বাংলা বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ঢাকা
এম. ফিল. ডিগ্রীর জন্যে লেখা গবেষণা অভিসন্দর্ভ।
নজরুলের শিশুসাহিত্য : (এম. ফিল গবেষণা অভিসন্দর্ভ)
সৈয়দা মোতাহেরা বানু
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নথিভুক্ত নম্বর :
:
RB
৮৯১.৪৪
BAN
১৯৯৬
প্রকাশক : নজরুল ইন্সটিটিউট। বাড়ী-৩৩০বি, রোড-২৮ (পুরাতন) ধানমন্ডি, ঢাকা-১২০৯।
প্রথম মুদ্রণ : অগ্রহায়ণ ১৪০৭ / ডিসেম্বর ২০০০।
দ্বিতীয় মুদ্রণ : আষাঢ় ১৪০৮ / জুলাই ২০০১।
অভিসন্দর্ভটি নজরুল ইন্সটিটিউট। বাড়ী-৩৩০বি, রোড-২৮ (পুরাতন) ধানমন্ডি, ঢাকা-১২০৯ হতে নি¤œলিখিত শিরোনামে প্রকাশিত
নজরুলের শিশুসাহিত্য
সৈয়দা মোতাহেরা বানু
ভূমিকা
বিশ শতকের পূর্বে বাংলা শিশুসাহিত্য প্রথমত: বিদ্যালয়ের পাঠ্য, দ্বিতীয়ত: অনুবাদ, তৃতীয়ত: নীতিশিক্ষামূলক ছিল। শিশুসাহিত্যের স্বাধীনভাবে স্ফূরণ ঘটে ঠাকুর বাড়ীর জ্ঞানদানন্দিনী দেবী সম্পাদিত ‘বালক’ (১৮৮৫) পত্রিকার মাধ্যমে। দিকপাল লেখকেরা শিশুদের জন্য লিখতে শুরু করেন। শিশুসাহিত্যের বিকাশ ঘটতে থাকে।
তারপর ভূবন মোহন রায়ের পত্রিকা ‘সাথী’ ও ‘সখা এবং আচার্য শিবনাথ শাস্ত্রীর পত্রিকা ‘মুকুল’ (১৮৯৫) প্রকাশিত হয়। এইসব পত্রিকার মাধ্যমে যে সব লেখকের উদ্ভব হয় তাদেরকে বিশ শতকের বাংলা শিশুসাহিত্যের পথিকৃত হিসাবে বিবেচনা করা যায়। এদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, যোগীন্দ্রনাথ সরকার, নবকৃষ্ণ ভট্টাচার্য, গিরিন্দ্রমোহন দাসী, দ্বিজেন্দ্রনাথ বসু, জগদানন্দ রায়, হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ, দীনেন্দ্রকুমার রায় ও জলধর সেন প্রমুখ সাহিত্যিক শিশুসাহিত্যের ক্ষেত্রে অবদান রাখেন। এই পর্বে পাঠ্যপুস্তকের প্রত্যক্ষ শাসন হতে শিশুসাহিত্য মুক্তি লাভ করে। নবীন লেখকেরা বুঝেছিলেন, যে ছোটদের সর্বাঙ্গীন মানসিক উৎকর্ষ সাধন করতে হলে আনন্দকে প্রথম সারিতে রেখে নীতিকে নেপথ্যে রাখতে হবে। যোগীন্দ্রনাথের ‘হাসি ও খেলা’ অবনীন্দ্রনাথের ‘শকুন্তলা’ ও ‘ক্ষীরের পুতুল’ এ দিক থেকে অনন্য কৃতিত্বের নিদর্শন।
বিশ শতকের সূচনালগ্নের উল্লেখযোগ্য শিশুসাহিত্যিক অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি বিদ্যালয়গ্রাহ্য বিদ্যায় অনুরাগী ছিলেন না। ছেলেবেলায় ঘরে শোনা গল্পে ও ছড়ায় তাঁর মন অভিষিক্ত ছিল। তাঁর ছিল মৌলিক শিল্পপ্রতিভা। যার সঙ্গে যোগ হয়েছিল সাহিত্যপ্রতিভা। পুরোনো রূপকথা কাহিনীকে নতুন রঙ্গে রঞ্জিত করে অবনীন্দ্রনাথ সাহিত্যের আসরে প্রথম দেখা দেন ‘শকুন্তলা’ (১৮৯৫) নিয়ে। মহাকবি কালিদাসের ‘শকুন্তলা’ নাটককে লেখক আখ্যানবস্তুরূপে নির্বাচন করে এটিকে রূপকথায় পরিণত করেন। তাঁর মহর্ষি কন্বের আশ্রমের বর্ণনা নি¤œরূপ,
বনে বনে হোমের কাঠ কুড়িয়ে বেড়াত, কালো গাই ধ’লো গাই মাঠে চরাতে যেত, সবুজ মাঠ ছিল তাতে গাই বাছুর চড়ে বেড়াতে, বনে ছায়া ছিল, ময়ূর গড়বার মাটি ছিল, বেণু বাঁশের বাঁশি ছিল, বটপাতার ভেলা ছিল, আর ছিল খেলবার পাখি, বনের হরিণ, গাছের ময়ূর আর মা গৌতমীর মুখে দেব দানবের যুদ্ধকথা, তাত কন্বের মুখের মধুর সামবেদ গান।
সকলি ছিল, ছিল না কেবল-আঁধার ঘরের মানিক ছোট মেয়ে শকুন্তলা। একদিন নিশুতি রাতে অপ্সরী মেনকা তার রূপের ডালি দুধের বাছা শকুন্তলা মেয়েকে সেই তপোবনে ফেলে রেখে গেলে বনের পাখিরা তাকে ডানায় ঢেকে বুকে করে রেখে দিলে।১
অবনীন্দ্রনাথের দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘ক্ষীরের পুতুল’-এ তার শক্তি আরো উজ্জ্বল। গল্পটিতে ‘Puss-in-Boots’ এর ক্ষীণছায়া আছে। রূপকথার পদ্ধতিতে গল্পটি বিন্যস্ত। এর ঢংটিও মা দিদিমার মুখে ব্রত কথা বলবার মত। এর সাথে ছেলে ভুলানো ছড়ার চিত্রগুলি যথেচ্ছ ব্যবহার করেছেন,
ঝুরঝুরে বালির মাঝে চিক্চিকে জল, তারি ধারে একপাল ছেলে দোলায় চেপে ছপন কড়ি গুনতে গুনতে মাঝ ধরতে এসেছে; কারে পায়ে মাছের কাঁটা ফুটেছে, কারো চাঁদমুখে রোদ পড়েছে। জেলেদের ছেলে জালমুড়ি দিয়ে ঘুম দিচ্ছে, এমন সময় টাপুর টুপুর বৃষ্টি এল, নদীতে বাণ এল; অমনি সেই ছেলের পাল, সেই কাঠের দোলা, সেই ছপন কড়ি ফেলে কোন্ পাড়ার কোন্ ঘরের কোণে ফিরে গেল। পথের মাঝে তাদের মাছগুলো চিলে কেড়ে নিলে কুনোব্যাঙে ছিপগুলো টেনে নিলে, খোকাবাবুরা ক্ষিপ্ত হয়ে ঘরে এলেন, মা তপ্ত দুধ জুড়িয়ে খেতে দিলেন, আর সেই চিক্ চিকে জলের ধারে ঝুরঝুরে বালির চরে শিব ঠাকুর এসে নৌকা বাঁধলেন তার সংগে তিন কন্যে এক কন্যে রাঁধলেন বাড়লেন, এক কন্যে খেলেন আর এক কন্যে না খেয়ে বাপের বাড়ী গেলেন। বামন তাঁর সংগে বাপের বাড়ীর দেশে গেল। সেখানে জলের ঘাটে মেয়েগুলি নাইতে এসেছে, কালো কালো চুলগুলি ঝাড়তে লেগেছে, তার একটি গুরুঠাকুর নিলেন, আর একটি নায়ে ভরা দিয়ে টিয়ে আসছিল সে নিলে। তাই দেখে ভোঁদর টিয়েকে এক হাতে নিয়ে আর মাছকে এক হাতে নিয়ে নাচতে আরম্ভ করলে, ঘরের দুয়ারে খোকার মা খোকা বাবুকে নাচিয়ে নাচিয়ে বললেন-ওরে ভোঁদর ফিরে চা, খোকার নাচন দেখে যা।২
অবনীন্দ্রনাথের ‘ক্ষীরের পুতুল’ দক্ষিণারঞ্জন মিত্রের কল্পনার সোনার কাঠি রূপোর কাঠির স্পর্শ বুলিয়ে তাঁকে উদ্বুদ্ধ করেছিল এবং তিনি এর অনুসরণে ‘ঠাকুরমার ঝুলি’ প্রকাশ করেছিলেন।
অবনীন্দনাথের অন্যান্য রচনা ‘নালক’, ‘খাতাঞ্চির খাতা’, ‘বুড়ো আংলা’, ‘ভূত-পতরীর দেশ’ (১৯৯৫), ও ‘চাঁই দিদি’র কাহিনীগুলি অপূর্ব। তবে তাঁর ‘ভূত পত্রীর দেশ’-এর কাহিনীর অসাধারণতার জন্য এটির রস গ্রহণ বয়স্ক পাঠকের পক্ষে অসুবিধাজনক। ঈশ্প ও কথামালার গল্প আশ্রয়ে তাঁর পালাগুলিও ঠিক একই কারণে শিশুদের জন্যে দুরূহ হয়ে উঠেছে।
বিশ শতকের আচার্য শিবনাথ শাস্ত্রীর ‘মুকুল’(১৮৯৫) একটি উৎকৃষ্ট পত্রিকা। নব-বিধানের ‘প্রকৃত’বের হয়েছে ১৯০৭ সালে। ঢাকা হতে অনুকুলচন্দ্র শাস্ত্রীর সম্পাদনায় ‘তোষিনী’১৯১০ সালে প্রকাশিত হয়। হেমেন্দ্রপ্রসাদ ‘আষাঢ়ে গল্প’ লিখেছেন ১৯০১ সালে। যোগীন্দ্রনাথ সরকারের ‘ছবির বই’ ১৯০২, ‘হাসিরাশি’ ১৯০২ এবং ‘নতুন ছবি’ ১৯০৩ সালে প্রকাশিত হয়। নবকৃষ্ণের ‘ছেলে খেলা’র দ্বিতীয় মুদ্রণ প্রকাশিত হয় ১৯০৪ সালে, মনোমোহন সেনের ‘খোকাবাবুর দপ্তর’ ১৯০২ সালে দুই খন্ডে বের হয়, অল্প কিছু পরে বের হয় তাঁর ‘মোহনভোগ’। ১৯০৪ সালে তাঁর ‘শিশুতোষ’ বের হয়। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী প্রাচীন কালের জীবজন্তু নিয়ে যে সমস্ত মনোরম প্রবন্ধ লিখেছিলেন সেগুলো একত্রে গ্রথিত করে ১৯০৩ সালে ‘সেকালের কথা’ প্রকাশ করেন।
বিশ শতকে উৎকট ভৌতিক গল্পের আবির্ভাব হয়েছে আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের হাতে। তাঁর ‘ভূত-পেতœী’ ১৩০৯ সালে ও ‘রাক্ষস-খোক্কস’ ১৩১০-এর প্রমাণ। প্রথমটি গ্রাম্যতার প্রতিমূর্তি, এর স্থূলকাহিনী ও কদাকার চিত্র বহু বৎসর ধরে শিশু মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে এবং দ্বিতীয়টি রূপকথা। তাঁর ‘সপ্ত আশ্চর্য্য’ ১৯০৩ সালে রচিত পৃথিবীর সপ্ত আশ্চর্য্যরে বর্ণনামূলক একটি সুন্দর বই।
১৩১০ সালে মোহিতচন্দ্র সেন সম্পাদিত কাব্য গ্রন্থাবলীর সপ্তম খন্ডরূপে দেখা দেয় রবীন্দ্রনাথের ‘শিশু’। কবি পতœীর দেহান্তরের (৭ই অগ্রহায়ণ, ১৩০৯) পর বেদনার্ত হৃদয়ে সন্তানদের সান্ত¡না দিবার জন্য তিনি শিশুদের উপযোগী কিছু কবিতা, নাটক, যেমন ‘নদী’, ‘মুকুট’, ‘শিশু ভোলানাথ’, ‘খাপছাড়া’, ‘সে’, ‘ছড়ার ছবি’, ‘ছেলেবেলা’, ‘গল্প সল্প’, ‘সহজপাঠ’, ‘পাঠ প্রচয়’ এবং ‘ছুটির পড়া’ রচনা করেন।
‘বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদেয় এল বান’ বালকের পৃষ্ঠায় শিশুদের জন্য রচিত তাঁর সর্বপ্রথম কবিতা। এটি কেবল অল্পবয়সী পাঠককে উদ্দেশ্য করেই লেখা নয়। রবীন্দ্রনাথের মন বর্ষণমুখরিত দিনে বিস্মৃতযুগের উজ্জয়িনীচারিনী ‘মালবিকা’র স্বপ্ন দেখে সেই মনটিই আর একভাবে নিজের ফেলে আসা অতীতের দিকে যাত্রা শুরু করেছে,
… মনে পড়ে সুয়োরাণী দুয়োরাণীর কথা,
মনে পড়ে অভিমানী কংকাবতীর ব্যথা।
মনে পড়ে ঘরের কোণে মিটিমিটি আলো,
একটা দিকের দেয়ালেতে ছায়া কালো কালো –
(রচনাবলীর পাঠ)
শৈশবের হারিয়ে যাওয়া দিনগুলোর জন্য বয়স্ক মনের দীর্ঘশ্বাস ‘কড়ি ও কোমলের উপকথা’ কবিতাতেও অনুরূপভাবে ঝরে পড়েছে,
রাজপুত্র অবহেলে কোন দেশে যেত চলে
কথা নদী কত সিন্ধু পার।
সরোবর ঘাট আলো মনি হাতে নাগবালা
বসিয়া বাঁধিত কেশভার
সিন্ধুতীরে কতদূরে কোন রাক্ষসের পুরে
ঘুমাইত রাজার ঝিয়ারী
তাঁর এই কবিতাগুলির মধ্যে দুইটি সুস্পষ্ট বিভাগ লক্ষ করা যায়। এক দিকে তাঁর মন পরিত্যক্ত বাল্য জীবনের মধ্যে ফিরে গিয়ে বালক হয়ে উঠেছে আর একদিকে মাতা-পিতার যৌথ বাৎসল্যের ¯েœহধারা অকৃত্রিমভাবে উৎসারিত হয়ে পড়েছে। এ প্রসঙ্গে ‘হাসি-রাশি’, ‘বাব্লা রাণী’, ‘মায়ের আশা’ ও ‘আশীর্ব্বাদ’ উল্লেখযোগ্য। তাঁর স্মৃতিচর্চার পরিচয় বহন করছে ‘বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর’, ছাড়াও ‘সাত ভাই চম্পা’, ‘পুরোনো বট’ ইত্যাদি কবিতা। ‘কড়ি ও কোমল’-এর বিস্তীর্ণ মংগল গীতির তিনটি কবিতার আদেশ ও উপদেশপূর্ণ বক্তব্য শিশুদের কাছে সম্পূর্ণ স্পষ্ট নয়। রবীন্দ্রনাথের ‘নদী’ কবিতাটি শিশুদের জন্য রচিত হলেও চিত্র রচনার কৌশলে, প্রকৃতি জীবজন্তু দেশ-বিদেশের মানুষের সংক্ষিপ্ত অথচ অপরূপ নিপুণ বর্ণনায় এবং ভাষার কোমল কারুকৃতিতে তরুণ পাঠকের মনকেই বেশী আকৃষ্ট করে।
রবীন্দ্রনাথের ‘কথা ও কাহিনী’ বিশ শতকের প্রথম দশকের স্মরণযোগ্য কিশোর সাহিত্য। ‘কথা ও কাহিনী’র ‘শ্রেষ্ঠ ভিক্ষা’, ‘মানী’, ‘বন্দীবীর’, ‘নগর লক্ষèী’, ‘বিচারক’, ‘নিষ্ফল উপহার’, ‘নকল গড়’, ‘পণ রক্ষণ’, ‘স্পর্শমণি’, ‘পুরাতন ভৃর্ত্য’, এবং ‘দুই বিঘা জমি’ কিশোর সাহিত্যের পর্যায়ভুক্ত।
শিশু ও কিশোরদের মধ্যে কোন অনুকম্পার সীমারেখা রাখেননি বলে রবীন্দ্রনাথের বহু রচনা শিশু সাহিত্যরূপে চিহ্নিত হয়েও শিশুদের জন্য নয়। রবীন্দ্রনাথের শিশু গ্রন্থগুলির মধ্যে মায়ের মন, শিশুর ভাবনা এবং শিশুর ভাবনা সম্পর্কে বয়স্কের অনুভবÑ এই ত্রিধারা একসঙ্গে মিলেছে।
বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ১৯০৫ সালে বাঙালীর জীবনে নবজাগরণ দেখা দিল। ফলে বাঙালী তাঁর ঐতিহ্য সম্পর্কে অনুসন্ধ্যিৎসু হল। সে আলোকে উদ্ভাসিত হয়ে দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার লিখলেন ‘ঠাকুরমার ঝুলি’ ১৯০৭ সালে। কালীপ্রসন্নের সহযোগে আর একখানি চমৎকার বই তিনি রচনা করেছিলেন ১৯০৯ সালে, সেটি ‘সচিত্র রসল চন্ডী’ ১৯০৯ সালে। শিশুদের জন্য মার্কন্ডেয় চন্ডীকে গদ্যে পদ্যে পরিবেশন করা হয়েছিল এবং এতে প্রচুর রঙীন ছবিও ছিল। ঢাকার ‘তোষিণী’ পত্রিকায় তার শিশুপাঠ্য উপন্যাসে ‘চারু ও হারু’ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল ১৯২২ সালে। ডে রচিত ‘Sandford and Marten’ -এর সূচনায় সামান্য সাদৃশ্য আছে কিন্তু এতে সমগ্রভাবে দক্ষিণারঞ্জণের মৌলিকতার পরিচয় আছে।
অন্যান্য লেখকের মধ্যে কয়েকটি জাপানী উপকথার স্বচ্ছন্দ অনুবাদ করে ভারতীয় সম্পাদক মনিলাল গঙ্গোপাধ্যায় ১৯০৮ সালে ‘জাপানী ফানুষ’ প্রকাশ করেন। ‘বালক’ সম্পাদিকা জ্ঞানদানন্দিনী দেবী ‘টাক্ডুমাডুম’ ও ‘সাত ভাই চম্পা’ লেখেন ১৯১০ সালে। দীনেন্দ্রকুমার রায় ১৯১৩ সালে ‘দানোর দান’ প্রকাশ করেন।
রজনীকান্ত সেনের ‘অমৃত’ ১৯১০ সালের বৈশাখ মাসে পুনর্মূদ্রিত হয়। এটি উপদেশপূর্ণ প্রসঙ্গ নিয়ে অনেকগুলি মনোহর কবিতার সমাবেশ। যেমন : ‘নদী কভু পান নাহি করে নিজ জল’ অথবা ‘ প্রভৃ ভৃত্যে দুইজনে নৌকা বাহি যায়’।৩
মহারাজ মনীন্দ্রচন্দ্র নন্দীর পৃষ্টপোষকতায় এং বরদাকান্ত মজুমদারের সম্পাদনায় ১৯১৩ সালে ‘শিশু’ নামে আরেকটি উচ্চাঙ্গের পত্রিকা প্রকাশিত হয়। এই পত্রিকা প্রকাশ প্রসঙ্গে সম্পাদকের মতামত : “‘শিশু’ শিশুদের খেলার সাথী- শিক্ষার সহচর। শিশুদিগকে আমোদের সহিত শিক্ষাদান করাই শিশুর উদ্দেশ্য।”৪
দক্ষিণারঞ্জন মিত্রের একটি কবিতা দিয়েই পত্রিকাটির সূচনা হয়েছিল :
শিশু
ওগো
আমরা এসেছি আজ
সোনার স্বপন দুটি ভাইভোন
সোনার দেশের বুক
হাসিয়া এসেছি মুখে।৫
এই পত্রিকাতেই হাসির কবিতার রচয়িতারূপে বিশিষ্ট লেখক হরপ্রসন্ন দাশগুপ্তের ‘সোনার দাঁত’, ‘পান্তা বুড়ি’, ‘বিদ্যাভূতুম’ ও ‘সাতখানি পিঠে’ প্রভৃতি মজার কবিতা প্রকাশিত হয়। পরে তার কাব্য গ্রন্থ ‘রঙিলায়’ তা প্রকাশিত হয় ১৯১৪ সালে।
১৯১৩ সালে ‘ধ্রুব’ নামে বীরেন্দ্র ঘোষের সম্পাদনায় একটি সচিত্র মাসিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। পত্রিকাটি বেশী দিন চালু ছিল না।
বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে প্রকাশিত ‘সন্দেশ’ (১৯১৪) একটি উল্লেখযোগ্য পত্রিকা। সম্পাদনা করেন উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী। সম্পাদকের গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ এবং তাঁর আাঁকা চিত্রে পত্রিকাটি সমৃদ্ধ ছিল।
১৯১২ সাল হতে তাঁর সুযোগ্য পুত্র সুকুমার রায় পত্রিকাটি সম্পাদনার ভার গ্রহণ করেন। লেখক হিসেবে এই পত্রিকায় তাঁর একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। এই পত্রিকাতেই তাঁর শ্রেষ্ঠ শিশুসাহিত্য ‘আবোল-তাবোল’, তাঁর, ‘এলিস ইন্ ওয়ান্ডারল্যান্ড’-এর ধরনে লিখা ‘হযবরল’, ‘পাগলা দাশু’র মজার গল্পগুলি এবং ‘লক্ষণের শক্তিশেল’ এবং ‘অবাক জলপান’, নাটক প্রকাশিত হয়। ‘আবোল-তাবোল’ এর ভূমিকায় তিনি লিখেছেন : ‘যাহা আজগুবি, যাহা উদ্ভট, যাহা অসম্ভব তাহাদের লইয়াই এই পুস্তকের কারবার। ইহা খেয়াল রসের বই। সুতরাং সে রস যাহারা উপভোগ করিতে পারেন এ পুস্তক তাহাদের জন্য নহে’। ‘পাগলা দাশু’ সুকুমার রায়ের একটি উল্লেখযোগ্য শিশুপাঠ্য বই। প্রকাশিত হয় ২২শে নভেম্বর ১৯৪০ সালে। রবীন্দ্রনাথ-এর প্রশংসাসূচক মন্তব্যে লিখেন : ‘সুকুমারের লেখনী থেকে যে অবিমিশ্র হাস্যরসের উৎসধারা বাংলা সাহিত্যকে অভিষিক্ত করেছে তা অতুলনীয়’। মূলত তাঁর বিশেষত্ব হাস্যোচ্ছ্বাসে।
সুকুমার শিশুসাহিত্যের ‘অন্যান্য গল্পে’ তিনটি গল্প আছে : ‘বাজে গল্প’ ও ‘হেশোরাম হুঁশিয়ারের ডায়েরি’ ’সন্দেশ’ পত্রিকায় প্রথমে প্রকাশিত হয়েছিল। পরে ‘পাগলা দাশু’ পুস্তকের প্রথম সংস্করণে প্রথম মুদ্রিত হয়েছিল। এসব গল্পের অধিকাংশই ভাবানুবাদ। অন্য রাষ্ট্র এবং বিদেশী পৌরাণিক গল্পগুলি এতে রয়েছে। যেমন, ‘ভাঙা তারা’, ‘মাওরি দেশের গল্প’, ‘খৃষ্ট বাহন’, ‘রোমান ক্যাথলিক’, ‘কাহিনী’, ‘দেবতার দুর্বুদ্ধি’, ‘নরওয়ে দেশের পুরান’, ‘বুদ্ধিমান শিষ্য’, ‘জাতকের গল্প’, ‘সুদন ওঝা’, ‘দ্রাবিড়ী গল্প’, ‘লোলির পাহারা’, ‘চীন দেশের গল্প’ ইত্যাদি।
১৯২১ সালে প্রকাশিত ‘মৌচাক’ পত্রিকায় প্রথম সংখ্যায় প্রথম কবিতাটির রচয়িতা সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত। তাঁর মতে, শিশুর মধ্য দিয়ে পৃথিবীতে কল্পলোকের মাধূর্যের অবতারণা হয়। শিশুর ‘প্রথম হাসির ধ্বনি’ কবির কাছে বোধ হয় যেন ‘ফুলঝুরিতে ফুল্কি হাসির রাশি’- যেন ‘রূপোর ঘুঙুর জড়িয়ে হাতে বাজায় কে খঞ্জনী’। দিদির উপর প্রথম অভিমানে অতি দু॥খে সরল, কলহ, অনভিজ্ঞ শিশু গালি দেয়Ñ ‘ডিডি! টুমি টুই’ (সত্যেন্দ্রনাথের শিশু কবিতা, ‘মৌলিক গালি’)। সরল শিশুর পক্ষেই সম্ভব দাঁত থাকা সত্ত্বেও দংশনকারী কুকুরকে পিতা কেন প্রতিফল না দিয়ে ছেড়ে দিলেনÑ এই প্রশ্ন করার (সত্যেন্দ্রনাথের উত্তম-অধম)। ভালবাসার রঙিন চোখে শিশুর সৌন্দর্যে কবি গোপন সঞ্চারী ‘লাল পরী’র অতুল রূপের স্পর্শ দেখতে পেয়েছেন (অভ্র আবীর, লালপরী)। খোকা ধার্মিক হোক, কি ‘জবরদস্ত’ দারোগা হোক, কি মিনমিনে ‘ভালোমানুষ’ হোকÑ এ মায়ের কামনা নয়। মায়ের আশাÑ মানুষ হবি শক্ত পোক্ত সাহসে উল্লাসÑ সত্যেন্দ্রনাথের শিশু কবিতা, (নই ঘরের ঘুমপাড়ানী)। তাঁর ‘উত্তম ও অধম’ এবং ‘নই ঘরের ঘুমপাড়ানী’ কবিতা দুটি অনুবাদ কবিতা।
শিশুর মনোরঞ্জনের জন্য সত্যেন্দ্রনাথ যেসব কবিতা লিখেছেন, তার বেশির ভাগ ছড়াজাতীয়। ভাবের দিক থেকে কতকগুলি প্রকৃতি বিষয়ক- কতকগুলি ‘ইলিশ মাছ’, ‘তাতারসির গান’ ইত্যাদি বালকদের লোভের বস্তু নিয়ে লেখা। রেলগাড়ীর গতির ছন্দে মিলানো ‘রেলগাড়ীর টানে’ যে টুকরো দৃশ্যগুলি ধরে রাখা হয়েছে, তার বিস্ময় মেশানো ভাষা ছেলে মানুষেরই মুখের ভাষা। সে ভাষার দৃষ্টান্ত,
একি! একি! একি দেখি! ঢেঁকি ঢেঁকি ভাই
ঘোড়া-চুলো গাছগুলো ছোটে বাঁই বাঁই
উকি মেরে ঝাৎ ক’রে
দেখি ঘাড় কাৎ করেÑ নাই আর নাই।
(সত্যেন্দ্রনাথের শিশু কবিতা)
সত্যেন্দ্রনাথের কবিতায় ছড়ার ভাব ও সুরের ঝঙ্কার তাঁর শিশুরঞ্জক কবিতাগুলির সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছে। তিনি কতকগুলি শিশুশিক্ষামূলক কবিতাও রচনা করেছেন। ‘শীতের ফুল’, ‘বসন্তের ফুল’, ‘শরতের ফুল’, এ (সত্যেন্দ্রনাথের শিশু কবিতা)। শিশুরা প্রকৃতির পাঠ পেয়েছে। শিশুর প্রাণে স্বদেশ ও স্বজাতি সম্বন্ধে গৌরববোধ জাগিয়ে তুলবার উপকরণ আছে ‘তাতারসির গানে’। খাদ্যদ্রব্যের বর্ণনার মধ্যে দিয়ে শিক্ষাদানের সবচাইতে ভাল দৃষ্টান্ত ‘পেটুকের বর্ণ পরিচয়’। এই কবিতার ভাষা উৎকর্ষের পরিচায়ক।
১৯২৪ সালে প্রকাশিত ‘খোকাখুকু’ একটি উচ্চঙ্গের শিশুপত্রিকা। এর প্রথম বৎসরেই নিজের আঁকা ছবির সংগে ‘গাট্টা মিঞা পাট্টাদার’ লিখে দেখা দেন সুনির্ম্মল বসু, সুকুমার রায়ের সার্থক উত্তর সাধক। তিনি শিশুবিষয়ক কাব্য, গল্প উপন্যাস, নাট্য-রচনা করে শিশুসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেন। তাঁর ‘অপরাধ’ কবিতায় শিশু যে অপরাধ করছে তা অত্যন্ত মানবিকবোধসম্পন্ন,
মাচায় ঝোলানো লোহার খাঁচাটি খুলিয়া দিলাম ধীরে,
উড়ায়ে দিলাম ভোরের আলোয় পোষা সে ময়নাটিরেÑ
অন্যত্র,
দুখীর ছেলের চাদর দিয়েছি, মাগো সেই কথা শোন
আমার চাদর দুইখানি আছে ওর কাছে নাই কোনো।
চাঁদ, জ্যোৎøা আকাশের হাজার তারা নিয়ে অগণিত কবিতা লেখা হয়, শিশুরা পড়ে এবং ভুলেও যায়, কিন্তুÑ
চাঁদটা যেন সত্যিকারের আলোরই মৌচাক
দুষ্টু ছেলের ঢিলটা লাগে হঠাৎ হোলো ফাঁক।
আজকে রে তাই সাঁঝের বেলায়
আলোর মধু সব ঝরে যায়
হাজার তারা মৌমাছিরা উড়লো ঝাঁকে ঝাঁকে
নীল আকাশের নিতল নীলে, উড়ল ঝাঁকে ঝাঁক
(মৌচাক- সুনির্মল বসু)
গতানুগতিক চাঁদ ও জ্যোৎøার বর্ণনা নয়। কবি কল্পনায় স্পর্শ লেগে সব কিছুই নতুন তাৎপর্য ও সৌন্দর্যে ভরে উঠেছে ও শিশুর কল্পনাকে জাগিয়ে দিয়েছে। এর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ‘হাওয়ার দোলা’, ‘হুলুস্থুল’, ‘টুনটুনির গান’।
১০২৪ সালে হেমেন্দ্রকুমার রায় রোমাঞ্চকর উপন্যাস ‘যকের ধন’, ‘মৌচাক’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করেছিলেন। সে সময় রূপকথার ইন্দ্রজাল ছড়িয়েছিলেন তিনি। সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায় তাঁর অনুসরণে লিখেছিলেন ‘লালকুঠি’। হাসির গল্প লিখেছিলেন নলিনীভূষণ দাশগুপ্ত। জুলভার্ণের অনুবাদ অবলম্বনে রমেশ চন্দ্র দাশের ‘সাগরিকা’ শিশুমহলকে আন্দোলিত করেছিল। সত্যচরণ চক্রবর্তীর গল্প, উপন্যাস, নিশিকান্ত সেন ও ফটিক বন্দোপাধ্যায় ‘খোকাখুকু’-তে লিখতে লাগলেন। কার্তিকচন্দ্র দাশগুপ্ত লৌকিকগল্পের আসর জমিয়ে তুলতে লাগলেন। ক্ষেত্রমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত, সুরেন্দ্রনাথ সেন এবং ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় নিয়মিতভাবে ঐতিহাসিক গল্প লিখেছেন। কবি শেখর কালিদাস রায় ও কুমুদরঞ্জন মল্লিক নীতিগর্ভ কবিতা লিখতে লাগলেন। হাসির গল্প ও উপন্যাসে কেদারনাথ চট্টোপাধ্যায়, প্রফুল্লচন্দ্র বসু ও জ্ঞানেন্দ্রনাথ রায় প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিলেন।
কাজী নজরুল ইসলাম বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার জামুরিয়া থানার অন্তর্গত চুরুলিয়া গ্রামে ১৩০৬ সালের ১১ই জ্যৈষ্ঠ (ইংরেজী ১৮৯৯ সালের ২৪শে মে) মঙ্গলবার জন্মগ্রহণ করেন।
নজরুল ইসলামের কবিত্ব শক্তির উন্মেষ হয়েছিল খুব অল্প বয়সেই। পিতার মৃত্যুর পর মাত্র দশ বছর বয়সে পরিবারের আর্থিক দুরাবস্থার দরুণ স্কুলের পড়া ছেড়ে দিতে বাধ্য হন এবং মক্তবের শিক্ষক এক মৌলবী সাহেবের কাছে আরবী-ফারসী মিশ্রিত বাংলা ভাষা শিক্ষা করেন। এরপর আর্থিক সচ্ছলতার উপায় হিসাবে তিনি ‘লেটো নাচ’ আর গানের দলে যোগ দেন এবং মাত্র বারো-তেরো বছর বয়সে উক্ত ভাষায় লেটোর দলের জন্যে গান আর ‘পালা’ লিখতে শুরু করেন।
লেটোর দল সাধারণত: অশিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত গ্রাম্য লোকের দ্বারাই গঠিত হয়। সে কারণে লেটোর গানের ভাষা মার্জিত ও সুরুচিসম্পন্ন হয় না। শিশু কবি নজরুল সেই অল্প বয়সে লেটোর দলের উপযোগী যে সমস্ত গান রচনা করেছিলেন, গ্রাম্য রসগ্রাহিদের কাছে তা-ই হয়েছিল পরম উপভোগ্য।
নজরুল ইসলাম বলে কর ভাই বন্দেগী,
খোয়াইও না আপন গোনাতে জিন্দেগী
শরমেন্দানী হবে হাসরের মাঝে।৬
লেটোর দলের জন্যে রচিত ‘চাষীর সং’ নাটিকায় ‘চাষীর গীত’ :
চাষ কর দেহ জমিতে,
হবে নানা ফসল এতে।
নামাজে জমি ‘উগালে’,
রোজাতে জমি ‘সামালে’
কালেমায় জমিতে মই দিলে
চিন্তা কি হে এ ভবেতে।৭
তাঁর আত্মীয় কাজী নুরুল ইসলামের মতে, নজরুল বাল্যকালে বেশ কয়েকশত মারফতী, পাঁচালী, ব্যঙ্গ, বংগ-মারফতী, ঠিস্ ইত্যাদি গান এবং লেটো-নাচের অভিনয়োপযোগী ছোট ছোট নাটক-নাটিকা রচনা করেছেন। তাঁর বাল্য-জীবনের রচিত সাহিত্য কুলীনসমাজে সমাদৃত না হলেও গীতগুলির অনাড়ম্বর সরল ভাষা কচিমনের অনাবিল ভাব পরিস্ফুট করেছে এবং পরবর্তীকালেও ভাষার এই সারল্য তাঁর রচিত সাহিত্যে প্রত্যক্ষ প্রভাব ফেলেছে ও সাহিত্য স্বাচ্ছন্দ্য লাভ করেছে। মসজিদ, মাজার ও মক্তবের আওতায় থাকার ফলে তাঁর কবিতায়, গানে প্রচুর আরবী-ফারসী শব্দ ব্যবহার করতে পেরেছিলেন।
আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে বার বারই নজরুলের স্থান ও স্কুল বদল হতে থাকে। এই অবস্থায় সিয়ারসোল উচ্চ ইংরেজী বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণীতে পড়াকালীন শিক্ষক বাবু ভোলানাথ স্বর্ণকার বি.এ. মহাশয়ের বিদায় উপলক্ষে ১৯১৬ সালের ১৩ই জুলাই নজরুল ইসলাম ‘করুণ গাঁথা’ অভিনন্দন পত্রটি রচনা করেন। একজন শিক্ষকের বিদায়ে ছাত্রদের হৃদয়বিদারক মানসিক অবস্থার বর্ণনা কবিতাটির উপজীব্য। শিক্ষক পিতার মত তিনি ¯েœহবন্ধনে ছাত্রকে আবদ্ধ করেন। ¯েœহের একটি রীতি এই যে, ¯েœহ কখনও বন্ধন ছিন্ন করতে চায় না। এখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘যেতে নাহি দিব’ কবিতার অনুরনণ শুনতে পাই। রবীন্দ্রনাথের কবিতা,
‘যেতে নাহি দিব’Ñ হায়
তবু যেতে দিতে হয়ে, তবু চলে যায়।৮
নজরুলের,
উঠরে বালক দল মুছিয়া আঁখির জল
করে নে বরণ-ডালা দে গলে পরিয়ে মালা
চরণ ঢাকিয়া দে রে প্রসুন রাশিতে;
পাবিনা আর যে কভু এ ভালবাসিতে।৯
কবিতাটি সাময়িকভাবে জনপ্রিয় হয়েছিল।
‘করুণ-বেহাগ’ কবিতাটিও একই স্কুলে পড়াকালীন সমসাময়িক রচনা। উক্ত স্কুলের শিক্ষক শ্রীযুক্ত হরিশংকর মিশ্র বি.এ. মহাশয়ের বিদায় উপলক্ষে রচিত। বিদায় বেদনা বড়ই করুণ। বার বারই সে বেদনা জেগে উঠে ও অশ্রু সম্বরণ কঠিন হয়ে পড়ে। স্মৃতি বিজড়িত দিনের কথা মনে করে কবি মর্মাহত। যিনি চলে যাচ্ছেন তাঁর হৃদয় আকাশের মত উদার ও রূপে গুণে তিনি ঋষিতুল্য। বস্তুত: যিনি চলে যান তাঁকেই আমাদের পরম কাছের মনে হয়। কবি তাঁকে যেতে দিতে চান না। কিন্তু জাগতিক নিয়মানুযায়ী তাঁকে চলে যেতেই হবে।
তাই কবির উপহার,
বনফুলহার দেবতার গলে সাজিবে না ওগো ভালো,
আনিয়াছি তাই মন-ফুলে ছোট সাজিখানি করি আলো।
কি দিব গো আর, কি দেবার আছে, আমরা বড়ই দীন,
বিনা এ হৃদির করুণ গভীর আসার-বিন্দু তিন।১০
কবিতাটির শব্দচয়ন ও ব্যঞ্জনা অত্যন্ত শ্রুতিমধুর। এই কবিতাটিও সাময়িকভাবে জনপ্রিয় হয়েছিল।
নজরুলের উল্লেখযোগ্য কবিতা ‘মুক্তি’ প্রকাশিত হয় ত্রৈমাসিক ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা’য় ১৩২৬ সালের শ্রাবণ মাসে। এটি তাঁর প্রথম প্রকাশিত কবিতা- সত্য ঘটনা অবলম্বনে রচিত এক দরবেশের কাহিনী।
কবিতায় ভক্ত-দরবেশ ও সাধু-দরবেশের মধ্যে ষ্পষ্ট পার্থক্য বোঝা যায়। প্রকৃত দরবেশ তিনি, যিনি মানুষকে মুক্তির পথ দেখাতে পারেন।
মানুষের জীবনে জন্ম থেকে শুরু করে শৈশব-কৈশোর-যৌবন-বার্ধক্য পর্যায়গুলি অতিক্রম করে আসে মৃত্যু নামক দেহের ‘মুক্তি’। সাধারণ মানুষ জীবনের পরিণতি মৃত্যু বলে ধরে নিলেও সাধু-সন্ন্যাসী বা ধ্যানী-পুরুষ মৃত্যুকেই জীবনের ‘মুক্তি’ বলে মনে করেন। গাড়োয়ানের গাড়ীর আঘাতে দরবেশের মৃত্যু তাঁর কাছে মুক্তি সমতুল্য। এক্ষেত্রে গাড়োয়ানই তাঁর মুক্তিদাতা। মুক্তিদাতার শাস্তিকে তাঁর কাছে অন্যায় মনে হয়,
ওগো, আমার মুক্তি দাতায় কে রেখেছ বেঁধে?
