকারী পরিচালক, নজরুল ইন্সটিটিউট।

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

নজরুলের শিশুতোষ গান

শিশুতোষ গান রচনার ক্ষেত্রে নজরুলের উদ্যোগ প্রায় ছিল না বলা চলে। তবু দুই-চারটি গান ‘প্রজাপতি’, ‘ঘুমপাড়ানী গান’, ‘লাল নটের ক্ষেত্রে লাল টুক্টুকে বউ’, ‘ত্রিভুবনের প্রিয় মোহাম্মদ’ শিশুদের উদ্দেশ্যেই রচিত। গানগুলি নজরুল রচনাবলীর ‘গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত কবিতা ও গান’-এর অন্তর্ভুক্ত।

প্রজাপতি গানটি দেশী সুরে, দেশী ভাব অনুষঙ্গে রচিত- ‘প্রজাপতি’ গানে প্রজাপতির মত রঙিন পাখা শিশুও চায়। তার টুকটুকে লাল, নীল, আঁকা-বাঁকা পাখা পাওয়ার জন্য আজকের শিশু উদগ্রীব,

প্রজাপতি! প্রজাপতি! কোথায় পেলে ভাই!

এমন রঙিন পাখা!

টুকটুকে লাল নীল ঝিলিমিলি আঁকা বাঁকা

কোথায় পেলে এমন রঙিন পাখা।

প্রজাপতির বন্ধু হয়ে সে ফুলের মধু খেতে চায় অর্থাৎ বস্তুজগতের স্বাদ নিতে চায়। প্রজাপতির পরাগ মাখা শিশুও প্রত্যাশা করে, তার মন পড়াশুনা করর জন্যে পাঠশালাতে যেতে চায় না। কেবলই প্রজাপতির সাথে ঘুরে ঘুরে উড়তে চায়। প্রজাপতি যেভাবে হাওয়ায় নেচে নেচে আনন্দ পায় সেও তাই প্রত্যাশা করে। সাদামাটা জামা তার ভাল লাগে না। প্রজাপতির মত রঙিন জামা তার পছন্দ।

শিশুর জগৎ বর্ণালী। শিশুর পাঠশালা পড়াশুনা একঘেঁয়েমি ও বিরক্তিকর মনে হয়, সে ঘুরে ঘুরে রঙিন পৃথিবীকে জানতে চায়, দেখতে চায়। এর বস্তু জগতের স্বাদ নিতে চায়। গানটি ধ্বনি-প্রতিধ্বনি, দৃষ্টিভঙ্গি, শব্দ, আবহ সমন্বয়ে এক অপূর্ব সৃষ্টি।

নাম শুনে বোঝা যায় ‘ঘুম পাড়ানী গান’ শিশুকে ঘুম পাড়ানোর ছড়া। শিশুর ঘুম আসছেনা । দুষ্টু ছেলেরা সহজে ঘুমুতে চায় না। কিন্তু ছেলে না ঘুমানো পর্যন্ত মায়ের স্বস্তি নেই। শিশুকে ঘুম পাড়ানোর জন্য মা ঘুম পাড়ানী মাসি পিসিকে ডাকছেন। মাসি পিসিরা শিশুর আপনজন হয়ে থাকেÑ তাই মা শিশুকে একা ঘুম পাড়াতে না পেরে তাঁদের ডাকছেন এবং ঘুম পাড়ানীকে নানা রকম প্রলোভন দেখিয়ে ছড়াটি শেষ করেছেন। ছড়াটির কিছু অংশ নি¤েœ উদ্ধৃত হল,

ঘুম পাড়ানী মাসি পিসি ঘুম দিয়ে যেয়ো

বাটা ভরে পান দেবো গাল ভরে খেয়ো

ঘুম আয়রে, ঘুম আয় ঘুম।

আলোচ্য ছড়াগানটিতে দেশী সুরে, দৃষ্টিভঙ্গিতে, আবহে বাঙালীর দৈনন্দিন জীবনযাত্রার ছবি তুলে ধরেছেন।

‘লাল নটের ক্ষেতে লাল টুকটুকে বউ’ সহজেই পথিকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে,

লাল নটের ক্ষেতে লাল টুকটুকে বৌ যায় গো

(তার) আলতা পায়ের চিহ্ন একে নাল্তা শাকের গায় (গো)

লাল নটের ক্ষেতে মৌমাছি ওঠে মেতে

তার রূপের আঁচে পায়ের তলায় মাটি ওঠে তেতে।

লাল পুঁইয়ের লতা নুয়ে পড়ে জড়িয়ে ধরে পায় গো ॥

নালতা শাক, মৌমাছি, লাল পুঁই সবাই তার সখ্যতা কামনা করে। রাখাল ছেলেকে দেখে লজ্জায় তার পা জড়িয়ে যায়। গানটিতে গ্রাম্যসুর ঝংকৃত হয়েছে।

গানটির প্রধান চরিত্রধারণকারী কোন শিশু নয় তথাপি এর দৃশ্যপট এর বর্ণময় চিত্র ও নৃত্যময় ছন্দ শিশুমনকে সমভাবে বয়স্ককেও আকর্ষিত করে। গানটি দেশী সুরে, দেশী ঢঙে ও দেশী আবহে রচিত।

‘ত্রিভুবনের প্রি মোহাম্মদ’ গানটি যৌত ভোগের। এটি আরবী সুরের অনুসরণে লিখিত। মোহাম্মদ (দ:) এর আগমনে আকাশ বাতাসকে দেখবার আহ্বান ধ্বনিত হয়েছে,

ত্রিভুবনের প্রিয় মোহাম্মদ

এল রে দুনিয়ায়।

আয়রে সাগর আকাশ বাতাস, দেখবি যদি আয় ॥

বেহ্শেত ও পৃথিবীতে আজ খুশীর ঢল নেমেছে। সে ইসলামের বাণী নিয়ে এসেছে,

দেখ্ আমিনা মায়ের কোলে

দোলে শিশু ইসলাম দোলে,

কচি           মুখে শাহাদতের বাণী সে শোনায় ॥

দুনিয়াতে আজ হতে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা হল। জীন পরী ফেরেশতা সবাই আজ- ‘সাল্লাললাহু আলায়হি অ-সাল্লাম’ পড়ছে। গানটির সুর, তাল, লয় পাঠককে আচ্ছন্ন করে।

নজরুলের ‘ওরে হুলোরে তুই’, ‘শুকনো পাতার নূপুর পায়ে’, ‘চম্কে চম্কে  ধীর ভীরু পায়’ গানগুলি ১৩৪১ সালের বৈশাখ মাসে প্রকাশিত ‘গীতি শতদল’ গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। নজরুলের যৌথ ভোগের ব্যঙাত্মক ‘ওরে হুলোরে তুই’ একটি উৎকৃষ্ট গান। গানখানিতে সন্ত্রাসবাদী কোনো শেতাঙ্গ পুলিশ কর্মকর্তার প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে বলে মনে হয়। কবিতাটির প্রথম এবং শেষ অংশ,

ওরে          হুলোরে তুই রাত বিরেতে ঢুকিসনে হেঁসেলে।

কবে          বেঘোরে প্রাণ হারাবি বুঝিসনে রাস্কেল ॥

স্বীকার করি শিকারী তুই গোঁফ দেখেই চিনি,

গাছে কাঁঠাল ঝুলতে দেখে দিস গোঁফে তুই তেল।

ওরে ছোঁচা ওরে ওঁচা বাড়ী বাড়ী তুই হাঁড়ি খাস

নাদনার বাড়ী খেয়ে কোনদিন ধনে প্রাণে মারা যাস,

বৌষি যখন মাছ কোটেরে, তুমি খোঁজ দাও

বিড়াল-তপস্বী, আড়নয়নে থালার পানে চাও॥

তুই উত্তম-মাধ্যম খাস এত তবু হল না আক্কেল ॥

একে নিছক কৌতুকের গান বলেও ধরে নেয়া চলে। সেক্ষেত্রে নজরুল ইসলাম শিশু মনস্তত্ত্ব বোঝেন। এখানে তিনি বিড়ালের স্বভাব সম্বন্ধে শিশুদের অবহিত করেছেন। বিড়াল শিশুর প্রিয় প্রাণী। কম বেশী সবশিশুই বিড়ালকে কোলের কাছে নিয়ে আদর করতে পছন্দ করে। তাই এত কিছুর পরও বিড়ালের আক্কেল হয় না কেন এ নিয়ে তার মনে বড়ই কষ্ট।

নিছক আনন্দ দানের কিছু গান শিশু ও বয়স্ক উভয়কেই আমোদিত করে। আর একটি গান ‘শুকনো পাতার নূপুর পায়ে’ গানটি আরবি সুরের অনুসরণে লিখিত। গানটি সংক্ষিপ্ত আকারে উদ্ধৃত হল,

শুকনো পাতার নূপুর পায়ে

নাচিছে ঘূর্ণী বায়।

জল-তরংগে ঝিল্মিল্ ঝিল্মিল্

ঢেউ তুলে সে যায় ॥….

ইরানী বালিকা যেন মরু চারিনী

পল্লীর প্রান্তর-বন-মনোহারিনী

ছুটে আসে সহসা গৈরিক-বরনী

বালুকার উড়ৃনী গায়।

নজরুল খুব সাধারণ জিনিসকে অসাধারণ মর্যাদা দিয়েছেন। এ গানটি তার আরেকটি প্রমাণ। খুব সাধারণ মরা পাতা, ফুলকলি, বনফুল, বালুকা দিয়ে ইরানী বালিকাকে গহনার যে সাজ পরিয়েচেন তা যে কোন দামী গহনাকে হার মানিয়েছে। এর চঞ্চলতা, এর উদ্দামতা পল্লীর প্রান্তরকে যে সৌন্দর্য এনে দিয়েছে তা শুধু শিশুমনকে নয়, যে কোন বয়স্ক মনকেও আন্দোলিত করে।

আরেকটি গান ‘চমকে চমকে ধীর ভীরু পায়’ যৌথ ভোগের। এ গানটিও আরবী সুরের অনুসরণে রচিত,

চম্কে চম্কে ধীর ভীরু পায়

পল্লীর বালিকা বন-পথে যায়

একেলা বন-পথে যায়॥

শাড়ী তার কাঁটা লতায়

জড়িয়ে জড়িয়ে যায়,

পাগল হাওয়াতে অঞ্চল লয়ে মাতে

যেন তার তনু পরশ চায়

একলো বন-পথে যায় ॥

পল্লী মেয়েটির ধীর মন্থর গতি, তার শাড়ির আঁচল, তাঁর তনুর পরশ পেয়ে বনপথ ধন্য। তার নূপুরের ঝুমুর শব্দে কুসুমও ঝরে পড়তে চায়। তার কবরীতে পাখি গান গায়। তার নীল চোখ দেখে হরিণী লুকিয়ে পড়ে, মাধবীলতা তার হাতের কাঁকন হতে চায়। ভ্রমরা তার কালত্ব প্রমাণ করতে না পেরে তার চুলের মধ্যে লুকিয়ে পড়ে। এখানেও প্রকৃতির সাথে পল্লী বালিকার একাত্মতা উভয়ের মনকে আন্দোলিত করে।

আলোচ্য গানটি ১৩৪১ সালের আশ্বিন মাসে প্রকাশিত ‘গানের মালা’ গ্রন্থের    অন্তর্ভুক্ত। মিশরীয় নৃত্যের সুরের অনুসরণে যৌথ ভোগের গান ‘মোমের পুতুল মমীর দেশের মেয়ে’। গানটির কিছু অংশ,

মোমের পুতুল মমীর দেশের মেয়ে

নেচে যায়।

বিহ্বল চঞ্চল পায়॥

সাহারা মরুর পারে

খর্জুর বীথির ধারে

বাজায় ঘুমুর ঝুমুর ঝুমুর মধুর ঝংকারে

উড়িয়ে ওড়না “লু” হাওয়ায়

পরী নাচনী নেচে যায়

দুলে দুলে দূরে সুদূর ॥

মিশরের বালিকাকে কবি মোমের সংগে তুলনা করেছেন। তার নৃত্যচপল ছন্দ মরুভূমির ‘লু হাওয়ার’ রুক্ষতাকেও সজীবতা ও প্রাণচাঞ্চল্যে ভরে তুলেছে। ‘লু হাওয়া’য় তার উড়ন্ত ওড়না তাকে পরীর সৌন্দর্য এনে দিয়েছে। প্রকৃতি তার সৌন্দর্যের আভরণ মেয়েটিকে পরাতে পেরেছে বলে সে নিজেকে ধন্য মনে করছে।

আলোচ্য গানটি ১৩৩৯ এর ভাদ্র মাসে প্রকাশিত ‘জুলফিকার’ কাব্যগ্রন্থের      অন্তর্ভুক্ত। ইসলামী ভাবাদর্শে রচিত ‘তোরা দেখা যা আমিনা মায়ের কোলে’ যৌথ ভোগের আরেকটি গান,

তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে।

মধু পূর্ণিমারই সেথা চাঁদও দোলে॥

যেন ঊষার কোলে রাঙা রবি দোলে ॥

‘এক আল্লাহ্ ছাড়া কোন মাবুদ নাই’ এই গানে রসুলের সেই বাণী নজরুল আমাদের শুনিয়েছেন। হযরত মোহাম্মদ (দ:) এর আগমনে পৃথিবী আলোকে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে। তিনি মানুষের মধ্যে ধনী গরীবের বিভেদ দূর করেছেন ও বিশ্বমানবতার মুক্তির গান শুনিয়েছেন।

এই গানটি সুর, তাল, লয় এক অপূর্ব ব্যঞ্জনার সৃষ্টি করেছে।

নজরুলের ‘পুতুলের পিয়ে’ নাট্যগ্রন্থ ১৩৪০ সালে প্রকাশিত হয়। আলোচিত গানগুলি এই গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন নাটিকা, কথোপকথন জাতীয় রচনা ও সংলাপ হয়ে গান ধরে। খুব নির্ঝঞ্জাট পরিবেশে তারা পুতুল খেলতে বসে,

খেলি আয় পুতুল খেলা

বয়ে যায় খেলার বেলা সই।

বাবা ঐ যান আপিসে ভাব্না কিসের

খোকারা দোলায় ঘুমায় ঐ ॥

সন্তান কানা খোঁড়া ল্যাংড়া যাই হোক না কেন মায়ের চোখে সব সন্তানই সমান। পুতুলের বিয়েতে ছড়াগানের মাধ্যমে নজরুল মাতৃ¯েœহের সেই অমোঘ সত্যটি তুলে ধরেছেন,

ধন্ ধন্ ধন্ ধন্ মুরলি

এই ধন্কে দেখতে নারে কোন বেরালি!

ওকে কে বলে রে খ্যাঁদা,

তার চোখে লাগুক ধাঁধাঁ

খ্যাঁদা কি বলতে দেবো?