এ কোন জনার ফন্দি,
বাঁধন যে মোর খুলে দিলে তায় করেছে বন্দী?১১
মুক্তি মূলত: আত্মার মুক্তি। মানবাত্মার মুক্তির কথা বলেছেন কবি। কবিতায় ভাব ও ভাষার সুরুচিসম্পন্ন ভাব পরিলক্ষিত হয়। ছন্দের ক্ষেত্রে প্রখর জ্ঞান ও বুদ্ধিমত্তার পরিচয় ক্রমশ:ই পরিস্ফুট হতে থাকে।
রাণীগঞ্জ সিয়ারসোল হাই স্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্র থাকাকালীন ১৩২৯ আশ্বিনে মাসিক ‘পল্লিশ্রী’ পত্রিকায় ‘ভগ্নস্তূপ’ কবিতা প্রকাশিত হয়। নিখুঁত মাত্রাবৃত্ত ছন্দে লেখা নজরুলের ‘প্রথম কবিতা’ এটি। কবিতাটি স্মৃতিচারণমূলক। মাটির যে প্রকান্ড স্তূপটি গ্রামের দক্ষিণে যুগ যুগ ধরে দাঁড়িয়ে আছে, তার বুক একসময় জাঁকসমকে পরিপূর্ণ ছিল। মানব হৃদয়ের সুখ-দু:খ, ব্যথা-বেদনার অনুভূতি,
(ঐ) গাঁয়ের দাখিনে দাঁড়ায়ে কে তুমি যুগ যুগ একা গো?
তোমার বুকে ও কিসের মলিন রেখা গো?
এ কোন্ দেশের ভগ্নাবশেষ?
কোন্ দিদিমার কাহিনীর দেশ?
যায় অতীতের আবছায়া টুকু পাষাণেরি গায় দেখা গো
তোমারি উরসে কোন চিতোরের চিতার ভষ্ম রেখা গো?১২
বালক নজরুল অতীতের এই সব মানব-মানবীর সুখ-দুঃখের সমব্যথী হয়েছেন এবং অত্যন্ত সহজ ও স্বচ্ছন্দ্য ভাষায় অন্ত্যমিল প্রয়োগে কবিতাটি রচনা করেছেন।
ঐ স্কুলের দশম শ্রেণীতে পড়াকালীন ‘চড়–ই পাখির ছানা’ কবিতাটি রচনা করেন। কাবিতাটির বক্তব্য ও বিষয় হৃদয়গ্রাহী। একটি চড়–ই ছানা নিয়ে স্কুলের দুষ্টু ছেলেদের কাড়াকাড়ির উপর ভিত্তি করে কবিতাটি রচিত হয়। চড়–ইছানাটি তার মায়ের বুক হতে পড়ে যাওয়াতে মায়ের যে বেদনা তা’ পাঁচু ছাড়া অন্য কোন ছেলেরই বোধগম্য হয়নি। পাঁচু মাতৃহারা বলে পাখিটির বেদনা তার হৃদয় স্পর্শ করেছে। কেননা,
মা মরেছে বহুদিন তার, ভুলে গেছে মায়ের সোহাগ
তবু গো তার মরম ছিঁড়ে উঠলো বেজে করুণ-বেহাগ
মই এনে সে ছানাটিরে দিল তাহার বাসায় তুলে,
ছানার দু’টি সজল আঁখি করলে আশিস পরাণ খুলে।
অবাক-নয়ান মা’টি তাহার রইলো চেয়ে পাঁচুর পাণে,
হৃদয়-ভরা কৃতজ্ঞতা দিল দেখা আঁখির কোণে।
পাখির মায়েরে নীরব আশিস যে ধারাটি দিল ঢেলে,
দিতে কি তার পারে কণা বিশ্বমাতার বিশ্ব মিলে।১৩
এ সময় হ’তে নজরুলের ভাষা পূর্বাপেক্ষা মার্জিত এবং ভাব প্রকাশেও উন্নতি পরিলক্ষিত হয়। তাঁর ছন্দ-জ্ঞানও বৃদ্ধি পায়।
উল্লেখিত সব রচনাই নজরুল শিশুদের উদ্দেশ্যে রচনা করেননি। কিন্তু শিশুতোষ-নজরুল সাহিত্যের সূচনা এখান হ’তেই।
বিশ শতকের চতুর্থ দশকে বাংলা ১৩৪৪ সালের মাঘ মাসে ছোটদের জন্য মোহাম্মদ নাসিরুদ্দিন অতি সহজ সরল ভাষায় বহু চিত্রশোভিত ‘শিশু সওগাত’ নামে একটি মাসিক পত্রিকা বের করেন। সে সময় বাংলাদেশে মুসলমানদের দ্বারা পরিচালিত ছোটদের জন্য কোনো পত্রিকা ছিল না। শিশুসাহিত্যের অভাব মোচনের জন্য ‘শিশু সওগাত’ই বাঙালী মুসলমান পরিচালিত ছেলেমেয়েদের একমাত্র মাসিক পত্রিকা। এর জন্য যে বিজ্ঞপ্তি প্রচারিত হয়েছিল তার সারমর্ম হচ্ছে,
শিশু সওগাত বাঙালী মুসলমানের পরিচালিত ছেলে-মেয়েদের একমাত্র মাসিক পত্র। শিশু মনের উপযোগী সহজ ও সরল ভাষায় লিখিত বিবিধ রচনা, আদর্শ জীবন-চরিত, জ্ঞান-বিজ্ঞানের কথা, ছোটদের গল্প উপন্যাস ও রসালো কবিতা, জীব-জানোয়ারের কাহিনী, দেশ-বিদেশের ছেলেমেয়েদের সচিত্র পরিচয়, সাধারণ জ্ঞানের কথা, ছড়া ও ধাঁ ধাঁ তার উপর পাতায় পাতায় ছবি, যেন চিত্রশালা। তিন বর্ণে রঞ্জিত মলাটের সৌন্দর্যে চোখ জুড়ায়। ছেলেমেয়েদের হাতে ‘শিশু সওগাত’ দিয়ে শিক্ষার সংগে সংগে তাদের হৃদয়মন আনন্দরসে ভরপুর করিয়া দিন।১৪
‘শিশু সওগাত’ পত্রিকাটি সর্বত্র সমাদৃত হয়েছিল। এর গ্রাহক সংখ্যা কল্পনাতীত ভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং ভাল পত্রিকা বলে বিবেচিত হওয়ায় সরকার দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলিকে এই পত্রিকার গ্রাহক করে দিয়েছিলেন এবং সরকারই ঐগুলির বার্ষিক মূল্য পরিশোধ করতেন।
মোহাম্মদ নাসির উদ্দীন ঐ কাগজের প্রথম সংখ্যার জন্য যুক্তাক্ষরবর্জিত শব্দ দ্বারা সহজ ভাষায় একটি কবিতা লিখে দিবার জন্য নজরুলকে অনুরোধ জানান। কবিতাটি শুরু এভাবে,
ওরে শিশু, ঘরে তোর এল সওগাত
আলো পানে তুলে ধর ননী মাখা হাত!
এটি ‘শিশু সওগাতে’র জন্য এত উপযোগী হয়েছিল যে, চারদিক থেকে এর প্রশংসা আসতে লাগল।
নজরুল শিশুকে ছেলেভুলানো ছড়া শোনাননি বা শুধু পুঁথিগত বিদ্যায় পারদর্শী করতে চাননি বা শুষ্ক নীতিবাক্য শোনাননি বরং শিশুসাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় তাঁর পদচারণা শিশুকে এক ভিন্নতর জগতে নিয়ে যায়।
তাঁর রচিত শিশুসাহিত্যকে আমরা বিষয়বৈচিত্র্যের দিক থেকে কয়েকটি শ্রেণীতে ভাগ করতে পারি।
সাধারণতঃ শিশু বলতে সাত বা আট বছরের শিশু বোঝায়, কিন্তু সাত আট বছরের শিশুর পক্ষে কবিতার মর্মার্থ হৃদয়ঙ্গম দুরূহ ব্যাপার, কাজেই বয়সের সময়সীমা আমরা বাড়াতে চাই। এ প্রসঙ্গে ড. শিবনাথশাস্ত্রীর মতামত গ্রহণযোগ্য। তিনি বলেছেন, ষোল বছরের নীচে সবাই শিশু। এই দৃষ্টিভঙ্গীতে নজরুল রচিত সাহিত্যের মধ্যে নি¤েœাক্ত সৃষ্টিসমূহ ‘শিশুসাহিত্য’ বিবেচনা করা যায়।
১. সাধারণ জিনিসকে অসাধারণত্ব দান- ‘ঝিঙ্গে ফুল’ কবিতা।
২. কৌতুক ও হাস্যরসের অবতারণা- ‘খুকী ও কাঠ্বেড়ালী’
৩. ‘খোকার খুশী’, ‘খাঁদু দাদু’, ‘দিদির বে’তে খোকা’,
‘খোকার বুদ্ধি’, ‘খোকার গপ্প বলা’, ‘চিঠি’, ‘লিচু চোর’, ‘হোঁদল কুঁৎকুতের বিজ্ঞাপন’, ‘ঠ্যাং ফুলী’, ‘পিলে-পটকা’, ‘মট্কু মাইতি বাঁটকুল রায়’, ‘নতুন খাবার’, ‘বগ দেখেছ’, ‘ফ্যাসাদ’ ইত্যাদি।
৪. শিক্ষামূলক উপদেশ- ‘লিচু চোর’, ‘সাত ভাই চম্পা’ ইত্যাদি।
৫. দেশপ্রেম- ‘হোঁদল কুঁৎকুতের বিজ্ঞাপন’ ইত্যাদি।
৬. আদর্শবাদী তথা শিক্ষামূলক বর্ণনা- ‘সাত ভাই চম্পা’ ইত্যাদি।
৭. নীতিশিক্ষা- ‘মা’ ইত্যাদি।
৮. জাগরণমূলক- ‘প্রভাতী’, ‘সাত ভাই চম্পা’ ইত্যাদি।
৯. প্রেরণা সমৃদ্ধ রচনা- ‘সংকল্প’, ‘ছোট হিটলার’ ইত্যাদি।
১০. সৌন্দয্য সৃষ্টিমূলক- ‘সারস পাখি’, ‘ঝিঙে ফুল’, ‘আগুনের ফুল্কী ছোটে’ ইত্যাদি।
১১. বাৎসল্য রসের কবিতা- ‘শিশু যাদুকর’, ‘আবাহন’, ‘কোথায় ছিলাম আমি’ ইত্যাদি।
১২. শিশুপ্রীতি তথা মানবসেবার কাহিনী ব্যক্ত করেছেন- ‘ঈদের দিনে’ গল্পে।
১৩. কল্যাণধর্মী রচনা- নজরুলের ‘পুতুলের বিয়ে’ নাটিকা।
১৪. অভিযানমূলক- নজরুলের ‘জাগো সুন্দর চিরকিশোর’ একাংকিকা।
১৫. শিশুদের নিছক আনন্দ দানের উদ্দেশ্যে তিনি কিছু গানও লিখেছেন। ‘প্রজাপতি’, ‘শুক্নো পাতার নূপুর পায়ে’, ‘ওরে হুলোর তুই রাত বিরেতে’ ইত্যাদি।
১৬. শিক্ষামূলক- নজরুল সম্পাদিত ও সংকলিত ‘মক্তব সাহিত্য’ গ্রন্থের রচনাবলী।
নজরুল ইসলামের প্রতিটি রচনারই এক একটি বৈচিত্র্যময় কাহিনী রয়েছে। শিশুদের মনন বিকাশের উপযোগী এই কাহিনীগুলি। শিশুমনের চিন্তাধারার উৎকর্ষ সাধনে এই সমস্ত কাহিনী তথা চরিত্রের বিন্যাস যথাযথ।
নজরুল শিশুসাহিত্যের সমাজচিত্র আলাদা বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। তিনি যুগের দাবীকে মেনে নিয়েছেন এবং অত্যন্ত বাস্তবসম্মতভাবে শিশুমানস বিকাশের উপযোগী করে তাঁর সাহিত্যে প্রতিভাত করেছেন।
নজরুল শিশুসাহিত্যের চরিত্রগুলো দ্বন্দ্ব সংঘাতময় এবং বাস্তবতার সাথে সম্পৃক্ত। শিশুমনের আশা-আকাক্সক্ষা, অজানাকে জানবার ও জয় করবার ইচ্ছা তাঁর সাহিত্যে মূর্ত হয়ে উঠেছে।
তাঁর সাহিত্যের বিশেষত্ব কাব্য সাহিত্যের আঙ্গিক ও ছন্দসৌকর্য বাস্তবসম্মত ও সুষমামন্ডিত। সাহিত্যিক মানদন্ডের বিচারে তা’ শিশুর মনন বিকাশের উপযোগী।
পাদটীকা
১. ‘শকুন্তলা’ অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রথম মুদ্রণ, পৃষ্ঠা ২-৩
২. ১৩০১ সালে রবীন্দ্রনাথের ‘ছেলে ভুলানোর ছড়া’ প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়।
অবনীন্দ্রনাথ সেটির দ্বারা বিশেষ প্রভাবিত হয়েছিলেন।
৩. ‘অমৃত’ ১৯১০ সালে প্রকাশিত পত্রিকা। সম্পাদক- রজনীকান্ত সেন।
৪. ‘শিশু’ ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত পত্রিকা। সম্পাদক- বরদাকান্ত মজুমদার।
৫. ‘শিশু’ পত্রিকায় প্রকাশিত। রচয়িতা- দিক্ষণারঞ্জন মিত্র।
৬. আব্দুল কাদির সম্পাদিত ‘নজরুল রচনাবলী’র তৃতীয় খন্ডে প্রকাশিত ‘গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত কবিতা ও গান’-এ ‘বন্দনা গান’-এর অর্ন্তভুক্ত।
৭. ঐ
৮. রবীন্দ্র রচনাবলী। তৃতীয় খ-। ‘সোনার তরী’ কাব্যগ্রন্থ। ১৩৮০ সালে প্রকাশিত। পৃষ্ঠা ৪৯-৫৫।
৯. আব্দুল কাদির সম্পাদিত ‘নজরুল রচনাবলী’র তৃতীয় খন্ডে প্রকাশিত ‘গ্রন্থকারে অপ্রকাশিত কবিতা ও গান’-এর অন্তর্ভুক্ত। খান মুহম্মদ মঈনুদ্দীনের ‘যুগ-স্রষ্টা নজরুল’ গ্রন্থে সংকলিত।
১০. আব্দুল কাদির সম্পাদিত ‘নজরুল রচনাবলী’র তৃতীয় খন্ডে প্রকাশিত ‘গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত কবিতা ও গান’-এর অন্তর্ভুক্ত। ঈদ সংখ্যা সাপ্তাহিক ‘ওয়াতান’ এ প্রকাশিত।
১১. ‘ত্রৈমাসিক বংগীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা’য় প্রকাশিত। ১৩২৬ সালের শ্রাবণ সংখ্যা।
১২. আব্দুল কাদির সম্পাদিত ‘নজরুল রচনাবলী’র তৃতীয় খন্ডে প্রকাশিত ‘গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত কবিতা ও গান’-এর অন্তর্ভুক্ত। ১৩২৯ আশ্বিনে ময়মনসিংহের মাসিক ‘পল্লীশ্রী’ পত্রিকায় প্রকাশিত।
১৩. আব্দুল কাদির সম্পাদিত ‘নজরুল রচনাবলী’র তৃতীয় খন্ডে প্রকাশিত ‘গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত কবিতা ও গান’-এর অন্তর্ভুক্ত। শৈলজানন্দ বলেন কবিতাটি ১৯১৮ সালে রচিত।
১৪. ‘শিশু সওগাত’ মাঘ, ১৩৪৪ সালে প্রকাশিত ১ম বর্ষ, ১ম সংখ্যায় প্রকাশিত ‘শিশু পত্রিকা’। সম্পাদক- মোহাম্মদ নাসির উদ্দীন।
১৫. ‘মক্তব সাহিত্য’ সংকলন, কাজী নজরুল ইসলাম।
প্রথম পরিচ্ছেদ
নজরুলের শিশুতোষ কবিতা
নজরুলের শ্রেষ্ঠ শিশুতোষ কাব্যগ্রন্থ ‘ঝিঙেফুল’। প্রকাশিত হয় বাংলা ১৩৩৩ সালের আশ্বিন মাসে। এতে ভূমিকা স্বরূপ নাম- কবিতাটি ছাড়া আরো তেরোটি কবিতা রয়েছে। কবিতাগুলো যথাক্রমে- ‘ঝিঙেফুল’, ‘খুকি ও কাঠ্বেড়ালি’, ‘খোকার খুশি’, ‘খাঁদু-দাদু’, ‘দিদির বে’তে খোকা’, ‘মা’, ‘খোকার বুদ্ধি’, ‘খোকার গপ্প বলা’, ‘চিঠি’, ‘প্রভাতি’, ‘লিচু চোর’, ‘ঠ্যাং-ফুলী’, ‘পিলে পট্কা’, ‘হোঁদল-কুঁৎকুতের বিজ্ঞাপন’।
কাব্যগুলে ‘ঝিঙে ফুল’ শিশুরঞ্জক নজরুলের অন্যতম উৎকৃষ্ট রচনা। কবিতাটির প্রথম কয়েকটি পঙ্তি,
ঝিঙে ফুল! ঝিঙে ফুল!
সবুজ পাতার দেশে ফিরোজিয়া ফিঙে-কুলÑ
ঝিঙে ফুল।
গুল্মে পর্ণে
লতিকার কর্ণে
ঢল ঢল স্বর্ণে
ঝলমল দোলো দুলÑ
ঝিঙে ফুল॥
‘গৃহস্থের আঙিনায় অতি সাধারণ এক সবজি লতার ফুল এ কবিতায় বর্ণে গন্ধে অভিজাত বাগান ফুলের মর্যাদা লাভ করেছে।’১ ফুলটির ঢলঢলে সোনা বর্ণের সৌন্দর্য কবির হৃদয়কে খুব সহজেই আকৃষ্ট করেছে। এর সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয়ে ফিঙে পাখিরা এর চারিদিকে কলরব করতে ভালবাসে।
সন্ধ্যেবেলায় এই ফুল ফোটার সঙ্গে সঙ্গে কবির হৃদয় গানের সুরে ভরে ওঠে। পৌষ মাসের শেষ বেলাতে যখন এই ফুল জাফরানী রং পরে উপস্থিত হয় তখন নীরব আসরও সরব ও জমজমাট হয়ে ওঠে।
এই ফুলকে ভালবাসার আরেকটি কারণ হচ্ছে যে, সে মিথ্যা প্রলোভনে ভোলে না। প্রচন্ড রোদের দাবদাহে আলুথালু বেশে সে শ্যামল মায়ের কোলেই ঘুমাতে ভালবাসে। প্রজাপতি তাকে তার সাথে উড়তে ডাক দেয়। আসমানের তারাও তাকে স্বর্গলোকে নিতে চায়। কিন্তু সে স্বর্গের সুখ চায় না। সে মাটির স্পর্শ চায়। সে বলে,
আমি হায়
ভালবাসি মাটি-মায়
চাই না ও অলকায়-
ভাল এই পথ ভুল।
সে তার ফসল দিয়ে মর্ত্যরে মানুষের সেবা করবে। এদের দু:খ-কষ্টের সে অংশীদার হবে। সে এই পৃথিবীর মাটিকে ভালবাসে- তাই সে এর সাথেই সম্পৃক্ত থাকতে চায়। কবিতাটির অপূর্ব সুন্দর ছন্দ শিশুমনকে আকৃষ্ট করে। এটি মাত্রাবৃত্ত ছন্দে রচিত।
জীবন শুধু কল্পনার বিলাসই নয় বাস্তবের দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও ঘাত-প্রতিঘাতময় ‘খুকী ও কাঠ্বেড়ালি’ কবিতাতে তিনি শিশুদের কাছে সে কথাটিই প্রমাণ করতে চেয়েছেন।
খুকী গাছে উঠতে অসমর্থ, কিন্তু সে একটি পেয়ারা চায়। ডাল হতে ডালে কাঠ্বেড়ালির অবাধ ও ত্বরিৎ বিচরণ খুকিকে আশান্বিত করেছে। সে পেয়ারার জন্য কাঠ্বেড়ালিকে প্রথমে প্রলোভন দেখায়,
গুড় মুড়ি খাও? দুধ ভাত খাও? বাতাবি নেবু? লাউ
বেড়াল বাচ্চা? কুকুর ছানা? তাও?
তার ডাকে সাড়া না দেয়াতে সে তাকে ‘হোঁৎকা পেটুক’ বলে অভিহিত করে। একটিও পেয়ারা পেতে অসমর্থ হয়ে খুকি গালি দেয়,
কাঠ্বেড়ালি! বাঁদরমুখি! মারবো ছুঁড়ে কিল?
দেখবি তবে? রাঙাদাকে ডাকবো? দেবে ঢিল!
কিন্তু কাঠ্বেড়ালিকে তার স্বভাব অনুযায়ী পেয়ারা খেতে দেখে খুকি তাকে অভিশাপ দেয়,
পেটে তোমার পিলে হবে! কুড়ি-কুষ্টি মুখে!
হেই ভগবান! একটা পোকা যাস পেটে ওর ঢুকে!
এতসব প্রলোভন, তিরস্কার ও অভিশাপের পরেও যকন খুকি কাঠ্বেড়ালির কার হতে পেয়ারা আদায়ে ব্যর্থ হয় তখন সে নমণীয় মনোভাব গ্রহণ করে এবং কাঠ্বেড়ালিকে সম্মানজনক পদ দিতে আহ্বান জানায়,
কাঠ্বেড়ালি! তুমি আমার ছোড়দি হবে? বৌদি হবে হুঁ!
তেমনি তাকে জামা দেবার লোভও দেখায়। কিন্তু তবু খুকি একটি পেয়ারাও কাঠ্বেড়ালির কাছ হতে আদায়ে সমর্থ হয় না। একটি ইতর প্রাণীর পক্ষে মানব সন্তানের আশা-আকাক্সক্ষার প্রাপ্তি দুরূহ কল্পনা বিশেষ।
পর্যায়ক্রমে এই অবস্থাগুলির মধ্যে দিয়ে শিশুচরিত্র বিকাশের একটি ধারাবাহিকতা লক্ষ করা যায়। শিশু হলেও তার মধ্যে একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষের চরিত্র লুকিয়ে থাকে। একজন বয়স্ক ধীর, স্থির, বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষও তার কাক্সিক্ষত বস্তু পেতে হলে উল্লিখিত পর্যায়গুলি অতিক্রম করে। উপরন্তু, শিশুরা সরল। যে অভিব্যক্তিগুলি একজন বয়স্ক মানুষ সঙ্কোচের কারণে প্রকাশ করতে পারে না শিশুরা তা অকপটে প্রকাশ করে। এদিক থেকে দেখতে গেলে শিশুচরিত্র বিকাশের একটি উল্লেখযোগ্য কবিতা ‘খুকি ও কাঠ্বেড়ালি’। এ কবিতাটি যে শিশুদের খুব প্রিয় তার প্রমাণ ছোটদের যে কোন অনুষ্ঠানে এই কবিতার পুন: পুন: আবৃত্তি দীর্ঘকাল যাবৎ।
‘খোকার খুশি’ কবিতাতে খোকার মতে ‘বিবাহ’ অর্থই খুব খাওয়া দাওয়া ধুম,
বিবাহ! বাস, কি মজা!
সারাদিন মন্ডা গজা
গপাগপ্ খাও না সোজা
দেওয়ালে ঠেসান দিয়ে।
খোকা বর হতে চায় না এই কারণে যে সারাদিন উপোস থাকতে হবে। বিয়ে হবে এই অর্থে যে, সারাদিন সানাই বাজবে, মন্ডা-গজা ইত্যাদি খাওয়ার সাথে সাথে নতুন জামা, পাগড়ি ইত্যাদি প্রাপ্তি ঘটবে।
শিশুরা সব সময়ই কৌতূহল প্রিয়। এই কবিতাটিতে শিশু মনের অজানা কৌতূহল ফুটে উঠেছে। বিয়ের যে কষ্টকর দিকটি উপোস থাকা বা শুধু হরিমটর খাওয়া শিশু সেসব ঝামেলা পোয়াতে চায়না, সে কষ্টকর দিকটি গ্রহণ করতে চায়না। সে শুধুই আনন্দের, ¯েœহ-প্রেম-প্রীতির ভাগটি নিতে চায়। ‘মামী ঘরে এলে সে আদর পাবে, তখন তার সব বিরক্তি, সব ভয় কেটে যাবে। সে সানন্দে ঘোষণা করে, ‘আমি রোজ করব বিয়ে।’২
কবি কবিতাটির বিষয়বস্তু নির্বাচন ও শব্দচয়নে শিশুদের নিকট সাহিত্যের রস পরিবেশন করেছেন ও শিশু মনে আনন্দের খোরাক জুগিয়েছেন।
‘খাঁদু-দাদু’ কবিতাটির নামকরণের মধ্যে দিয়েই কবিতাটির পরিচয় মূর্ত হয়ে উঠেছে। বাস্তবজীবনে বেশির ভাগ সময়ই দাদুর সংগে নাতির ঠাট্টার সম্পর্ক দেখা যায়। এখানে দাদুর বোঁচা নাক নিয়ে নাতির রসিকতাই কবিতাটির উপজীব্য।
দাদুর নাকটি কিভাবে বোঁচা হল তার রহস্য উদ্ঘাটন করতে গিয়ে নাতি বলছে কেউ হয়তো তার দাদুর নাকে ল্যাং মেরে বোঁচা করে দিয়েছে।
অমা! তোমার বাবার নাকে কে মেরেছে ল্যাং?
খোকা তার দাদুর নাকের উপমা দিয়েছে এভাবে,
চামচিকে ছা বসে যেন ল্যাজুড় ঝুলিয়ে!
অথবা,
বুড়ো গরুর টিকে যেন শুয়ে কোলা ব্যাঙ!
অথবা,
কাছিম যেন উপুর হয়ে ছড়িয়ে আছেন ঠ্যাং!
এমন আরো কিছু কল্পনা প্রসঙ্গত: লক্ষণীয়, কবিতাটির প্রতিস্তবকে ধুয়া হিসেবে ব্যবহৃত চরণটিতে ‘(অমা! আমি হেসে মরি, নাক ডেঙা ডেং ডেং) লৌকিক রচনার কিছুটা অনুরণন রয়েছে’।৩
দাদুর নাকটি চীন ও জাপান দেশের লোকের মতই চ্যাপ্টা। দাদুর নাকের তুলনা করতে যেয়ে কবি নিজ দেশ, ধর্ম, বর্ণের গন্ডী অতিক্রম করে চীন, জাপান দেশের সাথে নিজেদের একাত্মতা ঘোষণা করেছেন। এতে দেশ-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে শিশু মনে প্রসারতা ও উদারতা আনবার চেষ্টা করেছেন।
দাদুর নাটি ধ্যাবড়া করার পিছনে দিদিমার কোন কারসাজি আছে বলেও নাতির বিশ্বাস। অবশেষে লম্বা নাকের জন্য দাদুকে লম্বা নাকের দেবতা ‘গরুড় দেব’-এর ধ্যানের পরামর্শ দানেই কবিতাটির পরিসমাপ্তি।
শিশু মনে শুধু কল্পনার বিলাসই নয়, বাস্তবের দ্বন্দ্ব সংঘাতগুলোও কবি তুলে ধরেছেন। অনাবিল পরিহাস রসোচ্ছলতা কবিতাটিকে শিশুদের কাছে আবৃত্তিযোগ্য করে তুলেছে এবং অদ্যাবধি ছোটদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে প্রায়শ: কবিতাটির আবৃত্তি শোনা যায়।
‘দিদির বে’তে খোকা’-তে সাতটি ভাইয়ের একটি বোন চম্পা। তার কোন কষ্ট দেখতে ও মানতে খোকা রাজী নয়। সাত সাগর পাড়ি দিয়ে কাহিনীর দেশের রাজপুত্র এসেছে তার দিদিকে নিয়ে যেতে,
কাহিনীর দেশেতে ঘর
তোর সেই রাজপুততুর?
‘কাহিনী’ অর্থ যে দেশে দু:খ নেই, শোক নেই, জরা নেই, মৃত্যু নেইÑ কেবল চতুর্দিকে আনন্দ কোলাহলÑ কেবলই জীবনÑ শুধুই প্রাচুর্য।
বিয়ে অর্থই খোকার কাছে মন্ডা মিঠাই খাওয়ার ধুম। ‘কিন্তু এতেও তার শান্তি নেই, কেননা তার দিদি তাকে ছেড়ে একাকীই চলে যাচ্ছে,
ভাল ছাই লাগছে না ভাই
যাবি তুই একেলাটি।
খোকা তার দিদির কাছে সোনার কাঠি চায়, তার দিদি যদি সেখানে গিয়ে সারাদিন কেবলই ঘুমিয়ে থাকে তবে তাকে সেই কাঠির স্পর্শে ঘুম ভাঙ্গাবার জন্য।
নজরুলের শিশু কখনই নির্জীব ও নির্লিপ্ত নয়। দু:খ-শোক-জরা মৃত্যুকে জয় করবার জন্য সে সদাই তৎপর। রূপকথার রাজ্যের অফুরন্ত ও অশেষ শান্তি ও ঘুম খোকার কাম্য হতে পারে না। সে কারণে সে সোনার কাঠি চায় তার দিদির ঘুম ভাঙ্গাবার জন্য,
জাগাব পরশ দিয়ে
রেখে যাস্ সোনার কাঠি।
‘মা’ কবিতাতে কবি মায়ের সদৃশ্য ব্যক্তি পৃথিবীতে খুঁজে পাননি। পৃথিবীর যাবতীয় সুধা এই একটি কথার মাঝে। মা এর মত এত আদর সোহাগ আর কারো কাছেই পাওয়া যায় না,
মায়ের মতন এত
আদর সোহাগ সে তো
আর কোনখানে কেহ পাইবে না ভাই,
মায়ের মুখ দেখলে পৃথিবীর সব দু:খ দূরে সরে যায়। মায়ের কোলে ঘুমালে প্রাণ জুড়িয়ে যায়Ñ সকল যন্ত্রণার অবসান হয়। মা সমস্ত আবদার দিনরাত হাসিমুখে সহ্য করেন। দিনরাত এক করে নিজে না খেয়ে নিজ সন্তানকে বড় করে তোলেন।
এতটুকু থেকে মা কোলে করে বড় করে তোলেন; অসুখ হলে শিয়রে বাতি জ্বালিয়ে সারারাত মা-ই সেবা করেন।
ছোট শিশুর ব্যথা মা বুঝতে পারেন। দুঃখের মাঝে বুকে ধরে রেখে মা তাকে বড় করে তোলেন। পাঠশালা হতে ঘরে ফিরে গেলে মা-ই আদর করে কোলে তুলে খাবার কথা শুধান। পড়া লেখায় ভাল হলে গর্বে মার বুক ভরে ওঠে,
পড়া লেখা ভাল হ’লে
দেখেছ সে কত ছলে
ঘরে ঘরে মা আমার কত নাম ক’রে।
সন্তানের অসুখ হলে মা পীর ফকিরের কাছে মানত করে তার মঙ্গল কামনায়। ঘুম না পেলে ঘুম পাড়ানী গান গেয়ে ঘুম পাড়ান। দিবানিশি মায়ের ভাবনা তার সন্তান কিসে মানুষ হবে, কিসে বড় হবে। মায়ের আশীর্বাদে সব দু:খ ‘সুখ’ হয়ে যায়।
সুতরাং মায়ের চেয়ে বড় কেই নেই। সবাইকে কবি নত শিরে মায়ের পদধূলি নেবার আহ্বান জানিয়েছেন। বাঙালী মায়ের চিরন্তন রূপ এবং সন্তানের জন্যে সে মায়ের বিশেষ আকুতির পরিচয় গভীর দরদের সঙ্গে আলোচ্য কবিতায় আবেগ সঞ্চার করেছে।
‘খোকার বুদ্ধি’ কবিতায় কবি খোকার বীরত্বের পরিচয় দিয়েছেন এভাবে,
সাত লাঠিতে ফড়িং মারেন এমনি পালোয়ান
দাঁত দিয়ে সে ছিঁড়লে সেদিন আস্ত আলোয়ন!
ন্যাংটা-পুঁটো দিগম্বরের দলে তিনিই রাজা
তাঁরে কিনা বোকা বলা? কি এর উচিৎ সাজা?
খোকাকে বোকা বলা হোক এটা তার মোটেই পছন্দ নয়। যে শিশুরা তখনও আবরণের মর্ম বোঝে না তাদের দলে তিনি রাজা আর তাকে কি-না বোকা বলা? খোকা আপন বিচারে বীর এবং বুদ্ধিমান।
আমি নাকি বোক্-চন্দর? ও গো মা, বুদ্ধি দেখে যা!
ঐ না একটা মট্কু বানর দিব্যি মাচায় বসে
লাউ খাচ্ছে? কেউ দেখেনি, দেখি আমিই এসে!
দিদিদেরও চোখ ছিল ত, কেউ কি দেখেছেন?
তবে আমার আমায় বোকা কও যে!
কবির অন্তরের কোণে লুকিয়ে ছিল একটি শিশুমন। তাই শিশুদের আশা-আকাক্সক্ষা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। ছোট শিশু কিভাবে বুদ্ধির প্রকাশ করতে হয় জানে না; কিন্তু সে হার মানতেও রাজী নয়। নিজেকে মার কাছে বুদ্ধিমান প্রমাণ করতে যেয়ে সে যে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছে তাতে তার অকপট সরলতাই প্রকাশ পেয়েছে এবং অন্যদিকে প্রচুর আনন্দের খোরাক জুগিয়েছে।
‘খোকার গপ্প বলা’ কবিতাতে খোকা খুব সহজ সরল মনে তার মার কাছে আষাঢ়ে গল্পের অবতারণা করেছে। ‘আষাঢ়ে গল্প’ শুনতে শুধু শিশুরাই নয়, বয়স্করাও ভালবাসে। গল্পের যে একটি বস্তুনিষ্ঠ ভিত্তি থাকতেই হবে; একটি কার্যকারণ সম্পর্ক থাকতেই হবে এমন কথা শিশুরা মানতে চায় না। শিশুর কল্পনাতে রাজার ফড়িং শিকার করতে যাওয়া এবং রাণীর কল্মী শাক তুলতে যাওয়া কোন মানহানিজনক কাজ নয়,
একদিন না রাজাÑ
ফড়িং শিকার করতে গেলেন খেয়ে পাঁপড় ভাজা!
রাণী গেলেন তুলতে কলমী শাক
বাজিয়ে বগল টাক্ ডুমাডুম টাক্!
আবার বেড়াল বাচ্চাকে হাতি বলে ধরে নেয়া আর রাণীর রামছাগলের পিঠে চড়া শিশুর পক্ষে কোন অকল্পনীয় ব্যাপার নয়।
রাজা শেষে ফিরে এলেন ঘরে
হাতির মতন একটা বেড়াল বাচ্চা শিকার করে’।
এমন সময় দেখেন রাজা আসছে রাণী দৌড়ে
সারকুঁড়ে হ’তে ক্যাঁকড়া ধ’রে রাম-ছাগলে চড়ে!
সমানভাবে রাজার পান্তাভাত খাওয়ার মধ্যেও ধনী-দরিদ্রের বিভেদ শিশুমনে কোন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে না।
নজরুল ইসলাম একজন শিশু মনস্তত্ত্ববিদ ছিলেন। আলোচ্য কবিতাটিতে তিনি শিশুমনে ঢুকে তার হৃদয়ের কথাটি জেনে নিয়েছেন ও তা’ হৃদয়গ্রাহী করে তুলে ধরেছেন।
কিন্তু কবিতাটির শেষ অংশে খোকার দাদার বেধরক মারধর শিশুমনকে ব্যথিত করে তোলে। শিশুসুলভ গল্পবাজিকে মারপিটে ঠান্ডা করে তার দাদা তথা নজরুল বিবেচনার কাজ করেননি।
‘চিঠি’ একটি পত্র কবিতা। বাংলা শিশু সাহিত্যে কাজী নজরুল ইসলামের এটি একটি উল্লেখযোগ্য অবদান। চিঠির উত্তর লিখে ছোট বোনের মান ভাঙ্গানোর তথা উৎসাহিত করবার কবিতা। অপূর্ব সুন্দর ছন্দ মিলিয়ে প্রতিটি ছত্রে ছোট বোনকে কিভাবে তুষ্ট রাখা যায় তার চেষ্টা রয়েছে সর্বত্র। চিঠিটির লিখন, বানান ইত্যাদির মর্মোদ্ধার করা কবির পক্ষে যদিও খুব কষ্টসাধ্য তবু তিনি তিন ছত্রের জবাব দিয়েছেন বাষট্টি ছত্রে এবং তিনি তাঁর ছোট বোনের চিঠির প্রত্যাশী। তার ছোট্ট চিঠি কবির কাছে মোটেও তুচ্ছ নয়। বরং মহাদামী। ‘কবিতাটির একটি অংশ বড়দের জন্যেও রীতিমতো উপভোগ্যÑ যেখানে নজরুল পত্রলেখিকা’র হাতে লেখার বর্ণনা দেন’।৪
শিশুর কাঁচা হাতের লেখার এমন বাস্তবমুখী ও চমকপ্রদ বর্ণনা আর কোথাও আছে বলে মনে হয় না। ‘কবিতাটি লৌকিক ছড়ার ছন্দে লিখিত জন্টি নামের কোনো ছোট্ট মেয়ের লেখা চিঠির উত্তর’৫,
তোর অক্ষর
হাত পা নেয যক্ষর,
পেটটা কারুর চিপ্সে
পিঠ্টে কারুর ঢিপ্সে
ঠ্যাংটা কারুর লম্বা
কেউ বা দেখতে রম্ভা!
কেউ যেন ঠিক থাম্বা,
কেউ বা ডাকেন হাম্বা!
থুত্নো কারুর উচ্চে
কেউ বা ঝুলেন পুচ্ছে!
এক একটা যা বানান
হাঁ করে কি জানান!
কারুর গা ঠিক উচ্ছের,
লিখ্লি এমনি গুর্চ্চের! …
কবিতাটির ছন্দ সৌকর্য, বাস্তবমুখী বর্ণনা ও শব্দচয়নে শিশুদের নিকট সাহিত্যের রস পরিবেশন করেছেন।
‘প্রভাতী’ কবিতাটি জাগরণী গানে মুখরিত। আপাতঃদৃষ্টিতে মনে হয় খুকুকে তথা তাবৎ শিশুকে ভোরবেলা জাগানোই কবিতাটির উদ্দেশ্য,
ভোর হলো
দোর খোলো
খুকুমণি ওঠরে!
যখন যুঁইয়ের শাখে ফুলকুঁড়ি পাপড়ি মেলতে থাকে, সূর্য পূর্বদিক হতে সবে লাল আভা ধারণ করতে শুরু করেÑ দারোয়ানের হাঁক শোনা যায় ও বাসা ছেড়ে পাখিরা আকাশে গান গেয়ে বেড়ায় কবি সেই ভোরে শিশুদের জেগে উঠবার আহ্বান জানিয়েছেন।
বুলবুলিরা যখন ফুলে ফুলে শিষ দিয়ে বেড়ায়, নদীতে মাঝি নৌকায় পাল তুলে দেয়, সেই সকালে ঘুম থেকে উঠলে খুকুর কপালে ভোরবেলার চাঁদও টিপ দিয়ে যায়। তখন কে আগে উঠেছে তাই নিয়ে খুকুদের কলরব শোনা যায়। ভগবানের প্রতি প্রার্থনা জানিয়ে কবি দিনের কাজ শুরু করার আহ্বান জানিয়েছেন। সমস্ত জড়তা ও অলসতা পরিত্যাগ করে দিনের কর্মকান্ডে অংশ নিতে বলেছেন তিনি।
শুধু ভোরবেলার জাগরণই কবিতাটির আসল উদ্দেশ্য নয়; বস্তুত ভগবানের নামে জীবনের জাগরণই মূলকথা। অন্ধকার নয়, জীবনে আলোর প্রয়োজন। অফুরন্ত আলো আনবার আহ্বান জানিয়েছেন কবি।
‘লিচু চোর’ কবিতাটি বিষয়বস্তু ও ছন্দবৈচিত্র্যে বাংলা শিশু সাহিত্যে একটি শ্রেষ্ঠ সৃষ্টির দাবীদার। কবির ব্যক্তি জীবনের দুরন্তপনা ছড়িয়ে আছে কবিতাটিতে। কল্পনার স্বর্গরাজ্য নয়, বাস্তবজীবনের দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও ঘাত-প্রতিঘাতময় জীবনের কথা শুনিয়েছেন কবি শিশুদের।
এটি একটি কাহিনীমূলক কবিতা। ঘটনাটি নাটকীয়। পাড়ার ধনাঢ্য ব্যক্তির গাছ হতে এক দুরন্ত গ্রাম্য কিশোরের লিচু চুরির ব্যর্থ প্রয়াস।
যদিও প্রয়াসের ফল কিশোরের জন্য করুণ, কিন্তু পাঠকের জন্য কৌতুকবহ। চুরির প্রথম পর্যায়েই গাছে উঠবার সময় ডাল ভেঙে যায়। কিশোরটির জন্য মালী ও কুকুরের হাতে লাঞ্ছনা ও দুর্ভোগ জোটে।
তার ব্যর্থতা, লাঞ্ছনা, দুর্ভোগ ইত্যাদি দুঃখজনক পরিণতি পল্লী অঞ্চলের এক শ্রেণীর কিশোর মহলে অতি সাধারণ ব্যাপার। এই সাধারণ ব্যাপারটি নজরুল তাঁর স্বভাবগুণে পরম উপভোগ্য করেছেন। বর্ণনার কৌশল এবং শব্দাদির সুনিপুণ প্রয়োগে কিশোরদের কাছে এর চিরস্থায়ীত্ব এনে দিয়েছে এবং এটি বহুল আবৃত্ত একটি কবিতা।
কবিতাটিতে একটি শিক্ষামূলক বিষয়ও আছে। কিন্তু অভিজ্ঞতার পর কিশোরটির চুরি ছেড়ে দেয়ার শপথ গ্রহণ। যেমন,
যাব ফের? কান মলি ভাই,
চুরিতে আর যদি যাই!
তবে মোর নামই মিছা!
কুকুরের চাম্ড়া খিঁচা
সে কি ভাই যায় রে ভুলোÑ
মালীর ঐ পিট্নীগুলো!
কি বলিস্? ফের হপ্তা?
তৌবা-নাক খপ্তা।
‘ঠ্যাং ফুলি’ কবিতার উপজীব্য কৌতুক পরিবেশন- কিছু আঙ্গিক বিকৃতিকে উপলক্ষ করে, কথা আর শব্দের কাতুকুতু দেওয়া প্রয়োগের মাধ্যমে। কৌতুক এখানে তাই কিছু কৃত্রিম তথা অস্বাভাবিক।৬ যেমন এই অংশে,
বটু তুই র্জো দে ভোঁ দৌড়,
রাখালো! ভাঙবে গোঁ তোর
নাদনা গুঁতোর
ভিটিম্ ভাটিম্।
ধুমাধুম্ তাল ধুমাধুম্
পৃষ্ঠে-মাথায় চাটিম্ চাটিম্!
কবিতাটির শেষাংশে উপদেশমূলক দিকও রয়েছে যা শিশুদের জন্য কল্যাণধর্মী। কারো অংগহানির কারণে তার নিজেকে লজ্জিত হওয়া উচিত নয়। কেননা কান্না শোনার লোক পৃথিবীতে খুব কম। লোকে হাসবে বলে তার কোথাও যেতে বা কারো সাথে মিশতে মানা নেই।
বস্তুতঃ মানুষের অংগহানির জন্য সে নিজে দায়ী নয়। তার জন্য নিজেকে লুকিয়ে রাখা তার কোন মতেই উচিত নয়। কেননা নিজেকে লুকিয়ে রাখলেই অন্যরা তাকে নিয়ে হাসবে। বরং সবার সাথে মিলে মিশে থাকলে লোকে তাকে নিয়ে আর উপহাস ও ঠাট্টা করবে না। অন্যেরও উচিত নয় কারো দুর্বল স্থানে আঘাত করা। তাতে মানুষের কষ্ট দ্বিগুণ বেড়ে যায়।
‘পিলে-পট্কা’ কবিতাটিতে কবি নিছক কৌতুক পরিবেশন করেছেন কথা ও শব্দের কাতুকুতু দেওয়া প্রয়োগের মাধ্যমে আঙ্গিক বিকৃতিও করেছেন। পুরো কবিতাটিতেই পিলে পট্কা হাশিমের দৈহিক বিকৃতি ও তার চাল-চলনের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। এখানে কয়েকটি লাইন উদ্ধৃত হল,
উঁটমুখো সে সুঁটকো হাশিম,
পেট যেন ঠিক ভুঁটকো কাছিম!
চুলগুলো সব বাবুই দড়ি-
ঘুসকো জ্বরের কাবুয় পড়ি!
তিন-কোনা ইয়া মস্ত মাথা,
ফ্যাচকা-চোখো; হস্ত? হাঁ তা
ঠিক গরিলা, লোবনে ঢ্যাঙা!
নিট্ পিটে ঠ্যাং সজনে ঠ্যাঙা!
গাইতি-দেঁতো উঁচকে কপাল
আঁতকে ওঠেন পুঁচকে গোপাল“
নাক খাঁদা ঠিক চামচিকেটি!
পৃথিবীতে তার শুধু খাওয়া ছাড়া দ্বিতীয় কোন কাজ নেই। এই একটি কাজই সে পারে। সব মোটারা মিলেও পিলে পটকাকে বাগাতে পারে না, কেননা তার পেট মোটা ও পা সরু। সারাক্ষণ তার ঠ্যাং দুটো ঠুঁটো ব্যাঙের মত কিলবিলিয়ে নড়তে থাকে।
‘হোঁদল কুঁৎকুতের বিজ্ঞাপন’ নজরুলের অন্যতম বিখ্যাত রচনা। রচনাদৃষ্টে মনে হয় শিরোনাম অনুযায়ী কোন কিছুর বর্ণনা বা বিজ্ঞাপন থাকবে, কিন্তু এতে আছে কিছু ছেলেমেয়ের চেহারা আর চরিত্রের নামানুগ বিশ্লেষণ এবং চরিত্র বা চেহারা অনুযায়ী নামের ব্যাখ্যা।৭ কবিতাটি পড়াবার আগে এ দেশের শিশুরা কখনো ভেবে দেখেনি যে ড্যাবরা ছেলেদের স্বভাব কেমন হতে পারে এবং হাঁদারাই বা কেমন? প্যাঁটরা দেহ কোন ধরনের হয় এবং বোঁচাদেরই বা কি নাম রাখা দরকার। কিছু অংশ উদ্ধৃত হল,
গাব্দা ছেলের মনটি সাদা একটুকুতেই হন খুশী,
আদর করে মাত তারে তাই নাম দিয়েছেন মন্টুসী
* * *
গাল টেবো যাঁর নাম টেবী তার একটুকুতেই যান রেগে।
কান খডুকে’, মায়ের লেঠা, রয় ঘুমুলেও কান জেগে। …
* * *
পুঁটুরানী বাপ-সোহাগী, নন্দদুলাল মানিক মার,
দাদু বুড়োর ন্যাওটা যে ভাই মটরু ছাগল নামটি তার!…
কবিতাটি আগাগোড়া হাঁসির দমকে কাঁপানো তবে, শেষ অংশটি একটু ভিন্ন ধরনের। দেশের জন্য প্রাণ দিতে এবং সাত সাগরের ওপার থেকে বন্দিনী দেশ লক্ষèীকে উদ্ধার করতে সক্ষম বাদল নামের বীর ছেলেটিকে কবি উপহার দিতে চান ‘হোঁদল-কুঁৎকুঁতের ছানা’।
মনস্তাত্ত্বিক বক্তব্যের সাথে এই হাস্যকর বিষয়ের সংযোজনে নজরুল অসাবধানতার পরিচয় দিয়েছেন। দেশপ্রেম এখানে রসিকতায় পরিণত হয়েছে।
আব্দুল কাদির সম্পাদিত নজরুল রচনাবলীর তৃতীয় খন্ডে প্রকাশিত ‘অপ্রকাশিত কবিতা ও গান’-এ কিছুসংখ্যক শিশু কিশোরদের জন্য লিখিত কবিতা পাই। কবিতাগুলোÑ ‘সারস পাখি’, ‘ছোট হিটলার’, ‘নতুন পথিক’, ‘নতুন খাবার’, ‘শিশু সওগাত’, ‘মটকু মাইতি বাঁটকুল রায়’, ‘ঝুমকো লতায় জোনাকি’, ‘কোথায় ছিলাম আমি’, ‘সংকল্প’, ‘চলব আমি হাল্কা চালে’, ‘কিশোরের স্বপ্ন’, ‘প্রার্থনা’, ‘মুকুলের উদ্বোধনী’, ‘আগা মুর্গী লে কে ভাগা’, ‘মায়া-মুকুর’, ‘ফ্যাসাদ’, ‘আগুনের ফুল্কি ছুটে’, ‘আবাহন’, ‘আবীর’, ‘লাল সালাম’, ‘বর-প্রার্থনা’, ‘এস মধু মেলাতে’, ‘মা এসেছে’, ‘বগ দেখেছ’, ‘গদাই এর পদবৃদ্ধি’।
‘সারস পাখি’ কবিতাটিতে নজরুল অপরূপ সৌন্দর্য সৃষ্টি করেছেন। এদিক থেকে কবিতাটিকে নজরুলের ‘ঝিঙে ফুল’ কবিতার সাথে তুলনা করা যায়। বিশেষ কোন বক্তব্য নেই কবিতাটিতে। অতি সাধারণ একটি পাখি বা বিষয়ও যে প্রতিভার স্পর্শে অপরূপ সৌন্দর্যের আধারে পরিণত হতে পারে ‘সারস পাখি’ তার আরেকটি প্রমাণ। সাধারণকে এমন অসাধারণ সৌন্দর্য দান কেবল নজরুলের মত প্রতিভাবানের পক্ষেই সম্ভব। কবিতাটির প্রথমাংশে,
সারস পাখি! সারস পাখি!
আকাশ-গাঙের শ্বেতকমল!
পুষ্পপাখি! বায়ুর ঢেউ এ
যাস্ ভেসে তুই কোন্ মহল?
তোরে ময়ূর পঙ্খী করি
পরীস্থানের কোন্ কিশোরী
হাল্কা পাখার দাঁড়ে টেনে যায়?
নি¤েœ কাঁপে সায়র জল!
গগন-কূলে ঘুম ভেঙে চায়
মেঘের ফেনা অচঞ্চল।
‘ছোট হিটলার’ একটি বীর রসের রচনা। এ কবিতায় নায়ক সানি খুবই ছোট, কিন্তু সে অসম্ভব সাহসী ও তেজী। তার কল্পনায় সে একজন অমিত তেজ বীর পুরুষ। সে পোল্যান্ড, জার্মানিকে ভয় পায় না। রাইফেল, এয়ারগান এরোপ্লেন আধুনিক কোন সমরাস্ত্রই তার কাছে গ্রাহ্য করবার মত বস্তু নয়। তার রাগে ঘোলা চোখ দেখেই গোলাগুলি বারুদ বোম সব কুলপি বরফের মত ঠান্ডা হয়ে যায়,
রাইফেলকে ভয় করে কে? বগল দাবা এয়ারগান,
এক গুলিতে উড়িয়ে দিতে পারি কত মিঞার কান।
গুল্তি মেরে ফেলতে পারি ঝুলতি-ন্যাজা এরোপ্লেন,
দেখলে মোরে, বলবে ওরা ‘ছোট-হিটলার বেরুচ্ছেন’!
তার রণকৌশলে মুসোলিনি হেঁসেলে ঢুকে মশলা পিষবেন আর হিটলার হবেন উড়ে বামুন।
‘নতুন পথিক’ এ আগামী দিনের শিশুকে কবি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি তাদের নতুন যুগের মানুষরূপে দেখেছেন।
কবি তাদের সম্বন্ধে আশাবাদী। সে বেপথুকে পথ দেখাবে। মানুষকে ভরসার কথা শোনাবে। পৃথিবীতে আনন্দ বয়ে নিয়ে আসবে। এই পৃথিবীর মাটির করুণা নিয়ে স্বর্গ রচনা করবে। কবিতাটি নীচে উদ্ধৃত হল,
নতুন দিনের মানুষ তোরা
আয় শিশুরা আয়!
নতুন চোখে নতুন লোকের
নতুন ভরসায়।
নতুন তারার বেভুল পথিক
আনলি ধরাতে,
ধরার পারে আনন্দলোকে
দেখাস ইশারায়।
খেলার সুখে মাতলি তোরা
মাটির করুণা,
এই মাটির স্বর্গ রচিস,
তোদের মহিমায়।
‘নতুন খাবার’ হাস্য রসের কবিতা। তিনি খাবার তৈরীর যে উপকরণ ও পদ্ধতির কথা বলেছেন তা অবাস্তব ও উদ্ভট। নীচে কবিতাটির কিছু অংশ উদ্ধৃত হল,
কম্বলের অম্বল
কেরোসিনের চাট্নি,
চামচের আম্চুর
খাইছ নি নাত্নি?