সোনা দিয়ে নাক বাঁধিয়ে দেবো ॥

ছড়াগানটির আঞ্চলিক সুর ও শব্দের প্রয়োগ লক্ষণীয়।

পুতুলের বিয়ের সম্বন্ধে পাকা হওয়ার পর তারা ছড়াগান ধরে পুতুলকে নাচায়,

পুঁটু নাচে কোন খানে

শতদলের মাঝখানে।

সেথায় পুঁটু কি করে,

ডুব গালি গালি মাছ ধরে।

মাছ ধরে আর ফুল পাড়ে

কুঁজোজালি দিয়ে মাছ ধরে ॥

মাছ ধরে আর ফুল পাড়ে

কুঁড়োজালি দিয়ে মাছ ধরে ॥

এই ছড়াগানের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি, সুর, শব্দ ও দৃষ্টিভঙ্গি সবই দেশী সুরের ভাব-অনুসঙ্গে গীত।

মাতৃ¯েœহের একটি ধর্ম এই যে সব মা-ই মনে করেন তার সন্তান যেন সুখে থাকে বিয়ের আগে এবং পরেও। সেকথাটিই পুতুলের বিয়ের মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে,

খুকুর দেবো বিয়ে-বেগম মহলে,

খুকু হবে বেগম সাহেব, বাঁদী সকলে।

খুকু হাতে পরবে হীরের বালা

গলায় পরবে মুক্তোর মালা।

সোনার খাটে থাকবে শুয়ে রূপোর মহলে

শতেক বাঁদী বাঁধবে চুল নাইয়ে গোলাব-জলে ॥

এখানেও আঞ্চলিক জীবনযাত্রা এবং সংস্কৃতি সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। ছড়াগানটি দেশী সুরে গীত।

শিশুদের আচার খুব প্রিয় খাবার। বিশেষ করে পুতুল বিয়ের অনুষ্ঠানে আচার না হলে আসর জমার তো কথাই নয়। তার সাথে কিছু দেশী রসালো ফলের সংযোগ আসরকে জমজমাট করে তুলেছে। ছেলে-মেয়েরা ছড়াগানের মাধ্যমে আঞ্চলিক দৃষ্টিভঙ্গি ও সংস্কৃতির পরিচয় তুলে ধরেছে,

কুলের আচার নাচার হয়ে

আছিস কেন শিকায় ঝু’লে

কাঁচের জারে বেচারা তুই

মরিস কেন ফেঁপে ফুলে ॥

কাঁচা তেঁতুল পেয়ারা আম

ডাঁশা জামরুল আর গোলাপ জাম

যেমনি তোরে দেখিলাম

অমনি সব গেলাম ভুলে ॥

কোন মেয়েই স্বামীকে ভাগাভাগি করে নিতে চায় না। মেয়ের মায়েরও কাম্য নয় সতীনের ঘরে তার মেয়ে বিয়ে দিতে। এই প্রসংগে নজরুল আঞ্চলিক ভাষা ও দৃষ্টিভঙ্গিতে সতীন-প্রথা-বিরোধী এক দীর্ঘ ছড়া শুনিয়ে দেন। ছড়াটির প্রথম ও শেষাংশ এখান উদ্ধৃত হল,

আয়না আয়না আয়না

সতীন যেন হয় না।

উদ্বেড়ালি ক্ষুদ খায়

স্বামী রেখে সতীন খায়।

বঁটি বঁটি বঁটি

সতীনের ছেরাদ্দের কুট্নো কুটি

অশথ্ কেটে বস্ত করি!

সতীন কেটে আল্তা পরি ॥

নজরুল ব্যঙাত্মক কবিতা লিখে যেমন শিশু মনে আনন্দ ও কৌতুকের খোরাক জুগিয়েছেন, তেমনি পুতুলের বিয়েতে উদ্ধৃত ছড়া গানটিতে চীনাদের চেহারা নিয়ে ব্যংগ করেছেন,

ঠ্যাং চ্যাগাইয়া প্যাঁচা যায়

যাইতে যাইতে খ্যাচ্খ্যাচায়

প্যাঁচায় গিয়া উঠল গাছ,

কাওয়ারা সব লইল পাছ।

প্যাঁচার ভাইশতা কোলো ব্যাং

কইল, চাচা দাও মোরে ঠ্যাং

প্যাঁচায় কয়, বাপ, বারিত যাও

পাছ লইছে সব হাপের ছাও

ইঁদুর জবাই কইর‌্যা খায়

বোঁচা নাকে ফ্যাচ্ফ্যাচায় ॥

আঞ্চলিক ভাষা প্রয়োগের সাথে সাথে নজরুল ছড়াটিতে পরিমিত ও পরিশীলিত হাস্যকৌতুক পরিবেশন করেছেন।

স্কুলের মাষ্টারদের নিয়ে নজরুল ব্যঙ্গাত্মক গানটি কমলির দাদার মুখে জুড়ে দিয়েছেন, যার কাজ কেবল হাস্যরস পরিবেশন। আলোচ্য কমিক গানটিতে তিনি হাস্যরত পরিবেশনের সাথে সাথে খুনসুড়িপ্রতিম কথা শুনিয়েছেন,

হেডমাষ্টারের ছড়ি, সেকেন্ড মাষ্টারের দাড়ি

থার্ড মাষ্টারের টেড়ি, কারে দেখি কারে ছাড়ি।

হেড পন্ডিতের টিকির সাথে ওদের যেন আড়ি ॥

পুতুলের বিয়ে শেষ হলে আশীবার্দ পর্যায়ে পুতুল মেয়ের মুখের গানটি বিশ্বপ্রকৃতির আনন্দের বাণী বয়ে নিয়ে এসেছে,

লাল টুক্টুক্ মুখে হাসি, মুখ খানি টুল্ টুল্।

বিনি পানে রং দেখে যা লাল-ঝুটি বুল বুল ॥

দেখতে আমার খুকুর বিয়ে

সূর্যি ওঠেন উদয় দিয়ে,

চাঁদ ওঠে ঐ প্রদীপ নিয়ে

গায় নদী কুলকুল ॥

ছড়া গানটিতে দেশী সুরে ও ঢঙে আঞ্চলিক জীবনযাতা দৃষ্টিভঙ্গি ও সংস্কৃতি প্রতিফলিত হয়েছে।

‘জুজুবুড়ির ভয়’ একাংকিকাতে উল্লিখিত প্রথম ছড়া গানটি খেলার গান। ছেলেমেয়েরা খেলতে খেলতে গানটি গেয়ে থাকে। উদ্ধৃত গানে আঞ্চলিক লোকসংস্কৃতি, দৃষ্টিভঙ্গি ইত্যাদির চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে,

ছেলেকপাটি বৃন্দাবন,

ছেলেকপাটি দাঁতকপাটি

ন্যাড়া মাথায় মারব চাঁটি!

আম পাতা জোড়া জোড়া

মারব চাবুক চড়ব ঘোড়া

হাডু ডুডু ডুডু …..

দ্বিতীয় ছড়া গানটি ঘুম পাড়ানী গান। নিশুতি দুপুরে ঝিঙে ফুল, ঝুমকো লতা সবাই আলস্যে ঝিমুচ্ছে। মায়ের ইচ্ছা খোকার চোখেও যেন পরী ঘুম দিয়ে যায়। এখানেও লোকসংস্কৃতি জীবনযাত্রা ইত্যাদির প্রতিফলন ঘটেছে। এখানে গীতিকার একটি ব্যঞ্জনাময় আবহাওয়া সৃষ্টি করেছেন। কবিতায় শেষ চারটি লাইন উল্লেখযোগ্য,

টুল্টুল্ ঝিঙে ফুল ঝিমায়,

ঝুমকো লতায় ঝিঁ ঝিঁ আলসে ঘুমায়।

খোকনের চোখে দেয় ঘুম পরী চুম।

ঘুম আয় ঘুম ॥

‘নবার নামতা পাঠ’ – এ উদ্ধৃত ছড়া গানটি নামতায় প্রয়োজনীয় শব্দ, তাল, লয় ও ছন্দ মিলিয়ে একটি উৎকৃষ্ট শিশুতোষ রচনা পরিবেশন করেছেন,

একেক্ কে এক-

বাবা কোথায়, দেখ!

দুয়েককে দুই-

নেই ক? একটু শুই!

তিনেক্কে তিন-

উ হু হু! গেছি আলপিন!

পরের ছড়া গানটিতে নজরুল শিশুকে বাস্তব জীবনের দ্বন্দ্বসংঘাতের সাথে পরিচয় করিয়েছেন এবং এর থেকে পরিত্রাণের উপায়স্বরূপ যে পরিকল্পনার আশ্রয় নিয়েছেন তাতে শিশুর কল্পনার জগৎ বিস্তারিত হয়েছে ও মানসিক বিকাশ সাধিত হয়েছে,

আমি যদি বাবা হতুম, বাবা হত খোকা,

না হলে তার নাম্তা পড়া

মারতাম মাথায় টোকা ॥

‘কানামাছি’ একাংকিকাতে তাল গাছকে উদ্দেশ্য করে যে গানটি রয়েছে তার সংগে কানামাছি খেলাটির কোন সম্পর্ক নাই- শুধু দুরন্ত ছেলের পায়ে আঘাত পাওয়া ছাড়া। এখানে তাল গাছের উদ্দেশ্যে একটি ব্যঙাত্মক গান গাওয়া হয়েছে, যা হাসিরও খোরাক জোগায়,

ঝাঁকড়া চুলো তাল গাছ, তুই দাঁড়িয়ে কেন ভাই?

আমার মতন পড়া কি তোর মুখস্থ হয় নাই ॥

তুই দাঁড়িয়ে কেন ভাই?

আমার মতন একপায়ে ভাই

দাঁড়িয়ে আছিস কান ধরে ঠায়

একটুখানি ঘুমোয় না তোর

পন্ডিত মশাই ॥

তুই দাঁড়িয়ে কেন ভাই?

নজরুলের ‘তাল গাছ’ স্থবির, অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথের ‘তাল গাছ’ -এ জড়বস্তুর মধ্যে গতির আভাস পাওয়া যায়,

তালগাছ একপায়ে দাঁড়িয়ে

সব গাছ ছাড়িয়ে

উঁকি মারে আকাশে।

মনে সাধ, কালো মেঘ ফুঁড়ে যায়

একেবারে উড়ে যায়;

কোথা পাবে পাখা সে?

‘ছিনিমিনি খেলা’ একাংকিকাতে নজরুল যে ছড়াগানটি রচনা করেছেন তা’ অত্যন্ত বাস্তব জীবনমুখী।

প্রতিকূলতার সাথে সংগ্রামের একটি নিখুঁত চিত্র প্রয়োজনীয় শব্দ ও ছন্দ সংযোগে সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন,

ও ভাই কোলা ব্যাং, ও ভাই কোলা ব্যাং!

সর্দি তোমার হয় না বুঝি, ও ভাই কোলা ব্যাং।

সারাটা দিন জল ঘেঁটে যাও ছড়িয়ে দুটি ঠ্যাং।

ও ভাই কোলা ব্যাং ॥

নিছক আনন্দ দানের উদ্দেশ্যে নজরুল শিশুদের জন্য যে গুটিকতক গান লিখেছেন রচনা হিসেবে তা যেমন ছন্দিত তেমনি সুখপাঠ্য। দেশী ও বিদেশী সুরের অনুসরণে নজরুল যে সমস্ত গান লিখেছেন সেখানে শব্দ, ছন্দ ও সংগীতের অপূর্ব সুন্দর সার্থক সমাহার ঘটিয়েছেন। খুব অবহেলিত রুক্ষ খর্জুর বৃক্ষ, সাহারা মরুর, বালুকার উড়–নী ইত্যাদি জিনিসকে তিনি যে পেলবতা দিয়েছেন বাংলা গানের ক্ষেত্রে তা দুর্লভ সামগ্রী। এই সমস্ত গানকে তিনি শব্দ সংগীত ও ছন্দাঘাতে অনবদ্য করে তুলেছেন। খুব সাধারণ পুঁইপাতা, নটেশাক, লাল লংকার মত জিনিসকে চিত্রকল্পের মাধ্যমে অসাধারণ করে তুলেছেন। নজরুল শিশুদের তালপ্রবণ ও ছন্দপ্রিয় মনটিকে জানতেন বলেই এমন গান লিখতে পেরেছেন।

লোকসঙ্গীতের বিভিন্ন গানের মাধ্যমে আমরা পাই লোকায়ত নজরুলকে। এক্ষেত্রে আক্ষরিক অর্থেই আর এক নতুন পরিচয়ে আবির্ভূত। লোকসঙ্গীতের বিভিন্ন শাখায় তাঁর সফল পদচারণা আমাদের রীতিমত বিস্মিত করে। শিশুতোষ ছড়া গানগুলিতে আঞ্চলিক ভাষা অত্যন্ত মিষ্টিসুরে ঝংকৃত হয়েছে। এই সব ছড়াগানে আঞ্চলিক জীবনযাত্রার চিত্র অত্যন্ত সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। এতে বিয়ের নানা রকম গানে তাদের লোকসংস্কৃত, আঞ্চলিকভাষা, দৃষ্টিভঙ্গি ইত্যাদি প্রতিফলিত হয়েছে।

নজরুলের হাসির গানের জুড়ি মেলা ভার। নজরুলের গানে আছে নির্মল হাসির প্রবাহ। রাজনৈতিক, ধর্মীয় এবং সামাজিক সমস্যাবলীকে ব্যঙ্গ করে লেখা গানগুলি সমধিক প্রসিদ্ধ। সুরের দিক দিয়ে না হলেও বিষয়ের বৈচিত্র্যে ভরপুর।

বাংলা গানের সমৃদ্ধিতে নজরুলের আরেকটি উল্লেখযোগ্য অবদান হল বিদেশী সুর সংগ্রহ। যে কোন ভাষায় গানের আকর্ষণীয় সুর তিনি বাংলা গানে লিখতেন। এতে বাংলা গানের সুরের ভান্ডার সমৃদ্ধ হয়েছে। নজরুলগীতির সুরের মাদকতা বেড়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের অনেকগুলি দেশের বিভিন্ন সুর তিনি সংগ্রহ করেছেন এবং হুবহু সেই সুরের ফ্রেমে বাংলা কথা বসিয়ে দিয়েছেন।

নজরুলের হাতে বাংলা সংগীত যেভাবে সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে ইতিপূর্বে তেমনটি দেখা যায়নি। সুরের এই মৌলিক অবদানের জন্যেই নরুলগীতির ক্রমেই জনপ্রিয়তা লাভ করছে।

যৌথভাবের নজরুলের গানগুলি শিশুদের উদ্দেশ্যে রচিত না হলেও শিশু ও বয়স্ক উভয়েই গানগুলি গেয়ে এবং নেচে আনন্দ পায়। বিভিন্ন প্রকাশ মাধ্যমে এর পুন: পুন: গীত ও নৃত্য এর বহুল জনপ্রিয়তাই প্রমাণ করে।

পাদটিকা

১.             রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ‘শিশু ভোলানাথ’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। প্রকাশকাল : কার্তিক ১৩৪৯। প্রকাশক : রঞ্জিৎ রায় বিশ্বভারতী। ১০, প্রিটোরিয়া ষ্ট্রীট। কলিকাতা- ১৬।

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

নজরুলের শিশুতোষ নাটক

নজরুল ইসলাম ‘পুতুলের বিয়ে’ নাট্যগ্রন্থ ১৩৪০ সালে প্রকাশিত হয়। এতে ‘পুতুলের বিয়ে’ নাটিকা ছাড়াও গদ্যে পদ্যে মেলানো কথোপকথন জাতীয় রচনা, সংলাপসহ আরো আটটি রচনা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এগুলি যথাক্রমে ‘কালো জাম রে ভাই’, ‘জুজুবুড়ীর ভয়’, ‘কে কি হবি বল’, ‘ছিনিমিনি খেলা’, ‘কানামাঝিছ’, ‘নবার নামতা পাঠ’, ‘সাত ভাই চম্পা’ ও ‘শিশু যাদুকর’।

নজরুলের শিশুতোষ রচনাবলীর মধ্যে ‘পুতুলের বিয়ে’ নাটিকা একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন। এটি তাঁর একটি বিশিষ্ট শিশুসাহিত্য। তিনি একজন সফল শিশু সাহিত্যিকের মতোই নাটিকাটির চরিত্রাবলীর সাথে মিশে গেছেন। তিনি কেবল ‘চির শিশু চির কিশোর’ই নন, তাঁর মধ্যে আছে এক বিদ্রোহী, সংস্কারক আর হাসি গানের মানুষও। ‘পুতুলের বিয়ে’তে আমরা তাঁর এই মিশ্রিত রূপ পাই একই আধারে।

বিভিন্ন দেশের পুতুলের বিয়েকে কেন্দ্র করে ‘পুতুলের বিয়ে’র কাহিনী নির্মিত হয়েছে। এ বিয়ের নির্ণায়ক কম্লি, টুলি, খেঁদি আর বেগম নামের ছোট ছোট পাঁচটি মেয়ে। কমলির দুই ছেলে। একটির নাম ফুচুং। সে দেখতে চীনাদের মতো। তাই কেউ তার সংগে মেয়ের বিয়ে দিতে রাজী নয়। আরেকটি দেখতে রাজপুতের মতো তার নাম ডালিম কুমার। তাকে জামাই করতে সব মা-ই উৎসুক। এই নিয়ে ঝগড়া বেধে যায়। অনেক চেষ্টায় কম্লি ফুচুংয়ের জন্য বেগমের জাপানী মেয়ে বেছে নেয়। ডালিম কুমারের জন্য বেছে নেয় মেম কনে। পুরুত ডেকে বিয়ে সেরে ফেলা হয়। সবাই মিলে বর কনেকে আশীর্বাদ করে। সংক্ষিপ্তভাবে এই হচ্ছে ‘পুতুলের বিয়ে’র কাহিনী।

এছাড়াও নাটিকাটিতে আরো কয়েকটি চরিত্র আছে। কম্লির দাদা যার কাজ হল বিয়ের ভোজ খাওয়া ও সবাইকে হাসানো। যিনি বিয়ের মন্ত্র পড়ালেন সেই পুরুত ঠাকুর যিনি কথায় ধর্ম গেল, জাত গেল বলে চিৎকার করেন- তিনি একান্তভাবেই রক্ষণশীলতার প্রতীক। এ ছাড়াও রয়েছেন কম্লির ঠাকুরমা, যিনি একই দলের অন্তর্ভুক্ত।

নাটিকাটি বিশ্লেষণ করলে আমরা নি¤œলিখিত বিষয়গুলো এর অন্তর্ভুক্ত দেখতে পাই। (১) সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি (২) বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতি (৩) আঞ্চলিক সম্প্রীতি স্থাপন (৪) বিশ্বভ্রাতৃত্ব তথা সর্বমানবের একজাতিত্ববোধের আভাস। এছাড়া আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রসংগের অবতারণা রয়েছে যা থেকে নজরুলের প্রগতিশীল মনের পরিচয় পাওয়া যায়।

নজরুল সাম্প্রদায়িক বিরোধে সবসময় গভীর বেদনা বোধ করেছেন। তিনি ছিলেন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির একজন বিশিষ্ট সমর্থক। ‘পুতুলের বিয়ে’তে তাঁর এই মনোভাবের পরিচয় অত্যন্ত স্পষ্টভাবে ধরা পড়েছে। কম্লির চীনা ছেলের সংগে বেগমের জাপানী মেয়ে গেইশার বিয়ে প্রসংগে যখন কম্লিকে বলে, “আচ্ছা ভাই, মুসলমানের পুতুলের সাথে তোর পুতুলের বিয়া হবে কি করে”। তখন সবই এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়। কম্লি ও টুলির ভাষায়,

কম্লি। না ভাই ও কথা বলিসনে। বাবা বলেছেন, হিন্দু মুসলমান সব সমান। অন্য ধর্মের কাউকে ঘৃণা করলে ভগবান অসন্তুষ্ট হন। ওদের আল্লাও যা, আমাদের ভগবানও তা। ….

টুলি। সত্যি ভাই, এক দেশে জন্ম, এক মায়ের সন্তান। অন্য ধর্ম বলে কিতাকে ঘেন্না করতে হবে?

কম্লি ও টুলি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির একখানা গানও গেয়ে ফেলে। গানের প্রথম দুটি লাইন,

মোরা এক বৃন্তে দু’টি ফুল হিন্দু মুসলমান।

মুসলিম তার নয়ন-মণি, হিন্দু তাহার প্রাণ ॥

এরপর সবাই একদেশী পুতুলের সাথে ভিনদেশী পুতুলের বিয়ে নীরবে মেনে নেয়।

‘পুতুলের বিয়ে’তে নজরুল আঞ্চলিক সম্প্রীতির ভাবটিরও অবতারণা করেছেন। নাটকের দুটি চরিত্র খেঁদি আর পঞ্চি যথাক্রমে বাঁকুড়া ও ময়মনসিংহের বাসিন্দা। তারা যে যার আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে। আমরা সাধারণত: অন্যের মুখে আঞ্চলিক ভাষা শুনে কৌতুক বোধ ও অনেক সময় বিদ্রƒপও করি। কিন্তু এই নাটিকাটিতে শুধু একবার খেঁদি ‘বাঁক্ড়ি’ সম্বোধিত হওয়া ছাড়া আর কোথাও ঠাট্টা উপহাসের কথা উচ্চারিত হয়নি। তারা খেলার সঙ্গিনীদের মতই আঞ্চলিক ভাষা বৈচিত্র্যকেও সহজভাবেই মেনে নেয়।

নজরুল নাটিকাটিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রীতির সম্পর্কটি সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন। হিন্দু মেয়ে কম্লির ছেলে ডালিম কুমার ‘সায়েব’ আর ফুচুং চীনা এবং মুসলমান বেগমের মেয়ে গেইশা জাপানী। ফুচুং ডালিম কুমার গেইশার বিয়ের মাধ্যমে  আন্তর্জাতিক আন্তঃসাম্প্রদায়িক সম্পর্ক স্থাপন করেছেন। এখানে পরিবেশগত কোন সংস্কার প্রভাব ফেলতে পারেনি। এভাবে নজরুল মানুষের মন থেকে ভেদাভেদের সব ভাবনা উড়িয়ে দিয়েছেন।

‘পুতুলের বিয়ে’র অন্যতম বড়ো বৈশিষ্ট্য, এতে বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতির কিছু পরিচয় আছে। পাঁচটি ছোট ছোট মা তাদের পুতুল ছেলেমেয়েদের বিয়ে দেবার অভিপ্রায়ে কখনো আদর করে ছড়া কাটে, কখনো বিয়ের গান গায়। এই সব ছড়া আর গানের ধ্বনি প্রতিধ্বনি, তাদের আঞ্চলিক ভাষা, দৃষ্টিভঙ্গি সংস্কৃতি ইত্যাদির অনেক টুকরো পরিচয় নাটিকাটিতে ছড়িয়ে আছে। আঞ্চলিক লোকসংস্কৃতির পরিচায়ক হিসেবে এগুলি যথেষ্ট মূল্যবান। উদ্ধৃত গানটি এ প্রসংগে উল্লেখযোগ্য,

শাদী মোবারকবাদ শাদী মোবারক

দেয় মোবারক বাদ আলম্ রসুলে পাক আল্লাহ হক

আজ এ দুল্হিনে মিলে

মিলন হল প্রাণে প্রাণে

মাশুক আর আশক।

ময়মনসিংহের মেয়ে পঞ্চির মুখের ছড়াটি অত্যন্ত মিষ্টি সুরে ঝংকৃত হয়েছে। আঞ্চলিক জীবনযাত্রার আভাসও এতে পাওয়া যায়। ছড়াটি বিয়ের কনের উদ্দেশ্যে আশীর্বাদ জ্ঞাপনের,

চুল মেলবা সোনার খাডে,

নাইবা ধুইবা পদ্মার ঘাডে।

ভাত খাইবা সোনার থালে,

বেন্নন খাইবা রূপার বাডিতে।

নাটকটিতে নজরুল পুরুষের একাধিক বিয়ের বিরুদ্ধেও কথা বলেছেন। ডালিম কুমারের সাথে বেগম ও টুলির মেয়ের প্রস্তাব টুলি মেনে নেয় না। বলে ‘আমার মেয়ে সতীন নিয়ে ঘর করবে? আমি বেঁচে থাকতে নয়।’

পর্দাপ্রথার ঘোর বিরোধিতা করেছেন নজরুল। বেগমের বাবা কম্লির আট বছরের মেয়েকে পর্দার ভেতর বিবি করে রাখার পক্ষপাতি, কিন্তু কম্লির এতে ঘোর আপত্তি।

কম্লি।        মা গো মা! কি হবে! অসৈরণ সইতে নারি। আট বছরের মেয়ে আবার বিবি হবে!

বেগম।      মা গো মা

আমি বিবি হব না।

আম কুড়াবো জাম কুড়াবো, কুড়াবো শুকনা পাতা,

সোয়ামী করবে লাঙল চাষ, আমি ধরব ছাতা।

উৎপাদনক্রীয়ায় স্বামী-স্ক্রীর সম্মিলিত প্রচেষ্টায় উৎসাহদানেরও উদাহরণ পাওয়া যায় এতে।

শুধু গুরু গম্ভীর পরিবেশ ও চিন্তাশীল ধ্যানধারণাই নয়, নাটকটিতে তিনি হাস্যরসও পরিবেশন করেছেন। কম্লির দাদা মনি নাটকের একটি বিশিষ্ট চরিত্র। সে বয়সে কিশোর, তার ভূমিকা অল্প সময়ের জন্য, তার কাজ শুধু হাস্যরস পরিবেশন করা। সে কখনো উদ্ভট রান্নার ফর্মূলা বাৎলায়, কখনো খুনসুড়িপ্রতিম কথা বলে, কখনো আজব বিষয়ের গান গেয়ে বিয়ের আসর মাতিয়ে রাখে। উক্ত আসরে তার একখানি কমিক গান,

হেড মাস্টারের ছড়ি,   সেকেন্ড মাস্টারের দাড়ি

থার্ড মাস্টারের টেড়ি,  কারে দেখি কারে ছাড়ি।

হেড পন্ডিতের টিকির সাথে তাদের যেন আড়ি ॥

‘পুতুলের বিয়ে’ নাটিকার চরিত্রগুলি শিশুর, কিন্তু তাদের ভূমিকা বা সংলাপে কোন অকারণ ছেলেমানুষি নেই। নাটকটি রচনা করতে যেয়ে তিনি কোথাও গুরুগম্ভীর ভাবের অবতারণা করেছেন, কোথাও হাস্যরস পরিবেশন করেছেন, কোথাও চিন্তাশীল মতামত ব্যক্ত করেছেন। নাটিকাটির ঘটনা, স্বাভাবিক গতি ও স্বচ্ছন্দ সংলাপ ইত্যাদির মাধ্যমে প্রগতিশীল মতামত ব্যক্ত করেছেন।

‘কালো জাম রে ভাই’ একটি হালকা রসের নাটিকা কবিতায় লিখিত। বিভিন্ন ঋতুর দেশী ফলের সাথে কালো জামের সম্পর্ক কল্পনা এর উপজীব্য। যেমন কবিতাটির শুরু এই রকম,

কালো জাম রে ভাই

আম কি তোমার ভায়রা ভাই?

লাউ বুঝি তোর দিদিমা

আর কুমড়ো তোর দাদামশাই ॥

কালো জাম নাট্যকারের একটি অত্যন্ত প্রিয় ফল। তাই তিনি নাটিকাটির শেষাংশে এই ফলটির সংগে অন্যান্য ফলের সম্পর্ক নির্ণয় করেছেন। ফলটির প্রতি দুর্বলতা এর শেষাংশে পাওয়া যায়,

নোনা আতা সোনা ভাই তোর

রাঙা দি তোর লাল মাকাল,

ডাব বুঝি তোর পানিÑ পাঁড়ে

ঢিল বুঝি তোর ভাদুরে তাল।

গেছো দাদা, আয় না নেমে

গালে রেখে চুমু খাই ॥

গদ্যে পদ্যে মেশানো ‘জুজুবুড়ির ভয়’ নজরুল ইসলামের একটি একাংকিকা। ‘জুজুবুড়ির ভয়’ এর কাহিনী দুপুর বেলা ছাদে পাঁচটি ছেলেমেয়ের কিৎকিৎ খেলা নিয়ে। এই খেলায় তাদের মায়ের ঘোর আপত্তি। তাঁর মতে, দুপুর বেলা ছেলেদের পড়াশুনা করতে হবে এবং খুকীকে ঘুমাতে হবে। তারা তাঁর কাছে ধরা পড়বার পর যে কৈফিয়ত দেয় তা একদিকে অদ্ভুত হলেও, অন্যদিকে ছেলেদের সাহসিকতার পরিচয় ফুটে উঠেছে। তারা বলেছে ছাদে তারা খেলতে যায়নি বরং জুজুবুড়ি তাড়াতে গিয়েছিল। এই জুজুবুড়ি ছেলেধরা নয়, সে মা-ধরা জুজুবুড়ি। সে সেই সব মাকে শাস্তি দেয় যারা খোকাকে যখন তখন দুধ খাওয়ান, জল ঘাঁটলে বকেন এবং রোদে বেড়াতে না দিয়ে ঘুম পাড়ান। তাদের প্রধান সাক্ষী খুকী। সে বলে,

এরপর হেবো নামের ছেলেটির এবং পুনরায় খুকীর সাক্ষ্যদান। কিন্তু মা কোন সাক্ষ্যে বিশ্বাস করেননি বা শাস্তির উল্লেখে ভয় পাননি। তিনি ছেলেদের বই নিয়ে বসবার হুকুম দিয়ে খুকীকে ঘুম পাড়াতে নিয়ে গেছেন।

নাটিকাটির মধ্যে ছেলেদের অশান্ত ও অস্থির মনের চিত্র ফুটে উঠেছে। মায়ের ¯েœহের অনুশাসন তারা মানতে চায় না। মায়েরা শিশুদেরকে দায়িত্ব ও কর্তব্যের বাঁধনে বাঁধতে চান। কিন্তু দুরন্ত শিশুরা কখনই তা মানতে চায় না।

‘কে কি হবি বল’ একটি হাল্কা রসের একাংকিকা। কবিতায় রচিত বোনের প্রশ্নের জবাবে সাত ভাইয়ের ভবিষ্যৎ জীবনের পরিকল্পনা এ রচনার বক্তব্য বিষয়। প্রথম ভাইয়ের ইচ্ছ সে কাবুলিওয়ালা হবে। মুখভর্তি থাকবে তার চাপদাড়ি। সে মোটা সুদে টাকা ধার দিবে। দ্বিতীয় ভাই পন্ডিত মশাই হবে এবং তাকে দেখে ছেলেদের দল ভয়ে কাঁপবে। তৃতীয় ভাই ফেরিওয়ালা হবে এবং সে পাড়ায় পাড়ায় চানাচুর, ঘুগ্নিদানা ও কুল্ফী বানানোর মজার কল সাথে নিয়ে ঘুরবে। এর পরের ভাইদের ইচ্ছাগুলো ব্যতিক্রমধর্মী বা বিরোধী। চতুর্থ ভাই জজ হয়ে আসামীকে ছ’মাস করে ফাঁসি দিবে। পঞ্চম ভাই জজকে চালান দেওয়া দারোগার কাজ নিতে চায়। ষষ্ঠ ভাই কনষ্টেবল হয়ে দারোগাকে ভোগাতে চায়। সপ্তম ভাই প্রতাপলোভী। সে বাবা মা’র উপর মুরুব্বীগিরি ফলাতে চায়,

আমি হব বাবার বাবা

মা সে আমার ভয়ে

ঘোমটা দিয়ে লুকোবে কোণে

চুনি বিল্লি হয়ে!