আমড়ার দামড়ার
কান দিয়ে ঘষে নাও,
চামড়ার বাটিতে চট্কিয়ে কষে খাও।…
কবিতাটি সুকুমার রায়ের ‘খাই খাই’ কবিতার সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। তাঁর কবিতাতেও আজব আজব খাবারের কথা বলা হয়েছে। পার্থক্য এই যে, এখানে খাবারগুলির উল্লেখ করা হয়েছে বিভিন্ন ধরনের খাওয়ার উদাহরণ হিসেবে। ‘খাই খাই’ কবিতার কিছু অংশ,
ডাল ভাত তরকারি ফলমূল শস্য
আমিষ ও নিরামিষ, চর্ব্য ও চোষ্য,
রুটি লুচি, ভাজাভুজি, কৈ ঝাল মিষ্টি,
ময়রা ও পাচকের যত কিছু সৃষ্টি,।৮
‘শিশু সওগাত’ এ নজরুল সমগ্র শিশু সমাজকে এর অন্তর্ভুক্ত করেছেন। তিনি তাদের দেখেছেন নতুন প্রভাতের এবং সেই সংগে শক্তিরও প্রতীকরূপে।
প্রকৃতির যত কিছু আয়োজন এবং আহ্বান সব শিশুদেরই জন্য,
তোরে চেয়ে নিতি রবি ওঠে পুরবে,
তোর ঘুম ভাংগিলে যে প্রভাত হবে।
ডালে ডালে ঘুম জাগা পাখিরা নীরব,
তোর গান শুনে তবে ওরা গাবে সব।
অতএব, কবি শিশুকে আহ্বান জানিয়েছেনÑ
তারে দিন অনাগত, শিশু তুই আয়,
জীবন মরণ দোলে তার রাঙা পায়।
তোর চোখে দেখিয়াছি নবীন প্রভাত,
তোর তরে আজিকার নব সওগাত।
সহজ সরল শিশুদের জন্য রচিত অত্যন্ত উপযোগী কবিতা এটি। শিশুদের উপযোগী ছন্দ ও মিষ্টি ভাষায় একটি অপূর্ব নিদর্শন।
‘মট্কু মাইতি বাঁটকুল রায়’ একটি হাস্যরাসাত্মক কবিতা। নিতান্তই হাস্যরস পরিবেশেন এই কবিতা রচনার উদ্দেশ্য। এর কাহিনীর পিছনে বিশেষ কোন বক্তব্য নেই। ‘মট্কু মাইতি বাঁটকুল রায়’ কবিতার নামকরণটি যেমন উদ্ভট তেমনি এর কাহিনীটি। কাহিনীর নায়ক রেগেমেগে যুদ্ধে যাত্রা করলেও তার চলার ঢংটি মোটেও যুদ্ধংদেহী নয়। বরং তার চলার ঢংটি,
পায়ে পরে গাবদা বুট আর পট্টি,
গড়াইয়া চলে যেন গাঁঠ্রি ও মোটটি,
হনুলুলু সুরে গায় গান উদ্ভটটি
হাঁটি হাঁটি পা পা ডাইনে বাঁয়
মটকু মাইতি বাঁটকুল রায় ॥
বরং সে যুদ্ধ যাত্রা করলেও সামান্য দামড়া দেখেই ভয়ে অস্থির হয়। নায়কের আঙ্গিক ত্রুটি ও উদ্ভট আচরণ এখানে হাসির উৎস। নজরুলের নিজস্ব ঢঙে কিছু শব্দ এখানে পাওয়া যায়। এ ধরনের হাস্যরস পরিবেশন বাঙলা শিশুসাহিত্যে এই প্রথম।
‘ঝুমকো লতায় জোনাকি’তে কবির কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে মধুরতম শব্দটি হল শিশুর,
ঝুমকো লতায় জোনাকি
মাঝে মাঝে বৃষ্টি গো
আবল তাবল বকে কে
তারও চেয়ে মিষ্টি গো
মিষ্টি মিষ্টি।
এখানে শিশুর শব্দকে ‘ঝুমকো লতায় জোনাকি’ আলো এবং তার মধ্যে বৃষ্টির শব্দ পড়লে যে একটি মিষ্টিমধুর শব্দ ও আমেজের সৃষ্টি হয় তার চেয়েও মধুরতম শব্দকে শিশুর শব্দ বলা হয়েছে। কবিতাটির উপজীব্য বার বছর খোকনের বিরহে মা কাতর। বাঘিনী মাও তার ছেলের বিরহে কাতর। দুধের বাটি, যে বাটিতে শিশু দুধ খেত সেটি অব্যবহারে পাথর হয়ে গেছে। ঘরের সমস্ত জিনিস তার অভাব বোধ করছে,
কেঁদে বলে ঘরের জিনিসÑ “যেমন ছিলাম তেমনি আছি-
খোকা কেন ভাঙে না,
কিছুই ভালো লাগে না।”
পৃথিবীর সব কিছুই পরিবর্তন চায়। খোকার হাতের ছোঁয়া অর্থাৎ নতুনের ছোঁয়া সবাই আশা করে।
‘কোথায় ছিলাম আমি’র শিশু বিশ্বপ্রকৃতি বা বিশ্বমায়ের সন্তান। মায়ের কোলে আসার আগে সে ছিল সারা বিশ্বে ছড়ানো। সে ছিল চাঁদে শুকতারায়, কাজলা দীঘির পদ্মফুলে, নদীর বন্যায়, ঝড়ের দুরন্তপনায়, সন্ধ্যাদীপের শিখায়। কেননা বিশ্ব প্রকৃতির জন্য তার মন অধীর হয়। পৃথিবীর প্রকৃতি বলে ‘তুই যে আমার এই ত সেদিন আমার বুকে ছিলি’। সে সব খোকাকে নিজের মনে করে, ‘যে খোকারে দেখি-ভাবি আমার খোকা বুঝি’। বস্তুতঃ মায়ের কোলে আসার আগে সে ছিলো সারা বিশ্বে ছড়ানো। তার ভাষায়,
কবিতাটি রবীন্দ্রনাথের ‘শিশু’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত ‘জন্মকথা’৯ কবিতাটির দ্বারা প্রত্যক্ষ এবং গভীরভাবে প্রভাবিত। তবে রবীন্দ্রনাথের কবিতায় শিশুর প্রশ্ন ‘এলেম আমি কোথা থেকে?’ এর উত্তর দেন তার মা। নজরুলের শিশুর জবাব দিয়েছে বিশ্বমাতা বা বিশ্বপ্রকৃতি। এখানেই রবীন্দ্রনাথের কবিতার সংগে নজরুলের কবিতার পার্থক্য। অর্থাৎ ‘জন্ম কথা’র, শিশু মানুষের জীবনধারার জীবনচারণের ফল, ‘কোথায় ছিলাম আমি’র শিশু বিশ্বপ্রকৃতির তথা বিশ্বমায়ের সন্তান।
একটি জায়গায় এই উভয় কবির মিল রয়েছে। তা’হল রবীন্দ্রনাথের ‘জন্ম কথা’ ও নজরুলের ‘কোথায় ছিলাম আমি’ দার্শনিক তত্ত্বের কারণে শিশুদের কাছে সহজবোধগম্য হতে পারেনি।
‘সংকল্প’ কবিতাটি অভিযানমূলক। শিশু আর আবদ্ধ হয়ে থাকতে চায়না, সে চায় বিশ্বজগতের পরিচয় পেতে,
থাকব নাকো বদ্ধ ঘরে, দেখব এবার জগতটাকে,
কেমন করে ঘুরছে মানুষ যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে।
দেশ হতে দেশ দেশান্তরে
ছুটছে তারা কেমন করে,
কিসের নেশায় কেমন করে মরছে যে বীর লাখে লাখে
কিসের আশায় করছে তারা বরণ মরণ যন্ত্রণাকে।
কি করে এবং কিসের নেশায় মানুষ এক দেশ হতে আরেক দেশে ছুটে চলেছে, কেন মানুষ সাগরের তলদেশ হতে লক্ষèী আহরণে ব্যস্ত, কেন মানুষ হিমালয়ের চূড়ায় উঠতে চায়, পৃথিবীর উত্তর মেরু এবং দক্ষিণ মেরুতে কি আছে, চাঁদ ও মঙ্গল গ্রহেই বা কি আছে এসবই দেখা এবং জানার নেশায় মানুষ ছুটে চলেছে। নজরুলের শিশুও এইসব অভিযানে সামিল হতে চায়। চীনবিপ্লব, চীন প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, আয়ারল্যান্ড বিপ্লব, তুর্কী বিপ্লব, তুর্কী প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, গ্রীসের পতন নজরুলের স্বাধীনচিত্ত মনে প্রেরণা জাগিয়েছে ও সমভাবে শিশুর মনেও আবেগ সঞ্চারিত করেছে। কবিতাটির মাধ্যমে কবি শিশুর স্বাধীনসত্তা ও চিন্তার জগৎ প্রসারিত করেছেন।
‘চলব আমি হাল্কা চালে
পল্কা খেয়ার হাওয়ার তালে,
কুসুম যেমন গন্ধ ঢালে
তরল সরল ছন্দে রে।
যেনম চলার ছন্দ লুটে
চন্দ্র ডোবে সূর্য উঠে,
সন্ধ্যা সকাল সমীর ছুটে
যেমন সে আনন্দে রে ॥
সে ধনজন গাড়ী ঘোড়া কিছুই চায় না, সে প্রকৃতির পাঠ নিতে চায়। জাগতিক লোভ বা কোন কিছুতে মোহও নেই। ভয় দেখানো কোন কিছু হওয়ার ইচ্ছাও তার নেই। সবার ভালোবাসা নিয়ে সে বেঁচে থাকতে চায়।
‘কিশোর স্বপ্ন’ দেশপ্রেমমূলক কবিতা। এখানে শিশু দেশমাতার দু:খ মোচনের জন্য বাইরের জগৎ ঘুরে আসতে চায়। দেশের মধ্যে শুধু স্কুলে যাওয়া আর চাকুরী করার মত একঘেঁয়ে কাজ ছাড়া প্রাণের কোন বিকাশ নেই।
শিশু চেকোশ্লোভাকিয়া, চীন, জাপান ও রাশিয়া যাবে। সেখান হতে সে অগ্নিমন্ত্রের দীক্ষা এনে দেশমাতৃকার জড়তা ও অবহেলা দূর করবে। বিদেশ হতে রতœরাজি এনে তার দেশ মাতৃকাকে সে রাজরাণীর অলংকারে সাজিয়ে তুলবে।
দেশ-বিদেশের ছেলেমেয়ে তার প্রসাদে ধন্য হবে এবং হৃত গৌরব পুনরুদ্ধার করবে ও শৌর্যে-বীর্যে দেশকে সমৃদ্ধ করে তুলবে,
আমার দেশের প্রসাদ পেয়ে
দেশ-বিদেশের ছেলে মেয়ে
ধন্য হতে আগে যেমন তেমনি আজও হবে;
তোমার পুত্র না যদি রয় (তাহার) আশার স্বপ্ন রবে ॥
‘জিজ্ঞাসা’ নজরুলের আরেকটি ব্যতিক্রমধর্মী শিশুতোষ কবিতা। কিশোরসুলব অনুসন্ধিৎসার আড়ালে এটি একটি দার্শনিক বা তত্ত্বমূলক রচনা। ‘শিশু-যাদুকর’, ‘আবাহন’, ‘কোথায় ছিলাম আমি’, কবিতাতেও তত্ত্ব বা দর্শন আছে; সে দর্শন মানুষের জন্ম বিষয়ক কিন্তু ‘জিজ্ঞাসা’র অনুসন্ধিৎসা জগৎ ও তার পরিচালককে কেন্দ্র করে,
রব না চক্ষু বুঁজি
আমি ভাই দেখব খুঁজি
লুকানো কোথায় কুঁজি
দুনিয়ার আজব-খানায়।
আকাশের প্যাটরাতে কে
এত সব খেলনা রেখে
খেলে ভাই আড়াল থেকে,
সে তা ভাই ভারী মজার।…
‘মাঙ্গলিক’ প্রেরণামূলক কবিতা। খুব ভোরবেলা সুর্য পূর্বাকাশে ওঠে। সে তার আকাশ মায়ের কোলে ফুল ফোটায়, ক্রমে যত উপরে উঠে ও তার শক্তি ও তেজের দ্যুতি বিশ্বময় ছড়াতে থাকে। আবার তার বিদায়ে পৃথিবী মলিন হয়ে পড়ে।
শিশুর জীবনও হবে সূর্যের মত আনন্দময় ও গৌরবময়। তার আলোকে পৃথিবীর দু:খ শোক শেষ হয়ে যাবে। দেশের কলংক ও অসম্মান নিঃশেষ হয়ে নতুন প্রাণে সব কিছু জেগে উঠেবে। তার আহ্বানে আত্ম-অবিশ্বাসীরাও জেগে উঠবে। তবেই বিশ্ব তার মাঙ্গলিক গাইবে,
যে আদর্শ মানুষ আজও জন্মেনিক এই ধারায়,
তুমিই হবে সেই সে মানুষ অধ্যবসায়, তপস্যায়।
সূর্য-সম শেষ জীবনে রাঙিয়ে যাবে দিগি¦দিক্,
যুক্ত করে বিশ্ব-নিখিল গাইবে তোমার মাঙ্গলিক।
‘লক্ষèী ছেলে তাই তোলে’ কবিতাটি অভিযানমূলক। খোকা এখানে সমস্ত বাঁধা নিষেধ উপেক্ষা করে বিশ্বময় বেরিয়ে পড়তে চায়,
ঘরের আড়াল ভেঙ্গে এবার বাহির ভুবন লুটতে চাই;
জীনব হলো জেল-কয়েদি টেনে সর্বদাই।
নিষেধ বাঁধা মেনে মেনে বুকের ভিতর ধরল ক্ষয়,
প্যাঁচার চেয়েও হলাম অধম, সন্ধ্যে রাতে চলতে ভয়।
একটু বয়স হলে পন্ডিত মশায়ের রক্ত নেত্রে খোকা নিরুৎসাহ হয়ে পড়ে। অভিভাবকের দল খোকার মঙ্গলের ভয়ে ঘর হতে বাইরে বেরুতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
কবিতাটিতে খোকার মা, অভিভাবক এবং পন্ডিত মশাই খোকার মঙ্গল কামনায় সব কাজেই বাধা দেন ও নিরুৎসাহী করেন। এখানে মাতু¯েœহের আতিশয্যে শিশুর চলার পথ পায়ে পায়ে বিঘিœত হয়। তাই সে বড় হয়ে বীর তথা দেশের গৌরব বয়ে আনতে পারে না,
যৌবনে সে বীর হল না দেশের গরব? মার কোলে
বিশ বছরে তুলছে পটল? লক্ষèী ছেলে তাই তোলে।
‘কিশোর স্বপন’ একটি স্মৃতিচারণমূলক কবিতা। এই কবিতার নায়ক যৌবনের মাঝগগনে পৌঁছে বেনুবাদ্যরত কিশোরদের মাঝে আপন কৈশোরকে অবলোকন করে আনন্দিত হয়েছে। কৈশোর থেকে যৌবনে উত্তরণের বেদনায় সে বেদনার্ত,
ফোট ফুল আজ স্বপ্ন দেখে নয়ন বুজে,
কোরক-বেলায় বিকাশ বেদন বেড়ায় খুঁজে।
কিশলয়ের পাতার ফাঁকে
খুঁজে বেড়ায় আপনাকে,
অতীত দিনের পথের বাঁকে
তোদের সাথে হারিয়ে গেনু ॥
‘প্রার্থনা’ প্রার্থনামূলক কবিতা। খোদার কাছে নিজেদের তথা সকলের ভাল কামনা কবিতাটির উপজীব্য,
আমাদের ভালো করো হে ভগবান!
সকলের ভালো করো হে ভগবান ॥
মন থেকে হিংসা ও ক্লেশ দূর করে পরস্পরের প্রতি ভালবাসাবাসিতে পৃথিবী স্বর্গে পরিণত হবে। ভগবানের কাছে শিশুর প্রার্থনা- জ্ঞানের আলো ও বিপুল শক্তি- যেন তার প্রদত্ত জ্ঞানে শিশু তাঁকে চিনে নিতে পারে ও তাঁর শক্তি কাজে সহায় হয়। এই পর্যায়ে কবি অত্যন্ত ধর্মভীরু। কেননা,
ধর্ম যদি সাথী হয়
রবে না ক দু:খ ভয়।
বিপদে পড়িলে তুমি করো যেন ত্রাণÑ
হে ভগবান ॥
‘মুকুলের উদ্বোধনী’ উদ্বোধনমূলক কবিতা। কোন বালিকা বিদ্যালয়ের পারিতোষিক বিতরণী অনুষ্ঠানে পঠিত বলে সম্পাদক আবদুল কাদির মনে করেন। বিদ্যার মহিমায় আজ ভারত মাতার আসন টলে উঠেছে। জ্ঞানবিদ্যার সংস্পর্শে ছোট ছোট বোনেরা আজ প্রাণচাঞ্চল্যে জেগে উঠেছে, দেখে কবির মন ভরে উঠেছে,
আজ কি বাণীর সোহাগটুকুন লুটলি তোরা লুটলি হায়,
গরবিনী বোনগুলি মোর তাদের দেখে চোক জুড়ায়।
কিসের এত আনন্দ আজ জান কি তা জান বোন
লক্ষèী যত মেয়েদের আজ জ্ঞান-মুকুলের উদ্বোধন।
নজরুল নারী শিক্ষাকে উৎসাহিত করেছেন। মেয়েরা সব দুঃখজয়ের ক্ষমতা রাখে। সব দুঃখজয় করে ভালভাবে পড়াশুনা শিখলে মেয়েরাই দারিদ্র্যের কুটিরে রাজ বিভব আনতে পারবে।
যে সময়ে বৃটিশ শাসিত পরাধীন ভারতবর্ষে মুসলমান রমণীদের মধ্যে শিক্ষার হার অনেক কম ছিল সেই সময় রচিত এই কবিতাটি নারী শিক্ষাকে প্রচুর উৎসাহ জুগিয়েছিল।
‘আগা মুর্গী লে কে ভাগা’ অতি উপভোগ্য হাস্য রসের কবিতা। কবিতাটির মুখ্য চরিত্র আগা একজন অর্থব্যবসায়ী আফগানী। এদেশে এরা কাবুলিওয়ালা বলে পরিচিত। এরা চড়া সুদে টাকা ধার দেয়। নজরুল এদের নিয়ে কিছু নির্মল কৌতুক করেছেন। কবিতার এক অংশে আগা গাছে চড়ে জাম খাওয়ার সময় জাম ভেবে একটি ভোমরা মুখে পুরে খেয়ে ফেলে। ভোমরাটি যখন যন্ত্রণায় চুঁ চুঁ আওয়াজ করে আগা তখনও নিজের ভুল বুঝতে পারে না। সে কালো রঙের সব কিছু খেয়ে ফেলবেÑ কোনো আপত্তিই শুনবে না। কবিতাটির শেষ অংশ উপভোগ্য,
ও পাড়ার হীরু তোমায় দেখেই পালায় পগার পারে,
‘রুপিয়া লে আও’ বলে ধরলে তাহার ছাগলটারে।
দেখিয়াই মট্রু মিঞার মুর্গী লুকায় ঝোপের আড়ে
তাই কি ছেলে মেয়ে মুর্গী চোরা বলে ডাকে ॥
‘মায়া-মুকুর’ একটি প্রেরণামূলক কবিতা। সৃষ্টির আদিকাল হতে জগতের তাবৎ মুনি-ঋষিরা আপন মনের দর্পণে নিজেকে যাচাই করে নিতে চায়।
আজকের বালক-বালিকারা শরীরে সারা বিশ্বের ছায়া পড়েছে। শরীর ছোট হলেও তাদের মধ্যে সৃষ্টি বৈচিত্র্যের বিপুল সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে কেননা,
তুমি হতে পার মহাযোগী, মহামুনি, ঋষি, অবতার,
তুমি হতে পার লেনিন, কামাল, সাজিয়াৎ, হিটলার।
তুমি হতে পার কৃষ্ণ, বুদ্ধ, রামানুজ, শংকর,
প্রতাপাদিত্য, শিবাজী, সিরাজ, রানাপ্রতাপ, আকবর।
তুমি হতে পার রবীন্দ্র, অরবিন্দ, বিবেকানন্দ
দেখিবে, রয়েছে অনন্ত গাঁথি সুভাষ তোমাতে বন্ধ।
ভগবানের যে অসীম শক্তি তোমাতে তাহা বিরাজে,
বুঝিবে তোমার স্বরূপ দেখিলে মায়া-মুকুলের মাঝে।
নিজেকে ছোট ভাবলে কাজের পূর্ণতা আসে না। শিশুর মধ্যেই বড় ও মহৎ কর্মের প্রেরণা লুকিয়ে আছে কেননা সে বিপুল কর্মশক্তি নিয়ে পৃথিবীতে নেমে এসেছে। এই মানুষই দিব্যশক্তি বলে শক্তিশালী হতে পারে। ইচ্ছা করলেই সে ব্রহ্ম বিষ্ণু বা শিব হতে পারে। অজ্ঞানতা বা ক্ষুদ্রগন্ডি পেরিয়ে মানুষের ভিতর যে মহামানব রয়েছে তাকে জাগিয়ে তুলতে হবে। তাই কবি প্রেরণা জাগান শিশুর মাঝে,
তুমি নও শিশু দুর্বল, তুমি মহৎ ও মহীয়ান
জাগো দুর্বার, বিপুল, বিরাট, অমৃতের সন্তান।
‘ফ্যাসাদ’ একটি ব্যঙরসাত্মক কবিতা। পেসাদ নামের ছেলেটি একজন জীবনবিমুখ বালক। সে এই দুনিয়াতে বেঁচে থাকাটাই মস্ত ফ্যাসাদ বলে মনে করে,
শয্যা ছেড়ে নিত্য ভাবে গোমরা-মুখো পেসাদ,
এই দুনিয়ায় বেঁচে থাকা মস্ত একটা ফ্যাসাদ।
ভোরবেলা ঘুম থেকে ওঠা সে ঝামেলা বলে মনে করে। স্কুলের গুরুমশাই তার কাছে ‘জুজু’ বলে মনে হয়। পাঠশালাতে নামতা বলা এবং অংক কষা সবই তার কাছে বিরক্তিকর। বাড়ী এবং স্কুলের নিয়ম-শৃংখলা ও অনুশাসন কিছুই তার ভাল লাগে না; তার ভাল লাগে পাড়া বেড়াতে।
বাবা মায়ের ভয়ে সে প্রাণ খুলে হাসতে পারে না। আমবাগানে সে স্বাধীনভাবে ঘোরাফেরা করতে পারে না, সর্বত্রই তার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ। পরিশেষে,
বেঁচে থাকার ফ্যাসাদ দেখে পেসাদ ভাবে মনে,
আজ বাদে কাল চলে যাবে অনেক সে দূর বনে।
কিংবা হবে তালগাছে যে দানো একানোড়ে,
রাত্রি হলে বসবে এসে সবার ঘাড়ে চড়ে!
কিলিয়ে তাদের ভূত ভাগাবে, বলবে এ কি ফ্যাসাদ
নাকি সুরে বলবে তখন ‘ফ্যাঁসাদ নয়, এ পেঁসাদ’।
নজরুলের শিশু সব-সময়ই স্বাধীনতা ভালবাসে। কবিতাটি যৌথ ভোগের। শিশু ও বয়স্ক উভয়ই আমোদিত হয় কবিতাটি পড়ে।
‘আগুনের ফুলকী ছুটে’ কাব্যিক সৌন্দর্য আর ছন্দের ঝংকারে উপভোগ্য কবিতা। এটি গীতধর্মী। এর সূচনাভাগের কাব্যিক সৌন্দর্য,
আগুনের ফুলকি ছুটে, ফুলকি ছুটে!
ফাগুনের ফুলকি ফুটে নব যুগ পত্রপুটে
ফাগুনের ফুল কি ফুটে।
আগুনের ফুলকি ছুটে ফুলকি ছুটে“
উল্কার উলকি লেখায়
নিশীথে পথ কে দেখায়?
আকাশে হজরত আলির
আগ্নেয় ‘দুল দুল’ কি ছুটে?
আগুনের ফুলকি ছুটে ফুলকি ছুটে!
‘আবাহন’ বাৎসল্য রসের কবিতা। দার্শনিক তত্ত্বের জন্য বিখ্যাত। এতেও শিশুর আবির্ভাব পথের কথা বলা হয়েছে। পূর্বের আলোচিত ‘শিশু যাদুকর’ ও ‘কোথায় ছিলাম আমি’র সগোত্র। তবে এখানে তত্ত্ব আরো গভীর ও প্রত্যক্ষ। ‘জন্ম কথা’১০র মায়ের শিশু ইচ্ছে হয়ে তাঁর মনের ভিথর লুকিয়ে ছিল আর ‘আবাহন’ এর মা স্পষ্টই বলেনÑ তাদের সকল ইচ্ছার মূর্তি নিয়ে শিশুর আবির্ভাব ঘটেছে। তিনি শিশুর মধ্যে তার শৈশব সত্তাকে ফিরে পান। ‘আবাহন’ এর শিশু সার্বজনীন, সর্বকালীন সকল মায়ের ’সকল ইচ্ছার’ প্রতীক,
মোদের বুকের কামনায় কি সুপ্ত ছিলি ওরে,
শিশু হয়ে এলি সকল ইচ্ছা মূর্তি ধরে।
আমার ‘আমি’ হারিয়ে ফেলে পেয়েছি আজ ফিরে,
বহুদিনের হারিয়ে যাওয়া আমার ‘আমি’ টিরে।
‘আবাহন’ ১৯২২ সালে প্রথম প্রকাশিত। বাৎসল্য রসের কবিতা হলেও প্রকাশকাল দেখে বোঝা যায় এটি তাঁর প্রাগ্দাম্পত্য জীবনের রচনা কিন্তু কবিতাটিতে নবজাতককে কেন্দ্র করে মায়ের যে অনুভূতি ব্যক্ত হয়েছে কুমার নজরুল তাকে তাঁর কবি প্রতিভার বলে বিস্ময়করভাবে স্বাভাবিক রূপ দিয়েছেন।১১
কবিতাটি শিশুদের জন্য রচিত হলেও দার্শনিক তত্ত্বের কারণে বোধ্যতার দিক হতে শিশুর নাগালের বাইরে রয়ে যায়।
‘আবীর’ একটি প্রেরণামুলক কবিতা। এই দেশের শীতের জর্জরতা নেমে এসেছে। জরা-জীর্ণে ভরে উঠেছে সব কিছু। গানের আবীর ছড়াতে কবি আহ্বান জানিয়েছেন শিশুদের। এই পৃথিবী আবার ফুল ও ফলে ভরে উঠুক এবং ফাগুন হেসে উঠুক,
ছড়াও ছড়াও গানের আবীর শীত জর্জর দেশে,
রাঙিয়া উঠুক জীর্ণ ও জরা, ফাগুন উঠুক হেসে।
আবার পুষ্প পরøবহীন শীর্ণ তরুর শাখা
হউক পূর্ণ কুঁড়ি কিশলয়ে, পরাগের ফাগে মাখা।
এই পৃথিবী নতুনের রঙে রঞ্জিত হয়ে উঠবে। দেশ যখন ঘুমে অচেতন তরুণের আঁখি তখনও জেগে থাকে তারাই অশোক কৃষ্ণচূড়ার রঙে পৃথিবী রাঙিয়ে তুলবে।
‘লাল সালাম’ কবিতাটিতে সরস্বতী পূজার উদ্বোধনী গেয়েছেন কবি। আজ নতুনের উদ্বোধন। দিকে দিকে আজ জ্ঞানের দেবতা জেগে উঠেছে,
আজ নতুন
উদ্বোধন
বীন্-পাণির
সুর-বাণীর।
প্রকৃতিতেও আজ তার আয়োজন। ভাবে মোহিত হয়ে পাখি গান গাচ্ছে। এই বিশেষ সময় প্রতি বছর নতুন জামা ও বই প্রাপ্তি ঘটে। গুরুজনে ভক্তি করতে হবে। নইলে সুখ প্রাপ্তি কোথাও ঘটবে না। সুতরাং,
এই সভায়
আজ সবায়
কর প্রণাম
লাল সালাম।
বাহ্বা কি
আজ খুশি!
এমনি জোর
সব বছর
চাই হাসি
আর খুশি!
‘বর প্রার্থনা’ একটি ব্যতিক্রমধর্মী রচনা। ব্যঙ্গাত্মক এই কবিতাটি সমকালীন যুগযন্ত্রণার সাক্ষী। এটি রচিত হয় সম্ভবত দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের প্রথম দিকে। যখন একদল সুবিধাবাদী সুবিধা আদায়ে ব্যস্ত। আলোচ্য কবিতাতে দেবী দুর্গার কাছে বরপ্রার্থী কোনো ভক্তের জবানী বিবৃত। ‘তার কাম্য বস্তু মোক্ষ নয়, ঐহিক স্বাচ্ছন্দ্য।’ যার স্বরূপ,
ঐ খাঁড়াটা নিয়ে মা তোর করতে পারিস তাড়া?
বাড়িওয়ালা আসবে যখন চাইতে বাড়ী ভাড়া?…
রাত্রে যেন কামড়ায় না মা, ছাড়পোকা আর মশা,
আর দিনের বেলায় সইতে না হয়, গায়ে মাছি বসা।…
‘এস মধু মেলাতে’ কবিতায় কবি শিশুদের আহ্বান জানিয়েছেন শারদ প্রভাতের দুর্গাপূজার উৎসবে বালক-বালিকা, কিশোর-কিশোরীকে আহ্বান জানিয়েছেন পূজার আনন্দোৎসবে যোগ দিতে। নজরুল শিশুকে দেখেছেন শক্তিরও প্রতীক রূপে। যত প্রৌঢ় ও জরাজীর্ণ আছে তাদের অন্তর্নিহীত শক্তিকে জাগিয়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন,
এস মধু-মেলাতে
খেলতে ও খেলাতে
প্রৌঢ় ও জরাজীর্ণ যত বৃদ্ধে
লয়ে তনু ভরা তৃপ্তি, শক্তির দীপ্তি,
ডেকে আনো সাথেÑ ঐশ্বর্য-সমৃদ্ধে।
‘মা এসেছে’ কবিতায় এক বছর পরে আবার পূজা ফিরে এসেছে। হিন্দুধর্মে দুর্গাপূজা অর্থ মঙ্গল ও কল্যাণের দেবীর ফিরে আসা। মায়ের আসার খুশিতে দিকে দিকে আনন্দ ও বাদ্য বেজে উঠেছে।
নজরুল কোন ধর্মকেই ছোট করে দেখেননি। সব ধর্মের উৎসব ও আনন্দকেই আন্তরিকতার সাথে গ্রহণ করেছেন। তিনি কাজ ফেলেও এই দিনে বেহিসাবী খরচ করতে বলেছেন। কেননা আগামী বৎসর এই দিনের উৎসবে আবার যোগদান সম্ভব নাও হতে পারে,
এক বছরের অতৃপ্তি ভাই
এই ক দিনে কিসে মিটাই,
কে জানে ভাই ফিরব কি না আবার মায়ের কোলে,
আনন্দ আজ আনন্দকে পাগল করে তোল ॥
‘বগ দেখেছ’ কবিতাটি কৌতুক রসের কবিতা। বগ একটি সাদা রংয়ের পাখি। বাংলা অক্ষর ‘দ’ এর মত। এটি বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের জলাশয়ের পাখি। এখানে বগের আকৃতি যত রকমভাবে বানানো যেতে পারে তার বাস্তব ও চমকপ্রদ বর্ণনা দেয়া হয়েছে। নীচে তার কিছু অংশ উদ্ধৃত হল,
বগ অর্থাৎ বগলা অর্থাৎ কুঁজো সাদা পাখি।
রামার বুড়ো, দাদা মশাই, মামার খুড়ো
থুথ্থুড়ো নুন্নুড়ো যেমন সুটকো বাঁকা!…
বুঝলে না কো? আচ্ছা রোসো, উবু হয়ে সামনে বসো,
কাছিম যেমন বাড়ায় গলা তেমনি করে ঘাড়টা বাঁকাও
বাঁ হাতটা গুটিয়ে রেখে উপর দিকে কেৎরে তাকাও
ঠোঁট দুটোকে ঘোঁচ করম এই চষ্ণু হল,
এমনিতর বগ দেখেছ? দেখনি ক? কি যে বল!
একটি সাধারণ পাখিকে নিয়ে নজরুল সুকৌশল বর্ণনায় এবং শব্দাদির সুনিপুণ প্রয়োগে একটি পরম উপভোগ্য শিশুতোষ কবিতা রচনা করেছেন।
‘গদাই এর পদবৃদ্ধি’ একটি হাস্যরসের কবিতা। এখানে গদাই এর পদবৃদ্ধি অফিসে নয় বরং ঘরে।
গদাই এর যখন দু’পা ছিল অর্থাৎ বিয়ের পূর্বে তখন যে এখানে সেখানে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতো। বিয়ের পর হ’ল চার পা, এরপর যখন বাচ্চা হল তখন ক্রমেই ছয় পা হতে আট পায়ে পরিণত হল এবং তখন যে একটি কেন্নোয় পরিণত হল তার গতি হল মন্থর। কবিতাটির শেষাংশ উল্লেখযোগ্য,
মানুষ থেকে চার পেয়ে জীব, শেষ ছ’ পেয়ে মাছি,
তারপর আটপেয়ে পিঁপড়ে, গদাই বলে গেছি!
কেন্নোর প্রায় গদাই
ছুঁলেই এখন জড়সড় জবড়জঙ সদাই।
‘মোবারকবাদ’ ১৯৪৫ খৃষ্টাব্দে প্রকাশিত হয়। ‘নতুন চাঁদ’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। এটি একটি আদর্শবাদী কবিতা। তিনি এতে ‘মুকুলের মহফিল’ এর সভ্যদের উদ্দেশ্যে উদ্বোধনী হিসেবে কিছু মূল্যবান নীতিমূলক উপদেশ দেন।
নজরুল গোলামীর বিরুদ্ধে; হীনমন্যতার বিরুদ্ধে ছোটদের মন্ত্র শিখিয়েছেন এ কবিতায়,
গোলামীর চেয়ে শহীদী দর্জা অনেক উর্দ্ধে জেনো;
চাপরাশির ঐ তক্মার চেয়ে তলোয়ার বড় মেনো।
আার কাছে কখনো চেয়োনা ক্ষুদ্র জিনিস কিছু
আল্লাহ ছাড়া কারও কাছে কভু শির করিও না নিচু!