বলব বাবায়, ওরে খোকা

শীগ্গীর পাঠশালা চল্।

‘ছিনিমিনি খেলা’ নজরুলের একাংকিকা। এর উপজীব্য কয়েকটি ছেলের পুকুরে খোলামকুচি ছুঁড়ে খেলা নিয়ে। নজরুলের শিশুরা কখনই অলস নয়। সবসময়ে তারা দুরন্তপনায় ব্যস্ত।

একজন বলেÑ ‘আচ্ছা ভাই, মা যে বলে Ñ জল ঘাঁটলে সর্দি হয়, কই ব্যাঙের ত সর্দি হয় না।’ শিশুরা অবাধ স্বাধীনতা পছন্দ করে। তারা কাঁদামাটি পানি নিয়ে খেলতে ভালবাসে। কিন্তু মা বাদ সাধেন। শিশুর মতে, ব্যাঙের মা লক্ষèী কেননা এই ব্যাপারে সন্তানদের প্রতি তাঁর অবাধ স্বাধীনতা রয়েছে।

লক্ষèী মেয়ে মা তোর বুঝি

খেললে বেড়ায় নাকো খুঁজি,

কেই বকে না, মজাসে তাই গাইছ ঘ্যাঙর ঘ্যাং ॥

ব্যাঙের মা যেমন তার জলে ঘুরে বেড়ানোতে আপত্তি করে না, ছেলেগুলির মাও যদি তেমনি লক্ষèী হতেন, তা হলে তারাও ব্যাঙের সাথে জলেই থাকতো।

অন্যদিকে ব্যাঙের কাজ সারাদিন শুধু জল ঘাঁটাই নয়, সে জলদানবের মত বিরাট প্রাণীকে ল্যাং মেরে ফেলতে চায়। এই সাহস শিশুও অর্জন করতে চায়।

‘কানামাছি’ গদ্যে পদ্যে রচিত একটি একাংকিকা। ‘কানামাছি’র উপলক্ষ খেলা। এই খেলাতে যাকে কানামাছি সাব্যস্ত করা হয় তার চোখ পিছন হতে বেঁধে দেয়া হয়। সে অন্যদেরকে ছুঁতে চেষ্টা করে। কাইকে ছুঁয়ে দিলেই সে তখন কানামাছি হয়ে যায়। খেলার শুরুতে নজরুল সুন্দর একটি ছড়া কেটেছেন; যা থেকে এ দেশের সংস্কৃতির সুন্দর চিত্র ফুটে উঠেছে,

আইকম বাইকম তাড়াতাড়ি

যদু মাষ্টার শ্বশুর বাড়ী

রেন্ কম ঝমাঝম

পা পিছলে আলুম দম!

এই খেলাটি খেলবার সময় একটি ছেলে তালগাছে গুঁতো খায়। তখন অন্য একজন স্থবির তালগাছের উদ্দেশ্যে একখানি গান গায়। এখানে নজরুল তালগাছকে পড়া না পারা ছেলের সংগে তুলনা করেছেন। পড়া না পারলে যেভাবে ছেলেরা কানধরে এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকে এবং যে ছেলে পন্ডিত মশাইকে ফাঁকি দিতে চায়।

আলোচ্য একাংকিকাতে নজরুল কানামাছি খেলার বাস্তব চিত্র অংকন করেছেন। ‘নবার নামতা পাঠ’ একটি একাংকিকা। রচনাটি কৌতুকে ভরপুর। নবা নামতা পড়তে বসে গান ধরে, ‘একদা এক হাড়ের গলায় বাঘ ফুটিয়াছিল।’ ফলে তাকে বাবার কাছে ধমক খেতে হয়। এরপর সে এমন নামতা ধরে যার পুরোটাই ফাঁকিবাজিতে ভরা। যার প্রথম দুটি লাইন,

একেক্কে এক-

বাবা কোথায়, দেখ।

এবং শেষ দুটি লাইন-

দশেক্কে দশ-

বাবা আপিস্! ব্যাস!

‘সাত ভাই চম্পা’ শিরোনাম দেখে মনে হয় নজরুল এক শিরোনামে সাতটি সংলাপ লিখবার পরিকল্পনা নিয়েছিলেন, কিন্তু এই রচনাটি আসলে চারটি সংলাপের গুচ্ছ। সংলাপগুলিতে বিভিন্ন ভাইয়ের জীবন পরিকল্পনার কথা বর্ণিত হয়েছে। চরিত্রগুলো গুরুত্বপূর্ণ। সংলাপগুলো যথার্থই রসোত্তীর্ণ। গ্রাম বাংলার কোলে লালিত পালিত লোক-ঐতিহ্যের মানসপুত্র কবি নজরুলের এই কবিতাটি হয়ে উঠেছে তাঁর প্রাণস্পন্দন স্বরূপ।

-প্রথম ভাই-

এটি একটি জাগরণমূলক সংলাপ। এখানে খোকনের ভূমিকা ‘ঘুম জাগানো পাখী’র। সে সবার আগে ঘুম থেকে জাগবে এমনকি সূর্য ওঠার আগেই সে ঘুম থেকে উঠবে এবং সবাইকে ‘ঘুম-ভাঙা-গান’ শোনাবে,

আমি হব সকাল বেলার পাখী

সবার আগে কুসুম-বাগে উঠব আমি ডাকি।

সূয্যি মামা জাগার আগে উঠ্ব আমি জেগে,

শুধু ঘুম থেকে জাগানোই এর রচনার উদ্দেশ্য নয়। ঘুম থেকে জাগানো অর্থ সমস্ত অন্ধ, জরা, ব্যাধিগ্রস্থ ও অলসদের তিনি গতি দিতে চান। তাদেরকে তিনি উদ্যোগী ও কর্মঠ দেখতে চান। জীবনযুদ্ধে জয়ী দেখতে চান। সে নিরলস পরিশ্রমের মধ্যে দিয়ে শান্তি ও মঙ্গল আনবে।

-দ্বিতীয় ভাই-

‘দ্বিতীয় ভাই’য়ের ইচ্ছে রাখাল রাজা হওয়ার। অর্থাৎ মাঠের রাজা হওয়ার। এখানে রাজা হওয়ার ব্যাপারে প্রকৃতি ছাতিম তরু, শাল পাতার মুকুট, বন ফুলের মালা তার সহযোগিতা করবে। কিন্তু তার প্রধান কাজ হবে ‘তার রাজ্য’ শাসন করা। প্রথমেই সে রাজদন্ড তুলে ‘নদী’কে বলবে,

ওগো করদ নদী,

করব শাসন এই মাঠে কর না দিয়ে যাও যদি

এদেশে না ফললে ফসল, না পেলে ঘাস গরু,

না হাসিলে ফুলে-ফলে আমার দেশের তরু

পাহাড় কেটে পাথর এনে রাখব তোমায় বেঁধে,

তোমায় খুঁজে সাগর-মাতা মরবে তোমায় কেঁদে!

এরপর সে ‘মেঘ’ কে বলবেÑ

জল দিয়ে যাও, আমি রাখাল রাজা,

নৈলে বন্ধু থামিয়ে দেবো তোমার মাদল-বাজা!

বজ্র তোমার নেব কেড়ে নিবিয়ে বিজলি বাতি,

রাখব বেঁধে তোমার রাজার ঐরাবতী হাতি!

সবশেষে সে ‘বন’কে বলবেÑ

কানন, শোনো আমার কথা,

ভীর করে সব নীড় বাঁধিলে সকল পাখী হোথা

ঝড়কে বলো, আমার আদেশ-একটি পাখীর নীড়

উড়ায় যদি, ধরে তারে পরাব জিঞ্জীর!

তার সকল দাবীই বস্তুত: কৃষকের দাবী। ফুল-ফল-ফসলের সমৃদ্ধির দাবী।

-তৃতীয় ভাই-

‘তৃতীয় ভাই’য়ের সত্তার সাথে এক হলেও তাদের বক্তব্য আলাদা। এই ভাই হবে দিনের সহচর। সে লাঙল কাঁধে চাষীকে মাঠের দিকে যাওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে,

ওরে রোদ উঠেছে লাঙল কাঁধে ধর!

তোদের ছেলে উঠল জেগে, ঐ বাজে তার বাঁশি,

জাগল দুলাল বনের রাখাল, ওঠরে মাঠের চাষী!

‘তৃতীয় ভাই’ কৃষকের সমৃদ্ধিই চেয়েছে অন্যভাবে,

লিখব সবুজ কাব্য আমি, আমি মাঠের কবি,

উপর হতে করবে আশিস দীপ্ত রাঙা রবি।

ধরায় ডেকে বলব “ওগো শ্যামল বসুন্ধরা,

শস্য দিয়ো আমাদের এবার আঁচল ভরা”॥

কেননা বন্ধ্যাসম এই পৃথিবীকে ফুল-ফল-ফসলে চাষীরাই সমৃদ্ধ করেছে। তাই পৃথিবীর কাছে তার প্রত্যাশা,

খামার ভরে রাখব ফসল গোলায় ভরা ধান,

ক্ষুধায় কাতর ভাইগুলিরে আমি দেবো প্রাণ!

এই পুরানো পৃথিবীকে রাখব চির তাজা,

আমি হব ক্ষুধার মালিক, আমি মাটির রাজা।

‘চতুর্থ ভাই’ হবে সওদাগর। সাতটা সগরে তার আধিপত্য থাকবে। পৃথিবী জুড়ে চলবে তার বেচাকেনা।

আমি সাগড় পাড়ি দেবো, আমি সওদাগর।

সাত সাগরে ভাসবে আমার সপ্ত মধুকর।

আমার ঘাটের সওদা নিয়ে যাব সবার ঘাটে,

চলবে আমার বেচাকেনা বিশ্বজোড়া হাটে।

নজরুলের শিশু বিভিন্ন দেশের মধ্যে বিভেদের দেয়াল ভেঙ্গে দিয়ে অর্থনৈতিক সমতা আনতে চায়। সে সওদাগর হয়ে পৃথিবীর সমস্ত রতœ-রাজি এনে তার দরিদ্র দেশ মাতৃকাকে রাজরাণীর ঐশ্বর্যে ভরে দেবে,

বলব মাকে, “ভয় কি গো মা, বাণিজ্যেতে যাই।

সেই মণি মা দেবো এনে তোর ঘরে যা নাই।

দুঃখিনী তুই, তাইত মা এ দুখ ঘুচাব আজ,

জগৎ জুড়ে সুখ কুড়াব-ঢাকব মা এ লাজ।

এই রচনাটির প্রতিকী ব্যঞ্জনা লক্ষণীয়, ছোটদের মনে বিশ্বচেতনা জাগাবার চমৎকার প্রয়াস।

‘শিশু যাদুকর’ একটি রসোত্তীর্ণ নাটিকা-কবিতায় লিখিত। নবজাতকের প্রতি পিতার বিস্ময় বিমুগ্ধ বাৎসল্য এই কবিতার উপজীব্য। পিতা তাঁর শিশুর আবির্ভাব পথের কথা ভেবে বিস্মিত। সে যাদুকরের রূপ ধরে রূপকথার জগৎ ছেড়ে নেমে এসেছে বাস্তব পৃথিবীতে। সে স্বর্গের সমস্ত সৌন্দর্য নিয়ে এসেছে। পিতা তার রূপে মুগ্ধ। তার কাছে সে কখনো নির্মল আকাশের চাঁদ, কখনো রূপলোক থেকে আগত রূপকথা। তার আগমনে পৃথিবী বসন্তে বা নতুনত্বে ভরে গেছে। কখনো সে অমরার প্রজাপতি, কখনো তারা যুঁই। কখনো বন থেকে পৃথিবীর কোলে নেমে আসা একরাশ চুমু। শিশুর আগমনে ফুলের গন্ধ ও পাখীর গানে ঘর ভরে গেছে। নবজাতকের আগমনে পৃথিবী প্রাণময় প্রাচুর্যে ভরে উঠেছে। তার উদ্দেশ্যে কবির কথা,

…. আমি দিনু হাতে তোর নামের কাঁকন

তোর নামে রহিল রে মোর স্মৃতিটুক্,

তোর মাঝে রহিলাম আমি জাগরূক।

এই রচনাটির সংগে নজরুলের ‘ছায়ানট’ এর ‘চিরশিশু’ কবিতার তুলনা করা যেতে পারে। তবে ‘শিশু যাদুকর’ এর লক্ষ্য পিতার প্রথম সন্তান কিন্তু ‘চিরশিশু’তে পাওয়া যায় প্রথম সন্তানের মৃত্যুর পর জাত দ্বিতীয় সন্তানের কথা। শিশুর আবির্ভাব নিয়ে এখানেও বিস্ময় প্রকাশ করা হয়েছে। এতে নবজাতকের রূপের বর্ণনা নেই। এখানে শিশুধারার কথা এবং প্রথম শিশুর কথা ভেবে কান্নার কথা আছে,

নাম-হারা তুই পথিক শিশু এলি অচিন দেশ পারায়ে,

কোন্ নামের আজ পরলি কাঁকন, বাঁধন-হারার কোন্ কারা এ ॥…

পথ ভোলা তুই এই সে ওরে

ছিলি ওরে এলি ঘরে

বারে বারে নাম হারায়ে ॥…

আজ যে শুধু নিবিড় সুখে

কান্না সায়র উথলে বুকে,

নতুন নাকে ডাকতে তোকে,

ওরে ও কে কণ্ঠ রুখে

উঠছে কেন মন ভারায়ে।

নাটিকাটি বোধ্যতার দিক হতে শিশুদের নাগালের বাইরে রয়ে গেছে।

নজরুল ইসলাম প্রণীত ৩১শে জুলাই ১৯৩৫ সালে প্রকাশিত স্কুল পাঠ্যগ্রন্থ ’মক্তব সাহিত্যে’র অন্তর্ভুক্ত ‘সত্যরক্ষা’ একাঙ্কিকার কাহিনী সংক্ষেপে নি¤œরূপÑ

একদা বাহারায়েনের শাসনকর্তা বিচারে বসেছেন আসামী একজন হত্যাকারী মরুবাসী আরব। বিচারে তার মৃত্যুদন্ড সাব্যস্ত হলে সে তার পিতার গচ্ছিত অর্থ তার ছোট ভাইয়ের হাতে পৌঁছে দেয়ার নিমিত্তে একজন আমানতি নিযুক্ত করার অভিপ্রায়ে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময় চায়, কিন্তু একজন জামিন দরকার। শাসনকর্তার ভাই নোমান জামিন হ’য়ে মহত্ত্বের পরিচয় দেন।

একটু দেরী হলেও আসামী ফিরে এসেছিল এবং পিতার মৃত্যুর অভিযোগকারী যুবকদ্বয় তাকে মাফ করে মহত্ত্বের পরিচয় দিয়েছিল। এদিকে বাদশাহ নোমানও আসামীকে মুক্তি দেন এবং যুবকদ্বয়কে ক্ষতিপূরণ স্বরূপ কিছু দিতে চেয়ে মহত্ত্বের পরিচয় দেন। অন্যদিকে যুবকদ্বয়ও কোন প্রতিদান গ্রহণ না করে মহত্ত্বের চরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেনÑ

আমরা আল্লাহর ওয়াস্তে যা করিয়াছি, জাঁহাপানার নিকট হইতে তাহার প্রতিদান গ্রহণ করা অসম্ভব।

আলোচ্য নাটকের পাত্রগণ সবাই অন্যকে দেয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছেন ও মহত্ত্বের পরিচয় দিয়েছেন।

১৯৯১ সালে নজরুল ইন্সটিটিউট থেকে স্বতন্ত্র গ্রন্থাকারের প্রকাশিত নাটক ‘জাগো সুন্দর চিরকিশোর’। কাল্পনিক অভিযানের কাহিনী নিয়ে তিনি এটি লিখেছেন। বাস্তবের শিশু মহাকাশ পরিভ্রমণ ও সাগর অভিযানে অসমর্থ তাই নজরুল কল্পনার মাধ্যমে শিশুকে মহাকাশ অভিযানে ও সাগর তলদেশে নিয়ে যান। এটি হাসি কৌতুকে ভরপুর এবং আদর্শবাদী এবং প্রথমাংশে প্রাপ্ত ‘সাত ভাই চম্পা’র কবিতাটিতে আদর্শের পরিচয় পাওয়া যায়।

রচনা হিসাবে এটি সংযত ও মার্জিত। এর সংলাপও সুখপাঠ্য। কিছু অংশ এখানে উদ্ধৃত হলÑ

ওংকার Ñ তোর আঁচলে কি রে বেনু? অ! আমার হাফ প্যান্টের পকেট থেকে সব মুক্তো মানিক চুরি করেছিস বুঝি? দে, দে আমার মুক্তো দে!

বেনু Ñ বারে, তোমার ছেঁড়া পকেট গলে ওগুলো আপনা থেকে আমার কাছে এসেছে। আমি চুরি করব! আচ্ছা, ওংকারদা, তোমরা ব্যাটা ছেলে, তোমরা ও নিয়ে কি করবে? এখন ওগুলো আমার কাছে থাক। তোমার বউ এলে মালা গেঁথে উপহার দেবো … …।

নাটক রচনার ক্ষেত্রে নজরুল একজন সফলকাম শিশুনাট্য লেখকের পরিচয় দিয়েছেন। ‘পুতুলের বিয়ে’ নাটিকাটিতে তিনি বিভিন্ন দেশ, ধর্ম বর্ণের পুতুলের বিয়ের মাধ্যমে জাতি-ধর্ম-বর্ণ প্রথা দূর করে শিশু মনকে ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ববোধ আবদ্ধ ও কল্যাণ্যধর্মী করার চেষ্টা করেছেন। বস্তুতঃ শিশুকে উপলক্ষ করে বয়স্কের মনে ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ববোধ আনার চেষ্টা করেছেন।

পুতুলের বিয়ের সংক্ষিপ্ত পরিসরে নজরুল প্রগতিশীল মতামত ব্যক্ত করেছেন। এছাড়াও গুরুগম্ভীর, হাস্যরসপ্রতিম চিন্তাশীল ইত্যাদি নানা ধরনের চরিত্রের রূপায়ণ, নাটকীয় ঘটনাবলীর চমকপ্রদ সমাবেশ এবং অতি স্বাভাবিক গতি মিষ্টি সংলাপ নাটকটিকে উপভোগ্য করে তুলেছে।

অন্যান্য যেসব একাংকিকা ও সংলাপ রচনা করেছেন সেখানে তিনি শুধুই কৌতুক পরিবেশন করেননি, বিভিন্ন লেখার বর্ণনার মাধ্যমে আঞ্চলিক জীবনযাত্রা, দৃষ্টিভঙ্গি ও লোকসংস্কৃতির চিত্র তুলে ধরেছেন ও শিশুকে তার সংগে পরিচয় করিয়েছেনÑ যা শিশুর মানসিক বিকাশ সাধনে যথেষ্ট সহায়ক।

‘সত্যরক্ষা’ নাটকটি শিশুর নৈতিক চরিত্রগঠন তথা বিকাশসাধনে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে।

‘জাগো সুন্দর চিরকিশোর’ নাটিকাটিতে নজরুল শিশু-কিশোরদের কল্পলোকের বিস্তার ঘটিয়েছেন। উপযুক্ত শব্দচয়ন ও বলিষ্ঠ সংলাপে নাটকটি সমৃদ্ধ।

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

নজরুলের শিশুতোষ গল্প

নজরুল ইসলাম স্কুলের ছাত্রদের জন্য ১৯৩৫ সালে ‘মক্তব্য সাহিত্য’ নামে একখানি গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। এতে তিনি ‘হযরত মোহাম্মদের উম্মত পরীক্ষা’, ‘পানি’, ‘ঈদের দিনে’, ‘কাবা শরীফ’, ‘কোরআন শরীফ’, ‘উদ্ভিদ’, ‘আল্লাহ্তায়ালা’, ‘গোরু’, ‘পরিচ্ছেদ’, ‘বিড়াল’ গল্প অন্তর্ভুক্ত করেন।

‘হজরত মোহাম্মদের উম্মত পরীক্ষা’ গল্পটিতে আল্লাহ্তায়ালার সর্বদ্রষ্টতা সম্পর্কে শিশুমনকে নিশ্চিত করা হয়েছে। আল্লাহ্ নিরাকার হ’লেও তিনি নির্জন স্থানে আছেন প্রমাণ করতে যেয়ে তিনি একটি গল্পের অবতারনা করেছেন। গল্পটি সংক্ষেপে নি¤œরূপÑ

হজরতের উম্মত হবার অভিপ্রায় জানালে জনৈক ব্যক্তিকে তিনি একটি মুর্গীর বাচ্চা দিয়ে নির্জন স্থানে জবাই করে আনতে বললেন। কিন্তু সেই ব্যক্তি মানুষ না পেলেও সব জায়গাতেই আল্লাহ্র অস্তিত্ব অনুভব করলো। তখন হজরত তাঁকে বললেন, ‘তুমিই আমার উম্মত হইবার উপযুক্ত পাত্র’।

গল্পটি অত্যন্ত বস্তুনিষ্ঠ ও গঠনমূলক। শিশুর মনন বিকাশের উপযোগী।

‘পানি’ কথিকাটিতে নিতান্তই ছোট একটি রচনার মাধ্যমে এর প্রয়োজনীয়তা ও গুণাগুণ সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন। ‘পানি না হইলে আমরা বাঁচিতে পারি না’ Ñ এ তথ্যটি তিনি শিশুদের দিয়েছেন। জলস্থল সম্পর্কে একটি ভৌগলিক জ্ঞানও তিনি শিশুদের দিয়েছেনÑ

নদী পুষ্কুরিনী প্রভৃতির জল-ভাগ তোমরা অনেকে দেখিয়াছ। তাদের অপেক্ষা আরও বৃহৎ জল-ভাগ আছে তাহাকে সমুদ্র বলে। সমুদ্র দুনিয়ার স্থলভাগকে ঘিরিয়া আছে।

বিশুদ্ধ পানির বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে আলোচনা করতে গিয়ে বলেছেনÑ “বিশুদ্ধ পানি বর্ণহীন, গন্ধহীন ও স্বাদহীন।”

দূষিত পানি পান করলে নানারূপ রোগের আক্রমণ হতে পারে। দূষিত পানি বিশুদ্ধ করার উপায় হিসেবে পানি ফুটিয়ে ঠান্ডা করে পানের পরামর্শ দিয়েছেন। রচনাটি তথ্যনিষ্ঠ। বিদ্যালয়ে শিশু পাঠের উপযোগী করে রচনা করেছেন।

‘ঈদের দিনে’ হজরত মোহাম্মদের শিশুপ্রীতি তথা মানবসেবার কাহিনী। কাহিনীটি বহুলপ্রচলিত। এর আবেদন সর্বজনীন এবং চিরস্থায়ী। ঈদের দিনে নামাজের পর যখন সমস্ত বালক-বালিকা আনন্দে মত্ত তখন একটি বালকের নীরব ক্রন্দন হজরতকে বিচলিত করে। তিনি কারণ জানতে চাইলেন এবং জানলেন ছেলেটি পিতৃমাতৃহারা। হজরতের দয়ার হৃদয় অশ্রুসিক্ত হল এবং তিনি বললেন Ñ

আচ্ছা যদি আমি তোমার পিতা হই, আয়েশা তোমার মাতা হন, আর ফাতেমা তোমার বোন হয়, ইহাতে তুমি সুখী হইতে পারিবে?

ঈদের দিনে এক এতিম শিশুকে তিনি আপন সন্তানের মর্যাদা দিয়ে ঈদের আনন্দ দান করেছেন। হজরতের মানবতার এমন সুন্দর চিত্র নজরুল তার শিশুতোষ গল্পে হৃদয়গ্রাহী করে তুলে ধরেছেন। ঈষৎ সংক্ষিপ্ত এবং সম্পাদিত আকারে রচনাটি বাংলাদেশের স্কুলপাঠ্য বইতে পাওয়া যায়।

‘কাবা শরীফ’ রচনামূলক প্রবন্ধ। এটি মুসলমানদের পবিত্র স্থান। এখানে তিনি কাবা শরীফ নির্মাণের ইতিহাস সম্বন্ধে আলোচনা করেছেন Ñ

এখন যে স্থানে কাবা শরীফ অবস্থিত তাহা তখন গভীর জঙ্গলপূর্ণ ছিল। হজরত ইবরাহিম তাঁহার প্রিয় পুত্র হজরত ইসমাইলের মাতা হাজেরা বিবিকে এই স্থানে বনবাস দিয়াছিলেন। নিকটে কোথাও পানি না থাকায় মাতা-পুত্র মৃতপ্রায় হন। খোদার মহিমায় ও পুণ্যশীলা বিবি হাজেরার প্রার্থনার শিশু ইসমাইলের পায়ের আঘাতে সেই স্থানে এক সুপেয় পানি- বিশিষ্ট ঝর্ণার উৎপত্তি হয়। সেই ঝর্ণা আজও ‘আবে জম্জম্’ কূপ নামে বিখ্যাত।

কাবা শরীফের এই ‘আবে জমজমে’র পানি পান করে সমস্ত হাজীরা পবিত্র হন। অত্যন্ত স্বচ্ছন্দ গতিতে কাবা শরীফ নির্মাণের যে ইতিহাস বর্ণনা করা হয়েছে তা স্কুলপাঠ্য ছাত্রদিগকে পরিতৃপ্ত করে।

‘কোরআন শরীফ’ মুসলমানদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ। পবিত্র কোরআন কখন কোথায় এবং কেন নাযিল হয়েছে এই গল্পে তার স্পষ্ট উল্লেখ আছে।

কোরআন শরীফ আমাদের হজরত মোহাম্মদের মারফতে প্রেরিত পবিত্রগ্রন্থ। এই পবিত্র কেতাবে আমাদের ইসলাম ধর্মের সমস্ত অনুশাসন লেখা আছে। জীবরাইল ফেরেশতা আল্লাহের যে বাণী আমাদের হজরতের নিকট বহিয়া আনিতেন, পবিত্র কোরআন তাহারই সংগ্রহ।

কোরআনের অনুশাসন আমরা কেন মেনে চলব এ সম্পর্কে নজরুল বলেছেন –

কোরআন শরীফ পড়িলে হৃদয় মন পবিত্র থাকে, প্রাণে শান্তি পাওয়া যায়। ইহা রোজ পাঠ করিলে দুঃখ মুসিবতের হাত হইতে রক্ষা পাওয়া যায়।

মোট কথা কোরআন শরীফ পাঠে আল্লাহ্র নৈকট্য লাভ হয়Ñ এই সার্বজনীন সত্যটি তিনি তাঁর মুসিবতের হাত হইতে রক্ষা পাওয়া যায়।

‘উদ্ভিদ’ শিক্ষক ও ছাত্রদের মধ্যে কথোপকথন জাতীয় রচনা। শিক্ষক ছাত্রের সঙ্গে গল্পের আকারে বক্তব্য বিষয় তুলে ধরেছেন। স্কুলপাঠ্য এই রচনাটি নজরুল উদ্ভিদ সম্বন্ধে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন। উদ্ভিদের প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে তিনি বলেছেন –

এই উদ্ভিদ আছে বলিয়াই মানুষ, জীবজন্তু প্রভৃতি বাঁচিয়া আছে। উদ্ভিদ কত রকমে আমাদের নিত্য আহার ও বস্ত্র জোগাইতেছে। ধান, কলাই, গম ইত্যাদি শস্য ও নানাবিধ ফল আমরা নিত্য উদ্ভিদ হইতে পাইতেছি। গরু, মহিষ, ছাগল প্রভৃতি আমাদের কত উপকারে লাগে। ইহারাও উদ্ভিদ দ্বারা জীবন ধারণ করিয়া আছে। …

উদ্ভিদ সম্বন্ধে বৈজ্ঞানিক তথ্য দিতে গিয়ে তিনি বলেছেন Ñ

তুমি, আমি ও সমস্ত জীবজন্তু দিবারাত্র নিশ্বাস ছাড়িতেছি ও প্রশ্বাস গ্রহণ করিতেছি। আমরা যে মলমুত্র ত্যাগ করি উহা যেমন দূষিত পদার্থ, তেমনি আমরা যে নিশ্বাস ছাড়ি তাহাও দূষিত পদার্থ। প্রতি মুহুর্তে এই দুনিয়ার সমস্ত জীবজন্তু যে নিশ্বাস ছাড়িতেছে উহা দ্বারা সমস্ত বায়ুমন্ডল দূষিত হইয়া যাইতেছে।…পাতার সাহায্যে ইহারা সূর্যকিরণ ও বাতাস হইতে খাদ্য সংগ্রহ করে আবার শিকড় দিয়াও ইহারা মটির মধ্য হইতে খাদ্য সংগ্রহ করে। ,,,যে সমস্ত বৃক্ষ একবার মাত্র ফলদান করিয়া মরিয়া যায় তাহাদিগকে ঔষধি বলে।

কীটদষ্ট অংশগুলি পরিদৃষ্ট হলে উদ্ভিদ সম্বন্ধে আরো কিছু তথ্য শিশুরা অবহিত হতে পারতো।

‘আল্লাহ্তায়ালা’ গল্পে আল্লাহর একত্ববাদ সম্পর্কে শিশুদেরকে সন্দেহমুক্ত করেছেন। তিনি নিরাকার ও সমস্ত সৃষ্টির মালিক-শিশু মনে এ ধারণা দেবারও চেষ্টা করেছেন-

আল্লাহ্ এক। তিনি লা-শরীক অর্থাৎ তাঁহার কোনো শরীক নাই। তাঁহাকে কেহ পয়দা অর্থাৎ সৃষ্টি করে নাই। এই বিশ্বের যাহা কিছু আকাশ, বাতাস, গ্রহ, তারা, রবি, শশী, জীবজন্তু, তরু-লতা, ফুল-ফল সমস্ত তিনিই সৃজন করিয়াছেন। জীবন, মৃত্যু, সুখ, দু:খ সকলেরই নিয়ন্তা তিনি। তিনি নিরাকার।

আমরা যে তাঁহারই কাছে শক্তি ভিক্ষা করে, একমাত্র তাঁহারই এবাদত করি।

‘গোরু’ রচনাটি প্রাথমিক স্কুল পর্যায়ের উপযুক্ত একটি শিশুপাঠ্য রচনা। গরুর বর্ণনা এবং উপকারিতা অত্যন্ত সহজ ও স্বচ্ছন্দ্য ভাষায় শিশু পাঠ উপযোগী করে রচিত হয়েছে। তিনি গরুর বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে Ñ

সাদা, কাল, ঈষৎ লাল প্রভৃতি নানা বর্ণের গরু দেখিতে পাওয়া যায়। ইহাদের কান দুইটি বড় ও ঘার লম্বা, উহাতে গলকম্বল ঝুলিতে থাকে। লেজটি সরু ও লম্বা, নীচে এক গোছা চুল আছে, ইহা দ্বারা মশামাছি প্রভৃতি তাড়ায়। আমাদের দেশে গরুর সাহায্যে কৃষিকাজ সম্পন্ন করা হইয়া থাকে। ইহা ছাড়া গাড়ি টাকা, ঘানি টানা প্রভৃতি কাজও আমরা গরুর সাহায্যে করিয়া থাকি। গাভীর দুগ্ধই শিশুদের একমাত্র পানীয়।

আলোচ্য কথিকাতে ‘গৃহপালিত জন্তুর মধ্যে গরুর দ্বারা আমরা সর্বাপেক্ষা বেশি উপকার পাইয়া থাকি’Ñ লাইনটি রচনার শুরুতেই হওয়াতে রচনা লিখন পদ্ধতির ধারাবাহিকতা ক্ষুণœ হয়েছে। তা সত্ত্বেও গরু সম্বন্ধে তিনি তথ্য নির্ভর শিশু উপযোগী রচনা লিখেছেন।

‘পরিচ্ছদ’ কথোপকথন জাতীয় রচনা। ছাত্র ও শিক্ষকের মধ্যে এই কথোপকথন। বস্ত্র আমরা কিভাবে পাই, বস্ত্র কত প্রকার এবং বস্ত্রের প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে শিক্ষক ছাত্রের কাছে গল্পের আকারে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেছেন। বস্ত্র কিভাবে পাই ছাত্রের জবাবে শিক্ষক বলছেন,

‘বৃক্ষই আমাদের বস্ত্র দেয়।’