বয়স্কের অপূর্ণ কাজ পূর্ণ করার আহ্বান জানিয়েছেন কবি শিশুদের। তিনি এর জন্য শুধু আল্লাহর কাছে সাহায্যের হাত পাততে বলেছেনÑ কোন মানুষের কাছে নয়। কেননা,
গোলামের ফুলদানীতে যদি এ মুকুরে ঠাঁই হয়
আল্লাহর কৃপা বঞ্চিত হব, পাব মোরা পরাজয়।
‘অমর কানন’ ১৩৩২ সালে প্রকাশিত ‘ছায়ানট’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। এই কবিতাটি নজরুল ১৯২৫ সালে, বাঁকুড়া জেলার একটি বিদ্যালয়ের ছাত্রীদের জন্য লিখেছিলেন। বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয় অমর নামক এক তরুণের প্রচেষ্টায়। কবিতাটিতে আছে বিদ্যালয়ের পরিবেশ আর ছাত্রদের কাজকর্মের বর্ণনা। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য বাঁকুড়া জেলার গঙ্গাজলে ফঁটি নদী, পাহাড়, বন ও মাঠঘেরা নৈসর্গিক সৌন্দর্যের গ্রামীণ পরিবেশে স্থাপিত অমর কানন বিদ্যালয়ের ছেলেদের উদ্দেশ্যে গানটি রচিত।
অমর কাননের একাংশ,
… দূর প্রান্তর ঘেরা আমাদের বাস,
দুধ-হাসি হেসে হেথা কচি দুব্-ঘাস,
উপরে মায়ের মত চাহিয়া আকাশ
বেনু-বাজা মাঠে হেথা চরে ধেনুগণ ॥
মোরা নিজ হাতে মাটি কাটি, নিজে ধরি হাল,
সদা খুশি-ভরা বুক হেথা হাসি ভরা গাল,
মোরা বাতাস করিগো ভেঙ্গে হরিতকি ডাল,
হেথা শাখায় শাখায় শাখী, গনের মাতন ॥
নজরুল ইসলাম ১৯৩৫ সালের ৩১শে জুলাই স্কুল পাঠোযোগী ‘মক্তব সাহিত্য’, গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। ‘মোনাজাত’, ‘মৌলবি সাহেব’, ‘চাষী’, ‘হজরতের মহানুভবতা’, ‘ঈদের চাঁদ’ কবিতা আলোচ্য গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত করেন।
মোনাজাত
(সুরা-ফাতেহা)
শুরু করিলাম লয়ে নাম আল্লার
করুণা ও দয়া যাঁর অশেষ অপার।
* * *
সকলি বিশ্বের স্বামী আল্লার মহিমা
করুণা কৃপার যাঁর নাই নাই সীমা।
বিচার-দিনের খোদা! কেবল তোমারি
আরাধনা করি আর শক্তি ভিক্ষা করি।
সরল সহজ পথে মোদের চালাও
যাদের বিলাও দয়া সে পথ দেখাও।
যারা অভিশপ্ত পথভ্রষ্ট এ জগতে
চালায়োনা খোদা যেন তাহাদের পথে।
‘সুরা ফাতেহা’ পবিত্র কোরান শরীফের ৩০ নং অধ্যায়ের পদ্যানুবাদ। অত্যন্ত সহজ, সরল ভাষায় অনূদিত বলে নজরুল ইসলাম কবিতাটি আলোচ্য গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। আল্লাহ্র গুণকীর্তন এবং তাঁর কৃপালাভ এ কবিতাটির উপজীব্য। ‘মৌলবী সাহেব’ একটি নীতিবাদী কবিতা। কবিতাটি স্কুলপাঠ্য। মৌলবি সাহেবের গুণকীর্তন ছাড়া বিশেষ কিছু পাওয়া যায় না কবিতাটিতে। কবিতাটির প্রথম ও শেষাংশ,
ওয়ালেদেরই মতন বুজুর্গ
মক্তবের ঐ মৌলবি সাহেব
তাই – উহারে কেতাবে কয়
“হজরত রসুলের নায়েব।”
* * *
শিক্ষা দিয়ে দীক্ষা দিয়ে
ঢাকেন মোদের সকল আয়েব
পাক কদমে সালাম জানাই
নবীর নায়েব মৌলবি সাহেব।
কবিতাটি প্রসাদগুণে অসচ্ছল।
‘চাষী’ কবিতাতে কবি চাষীকে সম্মান করতে বলেছেন। কেননা চাষীরা মেহ্নতের ফসল না পেলে আমরা ক্ষুধায় অন্ন পেতাম না,
চাষীকে কেও চাষা বলে
করিও না ঘৃণা,
বাঁচতাম না আমরা কেহ
ঐ সে কৃষাণ বিনা।
রৌদ্রে পুড়ে ও বৃষ্টিতে ভিজে সে আমাদের ক্ষুধার অন্ন জোগায়, বিনিময়ে সে যশখ্যাতি কিছুই চায় না। এটিও প্রসাদগুণে অসচ্ছল এবং বিদ্যালয়ের পাঠ ছাড়া তেমন মুল্য নেই।
‘হজরতের মহানুভবতা’ হজরতের গুণকীর্তনমূলক রচনা। আলোচ্য কবিতায় কবি অত্যন্ত সহজ সরল ভাষায় তাঁর মহানুভবতা প্রকাশ করেছেন। একদা হজরতের ঘরে ভিক্ষার ঝুলি হাতে ভিক্ষুক এসেছে ভিক্ষা করতে। হজরতের নিজের ঘরেই কিছু নেই জেনে লজ্জিত ভিক্ষুক যখন ফিরে যাচ্ছিলেন তখন হঠাৎ তিনি আবার তাঁকে ডেকে বললেন,
ভুলিয়া গেছিনু, ফিরে এস তুমি, আছে আছে কিছু ঘরে,
উসমান কিছু দুধ পাঠায়েছে হাসান হোসেন তরে।
তাই এনে দিই, তুমি কর পান।
হজরত নিজে অভুক্ত এবং তাঁর নাতীদ্বয় হাসান হোসেনের মুখ হতে দুধের বাটি তুলে যখন ভিখারীর হাতে দেন ; তখন তাঁর এই ত্যাগ ও মহানুভবতায় বিশ্বমানবতা হতবাক হ’য়ে পড়ে।
হজরতের চরিত্র রূপায়নের মাধ্যমে নজরুল শিশু মনে ত্যাগ ও মহানুভবতার মহান চিত্র অংকন করেছেন। স্কুলেপাঠ্য হওয়ায় কবিতাটির ভাব ও ভাষা সরল ও স্বচ্ছন্দ।
‘ঈদের চাঁদ’ নজরুলের স্কুল পাঠ্য শিশুতোষ কবিতা। শিশুদের উদ্দেশ্যেই রচনা করেছেন বলে এর ভাব, ভাষা, ছন্দ অত্যন্ত সহজ ও সরল।
একমাস সিয়াম সাধনার পর ঈদের চাঁদ সব মুসলমানের জীবনেই আনন্দের বার্তা বয়ে নিয়ে আসে,
রমজানেরই রোজার শেষে
উঠেছে আজ ঈদের চাঁদ
চারদিকে আজ খুশির তুফান
নাই ভাবনা নাই বিষাদ।
শিশুমনে আল্লাহ্ এবং রাসুলের প্রতি একগ্রতা জাগ্রত করেছেন কবিতাটিতে।
নজরুল-শিশু-কাব্য সাহিত্য ঘুমপাড়ানী গান এবং শুধু শুষ্ক নীতিবিদ্যা না শুনিয়ে শিশুকে বাস্তবের দ্বন্দ্ব-সংঘাতের সাথে পরিচয় করিয়েছেন। ফলে তাঁর রচিত কিছু সংখ্যক শিশু কবিতা ক্লাসিক্সের মর্যাদা পেয়েছে।
তিনি শিশুপোযোগী বিষয়বস্তু উপস্থাপন করেছেন। শব্দচয়নে সাহিত্যের রস পরিবেশন করেছেন।
তাঁর জাগরণমূলক কবিতাতে শুধু ভোরবেলার জাগরণই নয়। এই জাগরণ আত্মার জাগরণ শিশুর ন্যায় সংগত অধিকারসমূহ আদায়ের জন্য চিত্তের জাগরণ।
নজরুল তাঁর অসাধারণ কল্পনাশক্তির বলে খুব সাধারণ জিনিসকে অসাধারণ মর্যাদা এনে দিয়েছেন। সুরসিক বিশ্লেষণী পর্যবেক্ষণে আর মন্তব্যে কিছু কবিতা হাস্যকর হয়ে উঠেছে, তা কেবল তাঁর অসাধারণ কল্পনাশক্তির বলেই সম্ভব হয়েছে। বক্তব্য এখানে সিরিয়াস হলেও, আদর্শবাদী কবিতার ক্ষেত্রে রচনাভঙ্গি বলিষ্ঠতর এবং আদর্শ ঋজুরেখ ও স্পষ্টবাক্।
কবিতা রচনার মূল কথা হল কবিতার কাব্যিক সৌন্দর্য ও ছন্দের ঝংকার। এক্ষেত্রে তাঁর সৌন্দর্যসৃষ্টিমূলক কবিতা কাব্যিক লাবণ্যে ঝলমল, তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিশুতোষ কীর্তি। নায়কের আংগিক ত্রুটি আর উদ্ভট আচরণ এবং নজরুলের নিজস্ব গড়া কিছু শব্দ দিয়ে নজরুল যে, হাস্যরসের সৃষ্টি করেছেন তা শিশু কাব্য সাহিত্যে তাঁর আগে কেউ পরিবেশন করেননি। নজরুলের এসব ছন্দিত রচনা লিখেছিলেন শিশু কিশোরদের প্রেরণা দানের জন্য; কিছু আবার আনন্দ দানের উদ্দেশ্যে।
নজরুল কিশোরসুলভ অনুসন্ধিৎসা নিয়ে যে সমস্ত কবিতা লিখেছেন তাতে কল্পলোকের বিস্তার ঘটিয়েছেন। শিশুর কল্পনাশক্তি ও চিন্তার জগৎকে বহুলাংশে বাড়িয়ে দিয়েছেন। অভিযানমূলক কবিতায় শিশুকে দুঃসাহসী করেছেন নিজের দেশকে ও বিশ্বকে জানবার অভিপ্রায়ে। দার্শনিক তত্ত্বের কবিতাগুলিতে শিশুকে দেখেছেন নতুন প্রভাতের ও শক্তির প্রতীকরূপে। হাস্যরসের কবিতার বর্ণনা বাস্তবমুখী ও চমকপ্রদ।
‘মক্তব সাহিত্য’ স্কুলপাঠ্য হওয়াতে এর ভাষা সহজ ও সরল। ছাত্রদের চারিত্রিক গঠনের উদ্দেশ্য এখানে তিনি নীতিশিক্ষার অবতারণা করেছেন এবং নীতিকে যথাসম্ভব আনন্দের সাথে পরিবেশন করেছেন। কিছু কবিতা বিষয়ের দিক হতে সাময়িক হলেও সুখপাঠ্য হয়েছে।
শিশুকাব্য রচনার ক্ষেত্রে নজরুলের সৃষ্টি প্রয়াস নিতান্তই স্বল্প। কিন্তু বিষয়ের বৈচিত্র্যে ও কাব্যগুণে প্রসাদে এই স্বল্প সৃষ্টি প্রয়াস বাংলা শিশুকাব্য সাহিত্যে ভিন্নতর ও স্থায়ী স্বাদ এনে দিয়েছে।
পাদটীকা
১-৭ আতোয়ার রহমান, ‘নজরুল বর্ণালী’, প্রকাশকাল ফাল্গুন, ১৪০০। প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ, সহকারী পরিচালক, নজরুল ইন্সটিটিউট।
৮ সুকুমার রায়, ‘খাই খাই’ কাব্যগ্রন্থ, প্রকাশকাল : ২১শে সেপ্টেম্বর, ১৯৫০। প্রকাশক সিগনেট প্রেস, ১০/২ এলিগেন রোড, কলকাতা।
৯-১০ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ‘শিশু’ কাব্যগ্রন্থ। ১৩১০ সালে প্রকাশিত। মোহিতচন্দ্র সেন সম্পাদিত।
১১ আতোয়ার রহমান, ‘নজরুল বর্ণালী’, প্রকাশকাল ফাল্গুন, ১৪০০। প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ, সহকারী পরিচালক, নজরুল ইন্সটিটিউট।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
নজরুলের শিশুতোষ গান
শিশুতোষ গান রচনার ক্ষেত্রে নজরুলের উদ্যোগ প্রায় ছিল না বলা চলে। তবু দুই-চারটি গান ‘প্রজাপতি’, ‘ঘুমপাড়ানী গান’, ‘লাল নটের ক্ষেত্রে লাল টুক্টুকে বউ’, ‘ত্রিভুবনের প্রিয় মোহাম্মদ’ শিশুদের উদ্দেশ্যেই রচিত। গানগুলি নজরুল রচনাবলীর ‘গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত কবিতা ও গান’-এর অন্তর্ভুক্ত।
প্রজাপতি গানটি দেশী সুরে, দেশী ভাব অনুষঙ্গে রচিত- ‘প্রজাপতি’ গানে প্রজাপতির মত রঙিন পাখা শিশুও চায়। তার টুকটুকে লাল, নীল, আঁকা-বাঁকা পাখা পাওয়ার জন্য আজকের শিশু উদগ্রীব,
প্রজাপতি! প্রজাপতি! কোথায় পেলে ভাই!
এমন রঙিন পাখা!
টুকটুকে লাল নীল ঝিলিমিলি আঁকা বাঁকা
কোথায় পেলে এমন রঙিন পাখা।
প্রজাপতির বন্ধু হয়ে সে ফুলের মধু খেতে চায় অর্থাৎ বস্তুজগতের স্বাদ নিতে চায়। প্রজাপতির পরাগ মাখা শিশুও প্রত্যাশা করে, তার মন পড়াশুনা করর জন্যে পাঠশালাতে যেতে চায় না। কেবলই প্রজাপতির সাথে ঘুরে ঘুরে উড়তে চায়। প্রজাপতি যেভাবে হাওয়ায় নেচে নেচে আনন্দ পায় সেও তাই প্রত্যাশা করে। সাদামাটা জামা তার ভাল লাগে না। প্রজাপতির মত রঙিন জামা তার পছন্দ।
শিশুর জগৎ বর্ণালী। শিশুর পাঠশালা পড়াশুনা একঘেঁয়েমি ও বিরক্তিকর মনে হয়, সে ঘুরে ঘুরে রঙিন পৃথিবীকে জানতে চায়, দেখতে চায়। এর বস্তু জগতের স্বাদ নিতে চায়। গানটি ধ্বনি-প্রতিধ্বনি, দৃষ্টিভঙ্গি, শব্দ, আবহ সমন্বয়ে এক অপূর্ব সৃষ্টি।
নাম শুনে বোঝা যায় ‘ঘুম পাড়ানী গান’ শিশুকে ঘুম পাড়ানোর ছড়া। শিশুর ঘুম আসছেনা । দুষ্টু ছেলেরা সহজে ঘুমুতে চায় না। কিন্তু ছেলে না ঘুমানো পর্যন্ত মায়ের স্বস্তি নেই। শিশুকে ঘুম পাড়ানোর জন্য মা ঘুম পাড়ানী মাসি পিসিকে ডাকছেন। মাসি পিসিরা শিশুর আপনজন হয়ে থাকেÑ তাই মা শিশুকে একা ঘুম পাড়াতে না পেরে তাঁদের ডাকছেন এবং ঘুম পাড়ানীকে নানা রকম প্রলোভন দেখিয়ে ছড়াটি শেষ করেছেন। ছড়াটির কিছু অংশ নি¤েœ উদ্ধৃত হল,
ঘুম পাড়ানী মাসি পিসি ঘুম দিয়ে যেয়ো
বাটা ভরে পান দেবো গাল ভরে খেয়ো
ঘুম আয়রে, ঘুম আয় ঘুম।
আলোচ্য ছড়াগানটিতে দেশী সুরে, দৃষ্টিভঙ্গিতে, আবহে বাঙালীর দৈনন্দিন জীবনযাত্রার ছবি তুলে ধরেছেন।
‘লাল নটের ক্ষেতে লাল টুকটুকে বউ’ সহজেই পথিকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে,
লাল নটের ক্ষেতে লাল টুকটুকে বৌ যায় গো
(তার) আলতা পায়ের চিহ্ন একে নাল্তা শাকের গায় (গো)
লাল নটের ক্ষেতে মৌমাছি ওঠে মেতে
তার রূপের আঁচে পায়ের তলায় মাটি ওঠে তেতে।
লাল পুঁইয়ের লতা নুয়ে পড়ে জড়িয়ে ধরে পায় গো ॥
নালতা শাক, মৌমাছি, লাল পুঁই সবাই তার সখ্যতা কামনা করে। রাখাল ছেলেকে দেখে লজ্জায় তার পা জড়িয়ে যায়। গানটিতে গ্রাম্যসুর ঝংকৃত হয়েছে।
গানটির প্রধান চরিত্রধারণকারী কোন শিশু নয় তথাপি এর দৃশ্যপট এর বর্ণময় চিত্র ও নৃত্যময় ছন্দ শিশুমনকে সমভাবে বয়স্ককেও আকর্ষিত করে। গানটি দেশী সুরে, দেশী ঢঙে ও দেশী আবহে রচিত।
‘ত্রিভুবনের প্রি মোহাম্মদ’ গানটি যৌত ভোগের। এটি আরবী সুরের অনুসরণে লিখিত। মোহাম্মদ (দ:) এর আগমনে আকাশ বাতাসকে দেখবার আহ্বান ধ্বনিত হয়েছে,
ত্রিভুবনের প্রিয় মোহাম্মদ
এল রে দুনিয়ায়।
আয়রে সাগর আকাশ বাতাস, দেখবি যদি আয় ॥
বেহ্শেত ও পৃথিবীতে আজ খুশীর ঢল নেমেছে। সে ইসলামের বাণী নিয়ে এসেছে,
দেখ্ আমিনা মায়ের কোলে
দোলে শিশু ইসলাম দোলে,
কচি মুখে শাহাদতের বাণী সে শোনায় ॥
দুনিয়াতে আজ হতে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা হল। জীন পরী ফেরেশতা সবাই আজ- ‘সাল্লাললাহু আলায়হি অ-সাল্লাম’ পড়ছে। গানটির সুর, তাল, লয় পাঠককে আচ্ছন্ন করে।
নজরুলের ‘ওরে হুলোরে তুই’, ‘শুকনো পাতার নূপুর পায়ে’, ‘চম্কে চম্কে ধীর ভীরু পায়’ গানগুলি ১৩৪১ সালের বৈশাখ মাসে প্রকাশিত ‘গীতি শতদল’ গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। নজরুলের যৌথ ভোগের ব্যঙাত্মক ‘ওরে হুলোরে তুই’ একটি উৎকৃষ্ট গান। গানখানিতে সন্ত্রাসবাদী কোনো শেতাঙ্গ পুলিশ কর্মকর্তার প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে বলে মনে হয়। কবিতাটির প্রথম এবং শেষ অংশ,
ওরে হুলোরে তুই রাত বিরেতে ঢুকিসনে হেঁসেলে।
কবে বেঘোরে প্রাণ হারাবি বুঝিসনে রাস্কেল ॥
স্বীকার করি শিকারী তুই গোঁফ দেখেই চিনি,
গাছে কাঁঠাল ঝুলতে দেখে দিস গোঁফে তুই তেল।
ওরে ছোঁচা ওরে ওঁচা বাড়ী বাড়ী তুই হাঁড়ি খাস
নাদনার বাড়ী খেয়ে কোনদিন ধনে প্রাণে মারা যাস,
বৌষি যখন মাছ কোটেরে, তুমি খোঁজ দাও
বিড়াল-তপস্বী, আড়নয়নে থালার পানে চাও॥
তুই উত্তম-মাধ্যম খাস এত তবু হল না আক্কেল ॥
একে নিছক কৌতুকের গান বলেও ধরে নেয়া চলে। সেক্ষেত্রে নজরুল ইসলাম শিশু মনস্তত্ত্ব বোঝেন। এখানে তিনি বিড়ালের স্বভাব সম্বন্ধে শিশুদের অবহিত করেছেন। বিড়াল শিশুর প্রিয় প্রাণী। কম বেশী সবশিশুই বিড়ালকে কোলের কাছে নিয়ে আদর করতে পছন্দ করে। তাই এত কিছুর পরও বিড়ালের আক্কেল হয় না কেন এ নিয়ে তার মনে বড়ই কষ্ট।
নিছক আনন্দ দানের কিছু গান শিশু ও বয়স্ক উভয়কেই আমোদিত করে। আর একটি গান ‘শুকনো পাতার নূপুর পায়ে’ গানটি আরবি সুরের অনুসরণে লিখিত। গানটি সংক্ষিপ্ত আকারে উদ্ধৃত হল,
শুকনো পাতার নূপুর পায়ে
নাচিছে ঘূর্ণী বায়।
জল-তরংগে ঝিল্মিল্ ঝিল্মিল্
ঢেউ তুলে সে যায় ॥….
ইরানী বালিকা যেন মরু চারিনী
পল্লীর প্রান্তর-বন-মনোহারিনী
ছুটে আসে সহসা গৈরিক-বরনী
বালুকার উড়ৃনী গায়।
নজরুল খুব সাধারণ জিনিসকে অসাধারণ মর্যাদা দিয়েছেন। এ গানটি তার আরেকটি প্রমাণ। খুব সাধারণ মরা পাতা, ফুলকলি, বনফুল, বালুকা দিয়ে ইরানী বালিকাকে গহনার যে সাজ পরিয়েচেন তা যে কোন দামী গহনাকে হার মানিয়েছে। এর চঞ্চলতা, এর উদ্দামতা পল্লীর প্রান্তরকে যে সৌন্দর্য এনে দিয়েছে তা শুধু শিশুমনকে নয়, যে কোন বয়স্ক মনকেও আন্দোলিত করে।
আরেকটি গান ‘চমকে চমকে ধীর ভীরু পায়’ যৌথ ভোগের। এ গানটিও আরবী সুরের অনুসরণে রচিত,
চম্কে চম্কে ধীর ভীরু পায়
পল্লীর বালিকা বন-পথে যায়
একেলা বন-পথে যায়॥
শাড়ী তার কাঁটা লতায়
জড়িয়ে জড়িয়ে যায়,
পাগল হাওয়াতে অঞ্চল লয়ে মাতে
যেন তার তনু পরশ চায়
একলো বন-পথে যায় ॥
পল্লী মেয়েটির ধীর মন্থর গতি, তার শাড়ির আঁচল, তাঁর তনুর পরশ পেয়ে বনপথ ধন্য। তার নূপুরের ঝুমুর শব্দে কুসুমও ঝরে পড়তে চায়। তার কবরীতে পাখি গান গায়। তার নীল চোখ দেখে হরিণী লুকিয়ে পড়ে, মাধবীলতা তার হাতের কাঁকন হতে চায়। ভ্রমরা তার কালত্ব প্রমাণ করতে না পেরে তার চুলের মধ্যে লুকিয়ে পড়ে। এখানেও প্রকৃতির সাথে পল্লী বালিকার একাত্মতা উভয়ের মনকে আন্দোলিত করে।
আলোচ্য গানটি ১৩৪১ সালের আশ্বিন মাসে প্রকাশিত ‘গানের মালা’ গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। মিশরীয় নৃত্যের সুরের অনুসরণে যৌথ ভোগের গান ‘মোমের পুতুল মমীর দেশের মেয়ে’। গানটির কিছু অংশ,
মোমের পুতুল মমীর দেশের মেয়ে
নেচে যায়।
বিহ্বল চঞ্চল পায়॥
সাহারা মরুর পারে
খর্জুর বীথির ধারে
বাজায় ঘুমুর ঝুমুর ঝুমুর মধুর ঝংকারে
উড়িয়ে ওড়না “লু” হাওয়ায়
পরী নাচনী নেচে যায়
দুলে দুলে দূরে সুদূর ॥
মিশরের বালিকাকে কবি মোমের সংগে তুলনা করেছেন। তার নৃত্যচপল ছন্দ মরুভূমির ‘লু হাওয়ার’ রুক্ষতাকেও সজীবতা ও প্রাণচাঞ্চল্যে ভরে তুলেছে। ‘লু হাওয়া’য় তার উড়ন্ত ওড়না তাকে পরীর সৌন্দর্য এনে দিয়েছে। প্রকৃতি তার সৌন্দর্যের আভরণ মেয়েটিকে পরাতে পেরেছে বলে সে নিজেকে ধন্য মনে করছে।
আলোচ্য গানটি ১৩৩৯ এর ভাদ্র মাসে প্রকাশিত ‘জুলফিকার’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। ইসলামী ভাবাদর্শে রচিত ‘তোরা দেখা যা আমিনা মায়ের কোলে’ যৌথ ভোগের আরেকটি গান,
তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে।
মধু পূর্ণিমারই সেথা চাঁদও দোলে॥
যেন ঊষার কোলে রাঙা রবি দোলে ॥
‘এক আল্লাহ্ ছাড়া কোন মাবুদ নাই’ এই গানে রসুলের সেই বাণী নজরুল আমাদের শুনিয়েছেন। হযরত মোহাম্মদ (দ:) এর আগমনে পৃথিবী আলোকে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে। তিনি মানুষের মধ্যে ধনী গরীবের বিভেদ দূর করেছেন ও বিশ্বমানবতার মুক্তির গান শুনিয়েছেন।
এই গানটি সুর, তাল, লয় এক অপূর্ব ব্যঞ্জনার সৃষ্টি করেছে।
নজরুলের ‘পুতুলের পিয়ে’ নাট্যগ্রন্থ ১৩৪০ সালে প্রকাশিত হয়। আলোচিত গানগুলি এই গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন নাটিকা, কথোপকথন জাতীয় রচনা ও সংলাপ হয়ে গান ধরে। খুব নির্ঝঞ্জাট পরিবেশে তারা পুতুল খেলতে বসে,
খেলি আয় পুতুল খেলা
বয়ে যায় খেলার বেলা সই।
বাবা ঐ যান আপিসে ভাব্না কিসের
খোকারা দোলায় ঘুমায় ঐ ॥
সন্তান কানা খোঁড়া ল্যাংড়া যাই হোক না কেন মায়ের চোখে সব সন্তানই সমান। পুতুলের বিয়েতে ছড়াগানের মাধ্যমে নজরুল মাতৃ¯েœহের সেই অমোঘ সত্যটি তুলে ধরেছেন,
ধন্ ধন্ ধন্ ধন্ মুরলি
এই ধন্কে দেখতে নারে কোন বেরালি!
ওকে কে বলে রে খ্যাঁদা,
তার চোখে লাগুক ধাঁধাঁ
খ্যাঁদা কি বলতে দেবো?
সোনা দিয়ে নাক বাঁধিয়ে দেবো ॥
ছড়াগানটির আঞ্চলিক সুর ও শব্দের প্রয়োগ লক্ষণীয়।
পুতুলের বিয়ের সম্বন্ধে পাকা হওয়ার পর তারা ছড়াগান ধরে পুতুলকে নাচায়,
পুঁটু নাচে কোন খানে
শতদলের মাঝখানে।
সেথায় পুঁটু কি করে,
ডুব গালি গালি মাছ ধরে।
মাছ ধরে আর ফুল পাড়ে
কুঁজোজালি দিয়ে মাছ ধরে ॥
মাছ ধরে আর ফুল পাড়ে
কুঁড়োজালি দিয়ে মাছ ধরে ॥
এই ছড়াগানের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি, সুর, শব্দ ও দৃষ্টিভঙ্গি সবই দেশী সুরের ভাব-অনুসঙ্গে গীত।
মাতৃ¯েœহের একটি ধর্ম এই যে সব মা-ই মনে করেন তার সন্তান যেন সুখে থাকে বিয়ের আগে এবং পরেও। সেকথাটিই পুতুলের বিয়ের মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে,
খুকুর দেবো বিয়ে-বেগম মহলে,
খুকু হবে বেগম সাহেব, বাঁদী সকলে।
খুকু হাতে পরবে হীরের বালা
গলায় পরবে মুক্তোর মালা।
সোনার খাটে থাকবে শুয়ে রূপোর মহলে
শতেক বাঁদী বাঁধবে চুল নাইয়ে গোলাব-জলে ॥
এখানেও আঞ্চলিক জীবনযাত্রা এবং সংস্কৃতি সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। ছড়াগানটি দেশী সুরে গীত।
শিশুদের আচার খুব প্রিয় খাবার। বিশেষ করে পুতুল বিয়ের অনুষ্ঠানে আচার না হলে আসর জমার তো কথাই নয়। তার সাথে কিছু দেশী রসালো ফলের সংযোগ আসরকে জমজমাট করে তুলেছে। ছেলে-মেয়েরা ছড়াগানের মাধ্যমে আঞ্চলিক দৃষ্টিভঙ্গি ও সংস্কৃতির পরিচয় তুলে ধরেছে,
কুলের আচার নাচার হয়ে
আছিস কেন শিকায় ঝু’লে
কাঁচের জারে বেচারা তুই
মরিস কেন ফেঁপে ফুলে ॥
কাঁচা তেঁতুল পেয়ারা আম
ডাঁশা জামরুল আর গোলাপ জাম
যেমনি তোরে দেখিলাম
অমনি সব গেলাম ভুলে ॥
কোন মেয়েই স্বামীকে ভাগাভাগি করে নিতে চায় না। মেয়ের মায়েরও কাম্য নয় সতীনের ঘরে তার মেয়ে বিয়ে দিতে। এই প্রসংগে নজরুল আঞ্চলিক ভাষা ও দৃষ্টিভঙ্গিতে সতীন-প্রথা-বিরোধী এক দীর্ঘ ছড়া শুনিয়ে দেন। ছড়াটির প্রথম ও শেষাংশ এখান উদ্ধৃত হল,
আয়না আয়না আয়না
সতীন যেন হয় না।
উদ্বেড়ালি ক্ষুদ খায়
স্বামী রেখে সতীন খায়।
বঁটি বঁটি বঁটি
সতীনের ছেরাদ্দের কুট্নো কুটি
অশথ্ কেটে বস্ত করি!
সতীন কেটে আল্তা পরি ॥
নজরুল ব্যঙাত্মক কবিতা লিখে যেমন শিশু মনে আনন্দ ও কৌতুকের খোরাক জুগিয়েছেন, তেমনি পুতুলের বিয়েতে উদ্ধৃত ছড়া গানটিতে চীনাদের চেহারা নিয়ে ব্যংগ করেছেন,
ঠ্যাং চ্যাগাইয়া প্যাঁচা যায়
যাইতে যাইতে খ্যাচ্খ্যাচায়
প্যাঁচায় গিয়া উঠল গাছ,
কাওয়ারা সব লইল পাছ।
প্যাঁচার ভাইশতা কোলো ব্যাং
কইল, চাচা দাও মোরে ঠ্যাং
প্যাঁচায় কয়, বাপ, বারিত যাও
পাছ লইছে সব হাপের ছাও
ইঁদুর জবাই কইর্যা খায়
বোঁচা নাকে ফ্যাচ্ফ্যাচায় ॥
আঞ্চলিক ভাষা প্রয়োগের সাথে সাথে নজরুল ছড়াটিতে পরিমিত ও পরিশীলিত হাস্যকৌতুক পরিবেশন করেছেন।
স্কুলের মাষ্টারদের নিয়ে নজরুল ব্যঙ্গাত্মক গানটি কমলির দাদার মুখে জুড়ে দিয়েছেন, যার কাজ কেবল হাস্যরস পরিবেশন। আলোচ্য কমিক গানটিতে তিনি হাস্যরত পরিবেশনের সাথে সাথে খুনসুড়িপ্রতিম কথা শুনিয়েছেন,
হেডমাষ্টারের ছড়ি, সেকেন্ড মাষ্টারের দাড়ি
থার্ড মাষ্টারের টেড়ি, কারে দেখি কারে ছাড়ি।
হেড পন্ডিতের টিকির সাথে ওদের যেন আড়ি ॥
পুতুলের বিয়ে শেষ হলে আশীবার্দ পর্যায়ে পুতুল মেয়ের মুখের গানটি বিশ্বপ্রকৃতির আনন্দের বাণী বয়ে নিয়ে এসেছে,
লাল টুক্টুক্ মুখে হাসি, মুখ খানি টুল্ টুল্।
বিনি পানে রং দেখে যা লাল-ঝুটি বুল বুল ॥
দেখতে আমার খুকুর বিয়ে
সূর্যি ওঠেন উদয় দিয়ে,
চাঁদ ওঠে ঐ প্রদীপ নিয়ে
গায় নদী কুলকুল ॥
ছড়া গানটিতে দেশী সুরে ও ঢঙে আঞ্চলিক জীবনযাতা দৃষ্টিভঙ্গি ও সংস্কৃতি প্রতিফলিত হয়েছে।
‘জুজুবুড়ির ভয়’ একাংকিকাতে উল্লিখিত প্রথম ছড়া গানটি খেলার গান। ছেলেমেয়েরা খেলতে খেলতে গানটি গেয়ে থাকে। উদ্ধৃত গানে আঞ্চলিক লোকসংস্কৃতি, দৃষ্টিভঙ্গি ইত্যাদির চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে,
ছেলেকপাটি বৃন্দাবন,
ছেলেকপাটি দাঁতকপাটি
ন্যাড়া মাথায় মারব চাঁটি!
আম পাতা জোড়া জোড়া
মারব চাবুক চড়ব ঘোড়া
হাডু ডুডু ডুডু …..
দ্বিতীয় ছড়া গানটি ঘুম পাড়ানী গান। নিশুতি দুপুরে ঝিঙে ফুল, ঝুমকো লতা সবাই আলস্যে ঝিমুচ্ছে। মায়ের ইচ্ছা খোকার চোখেও যেন পরী ঘুম দিয়ে যায়। এখানেও লোকসংস্কৃতি জীবনযাত্রা ইত্যাদির প্রতিফলন ঘটেছে। এখানে গীতিকার একটি ব্যঞ্জনাময় আবহাওয়া সৃষ্টি করেছেন। কবিতায় শেষ চারটি লাইন উল্লেখযোগ্য,
টুল্টুল্ ঝিঙে ফুল ঝিমায়,
ঝুমকো লতায় ঝিঁ ঝিঁ আলসে ঘুমায়।
খোকনের চোখে দেয় ঘুম পরী চুম।
ঘুম আয় ঘুম ॥
‘নবার নামতা পাঠ’ – এ উদ্ধৃত ছড়া গানটি নামতায় প্রয়োজনীয় শব্দ, তাল, লয় ও ছন্দ মিলিয়ে একটি উৎকৃষ্ট শিশুতোষ রচনা পরিবেশন করেছেন,
একেক্ কে এক-
বাবা কোথায়, দেখ!
দুয়েককে দুই-
নেই ক? একটু শুই!
তিনেক্কে তিন-
উ হু হু! গেছি আলপিন!
পরের ছড়া গানটিতে নজরুল শিশুকে বাস্তব জীবনের দ্বন্দ্বসংঘাতের সাথে পরিচয় করিয়েছেন এবং এর থেকে পরিত্রাণের উপায়স্বরূপ যে পরিকল্পনার আশ্রয় নিয়েছেন তাতে শিশুর কল্পনার জগৎ বিস্তারিত হয়েছে ও মানসিক বিকাশ সাধিত হয়েছে,
আমি যদি বাবা হতুম, বাবা হত খোকা,
না হলে তার নাম্তা পড়া
মারতাম মাথায় টোকা ॥
‘কানামাছি’ একাংকিকাতে তাল গাছকে উদ্দেশ্য করে যে গানটি রয়েছে তার সংগে কানামাছি খেলাটির কোন সম্পর্ক নাই- শুধু দুরন্ত ছেলের পায়ে আঘাত পাওয়া ছাড়া। এখানে তাল গাছের উদ্দেশ্যে একটি ব্যঙাত্মক গান গাওয়া হয়েছে, যা হাসিরও খোরাক জোগায়,
ঝাঁকড়া চুলো তাল গাছ, তুই দাঁড়িয়ে কেন ভাই?
আমার মতন পড়া কি তোর মুখস্থ হয় নাই ॥
তুই দাঁড়িয়ে কেন ভাই?
আমার মতন একপায়ে ভাই
দাঁড়িয়ে আছিস কান ধরে ঠায়
একটুখানি ঘুমোয় না তোর
পন্ডিত মশাই ॥
তুই দাঁড়িয়ে কেন ভাই?
নজরুলের ‘তাল গাছ’ স্থবির, অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথের ‘তাল গাছ’ -এ জড়বস্তুর মধ্যে গতির আভাস পাওয়া যায়,
তালগাছ একপায়ে দাঁড়িয়ে
সব গাছ ছাড়িয়ে
উঁকি মারে আকাশে।
মনে সাধ, কালো মেঘ ফুঁড়ে যায়
একেবারে উড়ে যায়;
কোথা পাবে পাখা সে?
‘ছিনিমিনি খেলা’ একাংকিকাতে নজরুল যে ছড়াগানটি রচনা করেছেন তা’ অত্যন্ত বাস্তব জীবনমুখী।
প্রতিকূলতার সাথে সংগ্রামের একটি নিখুঁত চিত্র প্রয়োজনীয় শব্দ ও ছন্দ সংযোগে সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন,
ও ভাই কোলা ব্যাং, ও ভাই কোলা ব্যাং!