কিন্তু বৃক্ষতো আমাদের সরাসরি বস্ত্র দেয় না। আমরা সুতি বস্ত্র, রেশমি বস্ত্র ও পশমী বস্ত্র যে তিন উপায়ে পেয়ে থাকি তার বর্ণনা দিয়েছেন এভাবেÑ

বিচি হইতে তুলা ছাড়াইয়া পরে পিঁজির চরকা বা টাকু প্রভৃতির সাহায্যে পাকাইয়া সুতা প্রস্তুত হয়। এই সুতা হইতেই আমরা সাধারণত সুতি বস্ত্র পাইয়া থাকি।

রেশমি বস্ত্রÑ

গুটিপোকা নামে একজাতীয় পোকা আছে, উহার শরীর হইতে এক প্রকার রস বাহির হয়, ঐ রসে গুটিপোকা আপনার ঘর প্রস্তুত করিয়া তাহার মধ্যে থাকে …

পশমী বস্ত্রÑ

পশমী কাপড় শীত নিবারণের জন্যই আমরা ব্যবহার করিয়া থাকি। ইহা ছাগল মেষ প্রভৃতির লোক কাটিয়া তাহার দ্বারা বুনা হয়।

বস্ত্র সম্বন্ধে নজরুল শিশুদের প্রয়োজনীয় তথ্য জ্ঞাপন করেছেন। অত্যন্ত স্বচ্ছন্দ ভঙ্গিতে সহজ সরল ভাষায় পরিচ্ছদ সম্বন্ধে শিশুর শিক্ষার উপযুক্ত পাঠ দিয়েছেন।

‘বিড়াল’ কথিকাটিতে তিনি বিড়ালের স্বভাব সম্বন্ধে বলেছেন,

বিড়াল খুব সহজে পোষ মানে। ইহারা মাছ, ভাত, দুধ ইত্যাদি খাইয়া বাঁচিয়া থাকে। দুধ মাছ পাইলে ইহারা আর কিছু চায় না। ইঁদুর ধরিতে ইহারা খুব ভালবাসে। ইহারা গরম স্থানে থাকিতে ভালবাসে বলিয়া বিছানা ও উনানের ধারে শুইয়া থাকে। …

বিড়ালের অনুকরণপ্রিয়তা সম্বন্ধে বলেছেন,

কোন সম্ভ্রান্ত মহিলার একটি বিড়াল ছিল। তিনি যখন লিখিতেন তখন তাঁহার পোষা বিড়ালটি টেবিলের উপর বসিয়া তাঁহার কলমের দিকে চাহিয়া থাকিত, একদিন তিনি লিখিতে লিখিতে অন্যত্র উঠিয়া গিয়াছেন … আসিয়া দেখিলেন যে তাঁহার ‘টমি’ নামে বড় বিড়াল … তাঁহার মত লিখিবার চেষ্টা …।

বিড়ালের উপকারিতা সম্বন্ধে বলেছেন,

ঘরে প্রাচীরের উপর হইতে বিড়ালটি এই ব্যাপারে দেখিতে পাইয়া গৃহিনীর আঁচল ধরিয়া টানাটানি করিতে লাগিল। শেষে তিনি বিরক্ত হইয়া দেখিলেন যে তাঁহার শিশু পুত্রটি খেলা করিতে করিতে জলের টবে পড়িয়াছে। তখন তিনি দৌড়াইয়া গিয়া তাহাকে জল হইতে তুলিলেন। আল্ল্হার কৃপায় সে যাত্রা সন্তানটি রক্ষা পাইল।

নজরুল ইসলাম শিশুসাহিত্যের অন্যান্য শাখা অল্পবিস্তর বিচরণ করলেও ছোটদের জন্যে কোনো গল্পগ্রন্থ প্রকাশ করেননি। তবু শিশুরঞ্জক কথাকার হিসেবে ছাত্রদের জন্য তিনি এই গ্রন্থটি প্রণয়ন করেছেন। সত্যিকার গল্পকারের গুণাবলী তাঁর ছিলো এবং সেই গুণাবলীর কিছু স্বাক্ষর তিনি এ গ্রন্থে রেখে গেছেন। গল্পগুলির ভাষা নিরতিশয় সরল ও স্বচ্ছন্দ, ঢঙে মজলিসী আর সরস। নিতান্তই শিশুতোষ গল্পের ভাষা ও রচনাভঙ্গির অনুরূপ। গল্প পরিবেশনে আঙ্গিকগত দিক থেকেও নজরুল যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। শিশুতোষ গল্প রচনায় মনোযোগী হলে তিনি একজন উঁচুদরের কথাকার হতে পারতেন নিঃসন্দেহে।

উপসংহার

সাহিত্য তার সমকালীন সমাজের মৌলচিত্রকে ধারণ করে যার প্রকাশও ঘটে সাহিত্যের বিচিত্র সব শাখায়। শিশুসাহিত্য যার উল্লেখযোগ্য একটি অধ্যায়। বিশ্বের সকল ভাষার শিশুসাহিত্য একটি বিরাট অধ্যায় জুড়ে রয়েছে। বাঙলা ভাষার শিশুসাহিত্যও সমৃদ্ধ হয়েছে আধুনিককালে সাহিত্যের বিকাশের সহজাত প্রক্রিয়ায়। আমাদের শিশুসাহিত্যের শাখা-প্রশাখায় রয়েছে সামাজিক রূপ। শিশুদের জন্য এযাবৎ রচিত হয়েছে পর্যাপ্ত গল্প, উপন্যাস, কবিতা, ছড়া ও নাটক।

শিশু সমাজের বাইরের কেই নয়Ñ বরং এরাই ভবিষ্যৎ সমাজের অংকুর। সেই আগামী লোকসমাজকে জ্ঞানে কর্মে মহত্ত্বে সর্বাঙ্গীনভাবে গড়িয়া তুলিতে হইলে তাহার জন্য বিপুলভাবেই আয়োজন করা উচিত।১

অনাগত ইতিহাসের নেতৃত্ব যারা গ্রহণ করবে, তাদের মানসিক পুষ্টিসাধন মানুষের প্রথম কর্তব্য :

For it is the very nature of Children to grow, they cannot stand still. They must have changed and activity of both mind and body. Reading which does not stir their imaginations, which does not stretch their minds, not only wastes their time but will not hold the Children permenently.3

শিশুর উপযুক্ত আত্মিক বিকাশ ঘটাতে হলে সাহিত্যের মধ্য দিয়ে তার মনকে প্রসারিত করতে হবে ও কল্পনাশক্তিকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে এবং তাদের চরিত্রে একটি স্থায়ী প্রভাব ফেলবে।

শিশুদের জন্য যিনি লিখবেন তাঁকে প্রথমত: সাহিত্যিক হতে হবে এবং তাঁর হাত হতে যা সৃষ্টি লাভ করবে তার নায়ক-নায়িকা শিশু হতে পারে কিন্তু তাতে নিত্য সাহিত্যের রস সঞ্চিত থাকতে হবে। যথার্থ শিশুসাহিত্য সব বয়সের নর নারীর কাছে সমান রসাস্বাদ এনে দেবে।

এ সম্পর্কে C. L. Lewis বলেছেন :

No book is really worth reading at the age of ten which is not equally (and often farmore) worth reading at the age of fifty.

শিশু মনে হ্যান্স এ্যান্ডারসনের কাহিনী যে রোমাঞ্চ জাগায় বার্ধক্যে তা আরো গভীর আনন্দ বয়ে আনে ও গম্ভীর গভীরতায় মগ্ন হয়। বাংলা সাহিত্যে সুকুমার রায়ের ‘আবোল-তাবোল’ বইখানির লঘুতা ও কৌতুক শিশু একভাবে গ্রহণ করে খুশি হয় কিন্তু বয়স বাড়বার সাথে সাথে এর অন্যবিধ সৌন্দর্য, এর সূক্ষè ব্যাঙের কৌশল কবির স্বাভাবিক কবিত্ব শক্তির স্বরূপটি আবিষ্কৃত হতে থাকে।

এছাড়া শিশুর একটি নৈতিক জগৎ আছে; উচিৎ-অনুচিৎ, সৎ-অসৎ, ভাল-মন্দ সব কিছু সম্পর্কে কতকগুলি সিদ্ধান্ত আছে। অর্থাৎ পরিবার ও পরিবেশ হতে যে ধরনের শিক্ষালাভ সে করে এবং তার মনে যে সমস্ত মূল্যবোধ সৃষ্টি হয়, সেগুলোর আলোকেই সে সবকিছুর বিচার করে নেয়। তাই দুর্বলের উপর সবলের জয় সে পছন্দ করে না; অন্যায়ের প্রতিবিধান না হলে তার মন পীড়িত হয়।

তাহলে শিশুসাহিত্যের জন্য তিনটি মৌলিক বস্তুর প্রয়োজন রয়েছে। প্রথমতঃ শক্তিমান ও সহানুভূতিশীল লেখক, দ্বিতীয়তঃ উৎকৃষ্ট সাহিত্য রস এবং তৃতীয়তঃ চরিত্র গঠনের উপযোগী উপযুক্ত নীতিবিন্যাস।৩

নীতি আবার শুষ্ক উপদেশে পর্যবসিত না করে আনন্দের মোড়কে মুড়ে দেয়াই শিশু সাহিত্যিকের প্রধান কৃতিত্ব।

শিশুতোষ ও কিশোর-উপযোগী সাহিত্য রচনার জন্য প্রয়োজন শিশু ও কিশোর মনস্তস্ত¡বিদের। প্রয়োজন তাদের মনমানসিকতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়া ও গভীরভাবে পরিচিত হওয়া। তাদের আচার-আচরণ, ভাবনা-চিন্তা ও স্বপ্ন-কল্পনার ব্যাপারে অভিজ্ঞতা অর্জন, তাদের ভাষা, কথনভঙ্গি ও অভিব্যক্তি সম্পর্কে প্রত্যক্ষ জ্ঞান, সেই ভাষায় ও ভঙ্গিতে লেখার ক্ষমতা। নজরুল এর সবকিছুই আত্মস্থ করেছিলেন, সহজ ও স্বচ্ছন্দে লেখার ক্ষমতাও তিনি আত্মস্থ করেছিলেন। নজরুল শিশু ও কিশোর মনস্তত্ত্বের সঙ্গে একাত্ম হতে পেরেছেন বলে তাদের সাহিত্য রচনায় অনবদ্যরূপ ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন তাদের ভাবনা, স্বপ্ন ও আকাক্সক্ষা এবং আচার-আচরণ।

ভাষা ও ছন্দের উপর ছিল নজরুলের অপ্রতিহত অধিকার। ছিল অনুপ্রাস ও    অন্ত্যমিল সৃষ্টির অপরিসীম ক্ষমতা, উপমা ও চিত্রকল্প রচনার দক্ষতা এক্ষেত্রে নজরুলকে সার্থক শিশুÑকিশোর উপযোগী সাহিত্য রচনায় সহায়তা দিয়েছে। অনেকক্ষেত্রে সামান্য ঘটনা আর বিষয়বস্তুকেও নজরুল নাটকীয় করে তুলেছেন, করেছেন আকর্ষণীয় অনুপ্রেরণা-সঞ্চারী, করে তুলেছেন ব্যঙ্গ-কৌতুক হাস্যরসে ভরপুর। এই অসাধারণ সৃষ্টিক্ষমতার কারণেই তাঁর রচনায় বিধৃত সুখ-দুঃখের অনুভূতি শিশু কিশোর ও বয়স্ক সবার মনকেই সমানভাবে আন্দোলিত করে। নজরুলের শিশুতোষ রচনায় অতি তুচ্ছ ঘটনা ও বিষয় এমনকি এক ধরনের বিষয়হীনতাও যে অনবদ্য এবং আকর্ষণীয় রূপ লাভ করেছে সেও তাঁর ভাষা, ছন্দ ও অন্ত্যমিল প্রয়োগের অসামান্য ক্ষমতার গুণে।

তাঁর অধিকাংশ শিশুতোষ ছড়া ও লোকসাহিত্যের কবিতাগুলি স্বরবৃত্ত ছন্দে রচিত। বাংলা ছন্দের প্রয়োগে তিনি যে নতুনত্ব দেখিয়েছেন, শিশুসাহিত্য তার ব্যতিক্রম নয়।

লোকঐতিহ্যের নিরিখে তাঁর সমগ্র সাহিত্যকর্ম বিশ্লেষণ করে আমরা দেখেছি লোকঐতিহ্যের প্রায় প্রতিটি শাখায় রয়েছে নজরুলের স্বচ্ছন্দ বিচরণ। শিশুতোষ রচনার ক্ষেত্রেও গ্রামীণ জীবনের বর্ণনায়, গ্রামবাংলার নৈসর্গিক সৌন্দর্যের বর্ণনায়, গ্রামীণ জীবনের চালচিত্র যেমন গ্রামীণ সমাজে বিয়ের বর্ণনা, গ্রামীণ মহিলাদের চরিত্র-চিত্রন, গ্রামীণ উপমার ব্যবহার লোকজ উপাদানের সার্থক প্রয়োগ দেখিয়েছেন। ঘুমপাড়ানী গান, পল্লীনৃত্যের গান, গ্রাম্যসংগীত, মেয়েলি লোকসংগীতের সুরে গীতরচনা ব্যাপকভাবে বাংলার আকাশে বাতাসে সেগুলিকে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন নজরুল। সুধী সমাজে অবহেলিত লোকসংগীতকে তিনিই আপন মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

পরিশেষে নজরুল শিশুসাহিত্য পর্যালোচনা করে আমরা দেখেছি তাঁর উল্লেখযোগ্য দু’টি কবিতা ‘প্রভাতী’র ‘ভোর হলো / দোর খোল!’ ও ‘সাত ভাই চম্পা’ রচনার প্রথম কবিতা ‘আমি হব সকাল বেলার পাখি’তে নজরুল শিশুসাহিত্যের মর্মবাণী বিধৃত হয়েছে। কবিতাদ্বয়ে বর্তমান ও ভবিষ্যতের শিশু মনের আশা-আকাক্সক্ষার মূর্ত প্রকাশ ঘটেছে। বস্তুত: শিশু এখানে মানব সমাজে অগ্রদূতের ভূমিকা পালন করেছে।

কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা শিশুসাহিত্যে নবজাগরণের সঞ্চার করেছেন ও সাহিত্যের মাধ্যমে প্রগতিশীল মতামত ব্যক্ত করেছেন। সাহিত্যের প্রচলিত মেজাজকে ভেঙ্গে চুরে নতুন মেজাজ প্রবর্তন ও বুদ্ধির বিকাশ ও চিন্তার মুক্তির ক্ষেত্রে তার সমপর্যায়ের লেখক বাংলাসাহিত্যে দুর্লভ।

নজরুল বাংলাসাহিত্যের একজন সব্যসাচীপ্রতিম লেখকÑ সাহিত্যের সকল ক্ষেত্রেই  যাঁর অবাধ বিচরণ। তাঁর শিশুসাহিত্য চর্চা এমনি বিচরণের ফল। সে কারণে তাঁর শিশু সাহিত্য সৃষ্টি যৎসামান্য। কিন্তু এই সামান্য সৃষ্টি নজরুল প্রতিভার স্পর্শে ঋদ্ধ। তাঁর রচনাগুলি ছন্দিত। তিনি এগুলি লিখেছেনÑ শিশুদের প্রেরণা ও আনন্দদানের উদ্দেশ্যে। কিন্তু শুধু শিশুই নয় তাঁর রচিত সাহিত্য শিশু-বয়স্ক উভয়েরই শ্রুতি ও দৃষ্টিকে নন্দিত করে। তিনি সে সর্বতোভাবে সফল হয়েছিলেন তার প্রমাণ আমরা আমাদের জীবনে জাতীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানে বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে পাই। সুতরাং শিশুসাহিত্যের ক্ষেত্রে নজরুলের সৃষ্টি প্রয়াস অল্প হলেও তিনি আধুনিক বাংলা শিশুসাহিত্যের এক বিশিষ্ট স্রষ্টা। নজরুল তাই তাঁর মহাপ্রয়াণের পরেও সমান জনপ্রিয়।

পাদটীকা

১.             বাংলা শিশু সাহিত্যের ক্রমবিকাশ, প্রথম প্রকাশ ১৩৮৮, আশা দেবী, এম, এ, ডি, ফিল। পৃ. ৩০২।

২.     The Unreluctant Years Lilian. H. Smith, p. 14.

৩.            বাংলা শিশু সাহিত্যের ক্রমবিকাশ, প্রথম প্রকাশ ১৩৮৮, আশা দেবী, এম, এ, ডি, ফিল। পৃ. ৩০৭।

পরিশিষ্ট- ১

কাজী নজরুল ইসলাম রচনাপঞ্জি

 

শিশুতোষ কবিতা

১.             অমর কানন                :               ‘ছায়ানট’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। প্রথম প্রকাশ ‘বিজলী’ পত্রিকা। ১৩৩২ শ্রাবণে ৫ম বর্ষের ৩৩শ সংখ্যক সংখ্যাতে।

২.             আবীর        :               আব্দুল কাদির সম্পাদিত নজরুল রচনাবলীর তৃতীয় খন্ডে প্রকাশিত ‘গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত কবিতা ও গান’- এর অন্তর্ভুক্ত। প্রথম প্রকাশ ১৩৮১ সালের বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ সংখ্যক ‘সওগাত’ পত্রিকায়।

৩.            আগা মুর্গী লেকে ভাগা :               আব্দুল কাদির সম্পাদিত নজরুল রচনাবলীর তৃতীয় খন্ডে প্রকাশিত ‘গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত কবিতা ও গান’- এর অন্তর্ভুক্ত।

৪.             আগুনের ফুল্কি ছুটে     :               ঐ

৫.             আবাহন     :               ঐ

৬.            ঈদের চাঁদ  :               নজরুল ইসলাম প্রণীত ‘মক্তব সাহিত্য’ গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। প্রকাশকাল ৩১শে জুলাই ১৯৩৫। প্রকাশক খোন্দকার আব্দুল জব্বার। ২৫-এ পঞ্চানন টোলা লেন, কলিকাতা।

৭.             এস মধুমেলাতে          :               আব্দুল কাদির সম্পাদিত নজরুল রচনাবলীর তৃতীয় খন্ডে প্রকাশিত ‘গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত কবিতা ও গান’- এর অন্তর্ভুক্ত।

৮.            কিশোর স্বপ্ন                :               আব্দুল কাদির সম্পাদিত নজরুল রচনাবলীর তৃতীয় খন্ডে প্রকাশিত ‘গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত কবিতা ও গান’- এর অন্তর্ভুক্ত। ১৩৩৪ জ্যৈষ্ঠে ‘বেণু’ পত্রিকায় প্রকাশিত।

৯.            কিশোর স্বপ্ন                :               আব্দুল কাদির সম্পাদিত নজরুল রচনাবলীর তৃতীয় খন্ডে প্রকাশিত ‘গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত কবিতা ও গান’- এর অন্তর্ভুক্ত। ১৩৬৭ মাঘে ‘খেলাঘর’ পত্রিকায় মুদ্রিত।

১০.          কোথায় ছিলাম আমি    :               আব্দুল কাদির সম্পাদিত নজরুল রচনাবলীর তৃতীয় খন্ডে প্রকাশিত ‘গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত কবিতা ও গান’- এর অন্তর্ভুক্ত।

১১.           খাঁদু-দাদু    :               ‘ঝিঙে ফুল’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। ১৩৩৩ সালে প্রকাশিত। প্রকাশক ডি, এম, লাইব্রেরী। ৬১, কর্ণওয়ালিশ স্ট্রীট, কলিকাতা।

১২.           খুকি ও কাঠ বেড়ালি     :               ঐ

১৩.          খোকার খুশি               :               ঐ

১৪.           খোকার বুদ্ধি               :               ‘ঝিঙে ফুল’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। ১৩৩৩ সালে প্রকাশিত। প্রকাশক ডি, এম, লাইব্রেরী। ৬১, কর্ণওয়ালিশ স্ট্রীট, কলিকাতা। ব; মু; সা; পত্রিকায় প্রকাশিত। সাল ১৩২৮ কার্তিক।

১৫.           খোকার গপ্প বলা         :               ‘ঝিঙে ফুল’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। ১৩৩৩ সালে প্রকাশিত। প্রকাশক ডি, এম, লাইব্রেরী। ৬১, কর্ণ ওয়ালিশ স্ট্রীট, কলিকাতা। ব: মু: সা: পত্রিকায় প্রকাশিত। সাল ১৩২৮ কার্তিক।

১৬.          গদাই-এর পদবৃদ্ধি       :               আব্দুল কাদির সম্পাদিত নজরুল রচনাবলীর তৃতীয় খন্ডে প্রকাশিত ‘গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত কবিতা ও গান’- এর অন্তর্ভুক্ত। প্রথম প্রকাশ ১৩৪২ আশ্বিনের ‘মাসিক মোহাম্মদী’তে।

১৭.           চলব আমি হাল্কা চালে  :               আব্দুল কাদির সম্পাদিত নজরুল রচনাবলীর তৃতীয় খন্ডে প্রকাশিত ‘গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত কবিতা ও গান’- এর অন্তর্ভুক্ত। ১৩৩৪ সালের আশ্বিন সংখ্যা ‘মৌচাক’ পত্রিকায় মুদ্রিত হয়।

১৮.          চাষী          :               নজরুল ইসলাম প্রণীত ‘মক্তব সাহিত্য’ গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। প্রকাশকাল ৩১শে জুলাই ১৯৩৫। প্রকাশক খোন্দকার আব্দুল জব্বার, ২৫-এ পঞ্চানন টোলা লেন, কলিকাতা।

১৯.          চিঠি           :               ‘ঝিঙে ফুল’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। ১৩৩৩ সালে প্রকাশিত। প্রকাশক ডি, এম, লাইব্রেরী। ৬১, কর্ণ ওয়ালিশ স্ট্রীট, কলিকাতা। ব: মু: সা: পত্রিকায় প্রকাশিত। সাল ১৩২৮ কার্তিক।

২০.          ছোট হিটলার              :               আব্দুল কাদির সম্পাদিত নজরুল রচনাবলীর তৃতীয় খন্ডে প্রকাশিত ‘গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত কবিতা ও গান’- এর অন্তর্ভুক্ত।

২১.           জিজ্ঞাসা     :               আব্দুল কাদির সম্পাদিত নজরুল রচনাবলীর তৃতীয় খন্ডে প্রকাশিত ‘গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত কবিতা ও গান’- এর অন্তর্ভুক্ত। ‘শিশু মহল’ পত্রিকা। ১৩৩৪ সালের ১ম বর্ষের ১ম সংখ্যা।

২২.           ঝিঙে ফুল  :               ‘ঝিঙে ফুল’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। ১৩৩৩ সালে প্রকাশিত। প্রকাশক ডি, এম, লাইব্রেরী। ৬১, কর্ণ ওয়ালিশ স্ট্রীট, কলিকাতা।

২৩.          ঝুম্কো লতায় জোনাকি                :               আব্দুল কাদির সম্পাদিত নজরুল রচনাবলীর তৃতীয় খন্ডে প্রকাশিত ‘গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত কবিতা ও গান’- এর অন্তর্ভুক্ত।

২৪.           ঠ্যাং ফুলী   :               ‘ঝিঙে ফুল’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। ১৩৩৩ সালে প্রকাশিত। প্রকাশক ডি, এম, লাইব্রেরী। ৬১, কর্ণ ওয়ালিশ স্ট্রীট, কলিকাতা।

২৫.           দিরি বে’তে খোকা       :               ঐ

২৬.          নতুন পথিক                :               আব্দুল কাদির সম্পাদিত নজরুল রচনাবলীর তৃতীয় খন্ডে প্রকাশিত ‘গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত কবিতা ও গান’- এর অন্তর্ভুক্ত। ১৩৩৫ আষাঢ় ‘রাজভোগ’ পত্রিকা।

২৭.           নতুন খাবার                :               ঐ

২৮.          পিলে পট্কা                :               ‘ঝিঙে ফুল’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। প্রকাশকাল ১৩৩৩। প্রকাশক ডি, এম, লাইব্রেরী। ৬১, কর্ণ ওয়ালিশ স্ট্রীট, কলিকাতা।

২৯.          প্রভাতী      :               ‘ঝিঙে ফুল’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। প্রকাশকাল ১৩৩৩। প্রকাশক ডি, এম, লাইব্রেরী। ৬১, কর্ণ ওয়ালিশ স্ট্রীট, কলিকাতা।

৩০.          প্রার্থনা       :               আব্দুল কাদির সম্পাদিত নজরুল রচনাবলীর তৃতীয় খন্ডে প্রকাশিত ‘গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত কবিতা ও গান’- এর অন্তর্ভুক্ত।

৩১.          ফ্যাসাদ      :               ঐ

৩২.          বর-প্রার্থনা :               ঐ

৩৩.         বগ দেখেছ :               ঐ

৩৪.          মট্কু মাইতি বাঁটকুল রায়              :               ঐ

৩৫.          মা             :               ‘ঝিঙে ফুল’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। প্রকাশ কাল ১৩৩৩। প্রকাশক ডি, এম, লাইব্রেরী। ৬১, কর্ণ ওয়ালিশ স্ট্রীট, কলিকাতা। ব : মু : সা : পত্রিকায় প্রকাশিত। সাল ১৩২৮ শ্রাবণ।

৩৬.         মুকুলের উদ্বোধনী        :               আব্দুল কাদির সম্পাদিত নজরুল রচনাবলীর তৃতীয় খন্ডে প্রকাশিত ‘গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত কবিতা ও গান’- এর অন্তর্ভুক্ত। প্রথম প্রকাশ ১৩৬১ সালের ভাদ্র মাসে।

৩৭.          মাঙ্গলিক     :               আব্দুল কাদির সম্পাদিত নজরুল রচনাবলীর তৃতীয় খন্ডে প্রকাশিত ‘গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত কবিতা ও গান’- এর অন্তর্ভুক্ত।

৩৮.          মায়া-মুকুর :               আব্দুল কাদির সম্পাদিত নজরুল রচনাবলীর তৃতীয় খন্ডে প্রকাশিত ‘গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত কবিতা ও গান’- এর অন্তর্ভুক্ত।

৩৯.          মা এসেছে :               ঐ

৪০.          মোবারকবাদ              :               ‘নতুন চাঁদ’ গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। প্রথম প্রকাশ ১৯৪০ খৃ: ৭ই আগষ্ট। ‘মুকুলের মহফিল’ শিরোনামে ছাপা হয়েছিল।

৪১.           মোনাজাত :               নজরুল ইসলাম প্রণীত ‘মক্তব সাহিত্য’ গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। প্রকাশকাল ৩১শে জুলাই ১৯৩৫। প্রকাশক খোন্দকার আব্দুল জব্বার। ২৫-এ পঞ্চানন টোলা লেন, কলিকাতা।

৪২.           মৌলবী সাহেব            :               নজরুল ইসলাম প্রণীত ‘মক্তব সাহিত্য’ গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। প্রকাশকাল ৩১শে জুলাই ১৯৩৫। প্রকাশক : খোন্দকার আব্দুল জব্বার। ২৫-এ পঞ্চানন টোলা লেন, কলিকাতা।

৪৩.          লাল সালাম :               আব্দুল কাদির সম্পাদিত নজরুল রচনাবলীর তৃতীয় খন্ডে প্রকাশিত ‘গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত কবিতা ও গান’- এর অন্তর্ভুক্ত। ১৩৬০ সালে ‘মাহে-নও’ পত্রিকায় ‘একটি অপ্রকাশিত কবিতা’ শিরোনামে প্রকাশিত।

৪৪.           লিচু চোর   :               ‘ঝিঙে ফুল’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। প্রকাশকাল ১৩৩৩। প্রকাশক ডি, এম, লাইব্রেরী। ৬১, কর্ণ ওয়ালিশ স্ট্রীট, কলিকাতা।

৪৫.           শিশু সওগাত              :               আব্দুল কাদির সম্পাদিত নজরুল রচনাবলীর তৃতীয় খন্ডে প্রকাশিত ‘গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত কবিতা ও গান’- এর অন্তর্ভুক্ত। ১৩৬০ সালে ‘মাহে-নও’ পত্রিকায়। ১৩৪৪ মাঘে প্রথম বর্ষের প্রথম সংখ্যক ‘শিশু সওগাত’ পত্রিকায় প্রকাশিত।

৪৬.          সংকল্প       :               আব্দুল কাদির সম্পাদিত নজরন্ডল রচনাবলীর তৃতীয় খন্ডে প্রকাশিত ‘গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত কবিতা ও গান’- এর অন্তর্ভুক্ত। ১৩৬০ সালে ‘মাহে-নও’ পত্রিকায়। এর প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ও পঞ্চম স্তবক ‘দেখব এবার জগৎটাকে’ শিরোনামে বিশ্বভারতী গ্রন্থনা বিভাগ কর্তৃক প্রকাশিত ‘কবিতা সংকলন’ নামক বাংলা দ্রুত পাঠ্যপুস্তকে সংকলিত (অগ্রহায়ণ, ১৩৬৯) হয়েছে।

৪৭.           সারস পাখি :               আব্দুল কাদির সম্পাদিত নজরুল রচনাবলীর তৃতীয় খন্ডে প্রকাশিত ‘গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত কবিতা ও গান’- এর অন্তর্ভুক্ত। ১৩৬০ সালে ‘মাহে-নও’ পত্রিকায়।

৪৮.          হজরতের মহানুভবতা  :               নজরুল ইসলাম প্রণীত ‘মক্তব সাহিত্য’ গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। প্রকাশকাল ৩১শে জুলাই ১৯৩৫। প্রকাশক খোন্দকার আব্দুল জব্বার, ২৫-এ পঞ্চানন টোলা লেন, কলিকাতা।

৪৯.          হোঁদল কুঁৎকুঁতের বিজ্ঞাপন            :               ‘ঝিঙে ফুল’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। প্রকাশ কাল ১৩৩৩। প্রকাশক ডি, এম, লাইব্রেরী। ৬১, কর্ণ ওয়ালিশ স্ট্রীট, কলিকাতা। ‘অংকুর’ পত্রিকায় প্রকাশিত।

পরিশিষ্ট- ২

সঙ্গীত

১.             আয়না আয়না আয়না    :               ‘পুতুলের বিয়ে’ নাট্যগ্রন্থের      অন্তর্ভুক্ত। প্রকাশকাল- ১৩৪০ সাল, প্রকাশক- ডি, এম, লাইব্রেরী, ৬১ কর্ণওয়ালিশ স্ট্রীট, কলিকাতা।

২.             আমি যদি বাবা হতুম, বাবা হত খোকা             :               ঐ

৩.            একেক্কে এ্  :               ‘পুতুলের বিয়ে’ নাট্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। প্রকাশকাল- ১৩৪৪ অগ্রহায়ণে ‘মোয়াজ্জিন’ পত্রিকা।

৪.             ও ভাই কোলা ব্যাঙ     :               ‘পুতুলের বিয়ে’ নাট্যগ্রন্থের      অন্তর্ভুক্ত। প্রকাশকাল- ১৩৪০ সাল, প্রকাশক- ডি, এম, লাইব্রেরী, ৬১ কর্ণওয়ালিশ স্ট্রীট, কলিকাতা।

৫.             ওরে হুলোরে তুই রাত বিরেতে     :               ‘গীতি শতদল’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। ১৩৪১ সালের বৈশাখ মাসে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত। প্রকাশক- ডি, এম, লাইব্রেরী, ৬১ কর্ণওয়ালিশ স্ট্রীট, কলিকাতা।