সর্দি তোমার হয় না বুঝি, ও ভাই কোলা ব্যাং।
সারাটা দিন জল ঘেঁটে যাও ছড়িয়ে দুটি ঠ্যাং।
ও ভাই কোলা ব্যাং ॥
নিছক আনন্দ দানের উদ্দেশ্যে নজরুল শিশুদের জন্য যে গুটিকতক গান লিখেছেন রচনা হিসেবে তা যেমন ছন্দিত তেমনি সুখপাঠ্য। দেশী ও বিদেশী সুরের অনুসরণে নজরুল যে সমস্ত গান লিখেছেন সেখানে শব্দ, ছন্দ ও সংগীতের অপূর্ব সুন্দর সার্থক সমাহার ঘটিয়েছেন। খুব অবহেলিত রুক্ষ খর্জুর বৃক্ষ, সাহারা মরুর, বালুকার উড়–নী ইত্যাদি জিনিসকে তিনি যে পেলবতা দিয়েছেন বাংলা গানের ক্ষেত্রে তা দুর্লভ সামগ্রী। এই সমস্ত গানকে তিনি শব্দ সংগীত ও ছন্দাঘাতে অনবদ্য করে তুলেছেন। খুব সাধারণ পুঁইপাতা, নটেশাক, লাল লংকার মত জিনিসকে চিত্রকল্পের মাধ্যমে অসাধারণ করে তুলেছেন। নজরুল শিশুদের তালপ্রবণ ও ছন্দপ্রিয় মনটিকে জানতেন বলেই এমন গান লিখতে পেরেছেন।
লোকসঙ্গীতের বিভিন্ন গানের মাধ্যমে আমরা পাই লোকায়ত নজরুলকে। এক্ষেত্রে আক্ষরিক অর্থেই আর এক নতুন পরিচয়ে আবির্ভূত। লোকসঙ্গীতের বিভিন্ন শাখায় তাঁর সফল পদচারণা আমাদের রীতিমত বিস্মিত করে। শিশুতোষ ছড়া গানগুলিতে আঞ্চলিক ভাষা অত্যন্ত মিষ্টিসুরে ঝংকৃত হয়েছে। এই সব ছড়াগানে আঞ্চলিক জীবনযাত্রার চিত্র অত্যন্ত সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। এতে বিয়ের নানা রকম গানে তাদের লোকসংস্কৃত, আঞ্চলিকভাষা, দৃষ্টিভঙ্গি ইত্যাদি প্রতিফলিত হয়েছে।
নজরুলের হাসির গানের জুড়ি মেলা ভার। নজরুলের গানে আছে নির্মল হাসির প্রবাহ। রাজনৈতিক, ধর্মীয় এবং সামাজিক সমস্যাবলীকে ব্যঙ্গ করে লেখা গানগুলি সমধিক প্রসিদ্ধ। সুরের দিক দিয়ে না হলেও বিষয়ের বৈচিত্র্যে ভরপুর।
বাংলা গানের সমৃদ্ধিতে নজরুলের আরেকটি উল্লেখযোগ্য অবদান হল বিদেশী সুর সংগ্রহ। যে কোন ভাষায় গানের আকর্ষণীয় সুর তিনি বাংলা গানে লিখতেন। এতে বাংলা গানের সুরের ভান্ডার সমৃদ্ধ হয়েছে। নজরুলগীতির সুরের মাদকতা বেড়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের অনেকগুলি দেশের বিভিন্ন সুর তিনি সংগ্রহ করেছেন এবং হুবহু সেই সুরের ফ্রেমে বাংলা কথা বসিয়ে দিয়েছেন।
নজরুলের হাতে বাংলা সংগীত যেভাবে সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে ইতিপূর্বে তেমনটি দেখা যায়নি। সুরের এই মৌলিক অবদানের জন্যেই নরুলগীতির ক্রমেই জনপ্রিয়তা লাভ করছে।
যৌথভাবের নজরুলের গানগুলি শিশুদের উদ্দেশ্যে রচিত না হলেও শিশু ও বয়স্ক উভয়েই গানগুলি গেয়ে এবং নেচে আনন্দ পায়। বিভিন্ন প্রকাশ মাধ্যমে এর পুন: পুন: গীত ও নৃত্য এর বহুল জনপ্রিয়তাই প্রমাণ করে।
পাদটিকা
১. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ‘শিশু ভোলানাথ’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। প্রকাশকাল : কার্তিক ১৩৪৯। প্রকাশক : রঞ্জিৎ রায় বিশ্বভারতী। ১০, প্রিটোরিয়া ষ্ট্রীট। কলিকাতা- ১৬।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
নজরুলের শিশুতোষ নাটক
নজরুল ইসলাম ‘পুতুলের বিয়ে’ নাট্যগ্রন্থ ১৩৪০ সালে প্রকাশিত হয়। এতে ‘পুতুলের বিয়ে’ নাটিকা ছাড়াও গদ্যে পদ্যে মেলানো কথোপকথন জাতীয় রচনা, সংলাপসহ আরো আটটি রচনা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এগুলি যথাক্রমে ‘কালো জাম রে ভাই’, ‘জুজুবুড়ীর ভয়’, ‘কে কি হবি বল’, ‘ছিনিমিনি খেলা’, ‘কানামাঝিছ’, ‘নবার নামতা পাঠ’, ‘সাত ভাই চম্পা’ ও ‘শিশু যাদুকর’।
নজরুলের শিশুতোষ রচনাবলীর মধ্যে ‘পুতুলের বিয়ে’ নাটিকা একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন। এটি তাঁর একটি বিশিষ্ট শিশুসাহিত্য। তিনি একজন সফল শিশু সাহিত্যিকের মতোই নাটিকাটির চরিত্রাবলীর সাথে মিশে গেছেন। তিনি কেবল ‘চির শিশু চির কিশোর’ই নন, তাঁর মধ্যে আছে এক বিদ্রোহী, সংস্কারক আর হাসি গানের মানুষও। ‘পুতুলের বিয়ে’তে আমরা তাঁর এই মিশ্রিত রূপ পাই একই আধারে।
বিভিন্ন দেশের পুতুলের বিয়েকে কেন্দ্র করে ‘পুতুলের বিয়ে’র কাহিনী নির্মিত হয়েছে। এ বিয়ের নির্ণায়ক কম্লি, টুলি, খেঁদি আর বেগম নামের ছোট ছোট পাঁচটি মেয়ে। কমলির দুই ছেলে। একটির নাম ফুচুং। সে দেখতে চীনাদের মতো। তাই কেউ তার সংগে মেয়ের বিয়ে দিতে রাজী নয়। আরেকটি দেখতে রাজপুতের মতো তার নাম ডালিম কুমার। তাকে জামাই করতে সব মা-ই উৎসুক। এই নিয়ে ঝগড়া বেধে যায়। অনেক চেষ্টায় কম্লি ফুচুংয়ের জন্য বেগমের জাপানী মেয়ে বেছে নেয়। ডালিম কুমারের জন্য বেছে নেয় মেম কনে। পুরুত ডেকে বিয়ে সেরে ফেলা হয়। সবাই মিলে বর কনেকে আশীর্বাদ করে। সংক্ষিপ্তভাবে এই হচ্ছে ‘পুতুলের বিয়ে’র কাহিনী।
এছাড়াও নাটিকাটিতে আরো কয়েকটি চরিত্র আছে। কম্লির দাদা যার কাজ হল বিয়ের ভোজ খাওয়া ও সবাইকে হাসানো। যিনি বিয়ের মন্ত্র পড়ালেন সেই পুরুত ঠাকুর যিনি কথায় ধর্ম গেল, জাত গেল বলে চিৎকার করেন- তিনি একান্তভাবেই রক্ষণশীলতার প্রতীক। এ ছাড়াও রয়েছেন কম্লির ঠাকুরমা, যিনি একই দলের অন্তর্ভুক্ত।
নাটিকাটি বিশ্লেষণ করলে আমরা নি¤œলিখিত বিষয়গুলো এর অন্তর্ভুক্ত দেখতে পাই। (১) সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি (২) বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতি (৩) আঞ্চলিক সম্প্রীতি স্থাপন (৪) বিশ্বভ্রাতৃত্ব তথা সর্বমানবের একজাতিত্ববোধের আভাস। এছাড়া আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রসংগের অবতারণা রয়েছে যা থেকে নজরুলের প্রগতিশীল মনের পরিচয় পাওয়া যায়।
নজরুল সাম্প্রদায়িক বিরোধে সবসময় গভীর বেদনা বোধ করেছেন। তিনি ছিলেন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির একজন বিশিষ্ট সমর্থক। ‘পুতুলের বিয়ে’তে তাঁর এই মনোভাবের পরিচয় অত্যন্ত স্পষ্টভাবে ধরা পড়েছে। কম্লির চীনা ছেলের সংগে বেগমের জাপানী মেয়ে গেইশার বিয়ে প্রসংগে যখন কম্লিকে বলে, “আচ্ছা ভাই, মুসলমানের পুতুলের সাথে তোর পুতুলের বিয়া হবে কি করে”। তখন সবই এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়। কম্লি ও টুলির ভাষায়,
কম্লি। না ভাই ও কথা বলিসনে। বাবা বলেছেন, হিন্দু মুসলমান সব সমান। অন্য ধর্মের কাউকে ঘৃণা করলে ভগবান অসন্তুষ্ট হন। ওদের আল্লাও যা, আমাদের ভগবানও তা। ….
টুলি। সত্যি ভাই, এক দেশে জন্ম, এক মায়ের সন্তান। অন্য ধর্ম বলে কিতাকে ঘেন্না করতে হবে?
কম্লি ও টুলি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির একখানা গানও গেয়ে ফেলে। গানের প্রথম দুটি লাইন,
মোরা এক বৃন্তে দু’টি ফুল হিন্দু মুসলমান।
মুসলিম তার নয়ন-মণি, হিন্দু তাহার প্রাণ ॥
এরপর সবাই একদেশী পুতুলের সাথে ভিনদেশী পুতুলের বিয়ে নীরবে মেনে নেয়।
‘পুতুলের বিয়ে’তে নজরুল আঞ্চলিক সম্প্রীতির ভাবটিরও অবতারণা করেছেন। নাটকের দুটি চরিত্র খেঁদি আর পঞ্চি যথাক্রমে বাঁকুড়া ও ময়মনসিংহের বাসিন্দা। তারা যে যার আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে। আমরা সাধারণত: অন্যের মুখে আঞ্চলিক ভাষা শুনে কৌতুক বোধ ও অনেক সময় বিদ্রƒপও করি। কিন্তু এই নাটিকাটিতে শুধু একবার খেঁদি ‘বাঁক্ড়ি’ সম্বোধিত হওয়া ছাড়া আর কোথাও ঠাট্টা উপহাসের কথা উচ্চারিত হয়নি। তারা খেলার সঙ্গিনীদের মতই আঞ্চলিক ভাষা বৈচিত্র্যকেও সহজভাবেই মেনে নেয়।
নজরুল নাটিকাটিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রীতির সম্পর্কটি সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন। হিন্দু মেয়ে কম্লির ছেলে ডালিম কুমার ‘সায়েব’ আর ফুচুং চীনা এবং মুসলমান বেগমের মেয়ে গেইশা জাপানী। ফুচুং ডালিম কুমার গেইশার বিয়ের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক আন্তঃসাম্প্রদায়িক সম্পর্ক স্থাপন করেছেন। এখানে পরিবেশগত কোন সংস্কার প্রভাব ফেলতে পারেনি। এভাবে নজরুল মানুষের মন থেকে ভেদাভেদের সব ভাবনা উড়িয়ে দিয়েছেন।
‘পুতুলের বিয়ে’র অন্যতম বড়ো বৈশিষ্ট্য, এতে বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতির কিছু পরিচয় আছে। পাঁচটি ছোট ছোট মা তাদের পুতুল ছেলেমেয়েদের বিয়ে দেবার অভিপ্রায়ে কখনো আদর করে ছড়া কাটে, কখনো বিয়ের গান গায়। এই সব ছড়া আর গানের ধ্বনি প্রতিধ্বনি, তাদের আঞ্চলিক ভাষা, দৃষ্টিভঙ্গি সংস্কৃতি ইত্যাদির অনেক টুকরো পরিচয় নাটিকাটিতে ছড়িয়ে আছে। আঞ্চলিক লোকসংস্কৃতির পরিচায়ক হিসেবে এগুলি যথেষ্ট মূল্যবান। উদ্ধৃত গানটি এ প্রসংগে উল্লেখযোগ্য,
শাদী মোবারকবাদ শাদী মোবারক
দেয় মোবারক বাদ আলম্ রসুলে পাক আল্লাহ হক
আজ এ দুল্হিনে মিলে
মিলন হল প্রাণে প্রাণে
মাশুক আর আশক।
ময়মনসিংহের মেয়ে পঞ্চির মুখের ছড়াটি অত্যন্ত মিষ্টি সুরে ঝংকৃত হয়েছে। আঞ্চলিক জীবনযাত্রার আভাসও এতে পাওয়া যায়। ছড়াটি বিয়ের কনের উদ্দেশ্যে আশীর্বাদ জ্ঞাপনের,
চুল মেলবা সোনার খাডে,
নাইবা ধুইবা পদ্মার ঘাডে।
ভাত খাইবা সোনার থালে,
বেন্নন খাইবা রূপার বাডিতে।
নাটকটিতে নজরুল পুরুষের একাধিক বিয়ের বিরুদ্ধেও কথা বলেছেন। ডালিম কুমারের সাথে বেগম ও টুলির মেয়ের প্রস্তাব টুলি মেনে নেয় না। বলে ‘আমার মেয়ে সতীন নিয়ে ঘর করবে? আমি বেঁচে থাকতে নয়।’
পর্দাপ্রথার ঘোর বিরোধিতা করেছেন নজরুল। বেগমের বাবা কম্লির আট বছরের মেয়েকে পর্দার ভেতর বিবি করে রাখার পক্ষপাতি, কিন্তু কম্লির এতে ঘোর আপত্তি।
কম্লি। মা গো মা! কি হবে! অসৈরণ সইতে নারি। আট বছরের মেয়ে আবার বিবি হবে!
বেগম। মা গো মা
আমি বিবি হব না।
আম কুড়াবো জাম কুড়াবো, কুড়াবো শুকনা পাতা,
সোয়ামী করবে লাঙল চাষ, আমি ধরব ছাতা।
উৎপাদনক্রীয়ায় স্বামী-স্ক্রীর সম্মিলিত প্রচেষ্টায় উৎসাহদানেরও উদাহরণ পাওয়া যায় এতে।
শুধু গুরু গম্ভীর পরিবেশ ও চিন্তাশীল ধ্যানধারণাই নয়, নাটকটিতে তিনি হাস্যরসও পরিবেশন করেছেন। কম্লির দাদা মনি নাটকের একটি বিশিষ্ট চরিত্র। সে বয়সে কিশোর, তার ভূমিকা অল্প সময়ের জন্য, তার কাজ শুধু হাস্যরস পরিবেশন করা। সে কখনো উদ্ভট রান্নার ফর্মূলা বাৎলায়, কখনো খুনসুড়িপ্রতিম কথা বলে, কখনো আজব বিষয়ের গান গেয়ে বিয়ের আসর মাতিয়ে রাখে। উক্ত আসরে তার একখানি কমিক গান,
হেড মাস্টারের ছড়ি, সেকেন্ড মাস্টারের দাড়ি
থার্ড মাস্টারের টেড়ি, কারে দেখি কারে ছাড়ি।
হেড পন্ডিতের টিকির সাথে তাদের যেন আড়ি ॥
‘পুতুলের বিয়ে’ নাটিকার চরিত্রগুলি শিশুর, কিন্তু তাদের ভূমিকা বা সংলাপে কোন অকারণ ছেলেমানুষি নেই। নাটকটি রচনা করতে যেয়ে তিনি কোথাও গুরুগম্ভীর ভাবের অবতারণা করেছেন, কোথাও হাস্যরস পরিবেশন করেছেন, কোথাও চিন্তাশীল মতামত ব্যক্ত করেছেন। নাটিকাটির ঘটনা, স্বাভাবিক গতি ও স্বচ্ছন্দ সংলাপ ইত্যাদির মাধ্যমে প্রগতিশীল মতামত ব্যক্ত করেছেন।
‘কালো জাম রে ভাই’ একটি হালকা রসের নাটিকা কবিতায় লিখিত। বিভিন্ন ঋতুর দেশী ফলের সাথে কালো জামের সম্পর্ক কল্পনা এর উপজীব্য। যেমন কবিতাটির শুরু এই রকম,
কালো জাম রে ভাই
আম কি তোমার ভায়রা ভাই?
লাউ বুঝি তোর দিদিমা
আর কুমড়ো তোর দাদামশাই ॥
কালো জাম নাট্যকারের একটি অত্যন্ত প্রিয় ফল। তাই তিনি নাটিকাটির শেষাংশে এই ফলটির সংগে অন্যান্য ফলের সম্পর্ক নির্ণয় করেছেন। ফলটির প্রতি দুর্বলতা এর শেষাংশে পাওয়া যায়,
নোনা আতা সোনা ভাই তোর
রাঙা দি তোর লাল মাকাল,
ডাব বুঝি তোর পানিÑ পাঁড়ে
ঢিল বুঝি তোর ভাদুরে তাল।
গেছো দাদা, আয় না নেমে
গালে রেখে চুমু খাই ॥
গদ্যে পদ্যে মেশানো ‘জুজুবুড়ির ভয়’ নজরুল ইসলামের একটি একাংকিকা। ‘জুজুবুড়ির ভয়’ এর কাহিনী দুপুর বেলা ছাদে পাঁচটি ছেলেমেয়ের কিৎকিৎ খেলা নিয়ে। এই খেলায় তাদের মায়ের ঘোর আপত্তি। তাঁর মতে, দুপুর বেলা ছেলেদের পড়াশুনা করতে হবে এবং খুকীকে ঘুমাতে হবে। তারা তাঁর কাছে ধরা পড়বার পর যে কৈফিয়ত দেয় তা একদিকে অদ্ভুত হলেও, অন্যদিকে ছেলেদের সাহসিকতার পরিচয় ফুটে উঠেছে। তারা বলেছে ছাদে তারা খেলতে যায়নি বরং জুজুবুড়ি তাড়াতে গিয়েছিল। এই জুজুবুড়ি ছেলেধরা নয়, সে মা-ধরা জুজুবুড়ি। সে সেই সব মাকে শাস্তি দেয় যারা খোকাকে যখন তখন দুধ খাওয়ান, জল ঘাঁটলে বকেন এবং রোদে বেড়াতে না দিয়ে ঘুম পাড়ান। তাদের প্রধান সাক্ষী খুকী। সে বলে,
এরপর হেবো নামের ছেলেটির এবং পুনরায় খুকীর সাক্ষ্যদান। কিন্তু মা কোন সাক্ষ্যে বিশ্বাস করেননি বা শাস্তির উল্লেখে ভয় পাননি। তিনি ছেলেদের বই নিয়ে বসবার হুকুম দিয়ে খুকীকে ঘুম পাড়াতে নিয়ে গেছেন।
নাটিকাটির মধ্যে ছেলেদের অশান্ত ও অস্থির মনের চিত্র ফুটে উঠেছে। মায়ের ¯েœহের অনুশাসন তারা মানতে চায় না। মায়েরা শিশুদেরকে দায়িত্ব ও কর্তব্যের বাঁধনে বাঁধতে চান। কিন্তু দুরন্ত শিশুরা কখনই তা মানতে চায় না।
‘কে কি হবি বল’ একটি হাল্কা রসের একাংকিকা। কবিতায় রচিত বোনের প্রশ্নের জবাবে সাত ভাইয়ের ভবিষ্যৎ জীবনের পরিকল্পনা এ রচনার বক্তব্য বিষয়। প্রথম ভাইয়ের ইচ্ছ সে কাবুলিওয়ালা হবে। মুখভর্তি থাকবে তার চাপদাড়ি। সে মোটা সুদে টাকা ধার দিবে। দ্বিতীয় ভাই পন্ডিত মশাই হবে এবং তাকে দেখে ছেলেদের দল ভয়ে কাঁপবে। তৃতীয় ভাই ফেরিওয়ালা হবে এবং সে পাড়ায় পাড়ায় চানাচুর, ঘুগ্নিদানা ও কুল্ফী বানানোর মজার কল সাথে নিয়ে ঘুরবে। এর পরের ভাইদের ইচ্ছাগুলো ব্যতিক্রমধর্মী বা বিরোধী। চতুর্থ ভাই জজ হয়ে আসামীকে ছ’মাস করে ফাঁসি দিবে। পঞ্চম ভাই জজকে চালান দেওয়া দারোগার কাজ নিতে চায়। ষষ্ঠ ভাই কনষ্টেবল হয়ে দারোগাকে ভোগাতে চায়। সপ্তম ভাই প্রতাপলোভী। সে বাবা মা’র উপর মুরুব্বীগিরি ফলাতে চায়,
আমি হব বাবার বাবা
মা সে আমার ভয়ে
ঘোমটা দিয়ে লুকোবে কোণে
চুনি বিল্লি হয়ে!
বলব বাবায়, ওরে খোকা
শীগ্গীর পাঠশালা চল্।
‘ছিনিমিনি খেলা’ নজরুলের একাংকিকা। এর উপজীব্য কয়েকটি ছেলের পুকুরে খোলামকুচি ছুঁড়ে খেলা নিয়ে। নজরুলের শিশুরা কখনই অলস নয়। সবসময়ে তারা দুরন্তপনায় ব্যস্ত।
একজন বলেÑ ‘আচ্ছা ভাই, মা যে বলে Ñ জল ঘাঁটলে সর্দি হয়, কই ব্যাঙের ত সর্দি হয় না।’ শিশুরা অবাধ স্বাধীনতা পছন্দ করে। তারা কাঁদামাটি পানি নিয়ে খেলতে ভালবাসে। কিন্তু মা বাদ সাধেন। শিশুর মতে, ব্যাঙের মা লক্ষèী কেননা এই ব্যাপারে সন্তানদের প্রতি তাঁর অবাধ স্বাধীনতা রয়েছে।
লক্ষèী মেয়ে মা তোর বুঝি
খেললে বেড়ায় নাকো খুঁজি,
কেই বকে না, মজাসে তাই গাইছ ঘ্যাঙর ঘ্যাং ॥
ব্যাঙের মা যেমন তার জলে ঘুরে বেড়ানোতে আপত্তি করে না, ছেলেগুলির মাও যদি তেমনি লক্ষèী হতেন, তা হলে তারাও ব্যাঙের সাথে জলেই থাকতো।
অন্যদিকে ব্যাঙের কাজ সারাদিন শুধু জল ঘাঁটাই নয়, সে জলদানবের মত বিরাট প্রাণীকে ল্যাং মেরে ফেলতে চায়। এই সাহস শিশুও অর্জন করতে চায়।
‘কানামাছি’ গদ্যে পদ্যে রচিত একটি একাংকিকা। ‘কানামাছি’র উপলক্ষ খেলা। এই খেলাতে যাকে কানামাছি সাব্যস্ত করা হয় তার চোখ পিছন হতে বেঁধে দেয়া হয়। সে অন্যদেরকে ছুঁতে চেষ্টা করে। কাইকে ছুঁয়ে দিলেই সে তখন কানামাছি হয়ে যায়। খেলার শুরুতে নজরুল সুন্দর একটি ছড়া কেটেছেন; যা থেকে এ দেশের সংস্কৃতির সুন্দর চিত্র ফুটে উঠেছে,
আইকম বাইকম তাড়াতাড়ি
যদু মাষ্টার শ্বশুর বাড়ী
রেন্ কম ঝমাঝম
পা পিছলে আলুম দম!
এই খেলাটি খেলবার সময় একটি ছেলে তালগাছে গুঁতো খায়। তখন অন্য একজন স্থবির তালগাছের উদ্দেশ্যে একখানি গান গায়। এখানে নজরুল তালগাছকে পড়া না পারা ছেলের সংগে তুলনা করেছেন। পড়া না পারলে যেভাবে ছেলেরা কানধরে এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকে এবং যে ছেলে পন্ডিত মশাইকে ফাঁকি দিতে চায়।
আলোচ্য একাংকিকাতে নজরুল কানামাছি খেলার বাস্তব চিত্র অংকন করেছেন। ‘নবার নামতা পাঠ’ একটি একাংকিকা। রচনাটি কৌতুকে ভরপুর। নবা নামতা পড়তে বসে গান ধরে, ‘একদা এক হাড়ের গলায় বাঘ ফুটিয়াছিল।’ ফলে তাকে বাবার কাছে ধমক খেতে হয়। এরপর সে এমন নামতা ধরে যার পুরোটাই ফাঁকিবাজিতে ভরা। যার প্রথম দুটি লাইন,
একেক্কে এক-
বাবা কোথায়, দেখ।
এবং শেষ দুটি লাইন-
দশেক্কে দশ-
বাবা আপিস্! ব্যাস!
‘সাত ভাই চম্পা’ শিরোনাম দেখে মনে হয় নজরুল এক শিরোনামে সাতটি সংলাপ লিখবার পরিকল্পনা নিয়েছিলেন, কিন্তু এই রচনাটি আসলে চারটি সংলাপের গুচ্ছ। সংলাপগুলিতে বিভিন্ন ভাইয়ের জীবন পরিকল্পনার কথা বর্ণিত হয়েছে। চরিত্রগুলো গুরুত্বপূর্ণ। সংলাপগুলো যথার্থই রসোত্তীর্ণ। গ্রাম বাংলার কোলে লালিত পালিত লোক-ঐতিহ্যের মানসপুত্র কবি নজরুলের এই কবিতাটি হয়ে উঠেছে তাঁর প্রাণস্পন্দন স্বরূপ।
-প্রথম ভাই-
এটি একটি জাগরণমূলক সংলাপ। এখানে খোকনের ভূমিকা ‘ঘুম জাগানো পাখী’র। সে সবার আগে ঘুম থেকে জাগবে এমনকি সূর্য ওঠার আগেই সে ঘুম থেকে উঠবে এবং সবাইকে ‘ঘুম-ভাঙা-গান’ শোনাবে,
আমি হব সকাল বেলার পাখী
সবার আগে কুসুম-বাগে উঠব আমি ডাকি।
সূয্যি মামা জাগার আগে উঠ্ব আমি জেগে,
শুধু ঘুম থেকে জাগানোই এর রচনার উদ্দেশ্য নয়। ঘুম থেকে জাগানো অর্থ সমস্ত অন্ধ, জরা, ব্যাধিগ্রস্থ ও অলসদের তিনি গতি দিতে চান। তাদেরকে তিনি উদ্যোগী ও কর্মঠ দেখতে চান। জীবনযুদ্ধে জয়ী দেখতে চান। সে নিরলস পরিশ্রমের মধ্যে দিয়ে শান্তি ও মঙ্গল আনবে।
-দ্বিতীয় ভাই-
‘দ্বিতীয় ভাই’য়ের ইচ্ছে রাখাল রাজা হওয়ার। অর্থাৎ মাঠের রাজা হওয়ার। এখানে রাজা হওয়ার ব্যাপারে প্রকৃতি ছাতিম তরু, শাল পাতার মুকুট, বন ফুলের মালা তার সহযোগিতা করবে। কিন্তু তার প্রধান কাজ হবে ‘তার রাজ্য’ শাসন করা। প্রথমেই সে রাজদন্ড তুলে ‘নদী’কে বলবে,
ওগো করদ নদী,
করব শাসন এই মাঠে কর না দিয়ে যাও যদি
এদেশে না ফললে ফসল, না পেলে ঘাস গরু,
না হাসিলে ফুলে-ফলে আমার দেশের তরু
পাহাড় কেটে পাথর এনে রাখব তোমায় বেঁধে,
তোমায় খুঁজে সাগর-মাতা মরবে তোমায় কেঁদে!
এরপর সে ‘মেঘ’ কে বলবেÑ
জল দিয়ে যাও, আমি রাখাল রাজা,
নৈলে বন্ধু থামিয়ে দেবো তোমার মাদল-বাজা!
বজ্র তোমার নেব কেড়ে নিবিয়ে বিজলি বাতি,
রাখব বেঁধে তোমার রাজার ঐরাবতী হাতি!
সবশেষে সে ‘বন’কে বলবেÑ
কানন, শোনো আমার কথা,
ভীর করে সব নীড় বাঁধিলে সকল পাখী হোথা
ঝড়কে বলো, আমার আদেশ-একটি পাখীর নীড়
উড়ায় যদি, ধরে তারে পরাব জিঞ্জীর!
তার সকল দাবীই বস্তুত: কৃষকের দাবী। ফুল-ফল-ফসলের সমৃদ্ধির দাবী।
-তৃতীয় ভাই-
‘তৃতীয় ভাই’য়ের সত্তার সাথে এক হলেও তাদের বক্তব্য আলাদা। এই ভাই হবে দিনের সহচর। সে লাঙল কাঁধে চাষীকে মাঠের দিকে যাওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে,
ওরে রোদ উঠেছে লাঙল কাঁধে ধর!
তোদের ছেলে উঠল জেগে, ঐ বাজে তার বাঁশি,
জাগল দুলাল বনের রাখাল, ওঠরে মাঠের চাষী!
‘তৃতীয় ভাই’ কৃষকের সমৃদ্ধিই চেয়েছে অন্যভাবে,
লিখব সবুজ কাব্য আমি, আমি মাঠের কবি,
উপর হতে করবে আশিস দীপ্ত রাঙা রবি।
ধরায় ডেকে বলব “ওগো শ্যামল বসুন্ধরা,
শস্য দিয়ো আমাদের এবার আঁচল ভরা”॥
কেননা বন্ধ্যাসম এই পৃথিবীকে ফুল-ফল-ফসলে চাষীরাই সমৃদ্ধ করেছে। তাই পৃথিবীর কাছে তার প্রত্যাশা,
খামার ভরে রাখব ফসল গোলায় ভরা ধান,
ক্ষুধায় কাতর ভাইগুলিরে আমি দেবো প্রাণ!
এই পুরানো পৃথিবীকে রাখব চির তাজা,
আমি হব ক্ষুধার মালিক, আমি মাটির রাজা।
‘চতুর্থ ভাই’ হবে সওদাগর। সাতটা সগরে তার আধিপত্য থাকবে। পৃথিবী জুড়ে চলবে তার বেচাকেনা।
আমি সাগড় পাড়ি দেবো, আমি সওদাগর।
সাত সাগরে ভাসবে আমার সপ্ত মধুকর।
আমার ঘাটের সওদা নিয়ে যাব সবার ঘাটে,
চলবে আমার বেচাকেনা বিশ্বজোড়া হাটে।
নজরুলের শিশু বিভিন্ন দেশের মধ্যে বিভেদের দেয়াল ভেঙ্গে দিয়ে অর্থনৈতিক সমতা আনতে চায়। সে সওদাগর হয়ে পৃথিবীর সমস্ত রতœ-রাজি এনে তার দরিদ্র দেশ মাতৃকাকে রাজরাণীর ঐশ্বর্যে ভরে দেবে,
বলব মাকে, “ভয় কি গো মা, বাণিজ্যেতে যাই।
সেই মণি মা দেবো এনে তোর ঘরে যা নাই।
দুঃখিনী তুই, তাইত মা এ দুখ ঘুচাব আজ,
জগৎ জুড়ে সুখ কুড়াব-ঢাকব মা এ লাজ।
এই রচনাটির প্রতিকী ব্যঞ্জনা লক্ষণীয়, ছোটদের মনে বিশ্বচেতনা জাগাবার চমৎকার প্রয়াস।
‘শিশু যাদুকর’ একটি রসোত্তীর্ণ নাটিকা-কবিতায় লিখিত। নবজাতকের প্রতি পিতার বিস্ময় বিমুগ্ধ বাৎসল্য এই কবিতার উপজীব্য। পিতা তাঁর শিশুর আবির্ভাব পথের কথা ভেবে বিস্মিত। সে যাদুকরের রূপ ধরে রূপকথার জগৎ ছেড়ে নেমে এসেছে বাস্তব পৃথিবীতে। সে স্বর্গের সমস্ত সৌন্দর্য নিয়ে এসেছে। পিতা তার রূপে মুগ্ধ। তার কাছে সে কখনো নির্মল আকাশের চাঁদ, কখনো রূপলোক থেকে আগত রূপকথা। তার আগমনে পৃথিবী বসন্তে বা নতুনত্বে ভরে গেছে। কখনো সে অমরার প্রজাপতি, কখনো তারা যুঁই। কখনো বন থেকে পৃথিবীর কোলে নেমে আসা একরাশ চুমু। শিশুর আগমনে ফুলের গন্ধ ও পাখীর গানে ঘর ভরে গেছে। নবজাতকের আগমনে পৃথিবী প্রাণময় প্রাচুর্যে ভরে উঠেছে। তার উদ্দেশ্যে কবির কথা,
…. আমি দিনু হাতে তোর নামের কাঁকন
তোর নামে রহিল রে মোর স্মৃতিটুক্,
তোর মাঝে রহিলাম আমি জাগরূক।
এই রচনাটির সংগে নজরুলের ‘ছায়ানট’ এর ‘চিরশিশু’ কবিতার তুলনা করা যেতে পারে। তবে ‘শিশু যাদুকর’ এর লক্ষ্য পিতার প্রথম সন্তান কিন্তু ‘চিরশিশু’তে পাওয়া যায় প্রথম সন্তানের মৃত্যুর পর জাত দ্বিতীয় সন্তানের কথা। শিশুর আবির্ভাব নিয়ে এখানেও বিস্ময় প্রকাশ করা হয়েছে। এতে নবজাতকের রূপের বর্ণনা নেই। এখানে শিশুধারার কথা এবং প্রথম শিশুর কথা ভেবে কান্নার কথা আছে,
নাম-হারা তুই পথিক শিশু এলি অচিন দেশ পারায়ে,
কোন্ নামের আজ পরলি কাঁকন, বাঁধন-হারার কোন্ কারা এ ॥…
পথ ভোলা তুই এই সে ওরে
ছিলি ওরে এলি ঘরে
বারে বারে নাম হারায়ে ॥…
আজ যে শুধু নিবিড় সুখে
কান্না সায়র উথলে বুকে,
নতুন নাকে ডাকতে তোকে,
ওরে ও কে কণ্ঠ রুখে
উঠছে কেন মন ভারায়ে।
নাটিকাটি বোধ্যতার দিক হতে শিশুদের নাগালের বাইরে রয়ে গেছে।
নজরুল ইসলাম প্রণীত ৩১শে জুলাই ১৯৩৫ সালে প্রকাশিত স্কুল পাঠ্যগ্রন্থ ’মক্তব সাহিত্যে’র অন্তর্ভুক্ত ‘সত্যরক্ষা’ একাঙ্কিকার কাহিনী সংক্ষেপে নি¤œরূপÑ
একদা বাহারায়েনের শাসনকর্তা বিচারে বসেছেন আসামী একজন হত্যাকারী মরুবাসী আরব। বিচারে তার মৃত্যুদন্ড সাব্যস্ত হলে সে তার পিতার গচ্ছিত অর্থ তার ছোট ভাইয়ের হাতে পৌঁছে দেয়ার নিমিত্তে একজন আমানতি নিযুক্ত করার অভিপ্রায়ে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময় চায়, কিন্তু একজন জামিন দরকার। শাসনকর্তার ভাই নোমান জামিন হ’য়ে মহত্ত্বের পরিচয় দেন।
একটু দেরী হলেও আসামী ফিরে এসেছিল এবং পিতার মৃত্যুর অভিযোগকারী যুবকদ্বয় তাকে মাফ করে মহত্ত্বের পরিচয় দিয়েছিল। এদিকে বাদশাহ নোমানও আসামীকে মুক্তি দেন এবং যুবকদ্বয়কে ক্ষতিপূরণ স্বরূপ কিছু দিতে চেয়ে মহত্ত্বের পরিচয় দেন। অন্যদিকে যুবকদ্বয়ও কোন প্রতিদান গ্রহণ না করে মহত্ত্বের চরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেনÑ
আমরা আল্লাহর ওয়াস্তে যা করিয়াছি, জাঁহাপানার নিকট হইতে তাহার প্রতিদান গ্রহণ করা অসম্ভব।
আলোচ্য নাটকের পাত্রগণ সবাই অন্যকে দেয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছেন ও মহত্ত্বের পরিচয় দিয়েছেন।
১৯৯১ সালে নজরুল ইন্সটিটিউট থেকে স্বতন্ত্র গ্রন্থাকারের প্রকাশিত নাটক ‘জাগো সুন্দর চিরকিশোর’। কাল্পনিক অভিযানের কাহিনী নিয়ে তিনি এটি লিখেছেন। বাস্তবের শিশু মহাকাশ পরিভ্রমণ ও সাগর অভিযানে অসমর্থ তাই নজরুল কল্পনার মাধ্যমে শিশুকে মহাকাশ অভিযানে ও সাগর তলদেশে নিয়ে যান। এটি হাসি কৌতুকে ভরপুর এবং আদর্শবাদী এবং প্রথমাংশে প্রাপ্ত ‘সাত ভাই চম্পা’র কবিতাটিতে আদর্শের পরিচয় পাওয়া যায়।
রচনা হিসাবে এটি সংযত ও মার্জিত। এর সংলাপও সুখপাঠ্য। কিছু অংশ এখানে উদ্ধৃত হলÑ
ওংকার Ñ তোর আঁচলে কি রে বেনু? অ! আমার হাফ প্যান্টের পকেট থেকে সব মুক্তো মানিক চুরি করেছিস বুঝি? দে, দে আমার মুক্তো দে!
বেনু Ñ বারে, তোমার ছেঁড়া পকেট গলে ওগুলো আপনা থেকে আমার কাছে এসেছে। আমি চুরি করব! আচ্ছা, ওংকারদা, তোমরা ব্যাটা ছেলে, তোমরা ও নিয়ে কি করবে? এখন ওগুলো আমার কাছে থাক। তোমার বউ এলে মালা গেঁথে উপহার দেবো … …।
নাটক রচনার ক্ষেত্রে নজরুল একজন সফলকাম শিশুনাট্য লেখকের পরিচয় দিয়েছেন। ‘পুতুলের বিয়ে’ নাটিকাটিতে তিনি বিভিন্ন দেশ, ধর্ম বর্ণের পুতুলের বিয়ের মাধ্যমে জাতি-ধর্ম-বর্ণ প্রথা দূর করে শিশু মনকে ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ববোধ আবদ্ধ ও কল্যাণ্যধর্মী করার চেষ্টা করেছেন। বস্তুতঃ শিশুকে উপলক্ষ করে বয়স্কের মনে ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ববোধ আনার চেষ্টা করেছেন।
পুতুলের বিয়ের সংক্ষিপ্ত পরিসরে নজরুল প্রগতিশীল মতামত ব্যক্ত করেছেন। এছাড়াও গুরুগম্ভীর, হাস্যরসপ্রতিম চিন্তাশীল ইত্যাদি নানা ধরনের চরিত্রের রূপায়ণ, নাটকীয় ঘটনাবলীর চমকপ্রদ সমাবেশ এবং অতি স্বাভাবিক গতি মিষ্টি সংলাপ নাটকটিকে উপভোগ্য করে তুলেছে।
অন্যান্য যেসব একাংকিকা ও সংলাপ রচনা করেছেন সেখানে তিনি শুধুই কৌতুক পরিবেশন করেননি, বিভিন্ন লেখার বর্ণনার মাধ্যমে আঞ্চলিক জীবনযাত্রা, দৃষ্টিভঙ্গি ও লোকসংস্কৃতির চিত্র তুলে ধরেছেন ও শিশুকে তার সংগে পরিচয় করিয়েছেনÑ যা শিশুর মানসিক বিকাশ সাধনে যথেষ্ট সহায়ক।
‘সত্যরক্ষা’ নাটকটি শিশুর নৈতিক চরিত্রগঠন তথা বিকাশসাধনে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে।
‘জাগো সুন্দর চিরকিশোর’ নাটিকাটিতে নজরুল শিশু-কিশোরদের কল্পলোকের বিস্তার ঘটিয়েছেন। উপযুক্ত শব্দচয়ন ও বলিষ্ঠ সংলাপে নাটকটি সমৃদ্ধ।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
নজরুলের শিশুতোষ গল্প
নজরুল ইসলাম স্কুলের ছাত্রদের জন্য ১৯৩৫ সালে ‘মক্তব্য সাহিত্য’ নামে একখানি গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। এতে তিনি ‘হযরত মোহাম্মদের উম্মত পরীক্ষা’, ‘পানি’, ‘ঈদের দিনে’, ‘কাবা শরীফ’, ‘কোরআন শরীফ’, ‘উদ্ভিদ’, ‘আল্লাহ্তায়ালা’, ‘গোরু’, ‘পরিচ্ছেদ’, ‘বিড়াল’ গল্প অন্তর্ভুক্ত করেন।
‘হজরত মোহাম্মদের উম্মত পরীক্ষা’ গল্পটিতে আল্লাহ্তায়ালার সর্বদ্রষ্টতা সম্পর্কে শিশুমনকে নিশ্চিত করা হয়েছে। আল্লাহ্ নিরাকার হ’লেও তিনি নির্জন স্থানে আছেন প্রমাণ করতে যেয়ে তিনি একটি গল্পের অবতারনা করেছেন। গল্পটি সংক্ষেপে নি¤œরূপÑ
হজরতের উম্মত হবার অভিপ্রায় জানালে জনৈক ব্যক্তিকে তিনি একটি মুর্গীর বাচ্চা দিয়ে নির্জন স্থানে জবাই করে আনতে বললেন। কিন্তু সেই ব্যক্তি মানুষ না পেলেও সব জায়গাতেই আল্লাহ্র অস্তিত্ব অনুভব করলো। তখন হজরত তাঁকে বললেন, ‘তুমিই আমার উম্মত হইবার উপযুক্ত পাত্র’।
গল্পটি অত্যন্ত বস্তুনিষ্ঠ ও গঠনমূলক। শিশুর মনন বিকাশের উপযোগী।
‘পানি’ কথিকাটিতে নিতান্তই ছোট একটি রচনার মাধ্যমে এর প্রয়োজনীয়তা ও গুণাগুণ সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন। ‘পানি না হইলে আমরা বাঁচিতে পারি না’ Ñ এ তথ্যটি তিনি শিশুদের দিয়েছেন। জলস্থল সম্পর্কে একটি ভৌগলিক জ্ঞানও তিনি শিশুদের দিয়েছেনÑ
নদী পুষ্কুরিনী প্রভৃতির জল-ভাগ তোমরা অনেকে দেখিয়াছ। তাদের অপেক্ষা আরও বৃহৎ জল-ভাগ আছে তাহাকে সমুদ্র বলে। সমুদ্র দুনিয়ার স্থলভাগকে ঘিরিয়া আছে।
বিশুদ্ধ পানির বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে আলোচনা করতে গিয়ে বলেছেনÑ “বিশুদ্ধ পানি বর্ণহীন, গন্ধহীন ও স্বাদহীন।”
দূষিত পানি পান করলে নানারূপ রোগের আক্রমণ হতে পারে। দূষিত পানি বিশুদ্ধ করার উপায় হিসেবে পানি ফুটিয়ে ঠান্ডা করে পানের পরামর্শ দিয়েছেন। রচনাটি তথ্যনিষ্ঠ। বিদ্যালয়ে শিশু পাঠের উপযোগী করে রচনা করেছেন।
‘ঈদের দিনে’ হজরত মোহাম্মদের শিশুপ্রীতি তথা মানবসেবার কাহিনী। কাহিনীটি বহুলপ্রচলিত। এর আবেদন সর্বজনীন এবং চিরস্থায়ী। ঈদের দিনে নামাজের পর যখন সমস্ত বালক-বালিকা আনন্দে মত্ত তখন একটি বালকের নীরব ক্রন্দন হজরতকে বিচলিত করে। তিনি কারণ জানতে চাইলেন এবং জানলেন ছেলেটি পিতৃমাতৃহারা। হজরতের দয়ার হৃদয় অশ্রুসিক্ত হল এবং তিনি বললেন Ñ
আচ্ছা যদি আমি তোমার পিতা হই, আয়েশা তোমার মাতা হন, আর ফাতেমা তোমার বোন হয়, ইহাতে তুমি সুখী হইতে পারিবে?
ঈদের দিনে এক এতিম শিশুকে তিনি আপন সন্তানের মর্যাদা দিয়ে ঈদের আনন্দ দান করেছেন। হজরতের মানবতার এমন সুন্দর চিত্র নজরুল তার শিশুতোষ গল্পে হৃদয়গ্রাহী করে তুলে ধরেছেন। ঈষৎ সংক্ষিপ্ত এবং সম্পাদিত আকারে রচনাটি বাংলাদেশের স্কুলপাঠ্য বইতে পাওয়া যায়।
‘কাবা শরীফ’ রচনামূলক প্রবন্ধ। এটি মুসলমানদের পবিত্র স্থান। এখানে তিনি কাবা শরীফ নির্মাণের ইতিহাস সম্বন্ধে আলোচনা করেছেন Ñ
এখন যে স্থানে কাবা শরীফ অবস্থিত তাহা তখন গভীর জঙ্গলপূর্ণ ছিল। হজরত ইবরাহিম তাঁহার প্রিয় পুত্র হজরত ইসমাইলের মাতা হাজেরা বিবিকে এই স্থানে বনবাস দিয়াছিলেন। নিকটে কোথাও পানি না থাকায় মাতা-পুত্র মৃতপ্রায় হন। খোদার মহিমায় ও পুণ্যশীলা বিবি হাজেরার প্রার্থনার শিশু ইসমাইলের পায়ের আঘাতে সেই স্থানে এক সুপেয় পানি- বিশিষ্ট ঝর্ণার উৎপত্তি হয়। সেই ঝর্ণা আজও ‘আবে জম্জম্’ কূপ নামে বিখ্যাত।
কাবা শরীফের এই ‘আবে জমজমে’র পানি পান করে সমস্ত হাজীরা পবিত্র হন। অত্যন্ত স্বচ্ছন্দ গতিতে কাবা শরীফ নির্মাণের যে ইতিহাস বর্ণনা করা হয়েছে তা স্কুলপাঠ্য ছাত্রদিগকে পরিতৃপ্ত করে।
‘কোরআন শরীফ’ মুসলমানদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ। পবিত্র কোরআন কখন কোথায় এবং কেন নাযিল হয়েছে এই গল্পে তার স্পষ্ট উল্লেখ আছে।
কোরআন শরীফ আমাদের হজরত মোহাম্মদের মারফতে প্রেরিত পবিত্রগ্রন্থ। এই পবিত্র কেতাবে আমাদের ইসলাম ধর্মের সমস্ত অনুশাসন লেখা আছে। জীবরাইল ফেরেশতা আল্লাহের যে বাণী আমাদের হজরতের নিকট বহিয়া আনিতেন, পবিত্র কোরআন তাহারই সংগ্রহ।
কোরআনের অনুশাসন আমরা কেন মেনে চলব এ সম্পর্কে নজরুল বলেছেন –
কোরআন শরীফ পড়িলে হৃদয় মন পবিত্র থাকে, প্রাণে শান্তি পাওয়া যায়। ইহা রোজ পাঠ করিলে দুঃখ মুসিবতের হাত হইতে রক্ষা পাওয়া যায়।
মোট কথা কোরআন শরীফ পাঠে আল্লাহ্র নৈকট্য লাভ হয়Ñ এই সার্বজনীন সত্যটি তিনি তাঁর মুসিবতের হাত হইতে রক্ষা পাওয়া যায়।
‘উদ্ভিদ’ শিক্ষক ও ছাত্রদের মধ্যে কথোপকথন জাতীয় রচনা। শিক্ষক ছাত্রের সঙ্গে গল্পের আকারে বক্তব্য বিষয় তুলে ধরেছেন। স্কুলপাঠ্য এই রচনাটি নজরুল উদ্ভিদ সম্বন্ধে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন। উদ্ভিদের প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে তিনি বলেছেন –
এই উদ্ভিদ আছে বলিয়াই মানুষ, জীবজন্তু প্রভৃতি বাঁচিয়া আছে। উদ্ভিদ কত রকমে আমাদের নিত্য আহার ও বস্ত্র জোগাইতেছে। ধান, কলাই, গম ইত্যাদি শস্য ও নানাবিধ ফল আমরা নিত্য উদ্ভিদ হইতে পাইতেছি। গরু, মহিষ, ছাগল প্রভৃতি আমাদের কত উপকারে লাগে। ইহারাও উদ্ভিদ দ্বারা জীবন ধারণ করিয়া আছে। …
উদ্ভিদ সম্বন্ধে বৈজ্ঞানিক তথ্য দিতে গিয়ে তিনি বলেছেন Ñ
তুমি, আমি ও সমস্ত জীবজন্তু দিবারাত্র নিশ্বাস ছাড়িতেছি ও প্রশ্বাস গ্রহণ করিতেছি। আমরা যে মলমুত্র ত্যাগ করি উহা যেমন দূষিত পদার্থ, তেমনি আমরা যে নিশ্বাস ছাড়ি তাহাও দূষিত পদার্থ। প্রতি মুহুর্তে এই দুনিয়ার সমস্ত জীবজন্তু যে নিশ্বাস ছাড়িতেছে উহা দ্বারা সমস্ত বায়ুমন্ডল দূষিত হইয়া যাইতেছে।…পাতার সাহায্যে ইহারা সূর্যকিরণ ও বাতাস হইতে খাদ্য সংগ্রহ করে আবার শিকড় দিয়াও ইহারা মটির মধ্য হইতে খাদ্য সংগ্রহ করে। ,,,যে সমস্ত বৃক্ষ একবার মাত্র ফলদান করিয়া মরিয়া যায় তাহাদিগকে ঔষধি বলে।
কীটদষ্ট অংশগুলি পরিদৃষ্ট হলে উদ্ভিদ সম্বন্ধে আরো কিছু তথ্য শিশুরা অবহিত হতে পারতো।
‘আল্লাহ্তায়ালা’ গল্পে আল্লাহর একত্ববাদ সম্পর্কে শিশুদেরকে সন্দেহমুক্ত করেছেন। তিনি নিরাকার ও সমস্ত সৃষ্টির মালিক-শিশু মনে এ ধারণা দেবারও চেষ্টা করেছেন-
আল্লাহ্ এক। তিনি লা-শরীক অর্থাৎ তাঁহার কোনো শরীক নাই। তাঁহাকে কেহ পয়দা অর্থাৎ সৃষ্টি করে নাই। এই বিশ্বের যাহা কিছু আকাশ, বাতাস, গ্রহ, তারা, রবি, শশী, জীবজন্তু, তরু-লতা, ফুল-ফল সমস্ত তিনিই সৃজন করিয়াছেন। জীবন, মৃত্যু, সুখ, দু:খ সকলেরই নিয়ন্তা তিনি। তিনি নিরাকার।
আমরা যে তাঁহারই কাছে শক্তি ভিক্ষা করে, একমাত্র তাঁহারই এবাদত করি।
‘গোরু’ রচনাটি প্রাথমিক স্কুল পর্যায়ের উপযুক্ত একটি শিশুপাঠ্য রচনা। গরুর বর্ণনা এবং উপকারিতা অত্যন্ত সহজ ও স্বচ্ছন্দ্য ভাষায় শিশু পাঠ উপযোগী করে রচিত হয়েছে। তিনি গরুর বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে Ñ
সাদা, কাল, ঈষৎ লাল প্রভৃতি নানা বর্ণের গরু দেখিতে পাওয়া যায়। ইহাদের কান দুইটি বড় ও ঘার লম্বা, উহাতে গলকম্বল ঝুলিতে থাকে। লেজটি সরু ও লম্বা, নীচে এক গোছা চুল আছে, ইহা দ্বারা মশামাছি প্রভৃতি তাড়ায়। আমাদের দেশে গরুর সাহায্যে কৃষিকাজ সম্পন্ন করা হইয়া থাকে। ইহা ছাড়া গাড়ি টাকা, ঘানি টানা প্রভৃতি কাজও আমরা গরুর সাহায্যে করিয়া থাকি। গাভীর দুগ্ধই শিশুদের একমাত্র পানীয়।
আলোচ্য কথিকাতে ‘গৃহপালিত জন্তুর মধ্যে গরুর দ্বারা আমরা সর্বাপেক্ষা বেশি উপকার পাইয়া থাকি’Ñ লাইনটি রচনার শুরুতেই হওয়াতে রচনা লিখন পদ্ধতির ধারাবাহিকতা ক্ষুণœ হয়েছে। তা সত্ত্বেও গরু সম্বন্ধে তিনি তথ্য নির্ভর শিশু উপযোগী রচনা লিখেছেন।
‘পরিচ্ছদ’ কথোপকথন জাতীয় রচনা। ছাত্র ও শিক্ষকের মধ্যে এই কথোপকথন। বস্ত্র আমরা কিভাবে পাই, বস্ত্র কত প্রকার এবং বস্ত্রের প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে শিক্ষক ছাত্রের কাছে গল্পের আকারে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেছেন। বস্ত্র কিভাবে পাই ছাত্রের জবাবে শিক্ষক বলছেন,
‘বৃক্ষই আমাদের বস্ত্র দেয়।’
কিন্তু বৃক্ষতো আমাদের সরাসরি বস্ত্র দেয় না। আমরা সুতি বস্ত্র, রেশমি বস্ত্র ও পশমী বস্ত্র যে তিন উপায়ে পেয়ে থাকি তার বর্ণনা দিয়েছেন এভাবেÑ
বিচি হইতে তুলা ছাড়াইয়া পরে পিঁজির চরকা বা টাকু প্রভৃতির সাহায্যে পাকাইয়া সুতা প্রস্তুত হয়। এই সুতা হইতেই আমরা সাধারণত সুতি বস্ত্র পাইয়া থাকি।
রেশমি বস্ত্রÑ
গুটিপোকা নামে একজাতীয় পোকা আছে, উহার শরীর হইতে এক প্রকার রস বাহির হয়, ঐ রসে গুটিপোকা আপনার ঘর প্রস্তুত করিয়া তাহার মধ্যে থাকে …
পশমী বস্ত্রÑ
পশমী কাপড় শীত নিবারণের জন্যই আমরা ব্যবহার করিয়া থাকি। ইহা ছাগল মেষ প্রভৃতির লোক কাটিয়া তাহার দ্বারা বুনা হয়।
বস্ত্র সম্বন্ধে নজরুল শিশুদের প্রয়োজনীয় তথ্য জ্ঞাপন করেছেন। অত্যন্ত স্বচ্ছন্দ ভঙ্গিতে সহজ সরল ভাষায় পরিচ্ছদ সম্বন্ধে শিশুর শিক্ষার উপযুক্ত পাঠ দিয়েছেন।
‘বিড়াল’ কথিকাটিতে তিনি বিড়ালের স্বভাব সম্বন্ধে বলেছেন,
বিড়াল খুব সহজে পোষ মানে। ইহারা মাছ, ভাত, দুধ ইত্যাদি খাইয়া বাঁচিয়া থাকে। দুধ মাছ পাইলে ইহারা আর কিছু চায় না। ইঁদুর ধরিতে ইহারা খুব ভালবাসে। ইহারা গরম স্থানে থাকিতে ভালবাসে বলিয়া বিছানা ও উনানের ধারে শুইয়া থাকে। …
বিড়ালের অনুকরণপ্রিয়তা সম্বন্ধে বলেছেন,
কোন সম্ভ্রান্ত মহিলার একটি বিড়াল ছিল। তিনি যখন লিখিতেন তখন তাঁহার পোষা বিড়ালটি টেবিলের উপর বসিয়া তাঁহার কলমের দিকে চাহিয়া থাকিত, একদিন তিনি লিখিতে লিখিতে অন্যত্র উঠিয়া গিয়াছেন … আসিয়া দেখিলেন যে তাঁহার ‘টমি’ নামে বড় বিড়াল … তাঁহার মত লিখিবার চেষ্টা …।
বিড়ালের উপকারিতা সম্বন্ধে বলেছেন,
ঘরে প্রাচীরের উপর হইতে বিড়ালটি এই ব্যাপারে দেখিতে পাইয়া গৃহিনীর আঁচল ধরিয়া টানাটানি করিতে লাগিল। শেষে তিনি বিরক্ত হইয়া দেখিলেন যে তাঁহার শিশু পুত্রটি খেলা করিতে করিতে জলের টবে পড়িয়াছে। তখন তিনি দৌড়াইয়া গিয়া তাহাকে জল হইতে তুলিলেন। আল্ল্হার কৃপায় সে যাত্রা সন্তানটি রক্ষা পাইল।
নজরুল ইসলাম শিশুসাহিত্যের অন্যান্য শাখা অল্পবিস্তর বিচরণ করলেও ছোটদের জন্যে কোনো গল্পগ্রন্থ প্রকাশ করেননি। তবু শিশুরঞ্জক কথাকার হিসেবে ছাত্রদের জন্য তিনি এই গ্রন্থটি প্রণয়ন করেছেন। সত্যিকার গল্পকারের গুণাবলী তাঁর ছিলো এবং সেই গুণাবলীর কিছু স্বাক্ষর তিনি এ গ্রন্থে রেখে গেছেন। গল্পগুলির ভাষা নিরতিশয় সরল ও স্বচ্ছন্দ, ঢঙে মজলিসী আর সরস। নিতান্তই শিশুতোষ গল্পের ভাষা ও রচনাভঙ্গির অনুরূপ। গল্প পরিবেশনে আঙ্গিকগত দিক থেকেও নজরুল যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। শিশুতোষ গল্প রচনায় মনোযোগী হলে তিনি একজন উঁচুদরের কথাকার হতে পারতেন নিঃসন্দেহে।
উপসংহার
সাহিত্য তার সমকালীন সমাজের মৌলচিত্রকে ধারণ করে যার প্রকাশও ঘটে সাহিত্যের বিচিত্র সব শাখায়। শিশুসাহিত্য যার উল্লেখযোগ্য একটি অধ্যায়। বিশ্বের সকল ভাষার শিশুসাহিত্য একটি বিরাট অধ্যায় জুড়ে রয়েছে। বাঙলা ভাষার শিশুসাহিত্যও সমৃদ্ধ হয়েছে আধুনিককালে সাহিত্যের বিকাশের সহজাত প্রক্রিয়ায়। আমাদের শিশুসাহিত্যের শাখা-প্রশাখায় রয়েছে সামাজিক রূপ। শিশুদের জন্য এযাবৎ রচিত হয়েছে পর্যাপ্ত গল্প, উপন্যাস, কবিতা, ছড়া ও নাটক।
শিশু সমাজের বাইরের কেই নয়Ñ বরং এরাই ভবিষ্যৎ সমাজের অংকুর। সেই আগামী লোকসমাজকে জ্ঞানে কর্মে মহত্ত্বে সর্বাঙ্গীনভাবে গড়িয়া তুলিতে হইলে তাহার জন্য বিপুলভাবেই আয়োজন করা উচিত।১
অনাগত ইতিহাসের নেতৃত্ব যারা গ্রহণ করবে, তাদের মানসিক পুষ্টিসাধন মানুষের প্রথম কর্তব্য :
For it is the very nature of Children to grow, they cannot stand still. They must have changed and activity of both mind and body. Reading which does not stir their imaginations, which does not stretch their minds, not only wastes their time but will not hold the Children permenently.3
শিশুর উপযুক্ত আত্মিক বিকাশ ঘটাতে হলে সাহিত্যের মধ্য দিয়ে তার মনকে প্রসারিত করতে হবে ও কল্পনাশক্তিকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে এবং তাদের চরিত্রে একটি স্থায়ী প্রভাব ফেলবে।
শিশুদের জন্য যিনি লিখবেন তাঁকে প্রথমত: সাহিত্যিক হতে হবে এবং তাঁর হাত হতে যা সৃষ্টি লাভ করবে তার নায়ক-নায়িকা শিশু হতে পারে কিন্তু তাতে নিত্য সাহিত্যের রস সঞ্চিত থাকতে হবে। যথার্থ শিশুসাহিত্য সব বয়সের নর নারীর কাছে সমান রসাস্বাদ এনে দেবে।
এ সম্পর্কে C. L. Lewis বলেছেন :
No book is really worth reading at the age of ten which is not equally (and often farmore) worth reading at the age of fifty.
শিশু মনে হ্যান্স এ্যান্ডারসনের কাহিনী যে রোমাঞ্চ জাগায় বার্ধক্যে তা আরো গভীর আনন্দ বয়ে আনে ও গম্ভীর গভীরতায় মগ্ন হয়। বাংলা সাহিত্যে সুকুমার রায়ের ‘আবোল-তাবোল’ বইখানির লঘুতা ও কৌতুক শিশু একভাবে গ্রহণ করে খুশি হয় কিন্তু বয়স বাড়বার সাথে সাথে এর অন্যবিধ সৌন্দর্য, এর সূক্ষè ব্যাঙের কৌশল কবির স্বাভাবিক কবিত্ব শক্তির স্বরূপটি আবিষ্কৃত হতে থাকে।
এছাড়া শিশুর একটি নৈতিক জগৎ আছে; উচিৎ-অনুচিৎ, সৎ-অসৎ, ভাল-মন্দ সব কিছু সম্পর্কে কতকগুলি সিদ্ধান্ত আছে। অর্থাৎ পরিবার ও পরিবেশ হতে যে ধরনের শিক্ষালাভ সে করে এবং তার মনে যে সমস্ত মূল্যবোধ সৃষ্টি হয়, সেগুলোর আলোকেই সে সবকিছুর বিচার করে নেয়। তাই দুর্বলের উপর সবলের জয় সে পছন্দ করে না; অন্যায়ের প্রতিবিধান না হলে তার মন পীড়িত হয়।
তাহলে শিশুসাহিত্যের জন্য তিনটি মৌলিক বস্তুর প্রয়োজন রয়েছে। প্রথমতঃ শক্তিমান ও সহানুভূতিশীল লেখক, দ্বিতীয়তঃ উৎকৃষ্ট সাহিত্য রস এবং তৃতীয়তঃ চরিত্র গঠনের উপযোগী উপযুক্ত নীতিবিন্যাস।৩
নীতি আবার শুষ্ক উপদেশে পর্যবসিত না করে আনন্দের মোড়কে মুড়ে দেয়াই শিশু সাহিত্যিকের প্রধান কৃতিত্ব।
শিশুতোষ ও কিশোর-উপযোগী সাহিত্য রচনার জন্য প্রয়োজন শিশু ও কিশোর মনস্তস্ত¡বিদের। প্রয়োজন তাদের মনমানসিকতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়া ও গভীরভাবে পরিচিত হওয়া। তাদের আচার-আচরণ, ভাবনা-চিন্তা ও স্বপ্ন-কল্পনার ব্যাপারে অভিজ্ঞতা অর্জন, তাদের ভাষা, কথনভঙ্গি ও অভিব্যক্তি সম্পর্কে প্রত্যক্ষ জ্ঞান, সেই ভাষায় ও ভঙ্গিতে লেখার ক্ষমতা। নজরুল এর সবকিছুই আত্মস্থ করেছিলেন, সহজ ও স্বচ্ছন্দে লেখার ক্ষমতাও তিনি আত্মস্থ করেছিলেন। নজরুল শিশু ও কিশোর মনস্তত্ত্বের সঙ্গে একাত্ম হতে পেরেছেন বলে তাদের সাহিত্য রচনায় অনবদ্যরূপ ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন তাদের ভাবনা, স্বপ্ন ও আকাক্সক্ষা এবং আচার-আচরণ।
ভাষা ও ছন্দের উপর ছিল নজরুলের অপ্রতিহত অধিকার। ছিল অনুপ্রাস ও অন্ত্যমিল সৃষ্টির অপরিসীম ক্ষমতা, উপমা ও চিত্রকল্প রচনার দক্ষতা এক্ষেত্রে নজরুলকে সার্থক শিশুÑকিশোর উপযোগী সাহিত্য রচনায় সহায়তা দিয়েছে। অনেকক্ষেত্রে সামান্য ঘটনা আর বিষয়বস্তুকেও নজরুল নাটকীয় করে তুলেছেন, করেছেন আকর্ষণীয় অনুপ্রেরণা-সঞ্চারী, করে তুলেছেন ব্যঙ্গ-কৌতুক হাস্যরসে ভরপুর। এই অসাধারণ সৃষ্টিক্ষমতার কারণেই তাঁর রচনায় বিধৃত সুখ-দুঃখের অনুভূতি শিশু কিশোর ও বয়স্ক সবার মনকেই সমানভাবে আন্দোলিত করে। নজরুলের শিশুতোষ রচনায় অতি তুচ্ছ ঘটনা ও বিষয় এমনকি এক ধরনের বিষয়হীনতাও যে অনবদ্য এবং আকর্ষণীয় রূপ লাভ করেছে সেও তাঁর ভাষা, ছন্দ ও অন্ত্যমিল প্রয়োগের অসামান্য ক্ষমতার গুণে।
তাঁর অধিকাংশ শিশুতোষ ছড়া ও লোকসাহিত্যের কবিতাগুলি স্বরবৃত্ত ছন্দে রচিত। বাংলা ছন্দের প্রয়োগে তিনি যে নতুনত্ব দেখিয়েছেন, শিশুসাহিত্য তার ব্যতিক্রম নয়।
লোকঐতিহ্যের নিরিখে তাঁর সমগ্র সাহিত্যকর্ম বিশ্লেষণ করে আমরা দেখেছি লোকঐতিহ্যের প্রায় প্রতিটি শাখায় রয়েছে নজরুলের স্বচ্ছন্দ বিচরণ। শিশুতোষ রচনার ক্ষেত্রেও গ্রামীণ জীবনের বর্ণনায়, গ্রামবাংলার নৈসর্গিক সৌন্দর্যের বর্ণনায়, গ্রামীণ জীবনের চালচিত্র যেমন গ্রামীণ সমাজে বিয়ের বর্ণনা, গ্রামীণ মহিলাদের চরিত্র-চিত্রন, গ্রামীণ উপমার ব্যবহার লোকজ উপাদানের সার্থক প্রয়োগ দেখিয়েছেন। ঘুমপাড়ানী গান, পল্লীনৃত্যের গান, গ্রাম্যসংগীত, মেয়েলি লোকসংগীতের সুরে গীতরচনা ব্যাপকভাবে বাংলার আকাশে বাতাসে সেগুলিকে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন নজরুল। সুধী সমাজে অবহেলিত লোকসংগীতকে তিনিই আপন মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
পরিশেষে নজরুল শিশুসাহিত্য পর্যালোচনা করে আমরা দেখেছি তাঁর উল্লেখযোগ্য দু’টি কবিতা ‘প্রভাতী’র ‘ভোর হলো / দোর খোল!’ ও ‘সাত ভাই চম্পা’ রচনার প্রথম কবিতা ‘আমি হব সকাল বেলার পাখি’তে নজরুল শিশুসাহিত্যের মর্মবাণী বিধৃত হয়েছে। কবিতাদ্বয়ে বর্তমান ও ভবিষ্যতের শিশু মনের আশা-আকাক্সক্ষার মূর্ত প্রকাশ ঘটেছে। বস্তুত: শিশু এখানে মানব সমাজে অগ্রদূতের ভূমিকা পালন করেছে।
কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা শিশুসাহিত্যে নবজাগরণের সঞ্চার করেছেন ও সাহিত্যের মাধ্যমে প্রগতিশীল মতামত ব্যক্ত করেছেন। সাহিত্যের প্রচলিত মেজাজকে ভেঙ্গে চুরে নতুন মেজাজ প্রবর্তন ও বুদ্ধির বিকাশ ও চিন্তার মুক্তির ক্ষেত্রে তার সমপর্যায়ের লেখক বাংলাসাহিত্যে দুর্লভ।
নজরুল বাংলাসাহিত্যের একজন সব্যসাচীপ্রতিম লেখকÑ সাহিত্যের সকল ক্ষেত্রেই যাঁর অবাধ বিচরণ। তাঁর শিশুসাহিত্য চর্চা এমনি বিচরণের ফল। সে কারণে তাঁর শিশু সাহিত্য সৃষ্টি যৎসামান্য। কিন্তু এই সামান্য সৃষ্টি নজরুল প্রতিভার স্পর্শে ঋদ্ধ। তাঁর রচনাগুলি ছন্দিত। তিনি এগুলি লিখেছেনÑ শিশুদের প্রেরণা ও আনন্দদানের উদ্দেশ্যে। কিন্তু শুধু শিশুই নয় তাঁর রচিত সাহিত্য শিশু-বয়স্ক উভয়েরই শ্রুতি ও দৃষ্টিকে নন্দিত করে। তিনি সে সর্বতোভাবে সফল হয়েছিলেন তার প্রমাণ আমরা আমাদের জীবনে জাতীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানে বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে পাই। সুতরাং শিশুসাহিত্যের ক্ষেত্রে নজরুলের সৃষ্টি প্রয়াস অল্প হলেও তিনি আধুনিক বাংলা শিশুসাহিত্যের এক বিশিষ্ট স্রষ্টা। নজরুল তাই তাঁর মহাপ্রয়াণের পরেও সমান জনপ্রিয়।
পাদটীকা
১. বাংলা শিশু সাহিত্যের ক্রমবিকাশ, প্রথম প্রকাশ ১৩৮৮, আশা দেবী, এম, এ, ডি, ফিল। পৃ. ৩০২।