৬.            কুলের আচার নাচার হয়ে              :               ‘পুতুলের বিয়ে’ নাট্যগ্রন্থের      অন্তর্ভুক্ত। প্রকাশকাল- ১৩৪০ সাল, প্রকাশক- ডি, এম, লাইব্রেরী, ৬১ কর্ণওয়ালিশ স্ট্রীট, কলিকাতা।

৭.             খেলি আয় পুতুল খেলা :               ‘পুতুলের বিয়ে’ নাট্যগ্রন্থের      অন্তর্ভুক্ত। প্রকাশকাল- ১৩৪০ সাল, প্রকাশক- ডি, এম, লাইব্রেরী, ৬১ কর্ণওয়ালিশ স্ট্রীট, কলিকাতা।

৮.            খুকুর দেবো বিয়ে বেগম মহলে      :               ঐ

৯.            ঘুম পাড়ানী গান          :               আব্দুল কাদির সম্পাদিত নজরুল রচনাবলীর তৃতীয় খন্ডে প্রকাশিত ‘গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত কবিতা ও গান’- এর অন্তর্ভুক্ত।

১০.          চম্কে চম্কে ধীর ভীরু পায়          :               ‘গীতি শতদল’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। ১৩৪১ সালের বৈশাখ মাসে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত। প্রকাশক- ডি, এম, লাইব্রেরী, ৬১ কর্ণওয়ালিশ স্ট্রীট, কলিকাতা।

১১.           ছেলেকপাটি বৃন্দাবন    :               ‘পুতুলের বিয়ে’ নাট্যগ্রন্থের      অন্তর্ভুক্ত। প্রকাশকাল- ১৩৪০ সাল, প্রকাশক- ডি, এম, লাইব্রেরী, ৬১ কর্ণওয়ালিশ স্ট্রীট, কলিকাতা।

১২.           ঝাঁকড়া চুলো তালগাছ

তুই দাঁড়িয়ে কেন ভাই :               ঐ

১৩.          টুলটুল ঝিঙে ফুল ঘুমে ঝিমায়        :               ঐ

১৪.           ঠ্যাং চ্যাগাইয়া প্যাঁচা যায়              :               ‘পুতুলের বিয়ে’ নাট্যগ্রন্থের      অন্তর্ভুক্ত। প্রকাশকাল- ১৩৪০ সাল, প্রকাশক- ডি, এম, লাইব্রেরী, ৬১ কর্ণওয়ালিশ স্ট্রীট, কলিকাতা।

১৫.           ত্রিভুবনের প্রিয় মোহাম্মদ              :               আব্দুল কাদির সম্পাদিত নজররুল রচনাবলীর তৃতীয় খন্ডে প্রকাশিত ‘গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত কবিতা ও গান’- এর অন্তর্ভুক্ত।

১৬.          তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে            :               ‘জুলফিকার’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। এর প্রথম সংস্করণের প্রকাশকাল ১৩৩৯-এর ভাদ্র মাসে। প্রকাশক- বি, দোজা, এম্পায়ার বুক হাউস, ১৫, কলেজ স্কোয়ার, কলিকাতা।

১৭.           ধন্ ধন্ ধন্ ধন্ মুরলি     :               ‘পুতুলের বিয়ে’ নাট্যগ্রন্থের      অন্তর্ভুক্ত। প্রকাশকাল- ১৩৪০ সাল, প্রকাশক- ডি, এম, লাইব্রেরী, ৬১ কর্ণওয়ালিশ স্ট্রীট, কলিকাতা।

১৮.          পুঁটু নাচে কোন খানে   :               ঐ

১৯.          প্রজাপতি   :               আব্দুল কাদির সম্পাদিত নজরুল রচনাবলীর তৃতীয় খন্ডে প্রকাশিত ‘গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত কবিতা ও গান’- এর অন্তর্ভুক্ত।

২০.          মোমের পুতুল মমীর দেশের মেয়ে :               ‘গানের মালা’ গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। এর প্রথম সংস্করণ ১৩৪১ সালের আশ্বিন মাসে প্রকাশিত হয়। প্রকাশকাল- গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় এ্যান্ড সন্স, ২০৩/১/১ কর্ণওয়ালিশ স্ট্রীট, কলিকাতা।

২১.           লাল নটের ক্ষেতে লাল টুকটুকে বউ               :               আব্দুল কাদির সম্পাদিত নজরুল রচনাবলীর তৃতীয় খন্ডে প্রকাশিত ‘গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত কবিতা ও গান’- এর অন্তর্ভুক্ত।

২২.           লাল টুক্টুক্ মুখে হাসি মুখখানি টুল্টুল্               :               ‘পুতুলের বিয়ে’ নাট্যগ্রন্থের      অন্তর্ভুক্ত। প্রকাশকাল- ১৩৪০ সাল, প্রকাশক- ডি, এম, লাইব্রেরী, ৬১ কর্ণওয়ালিশ স্ট্রীট, কলিকাতা।

২৩.          শুকনো পাতার নূপুর পায়ে           :               ‘গীতি শতদল’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। ১৩৪১ সালের বৈশাখ মাসে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত। প্রকাশক- ডি, এম, লাইব্রেরী, ৬১ কর্ণওয়ালিশ স্ট্রীট, কলিকাতা।

২৪.           হেডমাষ্টারের ছড়ি, সেকেন্ড মাষ্টারের দাড়ি :   ‘পুতুলের বিয়ে’ নাট্যগ্রন্থের      অন্তর্ভুক্ত। প্রকাশকাল- ১৩৪০ সাল, প্রকাশক- ডি, এম, লাইব্রেরী, ৬১ কর্ণওয়ালিশ স্ট্রীট, কলিকাতা।

পরিশিষ্ট- ৩

নাটিকা

১.             কালো জামরে ভাই     :               ‘পুতুলের বিয়ে’ নাট্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। প্রকাশকাল- ১৩৪০ সাল, প্রকাশক- ডি, এম, লাইব্রেরী, ৬১ কর্ণওয়ালিশ স্ট্রীট, কলিকাতা।

২.             কানামাছি   :               ঐ

৩.            কে কি হবি বল            :               ঐ

৪.             ছিনিমিনি খেলা            :               ঐ

৫.             জাগো সুন্দর চির কিশোর              :               ১৯৯১ সালে নজরুল ইন্সটিটিউট থেকে স্বতন্ত্র গ্রন্থাকারে প্রকাশিত।

৬.            জুজুবুড়ীর ভয়             :               ‘পুতুলের বিয়ে’ নাট্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। প্রকাশকাল- ১৩৪০ সাল, প্রকাশক- ডি, এম, লাইব্রেরী, ৬১ কর্ণওয়ালিশ স্ট্রীট, কলিকাতা।

৭.             নবার নামতা পাঠ        :               ‘পুতুলের বিয়ে’ নাট্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। প্রকাশকাল- ১৩৪০ সাল, প্রকাশক- ডি, এম, লাইব্রেরী, ৬১ কর্ণওয়ালিশ স্ট্রীট, কলিকাতা।

৮.            পুতুলের বিয়ে             :               ‘পুতুলের বিয়ে’ নাট্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। প্রকাশকাল- ১৩৪০ সাল, প্রকাশক- ডি, এম, লাইব্রেরী, ৬১ কর্ণওয়ালিশ স্ট্রীট, কলিকাতা।

৯.            শিশু যাদুকর               :               ‘পুতুলের বিয়ে’ নাট্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। প্রকাশকাল- ১৩৪০ সাল, প্রকাশক- ডি, এম, লাইব্রেরী, ৬১ কর্ণওয়ালিশ স্ট্রীট, কলিকাতা।

১০.          সত্যরক্ষা    :               নজরুল ইসলাম প্রণীত ‘মক্তব সাহিত্য’ গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। প্রকাশকাল ৩১শে জুলাই ১৩৩৫। প্রকাশক খোন্দকার আবদুল জব্বার, ২৫-এ পঞ্চানন টোলা লেন, কলিকাতা।

১১.           সাত ভাই চম্পা          :               ‘পুতুলের বিয়ে’ নাট্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। প্রকাশকাল- ১৩৪০ সাল, প্রকাশক- ডি, এম, লাইব্রেরী, ৬১ কর্ণওয়ালিশ স্ট্রীট, কলিকাতা।

পরিশিষ্ট- ৪

গল্প

১.             আল্লাহ্তায়ালা             :               নজরুল ইসলাম প্রণীত ‘মক্তব সাহিত্য’ গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। প্রকাশকাল ৩১শে জুলাই ১৩৩৫। প্রকাশক খোন্দকার আবদুল জব্বার, ২৫-এ পঞ্চানন টোলা লেন, কলিকাতা।

২.             ঈদের দিনে :                               ঐ

৩.            উদ্ভিদ        :                               ঐ

৪.             কাবা শরীফ :                               ঐ

৫.             কোরআন শরীফ          :                               ঐ

৬.            গোরু        :                               ঐ

৭.             পরিচ্ছদ     :                               ঐ

৮.            পানি          :                               ঐ

৯.            বিড়াল       :                               ঐ

১০.          হযরত মোহাম্মদের উম্মত পরীক্ষা :               ঐ

 

সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি

১.             আব্দুল আজিজ আল মামুন           :               সংগ্রহ ও সম্পাদনা; অপ্রকাশিত নজরুল। প্রথম প্রকাশ- শুক্রবার, ১লা অগ্রহায়ণ, ১৯৩৬, ১৭ নভেম্বর, ১৯৮৯। হরফ প্রকাশনী, এ-১২৬ কলেজ স্ট্রীট মার্কেট, কলিকাতা- ৭০০০০৭।

২.             ঐ             :               নজরুল গীতি (অষন্ড) প্রকাশকাল- ৬ আশ্বিন ১৩৮৫, ২৩শে সেপ্টেম্বর, ১৯৭৮। প্রকাশক- আব্দুল আজিজ আল মামুন এম, এ,। প্রকশনা- হরফ প্রকাশনী, কলিকাতা।

৩.            আতোয়ার রহমান        :               নজরুল বর্ণালী। প্রকাশকাল- ফাল্গুন ১৪০০ সাল। ফেব্রুয়ারী ১৯৯৪। প্রকাশনায়- আবুল কালাম আজাদ, নজরুল ইন্সটিটিউট, ঢাকা।

৪.             ঐ             :               শিশু সাহিত্যে মুসলিম সাধনা। প্রথম প্রকাশ- পৌষ ১৪০০। জানুয়ারী ১৯৯৪। প্রকাশক- সংকলন ফোকলোর বিভাগ, বাংলা একাডেমী, ঢাকা।

৫.             আবদুল মান্নান সৈয়দ   :               নজরুল ইসলাম/কবি ও কবিতা। প্রথম প্রকাশ- ২৯ আগষ্ট ১৯৭৭, ১২ ভাদ্র ১৩৮৮। প্রকাশক- তালিম হোসেন, নজরুল একাডেমী, বেলালাবাদ কলোনী, ঢাকা- ২।

৬.            আশা গঙ্গোপাধ্যায়       :               বাংলা শিশু সাহিত্যের ক্রমবিকাশ। (১৮০০-১৯০০) প্রথম মুদ্রণ- ১৩৮৮। প্রকাশক- শ্রী গোপালদাস মজুমদার। প্রকাশনায়- রূপবানী প্রেস- ৩১, বাদুড়বাগান স্ট্রীট, কলিকাতা- ৯।

৭.             এম, এ, মজিদ            :               ছোটদের কবি নজরুল। প্রথম প্রকাশ- বৈশাখ, ১৩৭৫, এপ্রিল, ১৯৬৮। প্রকাশনায়- এ, এম, সামসুদ্দিন, সিটি লাইব্রেরী, ৩৮/৬, বাংলা বাজার, ঢাকা-১।

৯.            করুণাময় গোস্বামী       :               সম্পাদনা; নজরুলের শিশুতোষ কবিতা। প্রকাশকাল- মাঘ, ১৪০১। ফেব্রুয়ারী, ১৯৯৫। প্রকাশক- রশিদুন নবী। নজরুল ইন্সটিটিউট, ঢাকা।

৯.            কালীপদ দাস              :               ছোটদের নজরুল; প্রথম প্রকাশ ১৯৯১ ইং, প্রকাশনায়- সাহিত্যমালা, ৩৪/২ নর্থব্রুক হল রোড, বাংলাবাজার, ঢাকা।

১০.          খগেন্দ্রনাথ মিত্র           :               শতাব্দীর শিশু সাহিত্য। প্রথম প্রকাশ- সেপ্টেম্বর, ১৯৫৮। প্রকাশক শ্রী মনো মোহন মুখোপাধ্যায়, বিদ্যালয় প্রাইভেট লিমিটেড, কলিকাতা।

১১.           ফেরদৌস ইসলাম       :               ছোটদের নজরুল। প্রথম প্রকাশ- মার্চ, ১৯৯৫। প্রকাশক- মোসলেম উদ্দীন, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ, ঢাকা- ২।

১২.           মাহবুবুল আলম          :               বাংলা ছন্দের রূপরেখা। পঞ্চম সংস্করণ- আগষ্ট, ১৯৮০। প্রকাশক- কে, এম, ফারুক খান, খান ব্রাদার্স এন্ড কোম্পানী, ৬৭ প্যারিদাস রোড, ঢাকা- ১।

১৩.          মোবাশ্বের আলী          :               নজরুল প্রতিভা : প্রথম সংস্করণ- ভাদ্র, ১৩৭৬। প্রকাশক- চিত্তরঞ্জন সাহা, মুক্তধারা [স্ব: পুঁথিঘর লি:] ৭৪, ফরাশগঞ্জ, ঢাকা- ১১০০।

১৪.           মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান                :               নজরুল সমীক্ষণ। প্রথম প্রকাশ- ১১ই জ্যৈষ্ঠ ১৩৭৯। প্রকাশক-মোহাম্মদ সুলতান, আনন্দ প্রকাশন, ১১ শ্রীশদাস লেন, বাংলা বাজার, ঢাকা- ১।

১৫.           মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন :               ‘সওগাত’ যুগে নজরুল ইসলাম। প্রথম প্রকাশ-আষাঢ়, ১৩৯৫। জুন, ১৯৮৮। প্রকাশক- মোহাম্মদ মাহ্ফুজউল্লাহ্। নজরুল ইন্সটিটিউট, ঢাকা।

১৬.          মোহাম্মদ মাহ্ফুজউল্লাহ               :               নজরুল ইসলাম ও আধুনিক বাংলা কবিতা। প্রথম প্রকাশ- ১১ই জ্যৈষ্ঠ, ১৩৭০, মে, ১৯৬৩। প্রকাশনায়- লতিফা বানু। সাহিত্য মঞ্জিল, ৪১, আগা মসিহ্ লেন, ঢাকা- ২।

১৭.           হায়াৎ মাহমুদ             :               নজরুল ইসলাম : কিশোর জীবন। প্রথম প্রকাশ- ফেব্রুয়ারী, ১৯৮৯। প্রতীক প্রকাশনা সংস্থা; ৪৬/২ হেমেন্দ্র দাস রোড, সূত্রাপুর, ঢাকা- ১১০০।

১৮.          শাহাবুদ্দীন আহমদ       :               ছোটদের নজরুল। প্রথম প্রকাশ- সেপ্টেম্বর, ১৯৭৭। প্রকাশক- চিত্তরঞ্জন সাহা, মুক্তধারা (স্ব: পুঁথিঘর লি:) ৭৪, ফরাশগঞ্জ, ঢাকা- ১১০০।

১৯.          সেলিম জাহাঙ্গীর          :               লোকায়ত নজরুল। প্রথম প্রকাশ- আষাঢ়, ১৪০৪। জুন, ১৯৯৭। প্রকাশক- রশিদুন নবী, গবেষণা ও প্রকাশনা বিভাগ, নজরুল ইন্সটিটিউট, ধানমন্ডি, ঢাকা।