২. The Unreluctant Years Lilian. H. Smith, p. 14.
৩. বাংলা শিশু সাহিত্যের ক্রমবিকাশ, প্রথম প্রকাশ ১৩৮৮, আশা দেবী, এম, এ, ডি, ফিল। পৃ. ৩০৭।
পরিশিষ্ট- ১
কাজী নজরুল ইসলাম রচনাপঞ্জি
শিশুতোষ কবিতা
১. অমর কানন : ‘ছায়ানট’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। প্রথম প্রকাশ ‘বিজলী’ পত্রিকা। ১৩৩২ শ্রাবণে ৫ম বর্ষের ৩৩শ সংখ্যক সংখ্যাতে।
২. আবীর : আব্দুল কাদির সম্পাদিত নজরুল রচনাবলীর তৃতীয় খন্ডে প্রকাশিত ‘গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত কবিতা ও গান’- এর অন্তর্ভুক্ত। প্রথম প্রকাশ ১৩৮১ সালের বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ সংখ্যক ‘সওগাত’ পত্রিকায়।
৩. আগা মুর্গী লেকে ভাগা : আব্দুল কাদির সম্পাদিত নজরুল রচনাবলীর তৃতীয় খন্ডে প্রকাশিত ‘গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত কবিতা ও গান’- এর অন্তর্ভুক্ত।
৪. আগুনের ফুল্কি ছুটে : ঐ
৫. আবাহন : ঐ
৬. ঈদের চাঁদ : নজরুল ইসলাম প্রণীত ‘মক্তব সাহিত্য’ গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। প্রকাশকাল ৩১শে জুলাই ১৯৩৫। প্রকাশক খোন্দকার আব্দুল জব্বার। ২৫-এ পঞ্চানন টোলা লেন, কলিকাতা।
৭. এস মধুমেলাতে : আব্দুল কাদির সম্পাদিত নজরুল রচনাবলীর তৃতীয় খন্ডে প্রকাশিত ‘গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত কবিতা ও গান’- এর অন্তর্ভুক্ত।
৮. কিশোর স্বপ্ন : আব্দুল কাদির সম্পাদিত নজরুল রচনাবলীর তৃতীয় খন্ডে প্রকাশিত ‘গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত কবিতা ও গান’- এর অন্তর্ভুক্ত। ১৩৩৪ জ্যৈষ্ঠে ‘বেণু’ পত্রিকায় প্রকাশিত।
৯. কিশোর স্বপ্ন : আব্দুল কাদির সম্পাদিত নজরুল রচনাবলীর তৃতীয় খন্ডে প্রকাশিত ‘গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত কবিতা ও গান’- এর অন্তর্ভুক্ত। ১৩৬৭ মাঘে ‘খেলাঘর’ পত্রিকায় মুদ্রিত।
১০. কোথায় ছিলাম আমি : আব্দুল কাদির সম্পাদিত নজরুল রচনাবলীর তৃতীয় খন্ডে প্রকাশিত ‘গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত কবিতা ও গান’- এর অন্তর্ভুক্ত।
১১. খাঁদু-দাদু : ‘ঝিঙে ফুল’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। ১৩৩৩ সালে প্রকাশিত। প্রকাশক ডি, এম, লাইব্রেরী। ৬১, কর্ণওয়ালিশ স্ট্রীট, কলিকাতা।
১২. খুকি ও কাঠ বেড়ালি : ঐ
১৩. খোকার খুশি : ঐ
১৪. খোকার বুদ্ধি : ‘ঝিঙে ফুল’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। ১৩৩৩ সালে প্রকাশিত। প্রকাশক ডি, এম, লাইব্রেরী। ৬১, কর্ণওয়ালিশ স্ট্রীট, কলিকাতা। ব; মু; সা; পত্রিকায় প্রকাশিত। সাল ১৩২৮ কার্তিক।
১৫. খোকার গপ্প বলা : ‘ঝিঙে ফুল’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। ১৩৩৩ সালে প্রকাশিত। প্রকাশক ডি, এম, লাইব্রেরী। ৬১, কর্ণ ওয়ালিশ স্ট্রীট, কলিকাতা। ব: মু: সা: পত্রিকায় প্রকাশিত। সাল ১৩২৮ কার্তিক।
১৬. গদাই-এর পদবৃদ্ধি : আব্দুল কাদির সম্পাদিত নজরুল রচনাবলীর তৃতীয় খন্ডে প্রকাশিত ‘গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত কবিতা ও গান’- এর অন্তর্ভুক্ত। প্রথম প্রকাশ ১৩৪২ আশ্বিনের ‘মাসিক মোহাম্মদী’তে।
১৭. চলব আমি হাল্কা চালে : আব্দুল কাদির সম্পাদিত নজরুল রচনাবলীর তৃতীয় খন্ডে প্রকাশিত ‘গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত কবিতা ও গান’- এর অন্তর্ভুক্ত। ১৩৩৪ সালের আশ্বিন সংখ্যা ‘মৌচাক’ পত্রিকায় মুদ্রিত হয়।
১৮. চাষী : নজরুল ইসলাম প্রণীত ‘মক্তব সাহিত্য’ গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। প্রকাশকাল ৩১শে জুলাই ১৯৩৫। প্রকাশক খোন্দকার আব্দুল জব্বার, ২৫-এ পঞ্চানন টোলা লেন, কলিকাতা।
১৯. চিঠি : ‘ঝিঙে ফুল’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। ১৩৩৩ সালে প্রকাশিত। প্রকাশক ডি, এম, লাইব্রেরী। ৬১, কর্ণ ওয়ালিশ স্ট্রীট, কলিকাতা। ব: মু: সা: পত্রিকায় প্রকাশিত। সাল ১৩২৮ কার্তিক।
২০. ছোট হিটলার : আব্দুল কাদির সম্পাদিত নজরুল রচনাবলীর তৃতীয় খন্ডে প্রকাশিত ‘গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত কবিতা ও গান’- এর অন্তর্ভুক্ত।
২১. জিজ্ঞাসা : আব্দুল কাদির সম্পাদিত নজরুল রচনাবলীর তৃতীয় খন্ডে প্রকাশিত ‘গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত কবিতা ও গান’- এর অন্তর্ভুক্ত। ‘শিশু মহল’ পত্রিকা। ১৩৩৪ সালের ১ম বর্ষের ১ম সংখ্যা।
২২. ঝিঙে ফুল : ‘ঝিঙে ফুল’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। ১৩৩৩ সালে প্রকাশিত। প্রকাশক ডি, এম, লাইব্রেরী। ৬১, কর্ণ ওয়ালিশ স্ট্রীট, কলিকাতা।
২৩. ঝুম্কো লতায় জোনাকি : আব্দুল কাদির সম্পাদিত নজরুল রচনাবলীর তৃতীয় খন্ডে প্রকাশিত ‘গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত কবিতা ও গান’- এর অন্তর্ভুক্ত।
২৪. ঠ্যাং ফুলী : ‘ঝিঙে ফুল’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। ১৩৩৩ সালে প্রকাশিত। প্রকাশক ডি, এম, লাইব্রেরী। ৬১, কর্ণ ওয়ালিশ স্ট্রীট, কলিকাতা।
২৫. দিরি বে’তে খোকা : ঐ
২৬. নতুন পথিক : আব্দুল কাদির সম্পাদিত নজরুল রচনাবলীর তৃতীয় খন্ডে প্রকাশিত ‘গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত কবিতা ও গান’- এর অন্তর্ভুক্ত। ১৩৩৫ আষাঢ় ‘রাজভোগ’ পত্রিকা।
২৭. নতুন খাবার : ঐ
২৮. পিলে পট্কা : ‘ঝিঙে ফুল’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। প্রকাশকাল ১৩৩৩। প্রকাশক ডি, এম, লাইব্রেরী। ৬১, কর্ণ ওয়ালিশ স্ট্রীট, কলিকাতা।
২৯. প্রভাতী : ‘ঝিঙে ফুল’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। প্রকাশকাল ১৩৩৩। প্রকাশক ডি, এম, লাইব্রেরী। ৬১, কর্ণ ওয়ালিশ স্ট্রীট, কলিকাতা।
৩০. প্রার্থনা : আব্দুল কাদির সম্পাদিত নজরুল রচনাবলীর তৃতীয় খন্ডে প্রকাশিত ‘গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত কবিতা ও গান’- এর অন্তর্ভুক্ত।
৩১. ফ্যাসাদ : ঐ
৩২. বর-প্রার্থনা : ঐ
৩৩. বগ দেখেছ : ঐ
৩৪. মট্কু মাইতি বাঁটকুল রায় : ঐ
৩৫. মা : ‘ঝিঙে ফুল’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। প্রকাশ কাল ১৩৩৩। প্রকাশক ডি, এম, লাইব্রেরী। ৬১, কর্ণ ওয়ালিশ স্ট্রীট, কলিকাতা। ব : মু : সা : পত্রিকায় প্রকাশিত। সাল ১৩২৮ শ্রাবণ।
৩৬. মুকুলের উদ্বোধনী : আব্দুল কাদির সম্পাদিত নজরুল রচনাবলীর তৃতীয় খন্ডে প্রকাশিত ‘গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত কবিতা ও গান’- এর অন্তর্ভুক্ত। প্রথম প্রকাশ ১৩৬১ সালের ভাদ্র মাসে।
৩৭. মাঙ্গলিক : আব্দুল কাদির সম্পাদিত নজরুল রচনাবলীর তৃতীয় খন্ডে প্রকাশিত ‘গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত কবিতা ও গান’- এর অন্তর্ভুক্ত।
৩৮. মায়া-মুকুর : আব্দুল কাদির সম্পাদিত নজরুল রচনাবলীর তৃতীয় খন্ডে প্রকাশিত ‘গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত কবিতা ও গান’- এর অন্তর্ভুক্ত।
৩৯. মা এসেছে : ঐ
৪০. মোবারকবাদ : ‘নতুন চাঁদ’ গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। প্রথম প্রকাশ ১৯৪০ খৃ: ৭ই আগষ্ট। ‘মুকুলের মহফিল’ শিরোনামে ছাপা হয়েছিল।
৪১. মোনাজাত : নজরুল ইসলাম প্রণীত ‘মক্তব সাহিত্য’ গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। প্রকাশকাল ৩১শে জুলাই ১৯৩৫। প্রকাশক খোন্দকার আব্দুল জব্বার। ২৫-এ পঞ্চানন টোলা লেন, কলিকাতা।
৪২. মৌলবী সাহেব : নজরুল ইসলাম প্রণীত ‘মক্তব সাহিত্য’ গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। প্রকাশকাল ৩১শে জুলাই ১৯৩৫। প্রকাশক : খোন্দকার আব্দুল জব্বার। ২৫-এ পঞ্চানন টোলা লেন, কলিকাতা।
৪৩. লাল সালাম : আব্দুল কাদির সম্পাদিত নজরুল রচনাবলীর তৃতীয় খন্ডে প্রকাশিত ‘গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত কবিতা ও গান’- এর অন্তর্ভুক্ত। ১৩৬০ সালে ‘মাহে-নও’ পত্রিকায় ‘একটি অপ্রকাশিত কবিতা’ শিরোনামে প্রকাশিত।
৪৪. লিচু চোর : ‘ঝিঙে ফুল’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। প্রকাশকাল ১৩৩৩। প্রকাশক ডি, এম, লাইব্রেরী। ৬১, কর্ণ ওয়ালিশ স্ট্রীট, কলিকাতা।
৪৫. শিশু সওগাত : আব্দুল কাদির সম্পাদিত নজরুল রচনাবলীর তৃতীয় খন্ডে প্রকাশিত ‘গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত কবিতা ও গান’- এর অন্তর্ভুক্ত। ১৩৬০ সালে ‘মাহে-নও’ পত্রিকায়। ১৩৪৪ মাঘে প্রথম বর্ষের প্রথম সংখ্যক ‘শিশু সওগাত’ পত্রিকায় প্রকাশিত।
৪৬. সংকল্প : আব্দুল কাদির সম্পাদিত নজরন্ডল রচনাবলীর তৃতীয় খন্ডে প্রকাশিত ‘গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত কবিতা ও গান’- এর অন্তর্ভুক্ত। ১৩৬০ সালে ‘মাহে-নও’ পত্রিকায়। এর প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ও পঞ্চম স্তবক ‘দেখব এবার জগৎটাকে’ শিরোনামে বিশ্বভারতী গ্রন্থনা বিভাগ কর্তৃক প্রকাশিত ‘কবিতা সংকলন’ নামক বাংলা দ্রুত পাঠ্যপুস্তকে সংকলিত (অগ্রহায়ণ, ১৩৬৯) হয়েছে।
৪৭. সারস পাখি : আব্দুল কাদির সম্পাদিত নজরুল রচনাবলীর তৃতীয় খন্ডে প্রকাশিত ‘গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত কবিতা ও গান’- এর অন্তর্ভুক্ত। ১৩৬০ সালে ‘মাহে-নও’ পত্রিকায়।
৪৮. হজরতের মহানুভবতা : নজরুল ইসলাম প্রণীত ‘মক্তব সাহিত্য’ গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। প্রকাশকাল ৩১শে জুলাই ১৯৩৫। প্রকাশক খোন্দকার আব্দুল জব্বার, ২৫-এ পঞ্চানন টোলা লেন, কলিকাতা।
৪৯. হোঁদল কুঁৎকুঁতের বিজ্ঞাপন : ‘ঝিঙে ফুল’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। প্রকাশ কাল ১৩৩৩। প্রকাশক ডি, এম, লাইব্রেরী। ৬১, কর্ণ ওয়ালিশ স্ট্রীট, কলিকাতা। ‘অংকুর’ পত্রিকায় প্রকাশিত।
পরিশিষ্ট- ২
সঙ্গীত
১. আয়না আয়না আয়না : ‘পুতুলের বিয়ে’ নাট্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। প্রকাশকাল- ১৩৪০ সাল, প্রকাশক- ডি, এম, লাইব্রেরী, ৬১ কর্ণওয়ালিশ স্ট্রীট, কলিকাতা।
২. আমি যদি বাবা হতুম, বাবা হত খোকা : ঐ
৩. একেক্কে এ্ : ‘পুতুলের বিয়ে’ নাট্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। প্রকাশকাল- ১৩৪৪ অগ্রহায়ণে ‘মোয়াজ্জিন’ পত্রিকা।
৪. ও ভাই কোলা ব্যাঙ : ‘পুতুলের বিয়ে’ নাট্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। প্রকাশকাল- ১৩৪০ সাল, প্রকাশক- ডি, এম, লাইব্রেরী, ৬১ কর্ণওয়ালিশ স্ট্রীট, কলিকাতা।
৫. ওরে হুলোরে তুই রাত বিরেতে : ‘গীতি শতদল’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। ১৩৪১ সালের বৈশাখ মাসে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত। প্রকাশক- ডি, এম, লাইব্রেরী, ৬১ কর্ণওয়ালিশ স্ট্রীট, কলিকাতা।
৬. কুলের আচার নাচার হয়ে : ‘পুতুলের বিয়ে’ নাট্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। প্রকাশকাল- ১৩৪০ সাল, প্রকাশক- ডি, এম, লাইব্রেরী, ৬১ কর্ণওয়ালিশ স্ট্রীট, কলিকাতা।
৭. খেলি আয় পুতুল খেলা : ‘পুতুলের বিয়ে’ নাট্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। প্রকাশকাল- ১৩৪০ সাল, প্রকাশক- ডি, এম, লাইব্রেরী, ৬১ কর্ণওয়ালিশ স্ট্রীট, কলিকাতা।
৮. খুকুর দেবো বিয়ে বেগম মহলে : ঐ
৯. ঘুম পাড়ানী গান : আব্দুল কাদির সম্পাদিত নজরুল রচনাবলীর তৃতীয় খন্ডে প্রকাশিত ‘গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত কবিতা ও গান’- এর অন্তর্ভুক্ত।
১০. চম্কে চম্কে ধীর ভীরু পায় : ‘গীতি শতদল’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। ১৩৪১ সালের বৈশাখ মাসে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত। প্রকাশক- ডি, এম, লাইব্রেরী, ৬১ কর্ণওয়ালিশ স্ট্রীট, কলিকাতা।
১১. ছেলেকপাটি বৃন্দাবন : ‘পুতুলের বিয়ে’ নাট্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। প্রকাশকাল- ১৩৪০ সাল, প্রকাশক- ডি, এম, লাইব্রেরী, ৬১ কর্ণওয়ালিশ স্ট্রীট, কলিকাতা।
১২. ঝাঁকড়া চুলো তালগাছ
তুই দাঁড়িয়ে কেন ভাই : ঐ
১৩. টুলটুল ঝিঙে ফুল ঘুমে ঝিমায় : ঐ
১৪. ঠ্যাং চ্যাগাইয়া প্যাঁচা যায় : ‘পুতুলের বিয়ে’ নাট্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। প্রকাশকাল- ১৩৪০ সাল, প্রকাশক- ডি, এম, লাইব্রেরী, ৬১ কর্ণওয়ালিশ স্ট্রীট, কলিকাতা।
১৫. ত্রিভুবনের প্রিয় মোহাম্মদ : আব্দুল কাদির সম্পাদিত নজররুল রচনাবলীর তৃতীয় খন্ডে প্রকাশিত ‘গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত কবিতা ও গান’- এর অন্তর্ভুক্ত।
১৬. তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে : ‘জুলফিকার’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। এর প্রথম সংস্করণের প্রকাশকাল ১৩৩৯-এর ভাদ্র মাসে। প্রকাশক- বি, দোজা, এম্পায়ার বুক হাউস, ১৫, কলেজ স্কোয়ার, কলিকাতা।
১৭. ধন্ ধন্ ধন্ ধন্ মুরলি : ‘পুতুলের বিয়ে’ নাট্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। প্রকাশকাল- ১৩৪০ সাল, প্রকাশক- ডি, এম, লাইব্রেরী, ৬১ কর্ণওয়ালিশ স্ট্রীট, কলিকাতা।
১৮. পুঁটু নাচে কোন খানে : ঐ
১৯. প্রজাপতি : আব্দুল কাদির সম্পাদিত নজরুল রচনাবলীর তৃতীয় খন্ডে প্রকাশিত ‘গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত কবিতা ও গান’- এর অন্তর্ভুক্ত।
২০. মোমের পুতুল মমীর দেশের মেয়ে : ‘গানের মালা’ গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। এর প্রথম সংস্করণ ১৩৪১ সালের আশ্বিন মাসে প্রকাশিত হয়। প্রকাশকাল- গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় এ্যান্ড সন্স, ২০৩/১/১ কর্ণওয়ালিশ স্ট্রীট, কলিকাতা।
২১. লাল নটের ক্ষেতে লাল টুকটুকে বউ : আব্দুল কাদির সম্পাদিত নজরুল রচনাবলীর তৃতীয় খন্ডে প্রকাশিত ‘গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত কবিতা ও গান’- এর অন্তর্ভুক্ত।
২২. লাল টুক্টুক্ মুখে হাসি মুখখানি টুল্টুল্ : ‘পুতুলের বিয়ে’ নাট্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। প্রকাশকাল- ১৩৪০ সাল, প্রকাশক- ডি, এম, লাইব্রেরী, ৬১ কর্ণওয়ালিশ স্ট্রীট, কলিকাতা।
২৩. শুকনো পাতার নূপুর পায়ে : ‘গীতি শতদল’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। ১৩৪১ সালের বৈশাখ মাসে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত। প্রকাশক- ডি, এম, লাইব্রেরী, ৬১ কর্ণওয়ালিশ স্ট্রীট, কলিকাতা।
২৪. হেডমাষ্টারের ছড়ি, সেকেন্ড মাষ্টারের দাড়ি : ‘পুতুলের বিয়ে’ নাট্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। প্রকাশকাল- ১৩৪০ সাল, প্রকাশক- ডি, এম, লাইব্রেরী, ৬১ কর্ণওয়ালিশ স্ট্রীট, কলিকাতা।
পরিশিষ্ট- ৩
নাটিকা
১. কালো জামরে ভাই : ‘পুতুলের বিয়ে’ নাট্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। প্রকাশকাল- ১৩৪০ সাল, প্রকাশক- ডি, এম, লাইব্রেরী, ৬১ কর্ণওয়ালিশ স্ট্রীট, কলিকাতা।
২. কানামাছি : ঐ
৩. কে কি হবি বল : ঐ
৪. ছিনিমিনি খেলা : ঐ
৫. জাগো সুন্দর চির কিশোর : ১৯৯১ সালে নজরুল ইন্সটিটিউট থেকে স্বতন্ত্র গ্রন্থাকারে প্রকাশিত।
৬. জুজুবুড়ীর ভয় : ‘পুতুলের বিয়ে’ নাট্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। প্রকাশকাল- ১৩৪০ সাল, প্রকাশক- ডি, এম, লাইব্রেরী, ৬১ কর্ণওয়ালিশ স্ট্রীট, কলিকাতা।
৭. নবার নামতা পাঠ : ‘পুতুলের বিয়ে’ নাট্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। প্রকাশকাল- ১৩৪০ সাল, প্রকাশক- ডি, এম, লাইব্রেরী, ৬১ কর্ণওয়ালিশ স্ট্রীট, কলিকাতা।
৮. পুতুলের বিয়ে : ‘পুতুলের বিয়ে’ নাট্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। প্রকাশকাল- ১৩৪০ সাল, প্রকাশক- ডি, এম, লাইব্রেরী, ৬১ কর্ণওয়ালিশ স্ট্রীট, কলিকাতা।
৯. শিশু যাদুকর : ‘পুতুলের বিয়ে’ নাট্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। প্রকাশকাল- ১৩৪০ সাল, প্রকাশক- ডি, এম, লাইব্রেরী, ৬১ কর্ণওয়ালিশ স্ট্রীট, কলিকাতা।
১০. সত্যরক্ষা : নজরুল ইসলাম প্রণীত ‘মক্তব সাহিত্য’ গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। প্রকাশকাল ৩১শে জুলাই ১৩৩৫। প্রকাশক খোন্দকার আবদুল জব্বার, ২৫-এ পঞ্চানন টোলা লেন, কলিকাতা।
১১. সাত ভাই চম্পা : ‘পুতুলের বিয়ে’ নাট্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। প্রকাশকাল- ১৩৪০ সাল, প্রকাশক- ডি, এম, লাইব্রেরী, ৬১ কর্ণওয়ালিশ স্ট্রীট, কলিকাতা।
পরিশিষ্ট- ৪
গল্প
১. আল্লাহ্তায়ালা : নজরুল ইসলাম প্রণীত ‘মক্তব সাহিত্য’ গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। প্রকাশকাল ৩১শে জুলাই ১৩৩৫। প্রকাশক খোন্দকার আবদুল জব্বার, ২৫-এ পঞ্চানন টোলা লেন, কলিকাতা।
২. ঈদের দিনে : ঐ
৩. উদ্ভিদ : ঐ
৪. কাবা শরীফ : ঐ
৫. কোরআন শরীফ : ঐ
৬. গোরু : ঐ
৭. পরিচ্ছদ : ঐ
৮. পানি : ঐ
৯. বিড়াল : ঐ
১০. হযরত মোহাম্মদের উম্মত পরীক্ষা : ঐ
সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি
১. আব্দুল আজিজ আল মামুন : সংগ্রহ ও সম্পাদনা; অপ্রকাশিত নজরুল। প্রথম প্রকাশ- শুক্রবার, ১লা অগ্রহায়ণ, ১৯৩৬, ১৭ নভেম্বর, ১৯৮৯। হরফ প্রকাশনী, এ-১২৬ কলেজ স্ট্রীট মার্কেট, কলিকাতা- ৭০০০০৭।
২. ঐ : নজরুল গীতি (অষন্ড) প্রকাশকাল- ৬ আশ্বিন ১৩৮৫, ২৩শে সেপ্টেম্বর, ১৯৭৮। প্রকাশক- আব্দুল আজিজ আল মামুন এম, এ,। প্রকশনা- হরফ প্রকাশনী, কলিকাতা।
৩. আতোয়ার রহমান : নজরুল বর্ণালী। প্রকাশকাল- ফাল্গুন ১৪০০ সাল। ফেব্রুয়ারী ১৯৯৪। প্রকাশনায়- আবুল কালাম আজাদ, নজরুল ইন্সটিটিউট, ঢাকা।
৪. ঐ : শিশু সাহিত্যে মুসলিম সাধনা। প্রথম প্রকাশ- পৌষ ১৪০০। জানুয়ারী ১৯৯৪। প্রকাশক- সংকলন ফোকলোর বিভাগ, বাংলা একাডেমী, ঢাকা।
৫. আবদুল মান্নান সৈয়দ : নজরুল ইসলাম/কবি ও কবিতা। প্রথম প্রকাশ- ২৯ আগষ্ট ১৯৭৭, ১২ ভাদ্র ১৩৮৮। প্রকাশক- তালিম হোসেন, নজরুল একাডেমী, বেলালাবাদ কলোনী, ঢাকা- ২।
৬. আশা গঙ্গোপাধ্যায় : বাংলা শিশু সাহিত্যের ক্রমবিকাশ। (১৮০০-১৯০০) প্রথম মুদ্রণ- ১৩৮৮। প্রকাশক- শ্রী গোপালদাস মজুমদার। প্রকাশনায়- রূপবানী প্রেস- ৩১, বাদুড়বাগান স্ট্রীট, কলিকাতা- ৯।
৭. এম, এ, মজিদ : ছোটদের কবি নজরুল। প্রথম প্রকাশ- বৈশাখ, ১৩৭৫, এপ্রিল, ১৯৬৮। প্রকাশনায়- এ, এম, সামসুদ্দিন, সিটি লাইব্রেরী, ৩৮/৬, বাংলা বাজার, ঢাকা-১।
৯. করুণাময় গোস্বামী : সম্পাদনা; নজরুলের শিশুতোষ কবিতা। প্রকাশকাল- মাঘ, ১৪০১। ফেব্রুয়ারী, ১৯৯৫। প্রকাশক- রশিদুন নবী। নজরুল ইন্সটিটিউট, ঢাকা।
৯. কালীপদ দাস : ছোটদের নজরুল; প্রথম প্রকাশ ১৯৯১ ইং, প্রকাশনায়- সাহিত্যমালা, ৩৪/২ নর্থব্রুক হল রোড, বাংলাবাজার, ঢাকা।
১০. খগেন্দ্রনাথ মিত্র : শতাব্দীর শিশু সাহিত্য। প্রথম প্রকাশ- সেপ্টেম্বর, ১৯৫৮। প্রকাশক শ্রী মনো মোহন মুখোপাধ্যায়, বিদ্যালয় প্রাইভেট লিমিটেড, কলিকাতা।
১১. ফেরদৌস ইসলাম : ছোটদের নজরুল। প্রথম প্রকাশ- মার্চ, ১৯৯৫। প্রকাশক- মোসলেম উদ্দীন, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ, ঢাকা- ২।
১২. মাহবুবুল আলম : বাংলা ছন্দের রূপরেখা। পঞ্চম সংস্করণ- আগষ্ট, ১৯৮০। প্রকাশক- কে, এম, ফারুক খান, খান ব্রাদার্স এন্ড কোম্পানী, ৬৭ প্যারিদাস রোড, ঢাকা- ১।
১৩. মোবাশ্বের আলী : নজরুল প্রতিভা : প্রথম সংস্করণ- ভাদ্র, ১৩৭৬। প্রকাশক- চিত্তরঞ্জন সাহা, মুক্তধারা [স্ব: পুঁথিঘর লি:] ৭৪, ফরাশগঞ্জ, ঢাকা- ১১০০।
১৪. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান : নজরুল সমীক্ষণ। প্রথম প্রকাশ- ১১ই জ্যৈষ্ঠ ১৩৭৯। প্রকাশক-মোহাম্মদ সুলতান, আনন্দ প্রকাশন, ১১ শ্রীশদাস লেন, বাংলা বাজার, ঢাকা- ১।
১৫. মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন : ‘সওগাত’ যুগে নজরুল ইসলাম। প্রথম প্রকাশ-আষাঢ়, ১৩৯৫। জুন, ১৯৮৮। প্রকাশক- মোহাম্মদ মাহ্ফুজউল্লাহ্। নজরুল ইন্সটিটিউট, ঢাকা।
১৬. মোহাম্মদ মাহ্ফুজউল্লাহ : নজরুল ইসলাম ও আধুনিক বাংলা কবিতা। প্রথম প্রকাশ- ১১ই জ্যৈষ্ঠ, ১৩৭০, মে, ১৯৬৩। প্রকাশনায়- লতিফা বানু। সাহিত্য মঞ্জিল, ৪১, আগা মসিহ্ লেন, ঢাকা- ২।
১৭. হায়াৎ মাহমুদ : নজরুল ইসলাম : কিশোর জীবন। প্রথম প্রকাশ- ফেব্রুয়ারী, ১৯৮৯। প্রতীক প্রকাশনা সংস্থা; ৪৬/২ হেমেন্দ্র দাস রোড, সূত্রাপুর, ঢাকা- ১১০০।
১৮. শাহাবুদ্দীন আহমদ : ছোটদের নজরুল। প্রথম প্রকাশ- সেপ্টেম্বর, ১৯৭৭। প্রকাশক- চিত্তরঞ্জন সাহা, মুক্তধারা (স্ব: পুঁথিঘর লি:) ৭৪, ফরাশগঞ্জ, ঢাকা- ১১০০।
১৯. সেলিম জাহাঙ্গীর : লোকায়ত নজরুল। প্রথম প্রকাশ- আষাঢ়, ১৪০৪। জুন, ১৯৯৭। প্রকাশক- রশিদুন নবী, গবেষণা ও প্রকাশনা বিভাগ, নজরুল ইন্সটিটিউট, ধানমন্ডি, ঢাকা।